৪. ইয়োরোপে যুদ্ধানল
পূর্ববর্তী অধ্যায়ে যেসব ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকেই বুঝতে পারা গেছে, ইয়োরোপে যুদ্ধ আসন্ন হয়ে উঠেছে। এই সময় ইয়োরোপে আন্তর্জাতিক সমস্যাবলী গভীর থেকে গভীরতর হয়েছে, ফলে স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে, ইয়োরোপ দ্রুতগতিতে যুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে। অস্ট্রিয়াকে জার্মান রাইখের অন্তর্ভুক্ত করবার পর জার্মান কর্তৃপক্ষ সুদেতেন-ল্যাণ্ডের ওপরেও দাবি তুলেছে।
যুদ্ধ যে প্রত্যাসন্ন সে কথাটা আরো স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে মিঃ চেম্বারলেন কর্তৃক নাটকীয়ভাবে মিউনিক গমনের ব্যাপারটা লক্ষ্য করে। ওখানে জার্মানী এবং ব্রিটেনের মধ্যে একটা জোড়াতালি দেওয়া সমঝোতা হয় এবং চেকোস্লোভাকিয়ার একটা অংশ বিনাযুদ্ধেই জার্মানীর অধিকারে আসে। এর ফলে যুদ্ধকে ঠেকানো গেছে বলে সাময়িকভাবে একটা ধারণার সৃষ্টি হলেও পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে বুঝতে পারা যায় মিউনিক চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে তো পারেইনি, বরং যুদ্ধকে আরো নিকটবর্তী করেছে। গ্রেটব্রিটেন তখন বাধ্য হয়ে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
ইয়োরোপীয় পরিস্থিতির এইরকম অবনতি দেখে কংগ্রেস মোটেই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারেনি। ১৯৩৯ সনে ত্রিপুরীতে অনুষ্ঠিত অধিবেশনে কংগ্রেস তাই নিম্নলিখিত প্রস্তাব পাস করে:
কংগ্রেস এতদ্বারা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের বৈদেশিক নীতিসঞ্জাত মিউনিক চুক্তি, ইঙ্গ-ইতালীয় চুক্তি এবং স্পেনের বিদ্রোহীদের স্বীকৃতিদানকে ধিক্কার জানাচ্ছে। তাদের এই নীতি গণতন্ত্রের প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা, বারবার প্রতিজ্ঞাভঙ্গ, যৌথভাবে নিরাপত্তামূলক কাজকে নস্যাৎ করা এবং গণতন্ত্রবিরোধী শক্তিসমূহের সঙ্গে আঁতাত করে গণতন্ত্রকে পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করা ছাড়া আর কিছু নয়। তাদের এই ধরনের নীতিহীন নীতির ফলে সমগ্র পৃথিবী আজ এমন এক আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে যে পশুশক্তির বিজয়াভিযান বিনা বাধায় অগ্রসর হয়ে জাতিসমূহের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করছে এবং শক্তির নামে এক ভয়াবহ যুদ্ধের জন্য বিরাটভাবে প্রস্তুতি চালাচ্ছে। মধ্য এবং দক্ষিণপূর্ব ইয়োরোপের আন্তর্জাতিক সদিচ্ছার এমনই অধঃপতন ঘটেছে, বিশ্ববাসী আজ সভয়ে লক্ষ্য করছে, নাৎসী সরকার ইহুদী জাতির বিরুদ্ধে সংগঠিতভাবে অমানুষিক নির্যাতন চালাচ্ছে এবং বিদ্রোহীরা বিভিন্ন শহরের অসামরিক জনসাধারণ ও সহায়সম্বলহীন বাস্তুত্যাগীদের ওপরে নির্মমভাবে আকাশ থেকে বোমাবর্ষণ করে চলেছে।
কংগ্রেস তাই ইংরেজদের এই বৈদেশিক নীতির আওতা থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করে নিচ্ছে, কারণ ইংরেজদের এই নীতি ফ্যাসিস্ট শক্তিগুলোকেই মদত দিচ্ছে এবং গণতান্ত্রিক দেশসমূহকে ধ্বংসের ব্যাপারে তাদের সাহায্য করছে। সাম্রাজ্যবাদের মতো ফ্যাসিবাদেরও কংগ্রেস বিরোধিতা করে। কংগ্রেস আরো মনে করে, বিশ্বের শক্তি ও সমৃদ্ধির জন্য এই দুটি ইজম-এরই শেষ হওয়া দরকার। কংগ্রেসের মতে ভারতের এখন স্বাধীন জাতি হিসেবে তার নিজস্ব বৈদেশিক নীতি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। এবং এই কারণে সাম্রাজ্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদ এই দুই থেকেই তাকে দূরে থাকতে হবে এবং শান্তি ও স্বাধীনতার পথে পদক্ষেপ করতে হবে।
আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে ঝটিকা বিস্তৃত হবার ফলে গান্ধীজীর মনের ওপরেও মেঘের কালো ছায়া ঘনীভূত হয়। বস্তুতপক্ষে এই সময়টায় তিনি প্রচণ্ডভাবে মানসিক অস্থিরতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর এই অস্থিরতা আরো বেড়ে যায় যখন ইয়োরোপ এবং আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি তাঁর কাছে যুদ্ধ থামাবার উদ্দেশ্যে কিছু একটা করার জন্য একের পর এক অনুরোধ এবং আবেদন করতে থাকে। সারা পৃথিবীর শান্তিবাদী মানুষ গান্ধীজীকে তাঁদের স্বাভাবিক নেতা বলে মনে করতেন। এই কারণেই গান্ধীজীর দিকে তাঁরা তাকিয়েছিলেন।
গান্ধীজী এই প্রশ্নটি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন এবং শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিকে উপদেশ দেন, বর্তমান আন্তর্জাতিক অনিশ্চয়তার ফলে ভারতকে এমন অবস্থায়ই তার কর্মপন্থা ঘোষণা করতে হবে। গান্ধীজী বলেন, ভারত কখনো যুদ্ধে অংশ নেবে না, অথবা যুদ্ধপ্রচেষ্টায় কোনোরকম সাহায্য করবে না। এমন কি, এতে যদি ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সুযোগ আসে, তবুও না।
এ ব্যাপারে গান্ধীজীর সঙ্গে আমার মতভেদ ছিলো। আমি মনে করতাম, ইয়োরোপ সুস্পষ্টভাবে দুটি বিপরীতমুখী শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একটি শিবির নাৎসীবাদ এবং ফ্যাসিবাদের পক্ষে, অপরটি গণতন্ত্রের। ভারতবর্ষকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক শিবিরের পক্ষ অবলম্বন করতে হবে। এর জন্য প্রথমেই দরকার স্বাধীনতা। কিন্তু ইংরেজ সরকার যদি ভারতকে স্বাধীনতা দিতে না চায় তাহলে ভারতীয়রা অপরের স্বাধীনতার জন্য কিভাবে যুদ্ধ করবে? নিজেরই যেখানে স্বাধীনতা নেই সেখানে অপরের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করার কোনো অর্থই হয় না। অতএব এ অবস্থায় ভারতের কর্তব্য হবে যুদ্ধের ব্যাপারে ইংরেজ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করা।
অন্যান্য বারের মতো এবারেও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। কোনো কোনো সদস্য তাঁদের মতামত সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করতেই পারেননি। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু এই ব্যাপারে সাধারণভাবে আমার সঙ্গে একমত হলেও কোনো কোনো সদস্য গান্ধীজীর অভিমতকেই আঁকড়ে ধরে রইলেন। তাঁদের বক্তব্য হলো, গান্ধীজীর অভিমতই সঠিক, সুতরাং তাঁর পাশে দাঁড়ানোই হবে উচিত কাজ। তাঁরা হয়তো ভেবেছিলেন, গান্ধীজীকে অনুসরণ করলেই ঈপ্সিত ফললাভ করা যাবে। ওয়ার্কিং কমিটিতে এই ধরনের মতবিরোধের ফলে কমিটি কোনো সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে পারে না।
কংগ্রেস যখন এইভাবে দ্বিধাগ্রস্ত মনোভাব গ্রহণ করেছে ঠিক সেই সময়ই ইয়োরোপে যুদ্ধ ঘোষিত হয়। এবং যুদ্ধ ঘোষিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই ভারতবর্ষে এক বিরাট সমস্যার সৃষ্টি হয়। যুক্তরাজ্য জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ১৯৩৯ সনের ৩রা সেপ্টেম্বর। সঙ্গে সঙ্গে কমনওয়েলথের সদস্যভুক্ত দেশ- গুলোকেও যুদ্ধ ঘোষণা করতে বলে। যুক্তরাজ্যের এই নির্দেশের অব্যবহিত পরেই বিভিন্ন ডোমিনিয়নের পার্লামেন্টের অধিবেশন বসে এবং তারা সবাই যুদ্ধ ঘোষণা করে। ভারতের ক্ষেত্রে কিন্তু ভাইসরয় নিজেই জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এবং এই কাজটি করতে গিয়ে কেন্দ্রীয় আইনসভার মতামত নেবার দরকারও তিনি বোধ করেন না। ভাইসরয়ের এই কাজের ফলে আর একবার নতুন করে প্রমাণিত হয়, ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষকে তাদের হাতের পুতুল বলে মনে করে। আরো প্রমাণিত হয়, ভারতবাসীর মতামতের কোনোরকম তোয়াক্কাই তারা করে না। এমন কি যুদ্ধের মতো একটা গুরুতর ব্যাপারেও তারা ভারতবাসীর মতামতকে আমল দিতে রাজী নয়।
ভারতবর্ষকে যখন এইভাবে স্বৈরতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে ফেলা হলো তখন গান্ধীজীর মানসিক অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। তিনি কিছুতেই ভারতবর্ষকে যুদ্ধরত দেশ হিসেবে মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু গান্ধীজী যাই ভাবুন না কেন, ভাইসরয় তাঁর মতামতের তোয়াক্কা না করেই ভারতবর্ষকে যুদ্ধের ভেতরে টেনে আনলেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে তার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। প্রস্তাবটি গৃহীত হয় ওয়ার্ধায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির এক সভায়। ১৯৩৯ সনের ৮ই সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অধিবেশন চলে। অধিবেশন শেষ হবার মুখে কংগ্রেস তার এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করে। প্রস্তাবে যুদ্ধ সম্পর্কে কংগ্রেসের দৃষ্টিভঙ্গির এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের ভূমিকার কথা সুস্পষ্ট ভাষায় প্রকাশ করে। পাঠকদের অবগতির জন্য প্রস্তাবটির পূর্ণ বয়ান নিচে দেওয়া হলো:
যুদ্ধ ঘোষিত হবার পরে ইয়োরোপে যে গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়টি ওয়ার্কিং কমিটি বিশেষ গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেছে। এক মাস আগেও এ ব্যাপারে ওয়ার্কিং কমিটি তার বক্তব্য ঘোষণা করেছিলো। কমিটি তখন ভারতের ইংরেজ সরকার কর্তৃক ভারতবাসীর মতামতকে উপেক্ষা করায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলো। কমিটি তখন আইনসভার কংগ্রেসী সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলো, তাঁরা যেন আইনসভার পরবর্তী অধিবেশনে অংশগ্রহণ না করেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও ইংরেজ সরকার ভারতবর্ষকে যুদ্ধরত দেশ বলে ঘোষণা করে। তারা অর্ডিন্যান্স জারি করে ভারত শাসন আইনকে সংশোধন করে এবং আরো এমনসব কার্যক্রম গ্রহণ করে যার ফলে ভারতীয়দের মনে গুরুতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শুধু তাই নয়, ভারত সরকারের এই ধরনের অবাঞ্ছিত নীতির ফলে প্রাদেশিক সরকারসমূহের ক্ষমতাও সীমিত করে। এবং এসবই করা হয় ভারতের জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ইংরেজ সরকারের এই ধরনের কার্যাবলী ওয়ার্কিং কমিটি কিছুতেই মেনে নিতে পারে না।
কংগ্রেস বহুবার নাৎসীবাদ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তার বক্তব্য উপস্থাপিত করেছে। নাৎসী আর ফ্যাসিস্টরা জনসাধারণকে তাদের পদতলে দলিত করার এবং সর্ববিধ উপায়ে তাদের দমিত করে রাখবার উদ্দেশ্যে যেভাবে যুদ্ধকে প্রাধান্য দিয়েছে তার বিরুদ্ধেও কংগ্রেস তার মতামত ব্যক্ত করেছে এবং ওদের আগামী কার্যকলাপ ও জনগণের স্বাধীন সত্তাকে অবদমিত করে রাখার মনোবৃত্তিকে ধিক্কৃত করেছে। নাৎসীবাদ এবং ফ্যাসিবাদের মধ্যে কংগ্রেস সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবেরই চরম অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখতে পেয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ভারতের জনসাধারণ বহু বৎসর যাবৎ সংগ্রাম করছে। ওয়ার্কিং কমিটি তাই পোলাণ্ডের বিরুদ্ধে নাৎসী সরকারের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ধিক্কার জানাচ্ছে এবং আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যারা দণ্ডায়মান হয়েছে তাদের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করছে।
কংগ্রেস আজ পুনরায় তার বক্তব্য প্রকাশ করে বলছে, ভারতের নীতি, তা সে যুদ্ধই হোক বা শান্তিই হোক, সে নিজেই স্থির করবে; বহিরাগত কোনো শক্তি এটা তার ওপরে চাপিয়ে দিতে পারবে না। ভারতের সম্পদরাশিও সাম্রাজ্যবাদীদের সুবিধের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। ভারতবাসীর ওপরে চাপিয়ে দেওয়া যে-কোনো সিদ্ধান্তকে এবং ভারতের সম্পদকে ভারতবাসীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ব্যবহার করার যে-কোনো প্রচেষ্টাকে ভারতের জনসাধারণ সর্বউপায়ে বাধা দেবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবসময় মনে রাখতে হবে, জোরজবরদস্তি দ্বারা সহযোগিতা পাওয়া যায় না। কমিটি তাই সুস্পষ্টভাবে এ সম্পর্কে তাঁদের বক্তব্য রাখছে, এ ব্যাপারে বাইরের কোনো কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশ ভারতের জনগণ কখনো মেনে নেবে না। সহযোগিতা সমানে সমানেই সম্ভব এবং তা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট উভয়পক্ষকে একটা পারস্পরিক বোঝাপড়ায় আসতে হবে এবং সেই বোঝাপড়া হবে কেবলমাত্র সৎকাজের ক্ষেত্রে। কিছুদিন আগেও ভারতের জনসাধারণ এ ব্যাপারে এক বিরাট ঝুঁকি নিয়েছিলো এবং স্বাধীনতালাভের তথা ভারতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় অনেক দাবি ছেড়ে দিতে রাজী হয়েছিলো। এখানে উল্লেখযোগ্য, ভারতবাসী চিরদিনই গণতন্ত্রের পক্ষে এবং এখনো তাদের সহানুভূতি গণতন্ত্রের পক্ষেই রয়েছে। অতএব ভারত কখনো এমন এক যুদ্ধের শরিক হতে পারে না, যে যুদ্ধের প্রবক্তারা গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতার কথা বললেও ভারতের ক্ষেত্রে সে নীতিকে অস্বীকার করছেন। শুধু তাই নয়, ইতিপূর্বে যে সামান্যতম স্বাধীনতা ভারতবাসীকে দেওয়া হয়েছিলো সেটুকুও তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
কমিটি ভালোভাবেই জ্ঞাত আছে, ইংলণ্ড এবং ফ্রান্সের সরকার এই বলে ঘোষণা করেছেন, তাঁরা গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার জন্য এবং আগ্রাসনকে বন্ধ করবার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু নিকট অতীতের ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, তাঁদের ঘোষিত নীতি-অনুসৃত কার্যক্রমের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে। ১৯১৪-১৮ সনের যুদ্ধের সময়ও ঘোষিত নীতি ছিলো গণতন্ত্র এবং স্বাধীনতা রক্ষা এবং ক্ষুদ্র জাতিসমূহকে স্বাধীনতা দান। কিন্তু যেসব সরকার উপরোক্ত ঘোষণাবাণী জারি করেছিলেন, কার্যক্ষেত্রে দেখা গেছে, সেইসব সরকারই গোপনে গোপনে চুক্তি করে তাঁদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থাকে কায়েম রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, অপর কোনো দেশের কোনো অঞ্চল অধিকার করবার অভিপ্রায় তাঁদের নেই; কিন্তু যুদ্ধ শেষ হলে দেখা যায়, বিজয়ী শক্তিসমূহ তাঁদের উপনিবেশগুলোকে বহুলাংশে বর্ধিত করেছেন। বর্তমান যুদ্ধের দ্বারাই প্রমাণিত হয়েছে, ভার্সাই সন্ধির কোনো মূল্যই দেওয়া হয়নি। উক্ত সন্ধিপত্র যারা রচনা করেছিলেন, পরবর্তীকালে তারাই সন্ধির শর্তাবলী উপেক্ষা করে পরাজিত শক্তিসমূহের শক্তির নামে সাম্রাজ্যবাদী জোয়াল চাপিয়ে দিয়েছিলেন। আদর্শ সংস্থা হিসেবে বহুলভাবে ঘোষিত ‘লীগ অব নেশনস’-এর আদর্শকেও তাঁরা কার্যকর করতে দেননি এবং শেষ পর্যন্ত উক্ত সংস্থাকে তাঁরাই গলা টিপে হত্যা করেছিলেন।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, কিভাবে তাঁরা তাঁদের ঘোষিত নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করে তা থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। মাঞ্চুরিয়ায় ইংরেজ সরকার আগ্রাসনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়; আবিসিনিয়াতেও তারা একই অসদুপায় অবলম্বন করে। এ ছাড়া চেকোস্লোভাকিয়ায় জার্মানদের অন্যায় কার্যকলাপ এবং স্পেনে বিদ্রোহীদের কার্যকলাপও তারা সমর্থন করে। এবং এইভাবে সমবায়মূলক প্রতিরক্ষার ঘোষিত নীতিকে তারা পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে। শুধু ইংরেজ নয়, অন্যান্য শক্তিও একই পন্থা অবলম্বন করেছিলো। এবারেও ‘গণতন্ত্র বিপন্ন’ বলে ধুয়া তুলে এইসব রাষ্ট্র গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলছে। তাদের এই ঘোষণা যদি সত্যিই আন্তরিক হয় তাহলে তার প্রতি কমিটির পূর্ণ সমর্থন আছে। কমিটি বিশ্বাস করে, পশ্চিমের জনসাধারণ এই আদর্শ অনুসরণ করে সর্ববিধ ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত হয়েছে। কিন্তু যারা এইভাবে ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের ইচ্ছাকে বারবার পদদলিত করা হয়েছে।
এই যুদ্ধ যদি সাম্রাজ্যবাদীদের শক্তি প্রদর্শনের শোভাযাত্রায় পরিণত হয় এবং ঔপনিবেশিক স্বার্থ এবং কায়েমী স্বার্থের স্থিতাবস্থাকে বজায় রাখার জন্য হয় তাহলে এ ব্যাপারে ভারতের কিছু করণীয় নেই; কিন্তু যুদ্ধটা যদি গণতন্ত্র রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক পথে বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে হয় তাহলে ভারতের এতে অবশ্যই সমর্থন আছে। কমিটি বিশ্বাস করে, ভারতের গণতন্ত্রের সঙ্গে ইংরেজের তথা পৃথিবীর যে-কোনো দেশের গণতন্ত্রের কোনো বিরোধ নেই। ভারতের গণতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদ এবং ফ্যাসিবাদের ঘোরতর বিরোধী; সুতরাং গ্রেটব্রিটেন যদি সত্যিই গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে থাকে তাকে নিজ অধিকারভুক্ত অঞ্চলসমূহে সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান ঘটাতে হবে এবং ভারতে পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ভারতের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার ভারতবাসীর হাতেই ছেড়ে দিতে হবে, যাতে তারা বৈদেশিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই একটি কনস্টিট্যুয়েন্ট অ্যাসেমব্লি গঠন করে তাদের নিজস্ব নীতি গ্রহণ করতে পারে। স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক ভারত তখন আনন্দের সঙ্গে অন্যান্য স্বাধীন জাতির পাশে দাঁড়িয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবে। গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন পৃথিবী গঠনের যে সংকল্পের কথা ঘোষণা করা হয়েছে সে কাজেও ভারত এগিয়ে আসবে, পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার এবং সম্পদের সঙ্গে নিজেদের জ্ঞান ও সম্পদকে যুক্ত করে মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণের জন্য সকলের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে। ইয়োরোপে যে দুর্যোগের ঝড় বইছে তা শুধু ইয়োরোপখণ্ডেই সীমাবদ্ধ নয়, সমগ্র মানবজাতিই আজ এই দুর্যোগের মধ্যে পড়েছে। সাধারণ ধরনের দুর্যোগ বা যুদ্ধ সহজে নিবার্য হলেও বর্তমান মহাদুর্যোগকে পৃথিবীর বর্তমান কাঠামোকে অক্ষত রেখে নিবারণ করা যাবে না। এই যুদ্ধের ফলে বিশ্বের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং আর্থনীতিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হবে। বিগত মহাযুদ্ধের পর থেকেই এর সূচনা হয়েছে এবং তখন থেকেই সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিরোধ ক্রমবর্ধমান অবস্থায় এগিয়ে এসে বর্তমান অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এবং যতোদিন পর্যন্ত নূতন কোনো ভারসাম্যের সৃষ্টি না হয় ততোদিন এ সমস্যার সমাধান হবে না। এই ভারসাম্য আসতে পারে ঔপনিবেশিক প্রভুত্বের এবং এক দেশ কর্তৃক অপর দেশকে শোষণের অবসান ঘটিয়ে এবং ন্যায়ের ভিত্তিতে সকলের ভালোর জন্য অর্থনৈতিক সুসম্পর্ক সৃষ্টি করে। এই সমস্যার ব্যাপারে ভারতের স্থান সকলের পুরোভাগে, কারণ সেখানেই সৃষ্ট হয়েছে আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের উদাহরণ; সুতরাং ভারতের সমস্যা সমাধান না করে বিশ্বকে পুনর্গঠন করা যাবে না। ভারত তার প্রভূত সম্পদ নিয়ে পৃথিবীর এই পুনর্গঠনের কাজে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু এটা সে করতে পারে একমাত্র স্বাধীন দেশ হিসাবে। আধুনিক কালে স্বাধীনতা অবিভাজ্য; অতএব পৃথিবীর যে-কোনো অংশে যদি সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থা বজায় থাকে তাহলে নতুন বিপদ দেখা দেবে। ওয়ার্কিং কমিটি লক্ষ্য করেছে, ভারতের অনেক নৃপতি ইয়োরোপে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এই যুদ্ধে ইংরেজকে ধনসম্পদ এবং জনবল দিয়ে সাহায্য করেছেন। অপর দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যারা এতোটা উদগ্রীব, তাদের প্রাথমিক কর্তব্য হলো নিজের দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এগিয়ে আসা, কারণ তাঁদের নিজের দেশে আজ নির্ভেজাল স্বৈরতন্ত্র চালু রয়েছে। এই স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার জন্য অবশ্য ইংরেজ সরকারই বেশী দায়ী। দেশীয় নৃপতিদের চেয়েও যে তারা বেশি দায়ী একথা পূর্ববর্তী বৎসরগুলোয় আরো ভালোভাবে প্রমাণিত হয়েছে। ইংরেজদের এই নীতি হলো গণতন্ত্রকে নস্যাৎ করার নীতি। ওয়ার্কিং কমিটি ইয়োরোপ, আফ্রিকা এবং এশিয়ায় সংঘটিত বিভিন্ন ঘটনা এবং বিশেষ করে ভারতে সংঘটিত অতীত এবং বর্তমান ঘটনাবলী গভীরভাবে লক্ষ্য করেও এমন কিছু দেখতে পায়নি যা থেকে বুঝতে পারা যায়, যুদ্ধের ফলে ভারতে গণতন্ত্র এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সুযোগ আসছে। গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ এবং সর্বপ্রকার আগ্রাসনের অবসান এবং একমাত্র এই পথেই নতুন পৃথিবী গঠন করা সম্ভব। কিন্তু বর্তমান যুদ্ধ সাম্রাজ্যবাদী পন্থায় পরিচালিত হচ্ছে বলে ওয়ার্কিং কমিটি এই যুদ্ধের মধ্যে নিজেকে টেনে আনতে রাজী নয় এবং এতে কোনোরকম সহযোগিতা করতেও তারা রাজী নয়, কারণ এই যুদ্ধের ফলে ভারতে সাম্রাজ্যবাদী শাসনব্যবস্থাই কায়েম হবে। পরিস্থিতির গুরুত্ব এবং বিগত কয়েকদিনের ঘটনাবলী এমন দ্রুতগতিতে আবর্তিত হচ্ছে যার সঙ্গে মানুষের মন যথাযথভাবে তাল রাখতে পারছে না। এবং এই কারণেই কমিটি কোনোরকম সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। যতক্ষণ এই যুদ্ধের আসল উদ্দেশ্য এবং এতাবৎ ঘোষিত বিষয়সমূহের পূর্ণ ব্যাখ্যা না জানা যায় ততোক্ষণ ভারত এই যুদ্ধের সামিল হতে পারে না। এই ব্যাখ্যা এবং উদ্দেশ্যের কথা জানাতে দেরি করা চলবে না, কারণ যতো দিন যাচ্ছে ততোই ভারতকে যুদ্ধের আবর্তের মধ্যে টেনে আনা হচ্ছে। ইংরেজদের এই নীতিকে ভারতবাসী অনুমোদন না করা সত্ত্বেও তাঁরা স্বেচ্ছাচারী মনোভাব নিয়ে তাঁদের সিদ্ধান্ত ভারতের ওপরে চাপিয়ে দিচ্ছেন।
ওয়ার্কিং কমিটি তাই ইংরেজ সরকারকে অনুরোধ করছে তারা, যেন গণতন্ত্র সম্পর্কে তাদের অভিমত এবং নতুন বিশ্বগঠনে তাদের আসল পরিকল্পনা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করে। সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটিয়ে ভারতকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিতে তারা প্রস্তুত আছে কিনা সে কথাও তাদের ঘোষণা করতে হবে। এই সম্পর্কে তাদের সুস্পষ্ট ঘোষণা পৃথিবীর প্রতিটি স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক দেশই অনুমোদন করবে। এখানে উল্লেখযোগ্য, ঘোষিত বিষয়কে কার্যকর করার আসল পরীক্ষা হলো তার বর্তমান প্রয়োগপদ্ধতি, কারণ বর্তমানই হলো ভবিষ্যতের নিয়ামক।
ইয়োরোপে যে ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হয়েছে তার ফল কী দাঁড়াবে তা আগে থেকেই বলা যায় না; কিন্তু সাম্প্রতিককালে দেখতে পাওয়া গেছে, আবিসিনিয়ায়, স্পেনে এবং চীনদেশে অরক্ষিত শহরগুলোর ওপরে নির্বিচারে বোমাবর্ষণ করে নারী শিশু এবং বৃদ্ধসহ অসংখ্য অসামরিক ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়েছে এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা এই, এইসব ধ্বংসমূলক পরিকল্পনা ঠাণ্ডা মাথায় গ্রহণ করা হয়েছে। এইরকম ভয়াবহ অবস্থা এখনো চলছে এবং সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসমূলক ভীতিপ্রদর্শন পৃথিবীর মানুষদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তুলেছে। এটাকে যদি বন্ধ করা না যায় তাহলে অতীতের সমস্ত ঐতিহ্যই ধ্বংস হয়ে যাবে। ইয়োরোপে এবং চীনে এই ভয়াবহ ব্যাপারের অবসান ঘটাতে হবে। কমিটির মতে, ফ্যাসিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদকে ধ্বংস না করা পর্যন্ত এ ব্যবস্থাকে পুরোপুরি কার্যকর করা যাবে না। ওয়ার্কিং কমিটি তাই এ বিষয়ে সাহায্য করতে সব সময় প্রস্তুত আছে।
পরিশেষে ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা করতে চায় ভারতের জনগণের সঙ্গে জার্মানীর জনসাধারণের কোনো বিরোধ নেই। ভারতের যা কিছু বিরোধ তা হলো সেই পদ্ধতির বিরুদ্ধে, যে পদ্ধতি স্বাধীনতাকে অস্বীকার করে এবং যে পদ্ধতি সন্ত্রাস ও আগ্রাসনের ওপরে নির্ভরশীল। এক দেশ কর্তৃক অপর দেশকে পদানত করে রাখা অথবা কোনো দেশ কর্তৃক অপর দেশের শান্তিরক্ষার নামে অধিকার কায়েম রাখার পদ্ধতিতে ভারতবাসী বিশ্বাসী নয়। তারা বিশ্বাস করে গণতন্ত্রের প্রকৃত জয়কে, যা সকল দেশের সকল মানুষকে সর্বপ্রকার সন্ত্রাস থেকে মুক্ত করে এক নতুন বিশ্ব গঠনে সাহায্য করবে।
পরিশেষে কমিটি ভারতের জনগণের কাছে বিশেষ আবেদন জানিয়ে বলছে, তারা যেন সমস্ত বাদবিসংবাদ অবসানের জন্য একজাতি একপ্রাণ হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এবং দৃঢ় সংকল্প নিয়ে বৃহত্তর স্বাধীন বিশ্বের মধ্যে স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার কাজে এগিয়ে আসেন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন