১৭. একটি স্বপ্নের শেষ হলো
আমার মনে একটি ক্ষীণ আশা ছিল যে, শ্রমিক সরকার মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা বাতিল করার প্রস্তাবে সম্মত হবেন না। এই পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল ইংল্যান্ডের তিনজন বিশিষ্ট শ্রমিক নেতার দ্বারা। এঁরা তিনজনেই শ্রমিক মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। যদিও ইতিমধ্যে ভারতসচিব লর্ড পেথিক লরেন্স পদত্যাগ করে মন্ত্রিসভা থেকে সরে গিয়েছিলেন, কিন্তু স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং মিঃ এ. ভি. আলেকজান্ডার তখনো মন্ত্রিসভায় ছিলেন। এই কারণেই আমার মনে একটা শেষ আশা ছিল যে, তারা হয়তো তাদের পরিকল্পনা বাতিল করবেন না। কিন্তু আমার সে আশা ফলবতী হলো না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন লন্ডনে পৌঁছবার পরেই আমি শুনতে পেলাম যে, মন্ত্রিসভা তার প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সেই পরিকল্পনা অদ্যাবধি প্রকাশিত হয়নি। আমার ধারণা, ওতে ভারত-বিভাগের কথাই বলা হয়েছিল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন দিল্লীতে ফিরে আসেন ৩রা মে। এরপর ২রা জুন তিনি কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে একটি আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। ৩রা জুন একটি শ্বেতপত্রের মাধ্যমে শ্রমিক সরকারের বিবৃতি প্রচার করা হয়। শ্রমিক সরকারের সেই বিবৃতি এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট অংশে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি শুধু এই কথাই বলতে পারি যে, আমি যা আশঙ্কা করেছিলাম, শেষ পর্যন্ত তাই বাস্তবে পরিণত হলো। স্বাধীনতা পাওয়া গেল ঠিকই, কিন্তু তা পাওয়া গেল ভারতবর্ষকে খণ্ডিত করে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত করার মূল্যে।
এই বিবৃতি প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে ভারতের অখণ্ডতা এবং একতা বজায় রাখবার সব আশা চিরতরে বিলুপ্ত হয়ে গেল। এই প্রথম মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাকে সরকারিভাবে বাতিল করে ভারত-বিভাগের পরিকল্পনা অনুমোদন করা হলো। শ্রমিক সরকার কেন তাদের মতামত পরিবর্তন করলেন, সে কথা চিন্তা করে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি যে, এ ব্যাপারে তারা ভারতের স্বার্থের চেয়ে ইংরেজদের স্বার্থই বড় করে দেখেছিলেন। শ্রমিক দল সব সময় কংগ্রেস এবং তার নেতাদের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন ছিলেন এবং বহুবার তারা মুসলিম লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল দল বলে ঘোষণা করেছেন। সুতরাং মুসলিম লীগের দাবির কাছে শ্রমিক দলের নতি স্বীকারের অর্থ, আমার মতে, মুসলিম লীগকে খুশি করবার জন্য নয়, আসলে এটা ইংরেজদের স্বার্থের কথা চিন্তা করেই করা হয়েছিল। মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা অনুসারে যদি অবিভক্ত ভারত স্বাধীনতা লাভ করত, তাহলে এদেশে ইংরেজদের শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বার্থরক্ষা তথা ভারতে বসবাসকারী ইংরেজদের অর্থনৈতিক জীবনকে বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ত। কিন্তু ভারত-বিভাগের ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে গঠিত আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলে সেখানে ইংরেজদের স্বার্থ পুরোপুরিভাবে বজায় থাকবে এবং তারা এদেশে খবরদারি করবার সুযোগ পাবে। মুসলিম লীগের কর্তৃত্বাধীন রাষ্ট্রে যে ইংরেজদের স্বার্থ চিরস্থায়ীভাবে বজায় থাকবে, এটা তারা ভালোভাবেই জানতেন। এবং তা জানতেন বলেই দেশবিভাগের পরিকল্পনা তারা অনুমোদন করেন। তারা আরো জানতেন যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হবার ফলে ভারতের মতিগতিও প্রভাবিত হতে বাধ্য। পাকিস্তানে ইংরেজদের স্বার্থ বজায় থাকার ফলে ভারতেও ইংরেজদের স্বার্থ যাতে বিঘ্নিত না হয়, সেদিকে ভারত সব সময় নজর দেবে।
অনেকদিন থেকেই সকলের মনে একটা প্রশ্ন ছিল যে, স্বাধীনতা পাবার পর ভারত কমনওয়েলথে থাকবে কিনা। মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনায় এটা স্বাধীন ভারতের ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে বলেছিলাম যে, ভারত হয়তো তার নিজের স্বাধীন ইচ্ছাতেই কমনওয়েলথের মধ্যে থাকবে। কিন্তু ভারত-বিভাগের পরিকল্পনা গৃহীত হবার ফলে এ বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে ইংরেজদের পক্ষেই যায়। মুসলিম লীগের দাবি অনুসারে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠিত হওয়ায় সে রাষ্ট্র অবশ্যই কমনওয়েলথের ভেতরে থাকবে। এবং পাকিস্তান যদি তা করে, তাহলে ভারতকেও বাধ্য হয়ে সেই পন্থাই অনুসরণ করতে হবে। এইসব ঘটনাই শ্রমিক সরকারের পক্ষে যাবে। তারা ভারতের স্বাধীনতাকে সমর্থন করবেন বলে ঘোষণা করলেও একথা তারা ভোলেননি যে, কংগ্রেস সব সময়ই ইংরেজদের বিরোধিতা করেছে এবং মুসলিম লীগ সব সময় তাদের সমর্থন করেছে। সুতরাং লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন মুসলিম লীগকে খুশি করবার জন্য ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করলেন, তখন শ্রমিক মন্ত্রিসভার অনেক সদস্যই তার প্রস্তাবকে সমর্থন জানালেন।
আমার বিশ্বাস, লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন রক্ষণশীল দলের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, তখন তিনি এই বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে জোর দিয়েছিলেন। মিঃ চার্চিল কোনো সময়ই মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাকে সমর্থন করেননি। তাই মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনাকে তার খুবই মনঃপূত হয় এবং তিনি এর ওপরে জোর দেন। শ্রমিক সরকারও রক্ষণশীল দলের মতামতের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। কারণ তারা জানতেন যে, কমন্সসভায় ভারতের স্বাধীনতা বিষয়ক বিলকে বিনা বাধায় পাস করাতে হলে রক্ষণশীল দলের সমর্থন দরকার হবে।
৩রা জুন কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভা হয়। এই সভায় নতুন পরিস্থিতি বিবেচনা করা হয়। সভার আলোচনায় যা সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পায়, তা হলো উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ভবিষ্যৎ। মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনায় সীমান্তের অবস্থা বেশ একটু ঘোরালো হয়ে পড়েছিল। খান আবদুল গফফর খান এবং তার দল সব সময় কংগ্রেসকে সমর্থন করেছেন এবং মুসলিম লীগের বিরোধিতা করেছেন। লীগ তাই খান ভ্রাতাদের শত্রু বলে মনে করে। লীগের বিরোধিতা সত্ত্বেও খান ভ্রাতারা সীমান্ত প্রদেশে কংগ্রেস সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়েছিলেন। এই সরকার তখনো বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ভারত-বিভাগের পরিকল্পনা খান ভ্রাতাদের এবং কংগ্রেস দলকে এক অস্বাভাবিক (awkward) অবস্থার মধ্যে এনে ফেলেছে। প্রকৃতপক্ষে খান ভ্রাতৃদ্বয় এবং তাদের খোদাই খিদমতগার দলকে লীগের দয়ার ওপরে এনে ফেলা হয়েছে।
আমি আগেই বলেছি, গান্ধীজী কর্তৃক মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনাটি সমর্থিত হওয়ায় আমি অত্যন্ত বিস্মিত হয়েছিলাম। এবার তিনি ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দেশবিভাগের পক্ষে বলতে শুরু করলেন। আমি এটা আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম; তাই তার বক্তব্য শুনে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। কিন্তু খান আবদুল গফ্ফর খানের মনের অবস্থা এর ফলে একেবারে শোচনীয় হয়ে পড়ে। গান্ধীজীর বক্তব্য শুনে তিনি এতোই বিস্মিত হন যে, কয়েক মিনিট তার মুখ থেকে কোনো কথাই বের হয় না। কিছুক্ষণ পরে তিনি ওয়ার্কিং কমিটিকে স্মরণ করিয়ে দেন যে, তিনি চিরকাল কংগ্রেসকে সমর্থন করে এসেছেন, কিন্তু কংগ্রেস আজ তাকে পরিত্যাগ করছে। তিনি আরো বলেন, কংগ্রেস তাকে পরিত্যাগ করায় সীমান্তের অবস্থা ভয়াবহ হয়ে উঠবে। শুধু তাই নয়, এখন থেকে তার শত্রুরা তাকে উপহাস করবে এবং বন্ধুরা বলবে যে, সীমান্ত প্রদেশ যতদিন কংগ্রেসের প্রয়োজন ছিল, শুধু ততদিনই তারা খোদাই খিদমতগার দলকে সমর্থন করেছে। তিনি আরো অভিযোগ করেন যে, কংগ্রেস যখন মুসলিম লীগের সঙ্গে সমঝোতায় আসে, তখন তার সঙ্গে একবার আলোচনা করবারও দরকার বোধ করেনি। অবশেষে তিনি বলেন, কংগ্রেস যদি খোদাই খিদমতগারদের নেকড়ের মুখে তুলে দেয়, তাহলে সীমান্ত প্রদেশ তাকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে মনে করবে।
খান আবদুল গফফর খানের কথা শুনে গান্ধীজী রীতিমতো বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, বিষয়টিকে তিনি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কাছে উত্থাপন করবেন। আসলে তিনি তা করেছিলেনও। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করে তিনি বলেছিলেন, মুসলিম লীগ খোদাই খিদমতগারদের প্রতি সুবিচার করবে বলে তিনি যতদিন না বুঝতে পারছেন, ততদিন তিনি দেশবিভাগে সম্মতি দেবেন না। কংগ্রেসের দুর্দিনে যারা সব সময় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এবং সব সময় তাকে সমর্থন করেছে, তাদের তিনি কিভাবে পরিত্যাগ করতে পারেন?
এর উত্তরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেন, এ বিষয় নিয়ে তিনি মিঃ জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনা করবেন। আলোচনা তিনি করেছিলেন এবং সেই আলোচনার ফলে মিঃ জিন্নাহ খান আবদুল গাফফার খানের সঙ্গে আলোচনা করতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। কিন্তু সে আলোচনায় কোনোই ফল হয় না। এটা আদৌ বিস্ময়ের ব্যাপার নয়। কংগ্রেস যখন একবার দেশবিভাগ মেনে নিয়েছে, তখন খান আবদুল গাফফার খান এবং তার দলের আর কোন ভবিষ্যৎ আছে? মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনার মূল কথাই ছিল মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোকে আলাদা করে পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা হবে। সীমান্ত প্রদেশে মুসলমানরা বিরাটভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ, সুতরাং ওই প্রদেশ পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকেও সীমান্ত প্রদেশ প্রস্তাবিত পাকিস্তান রাষ্ট্রের মধ্যেই পড়ে। এর সঙ্গে ভারতের কোনো রকম যোগাযোগই নেই।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, প্রদেশগুলোকে নিজেদের ইচ্ছামতো কাজ করবার স্বাধীনতা দেওয়া হবে। এই ঘোষণা অনুসারে তিনি বলেন, সীমান্ত প্রদেশ তার নিজের ভাগ্য নিজে নিয়ন্ত্রণ করবার সুযোগ অবশ্যই পাবে। তিনি আরো বলেন, এ ব্যাপারে দরকার হলে গণভোট নিয়ে প্রদেশবাসীদের ইচ্ছাটা জেনে নেওয়া হবে—তারা পাকিস্তানে থাকতে চায়, না ভারতের সঙ্গে থাকতে চায়। এই সময় সীমান্ত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ডঃ খান সাহেব ওয়ার্কিং কমিটির সভায় যোগদান করেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার এই পরিকল্পনার কথা ডঃ খান সাহেবকে বলেছিলেন এবং এতে তার কোনো আপত্তি আছে কিনা তা জানতে চেয়েছিলেন। ডঃ খান সাহেব মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলে এটা ধরে নিতে হবে যে বেশির ভাগ লোকের সমর্থন তার পেছনে আছে। সুতরাং গণভোটের প্রস্তাবে আপত্তি জানানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। কিন্তু তিনি এক নতুন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তিনি দাবি করেন, গণভোট যদি নিতেই হয়, তাহলে সীমান্তের পাঠানরা যাতে পাকতুনিস্তান নামে তাদের জন্য এক নতুন রাষ্ট্র গঠন করতে পারেন তার ব্যবস্থা করতে হবে।
সীমান্ত প্রদেশের ওপর খান ভ্রাতৃদ্বয়ের যতটা প্রভাব আছে বলে কংগ্রেস মনে করত, আসলে ততটা প্রভাব তাদের মোটেই ছিল না। দেশবিভাগের জন্য আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই তাদের প্রভাব কমতে থাকে। এখন পাকিস্তান যখন আর কল্পনার বস্তু নয়, এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশগুলোকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করা হবে বলে স্বীকার করা হয়েছে, তার ফলে সীমান্তের অধিবাসীদের ভাবপ্রবণ মনের এক বিরাট পরিবর্তন সংঘটিত হচ্ছে। মুসলিম লীগের আন্দোলন আরো শক্তিশালী হয়েছিল ইংরেজ অফিসারদের চালচলনের ফলে। এঁরা প্রকাশ্যেই পাকিস্তান পরিকল্পনাকে সমর্থন করছিলেন এবং উপজাতীয় লোকদের মুসলিম লীগের পাশে দাঁড়াবার জন্য উস্কানি দিচ্ছিলেন। ডক্টর খান সাহেব তাই বুঝতে পেরেছিলেন তাকে যদি তার নেতৃত্ব রক্ষা করতে হয়, তাহলে পাকতুনিস্তানের দাবি তোলা ছাড়া গতি নেই।
পাকতুনিস্তান ক্ষুদ্র হলেও বহু পাঠানদের মধ্যে বেশিরভাগ লোকই এটা চাইবেন; কারণ তারা পাঞ্জাবি শাসকদের অধীনস্থ হতে চান না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন কিন্তু নতুন কোনো দাবির কথায় কান দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তিনি তার পরিকল্পনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রূপ দেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই পাকতুনিস্তানের দাবি নিয়ে বিশেষ কোনো আলোচনাই দিল্লিতে হলো না।
কংগ্রেসের আলোচনা সভায় খান ভ্রাতৃদ্বয়ের এইটিই ছিল সর্বশেষ অংশগ্রহণ। সুতরাং দেশবিভাগের পূর্বে ও পরে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল সে কথা এখানে সংক্ষেপে বলা দরকার বোধ করছি। তারা যখন দেখতে পেলেন কংগ্রেস দেশবিভাগ মেনে নিয়েছে, তখন তাদের পরবর্তী কর্মপন্থা কী হবে তা তারা বুঝেই উঠতে পারছিলেন না। গণভোটের প্রস্তাব অগ্রাহ্য করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে এটাই মনে করা হবে যে তাদের পেছনে গণসমর্থন নেই। তারা তাই পেশোয়ারে ফিরে গিয়ে তাদের বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করে সীমান্ত প্রদেশের স্বাধীনতার দাবি তোলেন।
কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সীমান্ত কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মেনে নেয় এবং ওখানকার পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার জন্য যথাবিহিত কাজ করবার জন্য খান আবদুল গাফফার খানের ওপরে পূর্ণ দায়িত্ব অর্পণ করেন। সীমান্ত কংগ্রেস তখন স্বাধীন পাঠান রাষ্ট্র গঠনের দাবি তোলে এবং ইসলামিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে তার সংবিধান রচনা করতে চায়। এই দাবির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে খান আবদুল গাফফার খান বলেন, সীমান্তের পাঠানদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিদ্যমান আছে এবং এই ঐতিহ্য কিছুতেই রক্ষা করা যাবে না যদি তারা তাদের নিজস্ব ভাবধারা অনুসারে চলবার স্বাধীনতা না পান। তারা তাই দাবি করেন, গণভোট পাকিস্তান এবং ভারতের ব্যাপারে সীমাবদ্ধ না থেকে ওতে তৃতীয় বিকল্প হিসেবে স্বাধীন পাকতুনিস্তান-এর কথা থাকবে। একমাত্র এই পথেই গণভোট মারফত জনগণের প্রকৃত ইচ্ছা জানতে পারা যাবে। অন্যথায় এটা একটা অর্থহীন বিষয় হয়ে দাঁড়াবে, কারণ তাহলে পাঠানরা পাকিস্তানের অন্যান্য মুসলমানের মতো পাকিস্তানের অধীনস্থ হয়ে পড়বে। এই প্রসঙ্গে বলা চলে, গণভোটের প্রস্তাবে যদি স্বাধীন পাকতুনিস্তানের কথা জুড়ে দেওয়া হতো, তাহলে সীমান্ত প্রদেশের বিরাট সংখ্যক ব্যক্তি এর পক্ষে ভোট দিতেন। পাঞ্জাবিদের অধীনস্থ হয়ে থাকাটা তারা পছন্দ করতেন না এবং এই মনোভাবের ফলে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিতেন।
মিঃ জিন্নাহ এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন এ দাবি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরিষ্কারভাবে বলে দিলেন, সীমান্তে কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা যাবে না। সীমান্ত প্রদেশকে পাকিস্তানের ভেতরে কিংবা ভারতের ভেতরে থাকতে হবে। খান ভ্রাতৃদ্বয় তখন ঘোষণা করেন তাদের দল গণভোটে অংশগ্রহণ করবে না। পাঠানদের তারা এই গণভোট বয়কট করতে বলেন। কিন্তু তাদের বিরোধিতা কোনো কাজেই এলো না। যথাসময়ে গণভোট নেওয়া হলো এবং জনগণের এক বিরাট অংশ পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দিল। খান ভ্রাতৃদ্বয় যদি গণভোট বয়কট না করতেন এবং তাদের সমর্থকরা যদি ঠিকমতো কাজ করতেন, তাহলে জানা যেত পাঠানদের মধ্যে কতটা অংশ পাকিস্তানের সমর্থক। যাই হোক, গণভোটের ফলাফল মুসলিম লীগের পক্ষেই যায় এবং ইংল্যান্ডের সরকার অবিলম্বে এটা মেনে নেয়।
দেশবিভাগ হয়ে যাবার পরে অবস্থা অনুসারে ব্যবস্থা অবলম্বন করবার উদ্দেশ্যে তারা তাদের মতিগতির কিছুটা পরিবর্তন করেন। পাকতুনিস্তানের দাবি ব্যাখ্যা করে তারা বলেন এটা আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি নয়। আসলে এটা হলো পাকিস্তানের ভেতরে থেকেই পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন পাবার দাবি। তারা যা দাবি করছেন তা হলো পাকিস্তানের গঠনতন্ত্রে কেন্দ্রীয় সরকার হবে ফেডারেল সরকার এবং সেই ফেডারেল সরকারের অধীনে প্রতিটি প্রদেশ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার লাভ করবে। এর দ্বারা পাঠানরা তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নিজেদের ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ ও উন্নয়ন করতে পারবেন। এইরকম সাংবিধানিক রক্ষাকবচ না থাকলে পাঞ্জাবিরাই সমগ্র পাকিস্তানের ওপর আধিপত্য করবে। তারা হয়তো পাঠানদের এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারও মানতে চাইবে না।
নিরপেক্ষভাবে বিচার করলে যে কোনো ব্যক্তিই এটা স্বীকার করবেন—খান ভ্রাতৃদ্বয়ের দাবি মোটেই অযৌক্তিক ছিল না। তাদের এই দাবি মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবের সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিঃ জিন্নাহ খান ভ্রাতৃদ্বয়কে এই বলে অভিযুক্ত করেন তারা নাকি পাকিস্তানকে ভেঙে বেরিয়ে যেতে চান। প্রকৃতপক্ষে খান আবদুল গাফফার খান কয়েকবার করাচিতে গিয়ে মিঃ জিন্নাহর সঙ্গে আলোচনা করেন। এই আলোচনার সময় একবার এমনও মনে হয়েছিল তাদের মধ্যে একটা সমঝোতা সৃষ্টি হতে চলেছে। পাকিস্তানের কোনো কোনো পর্যবেক্ষক এমন কথাও বলেন, খান আবদুল গাফফার খানের সদিচ্ছা দেখে মিঃ জিন্নাহ খুবই খুশি হয়েছেন এবং তিনি নাকি পেশোয়ারে গিয়ে তার এবং তার সহকর্মীদের সঙ্গে দেখা করে আরো আলোচনা করতে চান। কিন্তু কার্যকালে আলাদা অবস্থা দেখা যায়। খান ভ্রাতৃদ্বয়ের রাজনৈতিক শত্রুরা মিঃ জিন্নাহর মনকে তাদের প্রতি বিষাক্ত করে তোলে। খান আবদুল কাইয়ুম খান (যিনি তখন সীমান্ত প্রদেশে সরকার গঠন করেছেন) স্বভাবতই চাননি মিঃ জিন্নাহর সঙ্গে খান ভ্রাতৃদ্বয়ের কোনো রকম আপস-রফা হয়। সুতরাং তিনি এমনভাবে কাজকর্ম শুরু করলেন, যার ফলে কোনো রকম সমঝোতা অসম্ভব হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে তার সরকার সমস্ত রকম স্বাধীনতা এবং সুবিচারের পথ পরিত্যাগ করে খুদাই খিদমতগার-দের ওপরে নানাভাবে অত্যাচার চালাতে থাকে। এ ব্যাপারে তিনি আইন এবং ন্যায়নীতিকেও বিসর্জন দেন। ফলে গণতন্ত্রের সমাধি হয়ে সেখানে পশুশক্তিই প্রধান হয়ে ওঠে। খান আবদুল গাফফার খান এবং ডঃ খান সাহেব সহ খুদাই খিদমতগার দলের আরো বহু সংখ্যক নেতাকে কারারুদ্ধ করা হয়। প্রায় ছয় বছর তারা বিনা বিচারে জেলে পচতে থাকেন। খান আবদুল কাইয়ুম খানের প্রতিহিংসামূলক মনোভাব এমনই এক তিক্ত পর্যায়ে এসেছিল, মুসলিম লীগের একটি অংশও তাতে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। এই মহল থেকে তখন দাবি ওঠে হয় খান ভ্রাতৃদ্বয়ের বিচার করতে হবে, না হয় তাদের মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু তাদের কথায় কোনো কাজই হয় না। ওখানে যেমন অরাজকতা চলছিল, তেমনই চলতে থাকে।
১৯৪৭ সালের ১৪ই জুন এ.আই.সি.সি.-র সভা বসে। এর আগে এ.আই.সি.সি.-র অনেক সভাতেই আমি অংশগ্রহণ করেছি কিন্তু এবারের এই সভার মতো দুর্ভাগ্যজনক সভা আর কোনোদিন অনুষ্ঠিত হয়নি। যে কংগ্রেস চিরদিন ভারতের ঐক্য এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে এসেছে, সেই কংগ্রেসই এখন আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবিভাগের প্রস্তাব গ্রহণ করতে চলেছে। পণ্ডিত গোবিন্দবল্লভ পন্থ প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন এবং সর্দার প্যাটেল ও জওহরলাল সেই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে বক্তব্য রাখেন। পরে গান্ধীজী-কেও এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হয়।
আমার পক্ষে কংগ্রেসের এই নতি স্বীকারকে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। আমার বক্তৃতায় আমি তাই ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্তকে দুর্ভাগ্যজনক বলে অভিহিত করি। দেশবিভাগ ভারতের পক্ষে এক মহাদুর্ভাগ্য ছাড়া আর কিছু নয়। এর পক্ষে একমাত্র যা বলা যায় তা হলো এই সিদ্ধান্ত না নেবার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি কিন্তু আমাদের সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। আমাদের ভুললে চলবে না ভারতবাসীরা একই জাতি এবং তাদের সংস্কৃতিও এক এবং অবিভাজ্য। রাজনীতির ব্যাপারে আমরা অকৃতকার্য হয়েছি বলেই আজ আমরা দেশকে বিভক্ত করেছি। আমাদের এই পরাজয়কে আমরা অবশ্যই স্বীকার করে নেবো। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা প্রমাণ করতে চেষ্টা করব আমাদের সংস্কৃতি কখনো বিভক্ত ছিল না। জলের মধ্যে একটা কাঠি ঢুকিয়ে দিলে মনে হবে জলটা বিভক্ত হয়ে গেছে কিন্তু যে মুহূর্তে কাঠিটাকে সরিয়ে নেওয়া হবে, জলটা পূর্বের মতো একাকার হয়ে যাবে।
সর্দার প্যাটেল আমার এই বক্তৃতা পছন্দ করলেন না। তাই দেখা গেল তার বক্তৃতার সময় তিনি আমার বক্তব্য খণ্ডন করবার জন্যই বেশি সময় ব্যয় করেন। তার বক্তৃতার সারমর্ম হলো, দেশবিভাগের প্রস্তাব কোনো রকম দুর্বলতা অথবা কোনো মহলের কোনো চাপের ফলে গৃহীত হয়নি। এই প্রস্তাব গ্রহণ করবার কারণ হলো, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতিতে এটাই হলো একমাত্র সমাধান।
কংগ্রেসের মধ্যে চিরদিনই কিছু সংখ্যক সুবিধাবাদী শ্রেণীর সদস্য ছিল। এমনকি বর্তমান দুর্ভাগ্যজনক সময়েও এরা আসর জাঁকিয়ে অবস্থান করছিল। এরা নিজেদের জাতীয়তাবাদী বলে জাহির করত কিন্তু কার্যক্ষেত্রে ঘোর সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় দিত। এরা সব সময় বলে এসেছে, ভারতের সংস্কৃতি কখনো অবিভাজ্য ছিল না। তারা আরো বলত, কংগ্রেস যাই বলুক না কেন, হিন্দু ও মুসলমানদের সামাজিক জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো, এরা হঠাৎ আসরে নেমে তারস্বরে ভারতীয় ঐক্যের কথা বলতে শুরু করল।
এরা প্রচণ্ডভাবে দেশবিভাগের প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে থাকে। এবার এরা বলতে শুরু করেছে, ভারতের সংস্কৃতি এবং জাতীয় ঐক্যকে কোনো মতেই বিনষ্ট করা চলবে না। এ ব্যাপারে আমি মোটামুটিভাবে তাদের সঙ্গে একমত হই। কিন্তু হঠাৎ এরা ভোল পাল্টালো কেন তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি।
প্রথম দিনের আলোচনার পর ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখা গেল। পণ্ডিত পন্থ এবং সর্দার প্যাটেলের বক্তৃতাও সদস্যদের মনোভাবকে প্রভাবিত করতে পারল না। কী করেই বা পারবে? জন্মকাল থেকে কংগ্রেস যে নীতির কথা বহুবার ঘোষণা করে এসেছে, কংগ্রেসের সেই বহু বিঘোষিত নীতির মূলেই কুঠারাঘাত করেছে ওয়ার্কিং কমিটির এই প্রস্তাব। ব্যাপার গুরুতর দেখে শেষ পর্যন্ত গান্ধীজী-কে অবতীর্ণ হতে হলো। তিনি ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবকে মেনে নেবার জন্য সদস্যদের কাছে আবেদন জানালেন। তিনি বলেন, তিনি আগাগোড়াই দেশবিভাগের বিরোধিতা করেছেন, কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি যেরকম জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে এ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্যই মাউন্টব্যাটেনের পরিকল্পনাকে গ্রহণ করতে হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করে তিনি পণ্ডিত পন্থের উত্থাপিত প্রস্তাব অনুমোদন করবার জন্য সদস্যদের কাছে আবেদন জানান।
প্রস্তাবটি যখন ভোটে দেওয়া হয় তখন দেখা যায় ২১ জন প্রস্তাবের পক্ষে এবং ১৫ জন বিপক্ষে ভোট দিয়েছেন। গান্ধীজী-র আবেদন সত্ত্বেও বেশি সংখ্যক সদস্য দেশবিভাগের পক্ষে ভোট দিলেন না।
প্রস্তাবটি পাস হলো ঠিকই, কিন্তু সদস্যদের মনের অবস্থা কি এর পক্ষে ছিল? দেশবিভাগের প্রশ্নে প্রত্যেক সদস্যের মনই তখন ভার হয়ে পড়েছে। সুতরাং খোলা মন নিয়ে তারা প্রস্তাবটি অনুমোদন করেননি। এমনকি, প্রস্তাবের পক্ষে যারা ভোট দিয়েছিলেন তাদের মনও এর বিপক্ষে ছিল। এটা একটা খারাপ ব্যাপার। কিন্তু এর চেয়েও খারাপ ব্যাপার হলো সাম্প্রদায়িকতার প্রচার—যা তখন রীতিমতো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন মহল থেকে তখন প্রকাশ্যেই বলা শুরু হয়েছে পাকিস্তানের হিন্দুদের ভয় করবার কিছু নেই, কারণ ভারতে সাড়ে চার কোটি মুসলমান থাকবে। সুতরাং পাকিস্তানের হিন্দুদের ওপরে যদি কোনো রকম অত্যাচার হয়, তাহলে ভারতের মুসলমানদের ওপরে তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
এ.আই.সি.সি.-র সভায় সিন্ধুর প্রতিনিধিরা তীব্রভাবে প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেন। তাদের তখন নানা রকম স্তোকবাক্য দিয়ে ঠাণ্ডা করা হয়। প্রকাশ্য সভায় কিছু না বলেও তাদের নিয়ে গোপনে আলোচনা সভা করে, তাদের কাছে এমন কথাও বলা হয়, পাকিস্তানে তাদের ওপর কোনো রকম অত্যাচার করা হলে ভারতের মুসলমানদের ওপরে তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।
আমি যখন এ কথা শুনতে পাই, তখন আমি বিশেষভাবে মানসিক আঘাত পাই। আমি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি এ এক সাংঘাতিক মনোভাব এবং এর ফলে এক সুদূরপ্রসারী এবং দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। এবং আশা করা হলো, ভারত পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রেই সংখ্যালঘুদের অপর রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে জামিন হিসেবে গণ্য করা হবে। এক রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের স্বার্থে অপর রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের ওপরে প্রতিশোধ নেবার এই মনোবৃত্তিকে আমি বর্বর মনোবৃত্তি বলে মনে করি। আমার কথাটা যে কতখানি সত্যি তা পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। দেশবিভাগের পরে উভয় রাষ্ট্রে যে রক্তের নদী প্রবাহিত হয়, সেটা এই মনোবৃত্তির ফলেই সংঘটিত হয়েছিল।
কংগ্রেসের কোনো কোনো সদস্য এই তত্ত্বের ভয়াবহ দিকটা সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। এ ব্যাপারে বাংলার কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায়ের নাম আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে। তিনিই প্রথমে এ কথাটা আমাকে বলেন। তিনি তৎকালীন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট আচার্য কৃপালনি-কেও এই সম্ভাব্য বিপদের কথা বলেছিলেন। তার মতে এটি ছিল একটি সাংঘাতিক তত্ত্ব। এইরকম মনোবৃত্তি যদি একবার গড়ে ওঠে, তাহলে পাকিস্তানে হিন্দুরা এবং ভারতে মুসলমানরা পাইকারিভাবে নিহত হবে। কিন্তু দুঃখের বিষয় কিরণশঙ্কর রায়ের উপরোক্ত কথায় কেউ কোনো রকম গুরুত্ব তো দিলেনই না, উপরন্তু অনেকে তাকে উপহাসও করলেন। এইসব ব্যক্তি তাকে এমন কথাও বলেন যে ভারত বিভক্ত হবার পর জামিনের তত্ত্বই অনুসৃত হবে। তারা আরো বললেন, একমাত্র এই পথেই পাকিস্তানের হিন্দুদের রক্ষা করা যাবে। কিরণশঙ্কর রায় তাদের কথায় খুশি হতে না পেরে প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে আমার কাছে এসে তার আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন। তিনি আরো বলেন, কয়েকজন নেতা যে পদ্ধতির কথা তাকে বলেছেন, তার ওপর তিনি আস্থা রাখতে পারছেন না।
ইংরেজ সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য প্রথমে পনেরো মাস সময় নির্ধারিত করেছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২০শে ফেব্রুয়ারি মিঃ অ্যাটলি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন, তার ইচ্ছা ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের মধ্যেই দায়িত্বশীল ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত করবেন। ২০শে ফেব্রুয়ারি এবং ৩রা জুনের মধ্যে অনেক ঘটনা সংঘটিত হয়। এখন দেশবিভাগের পরিকল্পনা গৃহীত হওয়ায় লর্ড মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা করেন পরিকল্পনাটি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কার্যে রূপায়িত করা হবে। তার মতিগতি মিশ্র ধরনের ছিল। প্রথমত তিনি ইচ্ছা করেছিলেন ইংরেজরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। দ্বিতীয়ত তিনি হয়তো ভেবেছিলেন এ ব্যাপারে দেরি করা হলে আবার হয়তো নতুন ধরনের ফ্যাকড়া উঠে পরিকল্পনাটা কার্যকর করার পথে বাধা উপস্থিত হবে। মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা উদ্ভাবিত হবার পরে তাকে কার্যকর করার বিলম্ব হবার জন্যই পরবর্তীকালে নানা ফ্যাকড়া উঠে পরিকল্পনাটির সমাধি হয়েছিল বলেই তার মনে এই চিন্তাধারা স্থান পেয়েছিল।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত-বিভাগের জন্য তিন মাস সময় নির্ধারণ করেন। তিনি স্থির করেন এই সময়ের মধ্যেই দেশবিভাগের কাজ তিনি সম্পন্ন করবেন। এটা খুব সহজ কাজ ছিল না। আমি তাই প্রকাশ্যেই আমার সন্দেহ ব্যক্ত করেছিলাম যে এত অল্প সময়ের মধ্যে এই বিশাল কর্মকাণ্ড সমাধা করা হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন যেরকম দ্রুততার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে এই কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন, তার জন্য আমি অবশ্যই তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাব। সমগ্র বিষয়ের ওপরে তার এমনই দখল (mastery) ছিল এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবার এমন ক্ষমতা তার ছিল, যার ফলে তিন মাসের আগেই তিনি সমস্ত সমস্যার সমাধান করেন এবং ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট ভারতবর্ষ দু ভাগে বিভক্ত হয়ে দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন কী রকম দ্রুততার সঙ্গে এই জটিল সমস্যার সমাধান করে দুটি রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে তার ঘোষণাকে কার্যকর করেছিলেন, সে সম্পর্কে দু-একটি উদাহরণ এখানে দেওয়া হচ্ছে। যখনই জানা গেল ভারতবর্ষ বিভক্ত হতে চলেছে, তখন হিন্দু ও মুসলমানরা নানা রকম দাবি তুলতে শুরু করলেন। এছাড়া দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দাঙ্গাহাঙ্গামাও দেখা দিল। ১৯৪৬ সালে কলকাতার বিরাট হত্যাকাণ্ডের পরে নোয়াখালি এবং বিহারে তার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ল। মার্চ মাসে পাঞ্জাবেও দাঙ্গা শুরু হলো। প্রথমে লাহোর শহরে দাঙ্গা শুরু হলেও পরবর্তীকালে তা ব্যাপক অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। রাওয়ালপিণ্ডি শহরই সবচেয়ে বেশি উপদ্রুত হয়। লাহোর শহর তো রীতিমতো যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং হিন্দু ও মুসলমানরা সেখানে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে। হিন্দু শিখরা কংগ্রেসকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন যে লাহোরকে ভারতের মধ্যেই রাখতে হবে। তারা বলেন, পাঞ্জাবের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন লাহোরেই কেন্দ্রীভূত এবং এই শহরটি যদি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়, তাহলে পাঞ্জাব চিরদিনের মতো পঙ্গু হয়ে যাবে। অতএব অনেকেই চাপ দিতে লাগলেন যে লাহোরকে ভারতের মধ্যে রাখার জন্য কংগ্রেস তার প্রভাব বিস্তার করবে। কিন্তু কংগ্রেস তাদের কথায় কর্ণপাত করে না। কংগ্রেসের বক্তব্য হলো, এই প্রশ্ন ওখানকার অধিবাসীদের ইচ্ছানুসারেই সমাধান হবে।
মুসলমান, হিন্দু এবং শিখদের কোনো কোনো অংশ মনে করে হিংস্র পদ্ধতিতেই লাহোরের প্রশ্নটির সমাধান করতে হবে। আসল ব্যাপার হলো, হিন্দুরাই ছিল লাহোর এবং তার নিকটবর্তী অঞ্চলসমূহের বেশির ভাগ সম্পত্তির মালিক। মুসলমানরা মনে করে হিন্দুদের সম্পত্তি ধ্বংস করলে অর্থনৈতিক দিকে হিন্দুদের ওপরে চরম আঘাত করা যাবে। তারা তাই অমুসলমানদের কলকারখানা এবং বাড়িঘর পোড়াতে শুরু করে এবং যথেচ্ছভাবে তাদের ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করতে থাকে। এর প্রতিশোধ নেবার জন্য হিন্দুরা শুরু করে মুসলমান নিধন। তাদের হাতে যথেষ্ট টাকা থাকায় তারা ভাবে টাকার জোরেই তারা মুসলমানদের ওপরে আক্রমণ সংগঠিত করে তাদের লাহোর থেকে তাড়িয়ে দিয়ে ওখানে হিন্দু প্রাধান্য স্থাপন করতে পারবে। এবং এ কথা ওখানে প্রকাশ্যেই বলা হতে থাকে। যেখানে এক পক্ষ সম্পত্তি ধ্বংসে মেতে উঠেছে এবং অন্য পক্ষ হত্যাকাণ্ডে মেতে উঠেছে—সেখানে সাম্প্রদায়িক নেতারা সকলেই প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে এই ব্যাপারে অংশগ্রহণ করতে থাকে। সুতরাং সর্বত্র এই কথা প্রচারিত হতে থাকে, মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক নেতারা হিন্দুদের ওপরে আক্রমণ সংগঠিত করছেন। অন্যদিকে হিন্দুমহাসভার নেতাদের ওপরেও মুসলমানদের আক্রমণ করবার জন্য হিন্দুদের উস্কানি দেবার কথা প্রচারিত হতে থাকে।
প্রায় অনুরূপ পরিস্থিতি কলকাতায় দেখা দেয়। মুসলিম লীগের সমর্থকরা দাবি করতে থাকেন কলকাতাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আবার লীগ-বিরোধীরা চাইছিলেন কলকাতা শহর ভারতের মধ্যেই থাকবে।
এই রকম দাবি আর পাল্টা দাবির মধ্যেই লর্ড মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাব আর বাংলা বিভক্ত করবার কাজে হাতে দেন। এই সম্পর্কে স্থির হয়, প্রাদেশিক আইনসভায় ভোটের মাধ্যমে স্থির হবে প্রদেশ দুটিকে বিভক্ত করা হবে, না তারা পুরোপুরিভাবে ভারতের পক্ষে অথবা পাকিস্তানের পক্ষে যোগদান করবে। উভয় প্রদেশই বিভাগের পক্ষে ভোট দেয়। এরপর প্রশ্ন দাঁড়ায় নতুন দুটি প্রদেশের সীমানা কী হবে। সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারে লর্ড মাউন্টব্যাটেন একটি সীমানা কমিশন নিযুক্ত করেন এবং মিঃ র্যাডক্লিফকে সেই কমিশনের ভার নিতে বলেন। মিঃ র্যাডক্লিফ তখন সিমলায় ছিলেন। তিনি এই নিয়োগ মেনে নিতে স্বীকৃত হন। কিন্তু তিনি বলেন, জরিপের কাজ তিনি শুরু করবেন জুলাই মাসের প্রথম দিকে। তিনি আরো বলেন, জুনের প্রচণ্ড গরমে পাঞ্জাবে জরিপ করা প্রায় অসম্ভব। জুলাই মাসে যদি কাজটি করা হয়, তাতেও তিন-চার সপ্তাহের বেশি দেরি হবে না। লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাকে বলেন, তিনি এ ব্যাপারে একদিনও দেরি করতে চান না; সুতরাং তিন-চার সপ্তাহের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তার নির্দেশ যথারীতি পালিত হয়। এ থেকেই বুঝতে পারা যায় কত তাড়াতাড়ি তিনি তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করেছিলেন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সামনে দ্বিতীয় সমস্যা দাঁড়ায় ভারত সরকারের সদর দপ্তর এবং সম্পত্তি ভাগ করার বিষয়। যেসব প্রদেশ ভারত অথবা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তাদের দলিলপত্র ভাগ করাটা খুবই অসুবিধাজনক হয়ে দাঁড়ায়। যেসব প্রদেশ পাকিস্তানের ভাগে পড়েছে, সেগুলোর কাগজপত্র আলাদা করে পাকিস্তানে পাঠাতে হবে। এর চেয়েও কঠিন কাজ হলো যেসব প্রদেশ বিভক্ত হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কর্মকুশলতার ফলে নিতান্ত জটিল কাজও সহজেই সুসম্পন্ন হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এইসব কাজ তিনি নিজেই তদারক করেছিলেন। তিনি যে কমিটি নিযুক্ত করেছিলেন, সেই কমিটি প্রত্যেকটি সমস্যাই যথাসময়ে সমাধান করে।
এর চেয়েও কঠিন সমস্যা দেখা দিয়েছিল অর্থদপ্তর এবং সেনাবাহিনী বিভক্ত করা নিয়ে। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের ফলে কোনো সমস্যাই তার কাছে কঠিন বলে বিবেচিত হয়নি। সবচেয়ে জটিল বলে বিবেচিত অর্থদপ্তর ভাগ করার কাজটিও নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছিল।
সেনাবাহিনী ভাগ করার ব্যাপারে স্থির হয় পাকিস্তানের ভাগে এক-তৃতীয়াংশ এবং ভারতের ভাগে দুই-তৃতীয়াংশ যাবে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠে সেনাবাহিনীকে অবিলম্বে বিভক্ত করা হবে, না, দু-তিন বছর স্থিতাবস্থায় রেখে দেওয়া হবে? সেনানায়করা অভিমত দেন সাধারণ সৈনিকদের একই কমাণ্ডের অধীনে রাখা উচিত। তাদের এই অভিমত আমাকে খুবই খুশি করে। আমি তাই সর্বান্তঃকরণে তাদের এই অভিমতকে সমর্থন জানাই। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের অভিমত ছাড়াও এ ব্যাপারে আমার একটি নিজস্ব অভিমত ছিল। আমি এই আশঙ্কা পোষণ করতাম দেশ বিভক্ত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশজুড়ে দাঙ্গাহাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে। এবং তা যদি হয়, তাহলে অবিভক্ত সেনাবাহিনী সুষ্ঠুভাবেই দেশকে রক্ষা করতে পারবে। আমার মতে সৈনিকদের মধ্যে কোনো রকম সাম্প্রদায়িকতার আমদানি করা অসঙ্গত হবে। তখন পর্যন্ত সৈনিকদের মধ্যে কোনো রকম সাম্প্রদায়িক মনোভাব বিদ্যমান ছিল না। সৈনিকদের যদি রাজনীতি থেকে বাইরে রাখা যায়, তাহলেই শুধু তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা ও নিরপেক্ষতা বজায় থাকবে। আমি তাই সেনা বিভাগকে অবিভক্ত রাখার জন্যই চাপ দিই। লর্ড মাউন্টব্যাটেনও এ বিষয়ে আমার সঙ্গে একমত হন। আজও আমি বিশ্বাস করি, সে সময় যদি সেনাবাহিনীকে অখণ্ড রাখা হতো, তাহলে স্বাধীনতার পরে সারা দেশময় রক্তের নদী প্রবাহিত হতো না।
আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি আমার সহকর্মীরা এ ব্যাপারে আমার বিরোধিতা করেন। আমি সবচেয়ে বেশি আশ্চর্য হয়েছিলাম ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদের বিরোধিতায়। তিনি ছিলেন শান্তিবাদী এবং অহিংসার একনিষ্ঠ পূজারী। কিন্তু সেই অহিংসার পূজারীই হঠাৎ উঠে পড়ে লেগে গেলেন সেনাবাহিনীকে ভাগ করার জন্য। তার বক্তব্য হলো, ভারতবর্ষ যদি বিভক্ত হয় তাহলে সেনাবাহিনীকে অবিভক্ত রাখা কিছুতেই চলবে না।
আমার মতে এটা একটা সাংঘাতিক মনোভাব। কিন্তু এই মনোভাবই দেখা গেল আমার সহকর্মীদের মধ্যে। এবং এই মনোভাব নিয়েই তারা সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করবার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেনাবাহিনী সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত হলো। গোটা বাহিনীর এক-চতুর্থাংশ গেল পাকিস্তানে এবং তিন-চতুর্থাংশ রইল ভারতে। বেশির ভাগ মুসলিম ইউনিট পাকিস্তানের ভাগে পড়ল। হিন্দু ও শিখ ইউনিটগুলো পুরোপুরিভাবে ভারতেই রয়ে গেল। এর পর থেকেই সেনাবাহিনীর মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতা প্রবেশ করল। সেনাবাহিনীর ভেতরে কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা দ্রুত বিস্তৃত হয়েছিল তা বুঝতে পারা গেল ১৫ই আগস্টের পরে। সীমান্তের উভয় দিকে যখন রক্তের বন্যা বইতে লাগল, সৈনিকেরা তখন কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে সেই অমানুষিক দৃশ্য দেখতে লাগল। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণও করল।
সেই সময়কার অবস্থা দেখে লর্ড মাউন্টব্যাটেন আমার কাছে দুঃখ করে বলেছিলেন, হিন্দু সৈনিকরা পূর্ব পাঞ্জাবের মুসলমানদের হত্যা করতে সচেষ্ট হয়েছিল, কিন্তু ইংরেজ অফিসাররা অনেক চেষ্টায় তাদের নিরস্ত করে রাখতে সমর্থ হন। এটা কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন ইংরেজ অফিসারদের প্রশংসা করলেও আমি তার কথা ধ্রুবসত্য বলে মেনে নিতে পারিনি। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি যে সেনাবাহিনী অবিভক্ত থাকাকালেও তার কিছু কিছু অংশ পাকিস্তানে হিন্দু ও শিখদের এবং ভারতে মুসলমানদের হত্যা করেছিল এবং সে কাজ তারা করেছিল ইংরেজ অফিসারদের জ্ঞাতসারেই। ভারতীয় বাহিনীর গৌরবময় ঐতিহ্য এইভাবেই বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল এবং কিছুদিন আগে পর্যন্ত সৈনিকদের মধ্যে যে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব বিদ্যমান ছিল, সাম্প্রদায়িকতার বিষে তা জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল।
আমি তখন আরো বলেছিলাম যে রাজনৈতিক কারণে আমরা দেশবিভাগ মেনে নিতে বাধ্য হলেও সরকারি কর্মচারীদের, বিশেষ করে উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের তাদের নিজ নিজ অঞ্চল থেকে সরিয়ে আনবার কোনো কারণ নেই। আমার মতে তাদের নিজ নিজ প্রদেশে রাখাই উচিত ছিল। অর্থাৎ পশ্চিম পাঞ্জাব, হিন্দু অথবা পূর্ববঙ্গের অফিসাররা যে সম্প্রদায়ের লোকই হোন না কেন, তাদের পাকিস্তানেই রাখা উচিত এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অফিসাররা হিন্দু অথবা মুসলমান যাই হোন না কেন, তাদের ভারতেই রাখা উচিত। আমি এই অভিমত পোষণ করতাম কারণ তারা যদি নিদেনপক্ষে সরকারি কর্মচারীদেরও সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্ত রাখতে পারতেন, তাহলে উভয় রাষ্ট্রেই অসাম্প্রদায়িক আবহাওয়ার সৃষ্টি হতো। কিন্তু দুঃখের কথা এই, আমার কথামতো কাজ হয়নি। এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তা হলো সরকারি কর্মচারীরা কোন রাষ্ট্রে থাকবেন তা তারা নিজেরাই স্থির করবেন। এই সিদ্ধান্তের ফলে হিন্দু এবং শিখ কর্মচারীরা ভারতে আসতে চাইলেন এবং মুসলমান কর্মচারীরা পাকিস্তানে যেতে চাইলেন।
এই বিষয় নিয়ে আমি তখন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গেও আলোচনা করেছিলাম। সেনাবাহিনী ও সরকারি কর্মচারীদের সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বিভক্ত করলে তার ফলাফল যে বিপজ্জনক হতে পারে সে কথাও তাকে বলেছিলাম। লর্ড মাউন্টব্যাটেনও এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত হন এবং আমার কথামতো কাজ করতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর ব্যাপারে তিনি কিছুই করতে পারেননি। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের হস্তক্ষেপে অসামরিক কর্মচারীদের ক্ষেত্রে পূর্ব-গৃহীত সিদ্ধান্তের কিছু পরিবর্তন করা হয়। স্থির হয় যে সরকারি কর্মচারীরা কোনো রাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে অথবা অস্থায়ীভাবে থাকতে চাইলে তাদের অভিমত কর্তৃপক্ষের কাছে জানিয়ে দেবেন। স্থায়ীভাবে যারা থাকতে চান তাদের সম্বন্ধে কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু যারা অস্থায়ীভাবে থাকার সিদ্ধান্ত জানাবেন তাদের সম্বন্ধে স্থির হয় ছয় মাস পরে তারা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে পারবেন। উভয় রাষ্ট্রই স্বীকার করে নেয় পরবর্তীকালে যেসব কর্মচারী তাদের কর্মস্থল পরিবর্তন করে অপর রাষ্ট্রে যেতে চাইবেন তাদের সে সুযোগ দেওয়া হবে এবং পূর্বে তারা যে যে পদে এবং যত বেতনে নিযুক্ত ছিলেন সেই সেই পদে অথবা তার অনুরূপ পদে সেই সেই বেতনেই নিযুক্ত করা হবে এবং তাদের চাকরির ধারাবাহিকতাও রক্ষা করা হবে। কিন্তু এইসব কর্মচারীদের তখন এ কথা বলা হলেও পরবর্তীকালে (অর্থাৎ এক রাষ্ট্র থেকে অন্য রাষ্ট্রে গেলে) তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা হয়নি।
এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, সরকারি কর্মচারীদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারেও মুসলিম লীগ মূর্খের মতো এবং অন্ধভাবে কাজ করে। লীগের নেতারা সমস্ত মুসলমান কর্মচারীকে ভারত ত্যাগ করে পাকিস্তানে চলে যাবার জন্য উস্কানি দেন। সে সময় কেন্দ্রীয় সরকারের সদর দপ্তরে অনেক মুসলমান কর্মচারী গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মুসলিম লীগ তাদের সবাইকে পাকিস্তানে চলে যাবার জন্য চাপ দেয়। লীগের এই চাপ সত্ত্বেও যেসব মুসলমান অফিসার তাদের নিজ নিজ পদে থাকতে চান, তাদের এই বলে ভয় দেখানো হয় কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে তাদের অবস্থা রীতিমতো সঙ্গীন হয়ে পড়বে। মুসলিম অফিসারদের মধ্যে এই ধরনের গুজব সৃষ্টি হয়েছে জানতে পেরে আমি ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে তার বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে বলবার জন্য চাপ দিই। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এবং জওহরলাল উভয়েই আমার কথা মেনে নেন এবং একটি সার্কুলার জারি করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মচারীদের আশ্বাস দেন তারা যদি ভারতে থাকতে চান, তাহলে তাদের পদ ও ক্ষমতা অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং সর্বদা তাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করা হবে।
এই সার্কুলার প্রচারিত হবার ফলে কেন্দ্রীয় দপ্তরের মুসলমান অফিসারদের মনে নিরাপত্তার ভাব জেগে ওঠে এবং অনেক অফিসারই তখন ভারতে থাকবেন বলে স্থির করেন। এদিকে মুসলিম লীগের নেতারা যখন এই বিষয়টি জানতে পারেন, তখন তারা সেইসব মুসলমান অফিসারদের মনে নানাভাবে ভীতির সঞ্চার করতে শুরু করেন। এই অফিসাররা আগে থেকেই তাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে সন্দিহান হয়েছিলেন। এবার তাদের এই বলে ভয় দেখানো হতে লাগল, তারা যদি ভারতে থাকেন তাহলে মুসলিম লীগ এবং পাকিস্তান সরকার তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করে শত্রুর মতো ব্যবহার করবে।
এইসব অফিসারদের মধ্যে এমনও অনেকে ছিলেন যাদের পৈতৃক বাসস্থান পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তারা যখন বুঝতে পারলেন মুসলিম লীগের পাণ্ডারা তাদের পাকিস্তানের ধনসম্পত্তি এবং আত্মীয়স্বজনের ওপরে প্রতিশোধ নিতে পারে, তখন তারা রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। আমার নিজের মন্ত্রকে কয়েকজন উচ্চপদস্থ মুসলমান অফিসার ছিলেন। তারা আমার কথায় নিশ্চিন্ত হয়ে ভারতে থাকবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ তাদের পাকিস্তানের সম্পত্তি এবং আত্মীয়স্বজনদের ওপর প্রতিশোধ নেবে বুঝতে পেরে রীতিমতো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে কয়েকজন আমার কাছে এসে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, আমরা ভারতে থাকব বলেই স্থির করেছিলাম, কিন্তু মুসলিম লীগ এখন যেভাবে ভীতি প্রদর্শন করছে তাতে এখানে থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। আমাদের পরিবার এবং আত্মীয়স্বজন রয়েছে পশ্চিম পাঞ্জাবে। আমরা তাদের অত্যাচারিত হতে দিতে পারি না। সুতরাং বাধ্য হয়ে আমাদের এখন পূর্ব-সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পাকিস্তানে যাবার জন্য নতুন করে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।
মুসলিম লীগ কর্তৃক মুসলমান অফিসারদের এইভাবে ভারত থেকে তাড়িয়ে পাকিস্তানে নিয়ে যাবার কাজটি শুধু মূর্খের মতোই ছিল না, এটা বিপজ্জনকও ছিল। প্রকৃতপক্ষে ভারতের মুসলমানদেরই এতে বিপদাপন্ন করা হয়েছিল। দেশবিভাগ যখন মেনে নেওয়া হয়েছে এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, তখন নবগঠিত রাষ্ট্রে মুসলমানরাও যে সব রকম সুযোগ-সুবিধা পাবেন তাতে কোনোই সন্দেহ থাকার কথা নয়। এর ওপর যদি কিছু সংখ্যক মুসলমান সরকারি চাকরিতে নিযুক্ত থাকেন, তাহলে তারা যে শুধু ব্যক্তিগতভাবেই সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন তাই নয়, সরকারি দপ্তরে তাদের পদাধিকারের কল্যাণে সামগ্রিকভাবে মুসলমান সমাজও নিরাপদ বোধ করবেন এবং তাদের মন থেকে ভীতি দূর হবে। মুসলিম লীগ কী রকম মূর্খের মতো দেশবিভাগের জন্য বায়না ধরেছিল সে কথা আগেই বলেছি। এবার মুসলমান অফিসারদের প্রতি লীগ যেরকম ব্যবহার করছে তাতে তাদের মূর্খামি আর একবার প্রকটিত হলো।
আলোচনায় স্থির হয়, ১৯৪৭ সনের ১৫ই আগস্ট ভারত ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হবে। মুসলিম লীগ সিদ্ধান্ত নেয়, পাকিস্তান ডোমিনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হবে একদিন আগে অর্থাৎ ১৪ই আগস্ট তারিখে। এই বিষয়েও দুঃখজনক একটি ঘটনা ঘটে। ব্রিটিশ কমনওয়েলথে এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল যে ডোমিনিয়নগুলো তাদের নিজস্ব গভর্নর জেনারেল মনোনীত করতে পারবে। এই পদ্ধতি অনুসারে আমরা একজন ভারতীয়কে গভর্নর জেনারেল মনোনীত করতে পারতাম। কিন্তু আমরা স্থির করি, এ ব্যাপারে হঠাৎ কোনো রকম পরিবর্তন ঘটানো ঠিক হবে না। আমরা মনে করি, লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে যদি এই পদে আরো কিছুদিন রাখা যায়, তাহলে তিনি সুষ্ঠুভাবে সরকারি নীতি প্রয়োগ করে শাসনকার্য পরিচালনা করতে পারবেন। আমরা আরো মনে করি, প্রাথমিক স্তরে উভয় ডোমিনিয়নে একই ব্যক্তি গভর্নর জেনারেল থাকলে ভালো হয়। এ ব্যাপারে পরিবর্তন যদি কিছু করতেই হয় তা করা যাবে পরবর্তীকালে। আমরা মনে করেছিলাম পাকিস্তানও এ প্রস্তাব মেনে নেবে।
আমরা তাই লর্ড মাউন্টব্যাটেনকেই ভারত ডোমিনিয়নের প্রথম গভর্নর জেনারেল হিসেবে মেনে নিই ও সেইভাবেই ঘোষণা প্রচার করি। আমরা আশা করেছিলাম মুসলিম লীগও এইরকম সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে লীগ আমাদের বিস্মিত করে ঘোষণা করে, মিঃ জিন্নাহ হবেন পাকিস্তান ডোমিনিয়নের প্রথম গভর্নর জেনারেল। লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন লীগের এই সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারেন, তখন তিনি আমাদের বলেন লীগের সিদ্ধান্তের ফলে সমগ্র পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয়ে গেছে; সুতরাং আমরাও যেন আমাদের পূর্ব-সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে একজন ভারতীয়কে গভর্নর জেনারেল মনোনীত করি। আমরা এর কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনি। সুতরাং আমরা আর একবার ঘোষণা করি, লর্ড মাউন্টব্যাটেনই হবেন ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন