১০. আহম্মদনগর ফোর্ট জেল
আমাকে এবং ওয়ার্কিং কমিটির নজন সদস্যকে আহম্মদনগর ফোর্টে নিয়ে আসা হয়। যে নজন সদস্যকে এখানে আনা হয় তারা হলেন, জওহরলাল নেহরু, সর্দার প্যাটেল, আসফ আলী, শঙ্কররাও দেও, গোবিন্দবল্লভ পন্থ, ডঃ পট্টভি সীতারামাইয়া, ডঃ সৈয়দ মামুদ, আচার্য কৃপালনী এবং ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ। রাজেনবাবু যদিও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন, কিন্তু তিনি বোম্বাইয়ের সভায় উপস্থিত ছিলেন না বলে তাঁকে পাটনায় গ্রেপ্তার করে সেখানেই বন্দী করে রাখা হয়।
দুর্গের ভেতরে যে দালানটায় আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সেটা দেখতে অনেকটা মিলিটারী ব্যারাকের মতো। প্রায় ২০০ ফিট লম্বা একটা ফাঁকা উঠোনের চারপাশ ঘিরে অনেকগুলো ঘর। পরে আমরা জানতে পারি, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিদেশী বন্দীদের এখানে রাখা হয়েছিলো। আমাদের খবরদারি করবার জন্য পুনা থেকে একজন জেলারকে ওখানে পাঠানো হয়েছিলো। প্রথমেই সে আমাদের জিনিসপত্রগুলো তল্লাসী শুরু করলো। আমার একটি ছোট পোর্টেবল রেডিও ছিলো। ওটাকে আমি সব সময় আমার কাছে রাখতাম। জেলার মশাই আমার অন্যান্য জিনিসগুলো আমাকে দিলেও রেডিওটাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। ওটা আবার আমাকে ফেরত দেওয়া হয় মুক্তির দিনে। তার আগে পর্যন্ত ওটাকে আমি দেখতেই পাইনি।
কিছুক্ষণ পরেই লোহার থালায় করে আমাদের খেতে দেওয়া হলো। থালাগুলো দেখে আমাদের মেজাজ খাট্টা হয়ে গেলো। আমি তখন জেলারকে বললাম, “আমরা চীনামাটির প্লেটে খেতে অভ্যস্ত। লোহার থালা আমাদের মোটেই পছন্দ নয়।” আমার কথার উত্তরে জেলার বিনীতভাবে বললেন, পরদিন থেকে আমাদের জন্য ডিনার সেট আনা হবে। আমাদের খাদ্য তৈরি করবার জন্য পুনা থেকে একজন কয়েদীকে নিয়ে আসা হয়েছিলো। লোকটি আমাদের পছন্দমতো খাবার তৈরি করতে পারতো না বলে কয়েকদিন পরেই তার বদলে নতুন একজন রসুইদারকে নিয়ে আসা হয়। এ লোকটার রান্নাও তথৈবচ।
আমাদের যে আহম্মদনগর দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়েছে, তা সযত্নে গোপন রাখা হয়েছিলো। আমার কিন্তু মনে হয়েছিলো, ওই গোপনতা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়, কারণ খবরটা বেশিদিন গোপন রাখা সম্ভব হবে না। যাই হোক, গভর্নমেন্টের এই ধরনের অতিরিক্ত সতর্কতা দেখে আমি মোটেই বিস্মিত হইনি। এইসব ব্যাপারে সব গভর্নমেন্টই এই ধরনের বোকামি করে থাকে।
দু-তিনদিন পরে বোম্বাইয়ের ইনস্পেক্টর জেনারেল অব প্রিজনস্ আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি আমাদের জানিয়ে দেন, আমরা কোনো চিঠিপত্র লিখতে পারবো না, এমনকি আত্মীয়স্বজনদের কাছেও না। তাছাড়া আমাদের নামে যেসব চিঠিপত্র আসবে সেগুলোও আমাদের দেওয়া হবে না এবং কোনো সংবাদপত্রও আমাদের সরবরাহ করা হবে না। এটা নাকি গভর্নমেন্টের আদেশ। তিনি বিনয় প্রকাশ করে বলেন, গভর্নমেন্টের নির্দেশ তাঁকে পালন করতেই হবে। তবে এইসব সুযোগ-সুবিধা ছাড়া আমরা আর যা যা চাইবো তা তিনি আনন্দের সঙ্গেই আমাদের দেবেন।
আমি যখন কলকাতা থেকে বোম্বাইতে আসি, তখন আমার শরীরটা ভালো ছিলো না। এ.আই.সি.সি.র মিটিংয়ের সময়ও আমি ইনফ্লুয়েঞ্জায় ভুগছিলাম। এ কথা গভর্নমেন্টও জানতেন। ইনস্পেক্টর জেনারেল নিজেও একজন ডাক্তার। তিনি তাই আমার রোগ পরীক্ষা করতে চাইলেন। আমি কিন্তু তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হইনি।
আমরা বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলাম বলে বাইরে কী হচ্ছে তা আমরা জানতেই পারিনি। এই অবস্থায় থাকলে আমাদের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়বে মনে করে আমরা একটা কিছু করবার কথা চিন্তা করতে থাকি। আগেই বলেছি, আমাদের ঘরগুলো একটা উঠোনকে বেষ্টন করে অবস্থিত ছিলো। আমি ছিলাম প্রথম ঘরে। দ্বিতীয় ঘরে জওহরলাল এবং তৃতীয় ঘরে ছিলেন আসফ আলী ও ডঃ সৈয়দ মাহমুদ। এই লাইনের শেষ ঘরটিকে আমাদের খাবার ঘর করা হয়েছিলো। সকাল আটটায় আমরা প্রাতঃরাশের জন্য এবং এগারোটায় দুপুরের খাবারের জন্য সেই ঘরটায় মিলিত হতাম। এরপর আমাদের আলাপ-আলোচনা চলতো আমার ঘরে বসে। বিভিন্ন ধরনের আলোচনা হতো ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আলোচনার পরে আমরা কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম। তারপর আবার আমরা বিকেলের চা পানের জন্য চারটের সময় পূর্বোক্ত খাবার ঘরে মিলিত হতাম। চা পানের পরে আমরা উন্মুক্ত উঠোনে কিছুক্ষণ ব্যায়াম করতাম। ডিনার সরবরাহ করা হতো রাত আটটার সময়। ডিনারের পরে রাত দশটা পর্যন্ত আবার চলতো আলোচনা। এরপর আমরা যে যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তাম।
আমরা যখন জেলখানায় এলাম, তখন ব্যারাকের ভিতরের উঠোনটা একেবারেই ফাঁকা ছিলো। উঠোনটা দেখে জওহরলাল একদিন বললেন, “ওখানে ফুলের বাগান তৈরি করলে বেশ হয়।” দিনের পর দিন নিষ্কর্মা অবস্থায় বসে বসে আমরা হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। বাগান করার প্রস্তাবটা তাই খুবই মনঃপূত হলো আমাদের। এতে আমরা কায়িক পরিশ্রম করবার সুযোগ পাবো। আমরা তাই সঙ্গে সঙ্গে জওহরলালের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে গেলাম। আমরা তখন জেল সুপারিন্টেন্ডেন্টকে বললাম, তিনি যেন পুনা থেকে ফুলগাছের কিছু বীজ আনিয়ে দেন। এরপর আমরা সবাই মিলে লেগে গেলাম জমি তৈরি করতে। বলা বাহুল্য, এ ব্যাপারে জওহরলালই নেতৃত্ব নিয়েছিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই বীজ এসে গেলো। আমরা তিরিশ-চল্লিশ রকমের বীজ পুঁতে প্রতিদিন তাতে জল সেচন করতে শুরু করলাম। বীজ থেকে যখন অঙ্কুরোদগম হলো, তখন আমাদের কী আনন্দ! যেন একটা কাজের মতো কাজ করে ফেলেছি। এরপর গাছগুলো বড় হয়ে যখন ফুল ফুটলো, তখন উঠোনটা ভারী সুন্দর দেখাতে লাগলো।
আমরা জেলখানায় আসবার দিন পাঁচেক পরে একজন অফিসার এসে জেলখানার ভার নিলেন। শুনতে পেলাম, সে এসেছে জেলের সুপারিন্টেন্ডেন্ট হয়ে। লোকটি শহরে থাকতো এবং প্রতিদিন সকাল আটটায় আসতো ও সন্ধ্যার সময় চলে যেতো। এর নাম আমরা জানতে পারিনি। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা বোধ করিনি। কারণ আমরা নিজেরাই ওর একটি নামকরণ করে নিয়েছিলাম। আমার মনে পড়ে যায়, চাঁদ বিবিকে যখন এই জেলখানায় বন্দিনী করে রাখা হয়েছিলো, তখন এখানে চিতা খাঁ নামে একজন জেলার ছিলো। আমি তাই প্রস্তাব করলাম, সুপারিন্টেন্ডেন্ট সাহেবকে এই নামটাই দেওয়া হোক। আমার সহকর্মীরা সঙ্গে সঙ্গে আমার প্রস্তাব মেনে নিলেন। নামটা এতোই জনপ্রিয় হয়েছিলো যে, কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো, সবাই তাঁকে চিতা খাঁ বলে উল্লেখ করছে। তিন-চারদিন পরে জেলার এসে আমাদের জানিয়ে দিয়ে গেলেন, চিতা খাঁ সেইদিন সকালেই ওখান থেকে বিদায় নিয়েছেন।
আমরা আরো জানতে পারি, এই চিতা খাঁ জাপানি আক্রমণের সময় পোর্ট ব্লেয়ারে ছিলো। পোর্ট ব্লেয়ার যখন জাপানের অধিকারে যায়, তখনও সে ওখানেই ছিলো।
২৫শে আগস্ট আমি ভাইসরয়কে একটি চিঠি লিখি। চিঠিতে আমি বলি, আমাকে এবং আমার সহকর্মীদের বিরুদ্ধে গভর্নমেন্ট যে ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে, তার বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। তবে জেলখানায় আমাদের প্রতি যেরকম ব্যবহার করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ আছে। জেলখানার কয়েদীদেরও তাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে চিঠি লিখতে দেওয়া হয়; কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে এটা অস্বীকার করা হয়েছে। চিঠিতে আমি আরো লিখি, দু-সপ্তাহের মধ্যে আমরা যদি গভর্নমেন্টের কাছ থেকে কোনোরকম সন্তোষজনক উত্তর না পাই, তাহলে আমি এবং আমার সহকর্মীরা পরবর্তী ব্যবস্থা সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবো।
১০ই সেপ্টেম্বর চিতা খাঁ আমাদের সঙ্গে দেখা করে বলে, সে গভর্নমেন্টের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছে আমরা আমাদের আত্মীয়স্বজনদের কাছে সপ্তাহে একবার করে চিঠি লিখতে পারবো। এছাড়া একটি দৈনিক পত্রিকাও প্রতিদিন আমাদের দেওয়া হবে। একটি ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ আমার টেবিলে দেওয়া হলো। পরদিন থেকে নিয়মিতভাবেই আমরা ওই সংবাদপত্র পেতে থাকি। সে রাতে বহুদিন পরে আমি খবরের কাগজ পড়ি। প্রায় এক মাস যাবৎ আমরা বাইরের কোনো খবরই জানতে পারিনি। এতদিন পরে দেশের খবরাখবর এবং যুদ্ধের অবস্থা আমরা জানতে পারি।
পরদিন আমি চিতা খাঁকে বলি, সে যেন পত্রিকার পুরনো সংখ্যাগুলো আমাদের দেয়। গভর্নমেন্ট আমাদের সংবাদপত্র সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে বলে চিতা খাঁ আমার প্রস্তাবটি মেনে নেয়। দু-তিনদিন পরেই ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’র পুরনো সংখ্যাগুলোর একটি সম্পূর্ণ ফাইল আমাদের দেওয়া হয়। আমার গ্রেপ্তারের দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত প্রতিটি সংখ্যাই সে ফাইলে ছিলো।
পত্রিকাগুলো পড়বার পর আমি জানতে পারি, আমি যা আগে অনুমান করেছিলাম, ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলন ঠিক সেই পথেই গেছে। বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং বোম্বাইতেই সরকারবিরোধী আন্দোলন বেশি করে বিস্তৃত হয়েছে। ওইসব প্রদেশে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপর্যয় সৃষ্টি করা হয়েছে এবং বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া বহুসংখ্যক থানা এবং রেলস্টেশন পুড়িয়ে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বহুসংখ্যক মিলিটারি লরিও পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধের সাজসরঞ্জাম তৈরি প্রচণ্ডভাবে ব্যাহত হয়েছে। এক কথায় বলা চলে, জনসাধারণ হিংসা দ্বারাই সরকারি হিংসা নীতির মোকাবিলা করছে। আমি ঠিক এইরকমই অনুমান করেছিলাম। এবং এইরকম একটা কিছু ঘটবে বা ঘটতে পারে ভেবেই কর্মীদের যথাযোগ্য নির্দেশ দিয়েছিলাম। সহকর্মীদের সঙ্গেও এ ব্যাপারে আমি তখন আলোচনা করেছিলাম।
১৯৪২-এর পরবর্তী মাসগুলোতে তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সংঘটিত হয়নি।
কিন্তু ১৯৪৩ শুরু হতেই আবহাওয়া আবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সংবাদপত্র থেকে জানতে পারি, গান্ধীজী একুশ দিন অনশন করবার সংকল্প নিয়েছেন এবং তাঁর সেই সংকল্পের কথা একটি চিঠিতে ভাইসরয়কে জানিয়ে দিয়েছেন। এই অনশনকে তিনি আত্মশুদ্ধির জন্য প্রয়োজন বলে ঘোষণা করেছেন। আমার মনে হয়, দুটি প্রধান কারণে গান্ধীজী এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। আমি আগেই বলেছি, গান্ধীজীর ধারণা ছিলো, গভর্নমেন্ট তাড়াহুড়ো করে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না; এবং এই ধারণার বশবর্তী হয়েই তিনি ভেবেছিলেন, নিজের অহিংস পদ্ধতিতে আন্দোলন পরিচালনা করবার যথেষ্ট সময় এবং সুযোগ তিনি পাবেন। কিন্তু তাঁর সব আশাই ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়ায় সমস্ত বিষয়ের জন্য তিনি নিজেকে দায়ী মনে করেন এবং এইজন্যই তিনি অনশন করে আত্মশুদ্ধি করবার প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। আমি কিন্তু তাঁর এই অনশনের মতলবটা খুশি মনে মেনে নিতে পারিনি। ব্যাপারটা আমার কাছে নিতান্তই অযৌক্তিক মনে হয়েছিলো।
ওদিকে গভর্নমেন্ট কিন্তু ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, গান্ধীজীর যা বয়স এবং তাঁর স্বাস্থ্যের যেরকম অবস্থা, তাতে একুশ দিন অনশন করা মানেই ইচ্ছামৃত্যু বরণ করা। তাঁরা আরো ভেবেছিলেন, বিশ্বের চোখে তাঁর মৃত্যুর জন্য গভর্নমেন্টকে দায়ী করবার উদ্দেশ্যেই তিনি অনশনের মতলব করেছেন। পরে আমরা জানতে পারি, গান্ধীজীর মৃত্যু হবেই ধরে নিয়ে তাঁকে দাহ করবার জন্য গভর্নমেন্ট চন্দনকাঠও সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। গভর্নমেন্ট আরো স্থির করেছিলেন, গান্ধীজীর মৃত্যু হলেও তারা তাঁদের নীতি পরিবর্তন করবেন না। তাঁরা আরো স্থির করেছিলেন, গান্ধীজীকে আগা খাঁ প্রাসাদেই সৎকার করা হবে এবং সৎকারের পরে তাঁর চিতাভস্ম তাঁর ছেলেদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
এই সময় কলকাতা থেকে ডাঃ বি. সি. রায় গভর্নমেন্টকে একটি চিঠি লিখে তাতে প্রস্তাব করেন, গান্ধীজীর অনশনের সময় তিনি তাঁর কাছে থাকতে চান। গভর্নমেন্ট এতে কোনো আপত্তি জানায় না। অনশন শুরু হবার পরে এমন একটা সময় আসে, যখন গান্ধীজীর চিকিৎসকরা তাঁর প্রাণের আশা পরিত্যাগ করেন। কিন্তু অসাধারণ মনোবল এবং জীবনীশক্তির সাহায্যে গান্ধীজী সে ধাক্কা কাটিয়ে ওঠেন এবং একুশদিন পর অনশন ভঙ্গ করেন।
গান্ধীজীর অনশনের পরে উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হয়ে এলে আমরা আবার আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্মে মনোযোগ দিই। তাঁর অনশনের সময় বারবার আমাদের মনে হয়েছে, বন্দীজীবনের অসহায় অবস্থার কথা।
গত কয়েক বছর যাবৎ আমার স্ত্রীর স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছিলো না। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে আমি যখন নাইনি জেলে বন্দী ছিলাম, তখন তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছিলো। মুক্তিলাভের পর আমি তাঁর সম্বন্ধে ডাক্তারদের মতামত নিই। তাঁরা সবাই বায়ু পরিবর্তনের কথা বলেন। এরপর স্ত্রীকে আমি রাঁচিতে পাঠিয়ে দিই। রাঁচি থেকে তিনি ফিরে আসেন ১৯৪২-এর জুলাই মাসে। সে সময় তিনি অপেক্ষাকৃত ভালো ছিলেন বলে আমি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে বোম্বাই রওনা হই। এরপর তাঁর অবস্থা আবার খারাপ হয়ে পড়ায় আমি বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ি। ৯ই আগস্ট আমার গ্রেপ্তার হবার সংবাদে তিনি রীতিমতো বিচলিত হয়ে পড়েন এবং তাঁর অবস্থা আবার খারাপ হয়ে পড়ে। আমার বন্দিদশায় তাঁর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে আমার মনটা সব সময়ই খারাপ হয়ে থাকতো।
১৯৪৪-এর প্রথম দিকে আমি বাড়ি থেকে আবার খবর পাই তাঁর অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। পরবর্তীকালে তাঁর অবস্থা যখন আরো খারাপ হয়ে পড়ে, তখন তাঁর চিকিৎসকরা রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন এবং আমাকে তাঁর সঙ্গে একবার দেখা করতে দেবার প্রার্থনা জানিয়ে গভর্নমেন্টের কাছে আবেদন করেন। গভর্নমেন্ট কিন্তু তাঁদের এই আবেদনে কর্ণপাতও করেননি। আমিও একই উদ্দেশ্য জানিয়ে ভাইসরয়ের কাছে একটা চিঠি লিখি। কিন্তু তাতেও কোনো ফল হয় না।
এপ্রিল মাসের কোনো এক তারিখে চিতা খাঁ হঠাৎ দুপুরবেলায় আমার সঙ্গে দেখা করে। এটা একেবারেই অস্বাভাবিক ব্যাপার ছিলো, কারণ ওইরকম সময় সে আর কোনোদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেনি। সে কোনো কথা না বলে আমার হাতে একটি টেলিগ্রাম তুলে দেয়। টেলিগ্রাম সাংকেতিক ভাষায় ইংরেজিতে লেখা ছিলো। কিন্তু তার একটি ইংরেজি অনুবাদও ওই সঙ্গে ছিলো। টেলিগ্রাম এসেছিলো কলকাতা থেকে এবং তাতে লেখা ছিলো, আমার স্ত্রী আর জীবিত নেই। টেলিগ্রাম দেখবার পরে আমি ভাইসরয়কে আবার একটি চিঠি লিখি। সেই চিঠিতে আমি তাকে জানিয়ে দিই, গভর্নমেন্ট ইচ্ছা করলে আমাকে সাময়িকভাবে কলকাতার জেলখানায় বদলি করতে পারতেন এবং তা করা হলে আমি আমার স্ত্রীর অন্তিম সময়ে তাঁকে একবার চোখের দেখাটাও দেখতে পারতাম। এ চিঠিরও কোনো উত্তর আমাকে দেওয়া হয়নি।
তিন মাস পরে আমার জন্য আর একটা দুঃসংবাদ জমা হয়ে ছিলো। আমার বোন আবরু বেগম ভোপালে বাস করতো। হঠাৎ খবর পেলাম, সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এরপর দু-সপ্তাহের মধ্যে তার মৃত্যুসংবাদ শুনতে পাই আমি।
এই সময় হঠাৎ একদিন খবরের কাগজ থেকে জানতে পারি গান্ধীজীকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। খবরটা পড়ে আমার মনে হয়, গান্ধীজী নিজেও তাঁর এই মুক্তির খবর আগে থেকে জানতেন না। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাঁদের নীতি পরিবর্তন করেছেন এবং সেইজন্যই তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী ঘটনাবলি থেকে জানা যায়, এ ব্যাপারেও তাঁর অনুমান অভ্রান্ত ছিলো না। আসল ঘটনা হলো, অনশনের পরে তাঁর স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে এবং তিনি একটা না একটা অসুখে ভুগতে থাকেন। পুনার সিভিল সার্জন তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে গভর্নমেন্টের কাছে এক রিপোর্ট দেন। রিপোর্টে তিনি লেখেন, গান্ধীজী আর বেশিদিন বাঁচবেন না। সিভিল সার্জনের এই রিপোর্ট পড়বার পরেই ভাইসরয় গান্ধীজীকে মুক্তি দেবার সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর মৃত্যুর দায়িত্ব যাতে গভর্নমেন্টের ওপর না বর্তায়, সেইজন্যই তিনি এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এছাড়া রাজনৈতিক অবস্থা যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছিলো, তাতে তাঁকে ভয় করবার মতো কোনো কারণ আছে বলেও ইংরেজরা আর মনে করতো না। যুদ্ধের অবস্থা তখন ইংরেজদের অনুকূলে এসে গেছে। মিত্রপক্ষের জয় এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। গভর্নমেন্ট আরো মনে করেছিলেন, কংগ্রেসের সব নেতাই যখন জেলে আবদ্ধ রয়েছেন, সে অবস্থায় গান্ধীজী একা কিছু করতে পারবেন না। অপরদিকে তাঁর মুক্তিতে ভারতবাসীর হিংস মনোভাবেরও অবসান হবে এবং তারা হিংসার পথ থেকে সরে যাবে।
মুক্তির পরেও কিছুদিন গান্ধীজী খুবই অসুস্থ ছিলেন। তিনি এতোই অসুস্থ ছিলেন যে, কোনোরকম কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করবার সাধ্যও তাঁর ছিলো না। কয়েক মাস যাবৎ চিকিৎসা চলে। এরপর শরীরের অবস্থা একটু ভালো হলেই আবার তিনি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শুরু করেন।
তাঁর সেই সময়কার রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যে দুটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। একটি হলো মুসলিম লীগের সঙ্গে একটা বোঝাপড়ায় আসবার জন্য মিঃ জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাৎকার এবং অপরটি হলো সরকারের সঙ্গে আর একবার আলোচনার প্রচেষ্টা। তিনি তাঁর পূর্ববর্তী ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি না রেখে লন্ডনের ‘নিউজ ক্রনিক্যাল’ পত্রিকায় এক বিবৃতি প্রকাশ করেন। সেই বিবৃতিতে তিনি বলেন, ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেওয়া হলে ভারতবাসী স্বেচ্ছায় ইংরেজের পক্ষে যোগ দেবে এবং যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে সর্বতোভাবে তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। গান্ধীজীর সেই বিবৃতি পড়ে আমি বিস্ময়ে অবাক হয়ে যাই। আমার তখন বারবার মনে হতে থাকে, তাঁর উভয় প্রচেষ্টাই বিফল হবে।
আমার মতে এই সময় মিঃ জিন্নার সঙ্গে আলোচনা করতে চেয়ে গান্ধীজী এক বিরাট ভুল করেছিলেন। এর ফলে মিঃ জিন্নার গুরুত্ব বিশেষভাবে বৃদ্ধি পায় এবং তিনি তার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন। জিন্নার প্রতি গান্ধীজীর মনোভাব প্রথম থেকেই দুর্বোধ্য ছিলো। মিঃ জিন্না কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যাবার পর তাঁর রাজনৈতিক গুরুত্ব বিশেষভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু গান্ধীজীর ভ্রান্ত কার্যকলাপের ফলে মিঃ জিন্না আবার ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্ব অর্জন করতে সমর্থ হন। গান্ধীজী যদি তাঁর প্রতি ওই ধরনের মনোভাব পোষণ না করতেন, তাহলে জিন্না সাহেব পুনরায় রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রাধান্য অর্জন করতে পারতেন কিনা সে বিষয়ে আমার রীতিমতো সন্দেহ আছে। ভারতের মুসলমান সমাজের এক বিরাট অংশ মিঃ জিন্না এবং তাঁর অনুসৃত নীতিকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। কিন্তু তাঁরা যখন দেখতে পান গান্ধীজী অনবরত তাঁর পেছনে ছুটছেন এবং নানাভাবে তাঁকে তোয়াজ করছেন, তখন অনেকেই মিঃ জিন্নাকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেন। তাঁরা তখন মনে করতে থাকেন, সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় এবং সুবিধেজনক শর্তাবলি গ্রহণের ব্যাপারে মিঃ জিন্নাই সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তি।
এই প্রসঙ্গে আমি আরো একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই। কথাটি হলো, গান্ধীজীই সর্বপ্রথমে মিঃ জিন্নাকে ‘কায়েদ-ই-আজম’ অর্থাৎ মহান নেতা বলে উল্লেখ করেন। গান্ধীজীর আশ্রমে আমতুস সালাম নামে একজন ধর্মপ্রাণা মহিলা বাস করতেন। তিনি নাকি কোনো এক উর্দু পত্রিকায় দেখেছিলেন মিঃ জিন্নাকে ‘কায়েদ-ই-আজম’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। গান্ধীজী যখন মিঃ জিন্নার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চেয়ে তাঁর কাছে চিঠি লিখতে বসেছিলেন, সেই সময় আমতুস সালাম তাঁকে বলেন, বিভিন্ন উর্দু পত্রিকায় জিন্না সাহেবকে ‘কায়েদ-ই-আজম’ বলে অভিহিত করা হয়েছে; অতএব তিনিও (গান্ধীজীও) ওই কথাটা ব্যবহার করতে পারেন। গান্ধীজী তখন কিছুমাত্র চিন্তা না করেই তাঁর চিঠিতে মিঃ জিন্নাকে ‘কায়েদ-ই-আজম’ বলে সম্বোধন করেন। কিছুদিন পরেই গান্ধীজীর সেই চিঠিটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ওই চিঠিতে গান্ধীজী মিঃ জিন্নাকে ‘কায়েদ-ই-আজম’ বলে সম্বোধন করেছেন দেখে ভারতীয় মুসলমানরা মনে করতে থাকেন, সত্যিই বুঝি মিঃ জিন্না একজন মহান নেতা বা ‘কায়েদ-ই-আজম’। ১৯৪৪-এর জুলাই মাসে আমি যখন সংবাদপত্রে দেখতে পাই গান্ধীজী মিঃ জিন্নার কাছে চিঠিপত্র লিখছেন এবং তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্য বোম্বাই যাচ্ছেন, তখন আমি সহকর্মীদের বলি, গান্ধীজী একটা মহা ভুল করছেন। তাঁর এই কাজের ফলে রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতির পরিবর্তে অবনতি ঘটবে। পরবর্তী ঘটনাবলি প্রমাণ করে আমার অনুমানই সঠিক ছিলো। মিঃ জিন্না এই ঘটনার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে নিজের নেতৃত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি কিছুই করেন না এবং তার জন্য একটি কথাও বলেন না।
গান্ধীজীর দ্বিতীয় কার্য, অর্থাৎ গভর্নমেন্টের সঙ্গে আলোচনা করার প্রস্তাবটাও সময়োপযোগী হয়নি। এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলাম, যাতে যুদ্ধের ব্যাপারে কংগ্রেস একটি বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইতিবাচক মনোভাব গ্রহণ করে। সেই সময় গান্ধীজী বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো অহিংসার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা স্থাপন। তিনি সে সময় দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন, স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যদি অহিংসার নীতি বিসর্জন দিয়ে কংগ্রেস যুদ্ধের ব্যাপারে ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা করতে চায়, তাহলে তিনি কংগ্রেসে থাকবেন না। কিন্তু আজ তিনিই বলছেন, ভারতবর্ষকে যদি স্বাধীনতা দেওয়া হয়, তাহলে কংগ্রেস ইংরেজের সঙ্গে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে। তাঁর পূর্বতন ঘোষণার সঙ্গে বর্তমান উক্তির আকাশপাতাল প্রভেদ দেখে দেশে এবং বিদেশে এক ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়। এর ফলে ভারতবাসীর মনে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তার চেয়েও দুর্ভাগ্যজনক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় ব্রিটেনে। ইংরেজদের মধ্যে অনেকেই মনে করতে থাকেন, যুদ্ধের অবস্থা যখন ইংরেজদের প্রতিকূলে ছিলো, সেই সময় গান্ধীজী তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করতে অথবা যুদ্ধের ব্যাপারে কোনোরকম সাহায্য করতে চাননি। কিন্তু বর্তমানে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হওয়ায় তিনি সহযোগিতার কথা বলছেন। আমি কিন্তু মনে করি, যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি লক্ষ্য করে গান্ধীজী তাঁর মত এবং পথ পরিবর্তন করেছেন বলে তাঁরা যা ভেবেছেন, সেটা মোটেই সঠিক নয়। কিন্তু আমি যা-ই ভাবি না কেন, ইংরেজরা গান্ধীজীর প্রস্তাবের এই ব্যাখ্যাই করেন যে, মিত্রপক্ষের বিজয় প্রায় অবধারিত দেখে তিনি ইংরেজদের সহানুভূতি পাবার জন্য নতুন করে চেষ্টা শুরু করেছেন। এবং এইরকম ধারণার বশবর্তী হবার ফলেই গান্ধীজীর প্রস্তাবের প্রতি তারা কর্ণপাত করেন না। এছাড়া, আগে যেমন ভারতের সাহায্য বিশেষ প্রয়োজন বলে ইংরেজরা মনে করতেন, বর্তমানে তাঁরা তা মনে করেন না। গান্ধীজীর প্রস্তাবের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করার এটাও একটা কারণ।
আজ এই ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে এই বই লিখবার সময় আমি যখন পেছনের ঘটনাবলির দিকে দৃষ্টিপাত করছি, তখন আমি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি, আগে যাঁরা গান্ধীজীর অহিংসা মন্ত্রের উপাসনা ছাড়া অন্য কিছু ভাবতেই পারতেন না, তাঁদের মনোভাবও পরবর্তীকালে বেশ কিছুটা পরিবর্তিত হয়। অতীতে কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত একটি প্রস্তাবে যখন বলা হয়েছিলো ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যদি ভারতবর্ষকে স্বাধীনতা দেন, তাহলে কংগ্রেস তাঁদের সঙ্গে সহযোগিতা করবে, তখন সর্দার প্যাটেল, ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, আচার্য কৃপালনী এবং ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তাঁরা তখন লিখিতভাবে আমাকে জানিয়েছিলেন, ভারতের স্বাধীনতা অপেক্ষা অহিংসাই তাঁদের কাছে বেশি কাম্য। কিন্তু পরবর্তীকালে, অর্থাৎ ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষ যখন স্বাধীনতা লাভ করে, তখন এইসব নেতা কেউই এমন কথা বলেন না যে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী ভেঙে দেওয়া হোক। শুধু যে একথা বলেননি, তাই নয়, তাঁরা এমন কথাও বলেন, ভারতীয় বাহিনীকে বিভক্ত করে সরাসরি ভারত সরকারের অধীনে আনা হোক। তাঁদের এই প্রস্তাব তৎকালীন কমাণ্ডার-ইন-চীফের মতামতের সম্পূর্ণ বিরোধী ছিল। কমাণ্ডার-ইন-চীফ বলেছিলেন, ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীকে তিন বছর একই কমাণ্ডের অধীনে রাখা উচিত এবং এই তিন বছর উক্ত বাহিনী অভিজ্ঞ অবস্থায় ‘যুক্তভাবে কাজ করবে’; কিন্তু এই নেতারা তাতে রাজি হননি। এখানে প্রশ্ন ওঠে, অহিংসাই যদি তাদের একমাত্র উপাস্য মন্ত্র হয়, তাহলে তাঁরা কিভাবে সেই গভর্নমেন্টে অংশগ্রহণ করেন, যে গভর্নমেন্ট প্রতি বছর প্রতিরক্ষা খাতে একশো কোটি টাকা ব্যয় করেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার প্রতিরক্ষা খাতে আরো বেশি অর্থ ব্যয় করবার জন্যও সুপারিশ করেন। এখানে আরো উল্লেখযোগ্য, বর্তমানে প্রতিরক্ষা খাতে প্রায় দুশো কোটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে।
আমি সব সময়ই মনে করতাম, আমার এইসব বন্ধু এবং সহকর্মী রাজনৈতিক ব্যাপারে তাঁদের নিজেদের ইচ্ছামতো চলতেন না। ও ব্যাপারে তারা সর্বতোভাবে গান্ধীজীর কথামতো চলতেন। গান্ধীজীকে আমি তাঁদের চেয়ে কম শ্রদ্ধা করতাম না এবং এখনো করি না। কিন্তু আমি অন্ধভাবে তাঁর কথামতো চলি না। আমার কাছে এইটা সত্যিই বিস্ময়কর, কারণ ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে যাঁরা হিংসা-অহিংসার প্রশ্নে ওয়ার্কিং কমিটি থেকে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন, ভারত স্বাধীন হবার পর সে প্রশ্ন তাঁদের মন থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়ে গেলো। এক মুহূর্তের জন্যও তাঁদের মনে এ প্রশ্ন উঠলো না যে সশস্ত্রবাহিনী এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিরাট অর্থব্যয় না করে গভর্নমেন্ট চালাতে হবে। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ পরিহার করার কথাটাও তাঁরা বললেন না। এখানে উল্লেখযোগ্য, একমাত্র জওহরলালেরই এ ব্যাপারে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো এবং তিনি প্রথম থেকেই আমার অভিমতের সমর্থক ছিলেন। আমি মনে করি, পরবর্তী ঘটনাবলির লজিক অনুসারে আমাদের অভিমতই সঠিক বলে প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে খবরের কাগজে ‘ডি’ ডে সম্পর্কে একটা রিপোর্ট দেখতে পাই। যুদ্ধের মোড় মিত্রপক্ষের অনুকূলে আসবার দরুনই এই বিশেষ দিনটির কথা ঘোষিত হয়। মিত্রপক্ষের বিজয় এখন আর কল্পনার বস্তু নয়। সারা বিশ্ব এবার বুঝতে পারছে, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের বিরাট ব্যক্তিত্ব এবং দূরদৃষ্টিই বিজয়কে নিশ্চিত করেছে। ভবিষ্যতের চিত্রও ক্রমশ সুস্পষ্ট হয়ে আসছে। এশিয়া এবং আফ্রিকায় মিত্রপক্ষ জয়ী হয়েছে। এবার তারা হিটলারের সিটাডেল অভিমুখে মার্চ করছে। আমার কাছে এটা কিছু বিস্ময়কর বলে মনে হয়নি। জার্মানীর কার্যকলাপ দেখে আমার আগেই মনে হয়েছিলো, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মতো এবারের যুদ্ধেও দুই রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সে মারাত্মক রকমের ভুল করেছে। হিটলার যেদিন রাশিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়, সেইদিনই সে তার পতনের বীজ বপন করে। এখন আর ধ্বংসের হাত থেকে তার নিজের এবং তার দেশের রক্ষা পাবার আর কোনো পথই নেই।
এই সময় আমাদের ক্যাম্পে একটা অভাবিত ঘটনা ঘটে। চিতা খাঁ একদিন হঠাৎ আমার কাছে এসে বলে, ডঃ সৈয়দ মাহমুদকে মুক্তি দেবার জন্য সে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছে। খবরটা শুনে সবাই আমরা বিস্মিত হলাম। বেছে বেছে একজনকে মুক্তির আদেশ দেবার কোনো যুক্তি-সংগত কারণ আমরা দেখতে পেলাম না।
কয়েক মাস আগে আহম্মদনগরে মহামারীর আকারে কলেরা শুরু হয়েছিলো। চিতা খাঁ তখন আমাদের সবাইকে কলেরা প্রতিষেধক টিকা নিতে বলেছিলো। আমাদের মধ্যে পাঁচজন, অর্থাৎ জওহরলাল, পট্টভি সীতারামাইয়া, আসফ আলী, ডঃ সৈয়দ মাহমুদ এবং আমি তাঁর পরামর্শমতো কাজ করেছিলাম; কিন্তু বাকি চারজন, অর্থাৎ সর্দার প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী, শঙ্কররাও দেও এবং ডঃ প্রফুল্ল ঘোষ টিকা নিতে অস্বীকৃত হন। টিকা নেবার ফলে আমার বেশ একটু জ্বর হয়েছিলো, কিন্তু ডঃ সৈয়দ মাহমুদ অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। প্রায় পনেরো দিন যাবৎ তিনি প্রবল অবিরাম জ্বরে শয্যাগত ছিলেন। আমরা সবাই তাঁর সেবা করেছিলাম। জওহরলাল তো রীতিমতো নার্সের কাজ করেছিলেন সে সময়। শুধু কি তাই, তিনি নিজের হাতে রোগীর মলমূত্রও পরিষ্কার করেছিলেন। ডঃ মাহমুদ তখন চিতা খাঁর চিকিৎসাধীন ছিলেন। কিন্তু তাঁর মুক্তির আদেশ যখন এলো, তখন তিনি প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয়ে গেছেন। সুতরাং তাকে যে স্বাস্থ্যের জন্য মুক্তি দেওয়া হচ্ছে, এ কথাটা আমরা কেউই মেনে নিতে পারিনি। আমাদের মনে হয়েছিলো, এতে হয়তো গভর্নমেন্টের মতিগতির পরিবর্তন সূচিত হচ্ছে। হয়তো তাঁরা এখন আমাদের প্রতি কিছুটা সদয় ব্যবহার করবেন বলে স্থির করেছেন। পরবর্তীকালে অবশ্য এর আসল কারণটা আমি জানতে পেরেছিলাম। কিন্তু দীর্ঘকাল পরে ও ব্যাপারে আর কোনো আলোচনা করবার ইচ্ছা আমার নেই।
আমরা যদিও আমাদের মুক্তির সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু জানতে পারিনি, কিন্তু তবুও আমাদের মনে হয়েছিলো, মুক্তির হয়তো আর বেশি দেরি নেই। আসলেও তাই দেখা গেলো। ১৯৪৪-এর মাঝামাঝি গভর্নমেন্ট সিদ্ধান্ত নেন, আমাদের আর আহম্মদনগর দুর্গে বন্দী করে রাখার প্রয়োজন নেই। ওখানে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো বিভিন্ন কারণে। গভর্নমেন্ট হয়তো ভেবেছিলেন যে ওখানে আমাদের বন্দী থাকার খবরটা গোপন রাখা যাবে। তাঁরা আরো ভেবেছিলেন, আমাদের যদি কোনো অসামরিক জেলে রাখা হয়, তাহলে হয়তো জেলে থাকা অবস্থাতেই বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারবে। কিন্তু মিলিটারি জেলে রাখলে এটা সম্ভব হবে না। আহম্মদনগর ক্যাম্প জেলে তখন শুধু ইউরোপীয় সৈনিক ছাড়া আর কোনো রক্ষী ছিলো না। সুতরাং তাদের মাধ্যমে বাইরের কোনো লোকের সঙ্গে কোনো রকম যোগাযোগই আমরা করতে পারবো না; এবং এরকম কিছু করতে গেলে তারা নিশ্চয়ই বাধা দেবে। আমরা এমন প্রমাণও পেয়েছিলাম, আহম্মদনগর জেলে আসবার পর আমরা যাতে বাইরের কোনো লোকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে না পারি, তার জন্যে গভর্নমেন্ট বিশেষভাবে সচেতন এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমরা যে ব্যারাকে বাস করছিলাম, তার ছাদে কয়েকটা স্কাইলাইট ছিলো। ওইসব স্কাইলাইটের ভেতর দিয়ে দুর্গের ভেতরের উঠোনটা দেখতে পাওয়া যেতো। কিন্তু আমাদের আসবার আগেই সেগুলোকে সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। সাড়ে তিন বছর আমরা আহম্মদনগর দুর্গে বন্দী ছিলাম। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ওখানে কোনো ভারতবাসীর আগমন আমরা দেখতেই পাইনি। একবার বা দুবার সামান্য কিছু মেরামতী কাজ করা হলেও কোনো ভারতীয় শ্রমিককে সে কাজে নিযুক্ত করা হয়নি। অর্থাৎ, ওখানে আমরা বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিলাম।
গভর্নমেন্ট যদিও বহির্জগতের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ করতে পেরেছিলেন, কিন্তু তাঁদের মুখ্য উদ্দেশ্য বিফল হয়েছিলো। আমরা ওখানে আসবার এক সপ্তাহের মধ্যেই জনসাধারণ জেনে ফেলেছিলো আমরা সবাই আহম্মদনগর দুর্গে বন্দী অবস্থায় রয়েছি। এখন অবশ্য গোপনীয়তা রক্ষার আর প্রয়োজন নেই। ইংরেজের বিজয় এখন দৃষ্টিসীমার ভেতরে এসে গেছে। ভারত গভর্নমেন্ট তাই মনে করলেন, এখন আর আমাদের মিলিটারি জেলে রাখবার দরকার নেই; এখন নিরাপদে আমাদের নিজ নিজ প্রদেশের অসামরিক জেলখানায় বদলি করে দেওয়া যেতে পারে।
প্রথমেই সর্দার প্যাটেল এবং শঙ্কররাও দেওকে পুনা জেলে বদলি করা হলো। আসফ আলীকে পাঠানো হলো বাতালায়। দিল্লির রাজনৈতিক বন্দীদের সাধারণত ওখানেই রাখা হতো তখন। জওহরলালকে প্রথমে এলাহাবাদের কাছে নাইনিতে, পরে আলমোড়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হলো। যাবার সময় জওহরলাল আমাকে বললেন, আমাদের মুক্তির সময় হয়তো আসন্ন হয়ে এসেছে। তিনি আমাকে আরো একটি অনুরোধ করলেন, মুক্তির পরেই আমি যেন ওয়ার্কিং কমিটির অথবা এ.আই.সি.সি.র কোনো সভা আহ্বান না করি। তিনি বললেন, মুক্তির পরে তাঁর কিছুদিন বিশ্রামের দরকার, এছাড়া ভারত সম্বন্ধে যে বইখানা লেখায় তিনি হাত দিয়েছেন, সেখানা সম্পূর্ণ করার জন্যও কিছুটা সময় তাঁর চাই।
আমি তাঁকে বললাম, আমিও ঠিক ওইরকমই চিন্তা করছিলাম। আমারও কিছুটা বিশ্রামের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তখনও আমি ভাবতে পারিনি যে, মুক্তির অব্যবহিত পরেই আমাদের আবার কর্মসাগরে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। অর্থাৎ আমাদের বাকি জীবনে বিশ্রামের কোনো প্রশ্নই আর উঠবে না।
আমার বদলির সময় যখন এলো, তখন চিতা খাঁ আমাকে বললে, আমার যা শরীরের অবস্থা তাতে কলকাতার মতো আর্দ্র আবহাওয়া আমার স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো হবে না। তার কথা থেকে বুঝতে পারলাম, আমাকে হয়তো বাংলার কোনো শুকনো জায়গায় পাঠানো হবে। একদিন সন্ধ্যার সময় সে আমাকে প্রস্তুত হতে বললে। আমার জিনিসপত্র একটা মোটর গাড়িতে তুলে দেওয়া হলো। এরপর আমি গাড়িতে উঠে বসলে সে নিজে গাড়িটা চালাতে লাগলো। আমাকে আহম্মদনগর স্টেশনে না নিয়ে গিয়ে কয়েক মাইল দূরের একটা গ্রাম্য স্টেশনে নিয়ে যাওয়া হলো। এর কারণ হলো, আমি যদি আহম্মদনগর স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠি, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সে খবর জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। আমার গন্তব্যস্থানটি সাধারণের মধ্যে প্রচারিত হোক এটা গভর্নমেন্ট চান না।
আমি যখন আহম্মদনগর জেলে ছিলাম, তার বেশির ভাগ সময়ই আমার কেটেছে নিদারুণ মানসিক দুশ্চিন্তায়। এতে আমার স্বাস্থ্যের ওপর বিরাট প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। গ্রেপ্তার হবার সময় আমার ওজন ছিলো ১৭০ পাউন্ড। ওই জেল থেকে যখন বদলি হই, তখন আমার ওজন কমে ১৩০ পাউন্ডে আসে। আমার খিদেও এতো কমে গিয়েছিলো যে বিশেষ কিছু খেতেই পারতাম না।
বাংলা থেকে একজন সি.আই.ডি. ইনস্পেক্টর এসেছিলো আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবার জন্য। চারজন কনেস্টবলও সঙ্গে এনেছিলো সে। আমরা স্টেশনে উপস্থিত হবার পর চিতা খাঁ আমাকে তার হাতে সমর্পণ করে। আমরা আহম্মদনগর থেকে কল্যাণী হয়ে আসানসোলে আসি। ওখানে আমাকে রিটায়ারিং রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। গভর্নমেন্ট সমস্ত বিষয়টা গোপন করে রাখতে চেয়েছিলেন; কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখা গেলো, সংবাদপত্রগুলো আমার খবর জেনে ফেলেছে। আমি দেখতে পেলাম কলকাতা থেকে কয়েকজন রিপোর্টার এবং এলাহাবাদ থেকে আমার কয়েকজন বন্ধু আসানসোলে এসে হাজির হয়েছেন। স্থানীয় লোকের এক বিরাট জনতাও সমবেত হয়েছে স্টেশনে।
আসানসোলের পুলিশ সুপার এসে আমার ভার নেন। তিনি আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে একটা আবেদন করেন। তিনি বলেন, আমি যদি জনসাধারণের সঙ্গে দেখা করতে চাই, তাহলে তিনি আমাকে বাধা দিতে পারবেন না, কিন্তু আমি তা করলে গভর্নমেন্ট তাঁর ওপরে অত্যন্ত বিরক্ত হবেন এবং তাঁর কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করবেন। তিনি আরো বলেন, আমি যদি জনসাধারণের সঙ্গে দেখা না করে সোজা দোতলায় যেতে সম্মত হই, তাহলে তিনি বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ হবেন। আমি তাঁকে বলি, তাঁর ক্ষতি হয়, গভর্নমেন্ট তাঁর ওপরে বিরক্ত হন এরকম কোনো কাজ করবার ইচ্ছা আমার নেই। এরপর আমি তাঁর সঙ্গে দোতলার একটা ঘরে যাই।
ঢাকার নবাবের সঙ্গে উক্ত পুলিশ সুপারের আত্মীয়তা ছিলো। তিনি এবং তাঁর স্ত্রী আমার দেখাশোনা করতে থাকেন। তাঁর স্ত্রী আমাকে একটি অটোগ্রাফ বইতেও সই দিতে অনুরোধ করেন। আমার সুখসুবিধার জন্য ওঁরা সর্বতোভাবে চেষ্টা করেন।
এবার আমি জানতে পারি, আমাকে বাঁকুড়া নিয়ে যাওয়া হবে। বিকেল চারটেয় ট্রেন প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করে। সেই ট্রেনে আমার জন্য একটা কামরা সংরক্ষিত ছিলো। আমাকে সেই কামরায় নিয়ে আসা হয়। ইতিমধ্যে এক বিরাট জনতা প্ল্যাটফর্মে এসে জমায়েত হয়েছে। কলকাতা, এলাহাবাদ এবং লখনৌ থেকেও এসেছে অনেকে। প্ল্যাটফর্মে সেই জনজমায়েত দেখে পুলিশ সুপার এবং তাঁর অধীনস্থ ইনস্পেক্টর বিশেষভাবে চিন্তিত হয়ে ওঠেন। জনতার দৃষ্টি থেকে কী ভাবে আমাকে আড়াল করে রাখা যায়, এই হলো তাঁদের দুশ্চিন্তার কারণ। সূর্যের উত্তাপ খুব বেশি থাকায় আমার জন্য একটি ছাতা আনা হয়েছিলো। ইনস্পেক্টর সেই ছাতাটি খুলে আমার মাথার ওপরে ধরে ছিলেন। জনতার দৃষ্টি থেকে আমাকে আড়াল করবার উদ্দেশ্যে তিনি ছাতাটি নিচু করতে করতে প্রায় আমার মাথার সঙ্গে ঠেকিয়ে ফেলেন। জনতা যাতে আমার মুখ দেখতে না পায়, সেই উদ্দেশ্যেই এ কাজটি তিনি করেন। তিনি ভেবেছিলেন, এইভাবে ছাতা আড়াল দিয়ে তিনি আমাকে ট্রেনের কামরায় নিয়ে যেতে পারবেন।
কারো সঙ্গে দেখা করবার কোনোরকম বিশেষ ইচ্ছা আমার ছিলো না। কিন্তু আমি যখন দেখতে পেলাম, আমাকে একবার চোখের দেখা দেখবার জন্য কলকাতা, এলাহাবাদ এবং লক্ষ্ণৌ থেকে বহু লোক ছুটে এসেছে তখন আমার মনে হলো, তাদের দিকে না তাকানোটা আমার পক্ষে অন্যায় কাজ হবে। আমি তাই ইনস্পেক্টরের হাত থেকে ছাতাটা টেনে নিয়ে সেটাকে বন্ধ করে ফেলি। জনতা তখন আমার দিকে ছুটে আসতে থাকায় আমি তাদের থামতে বলি। প্ৰত্যেক লোকের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে সম্ভাষণ করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আমি তাই জনতার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলি, পুলিস সুপার আর ইনস্পেক্টর দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। প্রতিমুহূর্তেই তাঁদের দুশ্চিন্তার বোঝা ভারী হচ্ছে, সুতরাং এই গরমের দিনে তাঁদের মাথা- ধরাটা আর আমি বাড়াতে চাই নে।
এরপর জনতার উদ্দেশ্যে হাত নেড়ে অভিনন্দন জানিয়ে আমি আমার কামরায় উঠে পড়ি। কিন্তু জনতা এসে কামরাটির সামনে ভীড় করে দাড়ায়। আর একদল লোক ট্রেনের অপর দিকের রেললাইন পার হয়ে আমার কামরার পাশে হাজির হয়। একটু পরেই ট্রেন ছেড়ে দেয় এবং সাতটার মধ্যেই আমরা বাঁকুড়ায় পৌঁছে যাই। ওখানে বাঁকুড়ার পুলিস সুপার এবং আরো কয়েকজন অফিসার আমাকে সঙ্গে করে শহরের বাইরের একটা দোতলা বাংলোয় নিয়ে যান।
তখন এপ্রিলের প্রারম্ভ। দিনের বেলাটা খুবই গরম ছিলো তখন। যাই- হোক, আমি যখন দোতলার বারান্দায় বসি তখন সান্ধ্য হাওয়া ফুরফুর করে আমার মুখে এসে লাগতে থাকে। সকাল এবং সন্ধ্যাবেলাট। খুব খারাপ লাগতো না, কিন্তু দিনের বেলা প্রচণ্ড গরম বোধ হতো। আমার জন্য একটা বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। এছাড়া বরফও রাখা হতো আমার জন্য। কিন্তু দুপুরের দিকে ওতে বিশেষ কোনো সুবিধে হতো না। কলেক্টর প্রতি সপ্তাহে একবার করে আমার সঙ্গে দেখা করতেন। একদিন তিনি আমাকে বলেন, আমার পক্ষে বাঁকুড়ায় থাকা কষ্টকর হয়েছে দেখে তিনি আমাকে কোনো ঠাণ্ডা জায়গায় পাঠাবার জন্য গভর্নমেন্টের কাছে চিঠি লিখেছেন। তিনি আরো বলেন, এখন তিনি তাঁর চিঠির উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছেন। উত্তর এলেই আমাকে কোনো ঠাণ্ডা জায়গায় পাঠিয়ে দেবেন।
ভালো রসুইদার সব সময় পাওয়া যায় না। বাঁকুড়াতেও প্রথম দিকে এ ব্যাপারে অসুবিধের সৃষ্টি হয়েছিলো। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই একজন ভালো রসুইদার নিযুক্ত করা হয়। তার রান্না এতোই ভালো ছিলো যে মুক্তির পরে আমি তাকে সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে আসি।
আমি আগেই বলেছি, আহম্মদনগর দুর্গে যাবার পর আমার রেডিও সেটটি আমার কাছ থেকে নিয়ে নেওয়া হয়েছিলো। কিছুদিন পরে চিতা খাঁ আমার সঙ্গে দেখা করে রেডিওটা ব্যবহার করবার জন্য আমার কাছ থেকে অনুমতি চান। আমি খুশি মনেই তাঁকে অনুমতি দিই। কিন্তু আহম্মদনগর থেকে চলে আসার দিন পর্যন্ত ওটার চেহারা ‘আর আমি দেখতে পাইনি। আমাকে যখন বাংলায় বদলি করা হয় তখন রেডিও সেটটাকে আমার জিনিসপত্রের ভেতরে রেখে দেওয়া হয়। রেডিওটা ব্যবহার করতে গিয়ে দেখি, ওটা খারাপ হয়ে গেছে। বাঁকুড়ার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে আর একটা রেডিও সেট দেন। বহুদিন পরে আবার আমি রেডিওর মাধ্যমে দেশ- বিদেশের খবরাখবর শুনতে পাই।
এপ্রিলের শেষদিকে আমি খবরের কাগজ থেকে জানতে পারি, আসফ আলী বাটালা জেলে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বেশ কিছুদিন তিনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন এবং তাঁর প্রাণের আশা একরকম ছিলোই না। গভর্নমেন্ট তাই তাঁর মুক্তির আদেশ দিয়েছেন এবং তাঁকে দিল্লীতে সরিয়ে নিয়েছেন।
১৯৪৫-এর মে মাসে ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করবার জন্য লর্ড ওয়াভেল লণ্ডনে যান এবং মে মাসের শেষদিকে ভারতে ফিরে আসেন। এই সময় একদিন সন্ধ্যায় আমি যখন রেডিওতে দিল্লীর সংবাদ শুনছিলাম তখন শুনতে পাই, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের পূর্ব-ঘোষিত নীতির পরিপ্রেক্ষিতে. ভাইসরয় ঘোষণা করেছেন ভারতের রাজনৈতিক সমস্য। সমাধানের জন্য আবার নতুন করে প্রচেষ্টা চালানো হবে। কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সিমলাতে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে এবং এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে আমন্ত্ৰণ জানানো হয়েছে। খবরে আরো বলা হয়, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরা যাতে উক্ত সম্মেলনে যোগ দিতে পারেন তার জন্য তাঁদের মুক্তি দেওয়া হবে।
পরদিন আমি শুনতে পাই, আমার এবং আমার সহকর্মীদের মুক্তির আদেশ জারি হয়েছে। খবরটা আমি শুনতে পাই রাত নটার সময়। ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটও শুনতে পেয়েছিলেন খবরটা। তিনি আমার কাছে একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে আমাকে জানিয়ে দেন, রেডিওতে আমার মুক্তির সংবাদ্দ প্রচারিত হলেও তাঁর কাছে কোনো সরকারী নির্দেশ তখনো এসে পৌঁছয়নি। সরকারী নির্দেশ পাবার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি আমাকে তা জানিয়ে দেবেন। রাত দুপুরের সময় জেলার এসে আমাকে জানিয়ে দেন, আমার মুক্তির আদেশ এসে গেছে। অতো রাত্রে কোনোরকম ব্যবস্থা অবলম্বন করা সম্ভব ছিলো না। পরদিন সকালে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি আমার মুক্তির আদেশপত্র পড়ে শোনান। এরপর তিনি বলেন, কলকাতা যাবার ট্রেন বিকেল পাঁচটায় বাঁকুড়া থেকে ছাড়বে। ওই ট্রেনে আমার জন্য একটা ফার্স্ট ক্লাস কুপে রিজার্ভ করা হয়েছে।
কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কলকাতা থেকে একদল সাংবাদিক আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। স্থানীয় লোকেরাও হাজার হাজার এসে হাজির হয় বাংলোর সামনে। বিকেল সাড়ে তিনটের সময় স্থানীয় কংগ্রেস কমিটি একটি জনসভার আয়োজন করেন। আমি ওই সভায় উপস্থিত হয়ে এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিই। সভা শেষ হবার পরে আমি এক্সপ্রেস ট্রেনে কলকাতা রওনা হই মুক্তির আদেশ এবং পরদিন সকালে হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত হই।
হাওড়া স্টেশন এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে তখন লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে। জনতার ভীড় এতো বেশী হয়েছে যে ট্রেনের কামরা থেকে নেমে আমার মোটর গাড়ি পর্যন্ত যেতে রীতিমতো অসুবিধে হয়। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের সভানেত্রী শ্রীমতী লাবণ্যপ্রভা দত্ত এবং আরো কয়েকজন স্থানীয় নেতা আমার সঙ্গে গাড়িতে ছিলেন। গাড়ি স্টার্ট দেবার সঙ্গে সঙ্গে আমি দেখতে পাই, গাড়িটার আগে একটি ব্যাণ্ডপার্টি ব্যাণ্ড রাজাতে শুরু করেছে। শ্রীমতী দত্তকে আমি জিজ্ঞাসা করি, ব্যাণ্ডপার্টির ব্যবস্থা করা হয়েছে কেন? আমার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি আমার মুক্তির জন্য একটি সামান্য অনুষ্ঠান। আমার এটা মোটেই পছন্দ ছিলো না; আমি তাই শ্রীমতী দত্তকে বলি, যদিও আমি মুক্তি পেয়েছি তবু এখনো আমার হাজার হাজার বন্ধু এবং সহকর্মী জেলে রয়েছেন, সুতরাং এ অবস্থায় কোনোরকম আনন্দানুষ্ঠান করা উচিত নয়।
আমার অনুরোধে তখুনি ব্যাণ্ড বাজনা থামানো হয় এবং ব্যাণ্ডপার্টি সরিয়ে নেওয়া হয়। গাড়িটা যখন হাওড়া ব্রীজের ওপর দিয়ে যাচ্ছিলো, তখন আমার মন ভেসে যায় অতীতের দিকে। আমার মনে পড়ে যায়, তিন বছর আগে আমি যেদিন ওয়ার্কিং কমিটির এবং এ. আই. সি. সি-র সভায় যোগদানের জন্য বোম্বাই অভিমুখে রওনা হই, সেদিন আমার স্ত্রী বাড়ির সদর ফটক পর্যন্ত এগিয়ে এসে আমাকে বিদায় অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তিন বছর পরে আবার আজ আমি বাড়িতে ফিরছি, কিন্তু তিনি আজ আর নেই। তাঁর নশ্বর দেহ তখন মাটির শীতল কোলে স্থানলাভ করেছে। আমার তখন ওয়ার্ডস’- ওয়ার্থের কবিতার দুটি লাইন মনে পড়ে যায় :
‘But she’s in her grave and oh
The difference to me.’
সঙ্গীদের আমি গাড়ি ঘুরিয়ে আমার স্ত্রীর সমাধিক্ষেত্রের দিকে নিয়ে যেতে বলি। বাড়িতে ঢোকবার আগে আমি তাঁর সমাধিটা একবার দেখে যেতে চাই। গাড়িতে বহুসংখ্যক ফুলের মালা ছিলো। আমি একটি মালা নিয়ে তাঁর সমাধির ওপরে রেখে নিঃশব্দে ফতেহা আবৃত্তি করি।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন