১৬. মাউন্টব্যাটেন মিশন
লর্ড মাউন্টব্যাটেন সর্বপ্রথম খ্যাতি অর্জন করেন যুদ্ধের সময়। সেই সময় তিনি কয়েক মাস ভারতে অবস্থান করেন এবং পরে তাঁর প্রধান কার্যালয় সিংহলে স্থানান্তরিত করেন। যুদ্ধ শেষ হবার পরে তিনি ব্রিটেনে ফিরে যান। কিন্তু লর্ড ওয়াভেল পদত্যাগ করার ফলে তিনি ভারতের ভাইসরয় এবং গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। শ্রমিক সরকারের কাছ থেকে কার্যভার গ্রহণ করবার পর মিঃ অ্যাটলির কাছ থেকে যে নির্দেশ নিয়ে ভারতে আসেন তা হলো ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুনের আগে অবশ্যই ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
২২শে মার্চ তিনি দিল্লিতে আসেন এবং ২৪শে মার্চ ভাইসরয় ও গভর্নর জেনারেল রূপে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের অব্যবহিত পরেই তিনি এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতার মাধ্যমে ভারতের সমস্যাবলী আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সমাধান করবার ব্যাপারে জোর দিয়ে তাঁর বক্তব্য রাখেন।
এর কয়েকদিন পরেই আমি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে সর্বপ্রথম মিলিত হই। সেই প্রথম সাক্ষাতের সময়ই তিনি আমাকে বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সর্বতোভাবে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছেন; তবে তার আগে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান করা দরকার। তিনি আরো বলেন, তাঁর মতে এ ব্যাপারে এখনই এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে যার ফলে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে। তিনি আমার সঙ্গে একমত হন যে, কংগ্রেস ও লীগের ভেতরের মতানৈক্য এখন অনেকটা কম হয়ে এসেছে। মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনায় আসাম এবং বাংলাকে একটি এলাকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কংগ্রেস মনে করে জোটভুক্তির ব্যাপারে কোনো প্রদেশকে বাধ্য করা উচিত হবে না এবং প্রত্যেক প্রদেশের পক্ষে সে কোনো জোটভুক্ত হবে কি হবে না তা নির্ধারণ করবার পূর্ণ অধিকার আছে। পক্ষান্তরে লীগের বক্তব্য হলো, সে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা এই কারণেই মেনে নিয়েছে যে বিভিন্ন দলভুক্ত প্রদেশগুলো শুধুমাত্র দল হিসেবেই ভোট দেবে এবং পরবর্তীকালে কোনো প্রদেশ যদি ইচ্ছে করে তাহলে দল থেকে বেরিয়ে এসে তার নিজস্ব শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারবে। লীগ আরো বলে, এই প্রস্তাবের কোনো ব্যত্যয় ঘটানো হলে পুরো পরিকল্পনাটিই অকেজো হয়ে যাবে। লীগ মনে করে কংগ্রেস এখন এটাই চাইছে। এই ভিত্তিতেই লীগ মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা অগ্রাহ্য করেছে।
এটা কেউই বুঝতে পারে না, আসাম মুসলমান-প্রধান প্রদেশ না হওয়া সত্ত্বেও লীগ আসামের প্রশ্নটির ওপর এতটা গুরুত্ব আরোপ কেন করছে। লীগের নিজস্ব তত্ত্ব অনুসারেও বলা চলে, আসামকে বাংলার সঙ্গে জোর করে যুক্ত করবার মতো কোনো কারণই বিদ্যমান নেই। তবে কারণ যাই হোক না কেন, ঘোষিত ব্যাখ্যা অনুসারে লীগের এই দাবী অভ্রান্ত। যদিও রাজনীতি ও ন্যায়নীতি অনুসারে তার এই দাবী খুবই দুর্বল। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে আমি কয়েকবার আলোচনা করেছি।
সাম্প্রদায়িক মনোভাবের দ্রুত বিস্তৃতি আমার মতে, কংগ্রেস এবং লীগের ভেতরের মতপার্থক্য এমন এক পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে যখন উভয়ের মধ্যে সমঝোতা সৃষ্টি করবার জন্য কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ দরকার হয়ে পড়েছে। আমার অভিমত হলো, এ বিষয়টি আমরা লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ওপরে ছেড়ে দিতে পারি। অতএব কংগ্রেস এবং লীগ তাঁর সালিসি মেনে নিতে স্বীকার করে তার হাতেই বিষয়টি ছেড়ে দিক। কিন্তু জওহরলাল এবং সর্দার প্যাটেল আমার এই পরামর্শ মেনে নিতে চাইলেন না। সালিসি প্রস্তাবের কথাটা তাদের কাছে আদৌ মনঃপূত হলো না। আমি তখন এ বিষয় নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করলাম না।
ইতিমধ্যে প্রতিদিনই পরিস্থিতির অবনতি ঘটছিল। কলকাতার দাঙ্গা-হাঙ্গামার ফলস্বরূপ নোয়াখালি এবং বিহারে দাঙ্গা শুরু হয়ে যায়। এরপর বোম্বাইতেও অশান্তি শুরু হয়। যে পাঞ্জাব এতকাল শান্ত ছিল, সেখানেও জ্বলে ওঠে অশান্তির আগুন। মালিক খিজির হায়াৎ খান ২রা মার্চ মুখ্যমন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। লাহোরে পাকিস্তান-বিরোধী আন্দোলন এমনই হিংস্র হয়ে ওঠে যে, ৪ঠা মার্চ তেরো জন লোক নিহত এবং বহুসংখ্যক লোক আহত হয়। প্রদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা ছড়িয়ে পড়ে। অমৃতসর, তক্ষশিলা এবং রাওয়ালপিণ্ডিতেও গুরুতর দাঙ্গাহাঙ্গামা হয়।
একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক মনোভাবের দ্রুত বিস্তৃতি ঘটছিল, অন্যদিকে শাসন কর্তৃপক্ষ যেন স্থাণু হয়ে পড়ছিলেন। সরকারি চাকরিতে যেসব ইউরোপীয়ান ছিলেন, তাঁরা তখন আর মন দিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করছিলেন না। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন যে, অচিরেই ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হবে। এই কারণেই তাঁরা তখন ‘দিনগত পাপক্ষয়’ করে চলেছিলেন, কর্তব্য সম্পাদনের ব্যাপারে তাঁদের কোনো আগ্রহই ছিল না। তাঁরা তখন প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেন যে, শাসনের দায়িত্ব আর তাঁরা নেবেন না। তাঁদের এই মনোভাব ও কথাবার্তার ফলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয় এবং জনসাধারণের মনে এক সার্বিক হতাশা দেখা দেয়।
পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে ওঠে যখন একজিকিউটিভ কাউন্সিলের ভেতরে কংগ্রেস এবং লীগ সদস্যদের মধ্যে এক অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়। সদস্যরা যেভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছিলেন, তাতে কেন্দ্রীয় সরকার একেবারেই পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। লীগের হাতে অর্থ দপ্তর থাকায় শাসনব্যবস্থার চাবিকাঠিই ছিল তাদের হাতে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, সর্দার প্যাটেলের একগুঁয়েমির জন্যই এটি হয়েছিল। নিজের হাতে স্বরাষ্ট্র দপ্তরটি রাখার জন্যই অর্থ দপ্তর মুসলিম লীগকে ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। অর্থ দপ্তরে কয়েকজন প্রবীণ ও সুদক্ষ মুসলমান অফিসার ছিলেন, যারা লিয়াকত আলীকে সর্বতোভাবে সাহায্য করছিলেন। তাদের পরামর্শেই লিয়াকত আলী কংগ্রেসের প্রস্তাবসমূহ বাতিল করছিলেন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অহেতুক বিলম্ব করে বাধার সৃষ্টি করছিলেন। সর্দার প্যাটেল এতদিনে বুঝতে পারেন যে, তিনি নিজে স্বরাষ্ট্র বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য হওয়া সত্ত্বেও লিয়াকত আলীর অনুমোদন ছাড়া তার বিভাগে একটি চাপরাসীর পদও সৃষ্টি করতে পারেন না। এই অবস্থার মধ্যে পড়ে কংগ্রেসী সদস্যরা বুঝেই উঠতে পারছিলেন না যে তাঁরা কোন পথে চলবেন।
কংগ্রেস কর্তৃক অর্থ দপ্তরটি লীগকে ছেড়ে দেওয়ার ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল, তা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। এবং এর ফলে যে অচল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তার ফলেই লর্ড মাউন্টব্যাটেন ধীরে ধীরে ভারত বিভাগের ক্ষেত্র প্রস্তুত করবার সুযোগ পেয়েছিলেন। রাজনৈতিক সমস্যার নতুন সমাধান খুঁজে বের করার কথা বলে তিনি কংগ্রেসকে ভারত বিভাগের প্রয়োজনীয়তার কথা বোঝাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন এবং একজিকিউটিভ কাউন্সিলের কংগ্রেসী সদস্যদের মানসিক ক্ষেত্রে এমনভাবে বিভেদের বীজ বপন করে চলেছিলেন, যার ফলে তাদের মনে এর প্রয়োজনীয়তার কথা ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে থাকে।
এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার। ভারতীয়দের মধ্যে একমাত্র সর্দার প্যাটেলই সর্বপ্রথমে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রস্তাবে সম্মতি দেন। কিছু দিন আগে পর্যন্ত পাকিস্তান কথাটি মিঃ জিন্নার দর-কষাকষির একটি হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু পাকিস্তানের জন্য লড়াই করে তিনি তার নিজের সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। কাউন্সিলের ভেতরে যেরকম অসহনীয় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে তিক্ত-বিরক্ত হয়েই সর্দার প্যাটেল শেষ পর্যন্ত ভারত বিভাগের পরিকল্পনায় বিশ্বাসী হয়ে পড়েছিলেন। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম লীগকে অর্থ দপ্তর ছেড়ে দেওয়ার দায়িত্বও ছিল সর্দার প্যাটেলের। লিয়াকত আলীর অসহযোগিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তাকেই বেশি করে করতে হয়েছিল। সুতরাং লর্ড মাউন্টব্যাটেন যখন পরামর্শ দিলেন যে, ভারত-বিভাগ মেনে নিলে অচলাবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব হবে, তখন সর্দার প্যাটেল তার সেই পরামর্শটি লুফে নিলেন। তার মনে তখন দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেছে যে, মুসলিম লীগের সঙ্গে একত্রে কাজ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তিনি তখন প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করলেন, ঝামেলা থেকে মুক্তি পাবার জন্য ভারতের একটি অংশ মুসলিম লীগকে ছেড়ে দিতে তিনি প্রস্তুত আছেন।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন ছিলেন অত্যন্ত চালাক লোক। তার ভারতীয় সহকর্মীদের মানসিক অবস্থা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতেও তাঁর বিলম্ব হলো না। যে মুহূর্তে তিনি বুঝতে পারলেন সর্দার প্যাটেল তার পরামর্শটি মেনে নিতে সম্মত হয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি তার অনন্যসাধারণ ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে সর্দার প্যাটেলকে নিজের কব্জায় আনতে সচেষ্ট হন। এই কাজটি করতে গিয়ে তিনি যখন-তখন সর্দারের প্রশংসা করতে থাকেন। সর্দার প্যাটেলের প্রশংসা করতে তিনি যে-সব কথা বলতে থাকেন, তা হলো, প্যাটেলের প্রকৃতিটা বাইরে থেকে দেখলে তালের আঁটির মতো কঠিন মনে হলেও, সেই কাঠিন্যের অন্তরালে লুকিয়ে আছে সরস ও নরম শাঁসের মতো একটি সহানুভূতিশীল মন।
সর্দার প্যাটেলকে স্বমতে আনবার পরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন জওহরলালের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। প্রথম দিকে জওহরলাল তার প্রস্তাবে আদৌ সম্মতি দেননি; বরং তিনি আরো তীব্রভাবে আপত্তি জানান। কিন্তু লর্ড মাউন্টব্যাটেন এমনভাবে ধাপে ধাপে তার প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন, যার ফলে জওহরলালের সেই তীব্র আপত্তি ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে লাগলো। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারতে আসার পর এক মাসের মধ্যেই দেখা যায় যে, দেশ বিভাগের প্রবল বিরোধী জওহরলাল নেহরু এই প্রস্তাবটিকে সরাসরি সমর্থন না করলেও নস্যাৎ করছেন না।
জওহরলালের মনকে লর্ড মাউন্টব্যাটেন কীভাবে জয় করেছিলেন, সেকথা আমি প্রায়ই চিন্তা করে থাকি। আমি জওহরলালের প্রকৃতিটি ভালো করে জানি। মানুষ হিসেবে তিনি তার নিজস্ব নীতির প্রতি আস্থাশীল হলেও, সময় সময় প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে তাঁকে নমনীয় হতে দেখা যেত। তাছাড়া সর্দার প্যাটেলের অভিমতও হয়তো তাকে প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু প্যাটেলের প্রভাব এমন কিছু প্রখর ছিল না যার ফলে জওহরলাল তার নিজস্ব নীতি পরিবর্তন করবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাকে কিছুটা প্রভাবিত করলেও তার ওপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন লেডী মাউন্টব্যাটেন। তিনি যে শুধু প্রখর বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন তাই নয়, তার আকর্ষণী শক্তি এবং চারিত্রিক বিশেষত্বও ছিল অনন্যসাধারণ। তিনি তার স্বামীকে সবিশেষ শ্রদ্ধা করতেন এবং অনেক সময় স্বামীর চিন্তাধারাকে বিরুদ্ধবাদীদের কাছে সুষ্ঠুভাবে ব্যাখ্যা করে তাদের বিরোধী মনোভাব দূর করতে চেষ্টা করতেন।
হয়তো আরো একজন ব্যক্তি এ ব্যাপারে জওহরলালকে প্রভাবিত করেছিলেন। এই ব্যক্তিটি হলেন কৃষ্ণ মেনন। ইনি জওহরলালের গুণপনার কথা এমনভাবে বলতেন যার ফলে জওহরলাল তাকে বিশেষভাবে খাতির করতেন। শুধু খাতিরই করতেন না, তার পরামর্শও মেনে নিতেন। আমি এতে বিশেষ খুশি ছিলাম না। আমার ধারণা, কৃষ্ণ মেনন প্রায়ই জওহরলালকে ভুল পথে চালিত করতেন। সর্দার প্যাটেলকেও আমি সব সময় সহ্য করতে পারতাম না; এমন কী আমরা একে অপরের চোখের দিকেও তাকাতাম না। কিন্তু আমাদের মধ্যে শত বিরোধ বিদ্যমান থাকলেও কৃষ্ণ মেনন সম্বন্ধে আমরা উভয়েই একই অভিমত পোষণ করতাম। এ বিষয়ে আমার আত্মজীবনীর তৃতীয় খণ্ডে আরো বিস্তৃতভাবে আলোচনা করা হবে।
আমি যখন বুঝতে পারি লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের কথা চিন্তা করছেন এবং জওহরলাল ও প্যাটেলকে তার স্বমতে আনতে পেরেছেন, তখন আমি রীতিমত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমি বুঝতে পারি যে, দেশ এক মহা বিপজ্জনক অবস্থার দিকে এগুচ্ছে। ভারত বিভাগ যে শুধু মুসলমানদের পক্ষেই ক্ষতিকর হবে তা-ই নয়, সারা দেশটাই এর ফলে বিপন্ন হয়ে পড়বে। আমি আরো মনে করি, ভারতের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাবই ছিল সবচেয়ে ভালো। ভারতের অখণ্ডতা এবং সংহতিকে বজায় রেখেই উক্ত পরিকল্পনা রচিত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, উক্ত পরিকল্পনায় প্রতিটি সম্প্রদায়কে স্বাধীনভাবে এবং সম্মানের সঙ্গে বিকাশ লাভের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও দেখা যায় যে, মুসলমানরা ওর চেয়ে ভালো কিছু আশা করতে পারতেন না। যেসব প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ, সেসব প্রদেশের আভ্যন্তরীণ শাসনব্যবস্থায় তাঁরা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকার লাভ করতেন। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারেও তারা যথেষ্ট সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাতে পারতেন। সুতরাং সাম্প্রদায়িক হীনমন্যতা এবং পারস্পরিক সন্দেহের ব্যাপারেও তাদের রক্ষাকবচ থাকত। আমি মনে করি, উক্ত পরিকল্পনার ভিত্তিতে যদি শাসনতন্ত্র রচিত হতো এবং সেই শাসনতন্ত্র অনুসারে সততার সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা হতো, তাহলে সাম্প্রদায়িক সন্দেহ এবং তৎসংক্রান্ত অন্যান্য অসুবিধেগুলো শিগগিরই বিদূরিত হয়ে যেত। দেশের আসল সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। সাম্প্রদায়িক সমস্যা আসলে কোনো সমস্যাই নয়। জনসাধারণের মধ্যে যা-কিছু ব্যবধান তা হলো শ্রেণী-বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য নয়। সুতরাং দেশ একবার স্বাধীন হতে পারলে হিন্দু, মুসলমান, শিখ প্রভৃতি প্রত্যেক সম্প্রদায়ই দেশের আসল সমস্যা বুঝতে পারত এবং তা বুঝবার পর সেই আসল সমস্যার মোকাবিলা করত। এবং তা করা হলে সাম্প্রদায়িক বিভেদ অচিরেই দূর হয়ে যেত।
আমি তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করি যাতে আমার সহকর্মীরা ভারত বিভাগের প্রস্তাবের পক্ষে শেষ সিদ্ধান্ত না নেন। আমি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাই যে, প্যাটেল এ ব্যাপারে এমনই আগ্রহান্বিত হয়ে পড়েছিলেন যে, এর বিরুদ্ধে কোনো কথাই তিনি শুনতে চাইছিলেন না। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় আমি তার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করি। আমি তাকে বলি, আমরা যদি দেশ-বিভাগ মেনে নিই, তাহলে আমরা দেশের চিরস্থায়ী ক্ষতি করব। দেশ-বিভাগের দ্বারা সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান কোনোক্রমেই হতে পারে না। আসলে এটা একটা চিরস্থায়ী নজির হয়ে থাকবে। জিন্না ‘দুই জাতি’র ধুয়া তুলেছেন, এক্ষেত্রে দেশবিভাগ মেনে নেবার অর্থ হবে তার সেই দাবীকেই স্বীকার করে নেওয়া। কংগ্রেস কিভাবে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশবিভাগে সম্মত হতে পারে? দেশবিভাগের ফলে সাম্প্রদায়িক প্রীতি চিরতরে বিদায় নেবে এবং তার পরিবর্তে দেখা দেবে সন্দেহ, অবিশ্বাস আর বৈরী মনোভাব। সুতরাং এই ভিত্তিতে যদি রাষ্ট্র গঠিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে যে কী হবে তা কল্পনাও করা যায় না!
এর উত্তরে প্যাটেল যা বলেন, তাতে আমি রীতিমতো দুঃখিত ও চিন্তিত হয়ে পড়ি। তিনি বলেন, আমরা যাই বলি না কেন, ভারতে দুটি আলাদা জাতি নিশ্চয়ই আছে। তার মতে হিন্দু ও মুসলমান এক জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না। সুতরাং এই বাস্তব ঘটনাকে স্বীকার করে নেওয়া ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় পন্থা নেই। এবং শুধু এই পথেই আমরা হিন্দু ও মুসলমানদের বিরোধের অবসান ঘটাতে পারি। তিনি আরো বলেন, দুই সহোদর ভাই যদি একসঙ্গে থাকতে না পারে, তাহলে তারা নিজ নিজ অংশ বুঝে নিয়ে পৃথক হয়ে যায়। এবং পৃথক হবার পরে আবার তাদের মধ্যে প্রীতির ভাব দেখা দেয়। কিন্তু তাদের যদি একসঙ্গে থাকতে বাধ্য করা যায়, তাহলে তাদের মধ্যে প্রতিদিনই বিবাদ চলতে থাকবে। জাতি বা সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সুতরাং প্রতিদিন বিবাদ না করে একবার একটা লড়াই করবার পর আমরা যদি আলাদা হয়ে যাই, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে শ্রেয় ব্যবস্থা।
প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনায় বিফলমনোরথ হয়ে অতঃপর আমি জওহরলালের সঙ্গে আলোচনা শুরু করি। কিন্তু তার কথাবার্তাও আমাকে হতাশ করে। প্যাটেলের মতো তিনি সরাসরি দেশবিভাগের কথা না বললেও, তিনি প্রকারান্তরে প্যাটেলকেই সমর্থন করেন। দেশবিভাগের প্রস্তাবকে ভ্রান্ত পথ বলে স্বীকার করেও তিনি বলেন যে, একজিকিউটিভ কাউন্সিলে লীগ সদস্যদের আচরণ দেখে তিনি বুঝতে পেরেছেন যে, তাদের সঙ্গে একত্রে কোনো কাজ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, মুসলমান সদস্যরা হিন্দু সদস্যদের চোখের দিকে তাকান না এবং হিন্দু সদস্যরাও তাই করেন। প্রতিদিনই তাদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই আছে। এইসব কথা উল্লেখ করে তিনি হতাশার সুরে বলেন, এ অবস্থায় দেশবিভাগ মেনে নেওয়া ছাড়া আর কোনো পথ আছে কী?
জওহরলাল দুঃখের সঙ্গে প্রশ্নটা তুললেও এর ভেতর দিয়ে তার মনের কথাটাই প্রকাশ পায়। তবে এটাও বুঝতে পারি, খোলা মন নিয়ে সহজভাবে তিনি দেশবিভাগের প্রস্তাবটা মেনে নেননি। এর জন্য নিজের মনের সঙ্গেও তাকে লড়াই করতে হয়েছে।
কয়েকদিন পরে জওহরলাল আবার আমার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। এবার তিনি এক বিরাট ভূমিকা ফেঁদে আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, তিনি কখনো কোনো অন্যায় কাজ সমর্থন করেন না এবং সব সময় বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার চিন্তাধারাকে চালিত করেন। এবং বাস্তব ঘটনাকে স্বীকার করে নিয়ে যা করা দরকার তা থেকেও তিনি পিছিয়ে আসেন না। ভূমিকা শেষ হলে তিনি তার আসল কথাটা ব্যক্ত করেন। আসল কথাটা হলো, দেশবিভাগের ব্যাপারে আমি যেন বিরোধিতা না করি। জওহরলালের বক্তব্য হলো, দেশবিভাগ মেনে নেওয়া ছাড়া যেখানে গত্যন্তর নেই, সেখানে এর বিরোধিতা করাটা মোটেই বুদ্ধিমানের মতো কাজ হবে না।
আমি কিন্তু তার এই অভিমত মেনে নিতে পারিনি। আমি সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, আমরা এক ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চলেছি। এবং সেই ভ্রান্ত পথ থেকে সরে আসার পরিবর্তে আমরা আরো গভীর ভ্রান্তির কর্দমে নিমজ্জিত হচ্ছি। মুসলিম লীগ মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করায় ভারতের সমস্যা সমাধানের পথ অনেকটা পরিষ্কারভাবে দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে পরিস্থিতি পরিবর্তিত হবার ফলে মিঃ জিন্না মুসলিম লীগের সেই সিদ্ধান্তকে বাতিল করে দেবার সুযোগ পান।
আমি তাই সওয়াল করে বলি, আমাদের উচিত ছিল লর্ড ওয়াভেলের পরামর্শ গ্রহণ করে স্বরাষ্ট্র বিভাগটি মুসলিম লীগকে ছেড়ে দেওয়া। এবং তা করা হলে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের কাজকর্মে কোনো অসুবিধা হতো না। কিন্তু তখন সর্দার প্যাটেলের একগুঁয়েমির জন্যই এটা সম্ভব হয়নি। তিনি কিছুতেই স্বরাষ্ট্র দপ্তর ছেড়ে দিতে সম্মত হননি। আমরা নিজেরাই অর্থ দপ্তরের ভার লীগের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। এই পর্যন্ত বলে আমি জওহরলালকে সাবধান করে দিয়ে বলি যে, আমরা যদি এখন দেশবিভাগ মেনে নিই, তাহলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে না। ভবিষ্যৎ ইতিহাস এই বলে রায় দেবে যে, ভারত বিভাগের ব্যাপারে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেস উভয়েই দায়ী।
সর্দার প্যাটেল এবং জওহরলাল দেশবিভাগের পক্ষে অভিমত দেওয়ায় আমার একমাত্র ভরসাস্থল হলেন গান্ধীজী। এই সময় তিনি পাটনায় ছিলেন। এর আগে কিছুদিন তিনি নোয়াখালিতে থেকে এসেছেন। সেই সময় নোয়াখালির মুসলমানদের ওপরে তিনি বিরাট প্রভাব বিস্তার করে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আবহাওয়া সৃষ্টি করে এসেছিলেন। আমরা আশা করেছিলাম, তিনি দিল্লীতে এসে লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করবেন। আমাদের এই আশা অনুসারেই কাজ হলো। ৩১শে মার্চ গান্ধীজী দিল্লীতে উপস্থিত হলেন। তিনি ওখানে আসতেই আমি তার সঙ্গে দেখা করে এদিকের পরিস্থিতির কথা জানিয়ে দিই। সব কথা শুনে তিনি আমাকে বলেন, ‘দেশবিভাগের প্রস্তাব বিরাট এক অভিশাপের মতো উপস্থাপিত হয়েছে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, বল্লভভাই এবং জওহরলালও এ ব্যাপারে আত্মসমর্পণ করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, আপনি কী করবেন? আপনি কি আমার সঙ্গে থাকবেন, না আপনিও মত পরিত্যাগ করবেন?’
আমি বলি, ‘আমি আগেও যেরকম দেশবিভাগের বিরুদ্ধে ছিলাম, এখনো ঠিক সেইরকমই আছি। তাছাড়া, সত্যি কথা বলতে কী, আজ আমি যতটা এর বিরোধী, ততটা বিরোধী আগে কোনোদিনই ছিলাম না। কিন্তু আমার আজ দুঃখ হচ্ছে সর্দার প্যাটেল আর জওহরলালের কথা ভেবে। এঁরা দুজনেই পরাজিতের মনোভাব গ্রহণ করেছেন। এখন আমার একমাত্র ভরসা হলেন আপনি। আপনি যদি দেশবিভাগের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান, তাহলে এখনো আমরা এই বিপদ থেকে রক্ষা পেতে পারি। কিন্তু আপনি যদি এর বিরোধিতা না করেন, তাহলে ভারতের ভাগ্য এক অনিশ্চিত তিমিরগর্ভে নিমজ্জিত হবে।’
আমার কথার উত্তরে গান্ধীজী বললেন, ‘এটা কোনো প্রশ্নই নয়। কংগ্রেস যদি দেশবিভাগ করতে চায়, তাহলে তা করতে হবে আমার মৃতদেহের ওপরে। আমি যতদিন জীবিত আছি, ততদিন কিছুতেই ভারতবিভাগ মেনে নেব না। এবং আমার যদি সাধ্য থাকে, তাহলে কংগ্রেসকেও এটা মেনে নিতে দেব না।’
ওই দিনই বিকেলের দিকে গান্ধীজী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করলেন। পরদিন এবং ২রা এপ্রিলও তিনি তার সঙ্গে দেখা করলেন। তিনি প্রথম দিন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করে ফিরতেই সর্দার প্যাটেল তার সঙ্গে দেখা করেন। সেদিন তাদের ভেতরে কী আলোচনা হয়েছিল, তা আমি জানি না। কিন্তু আমি যখন পুনর্বার গান্ধীজীর সঙ্গে দেখা করি, তখন তার কথা শুনে যেরকম আঘাত পেয়েছিলাম, সেরকম আঘাত জীবনে আর কোনোদিন পাইনি। আমি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করি যে, তিনি তার পূর্ব-অভিমত পরিবর্তন করেছেন। যদিও তিনি সরাসরি দেশবিভাগ মেনে নেবার কথা বললেন না, কিন্তু আগের মতো এর বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদও করলেন না। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, তিনিও সেদিন প্যাটেলের যুক্তিগুলোই আমার কাছে পুনরুত্থাপিত করলেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় আমি তার সঙ্গে আলোচনা করি, কিন্তু সে আলোচনায় বিশেষ কোনো ফল হয় না।
অবশেষে আমি হতাশ হয়ে বলি, ‘আপনিও যখন এই মনোভাব পোষণ করছেন, তখন ভারতের চরম বিপর্যয় প্রত্যাসন্ন হয়ে উঠেছে এবং সে বিপর্যয়কে কিছুতেই রোধ করা যাবে না।’
আমার কথার উত্তরে গান্ধীজী সোজাভাবে কিছু না বলে একটু ঘুরিয়ে বললেন, এখন আমাদের উচিত হবে মিঃ জিন্নাকে সরকার গঠনের সুযোগ দেওয়া এবং মন্ত্রিসভার জন্য মুসলমান সদস্যদের মনোনীত করা। গান্ধীজী বলেন, লর্ড মাউন্টব্যাটেনকেও তিনি এই কথাই বলেছেন এবং তাতে তিনি খুব খুশি হয়েছেন।
গান্ধীজী লর্ড ওয়াভেলকে কী বলেছেন, তা আমি আগেই জানতে পেরেছিলাম। গান্ধীজী তার সঙ্গে দেখা করবার পরে আমি যখন লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সঙ্গে দেখা করি, তখন তিনি আমাকে বলেন, আমরা যদি গান্ধীজীর কথামতো কাজ করি, তাহলে হয়তো দেশবিভাগ পরিহার করা যাবে। তিনি আরো বলেন, কংগ্রেস যদি মুসলিম লীগকে এই অনুরোধ করে, তাহলে হয়তো মিঃ জিন্নার বিশ্বাস ফিরে আসবে। দুঃখের বিষয়, এ প্রস্তাব আর বেশিদূর অগ্রসর হলো না। কারণ জওহরলাল এবং সর্দার প্যাটেল উভয়েই প্রস্তাবটির তীব্র বিরোধিতা করলেন। প্রকৃতপক্ষে গান্ধীজীকে এই প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নিতে এঁরা বাধ্য করলেন।
এ কথা গান্ধীজী আমাকে জানিয়ে দিয়ে বলেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশবিভাগ প্রায় অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এখন একমাত্র প্রশ্ন হলো, কী ভাবে এই কাজটি করা হবে।
এরপর শুধু এই প্রশ্ন নিয়েই দিনরাত গান্ধীজীর শিবিরে আলোচনা চলতে লাগলো।
সমগ্র ব্যাপারটি নিয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করি। আমি ভেবেই পাই না, গান্ধীজী এতো তাড়াতাড়ি কীভাবে তার মত পরিবর্তন করলেন। আমার বিশ্বাস, সর্দার প্যাটেলই তাকে এ ব্যাপারে প্রভাবিত করেছিলেন। প্যাটেল তখন প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেন যে, দেশবিভাগ ছাড়া আর কোনো দ্বিতীয় পথ নেই, কারণ অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে মুসলিম লীগের সঙ্গে একত্রে কাজ করা অসম্ভব। আরো একটা বিষয় হয়তো সর্দার প্যাটেলকে প্রভাবিত করেছিল। তা হলো লর্ড মাউন্টব্যাটেনের একটি মন্তব্য। তিনি বলেছিলেন, মুসলিম লীগের আপত্তি খণ্ডন করবার জন্যই কংগ্রেস কেন্দ্রে একটি দুর্বল সরকার গঠন করতে সম্মত হয়েছিল। এবং এই কারণেই প্রদেশগুলোকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকার দেবার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো দেশকে যদি ভাষা, সম্প্রদায় এবং সংস্কৃতির ভিত্তিতে টুকরো টুকরো করে ভাগ করা হয়, তাহলে দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে শাসনকার্য চালানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ না থাকলে আমরা একটি শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার গঠনের পরিকল্পনা করতে পারতাম এবং ভারতের ঐক্য ও সংহতির কথা বিবেচনা করে দেশের জন্য সংবিধান রচনা করতে পারতাম। এই কারণেই লর্ড মাউন্টব্যাটেন পরামর্শ দেন যে, এ অবস্থায় উত্তর-পশ্চিম এবং উত্তর-পূর্বের সামান্য কিছু অংশ ছেড়ে দিয়ে শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠন করা যাবে। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের এই মন্তব্যে সর্দার প্যাটেল বিশেষভাবে প্রভাবিত হন। তার মনে দৃঢ় প্রত্যয় জন্মে যে, মুসলিম লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলতে গেলে ভারতের ঐক্য এবং শক্তি বিশেষভাবে বিঘ্নিত হবে। আমি আরো বুঝতে পারি, এই প্রস্তাবটি শুধু সর্দার প্যাটেলকে নয়, জওহরলালকেও প্রভাবিত করেছিল। সর্দার প্যাটেল এবং লর্ড মাউন্টব্যাটেন একই অভিমত ব্যক্ত করবার ফলেই গান্ধীজী আর আগের মতো দেশবিভাগের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সবল প্রতিবাদ জানাতে পারেন না।
আমি সর্ব উপায়ে চেষ্টা করে চলেছিলাম যাতে লর্ড মাউন্টব্যাটেন মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটি কার্যকর করার জন্য উদ্যোগী হন। গান্ধীজী যতদিন এর পক্ষে ছিলেন, ততদিন আমি আশা ছাড়িনি। এবার গান্ধীজী তার পূর্ব অভিমত পরিবর্তন করায় আমি বুঝতে পারি যে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন আমার কথায় সম্মত হবেন না। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে, লর্ড মাউন্টব্যাটেন হয়তো মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটি আদৌ সুনজরে দেখেননি, কারণ পরিকল্পনাটি তার মাথা থেকে আসেনি। অতএব এটা মোটেই আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, উক্ত পরিকল্পনার বিরুদ্ধে কোনো মহল থেকে তীব্র আপত্তি উত্থাপিত হলে তিনি তার নিজস্ব পরিকল্পনা, অর্থাৎ দেশবিভাগের পরিকল্পনাটি প্রস্তাবাকারে তুলতে পারেন।
এখন দেশবিভাগের পরিকল্পনাটি সাধারণভাবে স্বীকৃত হওয়ায় বাংলা এবং পাঞ্জাবের প্রশ্ন বিশেষভাবে প্রাধান্য লাভ করে। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেন, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো আলাদা করা হবে বলে স্থিরীকৃত হওয়ায় বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলমান-প্রধান অঞ্চলগুলো আলাদা করতে হবে। তিনি তাই কংগ্রেস নেতাদের এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি না তোলার জন্য পরামর্শ দেন। তবে তিনি আমাদের ভরসা দিয়ে বলেন, এদিকে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য রাখবেন এবং দরকার হলে নিজেই বিষয়টি উত্থাপন করবেন।
গান্ধীজী পাটনা রওনা হবার আগে আমি আর একবার শেষ চেষ্টা করি। আমি তাকে বর্তমান অবস্থা আরো দুই বছর বজায় রাখতে বলি। আমি তাকে আরো বলি যে, প্রকৃত ক্ষমতা ইতিমধ্যেই ভারতীয়দের হাতে এসে গেছে। এখন শুধু আইনানুগভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরই বাকি রয়েছে। সুতরাং এর জন্য দুই বছর বা তিন বছর কোনো ক্ষতি তো হবেই না, উপরন্তু এইভাবে কাল-হরণের ফলে লীগ হয়তো আমাদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসতেও পারে। কী জন্য তারা সমঝোতায় আসতে পারে, সে কথা আমি পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বিবৃত করেছি। গান্ধীজীও এই ধরনের কথা কয়েক মাস আগে বলেছিলেন। তখন আমি তাকে বলেছিলাম, একটি জাতির ইতিহাসে দুই বা তিন বছর মোটেই দীর্ঘ সময় নয়। আমরা যদি দুই-তিন বছর চুপ করে থাকি, তাহলে মুসলিম লীগ হয়তো আমাদের সঙ্গে একটা আপসে আসতে চাইবে। আমার মনে হয়েছিল, আমরা যদি তাড়াহুড়ো করে এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নিই, তাহলে দেশবিভাগকে আর রোখা যাবে না। কিন্তু আমরা যদি এক বছর বা ছয় বছর অপেক্ষা করি, তাহলে হয়তো সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো শ্রেয়তর পথের সন্ধান পাওয়া যেতেও পারে। গান্ধীজী কিন্তু আমার এই প্রস্তাবে বিশেষ কোনো উৎসাহ দেখালেন না। তবে উৎসাহ না দেখালেও এর বিরুদ্ধে তিনি আপত্তিও জানালেন না।
ইতিমধ্যে লর্ড মাউন্টব্যাটেন তার পরিকল্পনা নিয়ে আরো অনেকদূর অগ্রসর হয়েছেন। এখন তিনি চাইছেন, এ ব্যাপারে লন্ডনে গিয়ে মন্ত্রিসভার সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। তিনি ভালোই জানতেন যে, রক্ষণশীল দল এ ব্যাপারে তাকে সমর্থন করবে। রক্ষণশীল দল মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করেছিল, কারণ ওতে মুসলিম লীগের বায়না অনুসারে ভারত-বিভাগের প্রস্তাব সন্নিবেশিত ছিল না। কিন্তু এবার লর্ড মাউন্টব্যাটেন যে পরিকল্পনা করেছেন, তাতে উক্ত দাবী পুরোপুরিভাবেই মেনে নেওয়া হয়েছে। এই কারণেই তিনি মনে করেন, মিঃ চার্চিল এ ব্যাপারে তাকে নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন।
৪ঠা মে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভা শেষ হয়। সভা শেষ হবার পর ওই দিনই আমি সিমলা রওনা হই। কয়েকদিন পরে লর্ড মাউন্টব্যাটেনও সিমলায় এসে হাজির হন। লন্ডনে যাবার আগে কয়েকদিন বিশ্রাম নেবার উদ্দেশ্যেই তিনি সিমলায় এসেছিলেন। তিনি স্থির করেছিলেন, ১৫ই মে দিল্লীতে ফিরে যাবেন এবং সেখানে দুদিন থেকে ১৮ই মে লন্ডন রওনা হবেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন সিমলায় আসায় আমি মনে মনে স্থির করি, এই সুযোগে তার সঙ্গে দেখা করে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাকে পুনরায় উজ্জীবন করবার জন্য শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখব। এই উদ্দেশ্য নিয়ে ১৪ই মে রাত্রে আমি লাটভবনে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি।
এক ঘণ্টারও বেশি সময় আমাদের মধ্যে আলোচনা হয়। এই সময় আমি তাকে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটি বাতিল না করতে অনুরোধ করি। আমি তাকে বলি, আমরা যদি ধৈর্য ধরতে পারি, তাহলে হয়তো মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা কার্যকর করা সম্ভব হবে। কিন্তু আমরা যদি এখনই দেশবিভাগের পরিকল্পনা গ্রহণ করি, তাহলে আমরা ভারতবর্ষের অপূরণীয় ক্ষতি করব। একবার দেশ বিভক্ত হয়ে গেলে ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা কেউ বলতে পারে না। তাছাড়া, তখন শত চেষ্টা করলেও আর পূর্বাবস্থায় ফিরে আসা যাবে না।
লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে আমি আরো বলি যে, মিঃ অ্যাটলি এবং তার সহকর্মীরা নিজেদের উদ্যোগে যে পরিকল্পনা তৈরি করেছিলেন, তা হয়তো তারা সহজে পরিত্যাগ করবেন না। সুতরাং লর্ড মাউন্টব্যাটেন যদি এ ব্যাপারে একটু জোর দেন, তাহলে মন্ত্রিসভা হয়তো কোনো আপত্তি উত্থাপন করবেন না। এতোদিন কংগ্রেস বলে এসেছে, ভারতকে অবিলম্বে স্বাধীনতা দিতে হবে। এখন সেই কংগ্রেসই এ ব্যাপারে দুই বা তিন বছর অপেক্ষা করতে বলছে। একেই বলে ভাগ্যের পরিহাস। যাই হোক, ইংরেজরা যদি কংগ্রেসের এই অনুরোধ মেনে নেন, তাহলে কোনো তরফ থেকেই তাদের ওপর কেউ কোনো দোষারোপ করবে না। এ ছাড়া আরো একটি বিষয়ের প্রতি আমি লর্ড মাউন্টব্যাটেনের দৃষ্টি আকর্ষণ করি, তা হলো, ইংরেজরা যদি এ ব্যাপারে তাড়াহুড়ো করে কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন না করেন, তাহলে স্বাধীন দেশসমূহের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকরা স্বাভাবিকভাবেই মনে করবেন যে, ভারতীয়দের প্রস্তুত হবার সুযোগ না দিয়েই ইংরেজ সরকার তাদের ওপর স্বাধীনতা চাপিয়ে দিয়েছে। ভারতীয়দের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের ওপরে দেশবিভাগ চাপিয়ে দিলে অনেকেই হয়তো সন্দেহ করবেন যে, ইংরেজদের উদ্দেশ্য শুভ ছিল না।
লর্ড মাউন্টব্যাটেন আমাকে ভরসা দিয়ে বলেন যে, তিনি বিগত দুই মাসে যা দেখেছেন এবং যা শুনেছেন, সেসব বিষয় পুরোপুরিভাবেই মন্ত্রিসভার সামনে তুলে ধরবেন। মন্ত্রিসভাকে তিনি একথাও বলবেন যে, কংগ্রেসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভারতের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারটা এক বছর বা দু বছর স্থগিত রাখতে চান। আমার অভিমতও তিনি মিঃ অ্যাটলি এবং স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসকে জানাবেন বলে কথা দেন এবং শেষ পর্যন্ত আমাকে বলেন যে, তার কাছ থেকে সব কথা শোনার পর এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভায় শেষ সিদ্ধান্ত নেবেন।
এই সময় ভারত-বিভাগের সম্ভাব্য ফলাফলের কথাও আমি লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বিবেচনা করতে বলি। দেশ বিভক্ত হবার আগেই যখন কলকাতা, নোয়াখালি, বিহার, বোম্বাই এবং পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে এবং হিন্দুরা মুসলমানদের ও মুসলমানরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে, তখন দেশ বিভক্ত হলে সেই আবহাওয়ায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রক্তের নদী বয়ে যাবে এবং সেই ঘটনার জন্য ইংরেজরাই দায়ী হবেন।
এর উত্তরে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেন, ‘অন্ততপক্ষে একটা ব্যাপারে আমি আপনাকে পুরোপুরিভাবে আশ্বাস দিতে পারি যে, দেশে যাতে রক্তপাত এবং দাঙ্গা না হয়, সে বিষয়ে আমি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করব। আমি একজন সৈনিক, একথা আপনাকে স্মরণ রাখতে বলি। আপনি জেনে রাখুন, দেশবিভাগের প্রস্তাব যদি অনুমোদিত হয়, তাহলে দেশের কোনো জায়গায় যাতে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা না হয়, তার জন্য আমি কড়া নির্দেশ জারি করব এবং কোথাও যদি কোনো গোলমাল দেখা দেয়, তাহলে সেই গোলমালকে অঙ্কুরেই বিনাশ করবার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করব। এ ব্যাপারে আমি সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে পিছপা হব না। দরকার হলে ট্যাঙ্ক এবং বিমানবহরও ব্যবহার করব।’
লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কথাবার্তা শুনে প্রথম দিকে আমার ধারণা হয় যে, দেশকে বিভক্ত করাই তার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়; এবং শুধু এই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি লন্ডনে যাচ্ছেন না। শুধু তাই নয়, আমার আরো মনে হয়, মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাও তিনি বাতিল করেননি। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলী দেখে আমি আমার এই অভিমত পরিবর্তন করতে বাধ্য হই। পরবর্তীকালে তিনি যেভাবে কাজ করেছিলেন, তাতে মনে হয়, দেশবিভাগের ব্যাপারে তিনি আগে থেকেই মনস্থির করে লন্ডনে গিয়েছিলেন এবং মন্ত্রিসভাকে দিয়ে বিষয়টি অনুমোদন করিয়ে নিয়েছিলেন।
সারা পৃথিবী লক্ষ্য করেছে, লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সেই সাহসী ঘোষণাবাণীর ফলাফল কী হয়েছিল। দেশ বিভক্ত হবার পরে দেশের এক বিরাট অংশে রক্তের নদী বয়ে গিয়েছিল এবং নিরপরাধ নরনারী ও শিশু নির্দয়ভাবে নিহত হয়েছিল। ভারতের সেনাবিভাগ বিভক্ত হবার ফলে সৈনিকরাও এ ব্যাপারে কোনো হস্তক্ষেপ করেনি; তাদের চোখের সামনেই নিরপরাধ হিন্দু এবং মুসলমানদের হত্যা করা হলেও তারা তাতে বাধা দেননি বা সেই পাইকারি নরঘাতন বন্ধ করবার জন্য কোনো চেষ্টাও করেননি। এইজন্যই পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমি বলেছি, হয়তো লর্ড ওয়াভেলের অভিমতই সঠিক ছিল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন