১৯. উপসংহার
গান্ধীজীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে একটি যুগের অবসান হয়ে গেল। আজও আমি আমাদের অকর্মণ্যতার কথা ভুলতে পারছি না। ভারতের এই যুগপুরুষের জীবনরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আমরা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলাম। গান্ধীজীর ওপরে বোমা নিক্ষেপের পর স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে করা উচিত ছিল আবারও তাঁর ওপরে আক্রমণ হতে পারে। এমন আশা করাও অসঙ্গত ছিল না যে দিল্লীর পুলিস এবং সি.আই.ডি. এটাকে সাবধানবাণী হিসেবে গ্রহণ করে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে। একজন সাধারণ নাগরিককে হত্যা করার চেষ্টা করা হলেও পুলিস-বিভাগ বিশেষভাবে তৎপর হয়ে ওঠে। এমনকি কোনো লোক যদি ভীতিপ্রদর্শনমূলক কোনো চিঠি পায় তাহলেও পুলিসী তৎপরতা দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু গান্ধীজীর প্রাণহরণের হুমকি দিয়ে ইস্তাহার প্রচার করা হলেও এবং তাঁকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষিপ্ত হলো, কোনো রকম সাবধানতা অবলম্বন করা হয়নি। অথচ সাবধানতামূলক ব্যবস্থা অবলম্বন করা মোটেই কঠিন ছিল না। প্রার্থনাসভা খোলা মাঠে অনুষ্ঠিত হতো না। সভা অনুষ্ঠিত হতো বিড়লা ভবনের প্রাচীর-ঘেরা বাগানে। সুতরাং ফটক দিয়ে প্রবেশ করা ছাড়া কারো পক্ষে সেখানে উপস্থিত হওয়া সম্ভব ছিল না। সুতরাং পুলিস ইচ্ছে করলে সহজেই আগন্তুকদের যাতায়াতের সময় তাদের তল্লাশি করতে পারতো।
দুর্ঘটনা ঘটে যাবার পর দর্শকদের সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, হত্যাকারী নিতান্ত সন্দেহজনকভাবে ভেতরে ঢুকেছিল। তার চালচলন এবং কথাবার্তা এতোই সন্দেহজনক ছিল যে সি.আই.ডি.র লোকেরা সহজেই তার ওপরে নজর রাখতে পারত। পুলিস যদি তৎপর হতো তাহলে তাকে ঠিকই ধরতে পারতো এবং তার কাছ থেকে রিভলবারও কেড়ে নিতে পারত। লোকটি রিভলবার সঙ্গে নিয়ে বিনা বাধায় ভেতরে ঢুকেছিল। গান্ধীজী যখন প্রার্থনা-সভায় উপস্থিত হন তখন সে তাঁর সামনে এগিয়ে এসে বলে, ‘আজ আপনি দেরি করে এসেছেন।’ এর উত্তরে গান্ধীজী বলেন, ‘হ্যাঁ।’ এরপর তিনি আর দ্বিতীয় বাক্য উচ্চারণ করবার সুযোগ পান না। লোকটি তড়িৎগতিতে রিভলবার বের করে গান্ধীজীকে লক্ষ্য করে পর পর তিনবার গুলিবর্ষণ করে। সঙ্গে সঙ্গে গান্ধীজী মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
স্বাভাবিকভাবে এই ঘটনার পরে ভারতের জনসাধারণ ক্রোধে একেবারে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ তো প্রকাশ্যেই সর্দার প্যাটেলকে দায়ী করেন। এঁদের মধ্যে জয়প্রকাশ নারায়ণের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে তিনি এই বক্তব্যটি জনগণের সামনে তুলে ধরেন। দিল্লীতে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় তিনি গান্ধীজীর উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে গিয়ে বলেন, গান্ধীজীর হত্যার ব্যাপারে ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব স্খালন করতে পারেন না। তিনি সর্দার প্যাটেলের কাছ থেকে এ ব্যাপারে তাঁর বক্তব্য দাবি করেন। সেই জনসভায় তিনি যে অভিযোগ তোলেন তা হলো, গান্ধীজীকে হত্যা করা হবে বলে ইস্তাহার প্রচারিত হবার পরেও তাঁর প্রাণরক্ষার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়নি কেন?
কলকাতার ডঃ প্রফুল্ল ঘোষও প্রায় একই অভিযোগ করেন। তিনি গান্ধীজীর প্রাণরক্ষায় অক্ষম হবার জন্য ভারত সরকারকে দায়ী করেন। তিনি আরো বলেন, সর্দার প্যাটেল একজন শক্ত লোক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু স্বরাষ্ট্র বিভাগ তাঁর হাতে থাকা সত্ত্বেও গান্ধীজীর জীবনরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হয়নি? তাঁর এই প্রশ্নের উত্তরও তিনি সর্দার প্যাটেলের কাছে দাবি করেন।
সর্দার প্যাটেল তাঁর চিরাচরিত পন্থায়ই এইসব অভিযোগের মোকাবিলা করেন। তিনি প্রকাশ্যেই এইসব অভিযোগের প্রতিবাদ করেন। তবে প্রতিবাদ জানালেও বিষয়টি যে তাঁর মনের ওপর গভীরভাবে আঘাত করেছিল তাতে কোনোই ভুল নেই। নিজের দায়িত্ব স্খালনের জন্য তিনি কংগ্রেস পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় বলেছিলেন, কংগ্রেসের শত্রুরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে কংগ্রেসকে ভাঙতে চেষ্টা করছে। তিনি গান্ধীজীর প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, গান্ধীজীর মৃত্যুর ফলে যে বিপজ্জনক এবং ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এবং শত্রুপক্ষ যার সুযোগ গ্রহণ করবার চেষ্টা করছে, সে সম্বন্ধে আমাদের সবাইকে সর্বদা সজাগ থাকতে হবে এবং তার মোকাবিলা করবার জন্য একতাবদ্ধভাবে দাঁড়াতে হবে। পার্টির অনেক সদস্যই তাঁর বক্তব্য মেনে নেন।
দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ইতস্তত-বিক্ষিপ্ত কতকগুলো ঘটনা থেকে জানতে পারা যায়, সে সময় সাম্প্রদায়িকতার বিষ সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছিল। গান্ধীজীর হত্যাকাণ্ডের ফলে সমগ্র দেশ বিক্ষুব্ধ ও বিচলিত হলেও কোনো কোনো শহরে আনন্দোৎসবও পালিত হয়েছিল। এই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল গোয়ালিয়র ও উজ্জয়িনী শহরে। আমি খবর পেয়েছিলাম, ওই দুটি শহরের অধিবাসীরা প্রকাশ্যেই তাদের আনন্দ আপন করেছিল এবং বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে মিষ্টান্ন বিতরণ করেছিল। কিন্তু তাদের সেই আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। সারা দেশে জনগণের ক্রোধ এমনভাবে ফেটে পড়েছিল যাতে গান্ধীজীর শত্রুরা ভীষণভাবে ভীত হয়ে পড়েছিল। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল, গান্ধীজীর মৃত্যুর পরে দু-তিন সপ্তাহ হিন্দুমহাসভা এবং আর.এস.এস.-এর নেতারা ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতেই পারেননি। তখন হিন্দুমহাসভার প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী। তিনি তখন ভারত সরকারের একজন মন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু তিনিও তাঁর বাসস্থান থেকে বাইরে আসতে সাহস পাননি। কিছুদিন পরে তিনি মহাসভার প্রেসিডেন্ট পদে ইস্তফা দিয়ে দল থেকে সরে আসেন। এরপর ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি হতে থাকে এবং জনসাধারণও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে আসে।
হত্যাকারী গডসেকে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে মামলা খাড়া করতে অস্বাভাবিক বিলম্ব ঘটেছিল। পুলিসের ধারণা গান্ধীজীর হত্যাকাণ্ডের পেছনে একটি বড়রকম ষড়যন্ত্র ছিল এবং সেই ষড়যন্ত্রের উৎস বের করবার জন্যই তদন্তকার্যে মাসের পর মাস অতিবাহিত হয়েছিল। গডসের গ্রেপ্তারে জনগণের একটা ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। এরা সাম্প্রদায়িকতার বিষে জর্জরিত হয়ে পড়েছিল, যদিও বিরাট-সংখ্যক ভারতীয় গডসের কাজকে জঘন্যতম অপরাধ বলে বর্ণনা করেছিলেন এবং তাকে জুডাসের (যীশুখ্রীষ্টের হত্যাকারী) সঙ্গে তুলনা করেছিলেন, তবুও কয়েকজন ধনী পরিবারের মহিলারা গডসের জন্য সোয়েটার বুনে তার কাছে পাঠিয়েছিলেন। গডসের মুক্তির জন্যও আন্দোলন হয়েছিল। আন্দোলনকারীরা প্রকাশ্যে তার অপকর্মকে সমর্থন করতে না পেরে ভিন্ন পন্থা গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরা যে বক্তব্য উত্থাপন করেছিলেন তা হলো গান্ধীজী যেহেতু অহিংসায় বিশ্বাসী ছিলেন সেইহেতু তার হত্যাকারীকে প্রাণদণ্ড দেওয়া উচিত হবে না। জওহরলালের কাছে এবং আমার কাছে বহু লোক টেলিগ্রাম করে এই অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, গডসেকে প্রাণদণ্ড দেওয়া হলে তা হবে গান্ধীজীর নীতির বিরোধী। কিন্তু আইন তার নিজের পথ ধরেই চলে। হাইকোর্ট তার প্রাণদণ্ড বহাল রাখে।
গান্ধীজীর মৃত্যুর পর দু বছর পার না হতেই সর্দার প্যাটেল হৃদরোগে আক্রান্ত হন। আমার ব্যক্তিগত ধারণা, গান্ধীজীর হত্যাকাণ্ডের ফলে তাঁর মনের ওপর যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তার ফলেই তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। গান্ধীজীর জীবনের শেষদিকে প্যাটেল তাঁর ওপরে বিরূপ হয়েছিলেন কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে জনসাধারণ যখন তাঁকে কর্তব্যচ্যুতির দায়ে অভিযুক্ত করতে শুরু করে তখন তিনি প্রচণ্ড মানসিক আঘাত পান। তাছাড়া তিনি ভুলতে পারছিলেন না যে রাজনীতিক্ষেত্রে তাঁর উত্থান এবং প্রতিষ্ঠার মূলেই ছিলেন গান্ধীজী। তাঁর ওপরে গান্ধীজী চিরদিনই স্নেহশীল ছিলেন এবং সেই স্নেহ সময় সময় মাত্রা ছাড়িয়ে যেতেও দেখা গেছে। এইসব কথা তাঁর মনের ওপর যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল তার ফলেই তিনি থ্রম্বোসিসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এরপর তিনি মাত্র বছর চারেক জীবিত ছিলেন। কিন্তু হৃতস্বাস্থ্য আর তিনি ফিরে পাননি।
এইভাবেই ভারত তার একতা বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছে। পাকিস্তান নামক নতুন রাষ্ট্রটিও সৃষ্টি হয়েছিল ভারতবাসীর একতাকে বিসর্জন দিয়ে। পাকিস্তানের সৃষ্টিকর্তা হলো মুসলিম লীগ; সুতরাং স্বাভাবিক কারণেই পাকিস্তানের শাসনভার মুসলিম লীগের ওপরেই বর্তায়। মুসলিম লীগ কিভাবে কংগ্রেসের বিরোধিতা করবার জন্য স্থাপিত হয়েছিল সে কথা আমি আগেই বলেছি। লীগের মধ্যে এমন সদস্য খুব কমই ছিলেন যাঁরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এঁদের না ছিল কোনো ত্যাগ আর না ছিল কোনো সংগ্রামী ঐতিহ্য। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ভূতপূর্ব সরকারী কর্মচারী অথবা ইংরেজের প্রসাদভোজী ব্যক্তি। ইংরেজের অনুগ্রহে এবং তাঁদের পরোক্ষ সহায়তার জন্যই এঁরা নেতা হয়েছিলেন। সুতরাং পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন প্রতিষ্ঠিত হলো তখন এঁরাই এসে আসর জমিয়ে বসলেন। এঁরা ছিলেন একাধারে স্বার্থপর এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদী।
আরো একটি বিষয় এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার। পাকিস্তান রাষ্ট্রের যাঁরা কর্ণধার হয়ে বসলেন তাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন উত্তর প্রদেশ, বিহার এবং বোম্বাইয়ের অধিবাসী। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, পাকিস্তানের ভাষাও তাঁরা ঠিকমতো বলতে পারতেন না। ওখানে তাই শাসক এবং শাসিতের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছিল এক বিরাট ব্যবধান। এইসব বয়স্ক নেতা আশঙ্কা করতেন যে অবাধ নির্বাচন হলে তাদের মধ্যে অনেকেই বাদ পড়ে যাবেন। এঁরা তাই চেষ্টা করতে থাকেন যতদিন সম্ভব নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখতে এবং সেই সুযোগে নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে। আজ দশ বছর পার হয়ে গেছে, কিন্তু আজও ওখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে ওখানে একটা সংবিধান খাড়া করা হয়েছে। এটাও শেষ সংবিধান নয়, কারণ যখন-তখন সংবিধানের ধারাগুলোকে পরিবর্জন করবার কথা উঠছে। সুতরাং সংবিধান একটা খাড়া হলেও সে সংবিধান কবে চালু হবে অথবা আদৌ হবে কি না সে কথা কেউ বলতে পারে না।
পাকিস্তান গঠনের সদ্য ফল যা দেখা গেল তা হলো ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের অবস্থাকে ভয়াবহভাবে জটিল করে তোলা। ভারতে যে সাড়ে চার কোটি মুসলমান বাস করছেন তাঁরা এখন নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়েছেন। উপরন্তু এখনও এমন কোনো চিহ্ন দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না যাতে পাকিস্তানে একটি শক্তিশালী সরকার গঠিত হতে পারে। মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থের দিক থেকেও কেউ যদি বিষয়টি নিয়ে বিচার-বিবেচনা করেন তাহলে তাঁকে বলতেই হবে, পাকিস্তান গঠিত হলেও কোনো সমস্যারই সমাধান হয়নি। আমি এই বিষয় নিয়ে যত চিন্তা করেছি ততই আমার মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে, পাকিস্তান কোনো সমস্যারই সমাধান করতে পারেনি। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে যেরকম বিরোধিতার সৃষ্টি হয়েছিল তাতে দেশকে বিভক্ত করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। মুসলিম লীগের বেশিরভাগ সমর্থকই এই অভিমত পোষণ করতেন। এখানে আরো একটি কথা বলা দরকার, দেশবিভাগের পরে বহুসংখ্যক কংগ্রেস নেতাও এই অভিমত পোষণ করতে থাকেন। এই বিষয় নিয়ে যখনই আমি জওহরলাল ও সর্দার প্যাটেলের সঙ্গে আলোচনা করেছি তখনই তাঁরা তাঁদের সিদ্ধান্তকে সঠিক বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু আমরা যদি সুস্থ মস্তিষ্কে বিষয়টি নিয়ে বিচার-বিবেচনা করি তাহলে দেখতে পাব, তাঁদের বিশ্লেষণ মোটেই সঠিক ছিল না। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, মন্ত্রিমিশনের আমলে আমি যে পরিকল্পনা উপস্থাপিত করেছিলাম এবং যে পরিকল্পনা মন্ত্রিমিশনও মেনে নিয়েছিলেন, তা গ্রহণ করলে এর চেয়ে অনেক ভালো সমাধান হতে পারত। আমরা যদি দৃঢ় মনোভাব নিয়ে দেশবিভাগের বিরোধিতা করতাম তাহলে আমার বিশ্বাস, অনেক ভালো ফল পাওয়া যেত।
একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলেও সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়নি। বরং তা আরো বেশি জটিল এবং আরো ক্ষতিকর হয়েছে। এইরকম হওয়াই স্বাভাবিক, কারণ দেশবিভাগের মূল তত্ত্বই ছিল হিন্দু ও মুসলমানদের শত্রুতার ওপরে ভিত্তি করে।
পাকিস্তান রাষ্ট্র একটি স্থায়ী রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করলেও সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ আরো জটিল হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, ভারতীয় উপমহাদেশ দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে এবং এক রাষ্ট্র অপর রাষ্ট্রকে ঘৃণা আর ভয়ের চোখে দেখছে। পাকিস্তান বিশ্বাস করে, ভারত তাদের শান্তিতে থাকতে দেবে না এবং সুযোগ পেলেই সে তাকে ধ্বংস করবে। একইভাবে ভারত মনে করে, পাকিস্তান সুযোগ পেলেই ভারতের বিরুদ্ধাচরণ করবে এবং তাকে আক্রমণ করবে। এই চিন্তাধারার ফলে উভয় রাষ্ট্রই দেশরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে থাকে। লর্ড ওয়াভেল এক সময় বলেছিলেন, সশস্ত্রবাহিনীর তিনটি শাখার জন্য একশো কোটি টাকাই যথেষ্ট। ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর এক-চতুর্থাংশ পাকিস্তানে যায়। কিন্তু তবুও ভারত তার সশস্ত্রবাহিনীর জন্য বছরে দুশো কোটি টাকা ব্যয় করছে। ভারত সরকারের মোট বার্ষিক আয়ের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই দেশরক্ষা খাতে ব্যয় করা হচ্ছে। পাকিস্তানের অবস্থা আরো খারাপ। অবিভক্ত ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর মাত্র এক-চতুর্থাংশ তার ভাগে পড়লেও সে কমপক্ষে বছরে একশো কোটি টাকা দেশরক্ষা খাতে ব্যয় করছে। এর ওপর আমেরিকার কাছ থেকে পাওয়া অস্ত্রশস্ত্রের মূল্যও বড় কম নয়। আমরা যদি ধীরভাবে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করি তাহলে সহজেই বুঝতে পারব কি বিপুল পরিমাণ অর্থ এইভাবে বরবাদ হয়ে যাচ্ছে! এই অর্থ যদি আমরা উন্নয়নমূলক কাজে ব্যয় করতে পারতাম তাহলে দেশের অগ্রগতির কাজ বিরাটভাবে এগিয়ে যেত।
মিঃ জিন্না এবং তাঁর অনুগামীরা বুঝতেই চাননি পাকিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান তাদের বিরুদ্ধে যাবে। অবিভক্ত ভারতে মুসলমানরা এমনভাবে ছড়িয়ে ছিলেন যে সেইসব অঞ্চলকে একত্র করে একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠন করা অসম্ভব ব্যাপার। মুসলিমপ্রধান অঞ্চলগুলো ছিল ভারতের উত্তর-পশ্চিমে এবং উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এই দুটি অঞ্চলের ব্যবধান এতো বেশি যে উভয় অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে একমাত্র ধর্ম ব্যতীত আর কোনো ব্যাপারেই মিল নেই। যদি বলা হয়, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক ব্যবধান সত্ত্বেও এবং উভয় অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতি আলাদা হওয়া সত্ত্বেও একমাত্র সমধর্মাবলম্বী বলেই উভয় অংশের অধিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করা যাবে তাহলে তা হবে একটা বিরাট ধাপ্পা। প্রথমদিকে ইসলাম এমনি একটি রাষ্ট্র গঠন করতে সচেষ্ট হয়েছিল, কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, শত চেষ্টা করেও ইসলাম সব দেশের মুসলমানদের একই রাষ্ট্রের অধীনে আনতে পারেনি।
এই অবস্থা আগেও ছিল এবং এখনও আছে। কোনো লোকই এমন আশা করতে পারেন না পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীরা তাঁদের সমস্ত ব্যবধান ভুলে গিয়ে এক জাতিতে পরিণত হবেন। আবার পশ্চিম-পাকিস্তানেও সিন্ধু, পাঞ্জাব এবং সীমান্ত প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে যথেষ্ট ব্যবধান রয়েছে এবং ওইসব অঞ্চলের মুসলমানেরা বিভিন্ন উদ্দেশ্য এবং বিভিন্ন স্বার্থ নিয়ে কাজ করছেন। কিন্তু পাশা যখন উল্টেই গেছে এবং নবগঠিত পাকিস্তান যখন একটি বাস্তব সত্যে পরিণত হয়েছে তখন ভারত এবং পাকিস্তান উভয়েরই উচিত হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে যাতে পাশাপাশি থাকা যায় তার ব্যবস্থা করা। অন্য কিছু করা হলে তার ফল মোটেই ভালো হবে না। অনেকে মনে করেন যা ঘটেছে তা অন্যায় এবং তাকে পরিহার করা যেত। আজও আমরা বলতে পারি না কোনটি সঠিক এবং কোটি বেঠিক। ভবিষ্যৎ ইতিহাসই স্থির করবে দেশবিভাগ মেনে নিয়ে আমরা বুদ্ধিমানের মতো কাজ করেছি কি না!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন