২০। পরিশিষ্ট

২০. পরিশিষ্ট

ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের তরফ থেকে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস নিম্নলিখিত ঘোষণাবাণীর খসড়া উপস্থাপিত করেন:

মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট, এই দেশে (অর্থাৎ ইংল্যাণ্ডে) এবং ভারতবর্ষে যেরকম উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে যেসব আশ্বাস দেওয়া হয়েছে সেসব বিষয় বিবেচনা করে ভারতবর্ষকে অবিলম্বে স্বায়ত্তশাসনাধিকার প্রদান করা সম্পর্কে যে ব্যবস্থা গৃহীত হবে বলে মনস্থ করেছেন তা সুস্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এর উদ্দেশ্য হলো ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র নামে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠন করা, যে রাষ্ট্রটি ইংল্যাণ্ডের যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের মতো ইংল্যাণ্ডের রাজমুকুটের অধীনে থেকে অন্যান্য ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সমান ক্ষমতার ভিত্তিতে কাজ করবে, তবে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র বিষয়ে কোনোক্রমেই কারো অধীনস্থ হবে না।

মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট এই উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত ঘোষণাবাণী প্রচার করছেন:

(ক) যুদ্ধ শেষ হবার অব্যবহিত পরে ভারতবর্ষের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করার উদ্দেশ্যে ভারতের জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত একটি প্রতিনিধিমণ্ডলী গঠন করা হবে।

(খ) ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোও যাতে উক্ত শাসনতন্ত্র রচনার কাজে অংশগ্রহণ করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে।

(গ) যে শাসনতন্ত্র রচিত হবে তা নিম্নবর্ণিত শর্তসাপেক্ষে মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট মেনে নেবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।—

(১) ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষের যেসব প্রদেশ উক্ত শাসনতন্ত্র গ্রহণ করতে সম্মত হবে না সেসব প্রদেশ যাতে ভবিষ্যতে তাদের ইচ্ছানুসারে কাজ করতে পারে, অর্থাৎ নতুন শাসনতন্ত্র মেনে নিয়ে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে অথবা না দিতে পারে তার জন্য যথাবিহিত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে। যেসব প্রদেশ ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রে যোগ দিতে চাইবে না, তারা ইচ্ছা করলে নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে তাদের জন্য একটি নতুন শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারবে।

(২) মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট এবং উক্ত শাসনতন্ত্র রচনাকারী সংস্থার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। এই চুক্তিতে ভারতীয়দের হাতে পুরোপুরিভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয় উল্লেখিত থাকবে; বিভিন্ন সম্প্রদায়কে এবং বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষার জন্য মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট যেসব আশ্বাস দিয়েছেন সেগুলো যাতে পুরোপুরিভাবে রক্ষিত হয় সে কথাও উক্ত চুক্তিতে উল্লেখিত থাকবে; তবে এর দ্বারা ব্রিটিশ কমনওয়েলথভুক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণের ব্যাপারে কোনো রকম বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে না।

ভারতের কোনো দেশীয় রাজ্য যদি নতুন শাসনতন্ত্র মেনে নিতে চায়, অথবা না চায় তাহলে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের সঙ্গে তাদের যে সন্ধি রয়েছে তার শর্তগুলি নতুন ব্যবস্থা অনুসারে পরিবর্তন করার প্রয়োজন হতে পারে।

(ঘ) ভারতবর্ষের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দ যদি যুদ্ধ শেষ হবার আগে বা পরে অন্য কোনো রকম ব্যবস্থা না চান তাহলে শাসনতন্ত্র রচনাকারী সংস্থা নিম্নবর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে গঠিত হবে:

যুদ্ধ শেষ হলে প্রাদেশিক স্তরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। উক্ত নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন প্রদেশের বিধানসভার নিম্নতর কক্ষের সদস্যরা একটি ইলেকটোরাল কলেজ গঠন করবে এবং নিজ নিজ প্রদেশের প্রতিনিধিদের শতকরা সংখ্যা অনুসারে শাসনতন্ত্র রচনাকারী সংস্থা গঠনের জন্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে। ইলেকটোরাল কলেজের সদস্যসংখ্যার এক-দশমাংশ নিয়ে এই নতুন সংস্থা গঠিত হবে।

ব্রিটিশ ভারতের মতো ভারতের দেশীয় রাজ্যগুলোকেও তাদের নিজ নিজ রাজ্যের জনসংখ্যা অনুপাতে প্রতিনিধি পাঠাবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে। এইসব প্রতিনিধির ক্ষমতা ব্রিটিশ ভারতের প্রতিনিধিদের চেয়ে কোনো অংশে ন্যূন হবে না।

(ঙ) ভারতবর্ষে এখন যেরকম অনিশ্চিত অবস্থা বিরাজ করছে সেই অনিশ্চিত কাল এবং নতুন শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া পর্যন্ত মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট ভারতের শাসনব্যবস্থার এবং বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপারে তাঁদের দায়িত্ব অনুসারে ভারতের প্রতিরক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব পূর্বের মতোই নিজের হাতে রাখবেন। মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃবৃন্দকে অবিলম্বে এগিয়ে আসতে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন এবং আশা করছেন যে উক্ত নেতৃবৃন্দ তাঁদের দেশ, কমনওয়েলথ এবং মিত্র জাতিসমূহের স্বার্থে একযোগে কাজ করবেন। এবং এইভাবে তাঁরা ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার পথ সুগম করবার জন্য কার্যকরী এবং গঠনমূলক সাহায্য দেবেন।

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের সঙ্গে পত্রালাপ

বিড়লা পার্ক
নয়া দিল্লী, এপ্রিল ১০, ১৯৪২

প্রিয় স্যার স্ট্যাফোর্ড,

২রা এপ্রিল আমি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবটি আপনার কাছে পাঠিয়েছিলাম। উক্ত প্রস্তাবে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের খসড়া ঘোষণাবাণী (যা আপনার মাধ্যমে প্রেরিত হয়েছে) সম্পর্কে কমিটি তার মতামত ব্যক্ত করেছে। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে আমরা ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী ব্যবস্থা সম্বন্ধে আমাদের আপত্তি জ্ঞাপন করেছি। আপত্তিকর বিষয়গুলো নিয়ে পরে আমরা আরো বিচার-বিবেচনা করেছি এবং তার ফলে এই দৃঢ় প্রত্যয়ে এসেছি যে আমাদের আপত্তি সম্পূর্ণরূপে যুক্তিসঙ্গত। সুতরাং আমরা আবার বলছি, ঘোষণাবাণীর উক্ত অংশ যেভাবে ঘোষণাবাণীতে স্থান পেয়েছে সেভাবে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে আমাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তই প্রকাশ করা হয়েছে।

উক্ত প্রস্তাবে বর্তমান পরিস্থিতির ওপর জোর দিয়ে বলা হয়েছে, বর্তমান ব্যবস্থার সম্ভাব্য পরিবর্তনের ওপরেই আমাদের শেষ সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। আমাদের তথা সমগ্র ভারতবাসীর সামনে যে সমস্যাটা সর্বপ্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো শত্রুর আক্রমণের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। সুতরাং পরবর্তী কয়েক মাসে অথবা কয়েক বছরে কি ঘটবে বা ঘটতে পারে তার ওপরেই আমাদের ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নির্ভর করবে। তবে ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে কোনো নিশ্চয়তা না পেলেও আমরা এখন এই আশা নিয়ে কাজে এগোতে চাই যে দেশরক্ষার জন্য আত্মত্যাগ করেই আমরা ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের সুদৃঢ় ভিত্তি স্থাপন করতে সক্ষম হব। এবং এই কারণেই আমরা বর্তমান ব্যবস্থার ওপরে সমধিক গুরুত্ব আরোপ করেছি।

ঘোষণাবাণীর ‘ঙ’ ধারায় যে কথা বলা হয়েছে তা অসম্পূর্ণ এবং অর্থহীন। ওতে আসল কথা সম্বন্ধে যে বিষয় পরিষ্কার করে বলা হয়েছে তা হলো, ভারতের শাসন ব্যবস্থা এবং প্রতিরক্ষার পূর্ণ দায়িত্ব ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের হাতেই ন্যস্ত থাকবে। আমাদের শুধু বলা হয়েছে, ভারতের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার জন্য ইংরেজের সঙ্গে সহযোগিতা করে চলতে। স্বাধীনতা সম্পর্কে ওখানে কিছুই বলা হয়নি; ওটা ভবিষ্যতের জন্য শিকেয় তুলে রাখা হয়েছে। তাছাড়া, বর্তমানে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে অথবা সরকার গঠন সম্পর্কে কিংবা কোনো রকম পরিবর্তন সম্বন্ধেও উক্ত ‘ঙ’ ধারায় কিছুই বলা হয়নি। আমরা যখন এই অসম্পূর্ণতা এবং অর্থহীনতার কথা আপনার সামনে তুলে ধরেছিলাম তখন আপনি আমাদের বলেছিলেন, ওটি ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে, কারণ এর দ্বারা আপনি বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে পারবেন। আলোচনার সময় আপনি আমাদের আরো বলেছিলেন, একমাত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া অন্যান্য সমস্ত ব্যবস্থাই পরিচালনা করবে জাতীয় সরকার।

প্রতিরক্ষা সব সময়ই এবং বিশেষ করে যুদ্ধের সময় নিঃসন্দেহে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং কোনো জাতীয় সরকারই এটি বাদ দিয়ে কাজ করতে পারে না। এই বিষয় ছাড়া আপনি আরো যে বিষয়ের ওপরে জোর দিয়েছিলেন তা হলো শত্রু কর্তৃক ভারত আক্রমণের সম্ভাব্য বিপদ। জাতীয় সরকারের প্রধানতম কর্তব্যই হলো দেশের জনসাধারণের সর্বাঙ্গীণ সহযোগিতার মাধ্যমে সর্ববিধ উপায়ে দেশের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা করে আক্রমণকারীর মোকাবিলা করা। এ কাজ একমাত্র জাতীয় সরকারই সুষ্ঠুভাবে করতে পারে। প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করবার জন্য জাতীয় পটভূমি থাকা দরকার। কারণ তার দ্বারা সামরিক-অসামরিক-নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষই বুঝতে পারে সে তার দেশের স্বাধীনতার জন্য জাতীয় নেতাদের নেতৃত্বে যুদ্ধ করছে।

এই প্রশ্ন শুধু জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের উদ্দেশ্যেই তোলা হয়েছে তাই নয়, সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এবং ভারতের মাটিতে পদার্পণকারী শত্রুর মোকাবিলা করবার জন্যও এর প্রয়োজন আছে। এ ব্যাপারে সর্বত্র যে সাধারণ নীতি প্রচলিত আছে তা হলো যে-কোনো সরকার তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতির মাধ্যমে তার সমগ্র বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করে। ভারতের জাতীয় সরকারেরও এই পদ্ধতি অনুসারেই কাজ করা উচিত। আমরা সুস্পষ্টভাবে বলেছি, প্রধান সেনাপতিই সশস্ত্রবাহিনী পরিচালনা করবেন এবং আক্রমণ প্রতিআক্রমণ ইত্যাদি ব্যাপারে যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবেন। এ ব্যাপারে ঐকমত্যে আসবার জন্য প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ক্ষমতাকে সীমিত করতেও আমরা সম্মত হয়েছিলাম। যুদ্ধের বর্তমান অবস্থায় সশস্ত্রবাহিনীতে সামান্যতম রদবদল করার বাসনাও আমাদের নেই। আমরা আরো স্বীকার করেছিলাম, যুদ্ধসংক্রান্ত ব্যবস্থার ভার ইংল্যাণ্ডের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার হাতেই থাকবে। তবে সেখানে একজন ভারতীয় সদস্য রাখতে হবে। আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে আরো বেশি কার্যকর এবং আরো বেশি সুদৃঢ় করা এবং তার জন্য জনগণের সহযোগিতা লাভ করা। যুদ্ধ পরিচালনা সম্পর্কিত যান্ত্রিক ব্যবস্থার ওপরে কোনো রকম হস্তক্ষেপ করবার ইচ্ছা আমাদের নেই। সুতরাং এই বিষয়ে একটি সর্বসম্মত পন্থা বের করতে কোনো রকম অসুবিধে হবার কথা নয়। কারণ এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে আদৌ কোনো মতবিরোধ নেই।

প্রতিরক্ষার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করে আপনি ও সম্পর্কে যে মূলনীতি নির্ধারণ করেছিলেন তা আপনি আপনার ৭ই এপ্রিলের পত্রে আমাকে জানিয়ে দিয়েছেন। উক্ত পত্রে আপনি বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালে ওয়ার্কিং কমিটির অভিমত অনুসারে বর্তমান ব্যবস্থার কোনো রকম পরিবর্তন করা যাবে না।’ এ ব্যাপারে ওয়ার্কিং কমিটির মনোভাব সম্পর্কে আপনার মনে ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং আমি পুনর্বার বিষয়টি পরিষ্কার করে বলার দরকার বোধ করছি। যুদ্ধের সময় শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন অসম্ভব বলে কমিটি মনে করে না। যুদ্ধব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে চালিত করবার জন্য যা যা করণীয় তা অবশ্যই করতে হবে। এবং এইভাবেই জয়কে সুনিশ্চিত করা যাবে। এর জন্য কোনো রকম জটিল আইন প্রণয়নেরও দরকার হবে না। ইচ্ছে থাকলে ভারতের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সহজেই স্বীকার করে নেওয়া যায়। এর জন্য শাসনব্যবস্থার অল্পস্বল্প পরিবর্তনের প্রয়োজন হলেও তার জন্য কোনো রকম অসুবিধা হবার কথা নয়। বাকি বিষয়গুলো ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া যেতে পারে।

এই সম্পর্কে আমি আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ফ্রান্সের পতনের অব্যবহিত পূর্বে ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের সংযুক্তির প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোনো পরিবর্তনের কথা চিন্তাও করা যায় না। এই প্রস্তাব করা হয়েছিলো যুদ্ধে যখন প্রচণ্ডতম ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল ঠিক সেই সময়েই। যুদ্ধ এমনই একটি ব্যাপার যে প্রচলিত আইনকানুনকে অগ্রাহ্য করেই প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন স্বীকার করে নেওয়া হয়।

আপনি প্রতিরক্ষা সম্পর্কে যে মূলনীতি আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন তা আমরা বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা করেছি। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে কী কী বিষয় থাকবে তার একটি তালিকাও আপনি পাঠিয়েছিলেন। উক্ত তালিকাও আমরা বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছি। তালিকাটি দেখে বুঝতে পারা গেছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর হাতে যেসব বিষয় থাকবে সেগুলোর কোনোই গুরুত্ব নেই। এ আমরা মেনে নিতে পারিনি এবং সে কথা আপনাকে জানিয়েও দিয়েছি।

পরবর্তীকালে এ ব্যাপারে একটি নতুন পরিকল্পনা আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছিলো। কিন্তু তার সঙ্গে কোনো তালিকা ছিলো না। এই পরিকল্পনা আমাদের কাছে অনেকটা ভালো বলে বিবেচিত হয়। আমরা তাই ওতে অল্পস্বল্প পরিবর্তন দরকার হবে বলে আপনাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। তখনও আমরা বলেছিলাম, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর অধীনে যেসব বিষয় থাকবে তার তালিকার ওপরই আমাদের শেষ সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।

এরপর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে আরো একটি সংশোধিত পরিকল্পনা আমাদের কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু তার সঙ্গেও কোনো তালিকা ছিলো না। এই পরিকল্পনায় সামরিক বিভাগের কাজকর্ম সম্বন্ধেই বিশেষ করে বলা হয়।

পরিকল্পনাটি এমন জটিল ও ব্যাপকভাবে তৈরি করা হয়েছে যে ও থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অধীনে কোন্ কোন্ বিষয় থাকবে এবং সমর-বিভাগের অধীনে কোন্ কোন্ বিষয় থাকবে তা বুঝতেই পারা যায় না। এই কারণেই আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা আপনার কাছ থেকে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে রকম কোনো তালিকা এখনও পর্যন্ত আমাদের কাছে পাঠানো হয়নি।

আপনার সঙ্গে আমাদের সাক্ষাৎকারের সময় এই নতুন পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমরা আলোচনা করেছিলাম এবং এ সম্বন্ধে আমাদের মতামত আপনাকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। সুতরাং এখানে নতুন করে ও সম্বন্ধে কিছু বলা হচ্ছে না। পরিকল্পনার শব্দবিন্যাস যেরকমই হোক না কেন, তাতে বিশেষ কিছু আসে-যায় না। তবে গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় যদি বাদ পড়ে গিয়ে থাকে তো আলাদা কথা। কিন্তু এই শব্দবিন্যাসের পেছনে এমন একটি মতলব দেখা যাচ্ছে যা দেখে আমরা রীতিমতো বিস্ময়বোধ করছি। কারণ ও থেকে বোঝা যাচ্ছে এতদিন আমরা আলেয়ার পেছনে ঘুরেছি।

আমরা যখন আপনাকে উভয় বিভাগের অধীনস্থ বিষয়গুলোর পূর্ণাঙ্গ তালিকা দিতে বলেছিলাম তখন আপনি সেই পুরনো তালিকার কথাই পুনরুল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু আপনি ভালোভাবেই জানেন ওই তালিকা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম। আপনি অবশ্য এ সম্বন্ধে আরো একটি কথা জুড়ে দিয়েছিলেন, আরো কিছু নতুন বিষয় তালিকার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলেন, নতুন তালিকার সঙ্গে পুরনো তালিকার তেমন কিছু পার্থক্য থাকবে না। সুতরাং আমরা যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম আবার সেখানেই ফিরে যেতে হচ্ছে। নতুন পরিকল্পনায় শব্দবিন্যাসে কিছু নতুনত্ব থাকলেও ওতে পুরনো জিনিসই রয়ে গেছে।

আমাদের মধ্যে আলোচনার সময় আরো অনেক বিষয় সম্বন্ধে পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছিলো; তবে সমস্ত ব্যাখ্যাই আমাদের বিপক্ষে গিয়েছিলো। আপনি ব্যক্তিগতভাবে এবং প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে জাতীয় সরকার এবং মন্ত্রিবর্গ-সমন্বিত ক্যাবিনেটের কথা বলেছিলেন। আপনার সেইসব কথা শুনে আমরা মনে করেছিলাম নতুন সরকার ক্যাবিনেট গভর্নমেন্টের মতোই কাজ করবে এবং সেখানে ভাইসরয় থাকবেন নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে; কিন্তু এখন আপনি যে চিত্রটি আমাদের সামনে তুলে ধরছেন তার সঙ্গে আগের চিত্রের বিশেষ কোনো প্রভেদ নেই। যেটুকু পার্থক্য আছে তা শুধু নামে। এবার আপনি নতুন সরকারের যে চিত্রটি দিয়েছেন সে সরকারকে কোনো মতেই জাতীয় সরকার বলা চলে না। তাছাড়া জাতীয় সরকারের মতো কাজও এ সরকার করতে পারবে না। ওতে এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সর্বেসর্বা হিসেবে ভাইসরয়ই হবেন সর্বক্ষমতার অধিকারী। আমরা কোনো রকম আইনগত পরিবর্তন দাবি না করলেও আপনার কাছ থেকে সুস্পষ্টভাবে জানতে চেয়েছিলাম নতুন সরকার একটি স্বাধীন সরকারের মতো কাজ করবে এবং তার সদস্যরা সাংবিধানিক সরকারের ক্যাবিনেটের মতো কাজ করবার সুযোগ পাবে। আমরা আরো বলেছিলাম, যুদ্ধ পরিচালনা এবং যুদ্ধ সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ের ভার প্রধান সেনাপতির ওপরই থাকবে এবং তিনি সমর-মন্ত্রীর মতো কাজ করবেন।

আমাদের জানানো হয়েছে, ভাইসরয়ের কাজ এবং ক্ষমতা সম্বন্ধে বর্তমান স্তরে আর বেশি কিছু বলা সম্ভব হবে না। এর অর্থ এই দাঁড়ায়, ভাইসরয়ের সঙ্গে কাউন্সিলের সদস্যদের মতবিরোধ হলে সদস্যদের পদত্যাগ করতে হবে। এ একটা অদ্ভুত ব্যবস্থা, কারণ এতে পদত্যাগের কথা আগে থেকেই মেনে নিয়ে নতুন সরকার গঠনের জন্য আমাদের এগিয়ে আসতে হবে। এই কারণেই আমরা বলছি, নতুন পরিকল্পনার সঙ্গে পুরনো ব্যবস্থার বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই। আমাদের মতে, এবং হয়তো আপনার মতেও, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাবটি ভারতীয়দের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাবার জন্যই উত্থাপন করা হয়েছে। অর্থাৎ ভারতের জনসাধারণ যাতে নবগঠিত সরকারকে তাদের সরকার বলে মনে করে এবং সঙ্গে সঙ্গে এও মনে করে যে তারা তাদের নবলব্ধ স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই যুদ্ধ করছে, এই উদ্দেশ্যেই প্রস্তাবটি আনা হয়েছে। কিন্তু জনসাধারণ যখন দেখতে পাবে, নতুন সরকার আগের দিনের পুরনো সরকারের প্রতিমূর্তি ছাড়া আর কিছু নয়, তখন তারা প্রচণ্ডভাবে হতাশ হয়ে পড়বে। যে ইন্ডিয়া অফিস আমাদের কাছে এক বিরাট অন্যায় ব্যবস্থার প্রতীকরূপে বিরাজ করছে তার যথাপূর্ব অবস্থিতিও এই ধারণারই পরিপোষণ করবে। কিছুকাল আগে থেকে জনগণের মনে এমন একটি ধারণার সৃষ্টি হয়েছিলো, ইন্ডিয়া অফিস শিগগিরই বিলুপ্ত হবে কিন্তু এখন আমাদের বলা হচ্ছে, ওটি আগের মতোই বিরাজমান থাকবে।

সুতরাং আপনার প্রস্তাবিত এই সরকারের মধ্যে আমাদের নিজেদের খাপ খাওয়ানো সম্ভব নয়। সাধারণভাবে এই বিষয় সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিতে আমাদের বিলম্ব হবার কথা নয়; কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের প্রতিরক্ষার কথা চিন্তা করে আমরা যে-কোনো সুষ্ঠু প্রস্তাবই বিবেচনা করতে সম্মত আছি। যে বিপদ আজ ভারতের দ্বারপ্রান্তে এসে হাজির হয়েছে সে বিপদ বিদেশীর অপেক্ষা আমাদের ওপরই বেশি করে চেপেছে। সুতরাং সঙ্গতভাবেই আমরা সেই বিপদের মোকাবিলা করবার জন্য আগ্রহান্বিত। কিন্তু স্বাধিকার এবং ক্ষমতা না পেলে পুরনো ব্যবস্থার মধ্যে থেকে আমরা এই বিপদের মোকাবিলা করার দায়িত্ব নিতে পারি না।

আপনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার সঙ্গে সঙ্গে একথাও বলে রাখছি, ভারতে যদি একটি জাতীয় সরকার গঠিত হয় তাহলে এখনও আমরা দায়িত্ব গ্রহণ করতে সম্মত আছি। ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে আমাদের সুনির্দিষ্ট অভিমত থাকলেও এখনই আমরা সেসব সম্বন্ধে কোনো রকম প্রশ্ন তুলবো না। তবে আমাদের বুঝতে দিতে হবে, নবগঠিত সরকার প্রকৃতই একটি জাতীয় সরকার হবে এবং সে সরকারে ভাইসরয় নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে থাকলেও ভারতীয় সদস্যরা ক্যাবিনেটের মতো কাজ করবে। প্রতিরক্ষা ব্যাপারে আমরা আমাদের অভিমত আগেই জানিয়ে দিয়েছি। আমরা মনে করি, প্রতিরক্ষার ব্যাপারে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্য ও সহযোগিতার বিশেষ প্রয়োজন আছে এবং সেজন্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে জনপ্রিয় করে তুলতে হবে।

এই বক্তব্যকে শুধু আমাদের বক্তব্য বলে বিবেচনা না করে একে ভারতের জনসাধারণের সামগ্রিক বক্তব্য হিসেবে মনে করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো দল অথবা সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনোই মতদ্বৈধ নেই; মতানৈক্য যা কিছু আছে তা ভারতের জনসাধারণ এবং ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের মধ্যে। ভারতে যে মতবৈষম্য বিদ্যমান রয়েছে তা হলো ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে। সর্বাধিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে এবং সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার জন্য এই বিষয়কে আমরা কিছুকালের জন্য স্থগিত রাখতেও সম্মত আছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ভারতে এ ব্যাপারে পূর্ণ মতৈক্য বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও ব্রিটেনের সরকার ভারতে জাতীয় সরকার গঠনের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে এবং এই সঙ্কটজনক সময়ে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ নিদারুণ দুঃখকষ্ট ভোগ করছে এবং প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে তখনও জাতীয় সরকার গঠন করা হচ্ছে না।

ভবদীয় গুণমুগ্ধ
স্বাঃ আবুল কালাম আজাদ

দি রাইট অনারেবল স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস,
৩, কুইন ভিক্টোরিয়া রোড,
নয়া দিল্লী।

১১ই এপ্রিল ক্রিপস আমাকে নিম্নলিখিত উত্তর দেন:

৩, কুইন ভিক্টোরিয়া রোড,
নয়া দিল্লী, ১১ই এপ্রিল, ১৯৪২

প্রিয় মৌলানা সাহেব,

আপনার ১০ই এপ্রিলের পত্রে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক মহামান্য ইংল্যান্ডেশ্বরের গভর্নমেন্টের খসড়া ঘোষণাটি প্রত্যাখ্যানের কথা জেনে মর্মাহত হলাম।

কমিটি তার প্রস্তাবে যেসব বিষয় উত্থাপন করেছে এবং যে প্রস্তাব আপনি আমার কাছে পাঠিয়েছেন সেসব বিষয় সম্পর্কে এখন আমি কোনো প্রশ্ন তুলছি না। কারণ ওগুলো স্পষ্টতই আপনাদের এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ নয়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতির মধ্যে কার হাতে কী কী দায়িত্ব থাকবে সে সম্বন্ধেও আপনি দীর্ঘ আলোচনা করেছেন; সুতরাং ও ব্যাপারেও আমি কোনো প্রশ্ন তুলছি না।

দায়িত্বের এই বিভাগ অনুসারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর হাতে যেসব বিষয় থাকবে তা হলো, প্রধান সেনাপতির এখতিয়ারভুক্ত সেনাবাহিনীর প্রধান কার্যালয়, নৌবাহিনীর প্রধান কার্যালয় এবং বিমানবাহিনীর প্রধান কার্যালয় ছাড়া প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত অন্যান্য যাবতীয় বিষয়। এইসব বিষয়ের বাইরে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আরো কিছু সীমিত বিষয় থাকবে। যথা:

স্বরাষ্ট্র বিভাগ—আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা, পুলিশ, উদ্বাস্তু ইত্যাদি।

অর্থ বিভাগ—যুদ্ধসংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়।

যোগাযোগ বিভাগ—রেলওয়ে, সড়ক পরিবহন, মাল পরিবহন ইত্যাদি।

সরবরাহ বিভাগ—সেনাবাহিনীর জন্য যাবতীয় দ্রব্য এবং গুলি-বারুদ।

তথ্য ও বেতার বিভাগ—প্রচার ইত্যাদি।

অসামরিক প্রতিরক্ষা বিভাগ—বিমান আক্রমণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (এ-আর-পি) এবং অন্যান্য যাবতীয় অসামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

আইন বিভাগ—আইনগত নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশ।

শ্রম বিভাগ—জনশক্তি।

প্রতিরক্ষা বিভাগ—দপ্তর পরিচালনা এবং ভারতীয় কর্মচারী ইত্যাদি।

এইসব কাজ এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের বিভিন্ন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্যদের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

এইসব বিষয় ছাড়া প্রতিরক্ষা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্যের হাতে আর কোনো ক্ষমতা দেওয়া যাবে না। কারণ তাতে প্রধান সেনাপতির এখতিয়ারকে খর্ব করা হবে এবং যুদ্ধপ্রচেষ্টার ক্ষতি হবে। আপনারা জানেন, যুদ্ধ চলাকালে যুদ্ধ পরিচালনার যাবতীয় দায় এবং দায়িত্ব মহামান্য ইংল্যান্ডেশ্বরের সরকারের হাতে ন্যস্ত থাকবে।

জাতীয় সরকারে অংশ গ্রহণ করা সম্বন্ধে আপনাদের প্রধান আপত্তি হলো এই, আপনাদের ইচ্ছা অনুসারে সরকার গঠন করা হচ্ছে না।

আপনি দুটি বিষয়ের কথা বলেছিলেন। প্রথমটি হলো, এখনই শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করতে হবে। এ সম্পর্কে আমি বলতে চাই, আমার প্রস্তাব তিন সপ্তাহ আগে আপনাদের কাছে উত্থাপিত হলেও এ প্রশ্ন মাত্র গতরাত্রে তোলা হয়েছে। এ সম্পর্কে আমি আরো বলতে চাই, ইতিমধ্যে অন্যান্য দলের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আমি যেসব আলোচনা করেছি তাতে প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন, বর্তমান অবস্থায় কোনো রকম আইনগত পরিবর্তন সম্ভব নয়।

আপনার দ্বিতীয় বক্তব্য হলো, ‘একটি প্রকৃত জাতীয় সরকার’ গঠন করতে হবে—যে সরকার ক্যাবিনেট সরকারের মতো পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন হবে।

এ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হলো, শাসনতান্ত্রিক কাঠামোকে ঢেলে সাজা না হলে এ সম্ভব নয়—যা আপনারাও বোঝেন।

যেখানে প্রচলিত ব্যবস্থা অনুসারে এই পদ্ধতি অনুসৃত হবে সেখানে নির্বাচিত ক্যাবিনেট (সম্ভবত প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বারা নির্বাচিত) তাদের নিজেদের কাছে ছাড়া আর কারো কাছে দায়ী থাকবে না। এ সম্ভব নয়, কারণ এর দ্বারা সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।

এই প্রস্তাব ভারতের প্রতিটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই মেনে নিতে চাইবে না। কারণ, এর ফলে তারা চিরদিনের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের পদানত হয়ে থাকবে। তাছাড়া মহামান্য ইংল্যান্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা সম্বন্ধে যেসব গ্যারান্টি দিয়েছেন, সেসব গ্যারান্টি রক্ষা করাও এর ফলে সম্ভব হবে না।

ভারতের মতো একটি দেশে, যেখানে সাম্প্রদায়িক বিভাজন এখনও এতো গভীর, সেখানে সংখ্যালঘুদের প্রতি দায়িত্ববিহীন সংখ্যাগরিষ্ঠের সরকার গঠন করা সম্ভব নয়।

এছাড়া ভারতের জনসাধারণ কর্তৃক ‘নতুন শাসনতন্ত্র রচিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় জনগণের এক বিরাট অংশের প্রতি মহামান্য ইংল্যান্ডেশ্বরের গভর্নমেন্টের যে কর্তব্য রয়েছে এবং সরকার তাদের যেসব কথা দিয়েছে, তা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।

মহামান্য ইংল্যান্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে অবিলম্বে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তন ছাড়া যতটা সম্ভব ক্ষমতা দেওয়া যায় তার ব্যবস্থা রয়েছে এবং বর্তমান পরিস্থিতির বিবেচনায় এটি সাধারণভাবে স্বীকৃত হয়েছে।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য ইংল্যান্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট এবং আমি ওয়ার্কিং কমিটির সদিচ্ছা, অর্থাৎ সর্ববিধ উপায়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ইচ্ছার কথা অনুধাবন করলেও দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে আপনার ওয়ার্কিং কমিটির যুদ্ধ-প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করবার মতো কোনো পন্থা বের করতে পারিনি। যদিও আমাদের এই আন্তরিক প্রস্তাব মেনে নেওয়া হলে ভারতীয় জনগণের বিভিন্ন অংশকে এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়কে একতাবদ্ধ করা যেতো।

ভবদীয় গুণমুগ্ধ
স্বাঃ স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস

আমি এই উত্তরটা সাধারণ্যে প্রচার করার প্রস্তাব রাখছি।

মৌলানা আবুল কালাম আজাদ,
বিড়লা ভবন,
নয়া দিল্লী।

আমি সেই দিনই তাঁর চিঠির উত্তর দিই।

বিড়লা ভবন
আলবুকার্ক রোড
নয়া দিল্লী এপ্রিল ১১, ১৯৪২

প্রিয় স্যার স্ট্যাফোর্ড,

এইমাত্র আপনার ১০ই এপ্রিলের চিঠিটি আমার হস্তগত হয়েছে। বলতে বাধা নেই পত্রটি পড়ে আমার সহকর্মীরা এবং আমি রীতিমতো বিস্মিত হয়েছি। আমি এখনই আপনার পত্রের উত্তর দিচ্ছি এবং আপনার উত্থাপিত কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে আমাদের মতামত ব্যক্ত করছি।

আমাদের মূল প্রস্তাবে যেসব কথা বলা হয়েছে সে সবই আমার কমিটির সুচিন্তিত প্রস্তাব এবং তাতে সামগ্রিকভাবে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রস্তাব সম্পর্কে আমাদের অভিমত প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আপনাকে বলেছিলাম ভারতের এই দুর্দিনে ভবিষ্যৎ শাসনব্যবস্থার বিষয়টি মুলতুবি রেখেও আমরা প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নেবার জন্য ব্যগ্র, তবে সে দায়িত্ব নিতে পারি, যদি তা প্রকৃত দায়িত্ব হয় এবং দায়িত্ব পালনের জন্য আমাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এবং সমর মন্ত্রীর কাজকর্মের বিভাগ সম্পর্কে আপনি কোনো বিস্তারিত তালিকা দেননি। এ ব্যাপারে আপনি শুধু পূর্ববর্তী তালিকার কথাই পুনরুল্লেখ করেছেন। কিন্তু আপনি ভালো করেই জানেন, আমরা ওটিকে প্রত্যাখ্যান করেছি। আপনার পত্রে আপনি এমন কতগুলো বিষয়ের কথা উল্লেখ করেছেন যেগুলো প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও অন্যান্য বিভাগ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হবে। সুতরাং বুঝতে পারা যাচ্ছে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর ক্ষমতা হবে খুবই সীমিত এবং তা আপনার প্রদত্ত পূর্ববর্তী তালিকার মতোই হবে।

প্রধান সেনাপতির স্বাভাবিক ক্ষমতাকে খর্ব করার কথা কখনও কেউ বলেনি। আমরা বরং তাঁকে আরো বেশি ক্ষমতা দিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একটা বিষয় সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি, প্রতিরক্ষা সম্বন্ধে আমাদের ধারণার সঙ্গে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ধারণার আকাশপাতাল প্রভেদ রয়েছে। আমাদের মতে এর প্রকৃতি হলো সত্যিকারের জাতীয় প্রকৃতি এবং ভারতের প্রতিটি নর-নারীকে এর সামিল হতে হবে। এর অর্থ হলো, আমাদের নিজেদের লোকের ওপর আস্থা রেখে এই বিরাট ব্যাপারে তাদের পূর্ণ সহযোগিতা লাভ করা; কিন্তু ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের যে মতিগতি দেখা যাচ্ছে তা হলো ভারতীয়দের ওপর তারা বিশ্বাস রাখতে পারছে না এবং তাদের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা অর্পণ করতেও তারা নারাজ। আপনি প্রতিরক্ষার ব্যাপারে মহামান্য ইংল্যান্ডেশ্বরের সরকারের কর্তব্য এবং দায়িত্বের কথা উল্লেখ করেছেন কিন্তু ভারতীয়দের হাতে যদি ক্ষমতা না দেওয়া হয় এবং তারা একে নিজেদের কর্তব্য এবং দায়িত্ব বলে মনে না করে, তাহলে এই কর্তব্য এবং দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা সম্ভব হবে না। কিন্তু জনগণের সদিচ্ছা ও সক্রিয় সহযোগিতার কথাটা ভারত সরকার আদৌ অনুধাবন করছে না।

আপনি বলেছেন, তিন সপ্তাহ বাদে আমরা সর্বপ্রথমে শাসনতন্ত্র পরিবর্তনের কথা উত্থাপন করেছি। এটি সত্যের অপলাপ। আমাদের মধ্যে আলোচনার সময় এ সম্বন্ধে আমরা কথা তুলেছিলাম। তবে এটা সত্যি, প্রথমদিকে এ ব্যাপারে আমরা বিশেষ জোর দিইনি। এর কারণ হলো, নতুন কোনো বিষয় আমরা তখন উত্থাপন করতে চাইনি। কিন্তু আপনি যখন সুস্পষ্ট ভাষায় আপনার পত্রে আমাদের জানালেন যে যুদ্ধের সময় শাসনতন্ত্রের কোনো রকম পরিবর্তন আমরা চাইনি, তখন সে কথা আমরা অস্বীকার করেছি এবং আপনার এই ধারণাকে বদলাতে চাইছি।

আপনার পত্রের শেষ অংশটি আমাদের বিশেষভাবে বিস্মিত এবং দুঃখিত করেছে। আপনার পত্রের সুর এবং বক্তব্য থেকে সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাচ্ছে, আলোচনা শুরু হবার পর থেকে যতই এগিয়ে গেছে ততই আপনার তথা ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের মতিগতি ভিন্ন পথে চলেছে। আলোচনার প্রাথমিক অবস্থায় আপনি যে কথা বলেছিলেন এখন আপনি তা থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন এবং শেষ পর্যন্ত আপনার আগের কথা পুরোপুরিভাবে অস্বীকার করেছেন। আপনি আমাকে বলেছিলেন, ভারতে একটি জাতীয় সরকার গঠিত হবে এবং সে সরকার ভাইসরয়কে নিয়মতান্ত্রিক প্রধান হিসেবে রেখে ক্যাবিনেট সরকারের মতো কাজ করবে। আপনি আরো বলেছিলেন, ভাইসরয়ের অবস্থা হবে অনেকটা ইংল্যান্ডের রাজার মতো। ইন্ডিয়া অফিসের কাজ সম্পর্কে আপনি আমাকে বলেছিলেন, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্বন্ধে এ যাবৎ কেউ কোনো প্রশ্ন না তোলায় আপনি বিস্মিত হয়েছেন। আপনার মতে ওটা হওয়া উচিত ডোমিনিয়ন অফিসের কাজ।

এই চিত্রটিই আপনি আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং এখন আপনি তা থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে এসেছেন। অর্থাৎ প্রথমে আপনি যেসব কথা বলেছিলেন এখন তা অস্বীকার করছেন।

আপনার পত্রে এবার এমন একটি নতুন বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যে বিষয়টি আমাদের আলোচনার সময় এর আগে কোনোদিনই আপনি বলেননি। এবার আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্বের কথা তুলেছেন। এটি সত্যিই বিস্ময়কর যে এ সম্পর্কে ঠিক এই সময়েই প্রশ্নটি তোলা হয়েছে। জরুরী সময়ে যখন একটি মিশ্র মন্ত্রিসভা গঠিত হয় তখন এ অসুবিধা থাকেই, কিন্তু নানা উপায়ে এর প্রতিবিধানও করা যায়। আপনি যদি আগে এ প্রশ্ন তুলতেন তাহলে এর একটা সন্তোষজনক সমাধান আমরা বের করতাম। কিন্তু এ বিষয়ে আগে যা কিছু আলোচনা হয়েছে তা হলো: একটি মিশ্র মন্ত্রিসভা গঠিত হবে, যে মন্ত্রিসভা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করবে। আমরাও তা মেনে নিয়েছিলাম। আমরা এমন কথা কখনও বলিনি কংগ্রেসই সর্বক্ষমতা গ্রাস করবে। আমাদের বক্তব্য ছিলো স্বাধীনতা দিতে হবে ভারতবাসীকে এবং রাষ্ট্র পরিচালন ক্ষমতাও ভারতবাসীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। কীভাবে মন্ত্রিসভা গঠিত হবে এবং কীভাবে তারা কাজ করবে সে সম্বন্ধে কথা হয়েছিলো তা স্থির হবে মূল প্রশ্নটির উত্তর পাবার পরে, অর্থাৎ ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট ভারতীয়দের হাতে কতটা ক্ষমতা ছেড়ে দিতে প্রস্তুত আছেন তা জানবার পরে। এই কারণেই আমরা আপনার সঙ্গে এ বিষয় নিয়ে আগে আলোচনা করিনি অথবা এ প্রশ্ন উত্থাপনও করিনি। আমাদের মতে আপনার পত্রে এই বিষয়ের অবতারণা করে আপনি মূল বিষয়টির পাশ কাটাতে চেয়েছেন।

আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, আমার সঙ্গে আপনার প্রথম সাক্ষাৎকারের সময় আপনি বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িক বা অনুরূপ আর কোনো প্রশ্ন বর্তমান স্তরে আসতে পারে না। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যখন ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা ও দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলে স্থির করবেন, সেই সময় অন্যান্য প্রশ্নের সুষ্ঠু সমাধানের ব্যবস্থা করা যাবে। আপনি আমাকে বুঝতে দিয়েছিলেন ওতে আপনার সম্মতি আছে।

আমরা এ বিষয়ে দৃঢ় নিশ্চিত, ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট যদি বিভেদের নীতি গ্রহণ না করে তাহলে সমস্ত দল-মত-নির্বিশেষে আমরা একসঙ্গে বসে এর একটা সাধারণ সমাধান বের করবো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানের এই বিপজ্জনক সময়েও ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তার ভেদনীতি পরিত্যাগ করতে চাইছে না। আমরা তাই মনে করতে বাধ্য হচ্ছি, তারা ভারতের ওপর তাদের শাসনব্যবস্থাকে যত বেশিদিন সম্ভব বজায় রাখতে চাইছে এবং এই উদ্দেশ্যের বশবর্তী হয়েই শত্রুর আক্রমণের সম্ভাব্য বিপদের সময়েও বিভেদের সৃষ্টি করে চলেছে। আমাদের তথা প্রতিটি ভারতীয়ের কাছে ভারতের প্রতিরক্ষাই হলো প্রধান বিবেচ্য বিষয় এবং সেই পরীক্ষাকেই আমরা প্রধান পরীক্ষা হিসেবে গণ্য করি।

আপনি লিখেছেন, আমার কাছে লেখা আপনার পত্রটি আপনি সাধারণ্যে প্রচার করতে চান। আমার বক্তব্য হলো, এ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যেসব চিঠিপত্রের আদান-প্রদান হয়েছে, অর্থাৎ আপনার কাছে প্রেরিত আমাদের মূল প্রস্তাব, তার উত্তরে আপনার পত্র এবং আপনার কাছে লেখা আমাদের পত্র যদি আমরা প্রকাশ করি তাতে আপনার আপত্তি হবে না।

স্বাঃ আবুল কালাম আজাদ
দি রাইট অনারেবল স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস,
৩, কুইন ভিক্টোরিয়া রোড,
নয়া দিল্লী।

ভারত ছাড়ো

ওয়ার্কিং কমিটির ১৯৪২ সনের ১৪ই জুলাইয়ের প্রস্তাব এবং তার পরবর্তী ঘটনাবলী, যুদ্ধের পরিস্থিতি, ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের একজন দায়িত্বশীল মুখপাত্রের বক্তব্য এবং ভারতে ও বহির্বিশ্বে যেসব আলোচনা ও সমালোচনা হয়েছে সেসব বিষয় সম্পর্কে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি বিশেষভাবে বিচার-বিবেচনা করে ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবটি অনুমোদন ও সমর্থন করছে। এই প্রস্তাব এবং পরবর্তী ঘটনাবলীর ফলে কমিটি এই অভিমত প্রকাশ করছে, ভারতের ওপর ইংরেজের আধিপত্যের আশু অবসান প্রয়োজন। এখনও যদি ভারতে ইংরেজ শাসন চলতে থাকে তাহলে বিশ্বের স্বাধীনতার জন্য ভারত তার কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করতে সক্ষম হবে না এবং নিজের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে পারবে না।

কমিটি হতাশার সঙ্গে লক্ষ্য করেছে, রাশিয়া এবং চীনের অবস্থাও জটিল হয়ে উঠেছে। ওই দুটি দেশের জনসাধারণ যেভাবে বীরত্বের সঙ্গে স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছেন তার দরুণ কমিটি তাঁদের অকুণ্ঠ সাধুবাদ জানাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান বিপদজাল প্রতিটি স্বাধীনতাকামী ব্যক্তিকে এবং স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যারা যুদ্ধ করছেন তাঁদের প্রত্যেককে ভেবে দেখতে বলছে মিত্র জাতিসমূহের মূল নীতি সঠিক পথে চলেছে কিনা, কারণ প্রতি পদক্ষেপেই তাদের বিপর্যয় ঘটছে।

বর্তমানে যে নীতি অনুসৃত হচ্ছে তাতে বিপর্যয়কে কোনো মতেই ঠেকিয়ে রাখা যাবে না এবং তাতে সাফল্য অর্জন করাও যাবে না। কারণ অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে জানা গেছে এই নীতির মধ্যেই নিহিত আছে বিফলতার বীজ। এইসব নীতি স্বাধীনতার ভিত্তিতে রচিত হয়নি। এগুলো রচিত হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী মনোবৃত্তি এবং অধিকার কায়েম রাখবার মনোবৃত্তিকে ভিত্তি করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই নীতি সাম্রাজ্যবাদী শাসকগোষ্ঠীকে জোরদার করার পরিবর্তে তাদের দুর্বল করে ফেলেছে এবং শেষ পর্যন্ত এটা একটা অভিশাপরূপে দেখা দিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃষ্ট নিদর্শন হলো ভারতবর্ষ এবং এই কারণে সেখানে এই প্রশ্নটি তীব্রভাবে প্রকটিত হয়েছে, কারণ ভারতবর্ষের স্বাধীনতার প্রশ্নেই ব্রিটেন এবং মিত্র জাতিসমূহের উদ্দেশ্য সম্যকভাবে বুঝতে পারা যাবে এবং এশিয়া ও আফ্রিকার জনসাধারণের মনে আশা ও উৎসাহ সঞ্জীবিত হবে। সুতরাং এদেশে ইংরেজ শাসনের আশু অবসান প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, কারণ এর ওপরই যুদ্ধের ভবিষ্যৎ এবং স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করছে। স্বাধীন ভারত তার বিপুল সম্পদকে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নিয়োজিত করে সাফল্যকে ত্বরান্বিত করতে পারে এবং নাৎসিবাদ, ফ্যাসিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের মোকাবিলা করতে পারে। এতে শুধু যুদ্ধের ভবিষ্যৎই নির্ধারিত হবে না; উপরন্তু সমগ্র শোষিত জনগণকে মিত্র জাতিসমূহের পক্ষভুক্ত করবে এবং এইসব জাতির অন্যতম হওয়ায় ভারত তাদের মানসিক ও আর্থিক নেতৃত্ব দিতে পারবে। কিন্তু ভারত যদি পরাধীন থাকে তাহলে সেখানকার দখলদার ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদ একতাবদ্ধ সমস্ত জাতির ভাগ্যের ওপর আঘাত হানবে।

অতএব বর্তমানের বিপদের অবসানের জন্যও ভারতের বুক থেকে ইংরেজ শাসনের অবসান হওয়া প্রয়োজন। ভবিষ্যতের জন্য কোনো রকম বাচনিক সংকল্প ব্যক্ত করে এ বিপদকে পরিহার করা যাবে না, কারণ তাতে ভারতের জনসাধারণ মোটেই উৎসাহিত হবে না। একমাত্র স্বাধীনতার আলোক-শিখাই কোটি কোটি ভারতবাসীর মনে আশা ও উৎসাহের প্রদীপ জ্বেলে দিতে পারে এবং অনতিবিলম্বে যুদ্ধের চেহারাকে বদলে দিতে পারে।

এ.আই.সি.সি. তাই পুনরায় এই দাবি জানাচ্ছে, ইংরেজ শক্তিকে ভারত থেকে বিদায় গ্রহণ করতে হবে। ভারতের স্বাধীনতা ঘোষিত হলে একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হবে এবং স্বাধীন ভারত ঐক্যবদ্ধ জাতিসমূহের সরিক হয়ে তাদের সঙ্গে একযোগে সমস্ত ব্যাপারে অংশগ্রহণ করবে। এখানে যে অস্থায়ী সরকারের কথা বলা হলো সে সরকার এ দেশের প্রধান প্রধান দলগুলোর সহযোগিতার ভিত্তিতে গঠিত হবে। অতএব এটা হবে এমন একটি সরকার যার পেছনে ভারতের প্রতিটি দল ও সম্প্রদায়ের সমর্থন থাকবে। এই সরকারের প্রাথমিক কাজ হবে ভারতের প্রতিরক্ষার জন্য সুষ্ঠু ব্যবস্থা করা এবং সশস্ত্র ও অহিংস শক্তির সাহায্যে যে-কোনো আক্রমণের প্রতিরোধ করা এবং সঙ্গে সঙ্গে মিত্রশক্তিগুলোর সরিক হয়ে কৃষিক্ষেত্রে, কলকারখানায় ও অন্যান্য ক্ষেত্রে অগ্রগতির সৃষ্টি করা, কারণ তাদের হাতেই রয়েছে সমস্ত ক্ষমতার মূলাধার। অস্থায়ী সরকারের অন্যতম কাজ হবে ভারতের জন্য সর্বজনগ্রাহ্য একটি সংবিধান বা শাসনতন্ত্র রচনাকারী সংস্থা গঠন করা। এই সংস্থা ভারতের জন্য একটি সর্বজনগ্রাহ্য শাসনতন্ত্র রচনা করবে। কংগ্রেসের মতে এই শাসনতন্ত্র হবে ফেডারেল ধরনের। এই ফেডারেল সরকারের অধীনে যেসব অঞ্চল বা প্রদেশ থাকবে তাদের হাতে যতটা সম্ভব ক্ষমতা এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অধিকার দেওয়া হবে। মিত্র জাতিসমূহের সঙ্গে ভারতের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কীরকম হবে তা স্থির করা হবে ভারতের এবং মিত্র জাতিগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। আলোচনার মাধ্যমেই স্থির হবে কীভাবে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আক্রমণকারীর মোকাবিলা করবে; এবং একমাত্র স্বাধীনতাই ভারতকে তার কর্তব্য পালনে সাহায্য করবে; ভারতীয়দের পেছনে তখন থাকবে তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তি।

ভারতের স্বাধীনতা অবশ্যই এশিয়ার অন্যান্য পরাধীন জাতিসমূহের স্বাধীনতার পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য হবে। ব্রহ্মদেশ, মালয়, ইন্দোচীন, ডাচ ইন্ডিজ, ইরান এবং ইরাকও অবশ্যই স্বাধীনতা অর্জন করবে। এই প্রসঙ্গে আরো একটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, এইসব দেশের মধ্যে যেগুলো এখন জাপানিদের অধীনে রয়েছে ভবিষ্যতে (অর্থাৎ যুদ্ধে জয়লাভের পরে) সেগুলোকে কোনোক্রমেই ঔপনিবেশিক শক্তির অধীনে ছেড়ে দেওয়া চলবে না।

এ.আই.সি.সি. যদিও ভারতের স্বাধীনতা এবং ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যাপারেই বিশেষভাবে সংশ্লিষ্ট তবুও তারা মনে করে, ভবিষ্যৎ শান্তি ও নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করবার জন্য স্বাধীন জাতিসমূহের দ্বারা একটি বিশ্ব-সংস্থা গঠন করা দরকার—অন্য কোনো উপায়ে বিশ্বের সমস্যাবলীর সমাধান করা যাবে না। এইরকম একটি বিশ্বসংস্থা তার সদস্য জাতিসমূহের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করবে। আগ্রাসনকে রুখবে, এক জাতি কর্তৃক অপর জাতিকে শোষণ করা বন্ধ করবে, সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা করবে, পশ্চাৎপদ জাতিসমূহের অগ্রগতিতে সাহায্য করবে এবং বিশ্বের সম্পদরাশি বিশ্ববাসীর সাধারণ উন্নয়নকল্পে ব্যয় করার জন্য সংগ্রহ করবে। এই রকম একটি বিশ্বসংস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে সমস্ত দেশে অস্ত্রসজ্জা বন্ধ করা সম্ভব হবে। বিভিন্ন দেশের জাতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমানবাহিনীরও তখন আর প্রয়োজন হবে না—তখন সমগ্র বিশ্বের জন্য এক সম্মিলিত প্রতিরক্ষাবাহিনী গঠিত হবে এবং সেই সম্মিলিত বাহিনী বিশ্বের শান্তিরক্ষা করবে এবং সবরকম আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করবে।

ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে সে আনন্দের সঙ্গে এই ধরনের বিশ্বসংস্থায় যোগদান করবে এবং অন্যান্য জাতিসমূহের সঙ্গে সমঅধিকারের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সমস্যাবলীর সমাধানের জন্য সর্ব-উপায়ে সহযোগিতা করবে। এই ধরনের বিশ্বসংস্থায় যে-কোনো জাতিই যোগদান করতে পারবে। তবে যোগদানের প্রধান শর্ত হবে উক্ত সংস্থার মূলনীতিসমূহ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দান। যুদ্ধ চলাকালে প্রথমদিকে শুধুমাত্র মিত্রপক্ষের জাতিসমূহ নিয়েই এই সংস্থা গঠিত হবে। এই পদ্ধতি গৃহীত হলে (অর্থাৎ এইরকম একটি বিশ্বসংস্থা গঠিত হলে) অক্ষশক্তিগুলোকে প্রচণ্ডভাবে বাধা দেওয়া যাবে এবং ভবিষ্যতের শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যাবে।

কমিটি দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, যুদ্ধে প্রচণ্ড রকম ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে দেখেও এবং সমগ্র বিশ্ব এক মহা বিপদের সম্মুখীন হয়েছে জেনেও কোনো কোনো দেশের সরকার এখনও এইরকম একটি বিশ্বসংস্থা গঠনের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের প্রতিক্রিয়া এবং বিদেশের পত্রিকাগুলোর বিরূপ সমালোচনার ফলে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নটি উপেক্ষিত হচ্ছে এবং এর দ্বারা ভারতকে তার নিজস্ব প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং রাশিয়া ও চীনকে তাদের প্রয়োজনের সময় সাহায্য করতে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। কমিটি কখনও এমন কিছু চায় না যাতে চীন অথবা রাশিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় কোনো রকম বাধার সৃষ্টি হয়। কারণ আক্রমণকারীদের উপযুক্তভাবে মোকাবিলা করতে হলে এই দুটি দেশের স্বাধীনতার মূল অশেষ, সুতরাং যেমন করেই হোক এদের স্বাধীনতা রক্ষা করতেই হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভারত এবং এই দুটি দেশের ওপর বিপদের মেঘ ঘনীভূত হয়েছে—এই অবস্থায় ভারতকে বিদেশী শক্তির অধীনস্থ করে রাখার অর্থ হলো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধ-ক্ষমতাকে খর্ব করে রাখা। এর দ্বারা মিত্র জাতিসমূহের স্বার্থকেই উপেক্ষা করা হচ্ছে। ইংরেজ সরকারের কাছে এবং মিত্র জাতিসমূহের কাছে ওয়ার্কিং কমিটির আন্তরিক আবেদনে আজও পর্যন্ত কোনো ফল তো হয়ইনি, উপরন্তু বিদেশে এমন সব বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে যাতে ভারতের স্বাধীনতা যে বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজন সে বিষয়ে অজ্ঞতাই প্রকাশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো মহলে ভারতের স্বাধীনতার প্রশ্নে শত্রুতামূলক মনোভাবও দেখা গেছে—এর দ্বারা ভারতের বুকে বিদেশী শাসনকে কায়েম রাখার এবং বর্ণগত শ্রেষ্ঠত্বের মনোভাবই প্রকটিত হয়েছে। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং নিজের শক্তি ও সম্পদ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন কোনো জাতিই এইরকম হীনতা সহ্য করতে পারে না।

এ.আই.সি.সি. এই শেষ মুহূর্তে আরো একবার বিশ্বের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটেন এবং মিত্র জাতিসমূহের কাছে আবেদন জানাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে কমিটি আরো মনে করে, ভারতকে সাম্রাজ্যবাদী বিদেশী শক্তির অধীনে রেখে সমগ্র মানবজাতির স্বার্থকে উপেক্ষা করা কোনোক্রমেই উচিত হবে না। ভারতের স্বাধীনতার জন্য কমিটি তাই অহিংস পদ্ধতিতে এক প্রবল গণ-আন্দোলন সংগঠনের জন্য প্রস্তাব গ্রহণ করছে। বিগত বাইশ বছরে দেশ যে অহিংস শক্তি সঞ্চয় করেছে, আসন্ন সংগ্রামে সেই শক্তিকে পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করা হবে। এই সংগ্রাম অবশ্যই গান্ধীজীর নেতৃত্বে পরিচালিত হবে, সুতরাং কমিটি তাকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে কমিটি দেশবাসীর কাছে আবেদন জানিয়ে বলছে, তাঁরা যেন সাহস, উৎসাহ আর উদ্দীপনার সঙ্গে সমস্ত রকম বিপদের মোকাবিলা করে শৃঙ্খলবদ্ধ সেনাবাহিনীর মতো স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করেন এবং তাদের যেসব নির্দেশ দেওয়া হবে সেগুলো সৈনিকের মতোই মেনে চলেন। তবে তাঁদের সব সময় মনে রাখতে হবে, অহিংসাই হবে এই সংগ্রামের মূলমন্ত্র। এমন সময় আসতে পারে যখন জনগণের কাছে নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া হয়তো সম্ভব হবে না এবং কোনো কংগ্রেস কমিটিও কাজ করতে পারবে না। এইরকম অবস্থায় ভারতের প্রতিটি পুরুষ এবং প্রতিটি নারী সংগ্রাম সম্বন্ধে সাধারণ নির্দেশ মেনে তাঁদের নিজ নিজ বিবেচনা অনুসারে কাজ করবেন। এবং এইভাবেই স্বাধীনতার লক্ষ্যপথে অগ্রসর হবেন।

এ.আই.সি.সি. ভবিষ্যৎ স্বাধীন ভারতের সরকার সম্বন্ধে তার অভিমত ব্যক্ত করলেও এখানে সুস্পষ্টভাবে বলে রাখা হচ্ছে, গণসংগ্রামের মাধ্যমে যে স্বাধীনতা অর্জিত হবে এবং সরকার গঠিত হবে, সে সরকার শুধু কংগ্রেসী সরকার হবে না, তা হবে জনগণের সরকার এবং যাবতীয় ক্ষমতা জনগণের হাতেই ন্যস্ত থাকবে।

ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ৩রা জুনের বিজ্ঞপ্তি

১। ২০শে ফেব্রুয়ারি মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট ঘোষণা করেছিল, ১৯৪৮ সনের জুন মাসের মধ্যে ভারতের শাসনভার ভারতীয়দের হাতে হস্তান্তরিত হবে। গভর্নমেন্ট তখন আশা করেছিল, ভারতের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবে এবং ১৯৪৬-এর ১৬ই জুনের মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাকে কার্যকর করে ভারতের জন্য সর্বজনগ্রাহ্য একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে। কিন্তু সে আশা ফলপ্রসূ হয়নি।

২। মাদ্রাজ, বোম্বাই, যুক্তপ্রদেশ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও বেরার, আসাম, উড়িষ্যা এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বেশিরভাগ প্রতিনিধি এবং দিল্লী, আজমীর, মারোয়াড়া ও ক্রুগের প্রতিনিধিরা ইতিমধ্যেই নতুন শাসনতন্ত্র রচনার কাজে হাত দিয়েছেন। কিন্তু মুসলিম লীগ দল এবং তার সহযোগী বাংলা, পাঞ্জাব ও সিন্ধুর বেশিরভাগ প্রতিনিধি এবং ব্রিটিশ বেলুচিস্তানের প্রতিনিধিরা উপরোক্ত ব্যাপারে অংশগ্রহণ করবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

৩। মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্টের সব সময়ই বাসনা, ভারতীয় জনগণের ইচ্ছানুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে। ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যদি ঐকমত্য থাকত তাহলে এই উদ্দেশ্যকে সফল করা যেত; কিন্তু তা না থাকায় ভারতীয় জনগণের ইচ্ছানুযায়ী একটি বিকল্প সরকার গঠনের দায়িত্ব ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ওপরে বর্তেছে। গভর্নমেন্ট তাই ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে নিম্নবর্ণিত ব্যবস্থা অবলম্বন করবে বলে স্থির করেছে। এই সম্পর্কে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট সুস্পষ্টভাবে বলে রাখছে, ভারতের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা করবার উদ্দেশ্য তার নেই; এ কাজটি ভারতীয়রাই করবেন। তাছাড়া বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনার কোনো রকম বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবার ইচ্ছাও গভর্নমেন্টের নেই।

৪। শাসনতন্ত্র রচনার জন্য বর্তমানে যে সংস্থাটি কাজ করছে তার কাজে বাধা দেবার ইচ্ছাও গভর্নমেন্টের নেই। বর্তমানে নিম্নবর্ণিত প্রদেশগুলো সম্পর্কে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তাতে গভর্নমেন্ট বিশ্বাস করে, এই ঘোষণাবাণীর পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব প্রদেশের মুসলিম লীগ প্রতিনিধিরা (যাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ব্যক্তি আগে থেকেই এই মতবাদ পোষণ করতেন) এগিয়ে আসবেন এবং এই পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন। এই প্রসঙ্গে আরো বলা হচ্ছে, শাসনতন্ত্র রচনাকারী সংস্থা যেরকম শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করুক না কেন তা কোনোক্রমেই অনিচ্ছুক প্রদেশগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে না। মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট আরো বিশ্বাস করে, নিচে যে পদ্ধতির কথা বলা হচ্ছে তা ওইসব অঞ্চলের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে সার্থকভাবে রূপদান করেছে এবং তারা যাতে নিজেদের শাসনতন্ত্র নিজেরাই রচনা করতে পারেন তার ব্যবস্থা করেছে। যেসব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে তা হলো:

(ক) বর্তমান গণপরিষদ বা শাসনতন্ত্র রচনাকারী সংস্থা সমস্ত প্রদেশের জন্য শাসনতন্ত্র রচনা করবে, অথবা

(খ) যেসব প্রদেশ বর্তমান গণপরিষদে অংশগ্রহণ করতে অনিচ্ছুক তাদের প্রতিনিধিরা একটি পৃথক সংস্থা গঠন করবে।

এর ফলে কোন সংস্থা অথবা কোন কোন সংস্থার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হবে তা নির্ধারণ করা সহজ হবে।

৫। বাংলা ও পাঞ্জাবের আইনসভার সদস্যগণ (ইংরেজ সদস্য ব্যতীত) উভয় অঞ্চলে বৈঠকে মিলিত হবেন। উভয় বিধানসভার মুসলমান ও অমুসলমান সদস্যরা পৃথক পৃথকভাবে নিজেদের মধ্যে বৈঠক করবেন। প্রতিনিধিদের সংখ্যা নির্ধারিত হবে জনসংখ্যার অনুপাত অনুসারে। জনসংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে ১৯৪১-এর আদমশুমারির রিপোর্টকে গ্রহণ করতে হবে। উপরোক্ত প্রদেশ দুটির মুসলমানপ্রধান জেলাগুলোর নাম এই বিবৃতির শেষে পরিশিষ্ট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।

৬। উভয় প্রদেশের আইনসভার সদস্যরা পৃথক পৃথকভাবে বসে প্রদেশ দুটিকে বিভক্ত করা হবে বা হবে না তা ভোটের মাধ্যমে স্থির করবেন। কোনো তরফে যদি প্রদেশ বিভাগের পক্ষে সামান্যতম সংখ্যাগরিষ্ঠতাও দেখা যায় তাহলে প্রদেশ দুটি অবশ্যই বিভক্ত হবে এবং সেই অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

৭। প্রদেশ বিভাগের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে উভয় প্রদেশের প্রতিনিধিদের জেনে নিতে হবে, প্রদেশ দুটি কোন গণপরিষদের অধীনে থাকতে চায়—প্রদেশগুলো একতাবদ্ধ থাকতে চাইলেই শুধু এই ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে। প্রদেশ দুটি যদি একতাবদ্ধ থাকতে চায়, অর্থাৎ বিভক্ত হতে না চায়, তাহলে আইনসভার সকল সদস্য (ইংরেজ সদস্য ব্যতীত) একসঙ্গে বসে স্থির করবেন কোন গণপরিষদের অধীনে প্রদেশ দুটি থাকতে চায়।

৮। আঞ্চলিক বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে উভয় আইনসভার প্রতিটি অংশ তাদের নিজ নিজ অঞ্চলের জন্য উপরোক্ত ৪নং ধারায় যে বিকল্প ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে সেইভাবে কাজ করতে হবে।

৯। অঞ্চল বিভাগের আশু প্রয়োজনে বাংলা ও পাঞ্জাবের মুসলমানপ্রধান জেলাগুলোর প্রতিনিধিরা এবং অমুসলমানপ্রধান জেলাগুলোর প্রতিনিধিরা পৃথক পৃথকভাবে বসে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। এটা হবে প্রাথমিক ও সাময়িক ব্যবস্থা। কারণ প্রদেশ দুটিকে সুষ্ঠুভাবে বিভক্ত করতে হলে সীমানা নির্ধারণ প্রভৃতি নানা ব্যাপারে বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রদেশ বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরে গভর্নর-জেনারেল উভয় প্রদেশের জন্য দুটি পৃথক সীমানা কমিশন নিযুক্ত করবেন। এই কমিশনের সদস্য হিসেবে কে কে থাকবেন তা তিনি স্থির করবেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে পরামর্শ করে। পাঞ্জাবের জন্য যে কমিশন নিযুক্ত করা হবে সেই কমিশনকে মুসলমান অধ্যুষিত এবং অমুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চল অনুসারে সীমানা নির্ধারণ করতে নির্দেশ দেওয়া হবে; সঙ্গে সঙ্গে অঞ্চলগুলোর ভৌগোলিক অবস্থান এবং আরো নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কেও বিবেচনা করতে বলা হবে। বাংলার সীমানা নির্ধারণের ব্যাপারেও একই রকম নির্দেশ দেওয়া হবে। যতদিন সীমানা কমিশনের রিপোর্ট হস্তগত এবং গৃহীত না হবে ততদিন পরিশিষ্ট অংশে যে সাময়িক সীমানার কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেই অনুসারে কাজ হবে।

১০। সিন্ধু প্রদেশের আইনসভার সদস্যরা (ইংরেজ সদস্য ব্যতীত) একটি বিশেষ বৈঠকে মিলিত হয়ে উপরোক্ত ৪নং ধারা অনুসারে তাদের অভিমত ব্যক্ত করবেন।

১১। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অবস্থাটা বিশেষ ধরনের। ওখানকার তিনজন প্রতিনিধির মধ্যে দুজনই বর্তমান গণপরিষদে অংশগ্রহণ করছেন। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থান এবং অন্যান্য বিষয়ের বিবেচনায় এই প্রদেশ সম্বন্ধে বলা হচ্ছে যে পুরোপুরি পাঞ্জাব প্রদেশ বা তার কোনো অংশ যদি বর্তমান গণপরিষদে অংশগ্রহণ না করে তাহলে এই প্রদেশকে তার পূর্ব অভিমত পুনর্বিবেচনা করবার সুযোগ দেওয়া হবে। এবং এই অনুসারে বর্তমান আইনসভার প্রতিনিধি নির্বাচনে যারা ভোট দিয়েছিলেন পুনরায় তাঁদের ভোট নিয়ে ৪নং ধারার বিকল্প ব্যবস্থা সম্বন্ধে তাঁদের অভিমত (অর্থাৎ ইচ্ছা অথবা অনিচ্ছার কথা) গ্রহণ করা হবে। প্রাদেশিক গভর্নরের সঙ্গে পরামর্শ করে গভর্নর-জেনারেল এই গণভোটের ব্যবস্থা করবেন।

১২। ব্রিটিশ বেলুচিস্তান একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করলেও তিনি বর্তমান গণপরিষদে যোগদান করেননি। ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে এই প্রদেশকেও ৪নং ধারার বিকল্প ব্যবস্থা সম্বন্ধে অভিমত জ্ঞাপন করবার সুযোগ দেওয়া হবে। এ ব্যাপারে কী করা হবে তা মহামান্য গভর্নর-জেনারেল বিবেচনা করে স্থির করবেন।

১৩। আসাম প্রদেশটি যদিও অমুসলমানপ্রধান, তবুও বাংলার পার্শ্ববর্তী সিলেট জেলাটিতে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই জেলা সম্পর্কে দাবি তোলা হয়েছে বাংলা বিভক্ত হলে এই জেলাটিকে বাংলার মুসলমানপ্রধান অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। বাংলা বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে গভর্নর-জেনারেল সিলেটে একটি গণভোটের ব্যবস্থা করবেন এবং আসাম সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন, অর্থাৎ সিলেট জেলাটি আসামের অংশ হিসেবে আসামের সঙ্গেই যুক্ত থাকবে, না, নবগঠিত পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হবে তা তিনি উপরোক্ত উপায়ে স্থির করবেন। এখানেও বাংলা ও পাঞ্জাবের মতো একটি সীমানা কমিশন নিযুক্ত করা হবে। এই কমিশন সিলেট জেলার মুসলমানপ্রধান অঞ্চলের সীমানা এবং তৎসংলগ্ন অমুসলমানপ্রধান অঞ্চলের সীমানা নির্ধারণ করবেন। এরপর সিলেট জেলার মুসলমানপ্রধান অঞ্চল পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং বাকি অংশ আসাম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত থেকে বর্তমান গণপরিষদের আওতায় থাকবে।

১৪। বাংলা এবং পাঞ্জাব বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে উভয় অংশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নতুন করে নির্বাচনের প্রয়োজন হবে। এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে মন্ত্রিমিশনের ১৯৪৬-এর ১৬ই মের পরিকল্পনা অনুসারে, অর্থাৎ প্রতি দশ হাজার লোকের জন্য একজন করে প্রতিনিধি নেওয়ার জন্য।

সিলেট জেলাকে যদি পূর্ববঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে ওখানেও নতুন করে নির্বাচন হবে। নির্বাচনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রদেশগুলো এবং অঞ্চলগুলোতে প্রতিনিধিদের আনুপাতিক সংখ্যা নিচের তালিকা অনুসারে হবে।–-

প্রদেশ (বা অঞ্চল)ধারণমুসলিমশিখমো
সিলেট জেলানাই
পশ্চিমবঙ্গ১৫নাই১৯
পূর্ববঙ্গ১২২৯নাই৪১
পশ্চিম পাঞ্জাব১২১৭
পূর্ব পাঞ্জাব১২

১৫। নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরে নব-নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বর্তমান গণপরিষদে অথবা নবগঠিত গণপরিষদে যোগ দিতে বলা হবে।

১৬। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিম্নলিখিত পদ্ধতিতে বিভক্ত অঞ্চলসমূহের শাসনব্যবস্থার জন্য আলোচনা শুরু করতে হবে:

(ক) সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিবৃন্দ এবং দেশীয় রাজ্যের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিরক্ষা, অর্থ এবং যোগাযোগসহ বিভিন্ন বিষয় যা বর্তমানে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন রয়েছে সে সম্বন্ধে নতুন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

(খ) বিভিন্ন দেশীয় রাজ্যের সঙ্গে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের যেসব চুক্তি বিদ্যমান আছে, ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ওইসব চুক্তির শর্ত কী হবে তা বিভিন্ন রাজ্যের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে স্থির করা হবে।

(গ) বিভক্ত প্রদেশগুলোর শাসনব্যবস্থা, অর্থাৎ ধনসম্পত্তি এবং দায়, পুলিশ এবং অন্যান্য সরকারি বিভাগ, হাইকোর্ট এবং প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো সম্বন্ধে নতুন করে ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে।

১৭। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপজাতীয় সর্দারদের সঙ্গে যেসব চুক্তি রয়েছে সেসব সম্বন্ধে সর্দারদের বর্তমান উত্তরাধিকারীদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে।

১৮। মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্ট এই প্রসঙ্গে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, তাদের এই সিদ্ধান্ত শুধু ইংরেজ শাসিত ভারতবর্ষ সম্পর্কেই প্রযোজ্য হবে; দেশীয় রাজ্যসমূহ সম্পর্কে মন্ত্রিমিশনের ১৯৪৬-এর ১২ই মের স্মারকপত্রে যে নীতির কথা উল্লেখ করা হয়েছিল সেই নীতি অপরিবর্তিত থাকবে।

১৯। শাসনক্ষমতার উত্তরাধিকারী কর্তৃপক্ষ যাতে ক্ষমতা গ্রহণের জন্য যথেষ্ট সময় পান সেই উদ্দেশ্যে উপরোক্ত ব্যবস্থাসমূহ যত শীঘ্র সম্ভব গ্রহণ করে সেগুলোকে কার্যকর করতে হবে। বিলম্ব পরিহার করার জন্য বিভিন্ন প্রদেশ অথবা প্রদেশের অংশসমূহ এই পরিকল্পনা অনুসারে স্বাধীনভাবে এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এগিয়ে যাবে। বর্তমান গণপরিষদ এবং নতুন গণপরিষদ (যদি তা গঠিত হয়) তাদের নিজ নিজ এলাকার জন্য শাসনতন্ত্র রচনার কাজে এগিয়ে যাবে। এখানে আরো একটি কথা উল্লেখযোগ্য, এরা স্বাধীনভাবেই নিজ নিজ এলাকার শাসনতন্ত্র রচনা করবে।

২০। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বার বার জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করেছে, ভারতের শাসনভার যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি হস্তান্তর করতে হবে। মহামান্য ইংল্যাণ্ডেশ্বরের গভর্নমেন্টের এ ব্যাপারে পূর্ণ সহানুভূতি আছে। ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তাই ঘোষণা করছে, ১৯৪৮ সনের জুনের মধ্যেই ভারতের শাসনভার ভারতীয়দের হাতে ন্যস্ত করা হবে। অর্থাৎ উক্ত তারিখের মধ্যেই ভারতে একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে সেই সরকারের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা হবে। এবং ঘোষণাকে কার্যকর করবার জন্য কমন্স সভার বর্তমান অধিবেশনেই ভারতের শাসনভার এক বা একাধিক ভারতীয় ডোমিনিয়নের হাতে ছেড়ে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় আইন বিধিবদ্ধ করতে চায়। তবে এই আইন দ্বারা ভারতের গণপরিষদের ক্ষমতা কোনোক্রমেই খর্ব করা হবে না অথবা ব্রিটিশ কমনওয়েলথে থাকা বা না থাকা সম্বন্ধে তাদের ওপরে কোনো রকম বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হবে না।

সর্বশেষে উল্লেখ্য যে এই সম্পর্কে ভবিষ্যতে আর কোনো রকম ঘোষণার প্রয়োজন হলে ভারতের গভর্নর-জেনারেল প্রয়োজনীয় ঘোষণা জারি করবেন।

১৯৪১ খ্রীষ্টাব্দের আদমশুমারি অনুসারে পাঞ্জাব এবং বাংলার মুসলমানপ্রধান জেলাসমূহ:

১। পাঞ্জাব

লাহোর বিভাগ—গুজরানওয়ালা, গুরুদাসপুর, লাহোর, শেখপুরা, শিয়ালকোট।

রাওয়ালপিণ্ডি বিভাগ—আটক, গুজরাট, ঝিলম, মিঞাওয়ালি, রাওয়ালপিণ্ডি, শাহ্‌পুর।

মূলতান বিভাগ—ডেরা গাজী খান, জঙ, লায়ালপুর, মন্টগোমারি, মুলতান, মুজাফ্ফরগড়।

২। বাংলা

চট্টগ্রাম বিভাগ—চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, ত্রিপুরা।

ঢাকা বিভাগ—বাখরগঞ্জ, ঢাকা, ফরিদপুর, মৈমনসিংহ।

প্রেসিডেন্সী বিভাগ—যশোহর, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া।

রাজশাহী বিভাগ—বগুড়া, দিনাজপুর, মালদহ, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর।

***

অধ্যায় ২০ / ২০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন