১৪। ভারতবিভাগের প্রাক-পর্ব

১৪. ভারতবিভাগের প্রাক্-পর্ব

রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের মুখে আসবার পর অপর একটি বিষয়ের প্রতি আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। আমি কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলাম ১৯৩৯ সালে। কংগ্রেসের গঠনতন্ত্র অনুসারে প্রেসিডেন্ট পদে আমার থাকার কথা মাত্র এক বছর। অবস্থা স্বাভাবিক থাকলে একবার ১৯৪০ সালে এবং আরেকবার ১৯৪২ সালে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হতো। কিন্তু ইতিমধ্যে সরকার কর্তৃক কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানটি বেআইনি ঘোষিত হবার ফলে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্ভব হয়নি। যার ফলে এই দীর্ঘ সময় আমিই প্রেসিডেন্ট হিসেবে কাজ করি।

এখন অবস্থা স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে এসেছে; সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অথবা মনোনয়নের প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়। প্রশ্নটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা ভারত থেকে দাবি ওঠে আমাকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত করতে হবে। যে কারণে আমার পুনর্নির্বাচনের দাবি ওঠে, তা হলো – স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, লর্ড ওয়াভেল এবং মন্ত্রিমিশনের সঙ্গে আলোচনায় আমিই মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলাম এবং সিমলা সম্মেলনে যখন সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল, তখন আমিই সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের পথ বের করতে সক্ষম হয়েছিলাম। কংগ্রেসের মধ্যে তাই একটি দৃঢ় মনোভাব জেগে উঠেছিল, আমি যেহেতু শেষ পর্যন্ত আলোচনা চালিয়ে এসেছি, সেইহেতু এর একটি সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত এবং সমাধানের পরে বিষয়টি কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমার হাতেই সমস্ত বিষয়টি থাকা দরকার। বাংলা, বোম্বাই, মাদ্রাজ, বিহার এবং উত্তর প্রদেশের কংগ্রেস কমিটিগুলো তখন খোলাখুলিভাবেই বলতে শুরু করেছে, মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা কার্যকর করবার দায়িত্ব আমাকেই দিতে হবে।

কংগ্রেস মহলে এই দাবি উত্থাপিত হলেও আমি বুঝতে পারি, কংগ্রেসের উচ্চতর কর্তৃপক্ষের মধ্যে কিছুসংখ্যক ব্যক্তি এ বিষয়ে ভিন্ন অভিমত পোষণ করছেন। আমি আরো বুঝতে পারি, সর্দার প্যাটেল এবার প্রেসিডেন্ট হবার বাসনা পোষণ করছেন। তাঁর বন্ধুরাও এটাই চাইছিলেন। ব্যাপারটি আমাকে বেশ কিছুটা অসুবিধার মধ্যে ফেলে; যার ফলে এ ব্যাপারে আমার কী করণীয় সে সম্বন্ধে মনস্থির করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। অবশেষে সমগ্র বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে আমি সিদ্ধান্ত নিই, যেহেতু আমি ১৯৩১ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত সুদীর্ঘ সাত বছর প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রয়েছি, সেইহেতু আমার পক্ষে এখন সরে দাঁড়ানো উচিত। অতএব আমি স্থির করি, এরপর আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার নাম প্রস্তাবিত হতে দেব না।

পরবর্তী প্রেসিডেন্টরূপে জওহরলাল

পরবর্তী প্রশ্ন হলো, কে আমার উত্তরাধিকারী হবেন? আমি চাইছিলাম পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন একজন ব্যক্তির আসা দরকার যিনি আমার সঙ্গে সর্ববিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন এবং আমি যেভাবে আলোচনা চালিয়ে এসেছি, সেই অনুসারে পরবর্তী কর্মপন্থা গ্রহণ করবেন। এ বিষয়ে সব দিক বিচার-বিবেচনা করে আমি এই সিদ্ধান্তে আসি, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে জওহরলালই সবদিক থেকে উপযুক্ত। আমি তাই ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ২৬শে এপ্রিল এক বিবৃতি প্রচার করে তাতে প্রেসিডেন্ট পদের জন্য জওহরলালের নাম প্রস্তাব করি এবং সেই বিবৃতির মাধ্যমে কংগ্রেস কর্মীদের কাছে আবেদন জানাই তাঁরা যেন সর্বসম্মতভাবে জওহরলালকে নির্বাচিত করেন। গান্ধীজি বোধহয় এ ব্যাপারে সর্দার প্যাটেলের দিকেই ঝুঁকেছিলেন; কিন্তু আমি জওহরলালের নাম প্রস্তাব করে বিবৃতি দেবার ফলে তিনি এ বিষয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। কেউ কেউ অবশ্য সর্দার প্যাটেল ও আচার্য কৃপালনীর নাম প্রস্তাব করেছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জওহরলালই সর্বসম্মতিক্রমে প্রেসিডেন্ট হন।

আমি যা সবচেয়ে ভালো এবং সঙ্গত মনে করেছিলাম, সেইভাবেই আমি কাজ করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাবলী দেখে আমার মনে হয় আমি হয়তো ভুল করেছিলাম এবং যারা আমাকেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরো কিছুকাল থাকার কথা বলেছিলেন, তাঁরাই হয়তো সঠিক ছিলেন।

আমার সিদ্ধান্ত সারা দেশের কংগ্রেসী মহলে এক বিরাট আলোড়নের সৃষ্টি করে। কয়েকজন নামকরা নেতা কলকাতা, বোম্বাই এবং মাদ্রাজ থেকে আমার কাছে ছুটে আসেন এবং বিবৃতি প্রত্যাহার করে নেবার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। আমার নাম যাতে পুনর্বার প্রস্তাবিত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যেই তাঁরা আমায় বিবৃতিটি প্রত্যাহার করতে বলেছিলেন। সংবাদপত্রেও একইভাবে আবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। কিন্তু আমি একবার যে সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেছি, তা প্রত্যাহার করে নিতে কিছুতেই সম্মত হইনি।

মুসলিম লীগ কাউন্সিল মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিলেন। কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটিও পরিকল্পনাটি অনুমোদন করেছিলেন। কিন্তু ওয়ার্কিং কমিটির এই অনুমোদন ছিল এ. আই. সি. সি.-র (নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি) সম্মতিসাপেক্ষ। আমরা অবশ্য এটাকে একটি নিয়মতান্ত্রিক বিষয় হিসাবেই মনে করেছিলাম। কারণ, অতীতে ওয়ার্কিং কমিটির প্রতিটি সিদ্ধান্তই এ. আই. সি. সি. সর্বতোভাবে অনুমোদন করে এসেছে। এই অনুসারে ৭ই জুলাই বোম্বাইতে এ. আই. সি. সি.-র সভা আহূত হয়। এদিকে সিদ্ধান্তটি যখন একবার গৃহীত হয়ে গেছে, সে অবস্থায় আমার পক্ষে দিল্লিতে বসে থাকার আর কোনো প্রয়োজন ছিল না। দিল্লির আবহাওয়াও তখন অত্যন্ত বেশি উত্তপ্ত। আমি তাই ৩০শে জুন দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে আসি। ৪ঠা জুলাই আমি কলকাতা থেকে বোম্বাই অভিমুখে রওনা হই। যে ট্রেনে আমি যাচ্ছিলাম, সে ট্রেনে শরৎচন্দ্র বসুও ছিলেন। যাবার পথে প্রায় প্রতিটি স্টেশনেই বিরাট জনতা সমবেত হয়েছে দেখতে পাই। সমবেত জনতা উচ্চকণ্ঠে দাবি জানাচ্ছিল, আমাকেই তারা পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে চায়। শরৎবাবু ছিলেন অন্য একটি কামরায়। কিন্তু প্রায় প্রতিটি বড় স্টেশনে আমার কামরায় এসে আমার সঙ্গে দেখা করছিলেন। জনতার দাবি শুনে তিনি আমার দৃষ্টি সেদিকে আকর্ষণ করে বলেন, “জনতা কি চায় শুনুন, এবং আপনি কি করছেন তা ভেবে দেখুন।”

৬ই জুলাই ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে। সেই সভায় এ. আই. সি. সি.-র সামনে যে প্রস্তাব পেশ করা হবে, তার খসড়া প্রস্তাব রচিত হয়। প্রথম প্রস্তাবটিতে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করা হয় এবং সেই প্রস্তাবটি আমাকেই উত্থাপন করতে বলা হয়। প্রস্তাবটি আমাকে উত্থাপন করতে বলার কারণ হলো, ওয়ার্কিং কমিটি মনে করেছিলেন বামপন্থীদের তরফ থেকে উক্ত প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হবে।

এ. আই. সি. সি.-র সম্মেলন শুরু হলে আমি জওহরলালকে আমার কাছ থেকে প্রেসিডেন্টের কার্যভার বুঝে নেবার জন্য অনুরোধ করি। এরপর সর্দার প্যাটেল মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য বলতে থাকেন। তিনি তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সমস্যাজর্জরিত বছরগুলোতে আমি যেভাবে কৃতিত্বের সঙ্গে আমার দায়িত্ব পালন করেছি এবং বহুবিধ বিপদের সম্মুখীন হয়েও অকুতোভয়ে এবং সুষ্ঠুভাবে যাবতীয় সমস্যার মোকাবিলা করেছি, তার জন্য আমাকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। সর্দার প্যাটেলের বক্তব্য শেষ হলেই আমি মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার ব্যাখ্যা-সংবলিত প্রস্তাবটি উত্থাপন করে সমগ্র বিষয়টি সংক্ষেপে বিবৃত করি। সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থী মহল থেকে তীব্রভাবে এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করা হয়। এই ব্যাপারে কংগ্রেস সোশালিস্ট দলই অগ্রণী ভূমিকা নেয়। কংগ্রেসের ভেতর থেকে কংগ্রেসের সরকারি প্রস্তাবের বিরোধিতা করলে সভায় জনপ্রিয়তা অর্জন করা যায়। সোশালিস্টরা এই পথই অনুসরণ করেছিলেন। তাঁদের চালচলনও ছিল অস্বাভাবিক এবং নাটকীয়তায় পূর্ণ। ইউসুফ মেহেরালী তখন গুরুতর অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু অসুস্থ অবস্থাতেই তাঁকে স্ট্রেচারে করে সভাস্থলে নিয়ে আসা হয়। উদ্দেশ্য হলো, সদস্যদের সহানুভূতি অর্জন। ইউসুফ মেহেরালী স্ট্রেচারে শায়িত অবস্থাতেই মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাকে বিরোধিতা করে তাঁর বক্তব্য রাখেন।

তখন সদস্যদের কাছে পরিকল্পনাটি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে আমি এই অভিমত প্রকাশ করি, কংগ্রেসের পক্ষে এটা একটা বিরাট জয়। ভারতের এই স্বাধীনতার স্বীকৃতিকে আমি ‘রক্তপাতহীন নীরব বিপ্লব’ বলে আখ্যাত করি। অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতের জাতীয় দাবিকে ইংরেজ কর্তৃক মেনে নেবার এই ঘটনাকে পৃথিবীর ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব বিষয় বলে আমি উল্লেখ করি। চল্লিশ কোটি লোকের এক বিরাট জাতি আজ সশস্ত্র যুদ্ধকে পরিহার করে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমস্ত বিরোধের অবসান ঘটিয়ে স্বাধীন হতে চলেছে। শুধুমাত্র এই বিষয়টি বিবেচনা করলেও বুঝতে পারা যাবে এই বিজয়কে ছোট করে দেখা অথবা এর বিরোধিতা করা পাগলামি ছাড়া আর কিছু নয়। আমি আরো বলি, মন্ত্রিমিশনের এই পরিকল্পনায় কংগ্রেসের সব দাবিই স্বীকৃত হয়েছে। কংগ্রেস ঐক্যবদ্ধ ভারতের স্বাধীনতা চায় এবং সবরকম বিভেদের বিরোধিতা করে। সুতরাং কংগ্রেস সোশালিস্ট দল কেন যে একে জয় বলে স্বীকার না করে পরাজয়রূপে অভিহিত করছেন, তা আমি বুঝতে পারি না।

আমার এই বক্তৃতা মন্ত্রশক্তির মতো কাজ করে। শ্রোতৃবর্গ পরিকল্পনার সারবত্তা ভালোভাবেই বুঝতে পারেন। এরপর প্রস্তাবটি সম্পর্কে ভোট নেওয়া হলে দেখা যায় বিপুল ভোটাধিক্যে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়েছে। ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা মেনে নেবার ঘটনাকে এইভাবেই কংগ্রেসের অনুমোদন লাভ করে।

কয়েকদিন পরে লর্ড পেথিক লরেন্স এবং স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপসের কাছ থেকে আমি দুটি তারবার্তা পাই। তারবার্তায় ওঁরা আমাকে অভিনন্দন জানান। এ. আই. সি. সি.-র সভায় মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা সম্বন্ধে আমার ব্যাখ্যা এবং সেই ব্যাখ্যার ফলে আমার প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়েছে জেনে ওঁরা দুজনেই আনন্দিত হন।

সাংবাদিক সম্মেলনে জওহরলালের বিবৃতি

এর কয়েকদিন পরেই এমন একটি দুর্ভাগাজনক ঘটনা ঘটে, যাতে ইতিহাসের ধারা ভিন্নপথে চলতে থাকে। ১০ই জুলাই জওহরলাল বোম্বাইতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে একটি বিবৃতি দেন। অন্য সময় হলে তাঁর সেই বিবৃতিটি তেমন কোনো আলোড়নের সৃষ্টি করত না। কিন্তু তৎকালীন অবিশ্বাস, সন্দেহ আর হীনম্মন্যতার আবহাওয়ায় এটা অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করে। কয়েকজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, এ. আই. সি. সি. কর্তৃক প্রস্তাবটি অনুমোদনের অর্থ কি এই নয়, কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠার বিষয়সহ সমগ্র পরকল্পনাটিই গ্রহণ করেছে?

এই প্রশ্নের উত্তরে জওহরলাল বলেন, কংগ্রেস গণপরিষদে অংশগ্রহণ করবে স্বাধীনভাবে, কোনোরকম বাধ্যবাধকতার জন্য নয়! এবং সেখানে যে পরিস্থিতিরই উদ্ভব হোক না কেন, তার মোকাবিলাও করবে স্বাধীনভাবে। বিষয়টি সুস্পষ্ট করবার জন্য সাংবাদিকরা আবার তাঁকে প্রশ্ন করেন, ‘এতে কি এই কথাই বোঝাচ্ছে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার হেরফের করা যাবে?’

এর উত্তরে জওহরলাল জোর দিয়ে বলেন, কংগ্রেস উক্ত পরিষদে যোগ দেবে এটাই শুধু স্বীকার করেছে। সুতরাং প্রয়োজনবোধে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার হেরফের করবার স্বাধীনতা তার নিশ্চয়ই আছে।

এই প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, জওহরলালের এই বিবৃতিটি ছিল ভ্রান্ত। এটি আদৌ সঠিক নয় যে কংগ্রেস ইচ্ছা করলে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনার হেরফের করতে পারে। কংগ্রেস প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রে ফেডারেল সরকার হবে বলে স্বীকার করে নিয়েছিল। আরো স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল, তিনটি বিষয় বাধ্যতামূলকভাবে এবং অপর কয়েকটি বিষয় প্রদেশগুলোর ইচ্ছাক্রমে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকবে। আমরা আরো স্বীকার করে নিয়েছিলাম, প্রদেশগুলোকে ক, খ এবং গ এই তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হবে। এসব স্বীকৃত বিষয় কিছুতেই কংগ্রেস তার নিজের ইচ্ছামতো পরিবর্তন করতে পারে না। পরিবর্তন করতে হলে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী এবং দলিলে স্বাক্ষরকারী অন্যান্য দলের মতামতও প্রয়োজন।

মুসলিম লীগ মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটি মেনে নিয়েছিল, কারণ ইংরেজ সরকার এর থেকে আর বেশিদূর অগ্রসর হতে সম্মত ছিলেন না। লীগ কাউন্সিলের সামনে বক্তৃতাপ্রসঙ্গে মি. জিন্না একথাটি স্পষ্ট করেই উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, এই পরিকল্পনা তিনি মেনে নিতে বলছেন, কারণ এর চেয়ে ভালো কিছু আদায় করা সম্ভব ছিল না।

আলোচনার পরিসমাপ্তি যেভাবে হয়, তাতে মি. জিন্না মোটেই খুশি হতে পারেননি; কিন্তু এর কোনো বিকল্প না থাকার জন্যই তিনি নিজেকে এর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। জওহরলালের বিবৃতিটি তাঁর কাছে একটা বোমার মতো হাজির হয়। তিনি তাই সঙ্গে সঙ্গে এক পাল্টা বিবৃতি প্রচার করে বলেন, কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের এই ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে সমগ্র বিষয়টিকে আবার নতুন করে বিচার-বিবেচনা করতে হবে। তিনি লিয়াকত আলীকে অবিলম্বে লীগ কাউন্সিলের সভা আহ্বান করতে বলেন এবং আর একটি বিবৃতির মাধ্যমে এই অভিমত ব্যক্ত করেন, মুসলিম লীগ কাউন্সিল দিল্লিতে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিল, কারণ তাঁদের বলা হয়েছিল কংগ্রেস এই পরিকল্পনা সর্বতোভাবে মেনে নিয়েছে এবং এই পরিকল্পনা অনুসারেই ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচিত হবে। কিন্তু এখন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট যখন ঘোষণা করেছেন পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে কংগ্রেস তার ইচ্ছামতো এই পরিকল্পনাকে অদল-বদল করতে পারবে, তার ফলে এই কথাটাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সংখ্যালঘুদের সব সময় এবং সব ব্যাপারে সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে দয়ার পাত্র হয়ে থাকতে হবে। মি. জিন্না আরো বলেন, কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় যখন সুস্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাচ্ছে কংগ্রেস মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা অগ্রাহ্য করেছে, সে অবস্থায় ভাইসরয়ের উচিত হবে মুসলিম লীগকে আহ্বান করে সরকার গঠনের দায়িত্ব তার ওপর ছেড়ে দেওয়া, কারণ মুসলিম লীগ পরিকল্পনাটি মেনে নিয়েছে।

২৭শে জুলাই বোম্বাইতে মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সভা বসে। উক্ত সভায় প্রারম্ভিক বক্তৃতায় মি. জিন্না পুনরায় পাকিস্তানের কথা ব্যক্ত করে বলেন, মুসলিম লীগের সামনে এইটিই হলো একমাত্র পথ। তিনদিন আলোচনার পরে মুসলিম লীগ কাউন্সিল মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করে এক প্রস্তাব গ্রহণ করে। প্রস্তাবে আরো বলা হয়, অতঃপর পাকিস্তান কায়েম করবার জন্য মুসলিম লীগ প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করবে।

পরিস্থিতি এইভাবে মোড় নেওয়ায় আমি অত্যন্ত দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। আমি স্পষ্ট দেখতে পাই, যে পরিকল্পনা নিয়ে আমি এতদিন অক্লান্তভাবে কাজ করে এসেছি, তা আমাদেরই অবিমৃশ্যকারিতার ফলে বানচাল হবার অবস্থায় এসে পড়েছে। আমি তাই মনে করি, পরিস্থিতির মোকাবিলা করবার জন্য এবং সমগ্র বিষয়টি নিয়ে নতুন করে বিচার-বিবেচনা করবার জন্য অবিলম্বে ওয়ার্কিং কমিটির সভা আহ্বান করা দরকার। আমার অনুরোধে ৮ই আগস্ট ওয়ার্কিং কমিটির সভা বসে। উক্ত সভায় আমি এই অভিমত জ্ঞাপন করি, আমরা যদি বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে চাই, তাহলে আমাদের এখন পুনরায় সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করতে হবে, এ. আই. সি. সি. কর্তৃক গৃহীত প্রস্তাবে কংগ্রেসের অভিমত ব্যক্ত হয়েছে, সুতরাং কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট অথবা যে-কোনো ব্যক্তি তা পরিবর্তন করতে পারেন না।

এ ব্যাপারে ওয়ার্কিং কমিটি এক মহাসমস্যার মধ্যে পড়ে। ব্যাপারটা এমন এক পর্যায়ে এসেছে যে একদিকে কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের সম্মান ব্যাহত হতে চলেছে, অপরদিকে এতদিনের অক্লান্ত চেষ্টার ফলে যে সমাধানের পথ পাওয়া গেছে, তা এক বিপজ্জনক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের বিবৃতিকে নস্যাৎ করা হলে তা সামগ্রিকভাবে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করবে, আবার মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করলে দেশকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে— এইসব কথা বিবেচনা করে অবশেষে আমরা একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করি, যাতে জওহরলালের সাংবাদিক সম্মেলনের কথা উল্লেখ না করে শুধু এ. আই. সি. সি.-র সিদ্ধান্তকেই কংগ্রেসের একমাত্র গৃহীত সিদ্ধান্ত বলে পুনরুল্লেখ করা হয়।

ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাব

ওয়ার্কিং কমিটি এ বিষয়ে যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, তার পূর্ণ বয়ান নিচে দেওয়া হলো:

ওয়ার্কিং কমিটি দুঃখের সঙ্গে ব্যক্ত করছে, সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের কাউন্সিল তাদের পূর্বসিদ্ধান্ত বাতিল করে এক নতুন প্রস্তাব মারফত ঘোষণা করেছে, তারা সংযুক্ত পরিষদে অংশগ্রহণ করবে না। দ্রুত-পরিবর্তনশীল বর্তমান সময়ে যখন বিদেশী শক্তির অধীনতা-পাশ থেকে মুক্ত হয়ে দেশ পূর্ণ স্বাধীনতালাভ করতে চলেছে এবং যে সময়ে উক্ত পরিবর্তনকে দেশবাসীর সামগ্রিক কল্যাণে নিয়োজিত করবার সুযোগ দেখা দিয়েছে এবং জনগণের সার্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সমস্যাবলীর সমাধানের জন্য জনগণের প্রতিনিধিদের আহ্বান করা হয়েছে, ঠিক সেই সময়েই মুসলিম লীগ কাউন্সিল এইরকম একটি প্রস্তাব গ্রহণ করল। ওয়ার্কিং কমিটি এখন সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছে, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু তবুও দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনা করে এবং ভারতবাসীর স্বাধীনতার কথা চিন্তা করে ওয়ার্কিং কমিটি দেশের স্বাধীনতাকামী প্রতিটি ব্যক্তির কাছে আবেদন করছে, তাদের সামগ্রিক সহযোগিতায় যাতে ভারতের সমস্যাবলীর সুষ্ঠু সমাধান করা যায়, তার জন্য তাঁরা যেন সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসেন।

মুসলিম লীগ সমগ্র বিষয়টিকে যেভাবে সমালোচনা করেছে, তা হলো, ১৬ই মে যে প্রস্তাবটি মেনে নেওয়া হয়েছিল, কংগ্রেস তা গ্রহণ করেনি। তাদের এই সমালোচনার উত্তরে কমিটি সুস্পষ্টভাবে বলছে, যদিও কংগ্রেস উক্ত পরিকল্পনার সমগ্র বিষয়ের সঙ্গে একমত হতে পারেনি, তবুও তারা সামগ্রিকভাবেই প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছিল। কংগ্রেস মনে করেছিল, পরিকল্পনায় যেসব বিষয় স্থানলাভ করেছে, সেগুলো অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে মতানৈক্য বিদূরিত করা যাবে। কংগ্রেস প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে একটি মৌলিক ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নিয়েছিল এবং প্রদেশগুলোর পক্ষে কোনো গ্রুপে যোগ দেওয়া বা না-দেওয়ার স্বাধীনতাও তারা মেনে নিয়েছিল। এ বিষয়ে ভবিষ্যতে যদি কোনোরকম গোলমাল দেখা দেয় বা এ বিষয়ে যদি কোনোরকম মতবৈষম্যের সৃষ্টি হয়, তাহলে পরিকল্পনার অঙ্গীভূত প্রস্তাবসমূহ অনুসরণ করেই তার সমাধান করা যাবে এবং সংযুক্ত পরিষদের কংগ্রেসী সদস্যদের প্রতি কংগ্রেস এইরকম নির্দেশই দেবে।

কমিটি সংযুক্ত পরিষদের পূর্ণ ক্ষমতার ওপর জোর দিয়ে এই কথা বলছে, বাইরের কোনো শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়াই তারা ভারতের শাসনতন্ত্র রচনা করবে এবং এ বিষয়ে তাদের পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। কিন্তু পরিষদের ভেতরে যেসব বাধা-বিপত্তি রয়েছে বা থাকবে, সেগুলো মেনে নিয়েই সদস্যদের কাজ করতে হবে এবং সব ব্যাপারে সকলের কাছে থেকে সহযোগিতা নিয়ে স্বাধীন ভারতের শাসনতন্ত্র এমনভাবে রচনা করবে, যাতে দল-মত নির্বিশেষে প্রত্যেক শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের স্বার্থ সমভাবে এবং ন্যায়সঙ্গতভাবে সুরক্ষিত হয়। এই উদ্দেশ্য নিয়ে এবং সংযুক্ত পরিষদে অংশগ্রহণ করে তাকে সাফল্যমণ্ডিত করবার জন্যই ওয়ার্কিং কমিটি তাদের ২৬শে জুনের (১৯৪৬) প্রস্তাব পাস করেছিল এবং সে প্রস্তাব নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি কর্তৃক ৭ই জুলাই অনুমোদিত হয়েছিল। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির উক্ত সিদ্ধান্তের প্রতি ওয়ার্কিং কমিটি পুনরায় তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে ঘোষণা করছে, সংযুক্ত পরিষদের কাজ কংগ্রেসের পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত অনুসারেই চলবে।

কমিটি আশা করে, মুসলিম লীগ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দলগুলো তাদের নিজ নিজ স্বার্থে এবং দেশের বৃহত্তম স্বার্থে এই কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে।

.

আমরা আশা করেছিলাম, ওয়ার্কিং কমিটির এই প্রস্তাব দ্বারা সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়াকে রোধ করা যাবে; কারণ, এই প্রস্তাব পাস করার ফলে মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনাটা যে সামগ্রিকভাবেই মেনে নেওয়া হয়েছিল, সে সম্বন্ধে আর কোনো সন্দেহই থাকবার কথা নয়। মুসলিম লীগ যদি আমাদের এই প্রস্তাবটি মেনে নিত, তাহলে সম্মান বজায় রেখেই পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া যেত। কিন্তু মি. জিন্না এ প্রস্তাব মেনে নেন না। তিনি জওহরলালের অভিমতই কংগ্রেসের আসল অভিমত বলে মনে করেন। তিনি বলেন, ইংরেজরা এদেশে উপস্থিত থাকাকালেই এবং ক্ষমতা তাঁদের হাতে থাকাকালেই যখন কংগ্রেস বারবার তার মত পরিবর্তন করছে, তাহলে ইংরেজরা চলে যাবার পর কংগ্রেস যে জওহরলালের অভিমত অনুযায়ী পুনরায় মত পরিবর্তন করবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়?

ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে এ কথা আবার বলা হয়, কংগ্রেস মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাব সমগ্রভাবেই গ্রহণ করেছে। এর ফলে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাবও স্বীকার করে নেওয়া হয়। কংগ্রেস কর্তৃক মন্ত্রিমিশনের প্রস্তাব এইরকম দ্ব্যর্থহীন ভাষায় মেনে নেবার আশু ফল দেখতে পাওয়া যায় ভাইসরয়ের মতিগতিতে। ১২ই আগস্ট তিনি জওহরলালকে আহ্বান করে নিম্নবর্ণিত শর্ত অনুসারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে বলেন:

মহান সম্রাটের সরকারের অনুমোদনক্রমে মহামান্য রাজপ্রতিনিধি ভারতবর্ষে অবিলম্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব উত্থাপন ও দাখিল করবার জন্য কংগ্রেস সভাপতিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং কংগ্রেস সভাপতি, উক্ত আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু মহামান্য রাজপ্রতিনিধির সঙ্গে এই প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনা করবার জন্য শিগগিরই নতুন দিল্লিতে আসছেন।

একই দিনে মি. জিন্না এক বিবৃতি প্রচার করেন। উক্ত বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘১০ই আগস্ট ওয়ার্ধায় গৃহীত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সর্বশেষ প্রস্তাবে কোনোই নূতনত্ব নেই, এটা কংগ্রেসের পূর্ববর্তী প্রস্তাবেরই পুনরাবৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ব্যাপারে সহযোগিতা করবার জন্য জওহরলাল তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, কিন্তু সে আমন্ত্রণ তিনি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে ১৫ই আগস্ট জওহরলাল মি. জিন্নার বাড়িতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতি সম্বন্ধে আলোচনা করেন, কিন্তু সে আলোচনা ফলপ্রসূ তো হয়ই না, উপরন্তু পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে পড়ে।

প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস

জুলাই মাসের শেষদিকে লীগ কাউন্সিলের সভায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং এ বিষয়ে যথাকর্তব্য করার জন্য মি. জিন্নার ওপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মি. জিন্না ১৬ই আগস্ট দিনটিকে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। কিন্তু সেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচী সম্বন্ধে কোনো কথাই তিনি বলেন না। সাধারণভাবে মনে করা গিয়েছিল, ওই দিন লীগ কাউন্সিলের আর একটি সভা অনুষ্ঠিত হবে এবং সেই সভায় প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কর্মসূচী স্থির করা হবে; কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তা হলো না। উপরন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, কলকাতায় এক অদ্ভুত এবং বিস্ময়কর অবস্থা দ্রুতগতিতে প্রসারিত হচ্ছে। অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের বিশেষ দিনগুলোতে হরতাল ডাকত, মিছিল বের করত এবং জায়গায় জায়গায় জনসভা করত। কিন্তু কলকাতায় মুসলমানদের যে মনোভাব আমি লক্ষ্য করলাম, তাতে বোঝা গেল, ১৬ই আগস্ট মুসলিম লীগপন্থী মুসলমানরা কংগ্রেসীদের আক্রমণ করবে এবং তাদের ধনসম্পত্তি লুঠ করবে। বাংলা সরকার ১৬ই আগস্টকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠল এবং জনসাধারণ বেশ কিছুটা ভীত হয়ে পড়ল। আইন সভায় কংগ্রেস দল সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়, কিন্তু সরকারপক্ষ তাঁদের প্রতিবাদে কর্ণপাত না করায় সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাঁরা সভাকক্ষ পরিত্যাগ করেন এবং এইভাবে সরকারি সিদ্ধান্তকে একটিমাত্র দলের সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখাতে চান। তাঁরা দেখাতে চান, সরকারের শাসনযন্ত্রের সহায়তায় শাসকদল তাঁদের অন্যায় সিদ্ধান্তকে সরকারি সিদ্ধান্ত হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন। আগে থেকেই কলকাতায় একটা ভীতির মনোভাব জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল, সেই মনোভাবটি এর ফলে আরো বেশি করে দেখা দিল। বাংলায় মুসলিম লীগ সরকার থাকার জন্য এবং লীগের অন্যতম নেতা মি. এইচ. এস. সুরাবর্দী সেই সরকারের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বলেই জনগণের মধ্যে এই ভীতির ভাবটা আরো বেশি প্রকটিত হয়।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ১ই আগস্ট একটি পার্লামেন্টারি সাব-কমিটি নিযুক্ত করেন। উক্ত সাব-কমিটিতে সদস্য হিসেবে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং আমাকে সদস্য হিসেবে নেওয়া হয়। ১৩ই আগস্ট আমরা এক সভায় মিলিত হয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্বন্ধে ভাইসরয়ের কাছে কী প্রস্তাব দাখিল করা হবে সে সম্বন্ধে আলোচনা করি। এরপর জওহরলাল ১৭ই আগস্ট পার্লামেন্টারি কমিটির একটি সভা আহ্বান করেন। উক্ত সভায় অংশ গ্রহণের জন্য আমি ১৬ই আগস্ট বিমানযোগে কলকাতা থেকে দিল্লি অভিমুখে রওনা হই।

১৬ই আগস্ট দিনটি ভারতের ইতিহাসে এক মসীলিপ্ত দিন। ওই দিন কলকাতা শহরে যেরকম পাইকারি নরহত্যা ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটে, তার কোনো পূর্ব-নজির নেই। শত শত লোক নিহত হয়, হাজার হাজার লোক গুরুতরভাবে আহত হয়। এছাড়া বহু কোটি টাকা মূল্যের সম্পত্তি ধ্বংস হয়। ওই দিন মুসলিম লীগ যে মিছিল বের করে, সেই মিছিলে অংশগ্রহণকারী লোকেরা লুঠ এবং অগ্নিসংযোগ করতে করতে এগোতে থাকে। এর ফলে সমগ্র কলকাতা শহর উভয় সম্প্রদায়ের গুণ্ডাদের হাতের মুঠোর মধ্যে এসে পড়ে।

বাংলা কংগ্রেসের নেতা শরৎচন্দ্র বোস গভর্নরের সঙ্গে দেখা করে পরিস্থিতিকে আয়ত্তে আনবার জন্য অবিলম্বে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেন। গভর্নরকে তিনি আরো বলেন, তাঁকে এবং আমাকে (লেখককে) কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির সভায় যোগদানের জন্য দিল্লি যেতে হচ্ছে। গভর্নর তাঁকে বলেন, আমাদের দুজনকে নিরাপদে বিমানবন্দরে নিয়ে যাবার জন্য তিনি আমাদের সঙ্গে মিলিটারি রক্ষীদল পাঠাবেন। আমি অনেকক্ষণ অপেক্ষা করি, কিন্তু আমাকে নিয়ে যাবার জন্য কেউ আসে না। আমি তখন একাই রওনা হয়ে যাই। শহরের রাস্তাগুলো তখন খাঁ খাঁ করছে এবং সারা শহরটি যেন মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে বলে বোধ হয়। আমি যখন স্ট্র্যান্ড রোড দিয়ে যাচ্ছিলাম, সেই সময় আমি লক্ষ্য করি, একদল গাড়োয়ান এবং দরোয়ান লাঠিসোঁটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা আমার গাড়িকে আক্রমণ করতে চেষ্টা করে। আমার ড্রাইভার তখন চিৎকার করে বলতে থাকে, এটা কংগ্রেস সভাপতির গাড়ি; কিন্তু জনতা তার কথায় কান দেয় না। অবশেষে অনেক কষ্টে প্লেন ছাড়বার কয়েক মিনিট আগে আমি দমদম বিমানবন্দরে আসি।

ওখানে আমি সেনাবিভাগের এক বিরাট কোম্পানিকে দেখতে পাই। তারা মিলিটারি ট্রাকে অবস্থান করছিল। আমি যখন তাদের জিজ্ঞেস করি, অবস্থার মোকাবিলা করবার জন্য তারা কিছু করছে না কেন, তার উত্তরে তারা আমাকে জানায় যে তাদের শুধু দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়েছে। আর কিছু করতে বলা হয়নি। সারা কলকাতা শহরেই এই অবস্থা দেখা যায়; সব জায়গাতেই মিলিটারি আর পুলিশকে কাঠের পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। চোখের সামনে নির্দোষ নরনারীকে নিহত হতে দেখেও তারা স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে।

১৬ই আগস্ট দিনটি যে শুধু কলকাতার জন্যই ‘কালো দিবস’, তাই নয়, সারা ভারতেই ও দিনটি ‘কালো দিবস’ হিসেবে পালিত হয়। ঘটনাবলী যেভাবে মোড় নিয়েছিল, তাতে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে তার মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। ভারতের ইতিহাসে এটা একটা মহা দুঃখজনক ঘটনা। আমি অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, মুসলিম লীগকে তার রাজনৈতিক এবং সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধানের জন্য পুনরায় সুযোগ দেওয়ার ফলেই এইরকম একটি মহা অনর্থের সৃষ্টি হতে পেরেছিল। মিঃ জিন্না এই ভুলের পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিলেন এবং এই সুযোগের ফলেই তিনি মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

জওহরলাল আমার ঘনিষ্ঠতম প্রিয় বন্ধুদের একজন এবং ভারতের জাতীয় জীবনে তাঁর অবদানও অসীম। ভারতের স্বাধীনতার জন্য তিনি নিরলসভাবে কাজ করেছেন এবং বহু দুঃখকষ্ট সহ্য করেছেন, এবং স্বাধীনতা লাভের পরে তিনি জাতীয় ঐক্য এবং অগ্রগতির প্রতীক হিসেবে পরিগণিত হয়েছেন। কিন্তু আমি দুঃখের সঙ্গে বলতে বাধ্য হচ্ছি, সময় সময় তিনি হৃদয়াবেগ দ্বারা চালিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, সময় সময় তিনি তাত্ত্বিক দিকের প্রতি বেশি করে জোর দেওয়ার ফলে আসল পরিস্থিতিকেও ছোট করে দেখেছেন।

সংযুক্ত পরিষদ সম্বন্ধে তাঁর বিরক্তিও তাঁর এই ধরনের ধারণার ফলেই প্রদত্ত হয়েছিল। একই ধারণার ফলে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দেও তিনি একটা বিরাট ভুল করেছিলেন। এটা হয়েছিল ১৯৩৫ খ্রীষ্টাব্দের ভারত শাসন আইন অনুসারে প্রথম নির্বাচনের প্রাক্কালে। উক্ত নির্বাচনে শুধু বোম্বাই এবং উত্তরপ্রদেশ ছাড়া আর সব প্রদেশেই মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল। বাংলার গভর্নর সেখানে লীগ সরকার গঠনের জন্য নানাভাবে লীগকে মদত দিয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, মুসলিম লীগই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। কিন্তু কৃষক প্রজা পার্টি বিজয়ের ফলে তাঁর সে আশা একেবারেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। অন্যান্য মুসলমানপ্রধান প্রদেশগুলোতেও, অর্থাৎ পাঞ্জাব, সিন্ধু এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশেও মুসলিম লীগ পরাজয়ের গ্লানি বহন করে। বোম্বাইতে মুসলিম লীগ কোনো রকমে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তবে উত্তরপ্রদেশে তারা বিরাটভাবে জয়ী হয়। ওখানে জমিয়ৎ-উল-উলেমা-ই-হিন্দ মুসলিম লীগের সঙ্গে সহযোগিতা করার ফলেই এটা সম্ভব হয়। জমিয়ৎ এই কথা ভেবে মুসলিম লীগকে সমর্থন করেছিল যে নির্বাচনের শেষে মুসলিম লীগ কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করবে এবং একসঙ্গে কাজ করবে।

উত্তরপ্রদেশের মুসলিম লীগের নেতা তখন চৌধুরী খালিকুজ্জমান এবং নবাব ইসমাইল খান। আমি যখন সরকার গঠনের উদ্দেশ্যে লক্ষ্ণৌ গিয়েছিলাম তখন তাঁদের উভয়ের সঙ্গেই আলোচনা করেছিলাম। তাঁরা আমাকে কথা দিয়েছিলেন, তাঁরা শুধু কংগ্রেসের সঙ্গে সহযোগিতা করেই তাঁদের কর্তব্য শেষ করবেন না, কংগ্রেসের কার্যসূচী রূপায়ণেও তাঁরা সর্বতোভাবে সহায়তা করবেন। তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিলেন, মুসলিম লীগ নতুন সরকারের অংশীদার হবে। স্থানীয় পরিস্থিতি তখন এমন আকার ধারণ করেছিল যে তাঁদের দুজনের মধ্যে কারো পক্ষেই এককভাবে সরকারে ঢোকা সম্ভব ছিল না। এই পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে আমি তাঁদের আশা দিই যে তাঁদের দুজনকেই সরকারের মধ্যে নেওয়া হবে। মন্ত্রিসভা যদি সাতজন মন্ত্রী নিয়ে গঠিত হয় তাহলে দুজনকে মুসলিম লীগ থেকে এবং বাকি সবাইকে কংগ্রেস থেকে নেওয়া হবে। আবার মন্ত্রিসভা যদি নয় জন মন্ত্রী নিয়ে গঠিত হয় তাহলে কংগ্রেসী মন্ত্রীর সংখ্যা আরো বেশি হবে। আমার সঙ্গে আলোচনার পরে একটি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি (note) তৈরি হয়, যাতে বলা হয়: মুসলিম লীগ দল কংগ্রেসের সঙ্গে একযোগে কাজ করবে এবং কংগ্রেসের কার্যসূচী মেনে নেবে। নবাব ইসমাইল খান এবং চৌধুরী খালিকুজ্জমান উভয়েই সেই বিবৃতিতে সই দেন। এরপর আমি লক্ষ্ণৌ থেকে পাটনা অভিমুখে রওনা হয়ে যাই। কারণ বিহারে মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যাপারে সেখানে আমার উপস্থিতি বিশেষভাবে প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।

কয়েকদিন পরে আমি এলাহাবাদে ফিরে আসি। ওখানে এসে দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করি, জওহরলাল ইতিমধ্যে এক অঘটন ঘটিয়ে বসেছেন। তিনি চৌধুরী খালিকুজ্জমান এবং নবাব ইসমাইল খানকে লিখেছেন, মন্ত্রিসভায় তাঁদের মধ্যে একজনকেই শুধু নেওয়া হবে। চিঠিতে তিনি আরো লেখেন, তাঁদের মধ্যে কাকে মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে তা মুসলিম লীগই স্থির করবে। আমি আগেই বলেছি তাঁদের একজনের পক্ষে মন্ত্রিসভায় যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাঁরা তাই দুঃখের সঙ্গে জানিয়ে দেন জওহরলালের প্রস্তাব মেনে নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়।

এটি সত্যিই একটি দুঃখজনক ঘটনা। উত্তরপ্রদেশ মুসলিম লীগের সহযোগিতার প্রস্তাবটি যদি তখন মেনে নেওয়া হতো তাহলে সমস্ত কার্যকরী ব্যবস্থাতেই মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের সঙ্গে মিলিত হতে হতো। জওহরলালের কাজের ফলে উত্তরপ্রদেশের মুসলিম লীগের মধ্যে এক নতুন প্রাণবন্যার সৃষ্টি হয়। রাজনীতি নিয়ে যাঁরা বিচার-বিবেচনা করে থাকেন তাঁরা সবাই জানেন, উত্তরপ্রদেশেই মুসলিম লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। মিঃ জিন্না এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন এবং এমনভাবে কংগ্রেসের বিরোধিতা শুরু করেন যার ফলে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান কায়েম হয়।

আমি দেখতে পাই, পুরুষোত্তমদাস ট্যান্ডন এই ব্যাপারে কিছুটা নেতৃত্ব নিয়েছেন এবং তিনিই জওহরলালের বিচারবোধকে প্রভাবিত করেছেন। ট্যান্ডনের রাজনৈতিক অভিমতের প্রতি আমার আদৌ কোনো রকম উচ্চ ধারণা ছিল না, সুতরাং আমি জওহরলালকে তাঁর সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করতে বলি। আমি তাঁকে বলি, মুসলিম লীগকে মন্ত্রিসভায় না এনে তিনি এক বিরাট ভুল করেছেন। আমি তাঁকে আরো বলি, তাঁর এই কাজের ফলে লীগের মধ্যে নতুন জীবন সঞ্চারিত হবে, যার ফলে ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে পদে পদে বাধার সৃষ্টি হবে। কিন্তু জওহরলাল আমার সঙ্গে একমত হতে পারেন না। তিনি বলেন, তাঁর বিচারই সঠিক। তিনি আমার সঙ্গে এই বলে তর্ক জুড়ে দেন, মাত্র ছাব্বিশজন সদস্য নিয়ে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় একটার বেশি আসন দাবি করতে পারে না। আমি যখন দেখতে পাই, জওহরলাল এ বিষয়ে তাঁর পূর্ব অভিমত থেকে একচুলও বিচ্যুত হতে প্রস্তুত নন, তখন আমি ওয়ার্ধায় গিয়ে এ ব্যাপারে গান্ধীজীর পরামর্শ চাই। আমি যখন সমস্ত বিষয় তাঁর কাছে খুলে বলি তখন তিনি আমার সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, জওহরলালকে তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য তিনি পরামর্শ দেবেন। কিন্তু জওহরলাল যখন বিষয়টি গান্ধীজীর কাছে অন্যভাবে ব্যাখ্যা করেন তিনি তখন তাঁর কথাই মেনে নেন এবং এ ব্যাপারে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। ফলে উত্তরপ্রদেশে কোনো রকম সমাধানই সম্ভব হয় না। মিঃ জিন্না এই পরিস্থিতির পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেন এবং সমগ্র মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের বিরোধী করে তোলেন। নির্বাচনের পরে মিঃ জিন্নার অনেক সমর্থকই তাঁকে পরিত্যাগ করবার কথা ভাবছিলেন। কিন্তু জওহরলালের কাজের ফলে তিনি পুনরায় সেই সব সমর্থককে দলে টানতে সক্ষম হন।

১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে জওহরলালের সেই ভুলটি নিশ্চয়ই খারাপ অবস্থা ডেকে এনেছিল। কিন্তু ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দে তিনি যে ভুলটি করলেন তার ফল হলো আরো মারাত্মক। জওহরলালের স্বপক্ষে কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, মুসলিম লীগ যে ওইভাবে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করবে তা তিনি ভাবতেই পারেননি। মিঃ জিন্না কখনো গণআন্দোলনে বিশ্বাসী ছিলেন না। আমিও তাই মিঃ জিন্নার এই মতি পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করি। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, মুসলিম লীগ কর্তৃক মন্ত্রিমিশনের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যাত হলে ইংরেজ সরকার আবার নতুন করে প্রশ্নটি উত্থাপন করবেন এবং আবার নতুনভাবে আলোচনা শুরু হবে। নিজে একজন আইন ব্যবসায়ী হওয়ায় তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আবার যদি আলোচনা শুরু হয় তাহলে তিনি তার দাবিকে পুনরুত্থাপন করে আরো কিছু সুযোগ-সুবিধে আদায় করে নিতে পারবেন। কিন্তু তাঁর সেই গণনা ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হয়। ইংরেজ সরকার মিঃ জিন্নাকে খুশি করবার জন্য নতুন করে আলোচনার সুযোগ তাঁকে দেন না।

স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস প্রথম থেকেই এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছিলেন। আমি তাকে লিখি, মন্ত্রিমিশন দীর্ঘ দু মাস যাবৎ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সঙ্গে আলোচনা করে যে পরিকল্পনা রচনা করেন তা উভয় দলই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা যে পরবর্তীকালে মুসলিম লীগ তার পূর্বসিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে যায়। এর যাবতীয় দায়িত্ব মুসলিম লীগের। সুতরাং নতুন করে আলোচনা শুরু করবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। এটা যদি করা হয় তাহলে বুঝতে হবে ইংরেজের সঙ্গে আমাদের আলোচনা কখনো শেষ হবে না এবং এর ফলে জনগণের মনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হবে এবং নতুন নতুন সমস্যার সৃষ্টি হবে। আমার চিঠির উত্তরে স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস লেখেন, তিনি এ বিষয়ে আমার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। তিনি আরো লেখেন, সরকারের মনোভাবও এইরকমই হওয়া উচিত। আমি যা আশা করেছিলাম সেইভাবেই ঘটনাস্রোত প্রবাহিত হতে থাকে। আগেই বলেছি, ১৯৪৬ খ্রীষ্টাব্দের ১২ই আগস্ট ভাইসরয় এক ঘোষণা প্রচার করে জওহরলালকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য আহ্বান করেন।

আমরা দিল্লীতে এসে মিলিত হই ১৭ই আগস্ট। এদিকে কলকাতা এবং অন্যান্য জায়গায় তখন চলছে ধ্বংস, নরহত্যা আর লুঠতরাজ। সারা দেশে যখন কালো ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে সেই অবস্থাতেই আমরা দিল্লীতে মিলিত হই। আমরা জানতাম, মিঃ জিন্না সরকার গঠনের ব্যাপারে জওহরলালের আমন্ত্রণ গ্রহণ করবেন না। প্রকৃতপক্ষে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে তিনি যে চিঠিটি লেখেন তা ১৬ই আগস্ট আমাদের হস্তগত হয়। জওহরলাল পুনরায় তাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, মুসলিম লীগের জন্য সব সময়ই দরজা খোলা রইলো। কিন্তু ঘটনাবলী তখন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে সম্পূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান আর সম্ভব ছিল না।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন