১। পূর্বাভাষ

১. পূর্বাভাষ

বছর দুয়েকের কিছু আগে আমি যখন মৌলানা আজাদের সঙ্গে দেখা করে তাঁর আত্মজীবনী রচনা করতে অনুরোধ করি তখন মুহূর্তের জন্যও ভাবতে পারিনি, আমাকেই এই গ্রন্থের ভূমিকা লেখার শোকাবহ দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত জীবন সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলতে চাইতেন না; তাই প্রথমে তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করতে অক্ষমতা জ্ঞাপন করেন। আমি তাঁকে বলি, ইংরেজ কর্তৃক ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অব্যবহিত পূর্বে এবং পরে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, সেই ঘটনাবলিকে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করার বিশেষ প্রয়োজন আছে, এবং যেহেতু উক্ত ব্যাপারে তিনি একটি মুখ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সেইহেতু একমাত্র তিনিই উক্ত ঘটনাবলিকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারেন এবং এর জন্য তাঁর একটা দায়িত্বও আছে। তখন তিনি সময়াভাব এবং শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে এ ব্যাপারে তেমন কোনো উৎসাহ দেখান না। তাঁর হয়তো মনে হয়েছিলো, তাঁর ওপরে ন্যস্ত সরকারী দায়িত্ব এবং জনগণের প্রতি তাঁর কর্তব্য পালন করার পর এ কাজের জন্য সময় ব্যয় এবং মস্তিষ্কচালনা তাঁর শরীরে কুলোবে না। কিন্তু আমি যখন তাঁকে কথা দিই, লেখার দায়িত্ব যাতে তাঁর ওপরে না চাপে সেজন্য এ ব্যাপারে আমি তাঁকে যথাসাধ্য সাহায্য করবো তখন তিনি আর আপত্তি তোলেননি। এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, লেখার দায়িত্ব আমি গ্রহণ করার ফলে বিষয়টার অর্থ এই দাঁড়ায় যে ভারতের জনসাধারণ তাঁর নিজের লেখা আত্মজীবনী পড়বার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। তবে আদৌ কিছু না পাবার পরিবর্তে তাঁর বক্তব্যের ইংরেজি প্রতিরূপ নিশ্চয়ই জনসাধারণের কাম্য হবে।

এবারে গ্রন্থটি কীভাবে রচিত হয়েছিলো সে সম্বন্ধে কিছু বলার দরকার বোধ করছি। গত দু বছর বা তার কাছাকাছি আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় কমপক্ষে এক ঘণ্টা মৌলানা আজাদের সঙ্গে কাটিয়েছি। এটি আমার নিয়মিত অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। এই নিয়মিত হাজিরার ব্যতিক্রম শুধু সেই ক’দিনই হয়েছে, যে ক’দিন আমি দিল্লীতে উপস্থিত থাকতে পারিনি।

মৌলানা সাহেবের কথা বলার ধারাটা এতোই চমৎকার ছিলো যে নিতান্ত দুরূহ বিষয়ও তিনি অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করতে পারতেন। আমি তাঁর সামনে বসে নোট নিয়েছি এবং মাঝে মাঝে কোনো কোনো বিষয় সম্বন্ধে তাঁর কাছ থেকে ব্যাখ্যা চেয়েছি। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় সম্বন্ধে বিশেষ কিছু বলতে চাইতেন না। তবে জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলো তিনি খোলাখুলিভাবেই বলতেন। এইভাবে একটা পরিচ্ছেদ লেখার মতো উপকরণ যখন আমার হাতে এসেছে তখন আমি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি ইংরেজিতে একটা খসড়া তৈরি করে তাঁর হাতে দিয়েছি। প্রতিটি পরিচ্ছেদের খসড়া প্রথমে তিনি নিজে পড়তেন, তারপর আমরা দুজনে মিলে আবার পড়তাম, আলোচনা করতাম। এই সময় (অর্থাৎ পরবর্তী আলোচনার সময়) তিনি অনেক কিছু পরিবর্তন অথবা পরিবর্ধন করেছেন। আবার প্রয়োজনবোধে কোনো কোনো বিষয় একেবারেই বাদ দিয়েছেন। শেষ পরিচ্ছেদের সমাপ্তি পর্যন্ত এইভাবেই আমরা কাজ করেছি, এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে গ্রন্থটির পুরো খসড়া-পাণ্ডুলিপি মৌলানা সাহেবের হাতে তুলে দিয়েছি।

পাণ্ডুলিপির খসড়াটি হস্তগত হবার পর মৌলানা সাহেব সিদ্ধান্ত নেন, তা থেকে ত্রিশখানা পৃষ্ঠা (যাতে ব্যক্তিগত বিষয়সমূহ স্থান পেয়েছিলো) বর্তমানে প্রকাশ করা হবে না। তিনি নির্দেশ দেন, পরিত্যক্ত প্রতিটি বিষয়ের একটি করে কপি সীলমোহর করা খামে কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারে এবং নয়া- দিল্লীর জাতীয় সংগ্রহশালায় সুরক্ষিত থাকবে। তিনি আরো বলেন, উক্ত প্রত্যাহৃত অংশগুলিকে কোনোক্রমেই কোনোভাবে পরিবর্তন করা চলবে না। (অর্থাৎ ঠিক যেভাবে তিনি বিষয়গুলিকে উপস্থাপনা করেছেন এবং প্রতিটি বিষয় সম্পর্কে তিনি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার কোনোরকম পরিবর্তন করা চলবে না।)

এরপর মৌলানা আজাদের নির্দেশ অনুসারে আমি কিছু কিছু পরিবর্তন এবং সংক্ষেপন করে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের শেষদিকে পাণ্ডুলিপির সংশোধিত খসড়াটি তাঁর হাতে তুলে দিতে সক্ষম হই।

এর পরেই আমি কিছুদিনের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় চলে যাই। আমার অনুপস্থিতিকালে মৌলানা সাহেব আর একবার পাণ্ডুলিপিটা পড়েন। এরপর আমি অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে এলে দুজনে মিলে আবার পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে বসি। এই সময় আমরা প্রতিটি পরিচ্ছেদের প্রতিটি লাইন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাঠ করি। এবারেও মৌলানা সাহেবের নির্দেশে কিছু কিছু পরিবর্তন করা হয়, তবে বড়রকমের কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। কোনো কোনো পরিচ্ছেদ তিনবার বা চারবারও সংশোধন করা হয়।

সংশোধনের কাজ শেষ হবার পর প্রজাতন্ত্র দিবসে মৌলানা সাহেব আমাকে বলেন, পাণ্ডুলিপিটা পড়ে তিনি খুশী হয়েছেন। তিনি আরো বলেন, এবার এটিকে ছাপতে দেওয়া যেতে পারে।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, গ্রন্থটি যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা হলো তাঁর অনুমোদিত খসড়া-পাণ্ডুলিপিরই মুদ্রিত রূপ। মৌলানা আজাদের ইচ্ছে ছিলো গ্রন্থটি তাঁর সপ্ততিতম জন্মদিনে (অর্থাৎ ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে) প্রকাশ করতে হবে; কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস গ্রন্থটি যখন প্রকাশিত হলো তখন তিনি আর ইহজগতে নেই!

আগেই বলেছি, এ বই লেখার ব্যাপারে মৌলানা সাহেব প্রথম দিকে মোটেই আগ্রহান্বিত ছিলেন না; কিন্তু পরবর্তীকালে রচনার কাজ যতোই এগোতে থাকে ততোই তাঁর আগ্রহ বাড়তে থাকে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিগত ছ মাসে তিনি প্রায় প্রতিটি সন্ধ্যাই পাণ্ডুলিপি তৈরির কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। ব্যক্তিগত ঘটনাবলি প্রকাশ করার ব্যাপারে সংকোচ বোধ করলেও শেষ পর্যন্ত তিনি তাঁর জীবনপঞ্জীর প্রথম অংশ লিখতে সম্মত হন। উক্ত প্রথম অংশের একটি সংক্ষিপ্তসারও তিনি তৈরি করেন। তাঁর ইচ্ছানুসারে উক্ত সংক্ষিপ্তসার এই গ্রন্থের প্রারম্ভিক পরিচ্ছেদ হিসেবে দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গত আরো একটি কথা বলে রাখা দরকার, আত্মজীবনীর একটি তৃতীয় খণ্ডও তাঁর লেখার ইচ্ছে ছিলো (যাতে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে পরবর্তীকালের ঘটনাবলি থাকবে), কিন্তু সে খণ্ডটি আর কোনোদিনই লেখা হবে না।

আমার কাছে এই গ্রন্থটি লেখার কাজ ছিলো অত্যন্ত আনন্দদায়ক। আমার এই আনন্দ আরো বর্ধিত হবে যদি আমি বুঝতে পারি মৌলানা সাহেবের প্রকৃত মানসকে আমি যথাযথভাবে উপস্থাপিত করতে পেরেছি। তার এই মানস হলো ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সুষ্ঠু সমঝোতা সৃষ্টি করে এক বিশ্বজনীন সৌভ্রাত্র সৃষ্টির প্রয়াস। তিনি আশা করতেন ভারত এবং পাকিস্তানের অধিবাসীরা পরস্পরের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হবে এবং একে অপরের প্রতি প্রতিবেশীর মতো আচরণ করবে। এই মনোভাবের জন্যই তিনি ‘ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল ফর কালচারাল রিলেশনস্’ নামক সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন। তিনি মনে করতেন, উক্ত প্রতিষ্ঠান এই ব্যাপারে উভয় রাষ্ট্রের অধিবাসীদের মধ্যে একটি সুস্থ পরিবেশ তৈরি করতে সক্ষম হবে। এই মনোভাব নিয়ে উক্ত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে যে ভাষণ দেন (এইটিই তার সর্বশেষ মুদ্রিত ভাষণ) তাতে তিনি উভয় রাষ্ট্রের জনগণকে (যারা মাত্র দশ বছর আগেও একই অবিভক্ত দেশের অধিবাসী ছিলেন) নিজেদের ভেতরের সমস্ত বাদ-বিসংবাদ এবং বিভেদের কথা ভুলে গিয়ে সৌভ্রাত্রের বন্ধনে আবদ্ধ হতে সনির্বন্ধ আবেদন জানিয়েছিলেন।

আমি তাই মনে করি, ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সৌভ্রাত্রমূলক সমঝোতা সৃষ্টির জন্য এই গ্রন্থের বিক্রয়লব্ধ অর্থের একটি বড় অংশ উক্ত প্রতিষ্ঠানকে দিলেই সবচেয়ে ভালো কাজ হবে। শেষ পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই পাকা হয়। স্থির হয়, এই গ্রন্থের রয়েলটির একটা অংশ পাবেন মৌলানা আজাদের নিকটতম আত্মীয়েরা এবং বাকি অংশ পাবে কাউন্সিল। আরো স্থির হয়, কাউন্সিলের হাতে যে অর্থ আসবে তা ব্যয় করা হবে দুটি বাৎসরিক পুরস্কারের মাধ্যমে। একটি পুরস্কার দেওয়া হবে ইসলামের ওপরে অমুসলমানদের লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের রচয়িতাকে এবং অপর পুরস্কারটি দেওয়া হবে হিন্দুধর্মের ওপরে মুসলমানদের লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের প্রণেতাকে। মৌলানা আজাদ তরুণদের খুব বেশি ভালোবাসতেন বলে আরো স্থির হয়, প্রতি বছর বাইশে ফেব্রুয়ারি যাদের বয়স ত্রিশ বছর বা তার নিচে থাকবে, তারাই শুধু এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে।

বক্তব্য শেষ করবার আগে আর একটি বিষয় আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই। বিষয়টি হলো, এই গ্রন্থে এমন কিছু কিছু মন্তব্য ও মতামত প্রকাশিত হয়েছে যেগুলোর সঙ্গে আমি একমত নই। অতএব কেউ যেন মনে না করেন, এতে যেসব মতামত ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো আমারও মতামত। মৌলানা আজাদ যখন জীবিত ছিলেন তখন আমি তাঁর কাছে অনেক বিষয়ে আমার মতানৈক্যের কথা বলেছি। আমার কথাগুলো তিনি ধীরভাবে শুনেছেন এবং তা নিয়ে বিচার-বিবেচনা করে গ্রন্থের কোনো কোনো জায়গায় পরিবর্তন অথবা পরিবর্ধন করেছেন। তাঁর একটি মহৎ গুণ ছিলো পরমতসহিষ্ণুতা। তাছাড়া তাঁর মনটিও ছিলো অত্যন্ত উদার এবং বিচারবুদ্ধিযুক্ত। এই কারণেই তিনি অপরের মতামতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে শ্রবণ করতেন এবং ভালো মনে হলে তা গ্রহণ করতেও দ্বিধাবোধ করতেন না। আবার যেসব ক্ষেত্রে আমার অভিমতকে তিনি মেনে নিতে পারতেন না সেসব ক্ষেত্রেও তিনি কোনোরকম বিরক্তি বা অসন্তুষ্টি প্রকাশ না করে হাসিমুখে বলতেন, ‘আমার নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করবার অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে।’ আজ যখন তিনি আর ইহজগতে নেই তখন তাঁর মন্তব্য এবং অভিমতসমূহ যেভাবে তিনি রেখে গেছেন ঠিক সেইভাবেই প্রকাশিত হয়েছে। অতএব, এতে আমার মতামতের কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

পরিশেষে যে কথাটা আমি বলতে চাই, তা হলো, কোনো ব্যক্তির পক্ষে অপর কোনো ব্যক্তির মনোভাব যথাযথভাবে প্রকাশ করা রীতিমতো কঠিন ব্যাপার। এমন কি, উভয় ব্যক্তি যখন একই ভাষাভাষী হয় তখনো দেখা যায়, সামান্য একটিমাত্র শব্দের পরিবর্তন ঘটালেও সম্পূর্ণ বিষয়টি ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করে। প্রথমত বলা চলে, মৌলানা সাহেব তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করতেন উর্দু ভাষায় এবং আমি তাঁর সেই উর্দু কথাগুলোকে ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করতাম। উর্দু এবং ইংরেজি ভাষার প্রকাশভঙ্গীর মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য থাকায় মৌলানা আজাদের চিন্তাধারাকে সুষ্ঠুভাবে প্রকাশ করা আরো কঠিন। উর্দু ভাষা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মতোই সমৃদ্ধ ও বর্ণাঢ্য; অপরপক্ষে ইংরেজি ভাষা মূলত বক্তব্য-সংক্ষেপক ভাষা হওয়ায় (essentially a language of understatement) বক্তার মনোভাব পুরোপুরি প্রকাশ করতে পারে না। বিশেষ করে বক্তা যেখানে মৌলানা আজাদের মতো একজন উর্দু ভাষায় সুপণ্ডিত ব্যক্তি এবং লেখক তাঁর বক্তব্যের ইংরেজি অনুবাদক, সেখানে যে কিছু কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি থাকতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু এইসব অসুবিধে থাকা সত্ত্বেও আমি আমার সাধ্যানুসারে তাঁর বক্তব্য বিষয়কে বিশ্বস্ত ভাবে উপস্থাপিত করতে চেষ্টা করেছি। এখানে আমার সবচেয়ে বড় পুরস্কার এই, আমার রচনা মৌলানা সাহেবের অনুমোদন লাভ করেছে।

হুমায়ুন কবীর
নয়াদিল্লী,
১৫ই মার্চ, ১৯৫৮

অধ্যায় ১ / ২০

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন