বিনোদ ঘোষাল

বেশ অনেকটা রাত্তির হয়ে গেল, কখন বাড়ি ফিরব কে জানে? ভেবেই রিডিং রুমের দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকাল নীল। ইসস সাড়ে সাতটা বাজে। মা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করছে। যদিও নীল লাইব্রেরিতেই রয়েছে সেটা মা'র জানা। সারাদিন বিচ্ছিরি গুমোট গরমের পর আজ বিকেলে যখন মেঘ ডাকতে শুরু করেছিল, তখনই নীল মাকে বলেছিল একটু লাইব্রেরি থেকে আসছি।
আজ বেরোস না। একটু পরেই ঝড় আসবে।
আমি জাস্ট বইটা দিয়ে একটা বই নিয়েই চলে আসব মা।
পাড়ার লাইব্রেরি রাজারাম স্মৃতি পাঠাগার নীলদের বাড়ির থেকে খুব বেশি দূরে নয়। সাইকেলে মিনিট পাঁচেক মোটে। ও যখন ক্লাস ফোরে পড়ে বাবা তখনই লাইব্রেরিটায় মেম্বার করে দিয়েছিল ওকে। আগে বাবার সঙ্গে যেত। এখন নীলের ক্লাস সেভেন। নিজেই সাইকেল চালিয়ে যায়।
আগে লাইব্রেরিতে অনেক মেম্বার ছিল। প্রচুর ভিড় হত। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে সেটার অবস্থা খুব খারাপ। সরকারি অনুদানের জন্য বহুবার আবেদন করেও কোনও সাড়া আসেনি আজ পর্যন্ত। এমন চলতে থাকলে লাইব্রেরিটা যে বন্ধই হয়ে যাবে সেটা নীলও বুঝতে পারে।
পড়াশোনার পাশাপাশি গল্পের বই পড়ার নেশাটাও ভীষণ ওর। এই মোটা মোটা বই তিন-চার দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলে। আর এখন তো সামার ভেকেশন চলছে। ফলে ম্যাক্সিমাম দেড় থেকে দু-দিনের মধ্যে শেষ।
লাইব্রেরিয়ান অসীমকাকু বলেন তুই সত্যিই এত তাড়াতাড়ি বই পড়িস নাকি পৃষ্ঠা উলটে ফেরত দিয়ে যাস বলত? বলে আচমকা বেশ কয়েকবার দু-একটা বইয়ের সামারি কী সেটা নীলকে জিগ্যেস করে বুঝে গেছেন এই ছেলে সত্যিই পুরো বই পড়ে, এবং অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে পড়ে।
ক্লাস সেভেনের মধ্যেই টেনিদা, ফেলুদা, কাকাবাবু, ঋজুদা-র অনেকগুলো উপন্যাস পড়া হয়ে গেছে। এখন ফেলুদা সিরিজ পড়ছে নীল। আজ সকালেই ছিন্নমস্তার অভিশাপ শেষ হয়েছে। এরপর ফেলুদারই আরেকটা বই এনে ফেলতে হবে।
নীল প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে এই গরমের ছুটিতেই ও ফেলুদার সবক'টা উপন্যাসের হাফ অন্তত শেষ করবেই করবে। বাবার কাছে জেনে নিয়েছে ফেলুদার মোট উপন্যাসের সংখ্যা পঁয়ত্রিশ। মানে অন্তত সতেরোটা ওকে শেষ করতেই হবে।
ছুটির বারোদিন কেটে গেছে তার মধ্যে মোটে সাতটা শেষ হয়েছে। পুয়োর পারফরমেন্স। তবে ফেলুদা সত্যিই লা জবাব। কী দারুণ লেখাগুলো।
যাই হোক, মাকে এক্ষুনি আসছি বলে কোনওমতে রাজি করিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেছিল নীল। লাইব্রেরিতে পৌঁছোনো মাত্র ঝুপঝাপ করে বৃষ্টিটা শুরু হয়ে গিয়েছিল। বৃষ্টিটা আসবে বলেই হয়তো লাইব্রেরিতে তেমন লোক ছিল না। অসীমকাকু বললেন, এ কি রে...এই বৃষ্টির মধ্যে এসেছিস কেন? ফিরবি কী করে?
ও ঠিক ফিরে যাব। বইটা আসলে শেষ হয়ে গেছে। নতুন একটা নিয়েই চলে যাব। উফ, সত্যিই তোর হবে। বলে একগাল হেসে অসীমদা বলেছিলেন, তাড়াতাড়ি দেখ কী বই নিবি?
তাড়াতাড়ি আর দেখতে হল না, মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টি থামার আর নাম নেই। কী কেলেংকারি।
রিডিং রুমে বসে থাকতে থাকতে এক সময় অধৈর্য হয়ে উঠল নীল। অসীমদার কাছ থেকে 'কৈলাসে কেলেংকারি' নেওয়া হয়ে গেছে অনেক আগেই। লাইব্রেরিও ফাঁকা। শুধু অসীমকাকু তার নিজের চেয়ারে বসে পা নাচাচ্ছেন আর ঘন ঘন ঘড়ি দেখছেন। লাইব্রেরি বন্ধ হওয়ার সময় হয়ে এল। আর একা একা রিডিং রুমে বসে থাকতে ভালো লাগছিল না নীলের। অসীমকাকুর কাছে এসে বলল, কাকু আমি একটু বইঘরে যাব?
কেন রে?
এমনিই, বইগুলো একটু দেখতাম।
লাইব্রেরিটায় আসলে তিনটে রুম। ডানদিকেরটা রিডিং রুম। পেল্লায় একটা টেবিলের দু-ধারে বেঞ্চ পাতা। টেবিলের ওপর সব খবরের কাগজ, ম্যাগাজিন ইত্যাদি রাখা থাকে। সকলে এসে পড়েন। মাঝের ঘরটা অফিস রুম। সেখানেই অসীমকাকু বসেন। বই-এর ক্যাটালগগুলো ওর ডেস্কের ওপরেই রাখা থাকে। মেম্বাররা সেই ক্যাটালগ ঘেঁটে নিজের পছন্দের বই বলে দিলে অসীমকাকু পাশের ঘর থেকে সেই বই এনে দেন। আর বাঁ-দিকের যে ঘরটায় সেলফের মধ্যে বইগুলো থাকে সেটাকে সকলে বইঘর বলে। সেখানে মেম্বারদের প্রবেশ নিষেধ। শুধুমাত্র কাকু যায়।
নীলের অনেকদিনের ইচ্ছা ওই ঘরটায় একবার ঢোকার। অত বইয়ের মধ্যে একা একা ঘুরে বেড়াবার মজাটা কেমন সেটা একবার খুব জানতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নো সুযোগ। কাকু পারমিশনই দেন না। আজও ভেবেছিল অনুমতি পাবে না, কিন্তু কী খেয়াল হল অসীমকাকু মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা যা দেখ গিয়ে। কিন্তু খবরদার কোনও বই এলোমেলো করিস না কিন্তু। আমার সিরিয়াল গন্ডগোল হয়ে যাবে তাহলে।
না, না, আমি কিছু করব না, বলেই দারুণ আনন্দ নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে পড়ল নীল। ঘরটায় ঢুকতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি। কী শান্ত! স্টিলের আলমারিগুলো সব পরপর রাখা। আর তার ভেতরে ঠাসা সব বই। পুরনো বইয়ের গন্ধে ঘরটা ভরে রয়েছে। বাইরের বৃষ্টির শব্দ ঢুকছে না ঘরটায়। দুদিকে এই উঁচু উঁচু আলমারির মাঝখানের সরু প্যাসেজ দিয়ে এদিকওদিক ঘুরতে লাগল নীল।
এই লাইব্রেরিটা যার নামে সেই রাজারামেরই বাড়ি ছিল এটা। বিশাল বাড়ি। একদিকে লাইব্রেরি আর অন্যদিকে দাতব্য চিকিৎসালয়। অসীমকাকু আর বাবার কাছে নীল শুনেছে, এই রাজারাম দাস ছিলেন একজন মস্ত ধনী মানুষ। অনেকবছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন একা।
তাঁর নাকি খুব বই পড়ার শখ ছিল। নিজের সংগ্রহে অজস্র বই ছিল। মারা যাওয়ার আগে তাঁর এই বাড়ি এবং সমস্ত বই উইল করে লাইব্রেরি আর দাতব্য চিকিৎসালয়ের জন্য দান করে যান। সেটাও আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখন নীলের বাবাও জন্মাননি, অসীমকাকুও না। এবং তাঁর মৃত্যুটাও ছিল নাকি বেশ রহস্যজনক। কীভাবে সেটা আর নীলকে জানানো হয়নি।
বাড়িটার ছাদ অনেক উঁচুতে আর এই বইঘরটাই তিনটে ঘরের মধ্যে সবথেকে বড়। এলোমেলো এদিক-ওদিক ঘুরপাক খাচ্ছিল নীল আর লুকিয়ে এই বই ওই বই ঘেঁটে দেখে নিয়ে আবার যথাস্থানেই রেখে দিচ্ছিল।
এইভাবে ঘুরতে ঘুরতে একসময় একেবারে শেষ আলমারিটার সামনে এসে দাঁড়াল। এই আলমারির সবক'টা বই-ই খুব খুব পুরনো। দেখে বোঝাই যায় এই বইগুলো কাউকে ইস্যু করা হয় না।
হাত দেবে কি না ভাবল নীল। দেওয়াটা ঠিক হবে না বোধ হয়। কিন্তু দেব না ভেবেও শেষ পর্যন্ত নিজেকে আটকাতে পারল না। কীসের যেন একটা টান ওকে বাধ্য করল একটা বই তুলে নিতে। বেশ মোটা একটা বই। সেটা তুলতেই তার ফাঁকে গোজা খুব ছোট একটা বই উঁকি দিল। আরে ওটা আবার কী বই? মোটা বইটা আলমারিতে রেখে দিয়ে সেটাকে বার করে আনল।
যাব্বাবা এটা বই কোথায়। একটা ডায়েরি, বইয়ের মতো করে চামড়া দিয়ে মলাট দেওয়া। ভেতরে কালি পেন দিয়ে পাতার পর পাতা লেখা। লেখা বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই।
ডায়েরিটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই ভেতর থেকে ভ্যাপসা একটা গন্ধ বেরিয়ে নীলকে কেমন অবশ করে ফেলল। ভয় লাগতে শুরু করল ওর। ইচ্ছে হল ঘরটা ছেড়ে সেই মুহূর্তে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু পারল না। কী এক শক্তি যেন ওকে মাটিতে কামড়ে ধরে রইল। আর অনেকটা নিজের অজ্ঞাতেই একটা ঘোরের মধ্যে টুক করে পাতলা বইটা নিজের প্যান্টের পকেটে চালান করে দিল নীল। কেন দিল নিজেও বুঝতে পারল না, কেউ যেন ওকে দিয়ে জোর করে করিয়ে নিল ওই অন্যায় কাজটা। তারপর সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে নিজের বইটাও না নিয়ে সেই বৃষ্টির মধ্যেই সাইকেলটা নিয়ে রওনা দিল বাড়ির দিকে। পিছন থেকে অসীমকাকু বেশ কয়েকবার ডাকলেন এত বৃষ্টির মধ্যে বেরোতে বারণ করলেন। নীল সেসব কিছু শুনতেই পেল না।
বাড়ি ফিরে মায়ের বকাও যেন কানে ঢুকল না নীলের। রাত্রে খাওয়া কোনওমতে শেষ করে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে খাটের ওপর বসে সেই ডায়েরিটা খুলল। ঝাপসা হয়ে যাওয়া হলুদ রুল টানা প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা শ্রীরাজারাম দাস। সন তেরোশো আটষট্টি। নীল মনে মনে হিসেব করে দেখল পঞ্চাশ বছরেরও আগের ডায়েরি এটা। বাপ রে। পৃষ্ঠাগুলো প্রায় ভাজা ভাজা হয়ে গেছে। খুব ঝাপসা হয়ে গেছে লেখাগুলো।
টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে পড়তে শুরু করল নীল। প্রতিটি পৃষ্ঠাতেই অদ্ভুত কয়েকটা লাইন লেখা। যেমন প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা সুরঙ্গমার শরীর ঠিক হয়ে যাক। পরের পৃষ্ঠায় আমি একটি পুত্র সন্তান চাই। তার পরে বংশীগ্রামের দিঘিটা যেন আমি পাই। উদয় নারায়ণ সিংহের সঙ্গে মোকদ্দমায় আমি জিততে চাই, আর রায় যেন আজই দেওয়া হয়। আমার একমাত্র পুত্র দীপেন্দ্র যেন সুস্থ হয়ে ওঠে। আরও আরও এমন লেখা।
কিছু ভালো ইচ্ছে কিছু খারাপ। কিছু খুবই খারাপ। যেমন আমার শত্রু ভানু ঘোষ যেন আগামি কালই মারা যায়। ত্রিদিব সামন্তর সব ধান যেন নষ্ট হয়ে যায়। আবার এমনও লেখা রয়েছে গ্রামে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় করতে চাই। আমি একটি বিদ্যালয় করতে চাই। প্রতি পৃষ্ঠাতেই এমন একটি করে ইচ্ছার কথা লেখা।
নীল খুব অবাক হয়ে গেল। এ আবার কেমন ধরনের ডায়েরি। ডায়েরিটার সবক'টা পৃষ্ঠাতেই এমন সব লেখা শুধু শেষের দিকে একটিমাত্র পৃষ্ঠা ফাঁকা। আর তার আগের পৃষ্ঠায় লেখা আমি আমার মৃত্যু চাই। আর তার পরের পাতায় দীর্ঘ লেখা। কী লেখা রয়েছে খুব আগ্রহ নিয়ে পড়তে শুরু করল নীল।
আমার মৃত্যুর পর এই ডায়েরি হয়তো ভবিষ্যতে কেউ পড়বে তাই কিছু কথা আমি লিখে যেতে চাই। আজ থেকে প্রায় বেশ কিছু বছর আগে আমি মানস সরোবর ভ্রমণে গেছিলাম। ফেরার সময় ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগে পড়ি। প্রাণ নিয়ে ফেরার কোনও আশাই ছিল না। তখন এক তিব্বতী লামা আমাকে বাঁচায়। আমি তখন প্রবল জ্বরে আক্রান্ত। সেই কয়েকটা দিন আমার কোনও জ্ঞান ছিল না।
জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি এক গুম্ভায়, আর একজন খুব বয়স্ক তিব্বতী লামা আমার শুশ্রূষা করছেন। কয়েকদিন পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। তারপর বেশ কিছুকাল আমি সেই লামার সেবা করি। প্রায় মাস খানেক ওর সেবা করার পর ফিরে আসার আগে উনি আমার হাতে এই ডায়েরিটি দেন। দিয়ে বলেন এটি একটি পিশাচসিদ্ধ খাতা। এতে কেউ যদি তার মনোস্কামনা লেখে তাহলে তা সত্যি হয়ে যায়। শুধুমাত্র অমরত্ব আর কোনও মৃত মানুষকে বাঁচিয়ে তোলার সাধ্য এই ডায়েরির নেই। একটি পৃষ্ঠায় কেবলমাত্র একটি মনোস্কামনা লেখা যাবে। সঙ্গে তিনি এটাও সাবধান করে দেন, যদি কেউ একবারও নিজের হাতে এই ডায়েরিতে কিছু লেখেন তাহলে আজীবন ডায়েরি তার পিছু ছাড়ে না, এবং কোনওভাবেই এটাকে বিনষ্ট করা যায় না।
আমি ডায়েরিটি নিয়ে আসি। ভেবেছিলাম আমার জীবনে কোনও অভাব নেই, সুতরাং কোনওদিনই ডায়েরিতে কিছু লিখব না। কিন্তু মানুষের লোভ বড় সাংঘাতিক। আর লোভ কোনওকালেই মানুষের ক্ষতি ছাড়া ভালো করেনি। এই ডায়েরি পাঠ করলে জানা যাবে আমি বহু সময় অন্যের ক্ষতি চেয়েছি। আর তার ফল স্বরূপ আজ আমাকে দুরারোগ্যব্যাধিতে একা পড়ে থাকতে হচ্ছে দিনের পর দিন। আমার সকল প্রিয়জনেরাও মৃত। এই অপরিসীম যন্ত্রণা আমাকে আর কতদিন ভোগ করতে হবে জানি না।
ডায়েরিতে আমি নিজের মৃত্যুকামনা করেও মরতে পারিনি, কারণ লামা বলেছিলেন এই ডায়েরিতে একবার কিছু লিখে ফেললে ডায়েরি তার পিছু ছাড়ে না। জানি না আমার কাছে শমন কবে আসবে। আমি আর পারছি না। এই ডায়েরির একটি পৃষ্ঠা আমি ফাঁকা রাখলাম, ভবিষ্যতে যদি কেউ এই ডায়েরি পড়ে তার একটি মনোস্কামনা যাতে পূর্ণ হয় সেই জন্য। তার একটি মনোস্কামনা পূর্ণর পর এই ডায়েরির মেয়াদ পূর্ণ হবে। তারপর কী হবে আমার নিজেরও জানা নেই। এ এক অভিশপ্ত ডায়েরি অতএব সাবধান।
পুরোটা এক নিশ্বাসে পড়ার পর পুরো হাঁ হয়ে গেল নীল। এসবের মানে কী? এসব কি সত্যি কথা? অবশ্য এমন একজন মানুষ খামোখা মিথ্যেই বা বলবেন কেন? ডায়েরিটাকে এবার ভয় পেতে শুরু করল নীল। কী করা যায় এটা নিয়ে। কাল গিয়ে আবার লাইব্রেরিতে ওই জায়গাতেই ঢুকিয়ে আসলেই হবে। কিন্তু কী করে? কাল কি আর অসীমকাকু বই ঘরে ঢুকতে দেবেন নাকি? তাহলে?
কিন্তু এতদিনেও ডায়েরিটা আর কারও হাতে পড়ল না কেন? উত্তরটাও নিজেই মনে মনে দিল নীল। তার মানে ওই রাজারামবাবু মারা যাওয়ার আগে নিজের বই-এর র্যাকে ডায়েরিটা গুঁজে রেখেছিলেন আর তার মৃত্যুর পর যেহেতু ওই বাড়ির যাবতীয় বই পুরো আলমারি সমেত লাইব্রেরিতে নিয়ে চলে আসা হয় এবং ওইসব পুরোনো বইগুলো কোনওদিনই কাউকে ইস্যু করা হয়নি তাই একইভাবে পড়ে রয়েছে।
অনেক ভেবেচিন্তে নীল ঠিক করল ডায়েরিটাকে কাল বোসপুকুরে ফেলে দিয়ে আসবে। কিন্তু তারপর? এই ডায়েরির তো মৃত্যু নেই, যদি কেউ কখনও খুঁজে পায় আর ফাঁকা পৃষ্ঠাটাই খুব খারাপ কিছু লিখে দেয় তাহলেই তো সর্বনাশ। হয়তো পৃথিবীটা ধ্বংস হয়ে যাক এমন কথাই কেউ লিখে বসল তাহলে কী হবে? ধুৎ মাথায় কিচ্ছু আসছে না। তাহলে? তাহলে একমাত্র উপায় বোসপুকুরে ফেলে দেওয়ার আগে ওই ফাঁকা পৃষ্ঠাটায় কিছু একটা লিখে দেওয়া যাতে আর কেউ কখনও কিছু না লিখতে পারে। কিন্তু কী?
অনেক কিছু ভাবতে থাকল নীল। ও যেন এই বছর স্কুলে ফার্স্ট হয় থেকে ও যেন এই বছর পুজোর ছুটিতে ব্যাংকক বেড়াতে যেতে পারে, ওর যেন দারুণ একটা ক্রিকেট ব্যাট হয় কিংবা এই বছর জুনিয়র সুইমিং কম্পিটিশনে স্টেট উইনার বিনয় শর্মাকে হারিয়ে দিতে পারে...আরও অনেক অনেক কিছু ভাবল কিন্তু কোনওটাই মনের মতো হল না। খালি মনে হল ধুর বড্ড কম হয়ে গেল। অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে শেষে খুব শান্ত মন নিয়ে ডায়েরির শেষ ওই পৃষ্ঠাটায় একটা ইচ্ছে লিখল নীল। তারপর ওটাকে পড়ার টেবিলে ম্যাথ কপির ভেতরে লুকিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ল।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙতেই আগে ড্রয়ার খুলে ওই ডায়েরিটাকে বার করতে গিয়ে খুব চমকে উঠল নীল। এই সর্বনাশ ডায়েরিটা কই? পুরো ভ্যানিশ! এই রে মা নিশ্চয়ই দেখতে পেয়েছে। এবার কী হবে? ওইসব পড়লে মা নিশ্চয়ই খুব বকবে নীলকে। খুব ভয়ে ভয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নীল দেখল ডাইনিং টেবিলে চায়ের কাপ হতে নিয়ে মা আর বাবা দিব্বি হেসে গল্প করছে। নীল এসে বসল। ভয়ে বুক ঢিপ ঢিপ করছে। এই বুঝি বকুনি শুরু হল। কোথা থেকে ডায়েরিটা পেয়েছিস জিগ্যেস করলে কী বলবে? লুকিয়ে নিয়ে এনেছি বললে কপালে মারও জুটবে নির্ঘাত। তাও সত্যি কথাই বলবে ও। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ পরেও মা কিংবা বাবা কেউই ওকে ডায়েরি নিয়ে কিছুই না বলাতে ও-ই নিজে থেকে জিগ্যেস করল, মা তুমি কি আমার ড্রয়ার থেকে কিছু বার করেছ?
তোর ড্রয়ার থেকে? কই না তো। কী খুঁজছিস?
নাহ কিছু না বলে উঠে এল নিজের ঘরে। উফ বাব্বা জোর বাঁচা বেঁচে গেছে। তাহলে ডায়েরিটা নিজে থেকেই ভ্যানিশ হয়ে গেছে। শেষ পৃষ্ঠাটা ভরতি হয়ে যাওয়াতেই ওটা উধাও হয়েছে বুঝতে পারল নীল। কিন্তু শেষ পৃষ্ঠায় যে ইচ্ছের কথাটা লিখেছিল সেটা কি আদৌ পূর্ণ হবে? কে জানে?
বিকেলে সাইকেল নিয়ে লাইব্রেরি পৌঁছোতেই নীল দেখল রিডিংরুমে অনেকের ভিড়। অসীমকাকু খুব খুশি খুশি মুখে সকলের সঙ্গে গল্প করছেন। বয়স্ক কয়েকজন মেম্বার বেশ হেসে হেসে আনন্দ নিয়ে গল্পে মশগুল।
নীলকে দেখেই অসীমকাকু বলে উঠলেন এই তো আমাদের খুদে মেম্বার এসে গেছে। এদিকে আয় মিষ্টি খেয়ে যা। বলে ডেস্কের সামনে রাখা বেশ বড় একটা প্যাকেট থেকে একটু সন্দেশ বার করে নীলের হাতে তুলে দিলেন।
সন্দেশ হাতে নিয়ে নীল জিগ্যেস করল কী ব্যাপার গো কাকু?
আরে দারুণ খবর। আমাদের লাইব্রেরিটা বুঝলি মনে হয় বেঁচে গেল। সরকার থেকে অনেক টাকা অনুদানের একটা চিঠি এসেছে। অনেক টাকা বুঝলি, প্রচুর বই কিনতে পারব। বিল্ডিংটা একটু সারাতে পারব। তোর কী কী বই চাই আমাকে লিস্ট করে দিস। হা হা হা।
অসীমকাকু আর লাইব্রেরির সেই পুরোনো মেম্বারদের হাসি মুখগুলো দেখে সত্যিই মন ভরে গেল নীলের। সন্দেশ খেতে খেতে বাইরে এসে ভাবল যাক বাবা ডায়েরিটা তাহলে ভ্যানিশ হওয়ার আগে কথা রেখে গেছে। শেষ পৃষ্ঠায় নীল লিখেছিল আমাদের রাজারাম স্মৃতি পাঠাগার যেন অনেক বড় লাইব্রেরি হয়ে ওঠে।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন