রতন ঘোষের মোরগ

বিনোদ ঘোষাল

রতন ঘোষের মোরগ

 

দীপারানি ঘোষ হল রতন ঘোষের বউ। আজকের বউ নয়, পুরো তিরিশ বছরের পুরোনো বউ। লোকে বিয়ে করলে পরিবার তৈরি হয়। স্বামী-স্ত্রী আন্ডা-বাচ্চা সব নিয়ে ছোট পরিবার ধীরে ধীরে বড় হয়। দীপার ক্ষেত্রে তা হয়নি। কামারহাটির বাদল দাসের একমাত্র মেয়ে দীপা রতন ঘোষকে বিয়ে করে কুঞ্জপুরে আসতেই পেল্লায় এক রেডিমেড ফ্যামিলি পেয়েছিল।

রতন বিয়ের পরদিন বউ নিয়ে বিকেলে নিজের বাড়ি এসেই নতুন বউ দীপাকে একে একে দেখিয়েছিল, এই দেখো আমার বড় মেয়ে শ্যামলী, এই হল লক্ষ্মী। ওই যে দেখছ রোগাপানা বেটি কিচ্ছু খায় না তাই অমন চেহারা। ওর নাম হল শুঁটকি। আর এই মেয়েটা আমার এই গত পরশুই হয়েছে। কী ফরসা হয়েছে দেখেছো, একেবারে ওর মায়ের মতো গায়ের রং পেয়েছে। ওর নাম দিয়েছি....আচ্ছা ওর নাম তুমিই দিয়ো কেমন।

বিয়ের বেনারসি পরা দীপা প্রথমদিন শশুরবাড়ি এসে পুরো ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছিল। লোকটা বলে কী! আমার বড় মেয়ে, ছোট মেয়ে বলে যাদের চেনাচ্ছিল তারা সব হল বাছুর। গরুর বাছুর।

আসলে রতন ঘোষের পেল্লায় খাটাল। সেই খাটালে বারো-তেরোটা গরু মোষ এবং সঙ্গে আরও কিছু তাদের ছানাপোনা। এ ছাড়াও দুটো গোদা মোরগ, তিনটে মুরগি আর দুটো ছাগল এবং একটা বলিষ্ঠ পাঁঠা রয়েছে। এটাই রতনের সংসার।

তা বিয়ের আগে ঘটক যখন দীপার বাবার কাছে সম্বন্ধ নিয়ে এসেছিল তখনই বলেছিল ছেলের পাকা পায়খানাযুক্ত একতল নিজস্ব বাটি। পাত্রের পৈতৃক ব্যবসা। অত্যন্ত সৎ চরিত্র। একমাত্র নিজের গরু-মোষ ছাড়া আর কোনও বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। দুধ আর ঘুঁটে বেচে আয়ও মন্দ নয়।

পাকা দেখার দিন রতনকে স্বচক্ষে দেখেও ছিল দীপা। রোগা, দাঁত উঁচু কিন্তু হাসিটা বড়ই সরল। আর খুব জোরে জোরে কথা বলে। বোধ হয় গরুদের বকতে বকতেই এমন অবস্থা হয়েছে।

সে যাই হোক মোটের ওপর সকলেরই পছন্দ হয়েছিল রতনকে। আর রতনেরও দিব্যি পছন্দ হয়েছিল দীপাকে। তবে সকলের মাঝেই বলে উঠেছিল, আমার তো মেয়ে দিব্যি লেগেছে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছে পারবে।

কী পারবে?

আমার গরুগুলোর আসলে এমনই একজন মা দরকার, মেয়েদের হাত না পড়লে—বুঝলেন কি না, ওদের যত্ন ঠিকঠাক হচ্ছে না।

সে তুমি চিন্তা কোরো না বাবা, আমাদের ঘরেও একটা গাই আছে, আর দুটো হাল টানার বলদ। ওদের দেখাশোনা আমার দীপু মা-ই করে। উত্তর দিয়েছিল দীপার তিরাশি বছরের ঠাকুমা।

ব্যস ঠাকুমা, তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। খুব খুশিখুশি হয়ে বলেছিল রতন।

আর এটা সত্যি কথাই যে দীপা বাপেরবাড়ির গরুগুলোর জন্য জাবনা কাটা থেকে গোবর তোলা, ঘুঁটে তোলা সবই করে, এমনকী দুধ দুইতেও দিব্যি হাত।

সুতরাং হয়ে গেল বিয়ে। দীপারানি বিয়ে করে চলে এল রতন ঘোষের গোয়ালে। বউভাত আর হয়নি। কারণ রতনের নিজের আত্মীয়স্বজন বলতে ওই গরু মোষগুলো ছাড়া আর কেউ-ই নেই। তাই বউভাতের দিন সকালে রতন তার সাধের গরু-মোষগুলোকে স্পেশাল খাওয়াদাওয়া করিয়েছিল। তার মধ্যে দু-পিস করে সন্দেশও ছিল।

দীপা বেশ অবাক হয়েছিল গরুকে নিজের বিয়ের নেমন্তন্ন খাওয়াতে দেখে। তবু দীপা ভেবেছিল ওগুলো ওর প্রিয় তাই হয়তো...যাই হোক, একটা মানুষ হতেই পারে...কিন্তু পরদিন সকালবেলায় দীপা যা নিজের চোখে দেখেছিল তাই দেখে মাথায় হাত! রতন ওর প্রত্যেকটা গরু-মোষকে নিজে হাতে টুথব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজায়, তা-ও আবার কোলগেট দিয়ে।

আর থাকতে পারেনি দীপা। বলেই ফেলেছিল, ওগো করো কী! গরু মোষকে কেউ দাঁত মাজায়?

আমি মাজাই। নইলে ব্যাটাদের মুখে খুব গন্ধ হয় কিংবা দাঁতে পোকাও হতে পারে।

তাই বলে গরুকে দাঁত মাজায় কেউ! বাপের জন্মে দেখা তো দূরের কথা, শুনিওনি।

কেন গরু বলে কি...। কথা থামিয়ে নিজের বড় বড় হলুদ দাঁতগুলো বার করে হেসেছিল রতন। আর দীপারানি সেদিনই বুঝে গেছিল রতনের এই গো-প্রীতি যে-সে প্রীতি নয়।

শুরু হল সংসার। দিন যায়, দীপার কাজ বাড়ে। এতগুলো গরু-বাছুর কার হাতে সঁপে দিয়ে যাবে তাই ভেবে কোথাও বেড়াতে যাওয়াও হয় না। মানিয়ে নিচ্ছিল দীপারানি। যাকগে, মানুষটা ভালো, এইটুকুই যথেষ্ট। তবে সারাদিন শুধু গরু আর গরু। উঠতে গরু, বসতে গরু, ঘুমিয়ে যেসব স্বপ্ন দেখে তাতেও গরু। আর ভোর থেকে রাত পর্যন্ত গরুর পিছনে গরুখাটা খেটে রাত্রে দুইজনে যেটুকু গল্পগাছা তাতেও গরু। কোন গরু দুধ কম দিচ্ছে, কোন মোষ বেশি চালাক হয়ে উঠছে। কোন বাছুরের কৃমি হয়েছে ইত্যাদি নানা বিষয়ে আলোচনা।

দীপার একেক সময়ে রাগ হত। ঝগড়াও করে ফেলত। তারপর রতনের সঙ্গে থাকতে থাকতে ও-ও একসময়ে মায়ায় পড়ে গেল গরুগুলোর। মানুষের সঙ্গে থাকতে থাকতে গরুরা অনেকটাই মানুষদের মতো হয়ে ওঠে আর মানুষরা...সে যাক গে।

দীপা আর রতনের ছেলেমেয়ে বলতে ওই বাছুররাই। সকাল হতেই হইহই লেগে যায় রতনের গোয়ালে। খদ্দেররা ভিড় করে আসে দুধ নিতে। একের-পর-এক গরুর দুধ দুইতে থাকে রতন।

রতনের যে-দুটো মোরগ আছে তার মধ্যে চেহারা বড়সড় যেটা স্বভাবে মহা বজ্জাত। সারাদিন রাজার স্টাইলে এমনভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে পা ফেলে ঘুরতে থাকে যেন পুরো এলাকাটাই ওর। এবং সবাই ঠিকঠাক কাজ করছে কি না সেটা দেখতে বেরিয়েছে। সে পর্যন্তও ঠিক আছে, কিন্তু সমস্যা হল, ব্যাটা মহা শয়তান গোছের। তার বিভিন্নরকমের শয়তানির মধ্যে দুটো শয়তানি সবথেকে মারাত্মক।

প্রথমটা আগে বলি। রতন রাত্রে ঘুমোয় এই সাড়ে বারোটা নাগাদ। ওঠে ভোর পাঁচটায়। কিন্তু রোজ ভোর সাড়ে তিনটের সময় জানলার সামনে সে ব্যাটা মোরগ এমন বিটকেলভাবে ডাকাডাকি শুরু করে যে রতনের ঘুম ভেঙে যায়। ধমক দিলেও শোনে না। উঠে ব্যাটাকে তাড়া লাগিয়ে আবার এসে শুলে আবার কিছুক্ষণ পর ডাকতে শুরু করে। ভাবখানা এই, কী রে, আমি উঠে পড়েছি আর তোরা উঠবিনি এখনও! ওঠ শিগগির। ওই চিল্লানির জন্যই রতনকে বাধ্য হয়ে উঠে পড়তে হয়।

আর দ্বিতীয়টা আরও সাঙ্ঘাতিক। রতন যখন কোনও গরুর দুধ দুইতে বসে তখন মোরগটা গরুর পিছনে চুপি চুপি এসে আচমকা এমন কোঁকর কোঁওওও করে হাঁক পাড়ে যে গরু চমকে লাফিয়ে ওঠে। মাঝে-মাঝেই এমনটা করে শয়তানটা।

কিন্তু আজ সকালে যা হল আর ধৈর্য রাখতে পারল না রতন। ঘটনা হচ্ছে, সকালে রোজের মতো দুধ দুইছিল ও। লাল রঙের গরু। নাম লালি। স্বভাবে খুব শান্ত, দোওয়ানোর সময় একটুকু পা-লেজ নাড়ায় না। আপনমনে জাবনা খেতে থাকে। আর দুধও দেয় অনেকটা করে। রতনের খুব প্রিয় গরু লালি। শান্ত বলে দুধ দোয়ানোর সময় ওর পিছনের দুই পাও দড়ি দিয়ে বাঁধতে হয় না।

কিন্তু আজ এই প্রথমবার চরম অঘটন ঘটল। দিনে দিনে মোরগটা এতই সাহসী আর শয়তান হয়ে উঠেছে যে আজ লালিকে দোওয়ানোর সময় কখন যেন টুকটুক করে এসে পিছনে দাঁড়িয়ে আচমকা এত জোরে কোঁকর কোঁওওওওও করে ডাক দিল যে শান্ত লালি বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে তিড়িং করে লাফিয়ে উঠল আর তার পায়ের ঠোক্করে আট সের দুধসমেত পুরো বালতি উলটে মাটিতে। গোয়ালের মেঝে সাদা।

রতন এইসান রাগল যে ওই বালতি ছুড়ে মারল মোরগের দিকে। সে বালতি মোরগটার গায়ে লাগল না, সটান লাগল গিয়ে দুধ নিতে আসা এক খরিদ্দারের হাঁটুতে। কেটে রক্তারক্তি ব্যাপার। হুলুস্থুল কাণ্ড। আর মোরগটা উড়ে টালির চালায় উঠে ঘাড় বেঁকিয়ে মজা দেখতে থাকল।

অনেক গালিগালাজ, মোরগের চোদ্দো পুরুষের নাম উদ্ধার করেও শান্তি হল না রতনের। দীপা বুদ্ধি দিল এত চেঁচিয়ে লাভ নেই। এবার ওটাকে তুমি বেচে দাও।

রতন বলল, না, বেচব না। আমি নিজে হাতে শয়তানটাকে কেটে চপ-কাটলেট-চাঁপ বানিয়ে খাব। তারপর আমার শান্তি হবে।

বেশ তাই কোরো।

তবে সেই প্ল্যান বিকেলের মধ্যেই ভেস্তে গেল। হাজার হোক নিজের পোষা মোরগ নিজে হাতে কাটতে কেমন লাগবে তার থেকে বেচে দেওয়াই ভালো।

রতন নিজে লিখতে জানে না, দীপাকে দিয়ে কাগজে লেখাল 'একটি মোটা মোরগ কেটে খাওয়ার জন্য বিক্রি আছে।'

দীপা আপত্তি করেছিল, কেটে খাওয়ার জন্য লেখার কী দরকার। বিক্রি হলেই হল। খদ্দের কেনার পর কী করবে তার ব্যাপার।

না-না, তুমি বোঝো না, ওই শয়তানটাকে যে-ই পুষতে যাবে ওর জ্বালায় অস্থির হয়ে দুদিন পরেই আমাকে ফেরত দিয়ে যাবে। তাই খেয়ে ফেলাই ভালো।

আলতা দিয়ে সাদা কাগজে লেখা সেই নোটিশ বাড়ির সামনের পাঁচিলে লাগানো হল।

একদিনের মধ্যেই খদ্দের হাজির। এক চাষি। মোরগ দেখে তার ভারী পছন্দ। টাকায় রফা হওয়ার পর বলল কাল বিকেলে এসে টাকা দিয়ে মোরগ নিয়ে যাবে। রতন নিশ্চিন্ত। মোরগটা ঘাড় বেঁকিয়ে কীসব যেন বোঝার চেষ্টা করল, তবে সারাদিন রইল রতনের নাগালের বাইরে। একবারের জন্যও ডাকল না। রতনও কিছুটা অবাক।

পরদিন বিকেলে চাষি এসে দাম দিয়ে মোরগ চাইল। কিন্তু ব্যাটাকে ধরবে কে? চাষি যতবারই ধরতে যায় ফসকে পালায়। শেষে রতন যেই ডাকল, আয় বাবা, কিছু করব না, আয় আয় আমার কাছে।

এমন নরম সুরে ডাকায় মোরগটা কী বুঝল কে জানে, সুরসুর করে রতনের পায়ের সামনে এসে কুটকুট করে পায়ের পাতায় টোকা দিল। আর রতন খপ করে ওর গলাটা ধরে চাষিকে বলল, শিগগির তোমার থলে খোলো।

থলের ভেতর ব্যাটাকে ভরেই বস্তার মুখ দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলল চাষি। তারপর জিভ চেটে বলল, জমিয়ে রান্না করব। কাল কুটুম আসবে, সবাই মিলে খাব।

হ্যাঁ, সেই ভালো। টাকাগুলো গুনে পকেটে ভরে বলল রতন। চাষি তার সাইকেলের হ্যান্ডেলে বস্তা ঝুলিয়ে রওনা দিল নিজের বাড়ির দিকে।

রতন চুপচাপ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। হঠাৎই নিজের লড়ঝরে সাইকেলটা বার করে দীপাকে বলল, আমি এখুনি আসছি।

চললে কই?

ওই চাষিকে ধরতে।

কেন?

এসে বলছি। ঝরমর শব্দ করতে করতে সাইকেল চালাল রতন। যেভাবে হোক লোকটাকে ধরতেই হবে।

 

 

সন্ধে নেমে গেছে অনেকক্ষণ। দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে রয়েছে রতন। হাসি-হাসি মুখ। একমনে বলে যাচ্ছে, আর ফের যদি একদিনও দেখি তোকে এমন চেল্লাতে, তোর দুই ঠ্যাং আমি কেটে কোর্মা বানাব বলে রাখলাম।

চাষির কাছ থেকে প্রায় জোর করেই দ্বিগুণ টাকা দিয়ে ফিরিয়ে আনা মোরগটা রতনের কথায় কী বুঝল কে জানে, গলা বাড়িয়ে ডেকে উঠল, কোঁকর কোঁওওওওওওও।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন