বিনোদ ঘোষাল

আজকেও লাস্ট ট্রেন। হাওড়া স্টেশনে বাস থেকে নেমে সাবওয়ে দিয়ে দৌড়ে কোনওমতে ট্রেনটার কামরায় উঠতে পারল পুষ্কর। ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। জানুয়ারির কনকনে শীতেও সোয়েটারের ভেতর ঘেমে উঠেছে টের পেল ও। বড় বড় নিশ্বাস নিতে নিতে সিটে এসে বসল। প্রায় ফাঁকাই বলা যায় কামরাটা। তিন-চারজন মানুষ গুটিসুটি মেরে চুপ করে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে বসে রয়েছে।
ঘড়ি দেখল পুষ্কর। রাত এগোরোটা পঁয়তাল্লিশ। এই বছর জাঁকিয়ে ঠান্ডাটা পড়েছে। জানলার কাচ নামানো। কিন্তু দরজা খোলা বলে হু-হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। ভালো করে মাথায় টুপিটা টেনে নিয়ে জড়সড়ো হয়ে বসল। কামরার এদিকটায় একজন মাতাল নিজের মনে কী সব হাবিজাবি বকছে আর ঢুলছে। ওইদিকে জনা তিনচারেক বিহারি দুধওয়ালা। তারাও দিনের শেষে ঘুমের দেশে।
লিলুয়া কারশেড পার হাওয়ার পর ট্রেনটা আরও গতি নিল। মোবাইল বার করে গান শুনবে ভাবল পুষ্কর। কিন্তু এখন আবার জ্যাকেটের পকেটে ঢোকানো হাত বার করতে হবে ভেবে ইচ্ছেটাকে ভেতরেই ঢুকিয়ে রাখল। রোজ-রোজ এই অফিস থেকে রাত করে বেরোতে কার ভালো লাগে? কিন্তু ও নিরুপায়। একুশ বছরের পুষ্কর মাস ছয়েক হল বিকম পাশ করে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। অ্যাকাউন্টস অ্যাসিস্ট্যান্ট। ডালহৌসি এলাকায় স্পেয়ার পার্টস-এর গো ডাউন। বেশিরভাগই ক্যাশ টাকার লেনদেন। ক্যাশ মিলিয়ে বেরোতে রোজ রাত হয়ে যায়। উপায় নেই। লিলুয়া, বেলুড়, বালি পার হয়ে গেল। বালিতে নেমে গেল দুধওয়ালারা। শুধু মাতালটা আর পুষ্কর।
আজ যেন বেশিই ফাঁকা ট্রেনটা। রোজ এতটা থাকে না। বোধহয় ঠান্ডার জন্যই আজ সবাই আগেই বাড়ি ফিরে গেছে। সত্যি বলতে এত ফাঁকা ট্রেনে বেশ গা ছম ছম করছিল পুষ্করের। যদিও রোজ ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে ভেজানো ছোলা আর খেজুর গুড় খেয়ে পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ানো। তারপর দুশো ডন আর দুশো বৈঠক দেওয়া চেহারাটায় হাত দেওয়ার আগে যতবড় গুন্ডা-মস্তানই হোক না কেন একবার ভাববে। বাইসেপ, ট্রাইসেপ, ল্যাটিস মিলিয়ে মাসলে মাসলে আর তিল ধারণের জায়গা নেই। আর পুষ্করের সাহসও ওর চেহারার সঙ্গে মানানসই।
হিন্দমোটর ছাড়ার পর উঠে দাঁড়াল ও। কোন্নগরে নামতে হবে। স্টেশন লাগোয়া সাইকেল স্ট্যান্ড থেকে সাইকেল নিয়ে ওর বাড়ি যেতে লাগে মিনিট পাঁচেক।
হিন্দমোটর-কোন্নগরের মাঝামাঝি ট্রেনটা হঠাৎ থেমে গেল। বোধহয় সিগনাল পায়নি। মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার তো! কখন ছাড়বে? আরও পাঁচ মিনিট কাটল। অধৈর্য হয়ে উঠল পুষ্কর। সেকেন্ড ডাউন লাইন দিয়ে একটা মেল ট্রেন তীক্ষ্ণ হুইসেল দিতে দিতে ঝড়ের বেগে চলে গেল। তার পরেও ছাড়ল না ট্রেন। আজ কী হল রে বাবা! বাড়ি ফিরব কখন?
দরজার সামনে এসে বাইরে একবার উঁকি দিল পুষ্কর। চারদিকে ঘন কুয়াশা। সিগনাল দেখা যাচ্ছে না। কী করা উচিত মাথায় আসছে না। এতক্ষণে বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা ওর। মা-বাবা নিশ্চয়ই চিন্তা শুরু করেছে। পকেট থেকে মোবাইল বার করে ফোন করতে গিয়ে দেখল টাওয়ার নেই। ধেত্তেরি! এইভাবে সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয়? সিট থেকে কিট ব্যাগটা পিঠে নিয়ে আবার দরজার সামনে এল ও। ট্রেন ছাড়ার কোনও লক্ষণ নেই।
এক লাফে ট্রেন থেকে নেমে পড়ল পুষ্কর। বাপ রে বাপ যেমন ঠান্ডা তেমনই অন্ধকার। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। মোবাইলের টর্চ অন করে সামান্য আলোয় লাইন ধরে হাঁটতে শুরু করল ও। আশা করা যায় মিনিট পনেরো হাঁটলে স্টেশনে পৌঁছে যাওয়া যাবে।
পশ্চিম দিকে হিন্দমোটর ফ্যাকটরির ধু-ধু ফাঁকা জলাভূমি আর পূব দিকে লাইন দিয়ে ঝুপড়ি। এখন কুয়াশার জন্য এসব কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লাইনে বিছানো পাথরের ওপর দিয়ে হাঁটছিল পুষ্কর। পায়ের চাপে কড়কড় করে শব্দ হচ্ছিল পাথরে। মোবাইলে সময় রাত বারোটা পঁয়ত্রিশ।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ মনে হল কেউ যেন ওর পিছু নিয়েছে। পিছন ফিরল। না, কেউ নেই। আবার কিছুক্ষণ হাঁটার পর একই অনুভব। অস্পষ্ট গুমরানোর মতো কথা বলতে বলতে কারা যেন আসছে ওর পিছনে। কারা?
আবার পিছন ফিরল পুষ্কর। আর ফিরতেই গোটা শরীর ঝিন ঝিন করে উঠল মুহূর্তে। কয়েকটা মানুষ। ঘন কুয়াশার মধ্যেও ও দেখতে পেল ঝাপসা কয়েকটা মানুষের অবয়ব। পুষ্করের পিছনেই আসছে।
হাঁটার স্পিড বাড়িয়ে দিল পুষ্কর। পিছনে লোকগুলোও গতি দ্রুত হল। এরা কারা? কী চায়? নিশ্চয়ই ছিনতাইবাজ। আশপাশের ঝুপড়িগুলোতে থাকে। পুষ্করকে দেখে ধাওয়া করেছে। মানিব্যাগে তিনশো টাকা রয়েছে। হাতে ঘড়ি আর একটা মোবাইল। মোবাইলটা বেশ দামি। সবে মাসদেড়েক আগে মাইনা পেয়ে কিনেছে। ছেলেগুলোর হাতে নিশ্চয়ই ছোরা পিস্তল কিছু আছে। সুতরাং মারপিট করার রিস্ক না নেওয়াই ভালো।
পুস্কর দৌড়োতে শুরু করল। একে অন্ধকার, তার ওপর পাথর, একটু ছুটেই ও বুঝতে পারল এইভাবে খুব বেশিদূর যাওয়া যাবে না। পিছলে পড়ে যাওয়ার খুব চান্স। আর একবার পড়ে গেলেই ছেলেগুলো ধরে ফেলবে ওকে। কিন্তু উপায় নেই। যতটা সম্ভব সাবধানে মোবাইলের আলো ফেলে মাথা ঠান্ডা করে ছুটছিল পুষ্কর। ছুটতে ছুটতে আপ লাইন ছেড়ে ডাউন লাইনে উঠে পড়ল।
পিছনে না তাকিয়েও বুঝতে পারছিল, ছেলেগুলোও ফুট দশেক দূরেই দৌড়ে তাড়া করেছে ওকে। হঠাৎ উলটো দিকে পুষ্করের একেবারে সামনে একটা লোক যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল। ভয়ানক কেঁপে উঠে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল পুস্কর। হাতে ধরা মোবাইল টর্চের আলো লোকটার মুখে, গায়ের ওপর পড়ল। লোকটার মাথায় টুপি, ঠোঁটে বাঁশি আর হাতে একটা লাঠি ধরে পুষ্করের দিকে তাকিয়ে আছে। পুলিশ! লোকটার চোখ দুটো এই অন্ধকারেও বিড়ালের চোখের মতো জ্বলছে।
পুষ্কর চিৎকার করে উঠল, বাঁচান আমাকে বাঁচান।
আরও কিছু বলার আগেই আচমকা ঘন কুয়াশা ভেদ করে চোখের ওপর তীব্র আলোর ঝলকানি, ট্রেনের হুইসেল। একেবারে সামনে ট্রেনটা। পা দুটো যেন মাটি কামড়ে ধরেছে পুষ্করের। শরীর অবশ, আর পালানোর উপায় নেই।
সামনের লোকটা আচমকা এক মুহূর্তে নিজের হাতদুটো সামনে তুলে পুষ্করকে জোর ধাক্কা দিল। কোনও স্পর্শ নয়, শুধু যেন প্রচণ্ড একটা হাওয়ার দমক। সেই হাওয়ায় ছিটকে পড়ে গেল পুষ্কর। আর কিছু মনে নেই তারপর...
চোখ মেলে তাকাল পুষ্কর। মাথার পিছনে অসহ্য যন্ত্রণা। গোটা শরীরেও ব্যথা জড়িয়ে রয়েছে। আবার চোখ বন্ধ করল। গত রাত্রের ঘটনাটা ছবির মতো মনে আসতেই ওর প্রথমে মনে এল, আমি কি বেঁচে আছি?
প্রশ্নটা মাথায় আসতেই আবার চোখ খুলে ফেলল। মাথা না নাড়িয়ে চোখ ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাল। এ কোথায়? ছোট্ট খুপড়ি মতো একটা বেড়ার ঘর। টালির ছাউনি। বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোদ্দুর ঢুকছে। এখন সকাল? পুষ্করকে ঘিরে কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। এরা কারা?
এখন কেমন লাগছে? একটা লোক জিগ্যেস করল।
পুস্কর চুপ। শুধু তাকিয়ে থাকল। তার মানে বেঁচে আছে ও।
'আমার কথা শুনতে পাচ্ছ?' আবার জিগ্যেস করল লোকটা।
'আমি কোথায়?' প্রশ্ন করল পুষ্কর।
'তুমি রেল কলোনিতে।' আরেকজন উত্তর দিল।
তার মানে রেল লাইনের ধারের বস্তিতে। এবার কোনওমতে কনুইতে ভর দিয়ে উঠে বসল পুষ্কর। গলা শুকিয়ে কাঠ।
'একটু জল দেবেন আমাকে?'
একজন মহিলা সঙ্গে সঙ্গে ঘরের কোনায় রাখা কুঁজো থেকে এক গ্লাস জল এনে দিল ওকে। জলটুকু এক নিশ্বাসে খেয়ে নিয়ে যেন প্রাণ পেল ও। কাল রাতের পুরো ঘটনাটা আরেকবার সিনেমার মতো পরপর মনে পড়তেই একবার পকেটে হাত দিল নিজের। মানিব্যাগটা ঠিকই আছে, কিন্তু মোবাইলটা নেই। হাতে ঘড়ির কাচটাও ভেঙেছে। সেই সময় মোবাইল হাতে ধরা ছিল। ছিটকে কোথায় পড়েছে কে জানে!
'শরীর ঠিক লাগছে এখন?' আরেকজন জিগ্যেস করল।
'হ্যাঁ।'
'কী হয়েছিল বলুন তো? এখানে এলেন কীভাবে?'
পুষ্কর ঘরের সবার মুখের দিকে তাকাল একবার। তারপর ধীরে ধীরে গত রাতের ঘটনাটা পুরো বলল ওদের। শুনতে শুনতে লোকগুলোর চোখ মুখ থমথমে হয়ে উঠল। পুষ্করের বলা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও লোকগুলোর মুখে কোনও কথা নেই।
'আমি কিন্তু সত্যি কথাই বলছি। আমার বাড়িও কোন্নগরেই।'
'আশ্চর্য তো!' একজল লোক শুধু এই কথাটুকু বলে সবার মুখের দিকে তাকাল, 'এমন হয়?'
পুষ্কর খেয়াল করছিল সবক'টা মানুষের মুখে কেমন ভয় লেগে রয়েছে।
'আমাকে প্লিজ বলবেন কী হয়েছে? আমি মিথ্যে বলছি না।'
'আমরা জানি মিথ্যে বলছেন না। কিন্তু...'
'কী কিন্তু?'
'আসলে আজ থেকে ঠিক সাত দিন আগে আপনি যেখেনে পড়েছিলেন সেই খানটায় একটা সাংঘাতিক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল। একটা মালগাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল আপ লাইনে। কয়েকটা ওয়াগান ব্রেকার মাল চুরি করতে এসেছিল। টের পেয়ে সুখরাম ওদেরকে একাই তাড়া করে।'
'সুখরাম! সে কে?'
'সুখরামজি জি আর পি-র হাবিলদার ছিল। খুব সৎ মানুষ। এখানে যখন ডিউটি পড়ত আমাদের কাছে মাঝেমধ্যেই আসত। সবাই চিনতাম আমরা। খুবই সাহস ছিল মানুষটার। পরের উপকার করতে আর গুন্ডাদের শায়েস্তা করতে ওর জুড়ি ছিল না। এর আগে অনেক ওয়াগন ব্রেকার ধরেছে ও। সেই সব গল্প আমরা ওর মুখেই শুনেছি। তো সেদিনও গুন্ডাগুলোকে তাড়া করেছিল, কিন্তু কপাল ছিল খারাপ। এমনই ঘন কুয়াশা ছিল যে ট্রেনের আলো পর্যন্ত বুঝতে পারেনি কেউ। ছ'টা গুন্ডা আর সুখরামজি সবাই ট্রেনের তলায় কাটা পড়ে যায়। তারপর থেকে...'
আর কিছু কানে ঢুকছিল না পুষ্করের। শুধু একটা কথাই বারবার মনে পড়ছিল, সেই ধাক্কাটা। এক দমক হাওয়ার ধাক্কায় কাল যদি লাইনের পাশে ছিটকে না পড়ত তাহলে? কীসের ধাক্কা ছিল ওটা?

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন