বিনোদ ঘোষাল

সারাদিন খুব আনন্দ হয়েছে। সকালে এতবড় পুকুরে চান করেছে টুবলু। বিন্তির সঙ্গে। তারপর পেয়ারা গাছে উঠেছে। জালে করে বড় বড় রুই-কাতলা মাছ ধরা দেখেছে। বিশাল বড় ধানখেত দেখেছে। ভাঙা মন্দির দেখেছে। এত বড় মাঠ জীবনেও দেখেনি টুবলু। কী করে দেখবে। এর আগে তো কোনওদিন গ্রাম দেখেনি ও। এই প্রথম আসা। কলকাতার বেহালায় এত বড় মাঠই বা কোথায় আর পুকুরই বা কোথায়? ক্লাস সিক্সে এই প্রথম গ্রাম দেখল টুবলু। তাও আবার এত সুন্দর গ্রাম। নামটাও খুব সুন্দর—অবন্তিপুর। হাওড়া স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে অনেকক্ষণ যেতে হয়। তারপর বর্ধমান স্টেশনে নেমে বাসে করে আরও অনেকক্ষণ। এর বেশি ঠিকানা টুবলুর জানা নেই। ওর বাবা-মা জানে। অত জানার দরকারই বা কী ওর? একা তো আর আসবে না।
ব্যাপার হল এই, টুবলুর বাবার কলেজ জীবনের বন্ধু অসীমকাকুর বোনের আজ বিয়ে। বাবার কাছে অসীমকাকুর অনেক গল্প শুনেছে টুবলু। দুজনে একেবারে মানিকজোড় বন্ধু ছিল কলেজে পড়ার সময়। একই মেসে থেকে কলকাতার কলেজে পড়াশোনা করেছে দুজন। তারপর কলেজ পাশ করে বাবা পেয়ে গেল রেলে চাকরি, আর অসীমকাকু ফিরে গেল নিজের গ্রামে জমিজিরেত দেখাশোনা করার জন্য।
তারপরেও যোগাযোগ ছিল। অসীমকাকু বেশ কয়েকবার কলকাতায় কাজে এসে টুবলুদের বাড়িতে দেখা করে গেছে, কিন্তু ওদের আর যাওয়া হয়নি। গত মাসে অসীমকাকু আবার এসেছিল। সঙ্গে ছোট বোনের বিয়ের নেমন্তন্ন কার্ড। এসে টুবলুর বাবা তন্ময়কে তুমুল ধমকে গেছে, 'এবার যদি সপরিবার না যাস তবে চিরদিনের জন্য বন্ধুত্বে ইতি।'
এবার আর তাই এড়াতে পারেনি তন্ময়। অফিসে দু-দিনের ছুটি নিয়ে বিয়ের দিন সকালে টুবলু আর টুবলুর মাকে নিয়ে সটান হাজির।
অসীমকাকু ওদের দেখে এত আনন্দ পেয়েছিল যে বাবাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছিল। তাই দেখে টুবলুরও চোখে জল এসে গেছিল। এত বড়রাও বন্ধুকে জড়িয়ে কাঁদে!
যাই হোক তারপর সারাদিন আনন্দ আর আনন্দ। অসীমকাকুর মেয়ে বিন্তি টুবলুরই বয়েসি। খুব ঝলমলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল দুজনের মধ্যে। ওর সঙ্গেই সারাদিন গ্রাম ঘুরে দেখল টুবলু। মাটির বাড়ি, ধানখেত, ধানের মড়াই, গোয়াল, তারপর মুড়ি বানানো, ধান সেদ্ধ করা—অনেক কিছু। যত দেখছিল ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিল ও। গ্রামে যে এত কিছু দেখার আছে ভাবতেও পারেনি। কতরকমের গাছ। সব নাম জানা বিন্তির। অবাক হয়ে টুবলু একসময় বলেই ফেলল বিন্তিকে,—সত্যি অনেক কিছু দেখলাম।
সেই শুনে বিন্তি হঠাৎ ফিক করে হেসে বলল,—আসল জিনিসটাই তো তোমার এখনও দেখা হয়নি।
—কী জিনিস? দেখাও।
—রাত্রে দেখতে পাবে। আর আমাকে দেখাতে হবে না। তিনি নিজেই দেখা দেবেন। গম্ভীর হয়ে বলেছিল বিন্তি।
—কে গো?
—ভূত।
—ধুৎ।
—সত্যি! কেন তুমি ভূত বিশ্বাস করো না?
—উম...ম করি তো। তবে ভূত কী করে দেখব?
—দেখবে দাঁড়াও না। রাত্তির হোক।
—কোথায় দেখব? উত্তেজনায় ঢোঁক গিলে বিন্তিকে জিগ্যেস করেছিল টুবলু।
—আমাদের বাড়িতেই দেখতে পাবে।
—বিয়েবাড়িতে! এত লোকের মধ্যে ভূত আসে নাকি কখনও? যাহ!
—আসে। মিত্তিরদাদু একমাত্র ভোজবাড়িতেই আসে।
—মিত্তিরদাদু আবার কে?
—অতসব বলতে পারব না এখন। নিজেই দেখে নিও।
তারপর সেই দুপুরের পর থেকে বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, চাপা উত্তেজনায় দম যেন আটকে আসছে টুবলুর। কোনও কিছুতেই মন নেই। কখন মিত্তিরদাদু নামের ভূত আসবে সেই টেনশনে অস্থির ও। একই সঙ্গে স্বচক্ষে ভূত দেখার এক্সপিরিয়েন্স। উফফ...!
সানাই বাজছে, লোকজন আসতে শুরু করেছে, বরও এসে গেল একটু আগে। কিন্তু মিত্তিরদাদু কই? বিন্তিকে বেশ কয়েকবার জিগ্যেস করা হয়ে গেছে টুবলুর। বিন্তি খুব গম্ভীর হয়ে ভুরু কুঁচকে উত্তর দিয়েছে,—তেনার সময় হলেই ঠিক আসবে। ভিড়টা একটু হালকা হোক। কয়েক ব্যাচ লোকে খেয়ে নিক, ঠিক আসবেই। বাবা নিজে নেমন্তন্ন কার্ড দিয়ে এসেছে।
—ভূতকে নেমন্তন্ন কার্ড দিয়ে এসেছে! যাহ, তাই হয় নাকি!
—কেন হবে না? ভূত বলে কি মানইজ্জত নেই নাকি? নেমন্তন্ন না করলে আসবে কেন?
এমন কথায় দমে গেছে টুবলু। হবে হয়তো। গ্রামের ব্যাপার-স্যাপার তো একটু অন্যরকমই হবে। নয়তো এতদিন ধরে ভূতের সিনেমায়, গল্পে যা দেখে এসেছে ও, তাতে ভূতকে নেমন্তন্ন না করলেও এমনিই সে আসে।
প্রায় রাত্তির এগোরোটা নাগাদ হঠাৎ শোনা গেল মিত্তিরমশাই আসছেন। বড়দের মধ্যে কেউ কেউ ভাঁড়ারে খোঁজ নিতে গেল মিত্তিরমশায়ের জন্য মিনিমাম একশো পিস মাছ, কেজি পাঁচেক পাঁঠার মাংস, দুশো লুচি আর একশোটা রসগোল্লা যে আলাদা করে রাখা ছিল, সেটা ঠিক আছে তো? কেউ আবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছে মিত্তিরমশায়ের খেতে বসার জায়গা ঠিক করতে। হইহই ব্যাপার। অসীমকাকু খুব ব্যস্ত। টুবলুর বাবা জিগ্যেস করল,—এতরাত্রে কে মিত্তিরমশাই এসেছে রে?
—পরে বলব, তুই টুবলুকে নিয়ে আয়। বলে অসীমকাকু চলে গেল।
বিন্তির কাছ থেকে মিত্তিরমশাই সম্পর্কে যে অনেকটাই তথ্য টুবলু জেনে নিয়েছে, সেটা আর ও বলল না। বাবার গায়ের সঙ্গে সেঁটে পায়ে পায়ে চলল টুবলু।
বাড়ির উঠোনের মাঝখানে ছাদনাতলার ঠিক পাশেই বেশ বড়সড় একটা হাতলওয়ালা চেয়ার পাতা হয়েছে। আর মাটিতে বড় একটা শতরঞ্চি পেতে তার ওপর দুই ঝুড়ি লুচি, পেল্লায় এক গামলা মাংস, তিন থালা মাছভাজা আর কয়েক হাঁড়ি রসগোল্লা সাজিয়ে রাখা হল। একজন লোক আবার একটা হাতপাখা নিয়ে চেয়ারের পিছনে এসে দাঁড়াল। টুবলু একই সঙ্গে অবাক এবং ভয়ে অস্থির। ভয়টা ভূতের, আর অবাক এই ভেবে যে, ভূত আসবে জানে, কিন্তু বাড়ির লোকগুলো এত খাবার সাজাচ্ছে, আবার পাখা দিয়ে হাওয়া করারও ব্যবস্থা করছে—এ আবার কেমন ভূত? নাহ ভূতের যা যা লক্ষণ তার সঙ্গে মিলছে না তো।
বাড়ির সবাই ভিড় করে দাঁড়িয়েছে ওই চেয়ারটাকে ঘিরে। অসীমকাকু বাড়ির মেন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মিত্তিরমশাইকে নিয়ে আসবে বলে। ভিড়ের মধ্যে বিন্তিকেও দেখতে পেল টুবলু। মায়ের শাড়ির আঁচল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। একবার চোখাচুখি হল দুজনের। তক্ষুনি গেটের সামনে থেকে শোনা গেল 'হুম না' 'হুম না' করে একটা পালকি এসে দাঁড়াল। জীবনে এই প্রথম পালকি দেখল টুবলু। তবে ছবিতে যেমন রংচঙে পালকি দেখেছে এতদিন, এটা তেমন নয়। নেহাতই ছোট্ট আর রংহীন কাঠের। চারজন বেহারা পালকিটা মাটিতে নামাল।
—আসুন আসুন মিত্তিরমশাই। বলে সামনে প্রায় ঝুঁকে পড়ল অসীমকাকু। ভূত এসেছে পালকি চেপে! বেহারাগুলোও তাহলে ভূত নাকি? নাহ, দিব্বি কপালের, ঘাড়ের ঘাম মুছছে তো গামছা দিয়ে। ভূতেরা আবার ঘামে নাকি?
টেনশন একেবারে গলার কাছে চলে এসেছে টুবলুর, ঠিক তখনই নাগরা পরা দুটো পা বেরলো পালকির ভেতর থেকে। তারপর একটা সাদা চুলওয়ালা লোক। অসীমকাকু আর কয়েকজন মিলে ধরে দাঁড় করাল তাকে। টুবুলু হাঁ করে দেখল একটা থুত্থুড়ে বুড়ো। সাদা পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে। হাতে ছড়ি। প্রায় ছ'ফুটের ওপর লম্বা। অসীমকাকু তাঁকে ধরে ধরে নিয়ে এল। সেই চেয়ারটায় বসাল। বুড়ো লোকটা চারদিকে মিটিমিটি তাকিয়ে হাসছে শুধু। অসীমকাকুর বোন এবং আরও অনেকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। দাদুটা ঘড়ঘড়ে গলায় কী যেন একটা জিগ্যেস করল শুনতে পেল না টুবলু, তবে অসীমকাকু উত্তর দিল,—হ্যাঁ কত্তাবাবু সবাই ভালো আছি। সবকিছু আপনার আশীর্বাদে।
দাদুটা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। এ ভূত হতেই পারে না। বিন্তি নিশ্চয়ই মিথ্যে কথা বলেছে। তবে লোকটা খুব বুড়ো। কত বয়েস হবে কে জানে। কে এ?
এবারে লোকটা তাকাল সামনে রাখা খাবারগুলোর দিকে। খুব মনোযোগ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ দেখল। মাথা নাড়ল অল্প অল্প। মনে হল বেশ খুশি হয়েছে। তারপর লুচির ধামার দিকে নিজের ছড়িটা বাড়িয়ে দিল। অসীমকাকু সঙ্গে সঙ্গে একটা লুচি সামনে তুলে ধরল। লুচিটা বেশ খুঁটিয়ে দেখলেন মিত্তিরমশাই।
—ব্রজঠাকুর রান্না করেছে মিত্তিরমশাই। আপনার প্রিয় ঠাকুর।
শুনে আবার মাথা নাড়ল দাদু।
এবার বেশ মজা লাগছে টুবলুর। লোকটা কিছুই খাচ্ছে না। কিন্তু সব খাবারগুলো খুব খুঁটিয়ে দেখছে।
আবার কী যেন বলল, সেই শুনে অসীমকাকু উত্তর দিল,—হ্যাঁ মিত্তিরমশাই, বরযাত্রী রওনা হয়ে গেছে। তরুণবাবু ঠিক আছেন। কিছু চিন্তা করবেন না। সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে।
শুনে যেন স্বস্তি পেল দাদু। আবার মাথা নাড়ল। তারপর নিজের দুটো হাত তুলে ধরল খানিকটা। সঙ্গে সঙ্গে অসীমকাকু সমেত আরও দুজন ধরে দাঁড় করাল তাকে। আবার এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকল পালকির দিকে।
পালকিতে চেপে একইভাবে চলে গেলেন মিত্তিরমশাই।
লাস্ট ব্যাচে বাড়ির সবাই খেতে বসেছে। অসীমকাকু বসেছে টুবলুর বাবার পাশে। তার পাশে টুবলু।
তন্ময়ই জিগ্যেস করল,—অসীম ভদ্রলোক কে রে? অনেক বয়েস তো।
—হুঁ ছিয়ানব্বই তো বটেই। লুচি মুখে পুরে বলল অসীম।
—কে উনি?
—আমাদের গ্রামের জমিদার। এখন অবশ্য আর জমিদারি নেই। কিছুই নেই আর। বড় ভালো মানুষ ছিলেন এই মিত্তিরমশাই। দান-ধ্যান, স্বভাবচরিত্রও অত্যন্ত ভালো। আর খেতে ভালোবাসতেন খুব। গ্রামে কারও বাড়ি ভোজ হলে চলে আসতেন। পেট পুরে খেতেন। এমন জমিদার দেখা যায় না—প্রজাদের বাড়িতে সবার সঙ্গে একই পংক্তিতে বসে খাচ্ছেন। আমরা ছোটবেলায় নিজের চোখে দেখেছি। আর খেতেনও তেমনই। ধামা ধামা লুচি, কেজি কেজি মাংস নিমেষে সাফ করে দিতেন। গরিব বাড়িতে অনুষ্ঠানের ভোজ থাকলেও নিজে টাকা পাঠাতেন যাতে খাওয়াদাওয়া কোনওভাবেই কম না পড়ে।
কিন্তু এত ভালো মানুষটার কপাল পুড়ল নিজেরই একমাত্র ছেলে তরুণের বিয়ের দিন। গোটা গ্রামের নেমন্তন্ন ছিল সেদিন। সন্ধেবেলা বরযাত্রী সবে রওনা দেবে, ঠিক তখনই হার্ট ফেল করে মারা যায় ছেলেটা। তারপর থেকেই কেমন যেন হয়ে যান মিত্তিরমশাই। আর কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। ওর স্ত্রী-ও মারা গেছেন অনেকদিন হল। একাই থাকেন। দু-চারজন চাকর রয়েছে, ওরাই দেখাশোনা করে। আর গাঁয়ের মানুষরাও যতটা সম্ভব খোঁজখবর নেয়।
সব থেকে কষ্টের কি জানিস, গ্রামে কারও বাড়ি বিয়ে লাগলে উনি আসবেনই। ভাবেন ওর ছেলেরই বিয়ে হচ্ছে। পাগল মানুষ তো। বড় কষ্ট লাগে। খাবারের সব মেনু উনি খুঁটিয়ে দেখেন। দেখেন খাবার যেন কম না পড়ে একটুও। তবে নিজে আর কিছু খান না। শুধু দেখেন আর তরুণ বরযাত্রীসমেত ঠিকমতো পৌঁছেছে কি না সেই খবর নেন। বলে থামল অসীমকাকু।
টুবলু হাঁ করে এতক্ষণ শুনল গল্পটা। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মিত্তিরদাদুর জন্য। তাকিয়ে দেখল উলটোদিকের টেবিলে খেতে বসা বিন্তিরও দু-চোখে জল টলটল করছে। বড় হলে বিন্তির যখন বিয়ে হবে টুবলুর যখন বিয়ে হবে, সেদিনও মিত্তিরমশাইকে নেমন্তন্ন করবে ওরা, সেটাই ভাবছিল দুজনে নিজেদের মতো করে।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন