বিনোদ ঘোষাল

এত সস্তায় বাড়িটা পেয়ে যাবেন ভাবতেই পারেনি অভয়। অভয়চরণ সরকার। বয়স বেয়াল্লিশ। বুকের ছাতি ছেচল্লিশ। বাইসেপ, ট্রাইসেপ, ল্যাটিস-প্যাটিস মিলিয়ে আরও গোটা পঞ্চাশ ইঞ্চি হবে। ক্যালকাটা ট্রাম কোম্পানিতে চাকরি করে। এমন একটা ভীমসেনী চেহারার কারণ অভয়চরণ সরকার একজন রাজ্যস্তরের ব্যায়ামবীর। একটা রুপো, দুটো ব্রোঞ্জের মেডেল ছাড়াও বেশ কিছু সার্টিফিকেট আর শিল্ড অভয়ের ঝুলিতে ঢুকেছে। চাকরিটাও সেই সূত্রে পাওয়া।
শীত নেই, বর্ষা নেই সারা বছর ভোর চারটেয় ঘুম থেকে উঠে পড়ে অভয়। তারপর জলে ভেজানো হাফ সের ছোলা খেয়ে কেডস, ট্রাকস্যুট পরে বেরিয়ে পাক্কা পাঁচ কিলোমিটার দৌড়ায়। দৌড়ের পর দুশো ডন দুশো বৈঠক তিনশো সিট আপ। ডামবেল, বারবেল মিলিয়ে সে এক এলাহি কাণ্ড। বজরংবলীর একনিষ্ঠ ভক্ত অভয় বিয়ে-থা করেনি। ডন-বৈঠকই তার বন্ধু কাম গৃহিণী।
দেশের বাড়ি ছিল সমুদ্রগড়। ওখান থেকেই রোজ কলকাতায় অফিসে ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করত। তারপর বাবা-মা মারা যাওয়ার পর পৈতৃকভিটে বিক্রি করে দিয়ে হাওড়া শিবপুরে একটি বাড়ির দোতলায় ভাড়া চলে আসে। বাড়িওয়ালা একতলায় থাকতেন। বদ্ধ কালা। ওনার স্ত্রী-ও কানে কম শুনতেন। ওনাদের একমাত্র ছেলে ব্যাঙ্গালোরে চাকরি করত।
দীর্ঘ সাত বছর ধরে ভাড়াটে-বাড়িওয়ালা মিলে সব ঠিকই ছিল। হঠাৎ বিপদ। বাড়িওয়ালার ছেলে ট্রান্সফার পেয়ে কলকাতায় নিজের বাড়িতে চলে এল। আর আসার কয়েকদিনের মধ্যেই অভয়ের সঙ্গে লেগে গেল ঝগড়া। ঠিক ঝগড়া নয়, কারণ প্রথমত অভয়ের বড়ই মাথা ঠান্ডা। প্রায় কখনই রাগে না। তার গুরু শিখিয়েছিলেন বলবান পুরুষদের কখনও মাথা গরম করতে নেই তাহলে বলহীন পুরুষদের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। আর দ্বিতীয়ত অভয়ের ছেচল্লিশ ইঞ্চি ছাতির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ রাঙিয়ে আঙুল তুলে কথা বলার মতো লোক বঙ্গভূমে বড়ই কম আছে। তাই ঝগড়া নয়, বলা যায় কাতর হুমকি।
রোজ ভোর সারে চারটে থেকে দোতলার ঘরে ডামবেল, বারবেলের ঢং ঢাং এবং হেঁইও হাঁইও শব্দে আধা পাগল হয়ে বাড়িওয়ালার ছেলে হাতজোড় করে অভয়কে বললেন, মাননীয় অভয়বাবু, আপনি অনুগ্রহ করে আগামী সাতদিনের মধ্যে এই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র ব্যবস্থা দেখুন অন্যথায় আমি যদি পাগল হয়ে যাই, পুলিশে আপনাকে ধরবে। এমনটা রোজ চলতে থাকলে আমি আর খুব বেশি হলে আট দিন তার পরেই ফুল পাগল হয়ে যাব। আর আমার মৃত্যু...ইয়ে পাগলত্বের জন্য আপনি দায়ী থাকবেন।
শুনে অভয় খুব গম্ভীর হয়ে বলেছিল কিন্তু আমি এতদিন ধরে এই বাড়িতে রয়েছি, কই আপনার বাবা-মা তো কোনওদিন...।
—আজ্ঞে, কেউই কানে শুনতে পান না বলে এখনও পৃথিবীতে রয়েছেন নইলে কবে ভবের মায়া ত্যাগ করে পালাতেন দুইজনে।
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে হুম দেখছি বলে নিজের ঘরে ঢুকে গেছিল অভয়। সমস্যা গুরুতর। এই বাজারে এত সস্তায় ঘর পাওয়া বেশ কঠিন। কিন্তু তাই বলে ব্যায়াম ছাড়ার কোনও প্রশ্নই নেই। তার থেকে ঘর ছাড়া ভালো। জোর করে থাকাই যায়। কিন্তু আত্মসম্মানের তো একটা ব্যাপার রয়েছে।
এই দোলাচলে দু'দিন কাটিয়ে তিনদিনের থেকে হা রে রে রে বলে ঘর খুঁজতে লেগে পড়ল অভয়। কিন্তু অতই কি সোজা? চেষ্টায় ভগবানের বর যদিও বা পাওয়া যায় কিন্তু মানুষের ঘর পাওয়া বেজায় কঠিন। পাঁচ দিনের দিন প্রায় আশাই ছেড়ে দিচ্ছিল। বাড়িতে বেচারা বাড়িওয়ালার ছেলেটার মুখের দিকে তাকানো যায় না। চোখের তলায় এক ইঞ্চি করে কালো গর্ত। কাতর দৃষ্টি। নাহ, বড় মায়া লাগে আর নিজেকে অপরাধী মনে হয়। সাত দিনের মধ্যে ঘর না পেলে ডামবেল, বারবেল নিয়ে গাছতলায় গিয়ে বাসা বাঁধবে, কিন্তু হনুমানজির চ্যালা হয়ে দেওয়া কথার খেলাপ করতে পারবে না।
ছয় দিনের দিন ঘরের যে কয়েকটা জিনিস ছিল সবক'টাকে বাঁধা ছাদা করে বাড়ি ছেড়ে সামনের গাছতলায় চলে যাবে বলে প্রস্তুত অভয়চরণ এমন সময় অফিসের পিওন হনুমানপ্রসাদ সিং বজরংবলীর অবতার হয়ে এসে ত্রান করল অভয়কে।
আপ তো মকান ঢুনতে হে বাবু। একঠো মকান মেরে তলাশ মে হ্যায়। খইনি ডলতে ডলতে বলেছিল হনুমান।
বলো কি হনুমান। কোথায়? মুসড়ে পড়া অভয় ফের জেগে উঠেছিল।
জি হাঁ। এহি জাহাঁ হামরা ঘর হ্যায়। উত্তরপাড়া মে।
বা-বা-বা-বা, একটু দয়া করো বাবা হনুমান। ঘরটা যাতে আমি পাই তার একটু ব্যবস্থা করে দাও ভাই।
ঠিক হ্যায় বাবু। হো যায়গা। আপ চিন্তা মত কিজিয়ে।
জিটি রোডে গঙ্গার ধারে দোতলা একটা পুরোনো বাড়ি। বহুদিন ধরে এই বাড়িতে কেউ আসে না বোঝাই যায়। বাড়ির মালিক উত্তরপাড়াতেই অন্যত্র থাকেন। নাম অঘোর মিত্র।
হনুমানের সঙ্গে অঘোরবাবুর কাছে গিয়ে কথা ফাইনাল করে ফেলল অভয়। পুরো বাড়ির ভাড়া মোটে চারশো টাকা। কোনও অ্যাডভান্স লাগবে না।
অঘোরবাবু বললেন, আগে থাকুন কিছুদিন তারপর অ্যাডভান্স নেওয়া যাবে'খন। এ যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। অবশ্য অভয় একতলাটা ব্যবহার করবে না বলেই দিল। কারণ, একতলার ঘরগুলোর অবস্থা খুবই খারাপ আর অতগুলো ঘর তার প্রয়োজনও নেই।
বাড়িওয়ালা আজকেই লোক লাগিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করিয়ে রাখবেন বলে দিলেন। আগামী কালই অভয় চলে আসতে পারেন। কথা ফাইনাল হয়ে যাওয়ার পর নেহাতই কৌতূহলে অভয় অঘোরবাবুকে জিগ্যেস করে ফেললেন এত বড় বাড়িটা এতদিন ফাঁকা ফেলে রেখেছেন?
অনেক আগে ভাড়ায় দিতাম। তারপর কিছু ঝামেলা হওয়ার পর থেকে আর দিই না। শরিকি সমস্যা রয়েছে বলে বিক্রিও করতে পারি না।
ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি এমনি জিগ্যেস করছিলাম। বলে নমস্কার জানিয়ে উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন অভয়। তখনই হঠাৎ বাড়িওয়ালা বললেন, আপনি তো শরীর চর্চাটর্চা করেন। তার মানে মনে ভয়ডরও বিশেষ নেই মনে হয়, তাই না?
ভয়! কীসের ভয়?
বিশেষ কারও নয়, এই মানে ভূতটুতের ভয় আর কি। আসলে অনেকদিনের পুরোনো বাড়ি। তারপর আবার একা একা থাকবেন তাই মনে হল।
ওহ, আচ্ছা। ভয় আমার চিরকালই বড্ড কম। আর ভূতে তো নয়ই। বলে গোঁফজোড়ায় সামান্য হাত বুলিয়ে দারুণ আনন্দে বাড়ি ফিরে এল। অনেক কাজ পড়ে রয়েছে।
২
পূব দিকের জানলা দিয়ে গঙ্গার হাওয়া। ইলেক্টিক ফ্যান চালানোর আর দরকার নেই। আহা এমন একটা ঘর প্রায় বিনে পয়সায় পাওয়া মানে হাতে লটারি পাওয়া। নতুন বাড়ির দোতলায় খাটের ওপর টানটান শুয়ে ভাবছিল অভয়চরণ। ঘড়িতে রাত সোয়া ন'টা। আজ সারাদিন খুব ধকল গেছে। ওই বাড়ি থেকে জিনিসপত্র এনে এই বাড়িতে সাজানো। সারাদিন লেগে গেল সাজানো-গোছানোর কাজে।
ঘরটাকে বাড়িওয়ালা লোক লাগিয়ে সাফাই করিয়েছেন ঠিকই তবে ঘরের জানলা-দরজা, দেওয়ালের পলেস্তারার অবস্থা বেশ খারাপ। সময় করে নিজেকেই ঠিক করে নিতে হবে। ভাবতে ভাবতে ঘুম এসে যাচ্ছিল অভয়ের। নাহ, কিছু খেয়ে নিয়ে তারপর জমিয়ে ঘুম দিতে হবে বলে দোকান থেকে কেনা বারোটা আটার রুটি আর এক হাঁড়ি মাংস গপাগপ সাঁটিয়ে একঘটি জল খেয়ে লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল অভয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই নাক ডাকার শব্দ।
রাত তখন কত হবে কে জানে, হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল অভয়ের। দরজায় শব্দ হচ্ছে। প্রথমে ভাবল ভুল শুনছে। কিন্তু না, ঘরের বাইরে দরজায় স্পষ্ট শব্দ হচ্ছে। কান খাড়া করে শুনল অভয়। ঠক ঠক শব্দ নয়, কেউ যেন দরজায় আঁচড়াচ্ছে। ক্রমাগত শব্দটা বাড়তেই থাকল। সঙ্গে চাপা গর্জন। কুকুরের। দোতলায় উঠল কী করে? নীচের দরজা তো আটকানো।...বোধ হয় কোনওভাবে খুলে গেছে। বিছানায় শুয়েই অভয় পেল্লায় হাঁক পাড়লেন অ্যায়...যাহ...হুশশ।
কয়েক সেকেন্ডের জন্য শব্দটা থামল। তারপর আবার। আগের থেকেও বেশি। দরজা যেন ভেঙে ফেলবে এমন ধাক্কা। সঙ্গে গর্জন। অভয় তড়াক করে উঠল বিছানা ছেড়ে। সুইবোর্ডটা কোথায় গেল। কোথায়...? ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেওয়ালে হাতড়াতে থাকল। দরজার পলকা ছিটকিনিটা একটু পরেই ভেঙে যাবে। তখনই ঘরে ঢুকে পড়বে জন্তুটা।
কোথায় সুইচবোর্ডটা। হে ভগবান।...প্রাণপনে দেওয়াল হাতড়াতে হাতড়াতে শেষ পর্যন্ত যখন সুইচটা খুঁজে পেল। বাইরের শব্দটাও আচমকা থেমে গেল। ততক্ষণে ঘেমে স্নান হয়ে গেছেন অভয়। মাথার চুলগুলো পর্যন্ত ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। কুকুরের এমন ভয়ংকর গর্জন জীবনে কোনওদিন শোনেননি অভয়। কুকুরই তো? অবশ্য এইখানে অন্য কোনও বন্য জন্তুই বা কী করে আসবে? আর গলাটা কুকুরের বলেই তো মনে হল। আবার একঘটি জল খেল অভয়। সারারাত আর ঘুম এল না।
পরদিন সকালে অফিস যেতেই হনুমান একগাল হেসে বলল, মকান পসন্দ হল তো বাবু?
অ্যাঁ...হ্যাঁ ভালোই তো। ভালোই। কুকুরের কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেলেন অভয়। এই গত মাসেই একসঙ্গে পাঁচ-পাঁচটা গুন্ডাকে ধোলাই দিয়ে চিৎপাত করা ব্যায়ামবীর অভয়চরণ সামান্য একটা কুকুরের জন্য ভয় পেয়েছে এমন কথা একবার অফিসে ছড়িয়ে গেলে আর লজ্জার শেষ থাকবে না।
তো বাবু হামার বখশিশ?
কাল পেয়ে যাবে।
জি। উয়ো আজ সুবাহ আপকা নয়া মকান মালিক হমকো পুছ রাথা কে বাবু ঠিক তো হায় খোঁজ লেনে কে লিয়ে। তো হম বতায়া কে বাবু হরবক্ত ঠিক হি রহতা হ্যায়। ডেলি এক সের চানা সত্তু যো পিতে হ্যায়। হা-হা-হা। বলে অভয়ের মনে একটু সন্দেহ উস্কে দিয়ে চলে গেল হনুমান।
বাড়িওলার হঠাৎ আমি ঠিক আছি কি না সকাল সকাল খোঁজ নেওয়ার কি দরকার পড়ল? কেন, ঠিক থাকার কথা ছিল না নাকি? মনের কোণে সন্দেহটা নিয়েই সারাদিন অফিস করে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরল অভয়। বাড়ি ফেরার সময়ে একটা মোটা চেন, তালা আর একটা নাইট বালব কিনে নিয়ে ফিরল। ঘরে ঢুকে আগে নাইট বালবটা ফিট করল। তারপর দরজার কড়ায় মোটা চেনটা ভালো করে পেঁচিয়ে তালা আটকে ভালো করে দু-তিনবার ঝাঁকিয়ে নিশ্চিন্ত হল। নিশ্চিন্তির আনন্দে গোটা পঞ্চাশ বুকডন দিয়ে ফেলল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ রেডিয়োর গান-খবর ইত্যাদি শুনে রাত্রের খাবার খেতে বসে গেল।
বারোটা রুটি, এক ভাঁড় তরকা আর সঙ্গে চারটে কাঁচা লঙ্কা দুটো কাঁচা পেঁয়াজ নিমেষে সাফা করে এক ঘটি জল খেয়ে বজরংবলীকে প্রণাম করে বিছানায় টান হল অভয়। ভোর চারটেয় উঠতে হয় বলে রোজ সাড়ে ন'টার মধ্যেই শুয়ে পড়ে। শোয়ার কিছুক্ষণ পরেই নাসিকা গর্জন।
আজ গোটা দরজাটা এবার ভেঙে পড়বে ক্রুদ্ধ গর্জন আর অসম্ভব ধাক্কায়। রাত কত কে জানে, বিছানার এককোণে শিঁটিয়ে বসে থরথর করে কাঁপছে অভয়। এ কুকুর নয়। কুকুরের গায়ে এত শক্তি হতে পারে না। এই মোটা পুরনো দিনের দরজা এইভাবে নাড়ানো কোনও কুকুরের পক্ষে ভাবতে ভাবতেই শেষ পর্যন্ত ধড়াম করে কড়া ভেঙে হাট পাট খুলে গেল দরজাটা। আর খুলতেই নাইট ল্যাম্পের ঝাপসা আলোয় অভয় স্পষ্ট দেখল ঘরের মধ্যে ঢুকল প্রকাণ্ড আকারের একটা কালো কুচকুচে কুকুর। কুকুরটার গলায় চেন। চেনের অপরপ্রান্ত বাইরে কারও হাতে ধরা।
কুকুরটা মুহূর্তে চেন ছাড়িয়ে একলাফে খাটের ওপর উঠে অভয়ের ঠিক নাকের সামনে ছুরির মতো দাঁতগুলো বার করে ভয়ংকর চিৎকার করতে থাকল। মুখ থেকে সাদা ফ্যানা গড়াচ্ছে। শুধু যেন কারও হুকুমের অপেক্ষা করছে জন্তুটা। তার পরেই অভয়ের টুটি ছিঁড়ে ফেলবে। এবার ঘরের মধ্যে ঢুকলেন সাদা পাঞ্জাবি-পাজামা পরা বয়স্ক মানুষ। লম্বা। খুব ধীরে ধীরে ঘরের ভেতর এসে গম্ভীর গলায় বললেন, রকি ডোন্ট শাউট। কাম ডাউন কাম ডাউন। আই সে ডোন্ট শাউট।
অভয়ের বিচার বুদ্ধি আর কাজ করছে না। শুধু ভয় পাওয়া শিশুর মতো কেঁপে চলেছে। নাক দিয়ে জল গড়াচ্ছে। লোকটার হুকুমে খাট থেকে নামল বিশাল কুকুরটা। কিন্তু অভয়ের দিকে তাকিয়ে গরগর শব্দ করেই চলল। এবার লোকটা খাটের সামনে এসে দাঁড়াল। আবার শিউরে উঠল অভয়। সাদা চুল বয়স্ক লোকটা অভয়ের খাটের সামনে এসে গমগমে গলায় বললেন, 'কে আপনি?'
উত্তর দিতে গিয়েও গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না অভয়ের। লোকটার দুটো চোখেরই মণি নেই। সম্পূর্ণ সাদা। অন্ধ।
এই ঘরে আমি ছাড়া অন্য কারও থাকাটা রকি পছন্দ করে না।
কিছু একটা বলতে গেলেন অভয়। শুধু গোঙানি বেরোল মুখ দিয়ে।
আমি আজীবন এখানেই থাকব। আর কেউ নয়। নইলে রকি...বলার সঙ্গে সঙ্গে আবার কুকুরটা খাটের ওপর লাফিয়ে উঠে অভয়ের মুখের সামনে আবার ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো বার করে ভয়ংকর গর্জন করতে থাকল আর লোকটা এগিয়ে এসে লম্বা শীর্ণ হাত বাড়িয়ে অভয়ের ডান হাতের কবজি চেপে ধরল। কী অসম্ভব ঠান্ডা আর শক্ত হাত। এরপর আর নিতে পারল না অভয়। জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল।
৩
চোখ মেলল অভয়। অচেনা একটা বাড়ির খাটে শুয়ে আছে। ধড়মড় করে উঠে বসতে গেল। পারল না। শরীর অসম্ভব দুর্বল। থাক থাক উঠতে হবে না। আপনি শুয়ে থাকুন। চেনা গলা পেল অভয়। পাশে তাকিয়ে দেখল অঘোরবাবু। এইটা তারমানে ওনার ঘর। এখানে কেন? কী ভাবে?
বাবু অব থোড়া দুধ পি লিজিয়ে। চাঙ্গা হো যাইয়েগা। বলে একগ্লাস গরম দুধ এনে সামনে ধরল হনুমান। ও-ও এখানে। ব্যাপারটা কী? বিনা বাক্যে গরম দুধটা তিনচুমুকে শেষ করে সত্যিই একটু আরাম বোধ করল অভয়। কিন্তু মনের ভেতর থেকে থিরথিরে কাঁপুনিটা এখনও যায়নি।
আমাকে মার্জনা করবেন। আমারই অন্যায় হয়েছে আপনাকে ওই বাড়ি ভাড়া দেওয়া। আসলে ভেবেছিলাম এতদিন পর হয় তো আর...পর্যন্ত বলে থেমে গেলেন বাড়িওলা।
কী ব্যাপার বলুন তো? এইসবের মানে কী? ভাঙা গলায় জিগ্যেস করল অভয়।
গলা খাঁকরে বলতে শুরু করলেন অঘোর মিত্র। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের কথা। ওই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন এক ভদ্রলোক। নাম নারায়ণ চক্রবতী। রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। যুদ্ধে বোমার আঘাতে ওর দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছিল। সম্পূর্ণ অন্ধ, একা। সবসময়ের সঙ্গী বলতে বাঘের মতো একটা গ্রে হাউন্ড কুকুর।
কুকুরটা যেমন দেখতে তেমনই হিংস্র। সেইজন্য ওনার বাড়িতেও কেউ যেত না। একটা ঠিকে চাকর ছিল, সেই রান্নাবান্না, ঘর ধোওয়া-মোছার কাজ করে দিত। পাড়ায় কারও সঙ্গে মিশতেন না উনি। তবে সময় মতো ভাড়াটা পাঠিয়ে দিতেন ওই চাকরের হাত দিয়ে।
একদিন সন্ধেবেলায় খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। ভদ্রলোক দোতলার ব্যালকনির দড়িতে শুকোতে দেওয়া জামাকাপড় তুলতে গিয়ে অসাবধানে জলে পা পিছলে নীচে রাস্তায় পড়ে যান। তখনই মৃত্যু হয় তার।
সব থেকে আশ্চর্য ওই ঘটনার পর দীর্ঘদিন কুকুরটা ওই বাড়ি ছেড়ে বাইরে বেরোয়নি। মিউনিসিপ্যালিটির লোকেও ভয়ে ঘাঁটাতে চেষ্টা করেনি ওটাকে। কিচ্ছু খেত না। শুধু চিৎকার করে কাঁদত সারাদিন। সে কান্না আজও এলাকার লোকেদের মনে রয়েছে। আমিও শুনেছি। বড় করুণ। একদিন কুকুরটাকেও মরে পড়ে থাকতে দেখা গেল বাড়ির সামনে। সম্ভবত বাস কিংবা লরিতে চাপা পড়েছিল। পিষে গেছিল অনাহারে থাকা শুকনো শরীরটা।
এই ঘটনার কিছুদিন পর আমি বাড়িটা রিপেয়ার করে আবার ভাড়া দিই। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই ভাড়াটে বাড়ি ছেড়ে পালায়। তার পরের ভাড়াটেও তাই। তাদের বক্তব্য তারা নাকি ভূত দেখেছে। এলাকার লোকেরা বলে অনেক রাত্রে বাড়িটার ভেতর থেকে না কি কুকুরের ডাক শোনা যায়। আমার বাড়িটা ভূতুড়ে বলে আর কেউ ভাড়া নিতে আসত না। পড়েই ছিল। তারপর আপনি...। বলে থামলেন ভদ্রলোক।
এতদিন ভাবতাম এইসব মিথ্যে কথা। ওই পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেদের বদমাইশি। ভূতের ভয় দেখিয়ে বাড়িটাকে ক্লাবঘর বানানোর ধান্দা। তাই আপনার মতো গাট্টাগোট্টা পালোয়ানকে ভাড়াটে হিসাবে পেয়ে একটু ভরসা পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম ওইসব বদমাইশি বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু আমি একেবারে নিশ্চিন্ত হইনি। তাই একটা কাজ করেছিলাম ভাগ্যিস, হনুমানকে বলে রেখেছিলাম রোজ সকালে আপনার বাড়ির সদর দরজা খোলা কি না সেটা খেয়াল রাখতে। আপনি যে রোজ ভোরবেলায় দৌড়াতে বেরোন সেটা জানি। আজ সকালে হনুমান এসে যখন জানাল অনেক বেলা হয়ে যাওয়ার পরেও আপনার সদর দরজা খোলা নেই তখনই আমার মনে কু ডেকেছিল। তাই লোক নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ওই বাড়িতে গিয়ে দরজা ভেঙে ওপরে উঠে দেখি আপনি মেঝের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে রয়েছেন। তারপরে তো এই।
আমি আর ভাড়া দেব না। এইভাবে মানুষকে বিপদে ফেলে...ছি ছি। খুবই লজ্জিত হলেন অঘোরবাবু। আপনার মতো সাহসী পালোয়ান লোকেরই যদি এই অবস্থা হয় তবে অন্য কারোও কী দশা হবে। হার্টফেলই করবে বোধহয়। আপনি বাড়ি ছেড়ে দিন। যতদিন না নতুন বাড়ি পাচ্ছেন আমার বাড়িতে এসে থাকুন।
ভূতের ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার লজ্জা ঢাকতে আর এত ভালো বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে শুনে একটু কিন্তু কিন্তু করে অভয় সবে বলতে শুরু করেছিল, না মানে ভয় ঠিক...ইয়ে আমি ভাবছিলাম স্বপ্নটপ্ন দেখিনি তো? কথা শেষ হল না, নিজের ডান হাতের কব্জির দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেলেন কালশিটের দাগ। কে যেন সাঁড়াশি দিয়ে চেপে দিয়েছে। মুহূর্তে আবার ভয়ে কেঁপে উঠল অভয়।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন