বিনোদ ঘোষাল

আজ স্কুল থেকে ফেরার সময়ে টর্চটা রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিল সুমন। সঙ্গে বিপুল আর অভিজ্ঞান ছিল। তিনজনেই নটরাজ শিক্ষায়তনের ক্লাস সেভেনের স্টুডেন্ট। সেকশন আলাদা। তবে তিনজনেই পরস্পরের প্রাণের বন্ধু।
তো ওরা আজ বিকেলে স্কুল থেকে ফিরছিল। স্কুল থেকে ফেরার পথে একটা বিশাল বাঁশবাগান পড়ে। ওই বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে ওদের পাড়ায় শর্টকাটে ফেরা যায়। বাগানের ভেতর দিয়ে খুব সরু পায়ে চলা মাটির পথ। সেখান দিয়েই সাইকেল চালাচ্ছিল ওরা। এমন সময় বিপুল বলে উঠেছিল, ওই দেখ!
শুকনো বাঁশপাতার আড়ালে কী যেন একটা চকচক করছিল। অভিজ্ঞান বলল, কী রে ওটা? সাপ-টাপ নয়তো?
ধুর গাধা! সাপ এমন সোনার মতো চকচক করে নাকি? চল তো দেখি। বলে সাইকেল থেকে নেমে পড়েছিল বিপুল। তিনজন বন্ধুর মধ্যে ওর সাহসই সবথেকে বেশি। সোজা ওইখানে গিয়ে পা দিয়ে বাঁশপাতাগুলো সরিয়ে দিয়ে দেখে বলল, ও হরি। এই যে রে!
কী ওটা?
হেহেহে। দেখে যা।
সুমন আর অভিজ্ঞান সামনে গিয়ে দেখেছিল, একটা পুরোনো টর্চ।
সোনালি রঙের টর্চ! কোনওদিন দেখিনি রে। সোনার নয় তো?
তোর মাথাটা গেছে। সোনার টর্চ হলে কি এইভাবে ফেলে দেয়?
তাও তো ঠিক।
কী করবি তাহলে? জিজ্ঞাসা করেছিল অভিজ্ঞান।
কী আবার করব? যেমন ছিল তেমনই ফেলে চলে যাব। এই টর্চ কোনও কাজে লাগবে না।
আমি তাহলে নিয়ে নিই? হঠাৎ বলে উঠেছিল সুমন।
কী করবি নিয়ে?
কাল মিস্টার মেকার-এ একটা দারুণ জিনিস বানানো শিখেছি। সেটা বানাতে এমন একটা মেটালের ফাঁপা নল লাগবে।
কী সেটা?
আগে বানাই। তারপর দেখাব।
স্কুল ব্যাগে টর্চটা ভরে নিয়ে বাড়ি চলে এসেছিল সুমন। তারপর বিকেলে খেলতে গিয়ে বেমালুম ভুলেই গেছিল ওটার কথা। মনে পড়ল সন্ধেবেলা ব্যাগ খুলে পড়ার জন্য বই বার করতে গিয়ে। কিন্তু বার করেই সঙ্গে সঙ্গে ব্যাগে আবার লুকিয়ে ফেলেছিল। মা-বাবাকে জানালে চলবে না।
গোটা সন্ধে পড়াশোনায় আজ তেমন মন বসল না সুমনের। খালি মনে হচ্ছে টর্চটা কতক্ষণে হাতে নিয়ে দেখবে।
পড়া শেষ করে ডিনার শেষ করে তারপর নিজের রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে ব্যাগ থেকে সেই টর্চটা বার করল। ঘরের লাইট নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে খুব খুঁটিয়ে দেখতে থাকল জিনিসটাকে। সাধারণ টর্চের থেকে অনেকটাই বড় সাইজ। আর পুরো টর্চটার গায়ে খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম কারুকাজ। এই জিনিস যে আজকের নয়, বহুকালের পুরোনো তা বোঝাই যায়। কিন্তু জিনিসটা বাঁশবাগানে ফেলল কে?
টর্চের পিছন দিকের ঢাকনাটার প্যাঁচ খুলে দেখল ব্যাটারি ভরা নেই। একবার দেখলে হয় জ্বলে কি না। ভাবামাত্র নিজের ভিডিয়ো গেমের থেকে ব্যাটারিগুলো খুলে তার থেকে তিনটে ব্যাটারি টর্চটার মধ্যে ভরতে গিয়ে ভেতর থেকে একটা ছোট ভাঁজ করা কাগজের টুকরো পেল। এটা আবার কী?
কাগজটা খুলে বেশ চমকে উঠল সুমন। বড় বড় অক্ষরে লেখা, 'সাবধান। এই টর্চে ব্যাটারি ভরার আগে নিজের জীবন সম্পর্কে দুইবার ভাববেন। অভিশপ্ত।'
এর মানে? গা ছমছম করে উঠল সুমনের। তারপর ভাবল, নিশ্চয়ই কেউ মজা করেছে। একটা টর্চ আবার অভিশপ্ত হবে কী করে? নিশ্চয়ই ভাঙা, জ্বলবে না। সেই জন্যেই মজা করে লিখেছে যে ফেলে গেছিল ওটা।
এই ভেবে তিনটে ব্যাটারি ভরে সুইচটা অন করতেই ঘরময় অদ্ভুত একটা নীলচে আলোতে ভরে গেল।
চমকে উঠল সুমন। এমন আলো ও জীবনে দেখেনি।
ওটা হাতে নিয়ে ঘরের দেওয়ালে ফেলতে লাগল ও। আচমকাই মনে হল ঘরের ভেতরে কারা যেন নাড়াচাড়া করছে। এদিক ওদিক হাঁটাচলা করছে। আর খুব নীচু স্বরে ফিসফিস কথা শোনা যাচ্ছে কারো।
গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল সুমনের। কারা এরা? ভালো করে চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু স্পষ্ট ফিল করা যাচ্ছে, ঘরের মধ্যে কেউ আছে। টর্চের আলোটা নিভিয়ে ফেলল সুমন। সঙ্গে সঙ্গে সব স্বাভাবিক।
এটা কি মনের ভ্রম নাকি। লাইট নিভিয়ে শুয়ে পড়ল সুমন। যতক্ষণ ঘুম এল না কেমন যেন ভয় ভয় করতে থাকল।
পরদিন স্কুলে টিফিন বেলায় বিপুল আর অভিজ্ঞানকে সবটা বলল সুমন। ওরা তো শুনে হেসেই অস্থির। বলে, তোর মাথাটা গেছে। আরে ভয় দেখাবে বলেই কেউ ইচ্ছে করে ভাঙা টর্চটা ওখানে ফেলে দিয়ে গেছিল। তুই টোপটা গিলেছিস।
না রে। সত্যি বলছি। আমি টর্চটা আজ ব্যাগে নিয়ে এসেছি। বাঁশবাগানে ওখানেই ফেলে দেব। দরকার নেই।
শুনে আবার হো হো করে হাসি ওদের। জিনিসটা আদৌ জ্বলে?
হ্যাঁ রে, জ্বলে।
কই, জ্বালা তো দেখি।
ব্যাটারি আনিনি তো।
ফেলিস না তাহলে। জ্বলে যখন, আমাকে দিয়ে দে। বলল অভিজ্ঞান।
কী দরকার এইসব ভূতুড়ে জিনিস নিয়ে। ছেড়ে দে তো। আমি আজই ফেলে দেব ।
ধেৎ! তুই একটা ভীতুর ডিম। কিছু হবে না। আমাকে দিয়ে দে।
প্রায় জোর করেই সুমনের কাছ থেকে টর্চটা সেদিন নিয়ে নিল অভিজ্ঞান।
এবং তার পরের দিনই মুখ চুন করে স্কুলে এসে বলল, টর্চটা সত্যিই গণ্ডগোলের রে। আমি কাল সারারাত ঘুমোতে পারিনি। জ্বালালেই ওই আলোতে কাদের যেন নড়তে চড়তে দেখেছি।
আর কথা?
হ্যাঁ। সেটাও শুনেছি। খুব নীচু স্বরে, কী কথা কিচ্ছু বুঝতে পারিনি।
তোদের দুটোরই মাথা একেবারে গেছে রে। একটা সামান্য টর্চে তোরা ভূত দেখতে শুরু করেছিস। এরপর দেখবি হয়তো ভূতগুলো তোদের ঘাড় মটকাবে। বিপুল হো হো করে হেসে উঠল।
হাসিস না রে বিপুল। আমরা দুজনেই ভুল দেখব?
ফালতু কথা রাখ। দে আমাকে। প্রায় জোর করে ছিনিয়েই বিপুল টর্চটা নিয়ে বাড়ি চলে এল।
তারপর তিনদিন হয়ে গেল, বিপুল আর স্কুলে আসছে না।
ছুটির পর সাইকেল চালিয়ে বিপুলদের বাড়িতে গিয়ে জানা গেল, দুদিন আগের রাত থেকে বিপুলের ধুম জ্বর। বন্ধুদের দেখেই বিছানায় উঠে বসল বিপুল।
কী হল রে তোর? জিজ্ঞাসা করল অভিজ্ঞান।
বিপুল চুপ।
হঠাৎ জ্বর এল কেন?
ওই টর্চ...ওই টর্চটা...
হুঁ, দেখেছিস তো কী চিজ...! আজই ওখানে ফেলে দিয়ে আসব।
না রে। আর উপায় নেই। ওটা ফেলে দিলে আমাদের ভয়ংকর ক্ষতি হবে। মরে যাব। বলতে-বলতে প্রায় কেঁদেই ফেলল বিপুল।
আরে! কী হয়েছে বলবি তো?
টর্চটা আমার ড্রয়ারে রয়েছে। একবার নিয়ে আয়।
সুমন গিয়ে নিয়ে আসল টর্চটা।
টর্চটা হাতে নিয়ে বিপুল বলল, তোরা এটাকে ভলো করে দেখেছিলি?
হ্যাঁ দেখেছি তো। খুব সুন্দর কারুকাজ করা।
উঁহু। শুধু কারুকাজ নয় রে। ভালো করে এখানটা দ্যাখ। দেখেছিস? কারুকাজের মধ্যে কেমন কায়দা করে ইংলিশে একটা নাম খোদাই করা আছে।
হ্যাঁ তাই তো। আমার চোখেই পড়েনি। ডেভিড মিশেল। আঠেরোশো নিরানব্বই। এর মানে কী রে?
আমিও প্রথমে বুঝিনি। নামটা পড়ার পর ইন্টারনেট ঘেঁটে জানলাম যে এই টর্চ লাইটের আবিষ্কর্তা ছিলেন তিনি। এবং ১৮৯৯ সালে তিনি টর্চ লাইটের পেটেন্ট পাওয়ার পর প্রথম লটে যে ক'টা লাইট ম্যানুফ্যাকচার করেছিলেন সেগুলোর মধ্যে এটা একটা।
হোয়াট! সেটা কোন দেশে?
উনি নিজে ব্রিটিশ হলেও চুক্তি করেছিলেন আমেরিকার একটা ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানির সঙ্গে। সেখানেই তৈরি হয়েছিল এটা। সুতরাং বুঝতেই পারছিস জিনিসটা অ্যান্টিক। এবং এর দাম এখন লক্ষ লক্ষ টাকা।
কিন্তু এটা আমাদের বাঁশবাগানে সাগর পেরিয়ে এল কী করে?
জানি না। তবে আমার আন্দাজ জিনিসটা স্মাগলিং হয়ে আমাদের দেশে ঢুকেছে। আমি জানতে পেরেছি ওই প্রথম লটের টর্চগুলোর মধ্যে মাত্র দুটো পিসই অবশিষ্ট ছিল। একটা ব্রিটেনের মিউজিয়মে আর একটা আমেরিকার এক ধনকুবের ডন প্যালট্রিনারির ব্যক্তিগত সংগ্রহে। বছর খানেক আগে সেই ট্রিলিয়নিয়ারের সংগ্রহ থেকে জিনিসটা চুরি যায়। আমার মনে হয়, যারা এই চক্রে জড়িত তাদের মধ্যে আমাদের এলাকারও কেউ রয়েছে। এবার কোনও কারণে সে ব্যাটা আমাদের মতোই শখ করে লাইট জ্বালাতে গিয়েই কেলো করেছে।
কেন?
দেখাচ্ছি দাঁড়া। বলে টর্চের ঢাকনাটার প্যাঁচ খুলে ঢাকনার পিছনে খুব খুদে খুদে ইংরেজি হরফে লেখা কতগুলো শব্দর দিকে আঙুল দিল বিপুল।
কী লেখা রে?
পড়ে দ্যাখ।
অভিজ্ঞান পড়ল। 'ইরাতু মাকাশি হওতা।'
এ আবার কী? কোন দেশের ভাষা রে?
আমিও জানি না। তবে যে ধনকুবেরের কাছে এই টর্চ ছিল তিনি তার ব্লগে লিখেছিলেন আফ্রিকার এক আদিম জনজাতির ভাষা এটা। তিনি নিজে সেখানে একবার গেছিলেন। এবং এই মন্ত্র শিখে টর্চে খোদাই করে রেখেছিলেন যাতে ভুলে না যান। আর এই মন্ত্র যে একবার পড়ে ফেলবে তখন এই টর্চের আলোতে অন্যজগতের মানুষদের দেখা যাবে।
অন্য জগৎ মানে! ভূত?
না রে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। কিন্তু পরে জানতে পারলাম তিনি ভূতেদের কথা বলেননি। অন্য জগৎটা এই পৃথিবীতেই আছে।
সেটা আবার কেমন?
দ্যাখ, আমরা পৃথিবীতে সবকিছু দেখতে পাই আলোর কারণে, তাই তো?
কিন্তু এমন তো হতেই পারে পৃথিবীতে এমন কিছু পদার্থ আছে যা আলো শুষে নেয়। তাহলে কী হবে?
ব্ল্যাকহোলের কাণ্ড হবে। কিছুই দেখা যাবে না তখন।
রাইট। এই পৃথিবীতে এমন কিছু বস্তু বা প্রাণী আছে যাদের এমন প্যারালাল একটা দুনিয়া আছে। তাদের আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। তারাও পায় না আমাদের দেখতে।
তারাও কি আমাদের মতোই? থাকে কোথায়?
তা জানি না। তবে এখানেই থাকে। এই পৃথিবীতেই। কেমন দেখতে জানি না। তবে তারা যে আমাদের মতো নাড়াচাড়া করে, কথা বলে সেটা আমি সিওর। আর একমাত্র এই মন্ত্রের দ্বারাই সেটা সম্ভব হয়। যে ব্যাটা এ টর্চটা এখানে নিয়ে এসেছিল, সে এটা পড়ে ফেলেছিল আর সঙ্গে সঙ্গে কেসটা অ্যাক্টিভেট হয়ে গেছে।
আমার হেব্বি ভয় করছে রে বিপুল। এবার কী করব? জিনিসটা ফেলে দিয়ে আসি?
না ফেলবি না। গতকাল রাতে তাদের সঙ্গে আমি যোগাযোগ করতে পেরেছি। এবং জানতে পেরেছি তারা খুবই বিরক্ত হচ্ছে তাদের এইভাবে আলোতে আনার জন্য। এখন তোদের একটা কাজ করতে হবে।
কী কাজ? জিজ্ঞাসা করল অভিজ্ঞান।
জিনিসটাকে ওর মালিকের কাছে ফেরত পাঠাতে হবে। কারণ একমাত্র উনিই জানেন, কীভাবে ওই মন্ত্রকে ডিঅ্যাক্টিভেট করা যায়।
কিন্তু পাঠাব কী করে?
ভদ্রলোকের অ্যাড্রেস আমি ওর ব্লগ থেকে পেয়ে গেছি। এবার শুধু আমাদের জিনিসটা কুরিয়ার করতে হবে। সঙ্গে একটা চিঠি লিখে দেব।
তিন বন্ধু মিলে চিঠি লিখতে বসে গেল। টু মিস্টার ডন প্যালট্রিনারি...।
প্রায় মাস খানেক পরে বিপুলের বাড়িতে একটা পেল্লায় পার্সেল এল। প্রেরক আমেরিকার ডন প্যাল্টিদনারি। ভেতরে তিনটে দামি ভিডিয়ো গেম, অনেক চকোলেট, বই আর সঙ্গে একটা ইংরেজিতে লেখা চিঠি। তাতে লেখা রয়েছে, ডন প্যাল্টিদনারি তাঁর হারানো জিনিস ফেরত পেয়ে খুবই খুশি হয়েছেন। কারণ ওই টর্চের আলো বেশিদিন ব্যবহার করলে অন্য জগতের সেই প্রাণীরা পৃথিবীর আলোতে দেখা প্রাণীদের ওপর বেজায় চটে গিয়ে হয়তো কোনও ক্ষতিও করে ফেলতে পারত। শুধু তাই নয়, তিনি বিপুল, অভিজ্ঞান এবং সুমনকে পাঁচ হাজার ডলার করে পুরস্কারও দিতে চান।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন