বিনোদ ঘোষাল

দ্রুত পা চালাচ্ছে রামকিংকর। সন্ধে সাতটায় ট্রেন। বিকেল সাড়ে চারটেয় গরুর গাড়ি চেপে রাজবল্লভপুর থেকে রওনা দিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক ক্যাচর কোচর শব্দ করে গাড়িটা শুকনো নদীর সামনে পর্যন্ত এসে গাড়োয়ান হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে সূর্যাস্তের দিকে তাকিয়ে বলল, কত্তা নেমে যান, আমি আর যাব না।
সে কী, কেন?
কেন বলতে পারবুনি। নেমে যান নেমে যান। বলে প্রায় ধাক্কা দিয়েই রামকিংকরকে গরুর গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়ে হ্যাট হ্যাট করতে করতে গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়েছিল। রামকিংকর পুরো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হাঁ করে তাকিয়েছিল চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে। একটু আগে পর্যন্ত ভালো ব্যবহার করছিল লোকটা শংকরের সঙ্গে। হঠাৎ হল কী? বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ দুম করে যেন অদৃশ্য হয়ে গেছিল গাড়িটা চোখের সামনে। এমন আবার হয় নাকি? নিশ্চয়ই চোখের ভুল। কিংবা অন্ধকার নেমে আসছিল বলে চোখে ঠাওর হয়নি।
গাড়োয়ান চলে গেছে প্রায় আধঘণ্টা আগে। হাত ঘড়িতে সন্ধে ছ'টা। নভেম্বর মাসে অন্ধকার নামে তাড়াতাড়ি। শুকনো নদীটা পায়ে হেঁটে পার করে ধু-ধু মাঠের ওপর দিয়ে হন হন করে হাঁটছে রামকিংকর। আর পা চলছে না।
কেন যে মরতে বন্ধুপ্রীতি দেখাতে গিয়ে শংকরের কথায় রাজি হয়ে গেছিল। আসলে উপায়ও ছিল না। একই ঘরের বন্ধু, দীর্ঘ চার বছর ধরে পাশাপাশি খাটে দুজনের শোয়া-বসা। সেই শংকর গত এক মাস ধরে জ্বরে শয্যশায়ী। কিছুতেই কমছে না। অগত্যা কলকাতা থেকে প্রায় একশো কিলোমিটার দূরে এই ধ্যারধ্যারে রাজবল্লভপুরে শংকরের বাড়ির লোককে জানাতে এসে পুরো ফেঁসে গেছে রামকিংকর।
বুকে হাঁফ ধরছে রামকিংকরের। আর কত দূরে স্টেশন সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। চারদিক অন্ধকার। দূর-দূরান্তেও এক বিন্দু আলোর টিকিটি নেই। মাঠ আর শেষ হয় না। হাঁটতেই থাকছে।
ঘটনা হল উত্তর কলকাতার এক মেস বাড়িতে থাকে রামকিংকর। সঙ্গে রুমমেট শংকর। দুজনের বয়স প্রায় একই। দুজনেই বেসরকারি অফিসের ক্লার্ক। মোটামুটি মাইনে। বয়স দুজনেরই চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। ফলে একই ঘরে থাকার কারণে দুজনের বন্ধুত্বটা বেশ গভীর।
রামকিংকরের দেশের বাড়ি মেদিনীপুর। অবশ্য মা-বাবা দুজনেই গত হওয়ার পর থেকে আর দেশের বাড়ি যাওয়া হয় না। বিয়েথাও করেনি রাম। সে কারণে কোনও পিছুটানও নেই। বাড়ি অফিস আর অফিস বাড়ি এই নিয়েই কেটে যায় জীবন। অবসরে শংকরের সঙ্গে একটু দাবা-তাস খেলা আর টিভি দেখা।
শংকর অবশ্য বিবাহিত। ওর দেশের বাড়ি বর্ধমানের রাজবল্লভপুরে। শংকরের কাছেই শোনা সেই গ্রামে পৌঁছানো নাকি বেশ জটিল ব্যাপার। সরাসরি কোনও বাস-ট্রেকার যায় না। বর্ধমান স্টেশন থেকে ঘণ্টা দেড়েক বাস জার্নি করে পাঁচকুলি নামের এক স্টপেজে নামতে হয়। সেখান থেকে মিনিট কুড়ি পায়ে হেঁটে নদী। সেই নদী পার করে আবার মাঠের ওপর দিয়ে ঘণ্টা খানেক হাঁটা। তারপর রাজবল্লভপুর গ্রাম।
এমন পান্ডব বর্জিত জায়গায় বাড়ি কেন জিগ্যেস করায় শংকর উত্তর দিয়েছিল কী আর করা যাবে। আমাদের সাতপুরুষ আগের ভিটে। কেউ আর ছেড়ে আসার কথা ভাবতেও পারে না। আর তা ছাড়া...
কী?
শুনেছি আমার ঠাকুরদার ঠাকুরদা ছিলেন ওই গ্রামের জমিদার। ওঁরই নাম ছিল রাজবল্লভ। তাঁর নামেই ওই গ্রাম। সেজন্য ছেড়ে চলে আসতেও মায়া লাগে।
সেই শংকর হঠাৎ মাসখানেক আগে পড়ল জ্বরে। হোমিওপ্যাথি, অ্যালোপ্যাথি, সব করেও কিছু লাভ হয়নি। বেচারা ভুগে ভুগে চৌকির সঙ্গে মিশে গেছে। এর পরেই রামকিংকর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর দেরি নয় এবার রওনা দেওয়া যাক।
সরকারি হাসপাতালে শঙ্করকে ভরতি করে ওর বাড়ির ঠিকানাটা জেনে নিয়ে রওনা দিয়েছিল আজ ভোর বেলায়। বেরোনোর সময়ে বোঝেনি জার্নিটা এত কষ্টের হবে। বাস স্টপে নেমে একটা চায়ের দোকানে যখন লোকজনকে রাজবল্লভপুর কীভাবে যাবে জিগ্যেস করেছিল সবাই এমনভাবে ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছিল যেন হরপ্পা যুগের কোনও গ্রামের খোঁজ নিচ্ছে। কেউ জিগ্যেস করেছিল কেন যাবেন? কেউ বলেছিল সে গ্রাম কি আর আছে?
কী যে বলে লোকগুলো, একটা গোটা গ্রাম আবার বেমালুম লোপাট হয়ে যায় নাকি? যাই হোক একটা ভ্যানওয়ালা শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে রাজি হয়েছিল। তবে পুরোটা নয়। বেশ খানিকটা আগে রামকিংকরকে নামিয়ে দিয়ে বলেছিল আর যাবুনি। এই সিধে নাক বরাবর চলে যান পৌঁছে যাবেন।
রামকিংকর কোনও উত্তর না দিয়ে নাক বরাবরই হাঁটা লাগিয়েছিল। তখনই পিছন থেকে ডেকেছিল ভ্যানওয়ালাটা।
ও বাবু শুনুন।
হ্যাঁ বলো।
রাজবল্লভপুরে আপনার কেউ থাকে?
হুঁ, আমার বন্ধুর বাড়ি।
আপনি আগে এসেছেন?
না, কেন বলো তো?
না, মানে, ওই আর কি। ইয়ে বলছিলাম যে সেই গ্রামে এখনও তারা আছেন কি না জানেন তো?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, থাকবে না কেন?
আচ্ছা সাবধানে যাবেন।
কেন বলো তো?
না তেমন কিছু না আসলে অনেক দিন হল ওই গ্রামে কেউ যায় না তো। সে জন্যিই।
অ। বলে আবার হাঁটা লাগিয়েছিল রামকিংকর। মনের ভেতর একটু খচখচ করছিল। কেউ যায় না কেন ওই গ্রামে?
কিন্তু বহু কষ্টে বেলা বারোটা নাগাদ পৌঁছানোর পর সেই গ্রামের রকমসকম দেখে তাক লেগে গিয়েছিল রামকিংকরের। ছবির মতো সাজানো ছোট্ট গ্রাম। গ্রামের মাঝখানে বিশাল একটা বটগাছ মস্ত ছাওয়া নিয়ে দাঁড়িয়ে। এতবড় বটগাছ আগে কোনওদিন দেখেনি রাম। ছোট ছোট মাটির বাড়ি, খড়ের চাল, নিকোনো উঠোন, গোলায় ধান, হাস-মুরগি, গরু, বাছুর, গাছপালা, সহজ সরল মানুষ জন।
জমজমাট গ্রাম। গ্রামের মানুষগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল সবাই যেন সবাইয়ের আত্মীয়। এত আন্তরিকতা। শংকরের বাড়িতে পৌঁছে নিজের পরিচয় দিয়ে শংকরের অসুস্থতার কথা বলতেই তো ওর মা প্রথমে খুব কান্নাকাটি করতে শুরু করলেন। খুব স্বাভাবিক কথা। মা-র চিন্তা হবেই। ওর বাবা এসে সামলাল।
রামকিংকরকে আলাদা ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল, দেখো বাবা আমরা কেউ যেতে পারব না। শংকরকেও এখানে পাঠিও না। অসুবিধে আছে। তুমি ওর বন্ধু। আমি তোমাকে টাকা দিয়ে দিচ্ছি ছেলেটার শহরেই ভালো করে চিকিৎসে করাও। যা খরচ লাগে আমরা গাঁয়ের লোক মিলে দেব।
রামকিংকর খুব অবাক হয়েছিল। নিজেদের একমাত্র ছেলে শহরে একা অসুস্থ হয়ে পড়ে রয়েছে জেনেও নিজেরা দেখতে যেতে চাইছে না, এমনকী ছেলেকেও নিয়ে আসতে চাইছে না। এ কেমন বাপ-মা! অথচ কী ভালো ব্যবহার!
দুপুর বেলায় এলাহি খাওয়াদাওয়ার পর ঘরের দাওয়ায় মাদুরে বসে শংকরের বাবা-মা আর গ্রামের কয়েকজনের সঙ্গে গল্প করছিল রামকিংকর। ভেবেই নিয়েছিল আজ রাতটা এখানে কাটিয়ে পরদিন সকালে রওনা হবে। শংকরের বাবা বেশ কিছু টাকা পুঁটলি করে ওর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন এটা দিয়ে শংকরের চিকিৎসা করো। দরকার লাগলে আরও দেব। কিন্তু বিকেল গড়াতেই সারাদিনের ভালোমানুষগুলো হঠাৎ যেন বদলে যেতে শুরু করল। এবার বেরিয়ে পড়ো, সন্ধে হয়ে গেলে আর ট্রেন পাবে না।
খুব অবাক লাগছিল রামকিংকরের। এ আবার কী? কোথায় বলবে দুটো দিন থেকে যাও তা না, দূর করার জন্য সবাই মিলে যেন উঠে পড়ে লেগেছে। অদ্ভুত ব্যবহার তো! তা ছাড়া এই এখন রওনা দিলেও কত রাত্রে বাড়ি পৌঁছবে তার ঠিক নেই।
রামকিংকরের মুখের হাবভাব দেখে শংকরের বাবা বলেছিল, তুমি কিছু মনে কোরো না বাবা, তোমাকে রাত্রে থাকতে দিতে পারলাম না। কিন্তু এখানে থাকতে তোমার বড় অসুবিধে হবে। তবে চিন্তা নেই, নিতাই তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসবে।
রাম মরিয়া হয়ে বলেছিল, না, না, মেসোমশাই আমার কোনও অসুবিধের ব্যাপার নেই। আমি বাইরেই না হয় শুয়ে পড়ব।
না, না, কোনও দরকার নেই। তুমি পরে একদিন ভোর ভোর এসো বাবা। আজ চলেই যাও।
এরপর আর কিছু বলার থাকে না। আচ্ছা অভদ্রমানুষ তো সব! রাম একাই হাঁটা লাগাবে ভেবেছিল। কিন্তু গ্রামের কেউ একা ছাড়ল না ওকে। বলল, রাস্তা ভুলে যেতে পারো। তা ছাড়া গরুর গাড়িতে গেলে তাড়াতাড়ি হবে, স্টেশন যাওয়ার শেষ বাসটা পেয়ে যাবে।
অগত্যা মনে মনে নাকখৎ দিয়ে নিতাইয়ের গরুর গাড়িতে চেপে বসেছিল রাম। রওনা দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তে শংকরের বাবা হঠাৎ বলে উঠেছিলেন ক্ষমা করে দিও বাবা, তোমাকে রাত্তিরটা রাখতে পারলাম না। সবই আমাদের কপাল! সেই কথা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শংকরের মা আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন।
এ সবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে গরুর গাড়ি করে স্টেশনের পথে রওনা দিয়েছিল রাম। গোটা রাস্তায় নিতাই নামের গাড়োয়ানটা একটা কথাও বলেনি। শুধু যতটা সম্ভব হন হন করে গাড়ি চালাচ্ছিল। গরু দুটোও প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াচ্ছিল।
ফেব্রুয়ারি মাসের বিকেল শেষ হয়ে যায় ঝুপ করে। সূর্যটা যখন পশ্চিমে প্রায় হেলে পড়েছে, তার একটু আগে থেকেই ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছিল নিতাই। কিন্তু তবু শেষ রক্ষা হল না। সেই বিকেল নেমেই গেল। আর নামতেই ওকে মাঠের ওপর নামিয়ে দিয়েই পালাল নিতাই।
তারপর থেকেই প্রায় ঘণ্টা খানেক এলোমেলো হাঁটার পর ক্লান্ত বিদ্ধস্ত রাম বুঝতে পারল সে গোলকধাঁধায় পড়ে গিয়েছে। একই জায়গায় বার বার ঘুরে ফিরে আসছে। মেন রাস্তার টিকিটি নেই। ততক্ষণে ঘড়িতে সন্ধে সাড়ে সাতটা। ট্রেন পাওয়ার আর কোনও আশা নেই। অগত্যা সেই গ্রামে ফিরে যাওয়াই ভালো। কোনওমতে রাতটা কাটিয়ে কাল ভোর ভোর রওনা দিলেই হবে।
ভাবামাত্র সেই পথে হাঁটা লাগাল রাম। আকাশে চাঁদ উঠেছে। মাঠের ওপর গরুর গাড়ির চাকার দাগ আবছা বোঝা যাচ্ছে। সেই আন্দাজ করে প্রায় ঘণ্টাদুয়েক আপ্রাণ হেঁটে যখন রাম আবার সেই গ্রামে পৌঁছাল তখন চক্ষু ছানাবড়া। কোথায় গ্রাম? সকালবেলার জমজমাট গ্রামটায় এখন একটা জনপ্রাণীও নেই। শুধু কয়েকটা ভাঙা চোরা ঘর আর প্রকাণ্ড একটা পাতাবিহীন ন্যাড়া বটগাছ ভূতের মতো দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে ভুল হল না কি? নাহ, এই তো সেই বটগাছটা। তাহলে? গ্রামটা বেমালুম উধাও। এমন আবার হয় নাকি? তাহলে...তাহলে...কনকনে একটা ঠান্ডা হাওয়া যেন রামের গোটা শরীর জুড়ে বয়ে গেল।
ন্যাড়া বটগাছটার ওপর থেকে একটা শকুন ডেকে উঠল ওয়া ওয়া করে। রামের পা দুটো যেন মাটিতে কামড়ে ধরেছে। ভীষণ ভয় পেলে মানুষ হয় স্থির হয়ে যায় নয়তো আত্মরক্ষার জন্য তার গায়ে অসুরের শক্তি ভর করে। রামের দ্বিতীয়টা হল। হঠাৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করল ও। দিগবিদিক জ্ঞান হারিয়ে শুধু ছুট ছুট। পিছনে শকুনের ডাকটা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওকে পিছন থেকে তাড়া করে যাচ্ছিল।
ছুটতে ছুটতে একসময়ে আর পারল না রাম। জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাঠের ওপর।
২
চোখ মেলল রাম। চারদিকে তাকাল। একগাদা মানুষ ওর দিকে ঝুঁকে তাকিয়ে আছে। ধড়মড় করে উঠে বসল। একজন বলে উঠল, এই জ্ঞান ফিরেছে রে বাবুর। একটু চা দে ওকে।
একটু জল হবে? কোনওমতে বলল রাম।
জলের জগ বাড়িয়ে দিল একজন।
প্রায় পুরো জলটা শেষ করে এদিক-ওদিক তাকাল রামকিংকর। একটা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে বসে রয়েছে ও। দোকানটা চিনতে পারল। এখান থেকেই কাল সকালে ও ভ্যানে উঠেছিল।
এখন একটু সুস্থ লাগছে? চায়ের ভাঁড় বাড়িয়ে দিয়ে জিগ্যেস করল একজন বয়স্ক লোক।
মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে রামকিংকর বলল, আমি এখানে কী করে?
প্রাণে বেঁচে যে ফিরেছেন এই যথেষ্ট। ভাগ্যিস বলাই আমাদের জানিয়েছিল যে আপনি রাজবল্লভপুরে গেছেন। তাই রাত হতেই আমরা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম আপনাকে।
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে আরাম লাগল রামের। গতকালের সব ঘটনা একে একে মনে পড়তে লাগল। ছুটে পালাতে পালাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত।
কেন গিয়েছিলেন বলুন তো আগে ওই ভূতের গ্রামে?
ভূত! বলেই থমকে গেল রাম।
হ্যাঁ, ভূতই তো। ওই গ্রামে কি আর মানুষ রয়েছে? মানুষ থেকে গাছ-পালা-গরু-ছাগল-হাস-মুরগি সব ভূত।
ভূত কেন বলছ হারু দা, বলো কিম্ভুত। নইলে রাত ছেড়ে দিনের বেলায় কী আর ভূত বেরোয় আর কোথাও? বলল আরেকজন।
তা ঠিক বলেছিস বটে।
ব্যাপার কী? আমি কিছুই বুঝছি না।
বলছি। বলে গলা খাঁকরে শুরু করল সেই হারু নামের বয়স্ক লোকটা। যা বলল তা সংক্ষেপে এই রকম। এক সময় রাজবল্লভপুর খুবই শান্ত এবং হাসিখুশি গ্রাম ছিল। মোটে দশ-বারো ঘরের বাস কিন্তু শান্তিতে ছিল সকলে। কিন্তু সে সুখ সইল না। বছর কয়েক আগে একদিন দুপুর বেলায় প্রবল ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয়। সঙ্গে মুহুর্মুহু বজ্রপাত। ওই গ্রামেরই মস্ত বটগাছটায় বাজ পড়ে গ্রামের সবক'টা মানুষ মরে গেল। একটা প্রাণীও বাঁচেনি। শুধু দু-একজন যারা সেই সময়ে গ্রামের বাইরে ছিল তারা বেঁচে গেছিল কপালজোরে। তারপর থেকেই গ্রামটা অদ্ভুতুড়ে হয়ে যায়।
দিনের বেলায় সবাই মরেছিল বলে নাকি রোজ সকালে জেগে ওঠে গোটা গ্রাম। আর সন্ধে নামতেই সব হাওয়া। কয়েকজন সাহস করে সেই দৃশ্য দেখতে গেছিল। তাদের কেউ মরেছে ভয়ে, কেউ পাগল হয়ে গেছে। আর দূর থেকে কেউ দেখতে পেয়েই প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। তবে তেনারা কারু কোনও ক্ষতি করেনি আজ পর্যন্ত।
গল্পটা শুনতে শুনতে ভয় নয়, বুকের ভেতরটায় টনটন করছিল রামের। মনে পড়ছিল এই সময় এখন নিশ্চয়ই শংকরের মা দাওয়ায় বসে রান্না করছেন। আর সেই বিশাল বটগাছটার ছাওয়ায় বসে গল্প করছে সেই গ্রামের মানুষগুলো।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন