মঙ্কু ও মুক্তোর মালা

বিনোদ ঘোষাল

মঙ্কু ও মুক্তোর মালা

 

ঙ্কু গাছের ডালে শুয়েছিল। আজ মন বেশ ফুরফুরে। বিকেলবেলার খাওয়াটা জম্পেশ হয়েছে।

জামরুল, আম এবং শশা। আমটা খুব মিষ্টি ছিল। কম করে সাত আটখানা আমই খেয়ে ফেলেছে।

এখন পেট ফুলে ঢোল। গাছের মগডালে শুয়ে থাকার কারণে বিকেলের ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়াটা খুব আরাম দিচ্ছে। চোখ বুজে গুন গুন করে গাইতে গাইতে চোখ লেগে এসেছিল।

হঠাৎই শুনতে পেল নীচে কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। প্রথমে কান খাড়া করে শুনল মঙ্কু। উঁহু একথা তো অন্য কোনও জন্তুর নয়, এ তো মনে হচ্ছে মানুষদের গলা। এই সন্ধে হয় হয় সময়ে মানুষ কী করে এল রে বাবা!

সাধারণত মানুষরা জঙ্গলে কাঠ-কুটো ফল-মূল ইত্যাদি নেওয়ার জন্য সকাল সকালই আসে আর দুপুর দুপুরই ফিরে যায়। বিকেলের মধ্যেই এই বিশাল জঙ্গলটায় এত অন্ধকার নেমে আসে যে আর কিছু দেখা যায় না।

মঙ্কু যে জঙ্গলে থাকে সেখানে সাপখোপ বাঘ ভাল্লুক হাতি সকলেই আছে, তাই এই জঙ্গল থেকে মানুষদের বসতি অনেক দূরে, ওই দূরের যে পাহাড়টা দেখা যায় সেটা পার করে তারপর মানুষদের গ্রাম।

মঙ্কুর যখন খুব অল্প বয়স তখন একবার মায়ের কোল আঁকড়ে ওই মানুষদের গ্রামে গিয়েছিল।

শুধু ও আর ওর মা নয় সেবার জঙ্গলের প্রায় সকলকেই বাধ্য হয়ে মানুষদের গ্রামে যেতে হয়েছিল। কারণ জঙ্গলে আগুন লেগে গেছিল। মঙ্কু যদিও তখন খুব ছোট, তবু এখনও ঝাপসা স্মৃতি রয়েছে। অনেক রাত। গোটা জঙ্গল দাউ দাউ করে জ্বলছে। আগুন এত উঁচুতে যেন আকাশটাকেও পুড়িয়ে দেবে। সেবার অনেক জন্তু মারা গেছিল আগুনে পুড়ে আর বাকিরা প্রাণের ভয়ে দৌড় লাগিয়েছিল মানুষদের গ্রামের দিকে।

গ্রামের মানুষগুলো খুব ভয় পেয়ে গেছিল অত প্রাণীদের গ্রামে ঢুকে পড়তে দেখে। প্রায় মারামারি লাগে আর কি। তখনই একজন লম্বা লোক, খুব ঝলমলে পোশাক পরা মাথায় মুকুট ঘোড়ায় চড়ে এসে গ্রামের লোকদের বলেছিল ভয় নেই, ওরা আমাদের কাছে আশ্রয় নিতে এসেছে, দেখছ না। জঙ্গল আগুন লেগেছে। ওদের তোমরা কেউ ক্ষতি কোরো না। যে ক'দিন ওরা থাকতে চায় আমাদের রাজ্যে থাকুক। ওদের খাবার-দাবার দিয়ে সাহায্য করো।

মা মঙ্কুকে বলেছিল ওই হচ্ছে এই মানুষদের রাজামশাই।

মঙ্কু অবাক হয়ে দেখেছিল রাজামশাইটাকে কী সুন্দর দেখতে!

পুরো চার-পাঁচদিন ওরা ছিল মানুষদের গ্রামে। গ্রামের মানুষরা খুব আদর করে দুই বেলা খাইয়েছিল ওদের। কেউ কোনও ক্ষতি করেনি। তারপর আগুন নেভার পর জঙ্গলের রাজা সিংহ নিজে গেছিলেন মানুষদের রাজা মশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে ধন্যবাদ জানাতে। সকলেই কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল রাজা মশাইকে। মায়ের কাছে মঙ্কু শুনেছিল এই রাজা খুবই ভালো। কোনওদিন মৃগয়া করতে আসেন না। মানে জঙ্গলে এসে পশু পাখি শিকার করা। রাজারা যেটা প্রায়ই করে থাকেন আর কি।

ফিরে এসেছিল সকলে। আবার ধীরে ধীরে গাছে নতুন পাতা গজাল, বৃষ্টি এল, একদিন আগের মতো সবুজ হয়ে উঠল বন। মঙ্কু বড় হল। জন্তুদের নিয়ম হল বড় হয়ে গেলে আর বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতে নেই। তাই মঙ্কুও একা হয়ে গেল। একা মানে পুরো দলের সঙ্গেই থাকা কিন্তু শুধু মায়ের কোলে পিঠে আর নয়। মঙ্কু বাঁদর হলে কী হবে গোটা জঙ্গলে ওর খুব সুনাম। এক ডাকে ওর নাম সকলে চেনে। সে কারণটা পরে বলছি আগে বলি মঙ্কু গাছের নীচে কী দেখল?

মঙ্কু ওপর থেকে ঝুঁকি দিয়ে দেখল, ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। খুব সাবধানে গাছের ডাল বেয়ে নেমে এল অনেকটা নীচে। প্রায় চার-পাঁচজন মানুষ। সকলের মাথায় কালো পাগড়ি মালকোছা দেওয়া ধুতি। হাতে লাঠি, বল্লম, কপালে তিলক, পাকানো গোঁফ। এরা কারা! লোকগুলো নীচু স্বরে নিজেদের মধ্যে কীসব কথা বলল তারপর দুইজনে মিলে ওই গাছে যে মস্ত কোটর আছে তার মধ্যে একটা বড় বস্তা ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়ে আবার জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ব্যাপার বেশ রহস্যময় মনে হচ্ছে। লোকগুলো কে আর ওই বস্তাতেই বা কী রয়েছে? নাহ জানতেই হবে।

কিছুক্ষণ পর গাছ বেয়ে নেমে এল মঙ্কু। সোজা ঢুকে গেল গাছের কোটরে। উফ কী ঘুটঘুটে অন্ধকার। হাতড়ে হাতড়ে বস্তাটা পেল। টান মেরে বাইরে নিয়ে আসল। উফ বেজায় ভারী! বস্তার মুখ দড়ি দিয়ে বাঁধা।

চটপট দাঁত দিয়ে খুলে ফেলল দড়ি আর তারপর বস্তার ভেতর হাত ঢুকিয়ে জিনিসগুলো বার করতেই চোখ ছানাবড়া মঙ্কুর। এ কী! এগুলো কী! লাল নীল হলুদ সবুজ সাদা কত রঙের সব ঝলমলে পাথর, এই নিভন্ত আলোতেও চিকমিক করছে আর রয়েছে হলদে রঙের সব গয়না, এগুলো মানুষেরা গায়ে মাথায় হাতে পরে।

এগুলো এখানে ওই লোকগুলো লুকিয়ে রেখে গেল কেন? নাহ ব্যাপার বেশ গোলমেলে মনে হচ্ছে। সবাইকে জানাতে হবে। ভাবামাত্রই মঙ্কু গাছের মগডালে তিরিং তিরিং করে উঠে গিয়ে চিরিরি চিরির করে ডাকতে থাকল আর মগডাল ধরে খুব ঝাঁকাতে থাকল। এটা জঙ্গলের নিয়ম। এর মানে হল বনের কেউ মিটিং ডাকছে, এক্ষুনি সকলে এখানে চলে আসতে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এইভাবে সব পশুপাখিরাই মিটিং ডাকতে পারে, যারা গাছে উঠতে পারে না তাদের হয়ে মঙ্কুর মতো বাঁদড়রা ডেকে দেয়।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই চলে এল সবাই। শুধু কচ্ছপের আসতে একটু দেরি হয়। সেটা সকলেরই জানা। তাই সে বেচারা সবক'টা মিটিংয়েই একটু দেরিতে পৌঁছয়। আজও একটু দেরিতেই পৌঁছল, ততক্ষণে মঙ্কু পুরো বিষয়টা সকলে জানিয়ে ফেলেছে।

বস্তার ভেতরের জিনিসপত্রগুলো দেখে অনেক জন্তুই চিনে ফেলল আরে এগুলো তো সব পাথর। বেশ দেখতে।

কাক বলল আরে এগুলো মানুষরা খুব যত্নে রাখে। এই জিনিসগুলোকে ওরা গয়না বলে। মানুষদের খুব প্রিয় এসব। এখানে এল কী করে? আর জিনিসগুলো যদি ওই মানুষদেরই হবে তাহলে এখানে লুকিয়েই বা রেখে গেল কেন?

হুঁ তার মানে ব্যাপার কিছু জটিল হবে। অত সহজ নয়। নিশ্চয়ই ওই মানুষগুলো ভালো নয়। এমন সময় চিল্লে উঠল নেংটি ইঁদুর। চিঁ চিঁ করে বলে উঠল আরে এই গয়নাগুলোর আমি কয়েকটা চিনি।

তুই! তুই কী করে চিনলি? প্রশ্ন করল সকলে।

আরে তোমরা তো জানই আমি অনেক সময় একটু ভালো-মন্দ খাওয়ার শখ হলে চলে যাই মানুষদের রাজ্যে। তো বেশ মাসখানেক আগে আমার একটু রাজবাড়ির খাবার-দাবার খাওয়ার সখ হয়েছিল। চলে গেছিলাম। খাবার খুঁজতে খুঁজতে আমি একটা গোপন ঘরে ঢুকে পড়েছিলাম ভুল করে, সেখানে এমন অজস্র পাথর আর এইগুলো ছিল বলে সোনার গয়নাগুলোর দিকে আঙুল তুলল ইঁদুর। ওখানেই জানতে পেরেছিলাম যে আমি রাজামশায়ের ধনাগারে ঢুকে পরেছিলাম।

আর এই পাথরগুলোকে ওরা বলে রত্ন আর এইগুলোকে বলে গয়না। আমি নিশ্চিত এই গয়নাগুলো আমি রাজা মশাইয়ের ওই ধনাগারে দেখেছি।

সর্বনাশ! সে কি কথা! তাহলে তো আমার যা মনে হচ্ছে, নির্ঘাৎ ওই লোকগুলো চোর-ডাকাত হবে, রাজামশাইয়ের ধনাগার থেকে চুরি করে এখানে লুকিয়ে রেখে গেছে। পরে এসে আবার নিয়ে যাবে। মাথা নেড়ে গম্ভীর হয়ে বলল ভাল্লুক।

আমারও তাই মনে হচ্ছে, ভাল্লুকের কথাই ঠিক, শুঁড় দুলিয়ে সায় দিল হাতি।

তাহলে উপায়?

আমাদের কীই-বা করার আছে। থাক যেমন পড়ে রয়েছে। বলল শিয়াল।

তা কী করে হয়? আমাদের উচিত যার ধন তাকে ফেরত দেওয়া। মঙ্কু উত্তর দিল।

তুমি খেপেছ নাকি? আমরা কীভাবে যাব ওই মানুষদের ডেরায়? না না ওসব ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। মানুষদের কাছে বেশি না ঘেষাই ভালো। বলল খরগোশ।

যা দেখা গেল বনের সব প্রাণীই মোটামুটি সায় দিল ওদের দুজনকে। মানুষদের সমস্যায় নাক না গলানোই ভালো। আর তা ছাড়া অত ভারী বস্তা নিয়ে যাওয়াও ঝামেলা। অনেক দূরের পথ।

কিন্তু বেঁকে বসল মঙ্কু। না ভাই, আমি তোমাদের সঙ্গে একমত হতে পারলাম না। সব কিছু জানার পরেও আমরা যদি যার জিনিস তাকে ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা না করি সেটা অন্যায় হবে, আর তা ছাড়া আমরা ওই রাজামশায়ের কাছে কৃতজ্ঞও বটে, সেই দাবানলের সময়ে উনিই আমাদের সাহায্য করেছিলেন। এখন তাঁর বিপদে আমরা পাশে না দাঁড়লে অন্যায় হবে।

সবই ঠিক কথা মঙ্কু, কিন্তু উনি ভালো হলে হবে কী? রাজ্যের সব মানুষ তো আর ভালো নয়।

সে যাই হোক তোমরা যদি কেউ যেতে রাজি না হও তাহলে কাল সকালে আমি একাই যাব।

না না মঙ্কু। তুমি আমাদের জঙ্গলের একজন ভালো বন্ধু। তুমি এতবড় ঝুঁকি নিয়ো না। সকলেই বলে উঠল।

আমার কিছু করার নেই ভাই। আমাকে যেতেই হবে। তোমরা বারণ কোরো না।

মঙ্কু যখন জেদ করেছে তখন ও করেই ছাড়বে। বারণ করলেও শুনবে না। আসলে ওর স্বভাবটাই এমন। জঙ্গলের সকলে ওকে খুব ভালোবাসে। এই জঙ্গলের একনম্বর বদ্যি হল ও। মানে ডাক্তার। কারও কোনও শরীর খারাপ হলে কোন গাছের পাতা বা শেকড় খাওয়াতে হবে সব ওর জানা। আর সেই ওষুধ যত দূরেই হোক না কেন ও ঠিক নিয়ে আসবেই। হাজার হোক হনুমানজির বংশধর বলে কথা। বিশল্যকরণী নিয়ে আসার অভ্যাসটা এখনও রক্তে রয়ে গেছে। কিন্তু মঙ্কুর যদি মানুষদের রাজ্যে গেলে কোনও ক্ষতি হয় সেই আশঙ্কাতেই রইল সবাই।

 

 

সকলকে বিদায় দিয়ে পরদিন ভোর ভোর রওনা দিয়ে দিল মঙ্কু। পিঠে ওই ভারী বস্তা। আকাশে ওর সঙ্গে উড়তে উড়তে পথ দেখাতে থাকল চিল।

অনেক পথ। শেষ আর হয় না। পিঠে অত বড় ভারী বস্তা নিয়ে জঙ্গল মাঠ, নদী পেরিয়ে প্রায় বিকেলের দিকে পৌঁছাল, তখন ক্লান্তিতে পিঠ প্রায় বেঁকে গেছে। প্রচণ্ড ক্লান্তি। তাই নিয়েই কোনওমতে ঢুকল মানুষদের রাজ্যে। খুব বেশিদূর যেতে হল না, একটু পরেই মানুষদের হইহই, ওই দেখ দেখ একটা বাঁদর এসেছে, পিঠে কীসের যেন একটা ঝোলা...

মঙ্কু রাজবাড়ি খুঁজতে শুরু করল কিন্তু খোঁজার উপায় কই? বজ্জাত মানুষরা এতই অসভ্য যে ঢিল ছুড়ে লাঠি দিয়ে খুঁচিয়ে মঙ্কুকে অস্থির করে তুলল। যেভাবেই হোক ওদের জানতেই হবে ওই বস্তায় কী আছে? মঙ্কু গাছে গাছে লাফিয়ে অনেক চেষ্টা করল পালানোর, কিন্তু শরীর ছিল বেজায় ক্লান্ত, তার ওপর আবার পিঠে ওই বোঝা। শেষ রক্ষা আর হল না। গাছ থেকে ধপ করে বস্তা সমেত পড়ল মাটিতে আর সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে কতগুলো রাজ পেয়াদা এসে আগেই ওই বস্তাটা খুলে দেখে বলল এই ব্যাটাই তাহলে চোর, ব্যাটা চোর বাঁদর। চল রাজা মশায়ের কাছে। তোকে আচ্ছাসে শিক্ষা দিতে হবে। গোটা গায়ে ব্যথা নিয়ে, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মঙ্কু চলল রাজার কাছে। কেউ শুনল না ওর কথা। রাজ্য জোড়া লোকে জেনে গেল রাজকোষের চুরি যাওয়া জিনিস পাওয়া গেছে, চোর হল একটা বাঁদর।

মঙ্কুর জায়গা হল খাঁচায়। বেচারার কথা কেউ শুনল না। রাজা মশাইও মঙ্কুর সঙ্গে দেখা না করেই আগে সাজা দিয়ে ফেললেন। পোরো ব্যাটাকে খাঁচায়। আর আকাশ থেকে চিল পুরো ব্যাপারটাই দেখে নিয়ে আবার উড়ে চলল জঙ্গলে। সবাইকে খবরটা দিতে।

 

 

এ তো ভারি অন্যায় হল। বেচারা গেল রাজার জিনিস ফেরত দিতে আর ওকেই কি না চোর ভেবে খাঁচায় ভরে দিল।

আমরা যে আগেই বলেছিলাম ওই মানুষদের স্বভাব ভালো না। ওরা খালি উলটো বোঝে। মঙ্কু আমাদের কথাই শুনল না।

থামো তোমরা। সিংহ মশাই ধমক দিলেন সকলকে। আমাদের সবথেকে প্রিয় বন্ধু খাঁচায় ভর্তি আর তোমরা কি না এখন ঠিক বেঠিক নিয়ে আলোচনা করছ।

তাহলে কী উপায় এখন মহারাজ আপনিই সিদ্ধান্ত দিন।

আমার সিদ্ধান্ত হল, আমরা কাল সকালে বনের সব পশুপাখিরা মিলে ওই মানুষ রাজার কাছে দরবার করতে যাব। আশাকরি আমরা সকলে মিলে বললে উনি শুনবেন।

কিন্তু মহারাজ...কুমির প্রশ্ন তুলল।

হ্যাঁ বলো।

ওই মানুষ রাজামশাই যদি আমাদের কারও কথাই না শুনে সকলকেই খাঁচায় ভরে দেন তাহলে কী হবে?

উফ তুমি থামো তো কুমির! আজেবাজে কথা বোলো না। বনের এত পশুপাখিকে খাঁচায় ভরে উনি কি চিড়িয়াখানা বানাবেন নাকি! আশ্চর্য।

সবাই হো হো করে হেসে উঠল সিংহের কথায়।

তাহলে?

তাহলে আমরা সকলে কাল যাব ওই রাজার কাছে। সবাই মিলে বলব আসল কথাটা।

সেই শুনে সকলেই হইহই করে সায় দিয়ে উঠল। কুমিরের চোখে একটু জল এল বটে, এতটা রাস্তা আবার কষ্ট করে যেতে হবে। কিন্তু কুম্ভীরাশ্রু বলে কেউ পাত্তা দিল না।

 

 

পরদিন প্রায় সন্ধের মুখে প্রায় হাজার খানেক পশুপাখি মিলে যেই মানুষদের রাজ্যে গিয়ে পৌঁছেছে মানুষদের মধ্যে সে কি হইচই। সকলেই ভেবে নিয়েছে জঙ্গলের সব পশুরা এসেছে ওদের আক্রমণ করতে। তারাও সব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত। খবর গেল রাজা মশাইয়ের কাছে। তিনিও রাজ্যের সব সৈন্যকে পাঠিয়ে দিলেন লড়াইয়ের জন্য। তিনি নিজেও ঘোড়ায় চড়ে চললেন লড়াইয়ে। বনের পশুরা সব একসঙ্গে আক্রমণ করতে এসেছে এমন ব্যাপার উনি জীবনে শোনেননি। কাজেই ব্যাপারটা জানারও বেশ কৌতূহল ওর।

লড়াই প্রায় শুরু হয়, কিন্তু রাজা মশাই দেখলেন পশুগুলো কেউ কিন্তু ওদের আক্রমণ করছে না। বরং তারস্বরে নানা শব্দে চিৎকার করছে।

সেনাপতি আক্রমণের হুকুম সবে দিতে যাবেন তাকে থামালেন রাজা। ব্যাপার কী বলো তো সেনাপতি। পশুগুলো অমন চিৎকার করছে কেন?

বুঝতে পারছি না মহারাজ।

আমার মনে হচ্ছে ওরা যেন কিছু বলতে চাইছে আমাকে। এক কাজ করো, তুমি ওদের পশুরাজের সঙ্গে গিয়ে আগে কথা বলো।

যথা আজ্ঞা। সেনাপতি বল্লমের আগায় সাদা নিশান বেঁধে ঘোড়ায় চড়ে একা গেলেন পশুদের দিকে। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। এই বুঝি বন্য জন্তুগুলো ঝাঁপিয়ে পরে আমার ওপর। কিন্তু সিংহের কাছে গিয়ে সেনাপতি যখন হাতজোড় করে প্রণাম জানালেন, পশুরাজও থাবা তুলে স্বাগত জানালেন তাকে।

হে পশুরাজ আপনাদের এই মানুষ রাজ্যে আসার কারণ কি জানতে পারি।

হ্যাঁ আমি আপনাদের রাজার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

তাহলে অনুগ্রহ করে আমার সঙ্গে আসুন।

সিংহ গেলেন রাজার কাছে। পরস্পরে প্রণাম বিনিময়ের পর রাজা মশাই বললেন বলুন পশুরাজ আপনাদের এখানে আগমনের কী হেতু। জঙ্গলে নিশ্চয়ই দাবানল ঘটেনি পূর্বের মতো।

না মহারাজ আমরা সকলে কুশলেই আছি আপনার শুভেচ্ছায়। কিন্তু সমস্যা যা হল...। বলে পুরো ঘটনাই রাজার কাছে সবিস্তারে জানালেন পশুরাজ।

পুরো ঘটনা শুনে রাজামশাই লজ্জায় জিভ কেটে বললেন, আমাকে ক্ষমা করবেন পশুরাজ আমারই অজ্ঞাতে মস্ত ভুল হয়ে গেছে। ছি ছি...এই কে আছিস, কাল যে পবননন্দনকে খাঁচায় ভরেছিলি এক্ষুনি তাকে সসম্মানে আমার রাজসভায় নিয়ে আয়। আর আপনারাও অণুগ্রহ করে আসুন সভায়। অনেকদিন পর আপনাদের আগমন ঘটল। দয়া করে আমরা আতিথ্য গ্রহণ করে আমার পাপস্খলনের সুযোগ দিন।

সকলেই জয় মহারাজের জয়, জয় পশুরাজের জয়ধ্বনি দিয়ে উঠল।

 

 

তারপরে যা হয় আর কি। ওই সেই চোরগুলো ধরা পড়ল আর তিন দিন ধরে চলল ধুমধাম রাজার আদর। এলাহি খাওয়া-দাওয়া, উৎসব। আর মঙ্কুর কাছে বার বার ক্ষমা চেয়ে মহারাজ নিজের গলা থেকে মুক্তোর মালা খুলে পরিয়ে দিলেন মঙ্কুর গলায়। কুমির খুক খুক করে কেশে বলল শেষ পর্যন্ত সত্যিই বাঁদরের গলায় মুক্তোর মালা। তবে বেশ মানিয়েছে কিন্তু!

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন