বিনোদ ঘোষাল

পাক্কা সাড়ে আটশো গ্রাম ওজনের একটা জ্যান্ত রুইমাছ থলেতে ভরার পরেও বিনয়বাবুর মনে এতটুকু শান্তি নেই। আরও বড় মাছ পেলে ভালো হত। এরপর মাটন কিনতে হবে। আজ ঘরে এলাহি খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা। তার কারণ আছে।
বরাবরই তিনি বাজার করতে ভালোবাসেন। রোজের বাজার রোজ করেন। সবজি তো নয়ই, এমনকী মাছ-মাংসও ফ্রিজে রাখতে বিলকুল অপছন্দ করেন। তার যুক্তি হল ফ্রিজ আসলে একটি হাফ মিনি মর্গ। আর সেখানে মাছ-মাংস রাখা মানে সেটা ফুল মর্গে পরিণত হওয়া। সুতরাং মর্গের জিনিস তিনি মুখে তুলবেন না। এই কারণে রোজ পরিমাণ মতো বাজার করেন, এবং রোজ সেই খাবার খেয়ে ফেলেন। কোনও রাখারাখির ব্যাপার নেই। বরফ দেওয়া চালানি মাছ মুখে তোলেন না। একমাত্র জ্যান্ত তিরিং বিরিং লাফানো মাছ দেখলে তবেই দর করেন। বাড়ির কাছে যে বাজারটা রয়েছে সেখানেই রোজ সকালে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসেন। মর্নিং ওয়াক কাম বাজার দুটোই একসঙ্গে হয়ে যায়।
বাড়িতে লোক বলতে তিনি একাই। বিয়ে থা করেননি। তারও যথেষ্ট কারণ রয়েছে। সেই কথা একটু পরে বলা যাবে। পৈতৃক দোতলা বাড়ির ওপরের তলায় থাকেন তিনি একা। দুটো বড় ঘর। একটা রান্নাঘর, এ্যাটাচ পায়খানা বাথরুম। আর নীচের তলায় দুইঘর পুরোনো ভাড়াটে। তাদের সঙ্গে বিনয়বাবুর সম্পর্ক বেশ ভালো।
গত দশ বছরে একটাকাও ভাড়া বাড়ানোর কথা বলেননি তিনি। দরকারও নেই। কারণ জীবনে চাকরিবাকরি না করলেও বিনয়বাবুর টাকাপয়সা নেহাত কম নয়। তেলকল, চালকলের মালিক বাবা আজীবন কঠোর পরিশ্রম করে যা রেখে গেছেন তাতে বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান এবং অকৃতদার বিনয়বাবুর আরামসে চলে যায়। বরং ভাড়াটে থাকার জন্য দুইপক্ষেরই দেদার সুবিধা হয়েছে। সুবিধাটা হল এই যে, বিনয়বাবু রোজ যে পরিমাণে বাজার করেন তা তার একার জন্য অনেকটাই বেশি। আবার বাসি মাছ সবজি তিনি কিছুতেই খাবেন না। এমনকী সকালের রান্নাও রাতে মুখে দেন না। তাই রান্নার মাসিকে রোজই দুইবেলা সব বাজারটাই রান্না করতে হয়। বিনয়বাবু যে প্রচুর পরিমাণে খেতে পারেন তাও নয়, উনি খাদ্যরসিক কিন্তু স্বল্পাহারী। তাহলে বাকি রান্নাটুকু কী হয়? বাকিটুকু প্রতিদিন দুইবেলা নীচের দুইঘর ভাড়াটেদের মধ্যে বিতরণ হয়। দীর্ঘকাল ধরেই এমন চলছে। এখন সকাল হলেই নীচের ভাড়াটে বঙ্কুবাবু আর উল্লাসবাবু নীচ থেকে হাঁক পেড়ে জেনে নেন, অ বিনয়দা আজ কী বাজার আনবেন? মানে সেইসব জিনিসগুলো তারা আর কিনবেন না।
তবে সবকিছুরই বিনিময়মূল্য চোকাতে হয়। নীচের দুইঘর ভাড়াটেরও হয়। বেশ অন্যরকমের মূল্য। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বিনয়বাবুর জীবনেও চাকরি না করা, অবিবাহিত থাকার কারণও।
বিনয়বাবু গপ্পো লিখতে ভালোবাসেন। ছোটবেলা থেকেই তার এই দুরন্ত শখ। পিতৃদেবের ইচ্ছে ছিল ছেলেও তার পথ ও মত অনুসরণ করে চালকল ও তেলকলের দায় নেবে। কিন্তু তা তো হল না। ছেলে গেল সাহিত্যচর্চায়। বাপ-ছেলের কথা বন্ধ। তাও বিনয়বাবু নাছোড়। শেষমেষ বাবা খুব দু:খ নিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। তারপর থেকে সাহিত্যচর্চায় আর কোনও বাধা রইল না।
দিনে দিনে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখতে থাকলেন বিনয়বাবু। পৃষ্ঠা জমে জমে পাহাড়। সাধ হল পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করার। স্বাভাবিক সাধ। পাঠাতেও শুরু করলেন। কিন্তু এই পোড়া দেশে প্রকৃত গুণীর কদর কোনওকালেই নেই। সব গুণীরাই মৃত্যুর পর খ্যাতি পেয়েছেন। বিনয়বাবুর ক্ষেত্রেও তাই-ই হল, যে দ্রুততায় লেখাগুলি পত্রপত্রিকায় জমা পড়তে থাকল তার থেকেও অবিশ্বাস্য দ্রুততায় সেইগুলি ফেরত আসতে থাকল। পৃথিবীতে শুভানুধ্যায়ীর অভাব নেই, বিনয়বাবুরও ছিল না। তেমনই একজন শুভানুধ্যায়ী জানালেন ডাকে লেখা পাঠিয়ে কোনও লাভ নেই, সম্পাদকরা পড়েন না। লেখককে নিজে গিয়ে সম্পাদকের হাতে জমা দিতে হয়। শুধু কাগজ নয়, সঙ্গে আরও কিছু। বিনয়বাবু তাই করলেন। মাত্র খান সাত-আটেক গল্প আর এক কেজি করে রসগোল্লার হাড়ি নিয়ে সম্পাদকদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করলেন। কিন্তু দেখা গেল শুধু রসগোল্লাই বরবাদ। লেখা ছাপার নাম নেই। শেষ পর্যন্ত রসগোল্লার মায়া ত্যাগ করে সম্পাদকরা দেখা করাও বন্ধ করে দিলেন বিনয়বাবুর সঙ্গে। ফোনও তুলতেন না।
বিনয়বাবুর পেট ফুলতে লাগল, হাজার হাজার সাহিত্যকর্ম কাকে শোনাবেন? রাতে ঘুম হয় না। সারাদিন কোনও কাজে মন লাগে না। এমনকী সাহিত্যচর্চার ব্যাঘাত হতে পারে এই ভয়ে বিয়েও করেননি তিনি। কিন্তু এতকিছুর পরেও হাল ছাড়লেন না তিনি। শেষ পর্যন্ত বেছে নিলেন শেষ রাস্তাটুকু। একদিন পাকড়াও করলেন নীচের ভাড়াটিয়া বঙ্কুবাবুকে। বঙ্কুবাবু তখন অফিস যাওয়ার তাড়ায় ছিলেন।
আজকাল তো আপনার দেখাই পাই না। আসুন ঘরে একবার।
বঙ্কুবাবু আর কী করেন? বিনি পয়সায় রোজ দুইবেলা ভালোমন্দ তরকারির বাটি। রাজি হলেন। ভাবলেন কতক্ষণই বা সময় লাগবে। গেলেন বিনয়বাবুর ঘরে। ছাড়া পেলেন পাক্কা সাড়ে তিন ঘণ্টা পর। ততক্ষণে বঙ্কুবাবু বিধ্বস্ত আর বিনয়বাবু যেন ধড়ে প্রাণ ফিরে পেলেন। আহ শরীরটা যেন পালকের মতো হালকা লাগছে। এতদিনের জমানো চাপ তিন ঘণ্টায় পুরো সাফ। পরের দিন দুই ভাড়াটিয়ার ঘরে মাটনের বড় বাটি গেল এবং আবার বঙ্কুবাবুকে ডাক।
পর পর তিনদিন এমন ঘটনার পর বঙ্কুবাবু বেজায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার বললেন প্রেশারটা আচমকা কোনও শক পেয়ে বেড়ে গেছে। ফুল রেস্ট। তাহলে উপায়? এবার বিনয়বাবু ধরলেন আরেক ভাড়াটিয়া উল্লাসবাবুকে। চারদিনের মাথায় উল্লাসবাবুরও তুমুল জ্বর। সঙ্গে প্রলাপ, ওই ওই গল্প আসছে...না, না, আমি যাব না...আমাকে ছেড়ে দাও।
পর পর দুটো ভাড়াটিয়াই এমন অসুস্থ হয়ে পড়ায় বেজায় মুষড়ে পড়লেন বিনয়বাবু। লেখার যে জোয়ার এসেছিল তা আচমকাই থেমে গেছে। বিনয়বাবুর গল্পের বিশেষত্ব হল তিনি চিরকাল করুণ রসের গল্প লিখে এসেছেন। স্বভাবেও নিজে খুব গম্ভীর। হাসি-মজা একেবারেই পছন্দ করেন না। তাই তার গল্পগুলোও অত্যন্ত দু:খের হয়। বিনয়বাবু ধরেই নিলেন যে তার ওই করুণ গল্প শুনেই দুইজন ভাড়াটে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এতটা আঘাত সইতে পারেননি। তাই তাদের চিকিৎসার দায়িত্বও তিনি নিয়ে নিলেন। এদিকে ওই দুজন সুস্থ হওয়ার পরও অসুস্থ সেজে থেকে গোপনে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করল। বাঁচতে তো হবে। আর এই বাজারে এমন বাড়ি ছেড়ে পালানোর কোনও প্রশ্নই নেই। দিন তিনেকের মাথায় ওই দুজন ভাড়াটিয়ার স্ত্রী বিনয়বাবুর কাছে এসে উপস্থিত। সঙ্গে আরেকটি বছর কুড়ির ছেলে।
দাদা এই ছেলেটিকে নিয়ে এলাম। ওর নাম কর্ণ। আমাদের কমন দু:সম্পর্কের আত্মীয়। গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে। আপনার কথা বলায় একছুটে নিজের বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে শুধু দুইবেলা আপনার গল্প শুনবে বলে। ও কথা বলতে পারে না, কিন্তু গল্প শুনতে আর পড়তে খুব ভালোবাসে।
আরে বাহ, তাই নাকি! এ তো খুবই ভালো কথা। বিশেষ করে কথা বলতে পারে না যখন তাহলে তো খুবই ভালো। কারণ গল্প শোনানোর সময় শ্রোতা কথা বললে ভারী বিরক্ত লাগে। বিনয়বাবুর বুক আনন্দে ভরে উঠল।
তার পরদিন থেকে কর্ণ ছেলেটি রোজ সকাল হলেই বিনয়বাবুর কাছে চলে আসে আর উনি তাকে একের পর এক করুণ গল্প শুনিয়ে যান। ছেলেটা সাহিত্যের সাচ্চা সমঝদার। কোনও রা কাটে না। গল্প শোনার কিছুক্ষণ পর থেকেই হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে। ওর কান্না দেখে বিনয়বাবুরও আনন্দে কান্না এসে যায়। তার মানে এতকালের সাহিত্যরচনা বিফলে যায়নি। তার সাহিত্যের সাচ্চা সমঝদার এখনও রয়েছে। ছেলেটিকে মনেপ্রাণে ভালোবেসে ফেললেন তিনি। আর আরও বেশি করে কৃতজ্ঞ হয়ে উঠলেন দুই ভাড়াটিয়ার ওপর।
দিব্বি চলছিল। এরমধ্যে একটি কাণ্ড ঘটল। পাড়ার দুর্গাপুজোয় প্রতিবছরই ক্লাবকে মোটা টাকা চাঁদা দেন বিনয়বাবু। কয়েকদিন আগে ছেলেরা চাঁদা চাইতে এসে বলল কাকু শুনলাম আপনি নাকি গল্প-টল্প লেখেন, তা আমাদের পুজোর সুভিনিয়রের জন্য একটা গপ্পো লিখে দিন না। আমরা ছাপব।
নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলেন না বিনয়বাবু। ছেলেগুলো কী বলছে!
হ্যাঁ, লিখব না কেন, অবশ্যই লিখব। কী ধরনের লেখা চাও বলো?
একটু মজাদার কিছু দিন।
মজাদার! কিন্তু আমি যে মজার গল্প লিখি না ভাই।
কিন্তু সুভিনিয়রে কাকু হাসি-মজার গল্প দিলেই ভালো হবে।
আচ্ছা বেশ, তাই দেব। রাজিই হয়ে গেলেন। এতবড় সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
পুরো দুদিন উদয়াস্ত পরিশ্রম করে লিখেই ফেললেন একখানা হাসির গল্প। সাংঘাতিক হাসি। নিজেই লিখতে লিখতে বহুবার গুরুগম্ভীর বিনয়বাবু কখনও হো হো করে কখনও মুচকি কখনও ফিকফিক করে হেসেছেন। সারারাত জেগে গল্পটা শেষ হওয়ার পর ভেবেছেন হাসির গল্প লেখার মতো সহজ আর কিছু হয় নাকি?
পরদিন সকালে কর্ণ আসতেই ওকে বসিয়ে গল্পটা শোনাতে শুরু করে দিলেন বিনয়বাবু। শিয়োর ছিলেন দ্বিতীয় লাইন থেকেই ছেলেটা হো হো করে হাসতে শুরু করবে। কিন্তু তা তো হল না। বরং প্রতিদিন যা হয়, একটা প্যারা শোনার পর থেকেই রোজের মতো ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করে দিল কর্ণ।
ব্যাপার কী? হাসির গল্পে কাঁদে কেন ছোঁড়া?
এতদিন যা বুঝতে পারেননি, তা আজ কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে গেলেন বিনয়বাবু। ছেলেটা শুধু কথাই বলতে পারে না তা নয়, কানেও শুনতে পায় না। একেবারে বোবা কালা। ওকে নীচের শয়তান ভাড়াটিয়া দুটো মিলে ফিট করেছে। শিখিয়ে দিয়েছে বাবু যাই পড়ুক, মিনিট দুয়েকের মধ্যেই তোকে কাঁদতে হবে। ব্যস, এটাই তোর চাকরি। বিনয়বাবু ভয়ংকর রেগে গেলেন। ভাবলেন এক্ষুনি এটা নিয়ে থানাপুলিশ করা উচিত। পুরো ফ্রড কেস। সবক'টাকে জেল খাটাতে হবে। কিন্তু একটু পরে নিজেই চুপষে গেলেন। এইসব কথা সাতকান না করাই ভালো। তার চেয়ে যেমন চুপচাপ চলছে চলুক। আহা বোবা কালা ছেলেটার তো কোনও দোষ নেই। বরং এই ঘটনাটাকে নিয়েই একটা গল্প লিখলে কেমন হয়? লিখে ফেললেন। আবার একটি পত্রিকায় পাঠিয়েও দিলেন ছাপা হবে না জেনেও।
কিন্তু বিনয়বাবুকে অবাক করে দিয়ে সেই পত্রিকার দফতর থেকে ফোন। গল্পটি মনোনীত।
এ যে আশাতীত! এমনও হয়! আনন্দে কী করবেন বুঝে উঠতে না পেরে দুইঘর ভাড়াটিয়াকে দুবেলাই নেমন্তন্ন করে ফেললেন তিনি। তারপর বাজারে ছুটলেন।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন