লকাই আর সেই লোকটা

বিনোদ ঘোষাল

লকাই আর সেই লোকটা

 

নেকদিন পর খাসা একটা রাত পড়েছে আজ। কাজকম্ম মনে হচ্ছে ভালোই হবে। ভেবে নিয়ে গায়ে চাপানো কালো রঙের কম্বলটা আরও ভালো করে জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে সিটের ওপর পা তুলে বসল লকাই।

এখন রাত্তির পৌনে দুটো বাজে। আর পাঁচ মিনিট পরেই সিক্স থ্রি ফাইভ জিরো ওয়ান আপ বর্ধমান লোকাল ট্রেনটা হাওড়া থেকে ছাড়বে। বর্ধমান পৌঁছোবে পৌনে চারটে নাগাদ। মাঝে একটামাত্র হল্ট। ঝড়ের বেগে যায় ট্রেনটা। প্যাসেঞ্জার প্রায় থাকে না বললেই চলে। তবু যে দু-একজন থেকে যায়, তাদের নিয়েই কাজ করতে হয় লকাইকে।

গত চার বছর ধরে এখানেই ডিউটি লকাইয়ের। প্রথমদিকে বেশ মজা লাগত, কিন্তু এখন আর ভালো লাগে না। ট্রান্সফারের জন্য অনেকবার আর্জি জানিয়েছে ওপর মহলকে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। কবে শিকে ছিঁড়বে, জানা নেই। অগত্যা মুখ গুঁজে কাজ করে যাও।

তবে আজকের দিনটা, মানে রাতটা, মনে হচ্ছে ডিউটি করতে বেশ মজাই লাগবে। কারণ সন্ধে থেকেই তুমুল ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। ফলে কয়েকদিনে যে গুমোট গরমটা পড়েছিল, তা আজ আর নেই। বরং বেশ একটা ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদার। এখন অঝোরে বৃষ্টিটা বন্ধ হলেও টিপটিপ করে পড়ছে। লকাইদের কাজের জন্য একদম আদর্শ রাত্তির।

যে কম্পার্টমেন্টে লকাই বসে রয়েছে সেখানে এখনও কোনও প্যাসেঞ্জার ওঠেনি। তবে উঠবে অবশ্যই। এই বগিতে না উঠলেও অন্য কোনও বগিতে উঠবেই। আর অন্য কোনও বগিতে উঠলে সে বগিতে চলন্ত ট্রেনেও চলে যাওয়া লকাইয়ের পক্ষে বাঁ-হাতের খেল। শিকারের অপেক্ষায় চুপ করে জানলার ধারের একটা সিটে বসে রইল ও। ট্রেন হুইসেল দিয়ে ছেড়েও দিল। প্ল্যাটফর্ম ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে টপাক করে একটা লোক যেন হাওয়ায় ভর করে টুক করে উঠে পড়ল লকাইয়ের কম্পার্টমেন্টে। এসে লকাইয়ের উলটোদিকের সিটে বসল।

ওহহ! শিকার একেবারে হাতের সামনে! সুরুৎ করে জিভের জল টেনে নিল লকাই। লোকটাকে ভালো করে মাপতে শুরু করল। সাদা ধপধপে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে থাকলেও পোশাকের ভেতরে চেহারাটা পুরো পেটাই, তা আন্দাজ করাই যায়। ফরসা ধপধপে। ব্যাকব্রাশ করা কালো চুল। লোকটার বয়সও বেশি নয়। তবে আন্দাজ করা যাচ্ছে না। চল্লিশও হতে পারে, আবার পঞ্চাশও হতে পারে। সে যাই হোক। আরেকটু সময় যাক। তারপরেই খেল শুরু করবে ও।

ট্রেন স্পিড নিয়ে নিয়েছে। ঘন অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে হু হু করে ছুটছে। আর মাঝেমধ্যে হুইসল দিচ্ছে। এই ট্রেনটা বর্ধমান পর্যন্ত মাঝে যে একটাই মাত্র স্টেশনে দাঁড়ায়, সে-স্টেশন আসতে ঢের দেরি। নাহ, এবার খোশ গল্পটা শুরু করতে হবে। আগে গল্পগাছা করে শিকারের মন ভুলিয়ে দিতে হবে। তার পরেই আসলি খেল। এটাই লকাইদের দস্তুর বা নিয়মবিধি।

লকাই গলা খাঁকরে জিগ্যেস করল, মশায়, যাবেন কোথায়?

বাঙালি?—লকাইয়ের প্রশ্নের উত্তরে পালটা প্রশ্ন করল লোকটা। ভারী এবং ভাবলেশহীন গলা।

অ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ। একেবারে সাতপুরুষ ধরে বাঙালি। আমি নিজেও একশো বছর ধরে বাঙালি।—খুক খুক করে হাসল লকাই।

লোকটা শুধু বলল, হুম।

লকাই বুঝল, ওর রসিকতার ভেতরে যে সত্যিটা লুকিয়ে রয়েছে, সেটা ধরতে পারেনি লোকটা।

—তা যাবেন কোথায় আপনি?

—বারডোয়ান জাংশন।

—অ্যাঁ, সেটা আবার কোথায়? এটা তো বর্ধমানে যাবে।

—ওখানেই যাব।

—ওহ! বেশ বেশ। তা মশায় কি আগের ট্রেন মিস করেছেন? কলকাতায় কাজে এসে দেরি করে ফেলেছিলেন বোধ হয়?

—না। আমি এই ট্রেনেই যাব।—একইরকম নিরুত্তাপ গলায় উত্তর দিল লোকটা।

একটু থমকাল লকাই। বলে কী! এত রাতের ট্রেনে কেউ শখ করে যায় নাকি?

—তা ওখানে কি জ্ঞাতিবাড়ি রয়েছে? মানে আত্মীয়-কুটুম...।

—জানি না।

—সে কী! তাহলে উঠবেন কোথায়?

—জানি না।

আচ্ছা জ্বালা তো! মনে মনে বিরক্ত হল লকাই। লোকটার কথা বলার কোনও ইচ্ছেই নেই। বরং এমন অপলক লকাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে যে নিজেই একটু ঘাবড়ে যাচ্ছে লকাই। মনে হচ্ছে, বেশ শক্ত ধাতুর মানুষ। গুন্ডা, ডাকাত-ফাকাত হবে বোধহয়। আজকাল তো আবার ডাকাতরা এমন ভদ্দরলোকেদের মতো ড্রেস দিয়েই ডাকাতি করতে যায়।

লকাই যখন ছোট ছিল, তখন বিশে ডাকাত, রঘু ডাকাত, চণ্ডী ডাকাত এদের নিজে চোখে দেখেছে। কী সব সাংঘাতিক চেহারা ছিল তাদের! খালি গা, মালকোছা মারা খেটো ধুতি, মাথায় লাল ফেট্টি, কপালে মা কালীর লাল টকটকে সিঁদুর। জবাফুলের মতো চোখ। আর হাতে থাকত পাকানো লাঠি কিংবা বল্লম।

হা রে রে রে রে রে বলে গর্জন তুলে যখন গ্রামের কোনও মহাজন বা বড়লোক চাষার বাড়িতে দলবল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ত, তখন গাঁয়ের সব্বার পিলে আরও ভেতরে সেঁধিয়ে যেত। মনে হত, ডাকাত পড়েছে বটে। আর এখন সব ফিটফাট ভদ্দরলোকবাবু সেজে আসবেন, তারপর আচমকা পকেট থেকে একটা বন্দুক কিংবা বোমা বার করে সবাইকে হাত তুলিয়ে চুপচাপ কাজ সেরে চলে যাবেন।

পুলিশ তো কোন ছার, যাদের সব গেল তাদেরও টের পেতে বেশ কিছু সময় লাগে ডাকাতি হয়েছে সেটা বোঝার জন্য। ছো ছো! কী দিনকাল পড়ল! এই লোকটা নির্ঘাত ডাকাতদলেরই হবে। বাকিরা সব অন্য বগিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। বর্ধমানের কোনও বাড়ি কিংবা ব্যাঙ্কে ডাকাতি করে আবার ফার্স্ট ট্রেনে ফিরে আসবে, তেমনই ধান্দা।

—তা মশায় কি বিশেষ কোনও কাজ-টাজে যাচ্ছেন নাকি? ওখানে?

—হুঁ।

—একাই যাচ্ছেন?

—হুঁ।

ধুসসস! এ তো পুরো মুখে কুলুপ এঁটে পাথরের মূর্তি হয়ে বসে রয়েছে। এর সঙ্গে গপ্প তেমন জমবে না। এবার আসল কাজে নেমে পড়তে হবে।

গলা খাঁকরে লকাই বলল, আমি অবশ্য রোজই এই ট্রেনেই যাই।

—আচ্ছা।

—মানে গত ছ'-সাত বছর ধরে যাওয়া-আসা করছি আর কি কাজের সূত্রে।

—হুম।

কী কাজ সেটা জানতে চাইবেন না? আশ্চর্য লোক তো মশাই আপনি!—এবার বিরক্তিটা প্রকাশই করে ফেলল লকাই।

—বলুন কী কাজ!

এই আপনাদের মতো মানুষদের ভয়-টয় দেখানো আর কি।—বলে সাদা ঝকঝকে দাঁত বার করে খিকখিক শব্দ করে হাসল লকাই।

আচ্ছা। ভয় কেমন দেখতে?—লোকটা একইরকম নির্বিকারভাবে প্রশ্ন করল।

মনে মনে অনেকটাই দমে গেল ও। মুখে বলল, একটু পরে আমিই দেখাচ্ছি কেমন দেখতে। আমি কে জানেন? মরিয়া হয়ে জিগ্যেস করল লকাই। নাহ...অন্যান্য দিনের মতো আবহটাই তৈরি হচ্ছে না আজ। ধুস। অন্যদিন হলে এইসময় মানুষগুলো অনেকটাই ঘাবড়ে যেত লকাইয়ের অমন হাসি শুনে। কিন্তু এই লোকটা...!

—জানেন কে আমি?

—আপনি একজন মানুষ।

হয়নি, হয়নি।—বলে এবার অট্টহাসি প্রয়োগ করল লকাই। এটা ওর স্পেশাল হাসি। খল খল করে হাড় হিম করা যখন এই হাসিটা দেয়, তখন মানুষ তো কোন ছার, জন্তুজানোয়াররাও ভয়েতে দৌড়ে পালাতে থাকে।

লোকটা খুব মন দিয়ে শুনল হাসিটা। তারপর আবার জানলা দিয়ে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকাল। আর এই প্রথমবার নিজে থেকে জিগ্যেস করল, বারডোয়ান আসতে কতক্ষণ লাগবে?

আরে ধেত্তেরি! নিকুচি করেছে তোর বারডোয়ান। আমাকে জানিস? কে আমি?

মানুষ।—আবার একই উত্তর দিল লোকটা।

আরে সেটা পঞ্চাশ বছর আগে ছিলাম। আর এখন দ্যাখ কে আমি?—বলে গায়ে জড়ানো কম্বলটা এক ঝটকায় সরিয়ে দিল লকাই। ট্রেনের অল্প আলোয় দেখা গেল ওর গায়ে মাংস বলতে কিছুই নেই। পুরোটাই কঙ্কাল। নিজের মুখটাও পালটে করোটি করে ফেলল। ফেলেই আবার হাড়-কাঁপানো হাসি। ফাঁকা ট্রেনের ঝমঝম শব্দকে ছাপিয়ে গেল সেই খলবলে হাসি।

শুধু হেসেই ক্ষান্ত রইল না লকাই। মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে কয়েকবার নাচানাচি করল। অনেকদিন পর এতটা পরিশ্রম করতে হল লকাইকে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে তুমুল ভয় দেখানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে আবার সিটের ওপর ধপ করে বসে পড়ল।

উফ! বাপরে বাপ! কী খাটনি। মানুষ হলে এতক্ষণে একবালতি ঘেমে যেত। নেহাত ভূত বলে ও-সব ঘামটাম হয় না। কিন্তু সামনের আহাম্মকটা ভয় পাওয়া তো দূরের কথা, একইরকম ভ্যাবলাকান্তর মতো তাকিয়ে রয়েছে।

এবার লকাইয়ের সন্দেহ হল। লোকটা পাগল-টাগল নয়তো! কারণ একমাত্র পাগল ভবঘুরে, এবং ফুটপাতবাসী ভিখিরিরা কোনও কিছুতেই ভয় পায় না। এরা ভয়কে জয় করে ফেলেছে। তাই ভূতসমাজের নিয়মাবলিতে এদের ভয় দেখানো বারণ।

লকাই করুণভাবে জিগ্যেস করল, পেলে ভয়?

—কোথায়? দিন?

—এই তো দেখালাম এতক্ষণ।

—ওহ, আচ্ছা। এটাই ভয়? বেশ মজার।

—মজার! হতভাগা! এত পরিশ্রম করে ভয় দেখালাম, এটা তোর মজার মনে হল! ছাগল একটা!

লোকটা একটুও রাগল না। শুধু জিগ্যেস করল, তাহলে আপনি কে?

—আমি ভূত। ভূত বুঝিস? এঁড়ে কোথাকার!

—আচ্ছা, তোমার নাম ভূত।

উফফ! এ কার পাল্লায় পড়লাম আজ। বলব না যা।—বলে গুম হয়ে বসে রইল লকাই। রাগের চোটে মাথা ঝনঝন করছে।

দুজনেই বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর লকাই বেশ কাতর কণ্ঠেই জিগ্যেস করল, এই মাইরি, তুমি সত্যিই একটুও ভয় পাওনি?

—হ্যাঁ পেলাম তো! আপনি দিলেন। আমার বেশ মজার লেগেছে। রেকর্ড করে নিয়েছি মেমারিতে।

হুম!—বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল লকাই। আপদটা ভয় কাকে বলে সেটাই জানে না তো পাবে কী!

—আপনার আরও ভয় থাকলে আমাকে দিতে পারেন।

আর মাথা ঠিক রাখতে পারল না লকাই। তবে রে, দাঁড়া! তোর মজা দেখাচ্ছি।—বলে এক লাফে লোকটার ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল লকাই। দু-হাত দিয়ে ঘাড়টা চেপে ধরে মটকাতে গেল। কিন্তু বাপরে বাপ! কী কড়া ঘাড়! মটকানো তো দূরের কথা, এতটুকু হেলাতে পারল না পর্যন্ত। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে আবার নিজের জায়গায় ফিরে এল।

—এই তুমি কে বলো তো? আমাদেরই লাইনের কেউ নাকি?

মানে?—জিগ্যেস করল লোকটা।

—মানে আমাদের মতো ভূত প্রজাতির কেউ নাকি?

—না। আমার কোড এক্স এক্স ০০৬।

—ইইইরররক! সেটা আবার কী নাম?

—এটা আমার কোড।

—তুমি কে ভাই?

আমি স্যাটার্ন থেকে এসেছি। মানে বাংলায় বলে শনিগ্রহ। আমি একজন রোবট। আমরা একটু আগেই পৌঁছেছি স্পেসশিপে। মোট একশোজন এসেছি মিশনে।

মাথায় কিছুই ঢুকল না লকাইয়ের।

—শনিগ্রহ থেকে এসেছ মানে? কে তুমি, শনিঠাকুর নাকি?

—না, আমি রোবট। বাংলায় যাকে বলে যন্ত্রমানব।

—রোবট...যন্ত্রমানব! আইব্বাপ, এসব আবার কী? তা তোমরা অদ্দূর থেকে এই পৃথিবীতে কেন এসেছ বাপধনেরা?

—আমরা জেনেছি, এই পৃথিবীতে মানুষ নামের একটা প্রাণী রয়েছে। তাদের খুব বুদ্ধি। আমরা সেই বুদ্ধি নিয়ে যেতে চাই আমাদের গ্রহে।

—অ্যাঁ বলো কী! সব বুদ্ধি নিয়ে যাবে!

—হ্যাঁ। আমাদের গবেষণার কাজে লাগবে। এবং ভবিষ্যতে এই গ্রহটাকে আমরা নিয়ে নিতে চাই। এবং মানুষের বুদ্ধির দ্বারাই এটা সম্ভব।

—তা বাবা আমাকে একটা কথা বলো দেখি, তুমি যদি শনিগ্রহের রোবটই হও, তাহলে এমন স্পষ্ট বাংলাভাষা শিখলে কী করে? আর এত রাত্তিরে বর্ধমানেই বা যাচ্ছ কেন?

—আমাদের কাছে পৃথিবীর মানুষদের সব ভাষা প্রাোগ্রামিং করা রয়েছে। যখন যেটা খুশি বলতে পারি। আর বারডোয়ানে যাচ্ছি কেন? আমরা ওখানে একটা হাব করব। বুদ্ধি স্টোর করার হাব। পৃথিবীর যেসব মানুষজাতির বুদ্ধি বেশি, সেখানে এমন একেকটা হাব হবে। এবং সেই হাবে সেই অঞ্চলের সব মানুষদের বুদ্ধি স্টোর করা হবে। আমার ভাগে বাঙালি জাতির বুদ্ধি নেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে। এই রকম বাকিদের একেকটা দেশের দায়িত্ব।

—লকাই বুঝল, ব্যাপার খুব গুরুতর। এক্ষুনি যদি কিছু না করা যায়, তাহলে পৃথিবীর মানুষদের সাংঘাতিক ক্ষতি হয়ে যাবে। আরে বাবা, আজ না হয় মরে ভূত হয়েছি, কিন্তু একদিন তো মানুষই ছিলাম। সেই মায়াটা আজও যায়নি। কিন্তু এমন অপকর্ম থেকে কী করে আটকানো যায় ব্যাটাগুলোকে? লকাই ভাবতে থাকল।

রোবটটা চুপ।

হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেল লকাইয়ের। বলল, কিন্তু বাপু হে, তোমাদের যে ভয়ানক একটা ভুল হয়ে গেছে। মানুষদের বুদ্ধি তো তোমরা নিতে পারবে না।

—কেন?

—আরে নেবে কী করে? আমরা মানে মানুষেরা তো আসলে ছায়ার মতো। শরীর বলে কিচ্ছু নেই। তাই বুদ্ধিও দেখা যায় না, ছোঁয়াও যায় না। তাহলে নেবে কী করে?

—আমাদের কপালের ঠিক মাঝখানে একটা ফুটো রয়েছে। সেখান থেকে আলট্রা জেড রে বার করে আমরা মানুষদের বুদ্ধি টেনে নিয়ে নিজেদের মেমারিতে স্টোর করে নেব।

লকাই খুব চিন্তিত মুখ করে বলল, উঁহু, যতটা সহজ ভাবছ, তত সহজ নয়।

রোবটটা চুপ।

—আমার কথা বিশ্বাস হল না তো? আচ্ছা বেশ, আমাকে দিয়েই না হয় প্রথম চেষ্টাটা করো। বলেই কম্বলের আড়ালে নিজেকে পুরো ছায়া বানিয়ে ফেলল লকাই।

বেশ। আমি স্টার্ট করছি।—বলে লোকটা নিজের কপালে হাত দিতেই লাল রঙের একটা সরু আলো বেরিয়ে এসে সরাসরি লকাইয়ের কপালে লাগল। না। ঠিক লাগল বলা যায় না। বরং কপাল ফুঁড়ে একেবারে ট্রেনের দেওয়ালে এসে পড়ল আলোটা। শরীরই তো নেই, আলোটা ঠেকবে কোথায়!

—কী বলেছিলাম? তোমাদের প্ল্যানিংয়ে গণ্ডগোল আছে। আরে বাবা, এত খরচা করে ওই অতদূর থেকে তেল পুড়িয়ে এলে! আরেকটু জেনে-শুনে আসবে তো?

রোবটটা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করল। কিন্তু প্রতিবারেই ফেল। তারপর নিজের ডান হাতের কবজি মুখের সামনে তুলে ধরে দুর্বোধ্য ভাষায় কীসব হাবিজাবি বলে গেল গড়গড় করে। একটা শব্দও বুঝতে পারল না লকাই।

তারপর উঠে দাঁড়াল। লকাইয়ের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ধন্যবাদ আপনাকে। আমাদের মানুষ সম্পর্কে এই ব্যাপারটা জানা ছিল না। তাই প্রাোজেক্ট ক্যানসেল হয়েছে। আমাদের ফিরে যাওয়ার নির্দেশ এসেছে।

—কী আর বলব বলো! এত দূর থেকে এলে তোমরা, খারাপ লাগছে। আচ্ছা, সাবধানে ফিরো বাবারা।

খুব দু:খ দু:খ মুখ করে উত্তর দিল লকাই।

লোকটা ট্রেনের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর বুকের কাছ হাত রাখতেই এক পলকে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল।

ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল লকাই। উউউফ বাবা! কাদের পাল্লায় আজ পড়া গেছিল! ভাগ্যিস, লকাইয়ের সঙ্গেই প্রথম দেখা হয়েছিল রোবটটার। নইলে যে কী কাণ্ড হত পৃথিবী জুড়ে! আবার জানলার ধারে এসে আয়েশ করে বসল লকাই। আজ আর কপালে কোনও শিকার জুটল না। যাই হোক গে, খানিকটা পুণ্যি তো হল পরের জন্মের জন্য।

ভেবেই হেসে ফেলল। এহহ! ভূতের আবার পরজন্ম!

 

অধ্যায় ১৭ / ১৭

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন