বুফে

বিনোদ ঘোষাল

বুফে

 

খন রাত্তির সাড়ে আটটা। সেই পৌনে সাতটার সময়ে খাওয়া মাত্র ছ'সাতখানা বড়ির সাইজের ঠান্ডা পকোড়া আর প্লাস্টিকের বেঁটে গ্লাসের আড়াই গ্লাস কফি এতক্ষণে পেটের মধ্যে বৃহদন্ত্রে চলে যাওয়ার কথা, অথচ আজ দ্যাখো প্রতি তিন মিনিট অন্তর ঢেঁকুর মারছে। প্রতিবার গলার কাছে এসে যাচ্ছে কফিগোলা পকোড়া।

আজ পাড়ার রেশন ডিলার ব্রজ সাহার ছোট ছেলের বৌভাত। কন্যাযাত্রী মিলিয়ে প্রায় বারোশো লোক নিমন্ত্রিত। এলাহি মেনু। মস্ত প্যান্ডেল হয়েছে ফাঁকা মাঠের ওপর। মাঘ মাস। কনকনে ঠান্ডা। পাশেই ধু-ধু ধানখেত থেকে হি-হি করা হাওয়া ছাড়ছে।

সাদায় কালোয় মিশিয়ে অগাধ টাকা করেছে ব্রজ সাহা। ছেলেটা অবশ্য অকাল কুষ্মাণ্ড। স্রেফ সিজিনের প্রথম বিয়ের নেমন্তন্ন বলে লোভটা ছাড়তে পারেননি গৌরাঙ্গ। তাই আসা। চিরকালের গ্যাস অম্বলের ধাত। তাই রিস্ক না নিয়ে আগে থেকেই প্যান্টের ডানপকেটে দুপিস র‌্যানট্যাক ওয়ান ফিফটি, আর একপিস ইউনিএনজাইম রেখে দেওয়া ছিল। কিন্তু কপাল খারাপ, ঠিক বেরোনোর আগে অন্য একটা প্যান্ট পরে চলে এসেছেন। কাছাকাছি কোনও ওষুধের দোকানও নেই। আজ আর খাওয়া কপালে নেই। ভেবে নিজের কপাল চাপড়ানোর বদলে কপালটা সামান্য চুলকে নিলেন বছর তেষট্টির গৌরাঙ্গবাবু।

আজ ঠান্ডাটা একেবারে যাচ্ছেতাই। হাড়-পাঁজরে ঝিঁঝি ধরিয়ে দিচ্ছে। তবু এত ঠান্ডার মধ্যেও প্যান্ডেলের ভেতর না থেকে মাফলারটা মাথা-গলায় কষে বেঁধে ফাঁকা মাঠে প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাঁটা-হাঁটি করলেন, তবু একটু খিদে পেল না! পেট না পাষাণ! এতদিন একসঙ্গে আছি তবু একটু মায়াদয়া নেই! ওরে আমি কি রোজ রোজ মটন বিরিয়ানি খাই? বছরে দু-একবার শখ হতে পারে না! রাগের চোটে বিড়বিড় করে নিজের পেটকে বলেই ফেললেন গৌরাঙ্গ।

আলো আবছা মাঠে কুয়াশার সঙ্গে ফিশ ফ্রাইয়ের গন্ধটা ফুল স্ট্রেন্থ নাকে টেনে নিয়ে ভাবলেন, না: বয়েস হচ্ছে, এবার থেকে খাওয়া দাওয়া একটু চেক করা দরকার—মাঠ পেরিয়ে ধানখেতের মধ্যে থেকে একটা শিয়াল ডেকে উঠল উয়ো উয়ো করে।

রাত গড়াতে গড়াতে সাড়ে ন'টা বেজে গেল। তিন-তিনবার ট্রাই নিয়ে একবারও সাইজ করতে পারলেন না গৌরাঙ্গ। জায়গা নেই, গুম হয়ে বসে আছেন। সাহাবাবুর ছোট ছেলেটা...কী যেন নামটা মনে পড়ছে না, ওই যে যেটার আজ বৌভাত হচ্ছে, একটু আগে গৌরাঙ্গবাবুর সামনে দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে যাওয়ার সময়ে একগাল দায়সারা হেসে বলে গেল,—মেসোমশাই এসেছেন? এই ব্যাচেই বসে পড়বেন। বুফে সিস্টেমও রয়েছে।

গৌরাঙ্গবাবু যথেষ্ট আশা নিয়ে বলতে যাচ্ছিলেন অনেকবার ট্রাই মেরেছি বাবা, একটু দেখো না যদি একটা বসার জায়গা...

হারামজাদা ছেলে কথাটা শোনার আগেই সাঁ করে চলে গেল। অপদার্থ। যেমন বাপটা চিটিংবাজ তেমনই ব্যাটা। না খেয়ে বাড়ি ফেরারও উপায় নেই। বাড়িতে তো ওই ফ্রিজে রাখা ট্যালট্যালে চারা মাছের ঝোল আর ভাত। ধ্যাসস। তা ছাড়া কড়কড়ে দুশো এক টাকার একটা গিফট ভাউচার দিয়েছেন বউটাকে। তার হিসেবটাও তো নেহাত ফেলনা নয়।

কিন্তু ছেলেটা কী যেন বলে গেল...বুফে? মানে ওই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়া। ওভাবে কি খাওয়া যায় মর্কট? কিন্তু নাহ আর দেরি করা ঠিক না। নিজের ব্যবস্থা নিজেকেই করতে হয়েছে চিরকাল। আজও করতে হবে। ভাবতে ভাবতেই সামনে এসে উপস্থিত হলেন গৌরাঙ্গর পাশের বাড়ির শ্যামসুন্দরবাবু। পেছনে ওঁর স্ত্রী। টুথ পিক দিয়ে দাঁত খুঁচিয়ে ফুক ফুক করে মাংসের টুকরো ফেলতে ফেলতে একগাল হেসে গৌরাঙ্গকে জিগ্যেস করলেন,—কখন এলেন? খাওয়া হয়ে গেছে?

হয়ে গেলে কি আর এই ঠান্ডায় বসে থাকি মর্কট? উত্তরটা মনে মনে দিয়ে মুখে বললেন,—না। এবার বসব।

—যান তাহলে, আর দেরি করবেন না। ওদিকে বিশাল লাইন। হে হে।

শ্যামসুন্দরের স্ত্রী হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলেন,—দিদিকে আনেননি?

—না, ওই...মানে ওর শরীরটা...। আসলে নেমন্তন্ন কার্ডে আপনি/ সবান্ধবের মধ্যে, সবান্ধবেটা যে কাটা ছিল সেটা আর বললেন না গৌরঙ্গ। ম্যাটার অফ প্রেসটিজ।

তবু কেসটা বোধ হয় আন্দাজ করে নিলেন শ্যামসুন্দর। ফিক ফিক করে হেসে বললেন আমাদের তো বাড়ি ঝেঁটিয়ে আসতে বলে দিয়েছিলেন ব্রজদা। দু'দিনই নেমন্তন্ন। যাক চলি তাহলে। চল গো।

দুজনে চলে গেলেন। উহ, আদিখ্যেতা। দু'দিন নেমন্তন্নটা ডেফিনিট ঢপ ঝেড়ে গেল। ক'দিন আগেই তো ওজনে কম দেয় বলে ব্রজকে খুব গালাগাল করছিলি দোকানে। গজ গজ করতে করতে গলায় প্যাঁচানো মাফলারের গিটটা একবার টেনে নিলেন গৌরাঙ্গ। তারপর পুরো বীর বিক্রমে এগিয়ে গেলেন খাবার জায়গার দিকে।

ইরররক...! এটা খাবার জায়গা! প্রায় শ'দেড়েক লোক চেয়ার টেবিলে বসে গোগ্রাসে গিলছে। আর খেতে বসা প্রতিটি মানুষের পিছনে অন্তত দুজন করে স্ত্রী-পুরুষ বডি গার্ডের মতো দাঁড়িয়ে। শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে নয়, খাদ্যরত মানুষটা খেয়ে উঠলেই কে কোন চেয়ারে বসবে তাই নিয়ে চেল্লামেল্লি সহকারে চেয়ার বাঁটোয়ারা চলছে। 'আই পটা তুই এদিকটায় দাঁড়া, চেয়ারটা ধরে দাঁড়িয়ে থাক... এই তো দাদা এখন চাটনি খাচ্ছেন, এক্ষুনি হয়ে যাবে ওনার।' 'না, না, দাদা আপনি খান, ব্যস্ত হবেন না।' 'আরে এদিকে সরে দাঁড়া চেয়ারের দিকে। নইলে অন্য কেউ বসে যাবে বলছি। ক'টা বাজে দেখেছিস? অনেক রাত্তির হয়ে যাবে এরপর।' 'এক্ষুনি হয়ে যাবে দাদার। আর তো শুধু মিষ্টি খাওয়া বাকি!'

—বাবা, কাকু ওটা কী খাচ্ছে? খেতে বসা এক ভদ্রলোকের প্লেটের দিকে আঙুল তুলে বাবার কোলে চেপে থাকা বছর চারেকের বাচ্চার প্রশ্ন।

—কাকুটা চিকেন খাচ্ছে।

—আমিও খাব।

—হ্যাঁ, খাবে তো। কাকুটা আগে উঠুক। লোকটার গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা বাবার উত্তর।

—কই গো শোনো না আমি আর চঞ্চলাদি এদিকে বসে যাব এই জ্যাঠামশাই উঠলেই। তুমি বুকলুকে নিয়ে সামনেরটায় বসে যেও।

যে লোকগুলো খাচ্ছে, চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন এখনও বসে রয়েছে বলে বেজায় অপরাধ করে ফেলেছে। চিকেন বাটার মশালা মুখে থাকা সত্বেও বড় রসগোল্লাটা মুখে গুঁজতে গিয়ে একজন বয়স্ক লোক বিষম খেয়ে অস্থির। অন্যদিকে আইসক্রিম হাতে নিয়েই বেশ কিছু মানুষ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আর দাঁড়ানো মাত্র সেই সিটেই সাইড করে ঝপ করে বসে পড়ছেন অপেক্ষমান বুভুক্ষুরা। সামনে ডাঁই করা মাংসের হাড় গোড়ের এঁটো প্লেট । কুছ পরোয়া নেহি। লজ্জা ঘৃণা ভয়, তিন থাকতে নয়।

বেচারা ক্যাটারিং সার্ভিসের ছেলেগুলো হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে প্রায় সার্কাস দেখানোর স্টাইলে ভিড় কাটিয়ে 'দিদি একটু সাইড দেবেন' 'কাকু একটু সরে দাঁড়ান' 'কাকিমা, একটু যেতে দিন' বলে যাচ্ছে এক নাগাড়ে। আর সাইড! কার সাইড কে দেয়। প্যান্ডেলের বাইরে নেড়ি কুকুরগুলো নিজেদের তুমুল খেয়োখেয়ি শুরু করেছে। সানাইয়ের শব্দও চাপা পড়ে যাচ্ছে সেই কেঁউ কেঁউতে।

এটা খাওয়ার জায়গা না হাওড়ার জগন্নাথ ঘাট? তবু গৌরাঙ্গবাবু অসহায়ভাবে আদ্যপ্রান্ত একবার চোখ বোলালেন। নাহহ নেই...কোথাও জায়গা নেই। এই ব্যাচেও নো চান্স! অগত্যা...এর লাগোয়া প্যান্ডেলেই সেই বুফের ব্যবস্থায়।

 

 

ঠিক কাঁটায় কাঁটায় ন'টা চল্লিশে জেলের কয়েদিদের মতো খাওয়ার জন্য লাইন দিয়ে একটা ফাঁকা প্লেট আর চামচ নিয়ে জীবনে প্রথম বেবি নান আর চানা মশলার কাউন্টারের দিকে এগোলেন গৌরাঙ্গবাবু। ভেতরটা রাগে জ্বলছে। কাউন্টারের ছেলেটা বিরসবদনে একটা নান আর কিছুটা চানা তুলে দিল। তারপর স্যালাড...তারপর...তারপর...বিরিয়ানি, চিকেন বাটার মশালা, ফিসফ্রাই, প্লেটের মধ্যে তীব্র রাগে একে একে জমিয়ে তুললেন উনি।

কিন্তু একটা জিনিসও মুখে তোলা যাচ্ছে না। তুলতে যে পারবেন না আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। খালি কাচের প্লেটটারই ওজন বোধ হয় কম করে সাড়ে তিনশো গ্রাম। এ বয়েসে এই মাল এক হাতে ধরে অন্য হাতে চামচ দিয়ে খাওয়া আর হাওড়া ব্রিজের টং-এ ওঠা একই কথা।

কুলাঙ্গারের দল। আবার কেতা করে বুফে করেছে বুফে! কেন বসার জায়গাটা আরেকটু বড় করতে পারলি না? এভাবে খাওয়া যায়? তবু দু-একবার ট্রাই নিতে গিয়ে ফেল করলেন উনি। একে কনকনে ঠান্ডা। তার ওপর এই ওজন! হাত কাঁপছে ঠক ঠক করে।

কী করবেন বুঝতে না পেয়ে গৌরাঙ্গবাবু চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন দু-হাতে প্লেটটা ধরে। কয়েকজন জোয়ান ছেলেমেয়ে হইহই করে দিব্বি সাঁটাচ্ছে ওই ভাবেই।

হঠাৎ ব্রজ সাহা এসে একগাল হেসে,—ঠিক করে খাবেন কিন্তু। রান্না কেমন হয়েছে?

মুখস্থের মতো বলেই চলে গেলেন। প্লেটটা ওর মাথায় ঢেলে দিতে ইচ্ছে করছিল গৌরাঙ্গবাবুর। নেমন্তন্ন করে ডেকে এনে এইভাবে হেনস্থা করা! এভাবে দাঁড়িয়ে মানুষ খেতে পারে? আমি কি গাধা ঘোড়া নাকি?

একবার অন্তিম চেষ্টা করলেন তবু। বাঁ-হাতে প্লেট ধরে চামচ ছাড়াই ডান হাত ডুবিয়ে বিরিয়ানির মাটনে কামড় বসাতে গেলেন আর সাঁৎ করে মালটা হড়কাল। তাড়াহুড়োয় বেখেয়ালে বাঁ-হাত দিয়ে ওটাকে ধরতে গিয়ে গোটা প্লেটটা উলটে নিজের গায়ে। সাদা শাল, ধুতি-পাঞ্জাবির খানিকটা একেবারে চাটনি হয়ে গেল। আর মাথার ঠিক রাখতে পারলেন না। শাললা এইভাবে মানুষে খেতে পারে? রাগের মাথায় আরও কী সব বলতে বলতে ঝালে ঝোলে রসে চাটনিতে মাখামাখি হয়ে কাঁপতে কাঁপতে বুফের ঘরের পাশে যেখানে বসে খাওয়া শুরু হয়েছে সেখানে ঢুকে দেখেন চার-পাঁচটা কুকুর—যেগুলো এতক্ষণ প্যান্ডেলের বাইরে এঁটো খাবার নিয়ে নিজেদের মধ্যে কামড়াকামড়ি করছিল, তিরপলের ফাঁক দিয়ে সবক'টা মহাবিক্রমে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।

টেবিল চেয়ার সব ওলোট পালট। খাবারদাবার মাটিতে গড়াচ্ছে। বউ-বাচ্চাদের তুমুল আতংকের চিৎকার। কেউ বলছে 'গরম জল ঢাল' কেউ বলছে 'লাঠি নিয়ে আয়'। পুরো ব্যাচ ভন্ডুল। সবাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে।

সেই সন্ধের পর এই প্রথম খিক খিক করে হেসে উঠলেন গৌরাঙ্গবাবু। মনে মনে বললেন বসে খাবি? খা আরও খা বসে। ভেবে ফুরফুরে মেজাজে হনহন করে বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালেন। চটচটে শাল ধুতি। সানাইটা বেড়ে বাজাচ্ছে বটে। রাস্তা থেকেও শোনা যাচ্ছে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন