ভেকুর কেরামতি

বিনোদ ঘোষাল

ভেকুর কেরামতি

 

যে কোনও তালা খুলে ফেলার জন্মগত প্রতিভা ছিল ভেকুর। ওর যখন পাঁচ বছর বয়স ভনা মোড়লের বউ নিজের পুঁচকে ছেলেটাকে ঘরে রেখে বাইরের দরজায় তালা দিয়ে পুকুরে গেছিল দুটো ডুব দিতে। চাবি ছিল আঁচলে বাঁধা। চান সেরে বাড়ি ফিরে আঁচলে হাত দিতেই...যা-আ-আ-আ! চাবি কই গেল...পুকুরে?

ওমা গো! কী হবে এবার? খোঁজ খোঁজ...পুকুরে জাল ফেলে জল সেঁচে সে এক হইহই কাণ্ড। কিন্তু চাবির টিকিটি নেই। ঘরের যেমন শাল কাঠের দশাসই দরজা তেমনই ভীমের মতো তালা, ও জিনিস ভাঙবে কে?

এদিকে এতক্ষণ ধরে ঘরের ভেতর আটকে থাকা বাচ্চাটা খিদেতে ভয়ে চিল-চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে।

গ্রামের সবাই মিলে আলোচনা করে যখন ঘরের দেওয়াল ভাঙার সিদ্ধান্তটা প্রায় পাকা করে ফেলেছে তখন কেউ খেয়ালই করেনি খালি গায়ে হাফপ্যান্ট পরা ভেকু হাতে ছোট্ট একটা তার নিয়ে ওই তালার ভেতর ঢুকিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে কখন যেন কুটুস করে খুলে ফেলেছে।

কেউ হয়তো জানতেও পারত না যদি না গ্রামের বুড়ো চৌকিদার রামশরণ কাণ্ডটা দেখতে পেয়ে যেত। 'আরে খোল দিয়া ববুয়া নে, তালা খোল দিয়া!' বলে নাচতে শুরু করে দিয়েছিল রামশরণ। হইহই ব্যাপার। ভনা মোড়লের বাড়িতে সাতদিন দুইবেলা টানা নেমন্তন্ন থাকল ভেকুর। গ্রামের লোকরাও একদিন ভোজ খেল কিন্তু এর পরেও কয়েকজনের সন্দেহ ছিল ভেকুর প্রতিভায়। ওইটুকু বাচ্চা ভালো করে কথাও বলতে পারে না। ও খুলবে তালা? ও নিশ্চয়ই এমনি ঘোরাতে ঘোরাতে খুলে গেছিল।

কিন্তু কয়েকমাস পরেই যখন গ্রামের একমাত্র ওঝা জগু সর্দারের মন্ত্রপূত খুলি রাখা লোহার বাক্সয় লাগানো তালার চাবি গেল হারিয়ে, তখন আবার ভেকু কোত্থেকে খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত।

চাবি খুঁজে খুঁজে আর তালা ভাঙার তিনশো সাতাশি রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে জগু তখন সেই বাক্সর সামনে লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে। ওই খুলি জগুর গুরুদেবের দেওয়া। ভূত তাড়ানোর সমস্ত শক্তি ওই খুলির মধ্যেই রয়েছে। ওই খুলির ভয়েই নামুনারি গ্রামের আশপাশের ভূতেরা কেউ এ তল্লাটে ঘেঁষে না।

জগুর চাবি হারানোর খবর মানুষদের সঙ্গে সঙ্গে ভূতেদের কানেও পৌঁছোল। আর পৌঁছোতেই একটা ফচকে ভূত ওই ভর দুপুরেই গিয়ে সোজা চাপল একেবারে গ্রামের জমিদারবাবুর ঘাড়ের ওপর। বিপদের ওপর আরও বিপদ হল, একটু পরেই জমিদারের পেয়াদা এল জগুকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এক্ষুনি গিয়ে ভূত ছাড়াতে হবে। না পারলে কপালে কী শাস্তি রয়েছে কেউ জানে না।

কিন্তু জগু যাবে কী করে? খুলিই তো বাক্সে আটক। বেচারা কেঁদেকেটে ঠিকই করে ফেলল, আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কোনও রাস্তা নেই। কিন্তু সেটা কীভাবে করা যায় তা একা সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে গ্রামের মাতব্বরদের কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছে। কেউ বলছে ঝুলে পড়। কেউ বলছে, না, না। সতীদাহপ্রথাটাই ভালো, আবার কেউ বলছে, ধুস, তার থেকে হাত-পায়ে পাথর বেঁধে নদীতে ঝাঁপ দেওয়াই বেস্ট।

এত অপশনের কোনওটাই জগুর খুব একটা আরামপ্রদ মনে হচ্ছিল না। কান্নার তোড় আরও বেড়ে যাচ্ছিল। তখন কেউ খেয়ালই করেনি কোন ফাঁকে ভেকু এসে ওই বাক্সের সামনে উবু হয়ে বসে এক টুকরো তার নিয়ে ওই তালার ফুটোয় ঢুকিয়ে ঘোরাতে ঘোরাতে কখন খুট করে খুলে দিয়েছে।

জগু তো আনন্দে আত্মহারা হয়ে 'এ মহাপুরুষ এ মহাপুরুষ' বলতে বলতে ঝাড়া এক ঘণ্টা ধরে ভেকুর সামনে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম। উঠতেই আর চায় না। শেষে সবাই মিলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে টেনে তোলা হল তাকে। এই ফাঁকে সেই ভূতটাও তালা খুলে যাওয়ার খবর পেয়ে জমিদারের ঘাড় ছেড়ে হাওয়া।

এই এত কাণ্ডের পরেও ভেকুর কিন্তু কোনও হেলদোল নেই। ছাড়া পেয়ে আনন্দের চোটে সেই খুলিটা পর্যন্ত বলে উঠেছিল, 'শাঁব্বাশ ভেঁকু। তোঁর হঁবে রে।'

সেইদিন থেকে আর কারও মনে সন্দেহ রইল না যে এই ছেলে প্রতিভা নিয়েই জন্মেছে। কিন্তু অনেকে আবার চিন্তায় পড়েছিল, এমনধারা প্রতিভা নিয়ে বড় হয়ে চোর-ছ্যাচ্চোড় না হয়।

তারপর থেকে গ্রামে কারও চাবি হারালেই হল। ভেকু ঠিক গিয়ে সেখানে হাজির। যেমনই তালা হোক, ঠিক খুলে ফেলবেই। আশপাশের গ্রাম থেকেও মাঝে মাঝে ডাক আসতে শুরু করল। পুরস্কার-টুরস্কারও জুটত। কিন্তু ভেকুর বাবা-মা ছেলের এমন প্রতিভায় মোটেও খুশি ছিল না। তারা চাইত, ছেলে পড়াশোনা করুক, যাতে বড় হয়ে কাজকম্ম করতে পারে।

কিন্তু চাইলে কী হবে? যার যেদিকে ঝোঁক। পড়াশোনায় একেবারে মন নেই। সারাদিন স্কুল পালিয়ে এগ্রাম-ওগ্রাম ঘুরে বেড়ায়, কার তালার চাবি হারিয়েছে সেই খোঁজে। যত কঠিন তালা, খুলতে ততই মজা। কিন্তু রোজ রোজ কত মানুষের চাবি হারাবে? অথচ আট-দশটা তালা না খুলতে পারলে ভেকুর সাংঘাতিক হাত চুলকায়। গা বমি বমি করে।

শেষে উপায় না পেয়ে গ্রামের যেকোনও বাড়িতে দরজায় তালা লাগানো থাকলেই খুলতে শুরু করে দিল। গ্রামের মানুষ পড়ল মহা বিপদে। কোথাও একটু বেরোনোর জো নেই ঘরে তালা দিয়ে। ব্যাটা ঠিক কখন লুকিয়ে এসে তালাটা খুলে দিয়ে যাবে। একদিন সন্ধেবেলা নিজের ইস্কুলে গিয়ে সবক'টা ক্লাসরুমের তালা খুলে দিয়ে এসে পরম নিশ্চিন্তির ঘুম। পরের দিন সকালবেলাই ইস্কুলের হেডমাস্টারমশাই ভেকুর বাড়িতে স্বয়ং হাজির।

ভেকু আছিস না কি রে?

ভেকু তখনও ঘুমিয়ে কাদা। ওর বাবা বাইরে বেরিয়ে এল, আজ্ঞে আপনি!

হ্যাঁ আমিই। ভেকু নেই?

তা আছে।

একবার ডাকুন তো সোনার চাঁদকে।

বাবার ধাক্কাধাক্কিতে কাঁচা ঘুম ভেঙে চোখ রগড়াতে রগড়াতে বাইরে বেরিয়ে এল ভেকু।

বাপ আমার! কাল সন্ধেবেলা ইস্কুলে গেছিলি?

ভেকুর আবার মিথ্যে কথা বলা ধাতে সইত না। মাথা নীচু করে বলল, হুঁ।

স্কুলের সব তালাগুলো...

মাস্টারমশায়ের কথা শেষ হওয়ার আগেই ভেকুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বাবা। চুলের মুঠিটা ধরে সবে প্রথম কিলটা মারতে যাবে, তখনই হাঁ-হাঁ করে উঠলেন মাস্টারমশাই, আহা হা করেন কী, করেন কী? এমন গুণধর প্রতিভাবান ছেলের গায়ে হাত তুলছেন? ওর কপাল মন্দ। তাই এই দেশে জন্মেছে। আমেরিকা হলে মাথায় তুলে রাখত।

তারপর ভেকুকে সামনে টেনে নিয়ে এসে বললেন, বাপধন, তোকে একটা কথা বলি। তুই হচ্ছিস একটা প্রতিভা। তাই পড়াশোনার মতো তুচ্ছ জিনিস তোর জন্য নয় বাপ। ওসব হল আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের জন্য। তাই তুই আর কাল থেকে ইস্কুলের দিকে যাস না সোনা আমার!

বলে ভেকুর মাথায় হাত বুলিয়ে সাইকেলে উঠতে গিয়েও আবার থামলেন, তবে তুই ছেলেটা বড় সরল আর সৎ। তাই চেষ্টা করিস তোর এই গুণটাকে মানুষের ভালোর জন্য ব্যবহার করতে। কোনওদিন খারাপ কাজে লাগাস না।

আসলে তালা খোলার মাথা সাংঘাতিক পরিষ্কার হলে কী হবে, ভেকুর আর অন্যসব বিষয়ে মাথা ছিল একেবারে নিরেট ইট। কিচ্ছু ঢুকত না।

সেদিন থেকে ইস্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। ভেকু তো মহা খুশি। আর ইস্কুল যাওয়ার মতো কঠিন কাজ নেই। সকাল হলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেত। সারাদিন এগ্রাম-ওগ্রাম ঘুরে দুপুরে বাড়ি ফিরে চাট্টি খেয়ে আবার টো-টো।

বাবা চেষ্টা করল কাজে লাগাতে। লাভ হল না। ছেলের কোনও কাজে মন নেই। মনের দু:খে হাল ছেড়ে দিল বাপ-মা। এদিকে দুই বেলা গ্রামের লোকের নালিশ। কেউ বলে, ভেকু আমার গোয়াল ঘরের তালা খুলে দিয়ে গেছে। কেউ জানায়, আজ দুপুরে হেঁশেলের তালা খুলে পালিয়েছে। বিড়ালে সব মাছ খেয়ে নিয়েছে।

একবার পাশের গ্রামের গদাই পালোয়ানের ঘরের তালা খুলতে গিয়ে বেদম পিটুনি খেল ভেকু। গায়ের ব্যথায় দুদিন বিছানায়। সবাই নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবল এবার বুঝি তালা খোলা রোগ ঠিক হয়ে যাবে। কোথায় ঠিক? একটু শরীর ঠিক হতেই দ্বিগুণ উৎসাহে আবার নেমে পড়ল।

তবে একটা ব্যাপার, এই যে এতদিন ধরে ভেকু লোকের বাড়ির তালা খুলে দিত, জীবনে কখনও কারও একটা জিনিসে হাতও লাগায়নি। এক ঘটি জলও খায়নি। তা ছাড়া বামুনারি সমেত আশপাশের গ্রামগুলোতে চোর-ডাকাতের উৎপাত ছিল না বলে জিনিসপত্র কিছু হাপিস হত না। যাকগে! মাঝে মাঝে কাজেও তো লাগে ছেলেটা। সেই ভেবে গ্রামের লোক ভেকুর অত্যাচার মেনে নিয়েছিল।

এমনিভাবে যেতে যেতে ভেকুর যখন ষোলো বছর বয়েস, তখন উনিশ বছর পর গ্রামে ফিরল ঝানু চোর টকাই। খবর শোনামাত্র গ্রামের মোড়ল-মাতব্বররা মিলে ঠিক করে ফেলল টকাইকে আর গ্রামে থাকতে দেওয়া হবে না। নইলে আবার চুরি-চামারি শুরু হয়ে যাবে।

একসময়ে টকাইয়ের অত্যাচারে কেউ বাড়িতে দামি জিনিস রাখতেই পারত না। সোনাদানা, টাকাপয়সা থেকে ঝাঁটা বালতি ন্যাতা যা পেত কিচ্ছু ছাড়ত না টকাই। হাজার চেষ্টা করেও ওর টিকিটি ধরা যেত না। শেষে লক্ষ্মীপুর গ্রামের মোড়লের ঘরে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে জেল। জেলে যাওয়ার লজ্জায় তারপর দীর্ঘ বছর আর এইমুখো হয়নি টকাই। সকলেই নিশ্চিন্ত ছিল। কিন্তু আবার সে এসেছে ফিরিয়া।

জেলে থাকতেই টকাইয়ের বাপ-মা মারা গেছিল। গ্রামে নিজের বলতে পচে যাওয়া ছিটে বেড়ার একটা ঘর আর ঘরের সামনে আগাছা ভরতি খানিকটা জমি। সবাই বলল, জমির দাম মিটিয়ে টকাইকে গ্রাম থেকে ভাগিয়ে দেওয়া হোক। কিন্তু টকাইও ছাড়ল না। বারবার সবাইকে বোঝাতে থাকল, এতদিন জেলের ভাত খেয়ে সে বিলকুল শুধরে গেছে। নিরামিশ খায় আর সারাক্ষণ হরিনাম জপে।

কিন্তু কিছুতেই কেউ শুনল না। শেষে মোক্ষম চাল দিল টকাই। আমরণ অনশন করে গ্রামের মোড়লমশায়ের বাড়ির সামনে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকল। শেষে আবার চারদিনের মাথায় মিটিং বসল। বাবা বাছা বলে মাথায় হাত বুলিয়েও টকাইকে একফোঁটা জলও খাওয়ানো যাচ্ছে না। সুতরাং সিদ্ধান্ত হল, ওকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া হোক।

থেকে গেল টকাই। কিন্তু স্বভাব যায় না ম'লে। মাস খানেক কাটতে না কাটতেই হাত-পা উশখুশ করতে শুরু করে দিল টকাইয়ের।

একদিন সন্ধেবেলা ভেকু মাঠ দিয়ে হেঁটে ফিরছে, টকাই ধরল ওকে।

এই শোন! আমাকে চিনিস?

ভেকু সোজা উত্তর দিল, হ্যাঁ, টকাইচোর।

নামের পরের বিশেষণটা পছন্দ হল না টকাইয়ের। তবু মুখে জোর করে হাসি এনে বলল, আমি এখন আর চোর নই। তবে তুই তো খুবই বিখ্যাত ছেলে রে। কলকাতাতেও সবাই তোর নাম জানে।

তাই?

তবে আর বলছি কী। তবে আমার কিন্তু মনে হয়, তোর যতটা নাম ততটা ওস্তাদ তুই নোস।

কেন নয় কেন? ভুরু কুঁচকে তাকাল ভেকু। বুক চিতিয়ে বলে উঠল, এমন কোনও তালা নেই যা আমি চাবি ছাড়া খুলে দিতে পারি না।

এই সুযোগটারই অপেক্ষা করছিল টকাই। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, বেশ তাহলে হারাধন ঘোষের সিন্দুক খুলে দেখা। যদি পারিস, তাহলে তোকে আমি ওস্তাদ বলে মেনে নেব।

লক্ষ্মীপুর গ্রামের হারাধন ঘোষের মস্ত তেজারতি কারবার। অনেক বছর আগে হারাধনের বাড়ির বিভীষণ সিন্দুকের তালা প্রায় সারা রাত চেষ্টা করেও খুলতে পারেনি টকাই। সেই দু:খ আজও রয়ে গেছে।

ভেকুও ভাবল, যাব্বাবা! এই খবরটা তো জানা ছিল না এতদিন। বলল, বেশ। কবে যাবে বলো, তোমার চোখের সামনেই খুলে দেখিয়ে দেব।

কাল তো অমাবস্যা রয়েছে। কাল রাতেই চল।

না, না রাত্রে কেন? দিনের বেলায় যাব। রাতে আমার ঘুম পায়।

না রে। দুপুরে হবে না। আমার একটা দরকারি কাজ রয়েছে। আমি রাতেই আসব। তোর ঘরের সামনে এসে শিয়ালের ডাক ডাকলে চুপচাপ বেরিয়ে পড়বি। ওহ! এই সব কথা কাউকে বলিস না যেন। কে আবার কী ভাববে!

ঠিক আছে।

 

 

রাত্রে বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল ভেকু। মা-বাবা দুজনেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছে। টকাই আর আসে না। ভেকুর দুই হাতের তালু কাল সন্ধের পর থেকেই সাংঘাতিক চুলকোচ্ছে। প্রায় মাঝরাতে এসে শিয়াল ডাকল টকাই। একবার শোনামাত্র তড়াক করে উঠে বসল ভেকু। তারপর খুব সাবধানে ঘরের বাইরে বেরিয়ে এল।

এসে গেছিস! নে, এবার চট করে আমার সাইকেলের রডে উঠে পড়। তাড়াতাড়ি যেতে হবে।

বামুনারির পর আরও তিনটে গ্রাম পেরিয়ে তারপর লক্ষ্মীপুর। প্রায় টানা চল্লিশ মিনিট খুব স্পিডে ওই ঘোর অন্ধকারের মধ্যেও এতটুকু কোথাও হোঁচট না খেয়ে নিপুণভাবে সাইকেল চালিয়ে একেবারে হারাধন ঘোষের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল টকাই। বিশাল উঁচু পাঁচিল, মস্ত গ্রিল দেওয়া গেট।

টকাই আগে থেকেই খোঁজ নিয়ে রেখেছিল যে আজ এই বাড়িতে কেউ নেই। সবাই কলকাতায় কুটুমবাড়ি গেছে নেমন্তন্ন খেতে। একটা বুড়ো পাহারাদার রয়েছে বটে, কিন্তু সে ব্যাটা সন্ধে হলেই আফিম খেয়ে ঝিমোয়। গ্রিলের উঁচু গেটটার দিকে আঙুল তুলে টকাই বলল, যা ব্যাটা। এবার এই গেট বেয়ে ভেতরে চলে যা।

এ বাবা! গ্রিল বেয়ে ভেতরে কেন ঢুকব? ডাকো ওদের।

না, না। এত রাত্রে ডাকাডাকি করলে আবার পাড়াসুদ্ধু লোকের ঘুম ভেঙে যাবে। তার থেকে বরং ভেতরে ঢুকে গিয়ে ডাকব'খন।

হ্যাঁ, সেটা ঠিক।

ভেতরে ঢুকতেই ভেকু আবার বলল, এবার তো ডাকো।

সেকথা শুনে টকাই খুব চিন্তিতমুখে বলল, আরে! আর বলিস না। আমি একেবারেই ভুলে গেছিলাম যে ওরা আজ কেউ বাড়ি থাকবে না।

যাআআআ। তাহলে চলো কাল সকালে আসব।

না, না। তা কী করে হয়? এতটা পথ কষ্ট করে এলাম। কাজ না করেই চলে যাব।

কিন্তু টকাইদা, বাড়ির কেউ নেই, এখন রাত্রে যদি তালা খুলি তখন আমাকে যদি কেউ চোর ভাবে? বড় হওয়ার পর আমি কখনও কারও বাড়ি রাতে তালা খুলি না। চলো পরে আসব।

আরে ধুৎ পাগল! আমার পুরো কথাটা তো শোন! হারাধনবাবু নিজে মুখে আমাকে বলেছেন, ভাই টকাই আমরা থাকব না তো কী হয়েছে? তুমি ভেকুকে নিয়ে এসে তালা খুলতেই পারো, অবশ্য যদি ছেলেটা পারে।

তাই! এই কথা? চ্যালেঞ্জের কথা শুনে আবার জেদ চেপে গেল ভেকুর। পকেট থেকে ওর তারের টুকরো বার করে সদর দরজায় ঝোলানো ইয়াব্বড় তালার ভেতর ঢুকিয়ে কয়েক মিনিটে কুটুস করে খুলে ফেলল।

টকাই মনে মনে ভাবল, নাহ! এই ছেলের হবে। বলল, চল। ঘরের ভেতরে যাই।

ভেতরে ঢুকে পকেট থেকে একটা ছোট টর্চ বার করে জ্বালল টকাই। ভেকুকে বলল, আয় আমার পিছন পিছন।

একটার পর একটা ঘর পেরোতে পেরোতে ভেকু বলল, এরা দেখছি খুবই বড়লোক টকাইদা।

হুঁ। ঠিকই বলেছিল। টকাই মনে মনে ভাবল, আজকের কেসটা যদি মানে মানে সেটল হয়ে যায় তাহলে আর এই তল্লাটে নয়। একেবারে সোজা মুম্বাই।

মস্ত একটা ঘরের ভেতর এসে টকাই বলল, এই দেখ। এটা হল হারাধনবাবুর শোওয়ার ঘর। তারপর ঘরের কোণে রাখা প্রায় চার ফুট চওড়া আর তিন ফুট লম্বা একটা লোহার সিন্দুকের ওপর টর্চের আলো ফেলল টকাই।

এই দেখ ভেকু, এটাই হল সেই সিন্দুক।

ভেকু সিন্দুকটার কাছে গিয়ে হাত বোলাল।

কী রে, কী মনে হচ্ছে? পারবি তো?

এত বড় সিন্দুক আমি আগে কোনওদিন দেখিনি গো টকাইদা।

হুম! নে নে। আর দেরি করিস না। দুগগা দুগগা বলে শুরু করে দে।

হ্যাঁ। এই করছি। বলে সিন্দুকের তালার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ভেকু। তারপর হাতের মুঠোয় ধরা তারের টুকরোটা সোজা ঢুকিয়ে দিল তালার ফুটোয়। তারপর পাঁচ মিনিট...দশ মিনিট...কুড়ি মিনিট...ভেকু একটু করে তার ঘোরায় আর তালায় কান ঠেকিয়ে কী যেন শোনে।

কী রে, হচ্ছে?

হুঁ।

আবার কিছুক্ষণ পর কী রে ভেকু? হচ্ছে?

হুঁ।

আরে ধেৎ! কী তখন থেকে হুঁ-হুঁ করছিস? তাড়াতাড়ি কর।

তাড়া দিও না টকাইদা। এটা বেশ কঠিন কেস। সময় লাগবে।

না, না। ঠিক আছে। তুই মাথা ঠান্ডা করে কর বাবা। শুধু দেখিস যেন ভোর না হয়ে যায়।

প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে টকাইকে ভয়ংকর টেনশনে ফেলে ঝনাৎ করে শব্দ করে সিন্দুকের হাতল খুলে ফেলল ভেকু। তারপর বুক চিতিয়ে টাকাইকে বলল, এই দেখো টকাইদা। তালা খুলে ফেলেছি।

শাব্বাশ ভেকু। তুই সত্যিই ওস্তাদ। আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিল্লে উঠল টকাই। যা। তোর কাজ শেষ। তুই বাড়ি চলে যা। এবার আমার কাজ শুরু হবে।

তোমার আবার কী কাজ?

আরে তেমন কিছু না। আমাকে এই ঘরটা এখন সারা রাত পাহারা দিতে হবে। তুই পালা। ভোর হয়ে আসছে। সকালে আবার তোর মা তোকে বাড়িতে না পেলে খুবই চিন্তায় পড়বে।

আচ্ছা। বলে ভেকু সবে রাস্তায় বেরিয়েছে তখনই পিছন থেকে গ্রামের চৌকিদার জাপটে ধরল ভেকুকে আর তুমুল চিৎকার, পাকড় লিয়া, চোর পাকড় লিয়া।

 

 

পরদিন সকালের দৃশ্য। থানায় মাটিতে বসে রয়েছে টকাই আর ভেকু। ভেকু একটানা বলে চলেছে, আমি চোরটোর নই। টাকইদা বলল বলে আমি তালা খুলতে গেছিলাম। টকাই কোনও কথার উত্তর দিচ্ছে না। চুপ করে বসে রয়েছে। কাল রাত্রে চৌকিদারের চেঁচামেচি শুনে টকাই কেস কিছু গড়বড় বুঝে পালাতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। গ্রামের লোকেদের তৎপরতায় ও ধরা পড়ে গেছিল পালানোর সময়। তারপর থেকে এই থানায়।

একটু বেলা বাড়তেই থানার বড়বাবু বললেন, চল ব্যাটা এবার উঠে জিপে গিয়ে বোস। সদরে চালান করব। দুজনেই গিয়ে জিপে বসল। জিপ সবে স্টার্ট নিয়েছে। তখনই উলটোদিক থেকে ধুলো উড়িয়ে থানার সামনে এসে থামল একটা মোটরবাইক।

বাইকের চালক হারাধনবাবুর বড়ছেলে আর পিছনে বসে স্বয়ং হারাধনবাবু। ভয়ংকর উত্তেজিত তিনি। ধুতির লুটোনো কোঁচা সমেত হুড়মুড়িয়ে ছুটে এলেন বড়বাবুর কাছে।

কে, কে খুলেছে আমার সিন্দুক?

দারোগাবাবু সঙ্গে সঙ্গে আঙুল তুলে ভেকুর দিকে দেখিয়ে বললেন, ওই যে ওই গুণধর। ব্যাটা পাক্কা চোর। আপনি একদম চিন্তা করবেন না হারাধনবাবু। এই গুরু আর চ্যালাকে আমি পাক্কা দশ বছর জেলের ঘানি ঘোরাব বলে রাখলাম।

আরে না, না। একদম না। ওই ছেলে আমার যা উপকার করেছে, তা জানেন না। ওই সিন্দুক আমার সাত পুরুষ আগের। কিন্তু ওটার চাবি ছিল না বলে আজ পর্যন্ত কেউ খুলতে পারেনি। বংশ আফটার বংশ সম্পত্তিগুলো পড়ে পড়ে পচছিল। এই ছেলে সেই তালা খুলে অসাধ্যসাধন করেছে। ও তো মহাপুরুষ মশাই। স্বয়ং বিশ্বকর্মা আবির্ভূত হয়েছেন। এতদিন পর সম্পত্তিগুলো আমার কাজে লাগবে। খুলুন খুলুন! ওর কোমরের দড়িগুলো খুলুন। আর ওই ব্যাটাকে জেলে ভরুন।

টাকইয়ের দিকে আঙুল তুললেন হারাধনবাবু।

 

 

এর পরের ঘটনা খুবই সামান্য। মস্ত অনুষ্ঠান করে ভেকুকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন। হারাধন ঘোষ কর্তৃক ভেকুকে নগদ দশ হাজার টাকা পুরস্কারপ্রদান। সেইসঙ্গে আরও একটা কাজ করলেন হারাধনবাবু। স্টেশন বাজারের সামনে ভেকুকে একটা তালা সারাইয়ের দোকান করে দিলেন। কিছুদিনের মধ্যেই দোকানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল নানাদিকে। মনের মতো কাজ পেয়ে ভেকুও দিব্বি খুশি।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন