বিনোদ ঘোষাল

খবরটা শোনা মাত্র পিলে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। একবিংশ শতাব্দির তস্কর সম্রাট নদু ওরফে নন্দ দুলে, যাকে ইন্টারপোল গত দুই দশক ধরে লাদেনখোঁজা খুঁজেও টিকির আশপাশ ছুঁতে পারেনি সেই নদু কিনা আচমকা কোনও অজ্ঞাতকারণে তার জন্মস্থান গুগলি জেলার কোন্দল পাড়ার পুলিশ ফাঁড়িতে আত্মসমর্পণ করেছে।
সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ একটা ছোট এরোপ্লেন কোন্দল পাড়ার মাঠে ল্যান্ড করে এবং সেখান থেকে নেমে আসে স্বয়ং নদু আর তার সতেরো নম্বর স্ত্রী চিঙ্কি। সঙ্গে দুই বিশ্বস্ত চেলা অকু আর পকু।
গাঁয়ের লোক প্রথমটায় নদুকে দেখে চিনতে পারেনি, বরং এরোপ্লেন থেকে বেরিয়ে আসা এই চারজনকে কোনও অলৌকিক প্রাণী ভেবে দৌড় লাগিয়েছিল। কিন্তু তারপর দু-চার কথার পরেই নদুকে চিনতে পেরে গ্রামশুদ্ধ হামলে পড়ে। হবে নাই-বা কেন এই নদুর জন্যই তো গুগলির অখ্যাত কোন্দলপাড়া উইকিপিডিয়াতে পর্যন্ত নাম তুলে ফেলেছে। নদু লিখে সার্চ মারলে জ্বলজ্বল করে নদুর জন্মস্থান কোন্দল পাড়া নামটা। এটা কি কম গর্বের।
মশাল, হ্যাজাক, হ্যারিকেন-সহ প্রায় শতিনেক বুড়ো-জোয়ান, বউ-ছেলে-মেয়ে রীতিমতো শোভাযাত্রা করে উপস্থিত হয় পুলিশ ফাঁড়িতে। বড়বাবু শ্রী হারাধন গাঁতাইত তখন অক্লান্ত ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। হঠাৎ অত লোকের হাঁকডাকে তিনি চোখ মেলে বেজায় ভড়কে গিয়ে বেমক্কা দৌড় মারেন। পরনের লুঙ্গিটা পর্যন্ত তার কাছছাড়া হয়ে যায়। শেষে গ্রামের লোকেরাই তাকে ধরে বেঁধে অনেক বুঝিয়ে কোনও ভয় নেই ইত্যাদি শুনিয়ে জল খাইয়ে নদুর সামনে এনে দাঁড় করায়। এবং নদু হাসিমুখে হিন্দি সিনেমার স্টাইলে হ্যান্ড কাফ পরানোর জন্য নিজের দুটো হাত বাড়িয়ে দেয়।
নদু কেন সারেন্ডার করল তাই নিয়ে দেশে বিদেশে হুলুস্থুল পড়ে গেল। দেশজুড়ে মানুষ একটানা কাজে ভুল করতে লাগল, পরস্পরের দিকে গভীর সন্দেহে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আপনমনে বিড়বিড় করতে লাগল। কাঁড়ি কাঁড়ি পুলিশ নেমে গেল রাস্তায়। যানজট, ফ্লাইট ক্যানসেল। টোটাল জনজীবন বিপর্যস্ত।
নদুর কেস উঠল জেলা আদালতে। নদু আবার সবাইকে চমকে দিয়ে নিজের পক্ষে কোনও উকিল রাখল না। যা বলার নাকি নিজেই বলবে। কী-ই যে বলবে তাই নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আলাপ-আলোচনা বেড়ে গেল টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে। টিআরপি বাড়তে থাকল হু-হু করে। কোনও বিশেষজ্ঞ বললেন, নদু নির্ঘাত কোনও নতুন গ্রহের সন্ধান পেয়েছে সেটাই জানানোর জন্য ধরা দিয়েছে।
যাই হোক কেসের দিন কোর্ট চত্বরে তিল ধারণের জায়গা নেই। মিডিয়ার লোকেরা হনুমানের মতো এডাল-ওডাল লাফাচ্ছে, ঠিক বেলা বারোটার সময়ে আদালত বসল। সরকারি পক্ষের উকিল শান্তশ্রী ভদ্র পাক্কা আড়াই গ্লাস জল খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো নদুর সামনে এলেন।
আপনার পুরো নাম?
নন্দ দুলে।
আপনি দু-হাজার সাতচল্লিশ সালের সাতই জুলাই রাত্রি সাড়ে সাতটা নাগাদ কোঁদলপাড়া পুলিশ ফাঁড়িতে আত্মসমর্পণ করেন?
আজ্ঞে হ্যাঁ।
আপনি জানেন আপনার বিরুদ্ধে সরকারি হিসেবে মোট তেরো হাজার সাতশো তেতাল্লিশটা চুরির অভিযোগ দায়ের রয়েছে।
নদু শান্ত হেসে বলল, বেসরকারি মতো ওটা পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে।
এ কথা সত্য যে এতদিন ধরে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা মহল বহু কাঠখড় জ্বালিয়েও আপনাকে ধরতে সক্ষম হয়নি। তাহলে আপনি হঠাৎ খামখা থুড়ি নিজে থেকে সারেন্ডার কেন করলেন?
নদু আবার বুদ্ধদেবের মতো স্নিগ্ধ হেসে বলল, এই প্রশ্নের উত্তরে মহামান্য আদালতের কাছে আমি আমার সংক্ষিপ্ত লিখিত বক্তব্য পাঠ করার অনুমতি চাইছি।
অনুমতি দেওয়া হল।
নদু বারকয়েক ভালো করে কেশে নিয়ে পকেট থেকে একটা চারভাঁজ করা কাগজ বার করে পড়তে শুরু করল—আপনারা সকলেই জানেন যে গত পঁচিশ বছর ধরে আমি একটি বিশেষ পেশার সঙ্গে জড়িত রয়েছি। প্রথম জীবনে আমি নেহাত শখের কারণে এই কাজে লিপ্ত হই। তারপর ধীরে ধীরে এর রস উপলব্ধি করতে পেরে শেষ পর্যন্ত এই নেশাকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করি।
এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত পৃথিবীর বহু গুণীজনের সঙ্গে দীর্ঘকাল দীর্ঘ সময় ধরে বাক্যালাপের পর আমি একসময়ে অনুভব করতে শুরু করি যে কাজের সঙ্গে আমি বা আমরা যুক্ত রয়েছি তা নিছক একটি কর্মমাত্র নয়। এটি শিল্প। এবং এমন একটি শিল্প যার সঙ্গে পৃথিবীর সাড়ে নিরানব্বই শতাংশ মানুষই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগে যদি এটা একটা শিল্পই হবে তাহলে এই একবিংশ শতাব্দিতে এসেও কেন চুরি একটি স্বতন্ত্র শিল্প হিসেবে সামাজিক প্রতিষ্ঠা পাবে না? কেন অন্যান্য পাঁচটা বৃত্তির মতো একেও আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হবে না?
এই সকল প্রশ্ন আমাকে উদ্বলিত করে তোলে। আমি অন্তরে অনুভব করি এই বিশ্বমুক্তির যুগে, যেখানে সবকিছু মুক্তি পাচ্ছে সেখানে এই মহৎ কাজকে আন্ডারওয়ার্ল্ডের কাজ বলা মানে সকল শিল্পের অপমান, সংস্কৃতির অপমান, পুরো মানবজাতির অপমান। তাই এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে যুক্ত একজন সামান্য কর্মী হিসেবে এর প্রতি অসম্মানের প্রতিবাদ করতেই আমি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিই এবং আমার জন্মস্থান, যেখানে আমার কর্মজীবনও শুরু হয়েছিল সেখানেই সারেন্ডার করব ঠিক করি।
একটানা এতগুলো কথা বলার পর নদু একটু থেমে কাগজ থেকে চোখ সরিয়ে সামনের অগুনতি শ্রোতার দিকে তাকাল। তারপর আবার দীপ্ত কন্ঠে বলে উঠল—উপস্থিত মহোদয়গণ এবং পৃথিবীর সকল শিল্পপ্রেমী এবং সমাজ সচেতন ব্যক্তিকে আমি আহ্বান করছি, আসুন আমরা অবিলম্বে এই পুণ্য আন্দোলনের শরিক হই। এই কলা তথা বৃত্তি সরকারি, সামাজিক স্বীকৃতি পাক এই কামনা করি, নমস্কার। বলে নদু কাগজটা তার পকেটে ঢুকিয়ে রুমাল দিয়ে মুখ মুছল। কয়েকমুহূর্ত পিনড্রপ সাইলেন্স।
তারপর দেওয়াল কাঁপানো হাততালি আর হইহই-তে কোর্টের কয়েকটা পলকা চেয়ার-টেবিলে চিড় খেয়ে গেল। জজ সাহেব অর্ডার অর্ডার বলে হাতুরিটা টেবিলে ঠুকে ঠুকে হাতলটা ভাঙার পর সকলে মোটামুটি চুপ করল। কয়েক হাজার চোখ জজের দিকে তাকিয়ে।
জজ সাহেব সাসপেন্সটাকে আরও চড়িয়ে দেওয়ার জন্যই বোধহয় বিরতি ঘোষণা করে দিলেন। ধ্যত্তেরি বিরতির আর সময় পেল না। আবার বেশ কিছুক্ষণ ধরে গোটা কোর্ট চত্বর জুড়ে কয়েক হাজার উৎকণ্ঠিত হৃৎপিণ্ডের সমবেত ধুপধাপ শব্দ।
বিরতি শেষ হল। জজ সাহেব থমথমে মুখ নিয়ে চেয়ারে বসলেন। তারপর বারতিনেক কেশে নিয়ে বললেন ব্যাপারটা হচ্ছে, নন্দবাবু আত্মপক্ষ সমর্থনে যা বক্তব্য রেখেছেন তা সত্যিই অভিনব এবং যুক্তিপূর্ণ। তাঁর বক্তব্যে আমি পুরোপুরি কনভিনসড। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে উনি যে প্রস্তাব এনেছেন চুরিকে লিগালাইজ করার, এই ব্যাপারে আমার নৈতিক সমর্থন থাকলেও কোনও দেশেই এমন কোনও আইন নেই। সুতরাং আমি একপ্রকার বাধ্য হয়েই নন্দ দুলে মহাশয়কে দণ্ডবিধির...যাহ কলা...।
নন্দ কিন্তু বসে রইল না। ওখান থেকে হাইকোর্ট তারপর সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত উঠে পড়ল। সুপ্রিম কোর্টেরও একই রায়। নন্দর প্রস্তাবে তাদের নৈতিক সমর্থন থাকলেও এই ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোনও আইন নেই, সেজন্য নন্দ দুলের সুবিচার করতে তারা অক্ষম।
ইতিমধ্যে নদু এবং কোর্ট এই দুইয়ের টানাটানি গোটা দেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুকে নন্দ দুলের নামে পেজ তৈরি হয়ে সেখানে লক্ষ লক্ষ লাইক পড়ছে নিত্যদিন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার রক্ষা সমিতিগুলো নদুর প্রস্তাবকে ভীষণভাবে স্বাগত জানিয়ে এবং এই ব্যাপারে আইন না থাকার জন্য সরকারের ব্যর্থতাকে ধিক্কার জানিয়ে মিটিং-মিছিলে রাস্তাঘাট ভরিয়ে ফেলল।
পত্র-পত্রিকায়, টিভি চ্যানেলগুলোয় নদুর ছোটবেলা, কী খেতে ভালোবাসে, গতকাল কোন তরকারিতে নুন বেশি হয়েছিল বলে নদু খায়নি থেকে শুরু করে নদু হাতমাটি করতে কোন সাবান পছন্দ করে পর্যন্ত ডিটেলে খবর দিতে লাগল। দেশ জুড়ে এমন উন্মাদনায় সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী অবিলম্বে ক্যাবিনেট মিটিং ডাকলেন। মিটিং-এর দিন ঠিক হল এগারোই আগস্ট।
২
নদু এদিকে সরকারি হেপাজত নামক একটি বিলাসবহুল বাংলোয় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। সারাদিন ল্যাপটপের সামনে বসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার নিজস্ব বিটগুলো ও অন্যান্য সংস্থাদের সঙ্গে যোগাযোগ, ই-মেলে আসা হাজার হাজার শুভেচ্ছাবার্তা থেকে বেছে বেছে বিশিষ্টদের শুভেচ্ছাগুলোর উত্তর পাঠানো, আন্দোলনকে আরও দৃঢ় করার জন্য জনমত সংগ্রহ, ক্যাডারদের দৈনিক কর্মসূচি ঠিক করা।
অকু আর পকুও বসে নেই। তারাও বসের সঙ্গে খেটে চলেছে দিনরাত। মিটিং-এর দিন যত এগোয় উত্তেজনার পারদ বাড়তে থাকে হু-হু করে। অবশেষে এল সেই দিন। দেশের অলিগলিতে নদুর আবক্ষ পোস্টার। নীচে লেখা নদু আমরা তোমার সঙ্গে আছি। সামরিক আধা সামরিক-বেসামরিক সব রকমের বাহিনিতে প্রত্যেকটা রাস্তা ভর্তি।
নির্দিষ্ট সময়ে প্রায় সমস্ত কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উপস্থিত। বাইরে সাংবাদিকরা কালো কালো লম্বা বুম নিয়ে একবার এর মুখে আরেকবার ওর মুখে ঠুসে ধরছে।
মিটিং শুরু হল। মিটিং-এর সভাপতি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী অতল ছ্যাছোরিয়া উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আজ আমাদের দেশ এক কঠিন অবস্থার সম্মুখীন। তারপর আরও এক কথা দু-কথা বলার পর যখন উনি বুঝতে পারলেন বক্তব্যের খেই হারাচ্ছেন তখন ছেদ টেনে বললেন, প্রথমে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীরামচোরামল বাটপারিয়াকে বলতে অনুরোধ করছি।
রামবাবু একটু হেসেই আবার গম্ভীর হয়ে বললেন কোনও রকম ভনিতা না করেই বলছি যে আমরা সত্যি-সত্যিই এই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে বেশ দেরি করে ফেলেছি। আমাদের অনেক আগেই চুরিটাকে লিগালাইজ করে দেওয়া উচিত ছিল। কারণ, প্রথমত চুরিকে সরকারি স্বীকৃতি দিলে পুলিশ গোয়েন্দা বিভাগের কাজ কমবে। এর ফলে চোর ধরার জন্য যে বিপুল খরচ হয় তা কমবে। আবার আরেক দিকে রিক্রুটমেন্ট কমবে। সেদিক থেকেও সরকারি তহবিলের অনেক সাশ্রয়। সুতরাং আমি তো এই ব্যাপারে লাভ ছাড়া আর কিছু দেখেছি না।
অর্থমন্ত্রী তূরীয় কৃষ্ণপুরম ধুতি ঝেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসে পড়ে বললেন, একদম ঠিক কথা। আরে বাবা চুরি তো প্রাচীনকালেও ছিল, এখনও আছে ভবিষ্যতেও থাকবে এবং বেশ বহাল তবিয়তেই থাকবে। এবং এই বৃত্তিটায় যে মিলিয়ন বিলিয়ন টাকার ট্রানজ্যাকশান হয় স্রেফ আইনি স্বীকৃতি নেই বলে কোনও স্টেটের অরিজিনাল রেভেনিউ আর লসের পিকচারটাই বোঝা যায় না। বাণিজ্যমন্ত্রী হামলে পড়লেন, একেবারে ঠিক, এই কথাটাই আমি এতদিন ধরে বলতে চেয়েছি, কেউ শোনেইনি। কত্ত সুবিধা চুরিকে আইনসঙ্গত পেশা করে দিলে। স্মাগলিং-এর মতো একটা বস্তাপচা টার্মকে বিদেশ বাণিজ্যের মধ্যে ঢেলে দেওয়া যাবে। রেভেনিউ বাড়বে। সবথেকে বড় কথা আমরা দেশের মানুষকে একটা ট্রান্সপ্যারেন্ট গভর্মেন্ট দিতে পারব।
পটাপট টেবিল চাপড়ানোর শব্দ উঠল।
তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বেণীগোপাল পুরকায়েত অনেকক্ষণ ধরেই কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যাপারটা খেয়াল করে বললেন, বেণীবাবু আপনি কি কিছু বলবেন?
হ্যাঁ হ্যাঁ বলে বেণীবাবু উঠে দাঁড়ালেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে কাগজ বার করে অত্যন্ত গদগদ কন্ঠে পড়তে শুরু করলেন—আজ এই পুণ্য লগ্নে উপস্থিত সকলকে জানাই আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের একজন সাক্ষী হিসেবে আমি নিজেকে গর্বিত বোধ করছি। এবং...
কথায় বাধা পড়ল, কর্মসংস্থান মন্ত্রী ওর পাঞ্জাবির খুট ধরে টানছেন। বেণীবাবু ভুরু কুঁচকে মাথা ঝুকিয়ে জিগ্যেস করলেন কী হল?
একটু তাড়াতাড়ি কমপ্টি করুন।
হ্যাঁ এই তো করছি। তো যা বলছিলাম চৌর্য মানে তো চাতুর্য। আর চাতুর্য কোথায় নেই? জীবন ধারণের প্রায় প্রতি পদক্ষেপেই আমাদেরকে এর আশ্রয় নিতে হয়। পূর্ববতী দুই বক্তা যুক্তির দ্বারা অত্যন্ত সুন্দরভাবে বুঝিয়েছেন যে চৌর্যবৃত্তিকে আইনি প্রতিষ্ঠা দিলে দেশের আর্থিক উন্নতি সাধিত হবে। তবে আমার ক্ষেত্র জনগণের আত্মিক দিকটা দেখা। সুতরাং সেই অ্যাঙ্গেল থেকে আমি কিছু বলতে চাই।
কৃষিমন্ত্রী বিড়বিড় করে আপন মনে বলে উঠলেন, হুঁ এতক্ষণে ভূমিকা শেষ হল।
দেখুন মাননীয় নদুবাবু তাঁর বক্তব্যে বলেছিলেন চৌর্য একটি কলা। এবং অতি প্রাচীন একটি কলা। সর্বোপরি এটি এমন একটি শিল্প যা প্রায় অন্যান্য সকল শিল্পেই মিশে রয়েছে। সাহিত্যে, সঙ্গীতে চুরির কথা তো আমরা জানিই, ইদানীং চলচ্চিত্র, থিয়েটার ইত্যাদিতেও এই শিল্পে দেদার প্রয়োগের প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।
আরে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে স্বয়ং বাগদেবী দেবতাদের অস্ত্র চুরি করেছেন, দেশের দু-দুটো মহাকাব্যই চুরির ঘটনাকে বেস করে লেখা। একটা পরস্ত্রী চুরি অন্যটায় রাজত্ব। এতকিছুর পরেও কেন যে এমন একটি শিল্পকে এখনও একঘরে করে রাখা হয়েছে ভাবলে দেশের সংস্কৃতির একজন প্রতিনিধি হিসেবে আমার লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে। আমি তো মানে...
কর্মসংস্থান মন্ত্রী দীনবন্ধু মশায় এবার বাধ্য হয়েই বেণীবাবুকে থামালেন। ধন্যবাদ বেণীবাবু। আপনার মূল বক্তব্য আমরা বুঝতে পেরেছি। আমার ছোট্ট কথা। দেশে কোটি কোটি বেকার। তখন এমন একটা চমৎকার স্বনিযুক্তি প্রকল্পকে আমরা কেন গ্রহণ করব না? দেশের কর্মহীন যুবশক্তি এই স্বরোজগার যোজনায় প্রচুর উপকৃত হবে। প্রয়োজন হলে অন্যান্য প্রশিক্ষণ সংস্থার মতো এই বিদ্যা শেখাতেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষাকেন্দ্র খোলা যেতে পারে এবং সরকারি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা উন্নতমানের শিক্ষাদানের ব্যবস্থাও করা যাবে।
কর্মসংস্থান মন্ত্রীর এমন প্রস্তাবে সকলে সাধু সাধু করে উঠলেন। মন্ত্রী বিগলিত হেসে বললেন, শুধু তাই নয়, যারা আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে রয়েছেন কিন্তু এই ট্রেনিং নিতে আগ্রহী তাদের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক থেকে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। পরে তারা বৃত্তিতে যোগদান করার পর মাসিক কিস্তিতে ঋণ শোধ করবেন। আবার হাততালি।
প্রায় সত্তরের মতো বয়েস মানব উন্নয়ন মন্ত্রী বনোয়ারিলাল পুরুষোত্তম গোটা মিটিংটায় মাথা নীচু করে চুপচাপ বসেছিলেন। বেণীবাবু ব্যাপারটা খেয়াল করে বললেন, বনোয়ারীবাবু আপনি কিছু বললেন না?
নাহ কী আর বলব?
তবু বলুন কিছু।
আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না একটা চোরের অন্যায় আবদারকে এমন খাতির দিয়ে আমরা আজ একটা অপরাধকে আইনি স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছি। এতে জনগনের কতটা নৈতিক অধ:পতন...
এবার বেনীবাবুরাই বনোয়ারিলালকে থামালেন, পুরুষোত্তমজি, আমাদের কবিগুরু কী বলেছেন জানেন, ভালোমন্দ যাহাই আসুক সত্যেরে লও সহজে। আর সত্যকে সহজে নেওয়াই তো নৈতিকতা।
কিন্তু...
বনোয়ারিবাবু আর সুযোগ পেলেন না। প্রধানমন্ত্রী আবার উঠে দাঁড়ালেন। মোটামুটি আমরা তাহলে সকলেই একমত। সুতরাং...
মিটিং শেষ হতে বাইরে আসতেই সাংবাদিকরা ঝাঁপিয়ে পড়ল। প্রধানমন্ত্রী হাসি হাসি মুখে বললেন, মিটিং সাকসেসফুল, আমরা অবিলম্বেই পার্লমেন্টে বিল আনছি। আশাকরি স্বাধীনতার একশো বছর পূর্তিতে আমরা দেশবাসীকে এই উপহার দিতে পারব।
বনোয়ারিলাল শেষ চেষ্টা করলেন। উঠে দাঁড়িয়ে তারস্বরে চিৎকার করে বললেন, কিন্তু চুরি শেষ পর্যন্ত একটি অপরাধ। তাকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া দেশের পক্ষে কতটা মঙ্গলজনক হবে?
অবশ্যই মঙ্গলজনক হবে। প্রথমত অমুক কেলেঙ্কারি, তমুক স্ক্যাম, কিকব্যাক ইত্যাদি শব্দগুলো আর থাকবে না। সরকারি তহবিলের সামান্য এদিক-ওদিক হলেই দেশের প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে হুটহাট তদন্ত কমিশন বসবে না। সিবিআই নামক ডিপার্টমেন্টটাই তুলে দেওয়া যাবে। খরচ কমবে এবং মন্ত্রীদের পদত্যাগ কমবে। ফলে দেশে রাজনৈতিক স্থিরতা আসবে। এবং...
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে পৃথিবীর প্রথম থেকে তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সবক'টা দেশে এই খবর পৌঁছে গেল। দেশে সরকার বিরোধী কয়েকটা দল এই বিল আনার বিরুদ্ধে আপ্রাণ প্রতিবাদ জানাল। কিন্তু যেহেতু এই দলগুলো আগে থেকেই সন্ত্রাসবাদী দল নামে পরিচিত সুতরাং তাদের প্রতিবাদ গ্রাহ্য হল না। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এই সিদ্ধান্তে তার প্রতিক্রিয়া জানালেন, এমন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ সত্যিই প্রশংসনীয়। এর ফলে আগামী দিনে আমেরিকার মৈত্রী বন্ধন আরও সুদৃঢ় হবে।
৩
কিন্তু যার জন্য এতকিছু সেই নদু কিন্তু সকাল থেকেই উদাস। ফুল-মালা, তোড়া আরও অনেক উপহারে ঘরদোর ভরতি। সারাদিন ধরে অগুনতি মানুষ এসেছে, নদু অনেকের সঙ্গে জোর করে মুখে হাসি এনে দু-চারটে কথাও বলেছে। কিন্তু এতবড় সাফল্যের পরেও যেন সেই আনন্দ নেই।
অকু আর পকু নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিল। বৌদি সেই সকালে শপিং-এ বেরিয়েছে, সন্ধে হয়ে গেল কিন্তু এখনও ফেরেনি। সেইজন্যই হয়তো বসের মুডটা ঠিক নেই।
নদুর এই সতেরো নম্বর বউ চিঙ্কির বয়েস পঁচিশ। ইরানের মেয়ে। নদু যখন মাসদুয়েক ইরানে ছিল তখন একদিন সন্ধেয় একটা হোটেল থেকে বেরোনোর সময়ে চিঙ্কি নদুর পকেট মেরে দেয়। কিন্তু নদুর সঙ্গে পারবে কেন? নদু কপ করে ওর হাত ধরে ফেলে আর ধরে ফেলে দু-দিনের মধ্যেই ইরানি মতে শুভবিবাহ। তাও প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল।
চিঙ্কি আগে যখন শুধুই পকেটমার তখন খানিকটা গরিব ছিল কিন্তু এখন তো টাকার অভাব নেই। তবু পুরোনো অভ্যাসটা পুরোপুরি যায়নি। দুম করে মাঝে মাঝে নেশাটা চাগিয়ে ওঠে। সকালে চিঙ্কি শপিং-এ যাচ্ছি বলে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই দারুণ সন্দেহ নিয়ে নিজের পার্সের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নদু। খুলে দেখে ঠিক তাই, পেট ফোলা পার্সটা নেতিয়ে পড়ে রয়েছে। নগদ টাকা তো বটেই বেশ কয়েকটা ডেবিট আর ক্রেডিট কার্ডও ছিল। সব হাওয়া। এমনিতে নদু সর্বক্ষণ টাকাপয়সা চিঙ্কির থেকে খুব সামলে রাখে। আজ সকালেই একটু বেখেয়াল হয়ে পড়েছিল। ব্যস...। তখন থেকেই মেজাজটা গুম হয়ে গেছিল নদুর। তারপর সারাদিন অশান্তিতে কেটেছে।
রাত্রি এগারোটা নাগাদ নদুর মোবাইলে চিঙ্কির ফোন এল, আজ ফিরব না, একটা নাইট ক্লাবে রয়েছি। দারুণ জমেছে।
তুমি আবার আমার টাকা মেরেছ! কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেল নদু। রাগটা গিলে নিয়ে শুধু বলল, হুম।
ফোন রেখেই নদু হাঁক পাড়ল, অকু—
হ্যাঁ স্যার। নদু ঢিলে গলায় খুব দু:খের সুরে বলে উঠল অকুরে...
আমায় আবার ডিভোর্স করতে হবে।
কেন স্যার?
ধ্যা...স এসব চোর-ছ্যাচ্চোরের সঙ্গে ঘর করা যায়!

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন