বিনোদ ঘোষাল

ঘুম ভাঙার কিছুক্ষণের মধ্যে বজ্রনাদের মাথায় হাত। এ কী সব্বোনেশে কাণ্ড! ঘুমটা হয়তো ঠিকঠাক এখনও ভাঙেনি এই ভেবে দুই থাবায় ভালো করে চোখ কচলে আবার একটা বড় করে ট্রাই নিল বজ্রনাদ। নাহ, একই অবস্থা। কিন্তু কাল রাত্রেও তো ঠিক ছিল। কোনও প্রবলেম হয়নি। একদম ফার্স্টক্লাস কোয়ালিটি যাকে বলে তাই। এমন অবস্থা হলে তো মুখ দেখানো দায় হয়ে যাবে। চোখে জল এসে গেল বজ্রনাদের। নেহাত চতুরপতি এসে পড়াতে সামলে নিতে হল। না হলে রাজামশাই কাঁদছে এই খবর একবার চতুরপতি জেনে ফেললে গোটা জঙ্গল জেনে ফেলতে দু-মিনিটও সময় লাগত না।
চতুরপতি এসেই রোজের মতো সাষ্টাঙ্গে একটা প্রণাম সারল বজ্রনাদকে। তারপর গলা খাঁকরে বলল, মহারাজ গুড মর্নিং।
বজ্রনাদ বললেন,—হুম।
—মহারাজের মন মেজাজ কি ভালো নেই? কিছু হয়েছে?
—কেন আমার আবার কী হবে?
—না মানে পেট খারাপ-টারাপ। কাল রাত্রে আসলে যে মরা মোষটাকে খেয়েছিলেন সেটা এতটাই পচা ছিল যে শকুনরাও খেতে এসে নাক চাপা দিয়ে পালিয়েছিল কি না।
—দেখো চতুর, খিদে পেলে আমি লোহাও হজম করে ফেলতে পারি। আমার ঠাকুরদা শুনেছি প্রচণ্ড খিদেয় একবার কোনও শিকার না পেয়ে আস্ত একটা মেলট্রেন খেয়ে ফেলেছিলেন, মনে রেখো আমি কিন্তু তারই নাতি।
—আজ্ঞে সে তো বটেই। মহারাজের পাকস্থলীর সঙ্গে আমাদের তুলনা। আমার তো কাল ওই মোষের গন্ধেই আজ পেটটা একটু নরম হয়েছে।
—যাকগে, এবার আসল সমাচার দাও এবং বিদেয় হও দেখি।
—হ্যাঁ, এবার বলি। বিষয় হচ্ছে যে জঙ্গলের উত্তরে একদল মানুষ এসে বাসা গেড়েছে। মহারাজ তো দীর্ঘকাল নরমাংস পাননি, তাই ভাবলাম এমন সুযোগ...হে হে হে।
—হুম। জানি, কাল বিকেলের দিকে ওদিকেই গেছিলাম, দেখে এসেছি। আর কিছু খোঁজ পেয়েছ কি? মানে কেন এসেছে ওরা, কী চায়?
—আজ্ঞে আমার কাছে সব খবর আপডেট মহারাজ। ওরা এসেছে জঙ্গল থেকে জড়িবুটি সংগ্রহ করতে। ওষুধ বানাবে বলে। ওরা ডাক্তার।
—হুম ভালো ভালো। বহুকাল মানুষ খাইনি।
—হ্যাঁ মহারাজ, বহুকাল আমিও ইয়ে মানে...।
—ঠিক আছে তুমি যাও।
আবার একটা লম্বা প্রণাম সেরে চলে যাওয়ার আগে আবার একবার কিন্তু কিন্তু করে চতুরপতি জিগ্যেস করেই ফেলল,—মহারাজ তাহলে সুস্থই রয়েছেন, যাক খুবই আনন্দের কথা।
—বারবার একই কথা জিগ্যেস করছ কেন বলো তো?
—আজ্ঞে আসলে আজ সকালে আপনার বজ্রগর্জন ডাক কেউ শুনতে পায়নি কি না, তাই গোটা জঙ্গলে এই নিয়ে খুব আলোচনা হচ্ছে। আপনি তো জানেনই মহারাজ, রোজ ভোর পাঁচটায় আপনি ডাক ছাড়েন। সময়ের এক চুলও এদিক ওদিক হয় না। তো আজ বোধহয় কেউ শুনতে পায়নি। ফলে সবার রোজের কাজকম্ম শুরু হতে দেরি হয়ে গেছে। আসলে আপনার ডাক শুনেই জঙ্গলের সবাই ঘড়ি মেলায় কি না। আমি সব্বাইকে বলেছি মহারাজ ডাক ছাড়েননি এমন হতেই পারে না। তোমাদের সকলের কান গেছে। ডাক্তার দেখাও।
এত পর্যন্ত শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না বজ্রনাদ। হাউ-হাউ করে কেঁদে ফেলল চতুরপতির সামনে।
—আরে রে রে মহারাজ এ কী কাণ্ড! এমন করেন কেন? আপনি হলেন এই প্রকাণ্ড জঙ্গলের একমাত্র রাজা। আপনাকে এত দুর্বলমতি হলে কি মানায়? মনকে শক্ত করুন, জল মুছুন। বলে নিজের ঝাঁকড়া লেজটা বজ্রনাদের দিকে বাড়িয়ে দিল চতুরপতি শিয়াল।
সেই লেজে ফ্যাঁচ ফোঁচ শব্দে নিজের নাকের জল চোখের জল সব মুছে বজ্রনাদ বলল আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে চতুর। বলেই দু-তিনটে ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে হ্যাঁচ্চো দিল।
—কী হয়েছে মহারাজ নির্দ্বিধায় বলুন। আপনার গলা দিয়েও তো প্রায় আওয়াজ আসছে না।
—চতুর, আজ সকাল থেকে আমার হালুমটা হারিয়ে গেছে।
—মানে?
—মানে আমার হালুম ডাক যার জন্য এই জঙ্গল ছাড়াও আশপাশের দশ-বিশটা জঙ্গলের সব্বাই আমাকে একডাকে চেনে, সেই হালুমটাকে আজ সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছি না।
—ধেৎ, এমন আবার হয় নাকি! আপনার নিজের ডাক কে নেবে?
—হয়েছে চতুর এমনই হয়েছে। কাল রাত্রেও শোওয়ার আগে ডাক দিয়ে শুয়েছিলাম।
—আজ্ঞে হ্যাঁ, সেই ডাক আমরা সকলেই শুনে তারপর ঘুমুতে গেছি।
—আর আজ সকালে ডাকতে গিয়ে দেখি...
—কী?
—বেমালুম ডাকটাই হাওয়া। রাত্রে ঘুমোনোর সময় কেউ চুরি করে নিয়েছে।
—সে কী কথা মহারাজ!
—তবে আর বলছি কী চতুর। আজ সকালে ডাকতে গিয়ে দেখি হালুমের বদলে...। কথা শেষ না করেই আবার ফুঁপিয়ে উঠল বজ্রনাদ। সেই ছোটবেলা থেকেই গলার জোর বাজ পড়ার মতো ছিল বলে বাবা শখ করে নাম রেখেছিল বজ্রনাদ। আর সেই আমি কি না আজ...
—আহহা মহারাজ, আপনি এত উতলা হবেন না। আচ্ছা একবার ডেকে দেখান দেখি কেমন শব্দ।
—না, না আর শুনতে চেও না প্লিজ!
—একবার শোনান মহারাজ। আমি কাউকে বলব না। ভরসা করুন, আমি আপনার অনুগত চেলা। না শুনলে রোগটা ধরব কী করে?
—রোগ নয়, রোগ নয়, স্রেফ চুরি গেছে।
—বেশ, একবার শোনান।
—একান্তই শুনবে...বেশ শোনো বলে প্রকাণ্ড হাঁ করে ডাক ছাড়ল বজ্রনাদ। ডাক আর বেরোল না, উলটে যেটা বেরোল তা শুনে চতুরপতিও হাসি চাপতে পারে না। স্রেফ ফ্যাও করে একটা শব্দ বেরোল অত্তবড় হাঁ থেকে। এও সম্ভব!
—শুনলে তো?
—হুম এ তো বড় কঠিন সমস্যা হল।
—কিছু একটা করো চতুর। নইলে এই জঙ্গল ছেড়ে আমাকে চলে যেতে হবে।
—হুম।
—কী হুম?
—দেখছি কী করা যায়? আচ্ছা মহারাজ গতকাল আপনি ঠিক কী কী খেয়েছিলেন সেটা আরেকবার মনে করবেন কি?
—বললাম তো একটা মোষ, ব্যস।—আর কিচ্ছু না।
—ভালো করে আরেকবার মনে করুন।
—না...ওহ হ্যাঁ, আর একটা সামান্য জিনিস চেটে খেয়েছিলাম। ওই মানুষগুলো একটা ছোট কাগজের কাপের মধ্যে কী যেন একটা সাদা সাদা জঙ্গলের মধ্যে ফেলে রেখেছিল। খানিকটা চেটে দেখেছিলাম, ব্যস।
—তাই? কেমন খেতে ছিল ওটা।
—মিষ্টি, অতি অখাদ্য। বলেই ফ্যাঁচ করে একটা হ্যাঁচ্চো দিল বজ্রনাদ।
—বুঝেছি, দেখছি কী করা যায়।
—প্লিজ কিছু করো চতুর। হালুম না থাকলে আমার বেঁচে থাকারও কোনও মানে হয় না।
—কোনও চিন্তা করবেন না মহারাজ। চতুরপতি বেঁচে থাকতে আপনার হালুম ফিরবেই। তবে মহারাজ একটা নিবেদন ছিল যে।
—শিগগির বলো কী চাই।
—বলছিলাম যে গর্তটায় আমি এখন থাকি সেটা এতই পুরোনো হয়ে গেছে যে স্ত্রী পুত্র নিয়ে থাকা দায় হয়ে উঠেছে। তো ওই আপনার নদীর ধারে পুরোনো বটগাছের যে কোটরটা রয়েছে সেই স্থানটুকু যদি আমাকে দেন...
—ওই কোটরে আমি মাঝেমধ্যে গিয়ে বিশ্রাম করি।
—আজ্ঞে সে জানি। আপনি যখন জল খেতে এসে ওখানে বিশ্রাম করবেন তখন আমি অবশ্যই সে স্থান খালি করে দেব।
—হুম। বেশ আমার হালুম যদি ফিরিয়ে দিতে পারো তবে...
—আমার আরও একটা আবদার ছিল।
—আরও? বেশ, বলে ফ্যালো।
—আজ্ঞে আমার স্ত্রী আর ছোট ছেলেটা হরিণ খাবে বলে ক'দিন ধরে খুব বায়না জুড়েছে। আমার নিজের সামর্থে তো হরিণ শিকার হবে না। তাই বলছিলাম হে হে...
—হুম বুঝেছি। বেশ যদি আমার হালুম আগামী কালের মধ্যে ফেরত আনতে পারো তবে কথা দিচ্ছি আগামী কালই তোমাকে দুটি হরিণ পুরস্কার দেব।
মহারাজের অসীম কৃপা। আমি চললাম মহারাজ। আগামী কালই আপনার হালুম ফেরত আনছি।
দেখো পারো কি না। বলে আবার দু-তিনটে হ্যাঁচ্চো দিল বজ্রনাদ।
এর পরের ঘটনা তবে খুবই সামান্য। কারণ তার পরদিনই চতুরপতি বিকেল নাগাদ একটি ছোট শিশি নিয়ে বজ্রনাদের কাছে আসে। এবং জানায় যে ওই শিশির মধ্যেই মহারাজের হারিয়ে যাওয়া হালুম ভরা রয়েছে। সে নিজের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে মহারাজের হালুম ফিরিয়ে নিয়ে এসেছে। তবে এই হালুম এখন লিকুইড অবস্থায় রয়েছে। বজ্রনাদকে টানা তিনদিন দুই বেলা এক ছিপি করে সেই লিকুইড খেতে হবে এবং সেইসঙ্গে রোজ বেলা বারোটার সময় নদীর গরম জলে গার্গল করতে হবে, তবেই মহারাজ আবার নিজের হালুম ফিরে পাবেন।
হলও তাই। চতুরপতির কথা শুনে তিনদিনের মাথাতেই বজ্রনাদ আবার ভয়ংকর হালুম ডাক ছাড়ল। গোটা জঙ্গলের আবার পিলে চমকে উঠল সেই ডাকে। আর পারিতোষিক হিসেবে চতুরপতি পেল দুটি বজ্রনাদের শিকার করা হরিণ এবং নদীর ধারের বট গাছের খাসা কোটর। কেউ জানল না বজ্রনাদের হালুমের কী হয়েছিল। এমনকী বজ্রনাদও না।
আসলে হয়েছিল কী, চতুর মহারাজের কাছে খানিকটা শুনেই আন্দাজ করে নিয়েছিল বজ্রনাদ, মানুষদের ওখানে গিয়ে এমন কিছু একটা খেয়েছে যার ফলে ওর গলায় ঠান্ডা লেগে গেছে। আর সেই কারণেই গলা থেকে হালুম ডাক আসছে না। তাই চতুর প্রথমেই চলে গেছিল জঙ্গলে সেই মানুষগুলো যারা জড়িবুটি সংগ্রহ করতে এসেছে, তাদের কাছাকাছি। এবং সেখানে দেখেছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বেশ কিছু প্লাস্টিকের ফাঁকা কাপ। গন্ধ শুঁকে বুঝে গেছিল চতুর ওই কাপগুলো আসলে আইসক্রিমের। তার মানে বজ্রনাদ ওই আধখাওয়া আইসক্রিম টেস্ট করতে গিয়েই গলার বারোটা বাজিয়েছে। রোগ ডিটেক্ট হয়ে গেল। এবার দরকার ওষুধ। একে চালাক তায় পণ্ডিত সুতরাং ওই মানুষদের তাঁবুতেই সুযোগ বুঝে ঢুকে টুক করে সর্দি-কাশির এক শিশি সিরাপ নিয়েই সে তল্লাট ছেড়ে দৌড় দৌড়।
এই গল্পটুকু অবশ্য বজ্রনাদও জানে না। তোমরাও কেউ বোলো না কিন্তু।

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন