কুমার তনু

বিনোদ ঘোষাল

কুমার তনু

 

কুমার ঝানু যদি না জন্মাতেন তাহলে পৃথিবীতে তার আসাটাই ফালতু হয়ে যেত। এমনটাই মত পাড়ার কুমার তনুর। কুমার তনুর আসল নাম অবশ্য তনুময় বসাক। কিন্তু পাড়াশুদ্ধ লোক তাকে কুমার তনু নামেই চেনে। এমনকী সরস্বতী থেকে দুর্গাপুজোর চাঁদার বিলেও কুমার তনু নামই লেখা হয়। ওই নাম লিখলেই পাড়ার সরস্বতী পুজোয় কম করে পঞ্চাশ টাকা, আর বড়দের দুর্গাপুজোয় পাঁচশো টাকা মিনিমাম। এসব ঘটনার পেছনেও একটা মস্ত ইতিহাস রয়েছে। সে কথায় পরে আসছি, তার আগে বলি তনুদার কুমার তনু হয়ে ওঠার রহস্যটা কী?

সবার আগে অবশ্য তনুর ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডটা কিঞ্চিৎ বলে নেওয়া প্রয়োজন। শিলাদিত্যপুরে বড়লোক বলতে খুব বেশি কেউ নেই। তবে যে-ক'জন রয়েছেন তাঁদের মধ্যে তনুরা অন্যতম। তনুর ঠাকুরদা রসময় বসাক ছিলেন চূড়ান্ত বেরসিক একজন মানুষ। কেন বেরসিক তা দু-কথা পরে বলছি। তবে তাঁর ছিল অসম্ভব ব্যবসায়ী বুদ্ধি আর পরিশ্রমের ক্ষমতা। বাংলাদেশ থেকে প্রায় খালি হাতে সপরিবারে একসময় চলে এসেছিলেন এখানে। এসে চাকরি-বাকরির আশায় বসে থাকেননি, কলকাতার বড় বাজারে একটা হোলসেল শাড়ির গদিতে কাজ শুরু করেছিলেন।

তারপর স্রেফ নিজের বুদ্ধি আর পরিশ্রমে ধীরে-ধীরে নিজেই ওই লাইনের ঘাঠঘোট বুঝে নিয়ে স্বাধীনভাবে ব্যবসা শুরু করেন। ঠাকুরদার তুখোড় বুদ্ধির সঙ্গে অবশ্য ভাগ্যও সঙ্গ দিয়েছিল। সুতরাং বছর কুড়ির মধ্যেই তিনি শিলাদিত্যপুরের একজন গণ্যমান্য ধনী ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যান। পেল্লায় একটা প্রাসদোপম বাড়ি, দুধসাদা অ্যাম্বাসাডর, দামি কুকুর—এ সবই তাঁর আমলেই হয়ে যায়। তাই রসময়বাবুর ছেলে দেবময় অর্থাৎ তনুময়ের বাবাকে আর বিশেষ পরিশ্রম করতে হয়নি। পৈতৃক সূত্রে যা ফুলে ওঠা ব্যবসা রেডিমেড পেয়েছিলেন, সেটাই ঠিকঠাক দেখাশোনা করেছেন আজীবন।

হ্যাঁ ব্যবসার ব্যাপারে তিনি বাপের যুগ্যি সন্তান। ব্যবসাকে আরও বড় করে তুলেছিলেন দেবময়। নিজস্ব তাঁত কারখানা করে ফেলেছিলেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাদের শাড়ি হোলসেলে যেত।

কিন্তু একটা ব্যাপারে বাপ-ব্যাটায় ছিল ভয়ংকর রকমের অমিল। রসময়বাবুর নামে রস থাকলেও আদতে ছিলেন ভয়ংকর বেরসিক। তাঁর বেরসিকতার নাম দূর দূরান্তরেও ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশেষ করে তিনি সঙ্গীত একেবারেই সহ্য করতে পারতেন না। একেক প্রকার গানে তার একেক রকমের অবস্থা হত। যেমন কীর্তন কানে ঢুকলে তাঁর টানা তিনদিন খুশখুশে কাশি হত। বাসক তুলসিপাতা মধুতেও সেই কাশি কমত না। বাউল গান শুনলে পাতলা দাস্ত অবধারিত। বাংলা কিংবা হিন্দি আধুনিক গান যদি কোনওভাবে তাঁর কানে যেত সঙ্গে-সঙ্গে তুমুল জ্বর। আর সবথেকে সাংঘাতিক ছিল ক্লাসিকাল, মানে ঠুংরি টপ্পা। শুনলে সঙ্গে-সঙ্গে দাঁতকপাটি লেগে মুচ্ছো যেতেন।

সেই কারণে তাঁর বাড়িতে তো দূরের কথা, বাড়ির আশেপাশেও গানের চর্চা এমনকী গানের মজলিস বা মাইক্রোফোনে গান চালানো বিশেষভাবে নিষিদ্ধ ছিল। পাড়ার লোকে এবং ছেলে-ছোকরারা তাঁর এই আপত্তি শুনত। তার কারণ তিনি এমনিতে ছিলেন খুবই পরোপকারী। কারও বিপদে-আপদে তৎক্ষণাৎ স্বশরীরে এসে সাহায্য করতেন।

শিলাদিত্যপুরে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং একটি প্রাইমারি স্কুলও নিজের খরচে তৈরি করেছিলেন তিনি। সঙ্গে আবার একটি অ্যাম্বুলেন্স। এ ছাড়াও পাড়ায় ফুটবল ম্যাচ থেকে যে-কোনও পুজোপার্বনে মোটা টাকা চাঁদা দিতেন। তাই পাড়ার মানুষ ওঁর এইটুকু আপত্তি মেনে নিয়েছিল। দুর্গাপুজোয় কোনও গান বাজত না। কারও বাড়িতে কেউ গানের চর্চা করত না। এমনকী কীর্তনের আসরও বসত না কোথাও।

সবথেকে ভয়ানক কথা হল, তিনি নিজে উকিলকে দিয়ে শেষ ইচ্ছেয় লিখে দিয়ে গেছিলেন যে তিনি মারা যাওয়ার পর শবযাত্রায় এবং শ্রাদ্ধবাসরে যেন কেত্তন বা কোনওপ্রকার গান না গাওয়া হয়, তাহলে তাঁর আত্মা শান্তি পাবে না।

তো এমন রসময়বাবুর ছেলে দেবময়বাবুই শেষ পর্যন্ত হয়ে উঠলেন বাপের মৃত্যুর কারণ। এমনিতে নিজের বাবাকে খুবই শ্রদ্ধাভক্তি করতেন তিনি, বাল্যকাল থেকে। পারিবারিক কারণেই তিনি গানবাজনার ধারেকাছেও যেতেন না। গান শোনা মানে একটি অপরাধ এমনই বরাবর জেনে এসেছিলেন তিনি।

কিন্তু কলেজ লাইফে একবার বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে কলকাতায় এক গানের অনুষ্ঠানে গেছিলেন। সেখানে এক মস্তবড় ওস্তাদজি ক্লাসিকাল গেয়েছিলেন। সেই গান শুনে তো তাঁর মাথা ঘুরে গেল। আহা এত সুন্দর! এত অপূর্ব হয় নাকি গান! ব্যস পড়বি তো পর একেবারে পিওর ক্লাসিকাল মিউজিকের প্রেমে পড়ে গেলেন তিনি। বাবাকে লুকিয়ে একটা রেকর্ডপ্লেয়ার কিনলেন, আর কাঁড়ি-কাঁড়ি ক্লাসিকাল মিউজিকের রেকর্ড। সেখানে আমির খাঁ থেকে বেগম আখতার, বড়ে গুলাম আলী থেকে ভীমসেন যোশি কে নেই। অনেক রাত্রে বাবা ঘুমিয়ে পড়ার পর চুপিচুপি তিনি রেকর্ড বাজিয়ে শুনতেন সেইসব গান।

একদিন ঘটল বিপদ। গভীর রাতে দেবময় বড়ে গুলাম আলীর বাজুবন্ধ খুলু খুলু যায় শুনছিলেন। টেরই পাননি তাঁর বাবা কখন ঘুম ভেঙে উঠে একেবারে দেবময়ের ঘরের দরজা খুলে ঘরে ঢুকে পড়েছেন।

—এই সব কী শুনছিস তুই। অ্যাঁ, কী শুনছিস! বলতে-বলতেই দাঁতকপাটি। কথা আর শেষ করতে পারলেন না। বুকে হাত দিয়ে সেখানেই ধড়াস করে পড়ে গেলেন। সঙ্গে-সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল, কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বয়স হয়েছিল, তাই এতবড় কার্ডিয়াক অ্যাটাক আর সামলাতে পারলেন না।

বাবার মৃত্যুর পর দেবময়বাবু গান শোনা ছেড়ে দিলেন চিরকালের মতো।

কিন্তু রক্তের দোষ যাবে কোথায়? কীভাবে যেন সেই গান শোনার নেশা ছড়িয়ে গেছিল দেবময়ের একমাত্র সন্তান তনুময়ের মধ্যে। তবে বাবার মতো ক্লাসিকাল গান নয়, একেবারে ফিল্মি গান। আর কোনও এক রহস্যজনক কারণে গায়ক কুমার ঝানুর কণ্ঠের প্রেমে পড়ে গেল তনুময়। প্রেম মানে একেবারে পাগলের মতো প্রেম। তার নিজের ঘরে ভর্তি কুমার ঝানুর বিভিন্ন পোজের ফটোগ্রাফ, ইন্টারভিউ-এর কাটিং। এযাবৎ প্রকাশিত তাঁর সব গানের অ্যালবাম।

প্রতি বছর কুমার ঝানুর জন্মদিনে বিশাল ভুঁড়িভোজের ব্যবস্থা। পাড়া বেপাড়া মিলিয়ে প্রায় হাজার মানুষ দুবেলা পাত পেড়ে খায়। একেবারে হইহই অবস্থা। তবে পাগলামোর পাশাপাশি নিজের ফ্যামিলি ট্রাডিশন বজায় রেখে ব্যবসার দিকেও যথেষ্ট নজর দিত তনু। শুধু দোকানের ভেতরে একটা মস্ত বড় কুমার ঝানুর ছবি। প্রতিদিন সকালে ফুল মালা দিয়ে পুজো করে তারপর ব্যবসা শুরু করত। আর দোকানের যারা কর্মচারী তাদের প্রত্যেকের গলায় ঝানুর ছবির লকেটওলা একটা হার পরা বাধ্যতামূলক ছিল। মেনেও নিয়েছিল কর্মচারীরা।

সবই ঠিক ছিল। শুধু জীবনে দুটো আফশোস ছিল তনুময়ের। প্রথম দুঃখ, বড্ড ইচ্ছে ছিল নিজের তনুময় বসাক নামটা বদলে কুমার তনু করে ফেলার। তাহলে গুরুর নামের কাছাকাছি আরেকটু আসা যেত। সেইমতো চেষ্টাও শুরু করে দিয়েছিল তনু। কিন্তু শেষমেষ আটকে গেল প্ল্যানটা। আইনি জটিলতার কারণেই তার আর কুমার তনু নাম নেওয়া হল না। তবে কেউ তার নাম জিগ্যেস করলে নিশ্চিন্তে 'কুমার তনু' নামই বলে, আর এলাকার লোক তাকে কুমার তনু বলেই ডাকে। অবশ্য সেটা কতটা ব্যঙ্গে আর কতটা আদরে বোঝা মুশকিল।

তাঁর দ্বিতীয় ইচ্ছে হল গুরুর মতো গান গাওয়ার। কিন্তু ভগবান বাকি অনেক কিছু তনুকে দিলেও সুর বস্তুটা তার গলায় একেবারেই দেয়নি। উলটে এমনই ফ্যাসফেসে গলা যে সেই গলা থেকে গান বেরোনো তো দূরের ব্যাপার, কথা বললেও মনে হয় ক্যাসেটের ফিতে জড়িয়ে গেছে। একেবারে শালিকপাখির কিচিরমিচির টাইপ। তারপরেও প্রায় দু-ডজন গানের মাস্টার রেখেছিলেন তনুময়। বড্ড শখ যে। সকলেই ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি বলে পালিয়েছে। এক মাসও টেঁকেনি কেউ। সেই দাগাটা বড্ড মনে লেগে রয়েছে।

তো এই হল কুমার তনুর মোটামুটি ইতিহাস। এইভাবেই চলছিল। হঠাৎই ঘটল এক তুমুল বিপর্যয়। অনেক রাত্রে দোকানে বসে তনু আর তার ছোটবেলার বন্ধু বাপ্পা মিলে চিনেবাদাম সহযোগে কোল্ডড্রিঙ্ক খাচ্ছিল। কথায় কথায় বাপ্পা বলল, তুই কিন্তু গানের চেষ্টাটা চালিয়ে যেতে পারতিস। এত সুন্দর গলা তোর!

পাড়ার একনম্বর পাগল হারানও জানে তনুর গলা কী জিনিস! সারাজীবন দিনে পঁচিশ ঘণ্টা রেওয়াজ করলেও ওই গলার কিছু হেরফের হওয়ার নয়, কিন্তু বাপ্পার এছাড়া কিছু উপায় ছিল না। কারণ, তনুর কাছে ওর অনেক টাকা ধার ছিল। শোধ দেওয়ার ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনওটাই না থাকায় স্রেফ তনুর কণ্ঠের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেই কিস্তিতে-কিস্তিতে শোধ দিত।

গ্লাসে শেষ চুমুকটা দিয়ে ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল তনুময়। বলল,ইচ্ছে তো ছিল রে ভাই। লড়াইও করেছি অনেক। কিন্তু কেউ বুঝল না...এই এক তুই ছাড়া।

বলতে-বলতেই কাঁদো-কাঁদো হয়ে উঠল তনু।

—মন খারাপ করিস না তনু। আমি আছি যখন তোর একটা ব্যবস্থা আমি করেই ছাড়ব। তোর কী স্বপ্ন শুধু একবার আমাকে বল।

—আমার স্বপ্ন তো তুই জানিসই। জীবনে অন্তত একবারের জন্য গুরুর মতো ফাংশনে সকলের সামনে গান গাইবার ইচ্ছে ছিল। সেটা আর হল না!

—কেন হবে না? তুই কবে ফাংশন করতে চাস বল? পাবলিক জোগাড় করার দায়িত্ব আমার।

—না রে, আমার মধ্যে সেই সুর সেই আবেগ কোথায়? 'হল না' 'হল না' বলতে-বলতেই ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল তনু।

—কাঁদিস না ভাই কাঁদিস না। তোর বন্ধু বেঁচে থাকতে তোর স্বপ্ন পূরণ হবে না তাই কখনও হয়? আলবাত হবে।

—কী করে?

—সিম্পল। পাড়ায় একটা প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করি, সেখানে স্রেফ তুই গাইবি।

—খেপেছিস? আমার গান কে শুনতে আসবে?

—আরে বাবা, আমি কি এতই বোকা। তুই স্টেজে থাকবি, হাতে মাইকও থাকবে। বাকি সব হ্যান্ডসও বাজবে আর আমি কুমার ঝানুর গান চালাব তুই জাস্ট লিপ মেরে দিবি।

—না-না, ওসবে প্রচুর রিস্ক। কে কোথা থেকে কাঠি মেরে দেবে, প্রেস্টিজের পাঁচ হয়ে যাবে। পাড়ায় আর থাকতে পারব না। তুই অন্যকিছু ভাব।

—অন্যকিছু...! হুমম...! বলে কিছুক্ষণ নিজের মাথায় টোকা দিয়ে ভাবল বাপ্পা। তারপর ঘাড় নেড়ে বলল, তোর ইচ্ছে তুই গান গাইবি, এবং সেটা সবাই দেখবে—তাই তো?

—হু।

—এবং তুই গুরুর গলায় গান গাইতে চাইছিস?

—একদম।

—হয়ে যাবে কোনও চাপ নেই। শুধু একটু খরচা করতে হবে।

—খরচের কথা তুই ভাবিস না। কিন্তু কোনও রিস্ক হবে না তো?

—আমি আছি যখন তোর নো রিস্ক। পুরোটা আমার ওপর ভরসা কর। তুই শুধু টাকা ঢালবি বাকিসব দায়িত্ব আমার।

 

 

 

ব্যবস্থা খুবই সোজা এবং অভিনব। পুরো পঞ্চাশ হাজার টাকা কুমার তনুর কাছ থেকে আদায় করল বাপ্পা। তার থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিল একটা লোকাল মিউজিক পার্টিকে।

প্ল্যানটা হল, একটা হলঘরে কুমার তনু মাইক হাতে করে একের পর এক কুমার ঝানুর গান গাইবে। আহা সত্যি সত্যি নয়, জাস্ট লিপ দেবে। অরিজিনাল গানগুলো বাজবে সিডিপ্লেয়ারে। আর মিউজিক হ্যান্ডসরা সেই অরিজিনাল গানের সঙ্গেই যে যার বাজনা বাজাবে। এবং পুরো ভিডিয়ো রেকর্ডিং হবে। রেকর্ডিং এডিটিং ও মিক্সিং হওয়ার পর লোকাল কেবল চ্যানেলে দেখানো হবে। ব্যস, রিস্কও থাকল না আবার পাবলিকও দেখল। সাপও মরল, লাঠিও ভাঙল না। জব্বর প্ল্যান। শুধু মিউজিশিয়ান থেকে রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার, সক্কলকে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতে হবে। এটাই শর্ত।

পুরো ব্যাপারটা কুড়ি হাজার টাকার মধ্যে ম্যানেজ করে ফেলল বাপ্পা। বাকিটা ওর নিজের পকেটে। আহা প্ল্যানিং-এর একটা খরচ আছে না? সবাই রাজি হয়ে গেল। বেঁকে বসল শুধু রেকর্ডিং ইঞ্জিনিয়ার। এত কম টাকায় কোনওমতেই এমন দুনম্বরি কাজ করবে না। বাপ্পা শেষে বাধ্য হয়ে কথা দিল কাজটা ভালোয়-ভালোয় মিটে যাক, তারপর খুশি করে দেবে। ইঞ্জিনিয়র নিমরাজি হল। তারপর একটা শুভ দিন দেখে পুরো ব্যাপারটা মিটে গেল। ফাটাফাটি ব্যাপার। তনু হাতে মাইক নিয়ে শুধু লিপ দিচ্ছে, নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করছে। অর্কেস্ট্রাপার্টি বাজনাও বাজাচ্ছে। পুরো ব্যাপারটা রেকর্ডিং হয়ে গেল। সিডিও তৈরি হয়ে গেল। একদিন বাড়িতে তনু আর বাপ্পা মিলে সেই সিডি দেখেও ফেলল। পুরোটা দেখে আনন্দে আবেগে বাপ্পাকে জড়িয়ে ধরল তনু। গদ গদ গলায় বলল, তুই আমার সাচ্চা বন্ধুরে বাপ্পা। এতদিন পর আমার স্বপ্ন পূরণ হল।

—দাঁড়া দাঁড়া এখনও খেল বাকি। পরশুদিন কেবলে প্রোগ্রামটা চলতে দে তারপর দেখবি কী হয়!

—উহ, আমি তো ভাবতেই পারছি না।

 

 

তারপরেই ঘটল সেই সাংঘাতিক ঘটনা। পরের দিন লোকাল কেবল চ্যানেলে যোগাযোগ করে পুরো ব্যাপারটা ম্যানেজ করে ফেলল বাপ্পা। কেবল অপারেটর পুরো কেস শুনে হাঁ। মনে-মনে বলল এত বড় ধাপ্পাবাজি! দাঁড়াও বাচ্চু, তোমার মজা দেখাচ্ছি।

কয়েকদিন ধরে রিকশা করে মাইক বাজিয়ে পাড়ায় ঘোরা হল 'আগামীকাল লোকাল কেবল চ্যানেলে কুমার তনুর একক গানের অনুষ্ঠান শুনুন সন্ধে সাড়ে সাত ঘটিকায়।' কেবলেও বিজ্ঞাপন দেওয়া হল। সকলেই জেনে গেল ব্যাপারটা।

সবশেষে এল সেই শুভক্ষণ।

পাড়ার অনেকেই সন্ধে সাড়ে সাতটায় টিভি খুলে বসেছে। দেখা যাক কুমার তনু কী গান করে।

গান শুরুও হল...কিন্তু এ কী! গানের ভঙ্গি করছে তনু, অথচ গান হচ্ছে কোনও মহিলার কণ্ঠে।

হইহই করে উঠল সব্বাই। এ আবার কি?

খানিকক্ষণের মধ্যেই আসল ব্যাপারটা বুঝে গেল সবাই। হাসির হুল্লোড় উঠল পাড়া বেপাড়া জুড়ে। আর সেদিন রাত্রেই বাপ্পা এবং কুমার তনু পাড়া ছেড়ে যে যার মতো হাওয়া। পাক্কা একমাসের জন্য।

আসলে পুরো কাণ্ডটা ঘটিয়েছিল কেবল অপারেটরই। তনুর গানের ভিডিয়োটা চালিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু গানটা চালিয়েছিল অন্য একজন লতা কণ্ঠির। ব্যস, একেবারে মাঠে হাঁড়িভাঙা অবস্থা।

অবশ্য এরফলে একটা ভালো ব্যাপার ঘটল। একমাস পরে কুমার তনু যখন বাড়ি ফিরল তখন সে একেবারে অন্য মানুষ। কুমার ঝানুর নাম শুনলেই খেপে যায়।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন