দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)

অনীশ দেব

বহুকাল আগে এক অর্ধ-সভ্য রাজা ছিল, মানুষটা ছিল বিচিত্র কল্পনাবিলাসী, আর তার কর্তৃত্ব ছিল এতই অপ্রতিরোধী যে খুশিমত সে নিজের অদ্ভুত কল্পনাকে বাস্তবে রূপায়িত করত৷ নিজের সঙ্গে নিবৃতে কথা বলা তার স্বভাব ছিল, আর, যখন সে ও তার সত্তা কোন বিষয়ে একমত হত, তক্ষুণি, সেটা, কার্যকরী করা হত৷ যখন তার, ঘরোয়া ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ মসৃণভাবে এগিয়ে চলে, তখন তার আচরণ হয় নম্র ও অমায়িক কিন্তু যখনই কোথাও সামান্য সঙ্কট দেখা দেয় তখনই সে হয়ে ওঠে আরো নম্র এবং আরো অমায়িক—কারণ, বক্র জিনিসকে ঋজু করতে বা অসমান জমিকে আঘাত করে সমান করতে সে সবচেয়ে বেশী উল্লসিত হত, উন্মুক্ত মল্লভূমিতে পুরুষালী ও পাশবিক শৌর্যের প্রদর্শনীতে আর বহিঃপ্রকাশ ঘটত৷ পরিবেষ্টিত আসন-শ্রেণী, রহস্যময় কুঠরী ও অদৃশ্য গলিপথের সমন্বয়ে তৈরী এই মল্লভূমি যেন আদর্শ বিচারের প্রতিভূ—সেখানে অপরাদী শাস্তি পায় এবং সৎ ব্যক্তি পুরস্কৃত হয় সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ও সৎ দৈব ঘটনার অনুশাসনে৷

যখনই রাজাকে আকৃষ্ট করার মত গুরুত্বপূর্ণ কোন অপরাধে কাউকে অভিযুক্ত করা হত, তখনই দিকে দিকে ঘোষণা করে দেওয়া হত যে এক নির্দিষ্ট দিনে রাজার মল্লভূমিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির ভাগ্য নির্ধারিত হবে৷ সমস্ত দর্শক গ্যালোরির আসনে জমায়েত হলে, এবং রাজা তার সভাসদ পরিবৃত হয়ে মল্লভূমির একপ্রান্তে উচ্চ রাজসিংহাসনে উপবেশন করার পর সে একটি শিারা করত, তার ঠিক নিচে একটি দরজা খুলে যেত, এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রবেশ করত রঙ্গভমিতে৷ রাজার সরাসরি বিপরীত দিকে, আবদ্ধভূমির দূরপ্রান্তে, অবস্থিত ছিল দুটি দরজা, পাশাপাশি এবং একে অপরের অবিকল প্রতিরূপ৷ বিচারাধীন ব্যক্তির কর্তব্য এবং অধিকার ছিল সোজাসুজি এই তরজা অভিমুখে যাওয়া এবং দুটির একটি দরজা খুলে ফেলা৷ সে তার খুশিমত যে কোন দরজা খুলতে পারে, নিছক নিরপেক্ষ ও নিখাদ দৈব ছাড়া আর কোন রকম উপদেশ বা প্রভাব তার সিদ্ধান্তকে সংক্রমিত করতে পারত না৷

একটি দরজা খুললে বেরিয়ে আসত এক ক্ষুধার্ত বাঘ, ভয়ঙ্কর ও হিংস্র, তৎক্ষণাৎ সে ঝাঁপিয়ে পড়ত তার ওপরে, অপারধের শাস্তি হিসেবে তাকে ছিঁড়ে ফেলতো টুকরো টুকরো করে৷ যে মুহূর্তে অপরাধীর মামলার এইভাবে নিষ্পত্তি হত, তখনই বিষাদের সুরে লৌহ-ঘণ্টা বাজানা হত, মল্লভূমির সীমানায় মোতায়েন করা ভাড়াটে শোককারীর দল সোচ্চার বিলাপ করত, এবং বিপুল জনতা মাথা নীচু করে ভগ্ন হৃদয়ে ধীরে ধীরে রওনা হত তাদের স্বগৃহ অভিমুখে, এইরকম তরুণ ও সুদর্শন, অথবা বৃদ্ধ ও সম্মানীয়, কোন মানুষের শোচনীয় দুর্ভাগ্যজনক পরিণতির কথা ভেবে তারা যথেষ্ট শোক প্রকাশ করত৷

কিন্তু যদি সেই অভিযুক্ত ব্যক্তি অন্য দরজা খুলত তাহলে বেড়িয়ে আসত এক রমণী, সুন্দরী প্রজাদের মধ্যে থেকে রাজার নিজের হাতে বেছে দেওয়া, এবং সেই ব্যক্তির বয়েস ও পদমর্যাদার সঙ্গে মানানই৷ এবং নির্দোষিতার পুরস্কার স্বরূপ সেই অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে মহিলাটির তৎক্ষণাৎ শুভবিবাহ সম্পন্ন হত৷ তার যে ইতিপূর্বে কোন স্ত্রী কিংবা পরিবার থাকতে পারে, অথবা তার ভালবাসা নিজের পছন্দসই কারো ওপরে অনুগত ভাবে অঙ্গাঙ্গী হতে পারে তাতে কিছু ইতর বিসেষ হত না, এ ধরনের হীনতর কোন ব্যবস্থাকে রাজা তার প্রতিশোধ ও পুরস্কারের মহান পরিকল্পনার পথে কোন রকমেই প্রতিবন্ধক হতে দিত না৷ মল্লভূমির মধ্যেই সমস্ত কার্যকলাপ তৎক্ষণাৎ ঘটে যেত৷ রাজার আসনের ঠিক নীচেই একটি দরজা খুলে যেত, সমবেত গায়কবৃন্দ ও স্বর্ণশিঙায় আকাশে-বাতাসে খুশির তরঙ্গ তুলে নৃত্যরত কুমারীর দল জনৈক পুরোহিতকে অনুসরণ করে এগিয়ে যেত পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা যুগলের কাছে, এবং ধুমধামের সঙ্গে দ্রুত বিধিসম্মত ভাবে শুভবিবাহ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হত তাদের৷ তারপর পিতলের ঘণ্টায় বেজে উঠত অনাবিল খুশির ধারাবাহিক ঘণ্টাধ্বনি, উপস্থিত জনতা উল্লাসের গুঞ্জন তুলত, আর সেই নির্দোষ মানুষটি তার নব বিবাহিতা বধূকে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হত৷ তার চলার পথে শিশুর দল ছড়িয়ে দিত অজস্র ফুল৷

এই দিন সেই রাজার অর্ধ-সভ্য বিচারের পদ্ধতি৷ এর নিখুঁত নিরপেক্ষ চরিত্র অত্যন্ত স্পষ্ট৷ অপরাধী জানতে পারত না কোন্ দারজা দিয়ে বেরিয়ে আসবে সুন্দরী মেয়েটি, পরমুহূর্তে সে কোন হিংস্র পশুর খাদ্য হবে না কোন সুন্দরীর পাণিগ্রহণ করবে সে বিষয়ে কণামাত্র ইঙ্গিত না পেয়েই অভিযুক্ত ব্যক্তি তার পছন্দসই দরজাটি খুলত৷ কোন কোন সময় বাঘটি এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসত, আর কখনও বা অন্য দরজা দিয়ে৷ এই বিচারের সিদ্ধান্ত যে শুধুমাত্র নিরপেক্ষ তা নয়, নিশ্চিতভাবে চূড়ান্ত, যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজেকে অপরাধী হিসেবে আবিষ্কার করে, তাহলে সেই মুহূর্তেই সে শাস্তি পেয়ে যাচ্ছে, আর যদি সে নিরপরাধ হয়, তাহলে পুরস্কারও পাচ্ছে তৎক্ষণাৎ, তা সেটা তার পছন্দ হোক বা না-ই হোক৷

রাজার মল্লভূমিতে এই বিচিত্র বিচারের হাত থেকে কোন নিষ্কৃতি ছিল না৷

এই বিধান অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল৷ এ জাতীয় কোন মহা বিচারের সময় জনগণ যখন জমায়েত হত, তখন তারা ঘুণাক্ষরেও জানত না তারা রক্তাক্ত নরহত্যা দেখতে এসেছে, না আনন্দমুখর কোন বিবাহ অনুষ্ঠান৷ এই অনিশ্চয়তাটুকু ঘটনার প্রতি সকলের এমন এক অদ্ভুত কৌতূহল জাগিয়ে তুলত যা অন্য কোন ভাবে সম্ভবপর ছিল না৷ সুতরাং এইভাবে জনগণকে খুশি করা হত, সন্তুষ্ট করা হত, এবং দেশের বুদ্ধিজীবী শ্রেণী এই পরিকল্পনাকে অন্যায় পক্ষপাতদুষ্ট বলে নিজের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগও আনতে পারত না৷ কারণ, পুরো বিচারের ভারটাই কি অভিযুক্ত ব্যক্তির হাতে নয়?

এই অর্ধ-সভ্য রাজার এক মেয়ে ছিল, আর বহুবর্ণ কল্পনার মতই ফুটফুটে, এবং একই রকম চূড়ান্ত উদ্ধত৷ এ সব ক্ষেত্রে সচরাচর যা হয়ে থাকে, মেয়েটি ছিল রাজার নয়নের মণি এবং রাজা তাকে অস্বাভাবিক ভালবাসত৷ তার সভাসদদের মধ্যে ছিল একজন যুবক৷ ভালবাসার যে সব সনাতনী নায়করা সাধারণ রাজকন্যাদের প্রেমে পড়ে থাকে, আমাদের এই প্রেমিকের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা ছিল না৷ এই রাজকন্যাটি তার প্রেমিকাকে নিয়ে সন্তুষ্টই ছিল, কারণ যে ছিল রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন ও সাহসী৷ আর মেয়েটি তাকে এত উদ্দামভাবে ভালবাসত যে সেই বন্য ভালবাসা ছিল যেমন উষ্ণ তেমন শক্তিশালী৷

বহু মাস ধরে এই ভালবাসা সুখ স্বাচ্ছন্দ্য এগিয়ে চলল৷ অবশেষে রাজা একদিন এর অস্তিত্ব টের পেল৷ নিজের কর্তব্য পালনে এক মুহূর্তও ইতস্ততঃ করল না সে৷ যুবকটিকে তৎক্ষণাৎ কারাগারে নিক্ষেপ করা হল, এবং মল্লভূমিতে তার বিচারের জন্য একটি দিন নির্দিষ্ট করা হল৷ এটা অবশ্যই একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এবং এই বিচারের অগ্রগতি ও পরিণতি প্রত্যক্ষ করার আগ্রহে রাজা ও প্রজাবৃন্দ একইভাবে অধীর হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল৷ এ ধরনের ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি, আগে কখনও কেউ রাজকন্যাকে প্রেম নিবেদন করার দুঃসাহস দেখায়নি৷

সবচেয়ে হিংস্র ও শক্তিশালী জন্তুদের খোঁজে রাজ্যের সমস্ত বাঘের খাঁচা অনুসন্ধান করে দেখা হল৷ এইসব হিংস্র বাঘদের মধ্যে সবথেকে সর্বাপেক্ষ ভয়ংকরটিকে বেছে নেওয়া হবে মল্লভূমির বিচারের জন্য৷ সুযোগ্য বিচারকদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হল রাজ্যের সেরা সুন্দরী তরুণীকে খুঁজে বের করার জন্য, যাতে নিয়তি যদি হতভাগ্য যুবককে ভিন্নপথে না ঠেলে দেয় তাহলে সে যেন উপযুক্ত একটি স্ত্রীরত্ন লাভ করতে পারে৷ অবশ্য, সকলেই জানত, যে যুবককে যে অন্যায়ের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে তা ইতিমধ্যেই সংঘটিত হয়ে গেছে৷ রাজকুমারীকে সে ভালবেসেছে৷ সে, রাজকন্যা বা অন্য কেউই এই সত্যকে অস্বীকার করার কথা ভাবেনি৷ কিন্তু এ ধরনের কোন তথ্য তার মহান-বিচারের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে, সেটা রাজা ভুলেও প্রশ্রয় দেবে না৷ কারণ এই বিচার তাকে অসীম আনন্দ দেয়, চরম তুষ্ট করে৷ ঘটনা যা ই ঘটুক না কেন যুবকটিকে অপসারিত করতেই হবে, এবং রাজকন্যাকে ভালবেসে যুবকটি অন্যায় করেছে কি করেনি, সেটা নির্ধারণ করবে যে ঘটনা প্রবাহ, তা দেখে রাজা স্বর্গীয় আনন্দ লাভ করতে চায়৷

নির্দিষ্ট দিন উপস্থিত হল৷ নিকট ও দূর-অঞ্চল থেকে বহু লোক এসে জমায়েত হয়েছে, মল্লভূমির চক্রাকার আসনশ্রেণীর প্রতিটি আসন পূর্ণ, আর বহু লোক অভ্যন্তরে প্রবেশাধিকার না পেয়ে বাইরের দেওয়ালের গায়ে স্তূপাকারে ভিড় করে রয়েছে৷ রাজা তার অমাত্যদের নিয়ে যথাযথ জায়গায় বসে রয়েছে, দরজা দুটির ঠিক বিপরীত দিকে—ভাগ্য নির্ধারণের দুই দরজা, তাদের চেহারা হুবহু একই রকম, এই অবিকল মিল অতি ভয়ঙ্কর৷ সবাই প্রস্তুত৷ সঙ্কেত দেওয়া হল৷

রাজ-পরিষদবর্গের ঠিক নিচে একটি দরজা উন্মুক্ত হল, এবং রাজকুমারীর প্রেমাস্পদ প্রবেশ করল মল্লভূমিতে৷ দীর্ঘকায়, অতীব সুদর্শন, হেমকান্তি, তার আবির্ভাবকে সংবর্ধনা জানানো হল প্রশংসা ও সংশয়ের চাপা গুঞ্জন ধ্বনিতে। অর্ধেক দর্শক জানাতই না যে এত রূপবান একতরুণ তাদের মধ্যে বাস করত৷ রাজকন্যা যে তাকে ভালবাসবে এ আর আশ্চর্য কি! আহা, বেচারা এই অবস্থায় এখানে, কি নিষ্ঠুর ভাগ্য!

মল্লভূমিতে এগিয়ে যাবার পথে প্রথা অনুযায়ী ঘুরে দাঁড়াল যুবক, ঝুঁকে কুর্ণিশ করল রাজাকে৷ কিন্তু এই রাজপুরুষটির দিকে তার কোন মনোযোগ নেই—তার চোখ অবিচলভাবে নিবদ্ধ পিতার ডান পাশে বসা রাজকুমারীর দিকে৷

রাজকুমারীর মধ্যে যদি সে বন্যপ্রকৃতি না থাকত তাহলে সে হয়তো অনুষ্ঠানে অনুপস্থিত থাকত, কিন্তু এই রকম কৌতূহল উদ্রেককারী একটি ঘটনায় ভার তীব্র ও তপ্ত হৃদয় কি করে রাজকন্যাকে অনুপস্থিত থাকতে দেয়! যে মুহূর্তে হুকুম জারী হয়েছে যে তার প্রেমিক রাজার মল্লভূমিতে উপস্থিত হয়ে নিজের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, সেই মুহূর্ত থেকেই দিন-রাত রাজকুমারী শুধু এই মহা ঘটনার কথা ও তার অনুষঙ্গী অন্যান্য বিষয়ের কথা ভেবে চলেছে৷ অধিক ক্ষমতা হাতে পাওয়ার ফলে, প্রভাবশালিনী হওয়ার ফলে এবং বিরল চারিত্রিক দৃঢ়তায় রাজকন্যা এমন একটি কাজ করেছে যা এর আগে কেউ পারেনি—দরজার গোপন রহস্য সে জানতে পেরেছে৷ সে জানে, ঐ রুদ্ধ দ্বারের অন্তরালে কোন্ কক্ষে রয়েছে দরজা খোলা বাঘের খাঁচা, এবং কোন ঘরেই বা অপেক্ষা করছে লাস্যময়ী রূপসী৷ ভারী দরজা দুটির পিচনে রয়েছে চামড়ার পর্দা৷ ফলে দরজা খুলতে অগ্রসরবর্তী কোন ব্যক্তির কাছে ঐ ভারী আবরণ ভেদ করে কোন রকম শব্দ বা ইশারা এসে পৌঁছনো সম্পূর্ণ অসম্ভব, কিন্তু সুপ্রচুর স্বর্ণমুদ্রা ও নারীর একাগ্র শক্তি ঐ গোপন রহস্য পৌঁছে দিয়েছে রাজকুমারীর কাছে৷

সে যে শুধু জানে কোন্ ঘরে উদগ্রীব হয়ে প্রতীক্ষা করছে লাজনম্র উজ্জ্বল দীপ্তিময়ী মেয়েটি তা নয়, সে তার পরিচয়ও জনেছে৷ রাজসভার শ্রেষ্ঠ গৌরবর্ণ সুন্দরীতমা এ তিরুণীকে নির্বাচিত করা হয়েছে অভিযুক্ত তরুণের পুরস্কার হিসেবে—যদি সে উচ্চশ্রেণীর কোন রমণীর প্রণয়কামী হয়েও নির্দোষ প্রতিপন্ন হয়৷

এই পুরস্কারী রূপসীর প্রতি রাজকুমারীর মনোভাব ভয়ঙ্কর ঈর্ষা ও দ্বেষপূর্ণ৷ বহু সময়েই রাজকন্যা লক্ষ্য করেছে এই মেয়েটি তার প্রেমাস্পদের প্রতি প্রেমজর্জার দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছে, এবং কখনও কখনও তার মনে হয়েছে, এই চকিত কটাক্ষ পুরুষটি বরণ করেছে, এমন কি প্রতি-চাহনিও ফিরিয়ে দিয়েছে উত্তরে৷ মাঝে-মধ্যে দুজনকে আলাপচারী অবস্থায়ও আবিষ্কার করেছে রাজনন্দিনী৷ যদিও সে কথোপকথন দু-এক মুহূর্তের, তবুও ঐ সংক্ষিপ্ত সময়ে বহু কথাই হয়তো বলা যায়, হয়তো ওদের সে বাক্যালাপ তুচ্ছ বিষয় নিয়েই, কিন্তু সে কথা জানবে কেমন করে রাজকুমারী? মেয়েটি সুন্দরী, কিন্তু সে রাজকন্যার কামনার পুরুষের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপের দুঃসাহস প্রকাশ করেছে সুতরাং, বর্বর পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া বন্য রক্তের ধারার সমস্ত তেজ কেন্দ্রীভূত করে সে ঘৃণা করে নিঃশব্দ দরজার পিছন থরকম্পমান ঐ মেয়েটিকে৷

যখন রাজকুমারীর প্রিয়তম ঘুরে তার দিকে তাকাল, তার চোখের মিলন হল, সে দেখল শঙ্কিত মুখের মহাসমুদ্রে রাজকুমারীর মুখমণ্ডল সবার চেয়ে বিবর্ণ ও রক্তহীন, একাত্ম দুই হৃদয়ের পলকে উপলব্ধি করার যে ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকে, এই ক্ষমতায় সে বুঝল, রাজকুমারী জানে, কোন্ দরজায় পিছনে ওত পেতে বসে আছে হিংস্র বাঘ, আর কোন্ দরজায় পিছনে বা দাঁড়িয়ে রয়েছে অপেক্ষমান রমণী৷ সে আশা করেছিল রাজকুমারীর এই রহস্য জানবে৷ রাজকুমারীর স্বভাব সে জানে, এবং সে নিশ্চিত ছিল, যে রহস্য দর্শকের অজানা, এমন কি স্বয়ং রাজারও অগোচর, সেই গোপন রহস্য আয়ত্ত না করা পর্যন্ত রাজকুমারী স্বস্তি পাবে না৷ যুবকের একমাত্র আশায় সামান্যতম যে নিশ্চয়তা ছিল, তার মূল ভিত্তি ছিল গোপন রহস্য উদ্ঘাটনে রাজকন্যার সফলতা, এবং সে মুহূর্তে সে রাজকন্যার দিকে তাকাল, সে বুঝতে পারল রাজকুমারী সফল হয়েছে, যেমনটি সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করত—রাজকুমারী সফল হবেই৷

তারপরই তার চকিত সংশয়ী দৃষ্টি নীরবে প্রশ্ন করল : কোন্ দরজা?

রাজকুমারী এত সহজে সে প্রশ্ন বুঝতে পারল যেন যুবক চিৎকার করে তাকে প্রশ্ন করেছে৷ একটি মুহূর্তও নষ্ট করার সময় নেই৷ বিদ্যুৎ ঝলকের মত প্রশ্নটি নিক্ষেপ করা হয়েছে, বিদ্যুৎ ঝলকেই তার উত্তর দিতে হবে৷

রাজকুমারীর ডান হাত ছিল তার সামনের গদী আঁটা সুদৃশ্য প্রাচীন৷ সে হাত তুলল, এবং ডানদিকে সংক্ষিপ্ত চকিত ইশারা করল৷ তার প্রেমিক ছাড়া আর কেউই রাজকুমারীকে লক্ষ্য করেনি৷ কারণ আর সকলেরই চোখ মল্লভূমিতে দন্ডায়মান অভিযুক্ত ব্যক্তির দিকে নিষ্পলকে তাকিয়ে৷

যুবকটি ঘুরে দাঁড়াল এবং দৃঢ় ও দ্রুত পদক্ষেপ উন্মুক্ত অংশটুকু অতিক্রম করল৷

প্রতিটি হৃৎপিন্ড থমকে দাঁড়াল চলতে চলতে, প্রতিটি শ্বাস রুদ্ধ হল, যুবকটির দিকে চঞ্চলভাবে নিবদ্ধ প্রতিটি চোখ৷

বিন্দুমাত্রও ইতস্ততঃ না করে যুবকটি ডানদিকের দরজার কাছে এগিয়ে গেল, এবং দরজা খুলল৷

এবারে গল্পের মূল কথা হল : দরজা দিয়ে কি বাঘ বেরিয়ে এলো, না সেই রূপসী তরুণী?

এই প্রশ্নটি নিয়ে আমরা যত ভাবি, ততই কঠিন মনে হয় এর উত্তর৷ মানব মনের এমন এক গভীর সমীক্ষা এর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে বহুতর আবেগের জটিল গোলকধাঁধায় সঠিক পথ খুঁজে পাওয়া আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন৷ আরও গভীরভাবে এই প্রশ্নের উত্তর ভাবুন, হে সহৃদয় পাঠক-পাঠিকা, মনে রাখবেন, এই প্রশ্নের উত্তর আপনার ওপর নির্ভর করছে না, বরং সেই উষ্ণ-শোণিত অর্ধ সত্য রাজকুমারীর ওপর নির্ভরশীল৷ হতাশা ও ঈর্ষার সম্মিলিত অগ্নিশিখার অন্তরালে তার হৃদয় হয়ে উঠেছে লোহিত তপ্ত৷ প্রেমাস্পদকে সে হারিয়েছে, কিন্তু অন্য কে লাভ করবে সেই পুরুষকে?

বহু, বহুবার বিনিদ্র রজনীর নির্জন প্রহরে, দুঃস্বপ্নে, বন্য সন্ত্রাসে চমকিত হয়েছে রাজকন্যা, দু-হাতে মুখ ঢেকেছে—যদি তাঁর প্রেমিক সেই দরজাটা খোলে, যেখানে অপেক্ষা করেছে হিংস্র বাঘের নিষ্ঠুর ধারালো দাঁত!

কিন্তু তার চেয়েও কত বেশিবার রাজকুমারী তাকে অন্য দরজাটা খুলতে দেখেছে৷ তার বেদনাতুর রোমন্থনে বহুবার সে দাঁতে দাঁত ঘষেছে, চুল ছিঁড়েছে, যখন সে দেখেছে তার প্রেমিক রমণীর দরজাটা খুলে নিজের আনন্দে সৌভাগ্যে চমকে উঠেছে৷ বহুবার তার মন জ্বলে পুড়ে গেছে যন্ত্রণার আগুনে, যখন সে দেখেছে যুবক ছুটে গিয়ে মিলিত হচ্ছে প্রতীক্ষরতা রূপসীর সঙ্গে, রূপসীর দুগালে লাজনম্রা রক্তাভা, দু-চোখে জয়ের দীপ্তি, পুনর্জীবন লাভের আনন্দে তার প্রেমিকের শরীরের প্রতিটি অণু রোমাঞ্চিত, শোনা যাচ্ছে দর্শকদের উল্লাসধ্বনি, সুখের ঘণ্টার ক্রমাগত বন্যা নিনাদ, সানন্দ অনুগামীদের অগ্রবর্তী হয়ে ঐ তরুণ-তরুণী যুগলের দিকে এগিয়ে চলেছেন রাজপুরোহিত, রাজকন্যার চোখের সামনে ওদের স্বামী-স্ত্রী হিসাবে অভিষিক্ত করবেন৷ রাজকন্যা আরো দেখেছে, কুসুমাস্তীর্ণ পথে ওরা দুজন এগিয়ে চলেছে, পিছনে উল্লসিত জনতার খুশিবিহ্বল চিৎকার, সেই চিৎকারে নিশ্চিহ্ন, লুপ্ত হয়ে গেছে রাজকুমারীর হতাশাময় হৃদয়বিদারী আর্তনাদ৷

তার চেয়ে মৃত্যুই কি প্রেমিকের পক্ষে শ্রেয় নয়? বরং সে রাজকুমারীর জন্য প্রতীক্ষা করবে পরলোকে৷

অথচ ঐ ভয়ঙ্কর শার্দুল, ঐ করুণ মরণ-আর্তনাদ?

সিদ্ধান্ত ইশারায় জানিয়ে দিতে রাজকুমারীর একটি মুহূর্ত মাত্র লেগেছে, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতে বহু দিন বহু রাত এক প্রচণ্ড যন্ত্রণাময় যুদ্ধ চলেছে রাজকুমারীর মনে, তারপর সে উপনীত হয়েছে সুচিন্তিত সিদ্ধান্তে৷ সে জানত তাকে জিগ্যেস করা হবে, কি উত্তর তখন সে দেবে তাও সে ঠিক করে নিয়েছে, এবং সামান্যতম দ্বিধা না করে সে ইঙ্গিত করেছে ডানদিকের দরজা৷

রাজকুমারীর এই সিদ্ধান্তকে খুব হালকা ভাবে নিলে চলবে না, আর আমিই-একমাত্র ব্যক্তি যে সেই প্রশ্নের উত্তর জানি, এ রকম অযৌক্তিক দাবীও আমি করছি না৷ সুতরাং, এই দায়িত্ব আমি তুলে দিলাম আপনাদের সবার কাঁধে৷ দয়া করে বলুন পাঠক-পাঠিকাগণ :

খোলা দরজা দিয়ে কে বেরিয়ে এলো—রমণী, না বাঘ?

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন