জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ

অনীশ দেব

প্রত্যেক বড় শহরের ছোট ছোট রাস্তায় এগুলো দেখতে পাবেন, এবং কখনো কখনো ভেবে অবাক লাগবে, এদের মালিকেরা কিভাবে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম হয়৷

ঢোকবার দরজাটা সাধারণতঃ রাস্তা থেকে কয়েক ধাপ নীচেই, আর একটা স্বল্পালোকিত জানলায় চিত্রবিচিত্র ছিটের কাজ করা অক্ষরে লেখা : পুরাতন বই৷ প্রায় সব ক্ষেত্রেই, দরজার ঠিক পাশে দাঁড় করানো একটা র‌্যাকের মুখোমুখি হবেন আপনি, তার মাথায় ঝোলানো সাইনবোর্ডে কাঁচা ছাঁদে লেখা : আপনার পছন্দ—দশ সেন্ট৷ অনিবার্যভাবে সেই র‌্যাকে আছে অন্ততঃ ছ’টা প্রচলিত বই—‘থ্রী উইকস’, ‘দি গ্রীন হ্যাট’, ‘হেনেলস বেবিজ, ‘ব্ল্যাক অক্সেন’, ‘ইফ উইন্টার কামস’, এবং ‘স্পীকিং অফ অপারেশনস’৷ কে

কেউ কখনো সে বই কেনে না, কানাকড়ি দাম দিয়েও না, এবং দোকানের ভেতরে যে বইগুলো অবশ্যই আপনি দেখতে পাবেন, ফ্যান্টাজিয়াস ম্যালার, দি গোল্ডেন অ্যাস, অথবা টার্শিয়াস অর্গানাম, সেগুলোর নির্ধারিত অত্যধিক মূল্য কেউ কখনো দিতে চেয়েছে বলে মনে হয় না৷ আপনার হয়তো সন্দেহ হবে যে দোকানের মালিক গ্রন্থপ্রিয় ক্রেতাদের গোপনে অন্য জাতীয় কিছু সরবরাহ করেন—ভূগোলের আগ্রহী ছাত্রেরা হেনরি মিলারের ট্রপিক অফ ক্যানসার এখানে পেতে পারে, এবং সেরকম ঘ্রাণশক্তি থাকলে দি পারফিউমড গার্ডেন-এর ঝাঁঝালো গন্ধও এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে—কিন্তু তাহলেও, বিক্রি যে নিতান্তই কম সেটা বুঝতে অসুবিধে হয় না৷ সুতরাং আপনি ভেবে অবাক হন, আরও একবার, যে এইসব দোকানের মালিকেরা কিভাবে বছরের পর বছর চালিয়ে যায়৷

ঠিক এই ধরনের একটি দোকানে জনৈক যুবক এসে উপস্থিত হল, সন্ধ্যের ঠিক মুখেই৷ তার নাম আবেল তার মধ্যে চোখে পড়ার মতো কিছুই নেই, শুধু রাস্তা থেকে ক্ষিপ্র পায়ে সিঁড়ি নেমে দোকানে ঢোকবার চোরা ভঙ্গীটুকু ছাড়া৷

দোকনে ঢুকতেই তার ভুরু কুঁচকে উঠলো, যেন পরিবেশ দেখে হতভম্ব হয়ে গেছে৷ যেন প্রতিষ্ঠানের এই সাদামাটা চেহারা তাকে কোনো কারণে দ্বিধা অথবা হতাশায় ফেলেছে৷ আর যখন দোকানের পেছন দিকের ধুলোভরা কাউণ্টার ছেড়ে দোকানের মালিক সামনে এসে উপস্থিত হলেন তখন তরুণ মিষ্টার আবেলের অভিব্যক্তি যেন বলে উঠল, আমার নিশ্চয়ই ভুল হয়েছে৷

মালিক নিজেই কোনো বইয়ের এক প্রচলিত সংস্করণ, সমর একটু ময়লা হয়ে গেছেন, তাঁর চেহারা বলছে তিনি বহু ব্যবহৃত, বর্জিত, এবং অবশেষে কোনো তাকে স্থান পেয়েছেন গড়িয়ে চলা বছরের প্রতি খেয়াল না রেখে অমনোযোগে ধুলো সংগ্রহের জন্য৷ তাঁর শরীরে আকারে ছোটোখাটো ও কুঁজো, এঁদের বেশীরভাগ যেরকমটা হয়ে থাকেন, ইতস্তত গোছা গোছা চুল ও সরু গোঁফের নির্দিষ্ট কোনো রঙ নেই, আর চশমার কাচের পেছনে চোখদুটো ঘোলাটে পুঁতিও হতে পারে৷

তাঁর কণ্ঠস্বর, যখন শোনা গেল, এক সুরহীন অস্পষ্ট উচ্চারণ৷

‘বলুন, কি চাই?’

তরুণ মিষ্টার আবেল ইতস্ততঃ করলো, আবারও তার ভুরু কুঁচকে উঠল, এক মুহূর্তের জন্য সে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো—এক কপি ‘জুর্গেন’ চাইবে, গতানুগতিক উত্তর দেবে, ‘না, এমনি দেখছি’, নাকি সটান দোকান ছেড়ে বেরিয়ে যাবে৷

কিন্তু সেই কুঞ্চিত ভুরুর পেছন নিছক বিস্ময় ছাড়াও অন্য কিছু ছিল কয়েক মুহূর্তে ইতস্ততঃময় নীরবতার পর যখন সে কথা বলল সেই অন্য কিছু দৃঢ়সংকল্পে বেজে উঠল তার কণ্ঠস্বরে৷

‘আমি পড়াশোনা করবার জন্য এখানে এসেছি,’ সে বলল, ‘একটা বিশেষ বিষয় নিয়ে, আর সেজন্য কয়েকটা বিশেষ বই আমার দরকার৷’

চশমার পেছনে পুঁতি দুটো নড়ে উঠলো এবং মালিক তার মাথা ঝাঁকালেন, ‘কি বই?’

‘তিনটে,’ উত্তর এল, ‘প্রথমটা ইনট্রোডাকশন টু মার্ডার’। দ্বিতীয়টা, ‘ডেথ অন দি ইনস্টলমেন্ট প্ল্যান’৷ আর ‘দি প্রাইস ইজ রাইট৷’

মালিক চোখ তুলে তাকালেন৷ ঘোলাটে পুঁতির বদলে সেখানে এখন লক্ষ্যভেদী কালো চোখ৷

‘দুষ্প্রাপ্য বই,’ বিড়বিড় করে তিনি বললেন, ‘তবে আমি হয়তো আপনাকে আমার নাম কে বলল?’

‘এমন একজন, যে বলেছে আপনি এ প্রশ্ন করবেন, এবং উত্তরে আমাকে চুপ করে থাকতে হবে৷’

পুস্তক বিক্রেতা সম্মতি জানালেন৷

‘চলুন, তাহলে, ভেতরে যাওয়াই ভালো৷ এক মিনিট দাঁড়ান, দোকানটা বন্ধ করে নিই৷’ তিনি দরজা নিয়ে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়ার পর আলোর সুইচে থাবা বসালেন৷ অন্ধকার সরুপথ ধরে তাকে অনুসরণ করে যুবকটি এসে উপসিথত হলো দোকানের পেছনে দিকের ঘরে৷

ঘরটা আলোয় উজ্জ্বল, আরামপ্রদ এবং নজরে পড়ার মতো সুসজ্জিত৷

‘বসুন,’’ মালিক বললেন, ‘তা আপনার নামটা?’

‘আবেল৷ চার্লস আবেল৷’

‘আবেল নাকি? তাই বলো৷’ বৃদ্ধ কর্কশ স্বরে হাসলেন, ‘তাহলে তুমি আমাকে মিষ্টার কেইন বলে ডাকতে পারো৷’

যুবকের কপালের রেখা মিলিয়ে গেলো৷

‘তাহলে সেই জায়গা,’ সে অবাক হয়ে বলে উঠল, ‘আপনিই সেই লোক!’ এটাই মিষ্টার কেইন কাঁধ ঝাঁকালেন৷

‘টাকা সঙ্গে এনেছ?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন৷

‘এই যে৷ এক হাজার ডলার, ছোট ছোট নোটে৷’

টাকাটা নিয়ে সযত্নে গুনলেন মিষ্টার কেইন৷ তারপর চোখ তুলে তাকিয়ে সম্মতি জানালেন৷

‘হ্যাঁ, আমিই সেই লোক,’ তিনি বিড়বিড় করে বললেন, ‘এখন, যে বিষয়ে তুমি পড়াশোনা করে শিখতে এসো সেই কথাই বলি৷ কাকে তুমি খুন করতে চাও?’

বিয়ের দোকানে তরুন আবেলের প্রথম আবির্ভাবের পর প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেছে৷ প্রতিদিন ঠিক রাত ন’টায় সে দোকানে এসেছে৷ আলস্যের কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, কারণ সে ভীষণ আগ্রহী ছাত্র৷ তাছাড়া, এতো কিছু শেখার রয়েছে৷

মিষ্টার কেইনকে উপযুক্ত শিক্ষক হিসেবে পেয়ে সে খুশী হয়েছে৷ সে কথা সে তাঁকে বলেছে, ভেবেছে, প্রশংসা শুনলে তিনি খুশী হবেন৷ কিন্তু বৃদ্ধ লোকটি মুখ বিকৃত করলেন৷ ‘জানো, সবাই কি বলে,’ তিনি মন্তব্য করলেন, ‘যারা নিজে হাতেকলমে করে না৷ তারা শেখাতে পারে না৷’

‘মানে আপনি কখনও নিজে হাতে খুন করেন নি?’

মিষ্টার কেইন অস্বস্তির অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললেন৷ ‘আমার রক্তাতঙ্ক রোগ আছে৷ নেহাতই দুর্ভাগ্য বলতে হবে৷ রক্ত দেখলে আমি এত ভয় পেয়ে যাই যে দোকানে ইঁদুর-ধরা কল পর্যন্ত লাগাতে পারি না৷ আমার লাভের গুড় ওরা একরকম খুটে খেয়েই শেষ করলো৷’

‘কিন্তু আপনার দোকানটাতে শুধু লোকের চোখে ধুলো দেবার জন্য৷ এটাই তো আপনার আসল ব্যবসা, তাই না?’

‘হ্যাঁ, মাষ্টারিই আমার পেশা৷’

তরুণ মিষ্টার আবেল প্রকট হাসলো৷ ‘হাসির জন্য ক্ষমা করবেন৷ কিন্তু আপনি এই পেছনের ঘরে বসে বসে নিখুঁত খুনের মতলব ভাঁজছেন, এ কথা ভাবলেই হাসি পায়৷’

‘এতে হাসির কি আছে, খোকা?’ দোকানদার উঠে দাঁড়ালেন৷ ‘এ ধরনের ব্যবসাদারদের যে কি দুরবস্থা তা যদি জানতে তাহলে বুঝতে৷ একটা লোককে তো খেয়ে পরে বাঁচতে হবে৷’

‘আপনি বললেন, ‘এ ধরনের ব্যবসাদারদের৷ তার মানে আপনি একাই নন? অন্যান্য পুরোনো বইয়ের দোকানদাররাও কি—’

‘সে তোমার জেনে কি হবে,’ মিষ্টার কেইন চটপট উত্তর দিলেন, ‘এখানে প্রশ্ন টশ্ন যা করবার সব আমি করবো৷ এবং ছোট উত্তরে কাজ হবে না৷ তুমি এক সপ্তাহ হলো পড়াশোনা করছো, কিন্তু এখনও আমাকে বলো নি কাকে তুমি খুন করতে চাও৷ এবার আসল কথায় এসো৷ আমি ব্যস্ত মানুষ, আমার অন্যান্য মক্কেলদেরও তো দেখতে হবে৷’

ছেলেটি মাথা নাড়লো৷ ‘বলবো, তবে নিঃসন্দেহ হলে,’’ ক্ষমা চাওয়ার সুরে সে বললো৷ ‘মানে নিখুঁত খুন কি ভাবে করতে হয় সেটা যে আপনি আমাকে শেখাতে পারবেন সে বিষয়ে আমাকে আগে নিঃসন্দেহ হতে হবে৷’

‘নিখুঁত খুন? ওটা কোনো ব্যাপারই নয়,’ মিস্টার কেইন তীব্র স্বরে জবাব দিলেন৷ ‘তোমাকে যে বলেছি, নিজে হাতে আমি কখনও কোনো খুন করিনি, সে কথা সত্যি৷ কিন্তু খুনের সাক্ষী হয়েছি তা বলতে পারো, বহুবার! আর বিশ্বাস করো, তার প্রতিটাই ছিল নিখুঁত খুন৷ খুনের পরিসংখ্যানের কোনো খবর তুমি রাখো? একশোটা খুনের মধ্যে পঞ্চান্নটার কোনো কিনারা হয় না৷ শতকরা পঞ্চান্নটা, একবার ভাবো৷ প্রত্যেক বছর যে সব খুনের ঘটনা ঘটে তার অর্ধেকের বেশীর কোনো মীমাংসা নেই, বিচার হয় না, এমন কি সন্দেহ কারবার কোনও লোকও পাওয়া যায় না৷ এটা নেহাৎ ঘটনাচক্র নয়৷ ওসব ঘটনার বেশীর ভাগ খুনীই অন্যান্য লোকের পরামর্শ পেয়েছিলো৷ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ৷ যে রকম আমি তোমাকে দিচ্ছি৷ ব্ল্যাক ডালিয়া মামলার কথা মনে পড়ে, ওয়েষ্ট কোস্টে?’

‘ওটা কি আপনার পরিকল্পনা?’

‘হ্যাঁ, আমার এক ছাত্রের জন্য৷’ মিষ্টার কেইন ঠোঁটে হাসলেন, লাজুক গর্বের হাসি৷ ‘যে ছাত্রের সত্যি শেখবার ইচ্ছে আছে, তার সামান্য সহযোগিতা পেলে আমি কদ্দূর কি করতে পারি ওটা তারই একটা উদাহরণ মাত্র৷’

তরুণ আবেল একটা সিগারেট ধরালো৷ ‘কি করে জানবো যে আপনি আজে বাজে মিথ্যে বলছেন না? ওই খুনটা আমার কাছে একেবারে অর্থহীন মনে হয়েছে৷

মিষ্টার কেইন ঠোঁটে কামড় দিলেন৷ ‘সেটাই আসল কথা’, তিনি জেদী সুরে বলে চললেন৷ ‘এক সপ্তা ধরে যা বলেছি তার কিছুই কি তোমার মনে নেই? এসো, সংক্ষেপে আর একবার সেগুলো ঝালিয়ে নেওয়া যাক৷ খুনের কি কি কারণ থাকে? চটপট বলো৷’

‘তিনটে, আপনি বলেছেন৷ প্রথম, প্রয়োজন৷’

‘যেমন?’

‘যেমন ইয়ে, করুণাবশে, টাকা পয়সার ব্যাপার থাকলে, বা যখন কেউ নিজের স্বামী কিম্বা স্ত্রীর কাছ থেকে মুক্তি চায়, কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদের নামে নীতিভ্রষ্ট হওয়ার ভয় পায়৷’

‘চমৎকার৷ এবার দ্বিতীয় কারণ?’

‘রাগ, ঈর্ষা, শত্রুতা৷ এ ধরনের ব্যাপার৷’

‘আর তিন নম্বর?’

‘নিছকই খেয়ালবশে, তাই না? নির্ভেজাল আনন্দের জন্য৷’

‘ভেজাল আনন্দের জন্য,’ শুধরে দিলেন মিষ্টার কেইন৷ ‘তিন নম্বরের কোনো স্থান নেই, অন্ততঃ আমার কাছে৷ মানসিক খুনীদের আমি ছাত্র হিসেবে নিই না৷ তার একটা কারণ, তারা যে আমার কথা মতো কাজ করবে তার কোনো বিশ্বাস নেই৷’

‘কিন্তু ব্ল্যাক ডালিয়ায় ব্যাপারটা মনে হয়েছিলো কোন মানসিক খুনীর কাজ৷’

‘এই তো, এবার মগজ খুলেছে,’ মিষ্টার কেইন আশ্বাস দিলেন’, হ্যাঁ, তাই মনে হয়েছিল৷ সেভাবেই ওটার পরিকল্পনা করা হয়েছিল৷’

‘পরিকল্পনা?’

‘তোমাকে তো আগেই বলেছি, এ শহরের অর্ধেকের বেশী খুনের কোন কিনারা হয় না৷ কেন? কারণ যে সব সূত্র বেশীর ভাগ খুনীকে ধরিয়ে দেয় সে সব সূত্রের সঙ্গে এই খুনগুলোর উদ্দেশ্যের কোন সম্পর্ক থাকে না৷ বছর বিশেক আগে খুনের জটিল, বিশদ পদ্ধতিগুলো ডিটেকটিভ বইগুলোর অস্বাভাবিক চাহিদা ছিলো৷ সে তো আমার জানবারই কথা, দোকানের সামনের তাকগুলো ওসব বইয়ের ভর্তি৷ যতো সব উদ্ভট খুনের গল্পো—বিষাক্ত ছুঁচ, জমাট বাঁধা তুষারের ছুরি, তালা বন্ধ ঘরের মারপ্যাঁচ, গলার স্বর টেপরেকর্ডারে তুলে রেখে নকল অ্যালিবাই তৈরী করা৷ এ সবই হাস্যকর৷ যদি তুমি সাদামাটা বিচার বুদ্ধি ব্যবহার করো, আর এমন কোন লোক তোমাকে না দেখে, যে দৌড়ে গিয়ে পুলিশে খবর দেবে বা সাক্ষী দেবে, তাহলে খুন করে পার পাওয়াটা কোন ব্যাপার নয়৷ অবশ্য, এই শর্তে, যে আঙ্গুলের ছাপ, রক্তের দাগ এবং এ ধরণের ছেলেমানুষ জিনিসগুলো সম্পর্কে তুমি যথেষ্ট সাবধান হবে৷

‘পুলিশ আজকাল খুনীদের ধরতে পারে না তাদের খুনের পদ্ধতির জন্য৷ অপরাধীর উদ্দেশ্যই তাদের আসল অপরাধীর দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়৷ আর হতভাগ্য সেই শতকরা পঁয়তাল্লিশ জন ঠিক এই জিনিসটাই ভুলে যায়৷ প্রয়োজনের কারণে যে সব খুনের জন্ম, সে সব ক্ষেত্রে পুলিশ এমন লোকের খোঁজ করে যে সেই খুনের ফলে লাভবান হয়, কোন উত্তরাধিকারী, বিবাহিত জীবনে অসুখী কোন পুরুষ অথবা স্ত্রী, ব্যবসার প্রতিদ্বন্দ্বী এইরকম৷ রাগ অথবা ঈর্ষার ক্ষেত্রে অপরাধীকে ধরে ফেলা খুবই সহজ, তিনি একটু থামলেন৷ ‘জেনে রেখে, যে সব খুনের মতলবে আমি সাহায্য করেছি তার প্রত্যেকটার পেছনেই একটা সত্যিকারের কারণ ছিল৷ কিন্তু সে মতলব আমি এমন ভাবে তৈরী করি যে আপাতদৃষ্টিতে খুনের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না৷ এক কথায়, প্রতিটা খুনই কোন মানসিক খুনীর কাজ বলে মনে হয়৷’

‘ও, এই তাহলে আসল ব্যাপার!’

‘যে লোক তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে সে এ কথা বলেনি?’ মিষ্টার কেইন জানতে চাইলেন৷ ‘নাকি তার সফল হওয়ার কাহিনীর খুঁটিনাটি তুমি জানো না?’

‘বলেছে,’ তরুণ আবেল স্বীকার করলো৷ ‘আর খুঁটিনাটি সমস্তই আমি জানি৷ সে আপনার সম্পর্কে অনেক প্রশংসা করেছে৷ শুধু তার আসল মানেটা আমি ধরতে পারিনি, প্রথম প্রথম৷

‘এখন ধরতে পেরেছো? ভালো! কি আছে, তাহলে এখন তা মন খুলে আমাকে সব বলতে পারো? তোমার আসল মতলবটা কি বলো দেখি?’ মিষ্টার আবেল আর ইতস্ততঃ করলো না৷

‘যে লোক আমাকে আপনার কথা বলেছে তাকেই আমি খুন করতে চাই৷’ সে বললো৷

‘আমারই কোন পুরোনো ছাত্র? কিন্তু, খোকা, সেটা একটু নীতিবিরুদ্ধ কাজ হবে না?’

‘নিশ্চিন্ত থাকুন৷ তার নাম আপনাকে আমি বলছি না৷ আপনি কখনও সে নাম জানতে পারবেন না, সুতরাং আপনার বিবেকও শান্ত থাকবে৷’

‘তার ওপর তোমার কোনো ব্যক্তিগত রাগ আছে বুঝি?’

‘হ্যাঁ৷ কিন্তু তার খুঁটিনাটি জানিয়ে আপনার মনের বোঝা বাড়াতে চাই না৷ শুধু এটুকু জানলেই আনপার যথেষ্ট হবে, তাকে ঘৃণা করি বলে সে আমাকে একটুও সন্দেহ করে না৷ সুতরাং ইতিমধ্যেই নিখুঁত পরিবেশ আমরা পেয়ে গেছি, অন্তত আপনার কথা মতো৷ ওই খুনের সঙ্গে কেউ আমাকে জড়াবে না, কারণ আপাত দৃষ্টিতে আমার কোন উদ্দেশ্য নেই৷ এখন আপনার কাছে আমার যা দরকার তা হলো খুনের একটা জুৎসই পদ্ধতি৷ এমন কায়দা যাতে সেই খুনটা কোন মানসিক রোগগ্রস্ত খুনীর কাজ বলে মনে হয়৷’

‘হুম-ম৷’ মিষ্টার কেইন উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করলেন৷ ‘শুনে তো সহাজই মনে হচ্ছে, যদি অবশ্য তুমি সত্যি কিথা বলে থাকো৷’

‘ঈশ্বর সাক্ষী৷’

‘তুমি যে রকম বলেছো—’ মিষ্টার কেইন সামান্য থামলেন৷ ‘তাতে মনে হয়, সেই লোককে নির্জন কোনো জায়গায় কোণঠাসা করে, গলা টিপে খুন করে সোজা হেঁটে চলে যাওয়াটা তোমার পক্ষে নেহাৎই সহজ হবে৷ অনেক সময় খুনের সহজ-সরল পদ্ধতিই বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ কোনো কানা গলিতে কাউকে মাথায় বাড়ি মেরে চম্পট দাও, দেখবে পুলিস ল্যাজে-গোবরে হয়ে গেছে৷’

‘কিন্তু স্যার,’ মিষ্টার আবেল হালকা স্বরে বলল, ‘এ পরামর্শের দাম বলতে চান নগদ এক হাজার ডলার—তাও আবার আয়করমুক্ত?’

‘তোমাকে কিছুটা বিষও আমি জোগাড় করে দিতে পারি—’

‘বিষের সঙ্গে মানসিক খুনের কি সম্পর্ক? সত্যি, এতো সব কথাবার্তার পর আমি আরও জমকালো কিছু আশা করেছিলাম৷’

‘জমকালো, হুঁ?’ মিষ্টার কেইন থামলেন, তাঁর চোখ উজ্জ্বল হলো৷ ‘তাহলে তোমার ভালো লাগবে এমন একটা কায়দা শোনো৷ পুরোনো প্যাঁচ ঠিক কথা, তবে এ ক’বছরে এটা খুব বেশী ব্যবহার হয় নি৷ আমি ওটার নাম দিয়েছি ‘ডেড লিটার অফিস৷’

‘ডেড লেটার অফিস’’?’

‘ডেড লিটার— নিষ্প্রাণ টুকিটাকি জিনিস৷’ ছাত্রের দিকে চোখ নামিয়ে হাসলেন তিনি৷ ‘এ পদ্ধতি কার্যকরী করতে গেলে, মাত্র তিনটে শর্ত পূরণ করা চাই৷’

‘কি শর্ত?’

‘প্রথমে, খুনীর পক্ষে শিকারকে লোভ দেখিয়ে কোন নির্জন জায়গায় নিয়ে যাওয়া এবং সেখানে তাকে খুন করা সম্ভব৷ আর, তোমার আপত্তি সত্বেও, আমি মাথায় বাড়ি মেরে বা গলা টিপে খুন করবার কথাই জোর দিয়ে বলবো৷ অবশ্য এ কথা ধরে নিচ্ছি যে সাধারণ সাক্ষ্য প্রমাণ ও খুনের অস্ত্র, যদি কিছু ব্যবহার করা হয়, লোপাট করবার জন্য যথেষ্ট যত্ন নেওয়া হবে৷ কি মনে হয়, এটুকু পারবে?’

‘খুব সহজেই পারবো৷’

‘ভালো৷ দ্বিতীয় শর্ত হলো যে খুনীর একটা গাড়ি থাকতে হবে৷’

‘আমার গাড়ি আছে৷’

‘তৃতীয়, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—খুনী যেন কারো নিয়মিত নজরে না থাকে৷ মানে, তার যেন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতে কোন বাধা না থাকে, সে দিন কয়েকের জন্য শহরের বাইরে গেলেও কেউ যেন তার খোঁজ না করে৷’

‘আমি একা থাকি, আর কাজ থেকে এক সপ্তা ছুটি নিয়ে এসেছি৷’

‘সাবাস! তাহলে মনে হয় একটা নিখুঁত মানসিক-খুনের বন্দোবস্ত করা যেতে পারে৷ ডেড লিটার অফিস নির্ঘাৎ পুলিসকে ধোঁকা দেবে৷ ওরা খুনের কায়দা নিয়ে এতো মাথা ঘামাবে যে খুনের উদ্দেশ্যর কথা ওদের মনেও আসবে না৷’

‘কিন্তু আমাকে কি করতে হবে?’

‘এখনও বুঝতে পারছো না? তুমি খুব সহজ কায়দায় তোমার লোককে খুন করো, যেমনটা আমি বলেছি৷ তারপর একটা হাত-দা কিম্বা কসায়ের ছুরি দিয়ে মৃতদেহটা টুকরো টুকরো করো৷ এ ধরনের ঘটনা অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, মোটামুটি যে টুকরোগুলো সাধারণতঃ করা হয় সে গুলো হল, পা, ঊরু পর্যন্ত দু টুকরো, গলা থেকে পেটও তাই, হাত, বাহু, আর মাথা৷ মোট তেরো টুকরো৷ অমঙ্গলের সংখ্যা, কিন্তু আশা করি অবান্তর কুসংস্কারে তুমি বিশ্বাস করো না৷’

‘না৷ শুধু কৌতূহল হচ্ছে৷ ওই টুকরোগুলো নিয়ে কি করবো?’

‘কেন, প্যাকেট করে ফেলবে৷ তেরোটা আলাদা প্যাকেট৷ বাড়িতে ফ্রীজে যে রকম প্লাস্টিকের বাগ ব্যবহার করা হয় সে রকম কয়েকটা ব্যাগ লাগবে, কিছু মোটা বাদামী কাগজ, আর কসায়েরা যে টোন সুতো ব্যবহার করে সে রকম টোন সুতো৷ দেখো, টোন সুতো যেন কম না পড়ে৷ প্যাকেটগুলো একবার তৈরী হয়ে গেলে তুমি শুধু সে গুলোর গায়ে ঠিকানা লিখবে, ডাক-টিকিট লাগবে, আর পার্সেল হিসেবে টুক করে ডাক বাক্সে ফেলে দেবে৷’

‘কিন্তু তেরোটা ভারী ভারী প্যাকেট—’

‘সেই জন্যই জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার গাড়ি আছে কিনা, আর হাতে সময় আছে কিনা৷ এক জায়গা থেকে তুমি ওগুলো পোষ্ট করবে না৷ গাড়ি নিয়ে তোমাকে ডজনখানেক বিভিন্ন শহরে ঘুরতে হবে৷ একাট ম্যাপ যোগাড় করে দেখে নিও দিন চারেকের মধ্যে তুমি কদ্দূর ঘুরতে পারবে৷ মোটামুটি ছন্নছাড়া ভাবে জায়গাগুলো ঠিক করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে, যাতে পুলিশ কোনোরকম ধারা অথবা আসল কাজের জায়গা খুঁজে না পায়৷ এ সব খুঁটিনাটি তোমাকে পরে দেখিয়ে দেবো৷ এও আমার কাজেরই একটা অঙ্গ৷ এ ছাড়া ডাকটিকিট সব আগেভাগেই কিনে রাখবে—আমার মতে একটা তিনসেন্টের পাতা কিনে নিও, কারণ সেগুলোর কথা কেউ খেয়াল রাখবে না৷

‘কিন্তু এই পার্সেলগুলো কাদের ঠিকানায় পাঠাবো?’

‘যে শহরে যাবে, তার টেলিফোন বই দেখে খুশীমতো নাম ঠিকানা বেছে নেবে৷ নয়তো—এ হলো এক নতুন কায়দা—তেরোজন লাশঘরের প্রহরীর কাছে ওগুলো পাঠিয়ে দাও, ভিন্ন ভিন্ন এলাকার তেরোজন প্রহরী৷ এতে পুলিশ একেবারে ভুল পথে পা দেবে৷ তারা সেই প্রহরীদের ওপর রাগ আছে এমন লোকের খোঁজ করে বেড়াবে৷ যাই হোক ওরা ঠিক ধরে নেবে এ কোনো৷ মানসিক খুনীর কাজ৷ কাগজওয়ালারা যদি একবার এ খবর পায় এবং গল্পটা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রকাশ করে, তাহলে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো যে সমস্ত সূত্র হারিয়ে যাবে ঐ রগরগে রোমাঞ্চকর উত্তেজনার গোলকধাঁধায়৷ কে এই উন্মাদ দানব? এ জাতীয় ব্যাপার আর কি৷’ মিষ্টার কেইন মাথা নোয়ালেন৷ ‘শুনে কি রকম মনে হচ্ছে, হুঁ? তোমার পছন্দ অনুযায়ী জমকালো হয়েছে তো?’

‘হ্যাঁ৷ কিন্তু আপনি ঠিক জানেন কোনো গোলমাল হবে না?’

‘দেখেশুনে মতলব ভাঁজলে সে ভয় নেই৷ আর প্রাথমিক সাবধানতাগুলো তোমাকে অবশ্যই নিতে হবে, যাতে শিকারকে লোভ দেখিয়ে ঠিক জায়গায় টেনে নিয়ে আসতে পারো৷ তাছাড়া, তোমার—ইয়ে—যন্ত্রপাতিগুলোর হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে৷ সবচেয়ে ভালো হচ্ছে কোনো ছুরি-কাঁচির দোকান থেকে ওগুলো চুরি করে জোগাড় করা৷ পরে, শহরের বাইরে কোনা ব্রীজের ওপর থেকে ওগুলো ফেলে দিলেই হলো৷ কিন্তু এসব খুঁটিনাটি পরে ধাপে ধাপে করা যাবে খন৷ প্রথমে আঙুলের ছাপ এড়ানোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে৷ সেটা কি এখন করবে না ছুটি নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? ও, ভালো কথা, আজ তো শুক্রবার৷ শনিবার যদি তোমার অফিস ছুটি থেকে থাকে তাহলে এখন ওটা সেরে নেওয়া ভালো৷ তাতে এই দুদিনের ছুটিতে তুমি অনেকটা সেরে উঠবে৷’

‘এ সব কি বলছেন আপনি?’

‘অ্যাসিড, খোকা৷ আমার নিজে হাতে তৈরী৷ আঙুলের সমস্ত দাগ তুলে দেব যাতে তোমার ছাপ পুলিশ না পায়৷ অবশ্য চামড়াটাও পুড়ে যাবে, কিন্তু উপায় কি৷ আর আমার কাছে অসাড় করবার কোনো ওষুধও নেই৷ তবে এই ঘরা মোটামুটি শব্দ রোধী, তুমি একটু আধটু চেঁচালেও কেউ খেয়াল করবে না৷’

‘অ্যাসিড? চেঁচাবো? আশ্চর্য, আপনি এসব—’ তরুণ আবেল কুঁকড়ে গেল৷ মিস্টার কেইন তাকে উপেক্ষা করে একটা দেওয়াল-আলমারির কাছে এগিয়ে গেলেন, বের করে নিলেন একটা বোতল, একটা বেসিন, এবং একটা বীকার৷ ওগুলো নিয়ে কি সব করলেন, তারপর ভেসে ওঠা কটু ধোঁয়ার মেঘের আড়াল থেকে তার ছাত্রের দিকে কৃপার দৃষ্টিতে উঁকি মারলেন৷

‘এসো,’ তিনি বিড়বিড় করে বললেন৷ ‘একটু হয়তো লাগবে, কিন্তু কথা দিচ্ছি, বিজয়ী-চেয়ারে বসে মারা যাওয়ার চেয়ে এর যন্ত্রণা অনে—ক কম৷ রসিকতায় যদি কিছু মনে না করো, বিজয়ী চেয়ারের কাছে গেলে সেটায় আর বসতে ইচ্ছে করবে না…’

মিস্টার আবেল ব্যাণ্ডেজ বাঁধা, দস্তানা পরা হাত নিয়ে বইয়ের দোকানে থেকে চলে যাওয়ার পর এবং একদিন সন্ধ্যায় তার পুনরার্বিভাবের মধ্যে এক সপ্তাহেরও বেশী কেটে গেছে৷

রাত তখন অনেক৷ দোকানের সদর দরজায় বহুক্ষণ কড়া নাড়বার পর মিষ্টার কেইন পা টেনে টেনে উপস্থিত হলেন এবং দরজা খুললেন৷

অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে তিনি যুবককে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন পেছনের ঘরে, অবাক চোখে চেয়ে রইলেন তার হাতের থলেটার দিকে, কিন্তু পেছনের ঘরের শান্ত পরিবেশে গিয়ে না বসা পর্যন্ত তিনি কিছু বললেন না৷

দোকানদার বৃদ্ধকে কৌতূহল আচ্ছন্ন করলো৷ ‘কি হয়েছিল কি তোমার?’

তিনি জানতে চাইলেন৷ ‘শেষবারের মতো তো নির্দেশ নিতে এলে না৷ আমি এদিকে চিন্তা করছি—’

তরুণ আবেল হাসলো৷ ‘আপনার চিন্তা করার দরকার ছিল না৷ যেটুকু আপনার কাছে শিখেছি, সেটুকু আমার কাজের পক্ষে ঢের বেশী৷ পুরো কাজটা দারুণ ভাবে শেষ হয়েছে৷’

‘তোমার—তোমার কাজ হয়ে গেছে? কিন্তু কবে? মানে, কাগজে তো কিছু দেখলাম না, কোন উল্লেখ পর্যন্ত—’

‘সবকিছু আমি ভেবে দেখেছি৷ শিকারকে নিছক গলা টিপে খুন করবার ব্যাপারে আপনি প্রথমে যে কথাটা বলেছিলেন, তার যুক্তি আছে৷ অবশ্য আমার আঙ্গুলে বেশ ব্যথা ছিল, কিন্তু তাতে কোন অসুবিধে হয়নি৷ অন্ধকার গলিতে ঘটে যাওায় খুনটাকে কোন সাধারণ ছিনতাই বাজের (তাই তো বলে ওদের) কাজ বলে ধরে নেওয়া হয়েছে৷ কাগজে ওটা পুরো এক প্যারাও জায়গা পায়নি, সুতরাং ওটা যে আপনার চোখ এড়িয়ে যাবে সে আর আশ্চর্য কি৷ নিন, এই দেখুন৷’

খবরের কাগজের একটা কাটিং আবেল এগিয়ে দিল, এবং বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি সেটা পড়লেন৷ তিনি চোখ তুলে তাকালেন, মাথা নাড়লেন৷ ‘ড্রিসকোল ছোকরা, হুঁ? কিন্তু আমি ভাবছিলাম তুমি হয়তো নামটা আমাকে বলবে না৷’

‘তাতে কিছু যায়-আসে না, আসে? সে-ই আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলো, আর সে আপনার একজন পুরোনো—ইয়ে—ছাত্র ছিল৷’

‘হ্যাঁ৷ একাট হিংসের ঘটনা ছিল৷ ওর বাগদত্তাকে একটা ছেলে চিনিয়ে নিয়েছিলো৷ আশ্চর্য বলতে হবে, ছেলেটার প্রতি ওর রাগ ছিলো না৷ ও মেয়েটাকে খুন করতে চেয়েছিলো৷ মেয়েটা তখন ওর প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে এক ফ্ল্যাটে থাকতো, আর সেই জন্য খুনের উদ্দেশ্য চাপা দিতে আমাদের কম হ্যাপা পোয়াতে হয়নি৷ অবশেষে, ভেবে চিন্তে এমন একটা কায়দা বের করা হলো যাতে খুনটা কোন মানসিক রোগীর কাজ বলে মনে হয়৷ যদ্দূর মনে পড়ছে, ‘ম্যাড বম্বার’’ এর কায়দা, তবে এখানে শুধু প্লেনের বদলে বাস৷ মার-প্যাঁচটা হচ্ছে, বোমাটা মেয়েটার মালপত্রের মধ্যে লুকোনো থাকবে না, তাহলে আসল উদ্দেশ্যটা বেরিয়ে পড়বার ভয় থাকে৷ ওটা লুকোনো থাকবে একটা সৈনিকের স্যুটকেসে, যে ছুটি কাটিয়ে ক্যাম্পে ফিরে যাচ্ছে৷ ঠিক সময়ে এরকম একটা লোকের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল এবং কাজটাও শেষ হল—সে সব খুঁটিনাটি বলে তোমাকে আর বিরক্ত করবো না৷ যাকগে, মোটমাট ওতে কাজ হয়েছিলো৷

আবেল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো৷ ‘হ্যাঁ, চারজন নিহত, তিনজন আহত হয়েছিল৷ মেয়েটাও মারা গিয়েছিল৷’

‘তোমার স্মৃতিশক্তির প্রশংসা করতে হয়৷ এ প্রায় দু’বছর আগেকার ঘটনা৷’ মিষ্টার কেইন একটু থামলেন৷ ‘নাকি ও তোমাকে বলেছিলো?’

‘ও আমাকে কিছুই বলেনি৷ আমি শুদু আন্দাজ করেছি৷ কারণ, আমিই ওর সেই প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাম৷ যে মেয়েটাকে ও খুন করেছে সে আমার প্রেমিকা ছিল৷’

‘ও, তাই বলো৷ তাহলে ওকে যে তুমি শেষ করতে চাইবে তাতে আর আশ্চর্য কি৷ যাক, তোমার প্রতিশোধ তবে নেওয়া হয়ে গেছে৷’

‘হ্যাঁ৷’

‘আর, সব ভালো যার শেষ ভালো৷’

‘কিন্তু শেষ এখনও হয়নি৷’

‘হয়নি?’

মিষ্টার আবেল তার থলে খুললো৷’ ‘আপনি তো নিজেই বলেছেন, আপনি ঐ ঘটনায় সাহায্যকারী ছিলেন৷ খুনের পরিকল্পনায় আপনি মদৎ দিয়েছেন৷ আর সেই জন্যেই—সে একটা বড় ছুরি আর একটা ছোট হাত-দা বের করলো৷’

‘দাঁড়াও, দাঁড়াও, মিষ্টার কেইন কেঁপে উঠলেন৷ ‘এ করে তুমি পার পাবে না৷’

‘আপনিই তো বলেছেন এ ঘরটা বলতে গেলে শব্দরোধী৷ কেউই আপনার চিৎকার শুনতে পাবে না, বিশেষ করে যদি প্রথমে আপনাকে মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে নিই৷’ দরজা আড়াল করে দাঁড়ালো আবেল এবং

দা-টা পরীক্ষামূলকভাবে হাওয়ায় ঘোরালো। বেশ পছন্দসই হাওয়া কাটার একটা সুইশ শব্দ হলো৷

‘কিন্তু দোহাই তোমার, আমার কথা শোনো—আমি মারা যাবো বলে বলছি না, তোমার মাস্টারমশাই হিসেবে বলছি, তোমার চেয়ে অভিজ্ঞতা বেশী বলেই বলছি৷ যে খুনের কায়দা তোমাকে আমি শিখিয়েছি আমার ক্ষেত্রে তা খাটবে না৷’

‘কেন খাটবে না? গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়ানার তো যথেষ্ট সময় আমার আছে৷ জানেন, আপনাকে আমি মিথ্যে কথা বলেছি? আমার হাতে দু সপ্তার ছুটি আছে, এক সপ্তাহ নয়৷’

‘তা হলেও তুমি ধরা পড়ে যাবে৷ কোথাও কেউ নিশ্চয়ই জানে, তুমি আমার কাছে রোজ রাতে আসতে৷ আর আমাকে এখান না দেখতে পেলেই—’

‘আপনি তো এখানে থেকে কোথাও যাচ্ছেন না৷ অন্তত বরাবরের জন্যে তো নয়ই৷ লোকে যদ্দূর জানবে তা হলো আপনি এক সপ্তার ছুটিতে যাচ্ছেন৷ এখান থেকে উধাও যে হচ্ছে, সে হলো আমি নিজে৷’

‘কোথায়?’

‘এইখানে, এই বইয়ের দোকানে৷ আপনার মতো রঙ করা চুল, কুঁজো হয়ে চলা, সরু গোঁফ এবং চশমার আড়ালে আমি উধাও হয়ে যাব৷’

‘তুমি আমার জায়গা নেবে? বরাবরের জন্যে?’

‘তাতে অসুবিধেটা কোথায়? আপনার গলার স্বর ও হাতের লেখা পড়ে নকল করে নিতে পারবো৷ আপনার কায়দা-কানুন থাকতে থাকতে ধরে নেবো৷ সেই সঙ্গে আপনার নতুন মক্কেলদেরও, কি বলেন৷ আপনাকে মানতেই হবে, এ রকম পরিকল্পনা যার মাথায় আসে তার মাস্টার হওয়ার যথেষ্ট যোগ্যতা আছে৷ তাছাড়া, এক্ষুনি যেটা করে দেখবো, আপনার চেয়ে একটা সুবিধে আমার বেশী আছে—রক্ত দেখে আমি মোটেই ভয় পাই না৷’

‘সে ভয় তুমি পাবে না—কারণ তুমি সত্যি একটা মানসিক-খুনী৷’

‘সব খুনীকেই তাই হতে হয়৷ আর সব মাস্টারদেরও৷’

‘কিন্তু—’

হাত দা-টা তাঁর উত্তরকে সংক্ষেপ করে দিলো৷

বড়ই দুঃখের কথা যে মিস্টার আবেলের প্রাক্তন শিক্ষক ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ছাত্রের পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপের কাজ দেখে গর্ব অনুভব করতে পারলেন না৷ যেহেতু পরিকল্পনার একটা অংশ মিষ্টার আবেলের মিষ্টার কেইনে পরিণত হওয়া, সে মিষ্টার কেইনের যাবতীয় আদব-কায়দা রপ্ত করে নিলো, এমনকি নিকৃষ্ট শ্লেষ অলঙ্কার প্রয়োগের রুচিটাও বাদ দিলো না৷ ডাকে দেবার জন্য তৈরী প্রত্যেক কটা প্যাকেটের ভেতর সে একটা করে বিশেষ বইয়ের মোড়ক ঢুকিয়ে দিলো৷ তার পছন্দ করা বইগুলোর মধ্যে ছিলো, ‘দিঅ্যানাটমি অফ মেলাঙ্কলি, ‘দি নেকেড অ্যান্ড দি ডেড’, আর ‘দি হার্ট অফ দি ম্যাটার’৷ হাত-পা বিহীন ধড়টুকুর জন্য, স্বাভাবিক ভাবেই, সে বেছে নিল, ‘এ ফেয়ার ওয়েল টু আর্মস’৷

এতে যে ঝুঁকি আছে তা সে বেশ বুঝতে পেরেছে, কিন্তু মানসিক খুনীদেরও একটু-আধটু নিরীহ ঠাট্টা করবার অধিকার আছে৷ বিশেষ করে সে যখন চায়, যেমন নতুন মিষ্টার কেইন চাইছেন, তার বাকী কাজ সযত্নে শান্তভাবে শেষ করতে এবং ফিরে এসে নীরস শিক্ষকতার জীবন নিয়ে বসবাস করতে৷

আর সেই ভাবেই, কাজ শেষ হলো৷ কাজ শেষ করে সে ফিরে এল বিয়ের দোকানে এবং চুলে রঙ মেখে চশমার পেছনে আত্মগোপন করলো৷ কিন্তু দিনের মধ্যেই জীবিকা-নির্বাহের ধরণ সে রপ্ত করলো৷ এবং আরও কিছু দিন পরে, নতুন ছাত্র আসতে শুরু করলো৷ পুরোনো বইয়ের দোকানটা তার ব্যবসা চালিয়ে যেতে লাগল৷

প্রত্যেক বড় শহরের ছোট ছোট রাস্তায় এগুলো দেখতে পাবেন, এবং কখনো কখনো ভেবে অবাক লাগবে, এদের মালিকের কি ভাবে জীবিকা নির্বাহে সক্ষম হয়…

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন