অনীশ দেব
র্যাভেনেল হলে এটাই সবচেয়ে খারাপ৷ বারান্দাগুলো ছায়াময় ও লম্বা, ঘরগুলো অন্ধকার ছাতা-ধরা, ছবিগুলো পড়ন্ত মলিন ও তাদের বিষয়বস্তু আরও শোচনীয়৷ হেমন্তের কোন সন্ধ্যায়, যখন বাগানের গাছগুলোয় বাতাস কেঁদে কেঁদে ফেরে, শুকনো পাতা শিষ দেয়, গুঞ্জন তোলে, আর বৃষ্টির ফোঁটা ঝাঁপিয়ে পড়ে জানালায়, তখন যে অল্পসাহসী মানুষেরা দিশেহারা হয়ে পড়বে সে আর আশ্চর্য কী! সুতরাং আমার পরিচিত লোকেরা যখন র্যাভেনেল-এ থাকতে ভয় পায়, তখন আমি অবাক হই না৷ এমন কি উইলভার্ন পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল ঃ অথচ সে সৈন্যদলে চাকরি করে, নিয়মিত পোলো খেলে, ওর অন্তর আরও সাহসী হওয়া উচিত চিল৷ ও যে দিন বিদায় নেয় তার আগের দিন রাতে আমি ওকে আবার তত্ত্ব বোঝাচ্ছিলাম ঃ যদি কয়েক ফোঁটা মানুষের রক্ত নিজের সামনে ফেলে খুব গভীর মনোনিবেশ করা যায় তাহলে কিছুক্ষণ পরে কোন পুরুষ বা নারীকে দেখতে পাওয়া যাবে, সে সারারাত তোমাকে সঙ্গ দেবে এমন কি দিনের বেলায় অপ্রত্যাশিত সব জায়গায় সে তোমার সঙ্গে দেখাও করতে পারে৷ যখন এই সব তত্ত্ব ওকে বুঝিয়ে বলছি ও আমাকে বাধা দিল৷—ভাই, অ্যালিস্টেয়ার! ও বলতে শুরু করল, যে করে হোক এ জায়গাটা তুমি ছাড়ো, শহরে যাও, একটু ঘরে ফিরে দ্যাখ—সত্যি, এ বাড়িটা তোমার ছাড়া উচিত৷
হ্যাঁ, আমি জবাব দিলাম, যাই আর হোটেলের বাজে খাবার আর ক্লাবের বাজে আলোচনার বিষে মরি৷ না ভাই, ধন্যবাদ৷ আর আমার স্বাস্থ্যের জন্যে তুমি যে রকম চিন্তিত হয়ে পড়ছ, তাতে আমি মনে মনে দুর্বল হয়ে পড়ছি৷
ঠিক আছে, তুমি যা ভালো বোঝ তাই কর, মেঝেতে পা ঠুকে ও বলল, কালকের পর আমি যদি আর একটা দিনও এ বাড়িতে থাকি তো কি বললাম—এখানে একমাত্র পাগল থাকতে পারে!
ও-ই ছিল আমার শেষ অতিথি, ও চলে যাবার কয়েক সপ্তাহ পরে সামনে কয়েক ফোঁটা রক্ত ফেলে আমি লাইব্রেরি ঘরে বসে ছিলাম৷ এ-ক’দিনে আমার তত্ত্ব প্রায় নির্ভুল হয়ে উঠেছে কিন্তু তাতে একটা গোলমাল ছিল৷
যাকে আমি সব সামনে দেখতাম সে ছিল এক বৃদ্ধা, মাথার চুল সিঁথি কেটে সমান দু-ভাগে ভাগ করা সেই চুল নেমে এসেছে কাঁধ পর্যন্ত, তার একপাশ সাদা, আর অন্যপাশ কালো৷ তার বয়েসে নুয়ে পড়া চেহারাটা আমি স্পষ্ট দেখতে পেতাম কিন্তু শুধু একটা খুঁৎ ছিল৷ তার কোন চোখ ছিল না, আর যখন আমি চোখ দুটোকে কল্পনা করে আপ্রাণ দেখতে চেষ্টা করতাম, তখন তার শরীরটা কুঁচকে গিয়ে পচে যেত আমার চোখের সামনেই৷ কিন্তু আজ রাতে আমি একমনে ভাবছি, শুধু ভাবছি, এত মনোযোগ দিয়ে আগে কখনও ভাবিনি, এবং দেখতে পেলাম চোখ দুটো ধীরে ধীরে এসে যেন হামাগুড়ি দিয়ে মাথায় জায়গা মতো বসে যাচ্ছে, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ভারী কিছু একটা পড়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর শব্দ বাইরে থেকে ছিটকে এল আমার কানে৷ এক ঝটকায় দরজা খুলে গেল, দুজন ঝি ঢুকল ঘরে৷ ওরা আমার চেয়ারের নিচে পাতা কার্পেটটা দেখল, এবং সঙ্গে সঙ্গেই ভয়ে সাদা হয়ে গিয়ে ‘ওঃ ভগবান!’ বলে চিৎকার করে জড়োসড়ো হয়ে বেরিয়ে গেল৷
লাইব্রেরিতে এভাবে ঢুকবার সাহস তোমাদের হল কোত্থেকে? আমি কঠোর স্বরে জানতে চাইলাম৷ কিন্তু কোন উত্তর পেলাম না, সুতরাং ওদের পিছু নিলাম৷ দেখলাম, বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তে বাড়ির সব ঝি চাকরেরা এক জায়গায় জটলা করে দাঁড়িয়ে রয়েছে৷
মিসেস পেব্ল—তীক্ষ্ণ স্বরে প্রধান পরিচারিকাকে লক্ষ্য করে আমি বললাম, কালকেই যেন এই মেয়ে দুটিকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়৷ এত বড় আস্পর্ধা! আপনার আরও সাবধান হওয়া উচিত৷
কিন্তু সে আমার কথা কানেই তুলল না৷ তার মুখ তখন আতঙ্কে বিকৃত হয়ে উঠেছে৷—ওঃ ভগবান! সর্বনাশ! মিসেস পেব্ল বলল, চল, আমরা সবাই মিলে লাইব্রেরিতে যাই—সবাইকে লক্ষ্য করে শেষ কথাগুলো বলল সে৷
এ বাড়ির মালিক এখনো আমি, না আর কেউ, মিসেস পেব্ল? একটা টেবিলে সজোরে ঘুষি মেরে আমি জানতে চাইলাম৷
ওদের কেউ যেন আমাকে দেখতে পাচ্ছে না, বা আমার কথা শুনেও শুনছে না, বলতে গেলে আমি যেন এক মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে চলেছি৷ ওদের অনুসরণ করে আমিও বারান্দা ধরে রওনা হলাম, এবং নানা রকম আদেশের সুরে বার বার বারণ করলাম লাইব্রেরি ঘরে ঢুকতে৷ কিন্তু ওরা আমাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল এবং ফায়ার প্লেসের সামনে পাতা কার্পেট ঘিরে জটলা করে দাঁড়িয়ে রইল৷ তারপর ওদের তিন-চারজন কি সব টানাটানি করতে লাগল, ধরে তুলতে লাগল—যেন কোন নিস্তেজ দেহ টেনে তুলে নিয়ে আসছে, তারপর সেই অদৃশ্য বোঝা নিয়ে হোঁচট খেতে খেতে একটা সোফায় নিয়ে গিয়ে রাখল৷ আমার পুরোনো পরিচারক সোম্স্ কাছেই দাঁড়িয়ে৷
বেচারা, দাদাবাবু! চাপা কান্নায় ভেঙে পড়ে সে বলল, আমি তাঁকে ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি৷ আর উনি কিনা এভাবে মারা গেলেন, এই কচি বয়েসে! আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম৷—এসব কি ব্যাপার, সোম্স্? চিৎকার আমি করে বললাম, আমি মরিনি, এই তো আমি—এই তো, তোমার সামনে!
সে কিন্তু এতটুকু নড়ল না, সুতরাং আমি একটু ভয় পেলাম৷—সোম্স্, ওকে ডাকলাম, তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? ছোটবেলায় আমার সঙ্গে কত খেলা করেছ মনে নেই? ওদের বল যে আমি মরিনি, প্লিজ সোম্স্, সোম্!
আমার মনে হয় গ্রামে গিয়ে ডাক্তারবাবুকে ডেকে আনা উচিত মিস্টার সোম্স্—মিসেস পেব্ল বলল, এবং সোম্স্ কাউকে পাঠাবার জন্য বেরিয়ে গেল৷
এই ডাক্তার লোকটা একটা অপদার্থ গর্দভ৷ তাকে আমি বাড়ি থেকে একবার বের করে দিয়েছিলাম, কারণ ত্রাণকর্তা ঈশ্বরে সে বিশ্বাসী ছিল, এবং একই সঙ্গে নিজেকে একজন বিজ্ঞানের লোক বলে দাবী করত৷ সে আমার বাড়ির চৌকাঠ যেন না মাড়ায়, এই ছিল আমার ইচ্ছে৷ সুতরাং আমি মিসেস পেব্লকে চিৎকার করে বারণ করতে থাকলাম, যেন ডাক্তারবাবুকে না ডাকা হয়৷ কিন্তু সে আমার কথা শুনতে পেরেছে বলে মনে হল না৷
ডাক্তারবাবুর সঙ্গে আমার দেখা হল লাইব্রেরি ঘরের দরজায়৷—এই যে! তীব্র ব্যঙ্গের সুরে বললাম, আবার কোন নতুন প্রার্থনা শেখাতে এসেছেন বুঝি?
সে এমনভাবে আমাকে পাশ কাটিয়ে ঘরে ঢুকল যে আমার ব্যঙ্গ টের পেয়েছে বলে মনে হল না৷ তারপর সে সোফার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল৷ মাথার শিরা ছিঁড়ে গেছে মনে হয়—সোম্স্ এবং মিসেস পেব্লকে লক্ষ্য করে একটু পরে সে বলল, মারা গেছেন ঘণ্টা কয়েক হবে৷ বেচারা! তোমরা টেলিগ্রাম করে ওঁর বোনকে খবর দাও, আমি কফিনওয়ালাকে খবর দিচ্ছি—
মিথ্যেবাদী কোথাকার! আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বললাম, ছোটলোক পাজী মিথ্যেবাদী! কোন্ সাহসে আমার চাকর-বাকরদের তুই বলছিস যে আমি মরে গেছি—যেখানে আমি তোমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি!
সোম্স্ ও মিসেস পেব্ল-এর সঙ্গে ডাক্তার ততক্ষণে বারান্দা ধরে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছে, আমার দিকে ওরা একবার ফিরেও তাকাল না৷
সারাটা রাত আমি লাইব্রেরিতে বসে রইলাম৷ আশ্চর্যই বলতে হবে, আমার একটুও ঘুম এল না, আর খিদেও পেল না৷ সকাল হতেই সব লোকেরা এসে গেল, এবং আমার শত বারণ সত্ত্বেও ওরা আমার চোখে অদৃশ্য এমন কোন জিনিসকে ঘিরে কি সব কাজ করতে লাগল৷ সুতরাং সুতরাং সারাটা দিন আমি হয় লাইব্রেরিতে বসে রইলাম নয় গোটা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে লাগলাম৷ রাতে লোকজনেরা আবার ফিরে এল—এবার সঙ্গে একটা কফিন নিয়ে৷ তখন নিতান্তই রসিকতাবশে, ভাবলাম এত সুন্দর একটা কফিন খালি পড়ে থাকবে, ফলে রাতটা আমি সেই কফিনে শুয়েই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিলাম৷ পরদিন সবাই যখন এসে হাজির হল, তখনও আমি বিশ্রামে মগ্ন৷ তারপর কফিনওয়ালা আমার দাড়ি-গোঁফ কামিয়ে দিল৷ আশ্চর্য লোক বটে!
সেই দিন সন্ধ্যায় নিচের তলায় নেমে আসতেই নজরে পড়ল হলঘরে কিছু মালপত্র রাখা আছে, এবং জানতে পারলাম আমার বোন এসে পৌঁছেছে৷ বিয়ের পর এতদিন ওকে দেখিনি৷ তাছাড়া এই নোংরা পৃথিবীতে সব থেকে বেশি কাউকে যদি আমি ঘেন্না করে থাকি তো সে আমার ওই বোন৷ ওকে দেখতে খুব সুন্দর, লম্বা, তামাটে রঙ ও ঋজু শরীর, আর ওর সব থেকে প্রিয় দুটো জিনিস ঃ পরনিন্দা-পরচর্চা ও পোশাক-পরিচ্ছদ৷ হয়তো এই জন্যেই আমি ওকে অপছন্দ করি৷ সাড়ে ন’টা নাগাদ একটা ভীষণ সুন্দর ঢিলে পোশাক গায়ে দিয়ে আমার বোন লাইব্রেরি ঘরে এল, এবং শিগগিরই বুঝতে পারলাম, আর সকলের মতই ও আমার উপস্থিতি একটুও টের পাচ্ছে না৷ যখন দেখলাম, ও কফিনের পাশে—আমার কফিনের পাশে, হাঁটু গেড়ে বসল, তখন আমি রাগে কাঁপতে লাগলাম কিন্তু যখন ও কফিনের বালিশে ঝুঁকে পড়ে চুমু খেল, আমি জ্ঞানগম্যি হারিয়ে বসলাম৷ সুতো কাটার একটা ছুরি সামনের টেবিলের ওপর পড়েছিল ঃ সেটা তুলে নিয়ে ওর ঘাড় লক্ষ্য করে সজোরে বসিয়ে দিলাম৷ আমার বোন চিৎকার করে ঘর ছেড়ে ছুটে পালাল৷
শিগগির এসো! শিগগির এসো! ও চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে লাগল, ভয়ে উত্তেজনায় ওর গলার স্বর কাঁপছে—মৃতদেহের নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে!
তখন আমি মনে মনে অভিসম্পাত দিলাম৷
তৃতীয় দিন সকালে ভীষণ তুষারপাত হল৷ এগারোটা নাগাদ দেখলাম, কালো পোশাক পরে গ্রামের লোকেরা বাড়িতে এসে ভিড় করেছে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য৷ লাইব্রেরিতে গিয়ে চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ শিগগিরই সব লোকজন এসে উপস্থিত হল, কফিনের ঢাকনা বন্ধ করে কফিন কাঁধে তুলে নিল৷ তারপর বেরিয়ে গেল ঘরে ছেড়ে৷ আর, আমি বসেই রইলাম, বিষণ্ণ হয়ে ভাবলাম, আমার কাছ থেকে কোন জিনিস যেন ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে ঃ কিন্তু সেটা যে কি, তা ঠিক বুঝতে উঠতে পারলাম না৷ প্রায় আধ ঘণ্টা চিন্তায় বিভোর রইলাম, স্বপ্ণ দেখলাম তারপর আমি এগিয়ে গেলাম নীচে হলঘরের দরজার দিকে৷ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কোন চিহ্ণই আর চোখে পড়ছে না কিন্তু একটু পরেই দূরে নজরে পড়ল, তুষারের সাদা পটভূমিতে একটা কালো সুতো এঁকেবেঁকে এগিয়ে চলেছে৷
আমি মরিনি! যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠলাম আমি৷ তাজা তুষারের মুখ ঘষলাম, আর তুষারের গুঁড়ো ছড়িয়ে দিলাম আমার ঘাড়ে, মাথায়—ওঃ ভগবান, আমি মরিনি! আমি বেঁচে আছি! বেঁচে আছি!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন