ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল

অনীশ দেব

ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল

আমার চাকরি নিয়ে ঠাট্টা করবেন না, প্লিজ৷ কলেজ এলাকার ছেলেছোকরাদের কাছ থেকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের অনেক খোঁচা সহ্য করেছি৷ শহরের লাশ-রাখা ঘরে রাতের কেরাণীর কাজ যে আমার খুব একটা পছন্দ তা নয়, তবে তার কতকগুলো সুবিধেও আছে৷

প্রথমত, এ চাকরিতে দিনের বেলায় কলেজে পড়াশোনা করার সুবিধে রয়েছে এবং রাতে সামান্য নিয়ম-মাফিক কাজ ও তন্দ্রার ফাঁকে ফাঁকে বই নিয়ে বসার যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়৷

ক্যালকুলাসের কোন অঙ্ক নিয়ে যখন মাথার মধ্যে তোলপাড় করছি, তখন লেবেল লাগানো নম্বর দেওয়া ড্রয়ারে শুয়ে থাকা বাসিন্দারা আমাকে একটুও বিরক্ত করে না৷ অন্তত আমি তাই ভাবতাম৷

এই রাতেও আমি এসে রোজকার মতো ওলাফ ডেলিকে ছুটি দিলাম৷ ওলাফ সব সময় কাজ নিয়ে লেগে থাকে, কাজ নিয়ে লেগে থাকে, কারণ ওর বয়েস আর খোঁড়া পা৷ চাকরি ছেড়ে পালাবার এই মুহূর্তটার জন্যেই যেন প্রতি দিন ও বেঁচে থাকে৷ সুতরাং বরাবেরের মতো এক নিশ্বাসে ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে ‘হ্যালো’ এবং ‘বিদায়’ বলল ওলাফ, তারপর খোঁড়া পায়ে অদ্ভুত তৎপরতার সঙ্গে লাশ-ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷

গভীর নিস্তব্ধতায় ভরা পাশের ঘরে এসে ফ্লাক্স, ট্রানজিস্টর রেডিয়ো ও কয়েকটা পড়ার বই ডেস্কের ওপর নামিয়ে রাখলাম৷ আমি এখন সম্পূর্ণ একা৷ রেকর্ডের ভারী খাতাটা সামনে টেনে নিলাম চোখ বুলিয়ে নেবার জন্য৷

রোজকার নাম-ধামগুলো ওলাফ ওর পরিষ্কার টানা হাতের লেখায় লিখে রেখেছে৷ জলে ডোবা যুবক৷ মোটর দুর্ঘটনায় মৃত মহিলা ও পুরুষ৷ বিছানায় আগুন লাগা সত্ত্বেও জেগে ওঠেনি এমন এক মাতাল৷ ছুরির লড়াইয়ে হেরে যাওয়া যুবক৷ নদীতে পাওয়া মহিলার মৃতদেহ৷

নাঃ, ওলাফের দিনটা রোজকার মতই কেটেছে৷ গত সপ্তার বুড়িটার মতো কোন লাশ আসেনি৷

বুড়িটা জঘন্য, নোংরা সেই রকমই নোংরা এক বাসায় একা একা থাকত৷ এমনিতে ছিল বদ্ধ পাগল, কিন্তু সব সময়েই এক স্বপ্নের দেশে বাস করত, যেখানে সে নোংরা নয়, বুড়ি নয়, সকলের করুণার পাত্রী নয়! বরং সে ভাবত, অন্ধকারের শক্তির ওপর তার খবরদারি ক্ষমতা রয়েছে সে এণ্ডরের চতুর্থা মায়বিনী৷’

অজ্ঞতা ও কুসংস্কারের ডিপো ছিল সেই বস্তি অঞ্চলটা এবং বুড়ির প্রতিবেশীরা সত্যি সত্যিই তাকে ডাইনী ভাবত, তার অলৌকিক ক্ষমতায় বিশ্বাস করত৷ অবশ্য তাকে দেখেও তাই মনে হত ঃ কঙ্কালের মতো মুখ, লম্বা নাকের ডগায় একটা আঁচিল, মুখে একটাও দাঁত না থাকায় থুতনীটা ছুঁচলো ও লম্বা মনে হত, আর ভাঙা দু-গালের ওপর ঝুলে থাকত নোংরা চুলের গোছা৷ হাত গুণে, ভবিষ্যৎ বলে, ভালোবাসার মন্ত্রপুত ওষুধ বেচে, তার আধপেটা খাবার জুটে যেত৷ তবে বুড়িটার একটা গুণ ছিল কারো খারাপ সে করত না, অন্তত তার প্রতিবেশীরা তাই বলত৷

কিন্তু একদিন, এক ভ্যাপসা গরমের রাতে, নিজের বাড়ির ছাদে উঠে গেল সেই ‘এণ্ডরের চতুর্থ মায়াবিনী’৷ কেউ ঠিক জানে না, সে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিল, না উড়ে চাঁদে যাবার চেষ্টা করেছিল৷ সে যাই হোক, ছ’তলা নীচের অ্যাসফন্টের রাস্তা থেকে তাকে চেঁছে তোলা হয়, নিজে আসা হয় এখানে, এবং চোদ্দো নম্বর ড্রয়ারে জমা দেওয়া হয়৷ শীততাপনিয়ন্ত্রিত বাক্সে বন্দী হয়ে সে চারদিন ছিল৷ তারপর দূরের কোন্ রাজ্য থেকে তার এক কেতাদুরস্ত ছেলে এসে হাজির হল মৃতদেহ দাবী করতে৷

সে চলে যাবার পরেও ওলাফ ডেলি স্বস্তি পায়নি৷ বুড়ো খালি বলেছে, মাইরি বলছি, চোদ্দো নম্বর ড্রয়ার থেকে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে, ঠিক যেন গন্ধকের মতো৷

আমি কিন্তু টের পাইনি৷ যে বদ গন্ধ আমার নাকে ধরা পড়ে তা হল কেমিষ্ট্রি ল্যাবরেটরির গন্ধ, যেখানে ক্লাসের পড়াশোনার সঙ্গে তাল রাখতে আমাকে রোজ হিমসিম খেতে হয়৷

রেকর্ডের খাতা থেকে চোখ সরিয়ে ঘরগুলোয় নিয়ম-মাফিক টহলে বেরোলাম৷ পাশের ঘরটা আকারে বেশ বড়, উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত, ঠান্ডা এবং নিষ্প্রাণ৷ ঘরের মেঝে তকতকে ধূসর টালিতে বাঁধানো, এবং তা থেকে সামান্য অ্যান্টিসেপটিকের গন্ধ নাকে আসছে৷ ঘরের ও প্রান্তে বড় দু-পাল্লার দরজা৷ সেটা পেরোলেই ছোট্ট বারান্দা ঃ মৃতদের প্রথম সেখানে এনে রাখা হয়৷ দরজার কাছেই ছোট ছোট চাকা লাগানো লম্বা সরু মার্বেল পাথরের টেবিল৷ সুখের কথা, এই মুহূর্তে সেটা খালি, ঘষে মেজে পরিষ্কার করা, এবং অনিবার্য ব্যবহারের জন্যে অপেক্ষা করছে৷ শীতাতপ যন্ত্রের চাপা ফিসফিসে গুঞ্জন যেন শোনার চেয়ে অনুভব করা যায় বেশি৷

আমার ডানদিকে অতিকায় মৌচাকের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সারি সারি ড্রয়ারের থাক৷ এখানেই মৃতদেহগুলো রাখা হয় কেউ দাবী করবে বলে, নয়তো শেষমেষ কোম্পানির খরচায় সেগুলো কবর দেওয়া হয়৷

যে যে ড্রয়ারে লাশ আছে, সেগুলোয় জাহাজের টিকিটের মতো কার্ড লাগানো আছে৷ লাশ রাখার সময়েই সরু তার দিয়ে কার্ডটাকে ড্রয়ারের হাতলের সঙ্গে বেঁধে দেওয়া হয়৷

নিছক কোন শব্দ শোনার আশাতেই হালকা সুরে শিস দিতে দিতে ড্রয়ারের কার্ডগুলো রেকর্ড খাতায় দেখা নামগুলোর সঙ্গে মনে মনে মিলিয়ে নিতে লাগলাম আমি৷

চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারের কাছে আসতেই একটা গন্ধ যেন নাকে এল৷ গন্ধ শুঁকতে গিয়ে হাঁচি পেল৷ ‘এই তাহলে ওলাফ ডেলির গন্ধ!’ আপন মনেই বিড়বিড় করে বললাম৷

চোদ্দ নম্বরে কোন দেহ আছে বলে রেকর্ড খাতায় ওলাফ কোন নাম লেখেনি, কিন্তু ড্রয়ারের হাতলে দেখছি কার্ড ঝুলছে! ড্রয়ারের কাছে এসে ঝুঁকে পড়লাম, হাত বাড়ালাম কার্ডটার দিকে৷ আমার ঠোঁট থেকে শিসের শব্দ ক্রমে মিলিয়ে গেল নিস্তব্ধতায়৷

অন্যমনস্ক ভাবেই কার্ডটাকে একবার উলটে দেখলাম তারপর আবার, আরো একবার—আগের চেয়ে আরে বেশি ক্ষিপ্রতায়৷

সোজ হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোতে লাগলাম৷ কার্ডের দু-পাশটাই সাদা৷ ওলাফ বুড়ো হতে পারে, কিন্তু এখনও ওর ভীমরতি ধরেনি৷ ড্রয়ারের কার্ডে নাম লিখতে ভুলে যাওয়াটা তো ওর স্বভাব নয়৷

তারপর আপন মনেই হেসে উঠলাম৷ ব্যাটা বুড়ো বোধ হয় আমার সঙ্গে মস্করা করতে চাইছে৷ ওলাফ যে ঠাট্টা মস্করাও করতে পারে এ ধারণা আমার আগে ছিল না৷

আমার ঠোঁটে শিসের সুর আবার ফিরে এল৷ ড্রয়ারটার হাতল ধরে এক হ্যাঁচকা টান মারলাম৷ ছোট ছোট রোলারে ভর করে ড্রয়ারটা সরসর করে খুলে এল৷ আমার শিসের সুর পালটে গেল এক চাপা চিৎকারে, এবং মাঝপথেই থমকে গেল৷

ড্রয়ারের মেয়েটা বয়েসে যুবতী৷ মাথার চুল সোনালী৷ যথেষ্ট সুন্দরী, এমন কী মরে যাবার পরেও৷

জুতোর ভেতরে আমার পায়ের বুড়ো আঙুল গুটিয়ে যেতে চাইল৷ মেয়েটার দিকে অপলকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম৷ মেয়েটার মুখের গড়ন চমৎকার, গায়ের চামড়া বিবর্ণ তামাটে সার্টিনের মতো৷ চোখ দুটো এমন ভাবে বোজা ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে, লম্বা লম্বা চোখের পাতা যেন ঘন ছায়ার রেখা৷ পরণে সাদা নাইলনের ইউনিফর্ম, কলারে নার্সদের পিন আঁটা৷ একমাত্র ব্যক্তিগত সাজ সজ্জা বলতে একটা সোনার ব্রেসলেট ঃ সরু চেনের সঙ্গে লাগানো একটা লকেট৷ লকেটে দুটি আদ্যাক্ষর খোদাই করা ঃ জেড. এল.৷

স্বর্ণকেশীর চোখ সরিয়ে চটপট এলাম পাশের ঘরে৷ টেবিলে রাখা রেকর্ডের খাতাটা এক ঝটকায় কাছে টেনে নিলাম৷ বুড়ো ডেলির প্রতি আমি অবিচার করতে চাই না৷

রোজকার ভর্তির নামের লিস্টে আঙুল বুলিয়ে চললাম৷ ইতস্তত করলাম৷ আগের পাতা উল্টে গতকালের লিস্টে চোখ বোলালাম৷ তারপর তার আগের দিন৷ নাঃ, চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারে কাউকেই ভর্তি করা হয়নি৷

আবার লাশ-ঘরের দিকে রওনা হলাম৷ শিস দিতে ঠোঁট ছুঁচলো করলাম, তবে শিসের শব্দ বেরোল না৷ দু-ঘরের মাঝের দরজাটার ওপর দিকটা কাঁচের৷ কাঁচ ভেদ করে চোখ মেলে দিলাম৷ দরজা খোলার কোন প্রয়োজন নেই৷ চোদ্দো নম্বর ড্রয়ারটা আমি খোলা রেখেই এসেছি, এবং স্বর্ণকেশী জেড এল. এখনও সেখানে রয়েছে এ সত্য জীবনের মতই বাস্তব ও মৃত্যুর মতই অমোঘ৷

সন্তর্পণে টেবিলে বসলাম, রুমাল বের কপালে বুলিয়ে নিলাম৷

একটা গভীর শ্বাস টেনে ফোন তুলে নিলাম৷ ডায়াল করলাম ওলাফ ডেলির নম্বর৷ ওর ফোন যখন বাজছে, আমি তখন একটা চোরা চাউনি ছুড়ে দিলাম লাশ-ঘরের দিকে৷

ছ’বার কি সাত বার ফোন বাজার পর ওলাফের বউ ঘুম-জড়ানো গলায় জবাব দিল৷—না, ওলাফের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব নয়, সে এখনও বাড়ি ফেরেনি৷

তারপর হঠাৎই ও একটু নরম সুরে বলে উঠল, এক মিনিট ধরুন৷ মনে হয় ও ফিরে এসেছে৷

গলা খাঁকারি দিয়ে বউয়ের কাছ থেকে ফোনটা নিল ওলাফ৷

হ্যালো, কী ব্যাপার?

আমি টুলি ব্র্যানসন বলছি, মিস্টার ডেলি৷

তোমার ইয়ার দোস্ত কে কোথায় বোতল খুলেছে তার জন্যে আমি তোমার জায়গায় গিয়ে ডিউটি দিতে পারব না৷

না, স্যর, তা নয়—আমি বললাম, আসল ব্যাপারটা হল, চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারের মেয়েটা সম্পর্কে আমার কিছু খবরাখবর দরকার৷

চোদ্দো নম্বরে তো কেউ নেই, টুলি৷

হ্যাঁ, স্যর, আছে৷ চোদ্দো নম্বরে একটা মেয়ে আছে৷ অল্পবয়েসি সোনালি চুল ফুটফুটে একটা মেয়ে, মিস্টার ডেলি৷ মরেছে বলে বিশ্বাসই হতে চায় না৷ আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে৷ শুধু খাতায় মেয়েটার নাম এন্ট্রি করতে আপনি ভুলে গেছেন৷

শুনতে পেলাম মিসেস ডেলি ওলাফকে জিগ্যেস করছে, কী ব্যাপার৷ বউয়ের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওলাফের স্বর পালটে গেল, মনে হয় ব্র্যানসন ছোকরা আজ রাতে ওর ফ্লাস্কে হুইস্কি নিয়ে এসেছে৷

না স্যর—ওলাফকে লক্ষ্য করে তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠলাম, যা অবস্থা তাতে আমার হুইস্কিরই দরকার, কিন্তু সঙ্গে তো এক ফোঁটাও নেই৷ শুধু যা আছে তা হল চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারে একটি সোনালি চুল মেয়ের মৃতদেহ, যার নামটা আপনি খাতায় টুকতে ভুলে গেছেন৷

এ রকম ভুল আমার কি করে হবে? ওলাফ জানতে চাইল৷

জানি না, কিন্তু হয়েছে—আমি বললাম, এই তো মেয়েটা চোখের সামনেই রয়েছে৷ বিশ্বাস না হলে নিজে এসে স্বচক্ষে দেখে যান৷

তাই করতে হবে দেখছি, খোকা! তুমি আমার নামে বিরাট বদনাম দিচ্ছ!

ও এত জোরে রিসিভারটা নামিয়ে রাখল যে আমার কানের পর্দা কেঁপে উঠল৷ অত্যন্ত শান্তভাবে ফোন নামিয়ে রাখলাম৷ একটা সিগারেট ধরিয়ে ফ্লাক্স থেকে কফি ঢাললাম, একটা সিগারেট ধরিয়ে কফিতে চুমুক দিলাম, এবং একটা সিগারেট ধরালাম৷

আর এক ঢোক কফি খেয়ে সিগারেটের প্যাকেটের দিকে হাত বাড়ালাম৷ আর তখনই লক্ষ্য করলাম, ইতিমধ্যে তিন তিনটে সিগারেট ধরিয়ে ফেলেছি এবং অ্যাসট্রে থেকে সেগুলোর ধোঁয়া এঁকেবেঁকে হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে৷ ক্লিষ্ট হাসি হেসে ভবিষ্যৎ সঞ্চয়ের জন্যে দুটো টান দিয়ে সিগারেট নিভিয়ে দিলাম৷

ঝোড়ো সমুদ্রের জাহাজের মাস্তুলের মতো ওর খোঁড়া পা নিয়ে ওলাফ এসে হাজির হল৷ ওর আগুনঝরা দৃষ্টির উত্তর দিলাম হাসি দিয়ে৷ যতখানি সম্ভব আশ্বাস ঢেলে দিলাম সে হাসিতে৷ তারপর ওকে ইশারা করলাম লাশ-ঘরের দিকে৷

সুইংডোর ডোর ঠেলে ওলাফ লাশ-ঘরে ঢুকল আমি ঠিক ওর পিছনে পিছনে৷ চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারটা এখনো হাট করে খোলা৷ ও ড্রয়ার পর্যন্ত যাওয়ার কষ্টটা করল না৷ বরং ড্রয়ারটার দিকে এক পলক দেখেই বিদ্যুৎগতিতে ঘুরে দাঁড়াল আমার মুখোমুখি৷

ব্র্যানসন! ও রাগে গর্জে উঠল, আমার বয়েস বিশ বছর কম হলে তোমার নাকটা থেঁৎলে দিতাম! তোমার সাহস আছে বলতে হবে, একটা ক্লান্ত বুড়ো মানুষকে এই হতচ্ছাড়া জায়গায় টেনে এনেছ৷ আর আমি ভাবতাম আজকালকার ছেলে-ছোকরার মধ্যে তুমি অনেক ভালো৷

কিন্তু, মিস্টার ডেলি…

আর কিন্তু বলে লাভ নেই ছোকরা! তোমার নামে আমি রিপোর্ট করব৷

উদ্ভ্রান্তের মতো আবার তাকালাম চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারের দিকে৷ ওই তো, স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েটাকে৷ সোনালি চুল, সুন্দরী এবং মৃত৷

আমাকে ঠেলা মেরে সরিয়ে ওলাফ বেরিয়ে যেতে চাইল ঘর থেকে৷ আমি ওর হাত চেপে ধরলাম৷ ভয়ে আমার অবস্থা মুরগীর ছানার মতো, এবং পারলে পালক সমেত খোলস ছেড়ে দিই৷—শুনুন শুনুন, আমি চিৎকার করে উঠলাম৷ মেয়েটাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন তো! আমি জানি স্পষ্ট দেখেছেন!

আমার গা থেকে হাত সরাও—ওলাফ চেঁচিয়ে জবাব দিল, ঠিক যা আছে আমি স্পষ্ট তাই দেখতে পাচ্ছি৷ একটা খালি ড্রয়ার৷ ঠিক তোমার ফাঁপা মগজের মতই খালি৷

আমি ওর হাত খামচে ধরলাম, প্রাণ গেলেও ছাড়ছি না৷—এ আপনি কি ধরনের ঠাট্টা করছেন আমার মাথায় ঢুকছে না…

ঠিক তাই৷ আমারও মাথায় ঢুকছে না আমার চেয়েও জোর চেঁচিয়ে বলল ওলাফ, তবে ঠাট্টাটা নেহাৎই বস্তাপচা!

তাহলে আপনি ড্রয়ারটার দিকে আর একবার দেখুন, আর এই খামখেয়ালিপনা বন্ধ করুন৷

আমার যা দেখার আমি দেখেছি৷ কোন গর্দভ দামড়া ছাড়া এক বুড়োকে রাত-বিরেতে তার বাড়ি থেকে বেরুবে না!

এক ঝটকায় ওলাফ হাত ছাড়িয়ে নিল, ঝড়ের মতো দরজা পার হয়ে বেরিয়ে গেল৷ সদর দরজায় পৌঁছে ও থামল৷ ঘুরে দাঁড়িয়ে আঙুল তুলে শাসাল আমাকে—হাড়-হাভাতে বজ্জাত ছোকরা—ও বলল, কাল থেকে অন্য চাকরি খুঁজতে শুরু কর! এ কথা বলে ও চলে গেল৷

ওলাফকে অনুসরণ করে আমি পাশের ঘর পর্যন্ত এসেছিলাম, এবার ঘুরে তাকালাম লাশ-ঘরের দিকে৷ একটা হতাশার আর্তনাদ বেরিয়ে এল আমার মুখ থেকে৷ কাচের শার্সি দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি জেড. এল. এখনও চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারেই রয়েছে৷

লক্ষ্মী মেয়ে আমার—আপন মনেই বিড়বিড় করে বললাম, চলে যাও দেখি, এই আমি চোখ বন্ধ করছি, সেই ফাঁকে তুমি কেটে পড়৷

চোখ বন্ধ করলাম, আবার খুললাম, না, মেয়েটা যায়নি, ড্রয়ারেই রয়েছে৷

হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের কাছে গিয়ে ধপ করে চেয়ারটায় বসে পড়লাম৷ কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারলাম না, কারণ কাজের ব্যস্ততার ইঙ্গিত দিয়ে দরজার কলিং বেল বেজে উঠল৷

আচমকা তীক্ষ্ণ শব্দে চেয়ার ছেড়ে প্রায় হাতখানেক লাফিয়ে উঠলাম৷ চেয়ারটা পায়ে লেগে ছিটকে পড়ল মেঝেতে৷

স্মিথ আর ম্যাকলিন তখন শতছিন্ন পোশাক পরা এক বুড়েকে স্ট্রেচার থেকে নামিয়ে রাখছে মার্বেল পাথরের টেবিলের ওপর৷

বেচারা এক চলন্ত ট্রাকের সামনে গিয়ে হাজির হয়—স্মিথ বলল৷

কোন পরিচয়-পত্র নেই—ম্যাকলিন বলল, জন ডো নাম দিয়ে এটাকে বরফ-ঘরে ঢুকিয়ে দাও৷

একেবারে ধেঁৎলে গেছে, তাই না ব্র্যানসন? জন ডো-র ওপর থেকে চাদরটা সরিয়ে নিয়ে দাঁত বের করে হাসল স্মিথ৷ ও সব সময়ে আমার সঙ্গে এ রকম বজ্জাতি করে, কারণ ও জানে আমার পাকস্থলী তেমন মজবুত নয়৷

হ্যাঁ, তা যা বলেছ—আমি বললাম, ঠোঁটের ওপর থেকে ঘাম মুছে নিলাম, তবে এই মেয়েটার মতো নয়৷ ওর গায়ে এতটুকু দাগ পর্যন্ত নেই৷

মেয়ে?

হ্যাঁ—আগ্রহ ঝরে পড়ণ্ডল আমার কণ্ঠস্বরে, সুন্দর সোনালি চুল মেয়েটা৷ চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারে যে আছে৷

স্মিথ ও ম্যাকলিন দুজনেই বাইরে বের করা খোলা ড্রয়ারটার দিকে দেখল৷ তারপর তাকাল পরস্পরের চোখে৷

টুলি ভাই—ম্যকলিন বলল, তোমার শরীর কেমন আছে?

ভালোই আছে—আমি জবাব দিলাম৷ স্পষ্ট টের পেলাম আমার কপালের ভাঁজে বরফ জমতে শুরু করেছে৷

ঘুমের কোন গণ্ডগোল হয়নি তো? কোন বাজে স্বপ্ন-টপ্ন বার বার দেখো নি তো?

কই না তো—আমি বললাম, কিন্তু চোদ্দ নম্বরের মেয়েটা…তোমরা যদি ওকে এনে না থাকো তাহলে হয়তো কলিন্স আর স্নেভলি এনেছে৷ ওরাই তাহলে মেয়েটা সম্পর্কে খবর-টবর দিতে পারবে৷

স্মিথ আর ম্যাকলিন যেন আমার কাছ থেকে সরে গেল৷ তারপরই স্মিথের দম-ফাটা হাসি লাশ-ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে চুরমার করে দিল৷

সুন্দরী মেয়ে, সোনালি চুল, চোদ্দ নম্বর ড্রয়ার, যেখানে ওই হতভাগা ছিটেল্ বুড়িটা ছিল…ঠিক আছে, ব্র্যানসন, বুঝেছি৷

ম্যাকলিন হতভম্ব হয়ে তার সঙ্গীর দিকে তাকাল, বুঝেছি মানে?

খুব সহজ—স্মিথ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল, বেচারা টুলির এখানে একা একা ভীষণ একঘেয়ে লাগে৷ এই আমাদের সঙ্গে একটু মজা করবার জন্যে এই গপ্পো ফেঁদেছে, কি বল টুলি?

স্পষ্টই বোঝা গেল মেয়েটাকে ওরা দেখতে পাচ্ছে না, আর পাবেও না৷ হঠাৎ বুঝতে পারলাম, আমি যদি আরও জোর করি, তা হলে বিপদটা শেষ পর্যন্ত আমারই হবে৷ সুতরাং মাখন তোলা দুধের মতো সাদা হাসিতে ফেটে পড়লাম—যা বলেছ—বললাম স্মিথকে, খাটুনির কষ্টটা তো ভুলতে হবে৷

স্মিথ কনুই দিয়ে খোঁচা মারল আমার পাঁজরে—দেখ টুলি ভায়া, এই লাশ যেন গরম হয়ে না ওঠে—৷ আর একদফা হাসি হেসে ও চলে গেল৷ কিন্তু স্মিথের পিছন পিছন বেরোবার সময় ম্যাকলিন বারকয়েক ঘাড় ফিরিয়ে চিন্তিত দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে গেল আমার দিকে৷

আমার অনিচ্ছা সত্তেবও বাইরের দরজাটা বন্ধ হল৷ এই মুহূর্তে আমার সঙ্গীর ভীষণ প্রয়োজন৷ ‘লাশ-ঘরে আমি একা জীবিত প্রাণী’ এ কথা ভেবে এই প্রথম আমার পাকস্থলী যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেল ঠিক ঠান্ডা শুকনো খেজুরের মতো৷

এত সাবধানে চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারকে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম যেন এক গভীর খাদের ওপর দিয়ে এক ভঙ্গুর কাঁচের সেতু পার হচ্ছি৷

চলে যাও বলছি—জেড. এল. কে লক্ষ্য করে চাপা গলায় বলে উঠলাম, তুমি মোটেই সত্যি নও৷ এমন কি মৃতদেহ পর্যন্ত নও৷ নিছকই একটা—একটা ছায়া যে ছায়া আমি আমি ছাড়া কেউ দেখতে পাচ্ছে না৷ সুতরাং কেটে পড়৷

যাকে উদ্দেশ্য করে এত কথা বলা সে নির্বিকার রইল৷ বরং কোন্ সুরে অস্তিত্বহীন একটা মৃতদেহের সঙ্গে কথা বলছি তা ভেবে আমি নিজেই ভয় পেলাম৷

পাশের ঘরের টেবিলে ফিরে এসে বসলাম৷ কয়েক সেকেন্ড এক বিচিত্র কাঁপুনি দিয়ে গেল আমার শরীরে৷ তারপর একটা উৎসাহী চিন্তা ঝলসে উঠল মনের মধ্যে৷ হয়তো ওলাফ ডেলি, স্মিথ ও ম্যাকলিন, সবাই মিলে আমার সঙ্গে মজা করছে৷ হয়তো জেড. এল-এর মৃতদেহ কলিন্স আর স্নেভলিই নিয়ে এসেছে, কারণ দিনের বেলায় ওরাই লাশ এনে জমা দেয়৷ তারপর ওরা হয়তো ভেবেছে এই কলেজের ছোকরাকে ভয় দেখিয়ে দারুণ একটা মজা করা যাবে৷

মেজাজটা সামান্য ভালো হল৷ হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নিয়ে জুড লরেন্সকে ফোন করলাম৷ জুড আমার বাবার গল্ফ্ খেলার সঙ্গী এবং হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের সাদা পোশাক ডিটেকটিভ৷ আমার সম্পর্কে ওর ধারণা ভালোই, এবং সত্যি বলতে কি, এ চাকরিটার জন্যে ও-ই আমার হয়ে সুপারিশ করেছিল৷

জুডকে বাড়িতে পেলাম না৷ ও তিনটে থেকে এগারোটা ডিউটি করে বেড়াচ্ছে৷ সুতরাং পুলিশ হেডকোয়ার্টারে ফোন করলাম৷ শুনলাম, জুড সই করে বেরিয়ে গেছে, কিন্তু ওরা চেষ্টা করে লকার রুমে জুডকে পেল৷

টুলি ব্র্যানসন, মিস্টার লরেন্স৷

কেমন চলছে, টুলি?

একটা মুশকিলে পড়ে গেছি৷

বলে ফেল৷ ওর জোরালো মেজাজি স্বরে দ্বিধার লেশমাত্র নেই৷

হ্যাঁ, মানে…মনে হচ্ছে, একটা লাশের ব্যাপারে আমাদের রেকর্ড খাতায় একটু গোলমাল হয়েছে৷ একটা মেয়ে৷ সোনালি চুল৷ নার্স৷ নামের আদ্যাক্ষর জেড. এল.৷

তাহলে ওলাফ ডেলিকে ফোন করে দ্যাখ, টুলি৷

হ্যাঁ, স্যার, কিন্তু জানেন তো, ডিউটি থেকে ছাড়া পাওয়ার পর ওলাফের কি অবস্থাটা হয়! এতক্ষণে ও স্বপ্নের দেশে পৌঁছে গেছে, আর আমি ওকে এ সময়ে বিরক্ত করতে চাই না৷ ও ভীষণ ক্ষেপে যাবে৷

জুত দরাজ গলায় হেসে উঠল, নাঃ, বেচারাকে দোষ দেওয়া যায় না৷ মেয়েটার সম্বন্ধে আর কিছু তাহলে জানো না?

না, যা বললাম শুধু তাই৷ মেয়েটা বেওয়ারিশ নয়, এ আমি হলফ করে বলতে পারি৷ এর মতো মেয়ে, বিশেষ করে স্বাভাবিক কারণে যে মারা গেছে, বেসরকারি কবরখানায় যার যাওয়ার কথা, এখানে আসার কথা নয়৷

সুতরাং মর্গে যখন এসেছে তখন মেয়েটা স্বাভাবিক ভাবে মারা যায়নি, জুড বলল৷

সে ছাড়া আর কী হতে পারে৷

খুন?

অন্য কোন কারণ তো মনে পড়ছে না—আমি বললাম, মেয়েটা নিশ্চয়ই সন্দেহজনক অবস্থায় মারা গেছে৷

ঠিক আছে, টুলি৷ দেখছি, তোমার জন্যে কী করতে পারি৷

আপনাকে কষ্ট দিতে হচ্ছে বলে ভীষণ খারাপ লাগছে৷

কষ্ট—ও বলল, কষ্টের কী আছে? গোটা দুয়েক টেলিফোন করলেই কাম ফতে হয়ে যাবে৷

ধন্যবাদ, মিস্টার লরেন্স৷

ফোন রেখে দিলাম৷ জুড লরেন্সের টেলিফোনের অপেক্ষা করতে করতে উঠে গেলাম লাশ-ঘরের দরজার কাছে৷ আস্তে আস্তে শার্সির ফাঁক দিয়ে নজর চালিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলাম আমি যে, চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারে মেয়েটার ছায়া এখনও আছে৷

হ্যাঁ আছে৷ পা টেনে টেনে আবার ফিরে এলাম টেবিলের কাছে৷ মনে হল আমি যেন এক ক্লান্ত বৃদ্ধ মানুষ৷

অবশেষে ফোন যখন বাজল, আমি ছোঁ মেরে রিসিভার তুলে নিলাম৷

সিটি মর্গ৷ টুলি ব্র্যানসন বলছি৷

আমি জুড, টুলি৷

আপনি কি…

হোমিসাইড থেকে কোন খবর নেই, টুলি৷ জেড. এল. নামে কোন সোনালিচুল মেয়ে গত চবিবশ ঘণ্টায় খুন হয়নি৷

ও—সত্যিকারের যন্ত্রণার আর্তনাদকে মাঝপথে টুঁটি টিপে থামিয়ে দিলাম৷

নার্সদের খাতা-পত্তরেও খোঁজ নিয়েছি—জুড তখন বলে চলেছে, তোমার বর্ণনা নার্সকে পাওয়া গেছে৷ যুবতী, সোনালি চুল, সবে ট্রেনিং শেষ করেছে৷ ওর নাম জেলা ল্যাংট্রি৷ থাকে ৭১১ ইস্টল্যান্ড অ্যাভিনিউতে৷ সম্প্রতি সিটি হসপিটালে কাজে ঢুকেছে৷ যদি ওর কোন বিপদ-আপদ হয়ে থাকে, তাহলে তা গত আধ ঘণ্টায় হয়েছে৷ কারণ কিছুক্ষণ আগেই শিফ্ট বদলের সময় ও ডিউটি শেষ করে বাড়ি রওনা হয়ে গেছে৷

জুডের কথা ও চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারের ছায়া যোগ করলে একটাই অবিশাস্য উদ্ভট সম্ভাবনা বাকি থাকে৷ সেটা এতই ভয়ঙ্কর ও অপার্থিব যে আমার মাথার চুল ছুঁচের মতো খাড়া হয়ে উঠল৷

মিস্টার লরেন্স, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে, জেলা ল্যাংট্রি কোন দিনই জীবিত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছবে না৷

তার মানে? কী বলছ তুমি, টুলি?

এন্তরের চতুর্থ মায়াবিনী যে ড্রয়ারে…আমার কথা জড়িয়ে গেল, বুড়িটার মন ভীষণ নরম ছিল৷ কখনও লোকের ক্ষতি করত না৷ শুধু ভালো করত৷

কী সব আবোল-তাবোল বকছ? তীক্ষ্ণ গলায় জানতে চাইল জুড, টুলি, তুমি নেশা করেছ নাকি?

না, স্যর৷

শরীর ঠিক আছে তো?

আমি—মানে…ইয়ে, হ্যাঁ, স্যর৷ অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার লরেন্স৷

বিশ মিনিট পরে আমার ঝরঝরে চার-চাকা ইস্টল্যান্ড অ্যাভিনিউতে এসে থামল৷ গাড়ি থেকে বেরিয়ে নম্বর খুঁজতে খুঁজতে পা চালালাম৷ বুঝলাম, ঠিক জায়গাতেই এসেছি, এবং ৭১১ নম্বর সহজেই পেয়ে গেলাম৷ একটা ছোট সাদা রঙের বাড়ি, সঙ্গে লাগোয়া ছোট উঠোন৷

জায়গাটা অন্ধকার, নির্জন, শান্ত৷

সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যখন গর্দভ মনে হচ্ছে তখন হঠাৎই সামনের চৌরাস্তা থেকে ডিজেল ইঞ্জিনের শব্দ ভেসে এল৷ তাকিয়ে দেখি, একটা সরকারী বাস ভারী শরীর নিয়ে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে৷

একটা দলছুট মেপ্ল্ গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে দেখলাম, একটা মেয়ের ছায়া-শরীর ইস্টল্যান্ড অ্যাভিনিউ ধরে আমারই দিকে এগিয়ে আসছে৷ কিন্তু বাস থেকে মেয়েটা একা নামেনি৷ ওর ঠিক পিছনে আরও লম্বা, ভারী একটা ছায়া ঃ একটা লোক৷ দৃশ্যটা দেখে আমার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেল৷

মেয়েটা টের পেল ওর পিছনে কেউ আসছে৷ তাই তাড়াতাড়ি পা চালাতে শুরু করল৷ লোকটাও চলার গতি বাড়িয়ে দিল৷ মেয়েটা পিছন ফিরে তাকাল৷ আরও জোরে পা চালাল বলতে গেলে এখন ছুটছে৷

ফুটপাথে লোকটার পায়ের শব্দ স্পষ্ট ও দ্রুত লয়ে বাজতে লাগল৷ সে মেয়েটার ঘাড়ের ওপর এসে পড়তেই মেয়েটার চিৎকার মাঝপথে থেমে গেল৷

ফুটপাথে ওরা তখন যুঝে চলেছে৷ লোকটা বাহুর খাঁজে মেয়েটার গলা চেপে ধরেছে, মেয়েটা হাত-পা ছুড়ছে আর ছটফট করছে৷

মেপ্ল্ গাছের আড়াল থেকে আমি এমন ভাবে ছুটে গেলাম যেন অদৃশ্য দামামা আমাকে রক্তের হোলিখেলায় যোগ দেবার জন্যে হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷ লোকটা আমার পায়ের শব্দ পেয়ে মেয়েটাকে ছেড়ে দিল৷ আমি সরাসরি গিয়ে লোকটার ওপরে পড়লাম৷ আমার কাঁধ ওর পেটে আঘাত করল৷

লোকটা সজোরে একটা হাঁটু তুলল৷ আঘাতটা আমার থুতনিতে এসে লাগল৷

আমি ফুটপাথে বসে পড়লাম, এবং লোকটা ঘুরে দাঁড়িয়ে ছুটে পালাল৷

শক্ত অথচ কোমল হাত আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল৷ এই প্রথম আমি জেলা ল্যাংট্রির চোখের দিকে তাকালাম৷ ছায়াময় রাতে কৃতজ্ঞতা মাখানো ভারী সুন্দর ধোঁয়াটে চোখ৷

আপনার লাগেনি তো? দম ফিরে পেয়ে প্রশ্ন করলাম৷

না, ঠিক আছি৷ আপনি?

না না, আমার কিছু হয়নি, আমি বললাম৷

মেয়েটা আস্তে আস্তে আস্থা ফিরে পাচ্ছে৷

ভাগ্যিস্ ঠিক সময়ে আপনি এসে পড়েছিলেন!

আমি—ইয়ে—মানে এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম—ওকে বললাম, চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিই৷ ওই লোকটার নামে পুলিশে রিপোর্ট করে লাভ নেই৷ কারণ মুখ দেখতে পাইনি৷ ওরা ধরতে পারবে না৷’

আমি বাড়ি যাচ্ছিলাম—ও বলল, একটু এগিয়েই আমার বাড়ি৷

আমরা হাঁটতে শুরু করলাম৷ মেয়েটা বলল, ওর নাম জেলা৷ আর আমিও বললাম, আমার নাম টুলি৷ ওর বাড়ির দরজায় পৌঁছে আমরা পরস্পরের চোখে তাকালাম, এবং আমি জানতে চাইলাম কখনও ওকে ফোন করলে কোন অসুবিধে আছে কি না, ও বলল, হাতের কাছে টেলিফোন খালি পেলেই করতে৷ দেখলাম, ও বাড়িতে ঢুকে গেল৷ গাড়িতে ফিরে আসার সময়ে আমি শিস দিতে শুরু করলাম৷

মর্গে ফিরে এসে সোজা এগিয়ে গেলাম চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারের দিকে৷ আমার অনুমান যদি ঠিক হয় তাহলে জেলা ল্যাংট্রির ছায়াকে ড্রয়ারে আর দেখা যাবে না, কারণ এইমাত্র ওকে মৃত্যুর করাল গ্রাস থেকে উদ্ধার করা হয়েছে৷

সুতরাং চোদ্দ নম্বর ড্রয়ারের কাছে দাঁড়িয়ে ভালো করে অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম৷ না, আমার অনুমানে অন্তত কোন ভুল হয়নি৷

জেলা ল্যংট্রির ছায়া ড্রয়ারে আর নেই৷ নতুন যে মেয়েটা রয়েছে তার মাথায় সুন্দর একরাশ লাল চুল!

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন