অনীশ দেব
ক্রলাবের আরাম-কেদারায় হেলান দিয়ে একটা খানদানী চুরুটে আগুন ধরালেন মিস্টার ডেভিড পোরলক৷ দুনিয়ার যা কিছু ভালো সবেতেই তাঁর আজ দিল খুশ৷ একটু আগেই নৈশভোজ সেরেছেন মেজাজী কেতায়৷ সব কাজ এভাবেই সারেন তিনি৷ সুগন্ধী ধোঁয়ার প্রথম রেখা ওপরে ভেসে উঠতেই তিনি মনোযোগ দিলেন পানপাত্রের সোনালি তরলে৷ গ্লাস ঠোঁট ছোঁয়াতে যাবেন এমন সময় একজন পরিচালক রুপোর ট্রে-তে করে একটা কার্ড বয়ে নিয়ে এল৷
‘ডিটেকটিভ-ইন্সপেক্টর, নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে, নিলিপ্ত মুখে কার্ডটা পড়লেন মিস্টার পোরলক, ‘কী ব্যাপারে এসেছেন?’
‘উনি বলেননি, স্যার৷’
‘ওঁকে ভিজিটরদের ঘরে বসাও৷ আমি কয়েকমিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি৷’
পানীয় শেষ করলেন মিস্টার পোরলক, তারপর ধীরে সুস্থে রওনা হলেন৷ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তাঁর কাছে কী জানতে চায়?
‘আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে দুঃখিত, স্যার, ‘ইন্সপেক্টর সিলভার বললেন, ‘ব্যাঙ্ক ম্যানেজার মিস্টার চার্লস ক্যাভেন্ডিশের ব্যাপারে আপনার কাছে এসেছি৷’
‘ক্যাভেন্ডিশ? কেন, ওঁর কী হয়েছে?’ চটপট কৌতূহলী হয়ে মিস্টার পোরলক জানতে চাইলেন৷
‘মানে, সত্যি কথা বলতে কি, আমিও ঠিক জানি না৷ মনে হচ্ছে, তিনি কেমন রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছেন৷’
পোরলক ক্রমশ গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন৷ হঠাৎই যেন সহজ হলেন৷
‘রাবিশ!’ বলতেন তিনি, ‘ক্যাভেন্ডিশের মতো লোক কখনও উধাও হতে পারেন না৷ কাল রাতেই তো উনি এখানে আমার সঙ্গে ডিনার খেয়েছেন৷ না, না, সেরকম গোলমেলে কিছু হতেই পারে না৷’
‘সকলের আশা তাই, কিন্তু কাল রাতে তিনি বাড়ি ফেরেননি৷ আর তারপর থেকে কেউ ওঁকে দেখেনওনি৷’
দিশেহারা দৃষ্টি নিয়ে সি.আই.ডি. অফিসারের দিকে তাকিয়ে রইলেন পোরলক৷
‘আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না৷ কাল চলে যাওয়ার সময় মিস্টার ক্যাভেন্ডিশ তো ঠিকই ছিলেন৷’
‘তখন ক’টা হবে, স্যার?’
‘এই প্রায় এগারোটা, কি তার ঠিক পরেই৷ আমি ততটা খেয়াল করে দেখিনি৷’
‘উনি কি বলেছিলেন কোথায় যাচ্ছেন?’
‘না৷ তবে আমি স্বাভাবিকভাবেই ধরে নিয়েছি বাড়ির দিকে যাচ্ছেন৷ সে ছাড়া আর কিছু ভাবার তো কোনও কারণ ছিল না৷’
লোহার মতো ধূসর গোঁফে আঙুল ছোঁয়ালেন সিলভার৷
‘তাঁকে দেখে কি তখন নরমাল মনে হয়েছিল, স্যার?’
‘অবশ্যই৷ সত্যি কিথা বলতে কি, উনি দারুণ খোশমেজাজে ছিলেন৷ পরের শনিবার দুজনে মিলে মাছ ধরতে যাওয়ার প্রোগ্রামও করেছিলাম৷’
‘আপনি আর মিস্টার ক্যাভেন্ডিশ বোধহয় পুরনো বন্ধু?’
‘হ্যাঁ৷ পঁচিশ বছর আগে আমরা একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি৷ এই উধাও হওয়ার ব্যাপারটাকে আমি খুব একটা সিরিয়াসলি নিতে পারছি না, ইন্সপেক্টর৷ দেখবেন, খুব শিগগিরই উনি সশরীরে এসে হাজির হবেন৷ অবশ্য যদি না ওঁর কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়ে থাকে৷’
‘আমরা সব হসপিটালে খোঁজ নিয়েছি৷ সেখানে ওঁর কোনও খবর পাওয়া যায়নি৷’
‘এক মিনিট, উনি যেন বলছিলেন—হ্যাঁ, উনি আমাকে যেন বললেন, ওঁর স্ত্রীর ইস্টবোর্ন না কোথায় যেন গেছেন৷’
‘মিসেস ক্যাভেন্ডিশ কাল রাতে হঠাৎই ফিরে এসেছেন, স্যার, আর এসেই ভীষণ আপসেট হয়ে পড়েছেন৷ আজ ভোর চারটের সময় তিনি আমাদের ফোন করে ব্যাপারটা জানিয়েছেন৷ আমরা বহু খোঁজখবর করেছি, কিন্তু কোনও লাভ হয়নি৷ সবে আজ সন্ধেবেলা চিফ ক্যাশিয়ারের হঠাৎ খেয়াল হয় যে, তিনি মিস্টার ক্যাভেন্ডিশকে গতকাল বলতে শুনেছিলেন, উনি নাকি রাতে আপনার সঙ্গে ডিনার সারবেন৷’
‘হ্যাঁ, ব্যাপারটা শুনে একটু ইয়ে হওয়ারই কথা৷’ পোরলক মন্তব্য করলেন৷
‘কাল রাতে ঠিক কী হয়েছিল একুট খুলে বলবেন, স্যার—যদি আপনার আপত্তি না থাকে৷’
‘না, না, আপত্তির কী আছে৷ কাল রাত আটটার সময় ক্লাবে ওঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়৷ ডিনারের পর আমরা একটু বিলিয়ার্ড খেলেছিলাম৷ তারপর একটা ট্যাক্সি নিয়ে আমার ফ্ল্যাটে যাই৷’
‘ফ্ল্যাটে ক’টার সময় পৌঁছেছিলেন, স্যার?’
‘তা দশটা তো হবেই৷’
‘ওখানে যাওয়ার বিশেষ কোনও কারণ ছিল?’
‘হ্যাঁ৷ আমার কাছে খুব চমৎকার পুরনো নেপোলিয়ন ব্র্যান্ডি ছিল৷ আমি চেয়েছিলাম ক্যাভেন্ডিশ ওটা একটু চেখে দেখুক৷’
‘ও, তার মানে উনি আপনার ফ্ল্যাটে ঘণ্টাখানেকের বেশি ছিলেন?’
‘তা হবে৷’
‘যখন ওঁকে ছেড়ে দেন তখন আপনি কোথায় ছিলেন?’
‘আমার ফ্ল্যাটের দরজায়৷’
‘তার মানে লিফটে চড়ে তিনি একাই নেমে গিয়েছিলেন?’
‘না৷ আসলে উনি লিফটে নামেননি৷ বলছিলেন, ওটার জন্যে অপেক্ষা করতে বিরক্ত লাগছে৷’
‘আপনি কি আর ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়েছিলেন, স্যার?’
‘না৷ একটু পড়াশোনা করলাম, তারপর মাঝরাত নাগাদ শুতে গেলাম৷’
ইন্সপেক্টরের আঙুল আবার চলে গেল গোঁফের দিকে৷
‘ব্যাপারটা এবার স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে,’ তিনি বললেন, ‘আপনিই ওকে শেষ দেখেছেন৷’
‘তাই তো মনে হচ্ছে৷ যদি না অবশ্য আমাদের বাড়ির রাতের দারোয়ান ওঁকে বেরোনার সময় দেখে থাকে৷ লোকটা নিচের হলে ওর ছোট্ট অফিসেই সাধারণত বসে থাকে৷ তবে জানি না, কাল ক্যাভেন্ডিশকে বেরোতে দেখেছে কি না৷’
‘অনেক ধন্যবাদ, স্যার৷ এরকম একটা ব্যাপারে আমাদের তো খোঁজখবর করতেই হবে৷ তবে আপনি যেমন বললেন, আমরাও চাই খুব শিগগিরই উনি সশরীরে এসে হাজির হোন৷’
‘ব্যাপারটা সত্যিই বেশ অদ্ভুত৷ ব্যাঙ্ক ম্যানেজাররা সাধারণত বেশ শক্ত ধাতের ভরসা করার মতো মানুষ হয়৷ দেখুন, ওঁর হয়তো স্মৃতিভ্রম হয়েছে, পথ হারিয়ে কোনদিকে চলে গেছেন৷ এখন সত্যিই বড় চিন্তা হচ্ছে৷’
আরও একদিন কেটে গেল৷ খবরের কাগজগুলো ব্যাপারটায় খুব মারাত্মক আগ্রহ না দেখিয়ে কয়েকটা সাবধানী প্যারাগ্রাফ ছাপল, কারণ মানুষ তো রোজই উধাও হয়ে যাচ্ছে৷ ঠিকই যে, এক্ষেত্রে উধাও-হয়ে-যাওয়া মানুষটি একজন ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, ফলে কিছুটা গুরুত্বপূর্ণ৷ ওয়্যারলেসে এস.ও.এস. পাঠিয়ে আরও খানিকটা প্রচার পাওয়া গেল৷ তবে সপ্তাহের শেষে অন্যান্য আরও ঘটনা জনতার নজর কেড়ে নিল৷ আর অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার ভদ্রলোক অস্থায়ীভাবে চালকের আসনে বসে ব্যাঙ্কের কাজকর্ম দিব্যি সামাল দিতে লাগলেন৷
সুতরাং, মাসখানেক পর এই উধাও হওয়ার ব্যাপারটা প্রায় সকলেই ভুলে গেল৷ শুধু ব্যক্তিগতভাবে যাঁরা মিস্টার ক্যাভেন্ডিশকে চিনতেন তাঁরা ভুলতে পারলেন না৷ আর মিসেস ক্যাভেন্ডিশ ধরে নিলেন যে, রহস্যময় এক বিচিত্র ঢঙে তিনি বিধবা হয়েছেন৷
মিস্টার ডেভিড পোরলক রীতিমতো আয়েসী ভদ্রলোক৷ তিনি ঠিক করলেন এই জুন মাসের কয়েকটা সপ্তাহ পারীতে কাটিয়ে আসবেন৷ কারণ এই সময়টাই ওই পূর্তির শহরের সেরা সময়৷ ভিক্টোরিয়া স্টেশনের ক্লোকরুমে তাঁর সব মালপত্র জমা দেওয়া হল৷ তারপর তিনি দু-একটা কাজ সেরে ক্লাব এলেন লাঞ্চ সারতে৷ কিন্তু সামনে সাজিয়ে দেওয়া উৎকৃষ্ট মাছের পদের স্বাদ নেবার আগেই ডিটেকটিভ-ইন্সপেকটর সিলভারের কার্ড তাঁর কাছে হাজির করল একজন পরিচারক৷
সামনের খাবারের দিকে একপলক তাকিয়ে ভুরু কোঁচকালেন মিস্টার পোরলক৷
‘ওঁকে বলো, আমি এক্ষুনি নিচে আসছি৷’ পরিচারককে এ-কথা বলে ছুরি আর কাঁটাচামচ তুলে নিলেন তিনি৷ এরপর যখন তিনি নিচে নেমে এলেন, ডিকেটটিভ সিলভার তখনও ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছেন৷
‘আবার কী ব্যাপার, ইন্সপেক্টর?’ অভিজাত মানুষটি আলগা সৌজন্য দেখিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আমি বেশিক্ষণ থাকতে পারব না, কারণ আজই আমি পারী চলে যাচ্ছি৷’
‘ওই মিস্টার ক্যাভেন্ডিশের ব্যাপারটার জন্যেই এসেছি, স্যার৷ আমরা এখনও ওটার ফাইল ক্লোজ করতে পারনি৷’
‘ওহ্, হ্যাঁ, ঠিকই তো৷ আপনারা একবার কোনও কিছু কামড়ে ধরলে সহজে ছাড়েন না, তাই না?’
‘ছাড়তে চেষ্টা তো করি, কিন্তু না পারলে আর কী করব৷ এই কেসটার জট আমরা এখনও চাড়াতে পারিনি৷’
‘আমার তো মনে হয় ওঁর মেমোরি লস হয়েছে৷’
‘আপনি হয়তো সেটা ভাবতে পারেন, স্যার—তবে ওঁর ডাক্তার মোটেও সেরকম ভাবেন না৷’ সিলভার বললেন, ‘তিনি স্পষ্ট বলেছেন, অ্যামেনেসিয়া আর যারই হোক, মিস্টার ক্যাভেন্ডিশের হবার নয়৷’
‘তাহলে আমি হাল ছেড়ে দিচ্ছি৷’ খানিকটা বিমূঢ়ভাবে আনমনা গলায় বললেন পোরলক৷
‘কিন্তু আমরা কখনও হাল ছাড়ি না৷’
‘যাকগে, আপনি কী জন্যে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন, বলুন৷ আমি বোধহয় আপনাকে কয়েক মিনিটের বেশি সময় দিতে পারব না৷’
অবিচলিত ইন্সপেক্টর তাঁর লোহা-ধূসর গোঁফে আঙুল চালাতে লাগলেন৷
‘দুঃখিত, স্যার, এরকম একটা ব্যাপারে আমরা তাড়াহুড়ো করতে পারি না৷ আরও দু-একটা পয়েন্ট আছে যেগুলো নিয়ে আপনার সঙ্গে একটু আলোচনা করা দরকার—যদি অবশ্য আপনার আপত্তি না থাকে৷ মিস্টার ক্যাভেন্ডিশ উধাও হওয়ার পরদিন আপনি আমাকে যা যা বলেছিলেন তার সমস্ত নোট এখানে রয়েছে৷’
‘এ তো জানা কথা, আমার আর কিছু বলার নেই৷ তখনই যা বলার সব বলেছি৷’
‘হতে পারে, স্যার৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও রুটিন মাফিক কাজ তো আমাদের করতেই হবে৷ এখানে লেখা আছে দেখছি আপনি মিস্টার ক্যাভেন্ডিশকে নিয়ে আপনার ফ্ল্যাট গিয়েছিলেন রাত দশটায়৷ আর, তারপর আপনি আর বেরোননি?’
পোরলক ছোট্ট করে হাসলেন৷
‘হ্যাঁ, কিন্তু এসব তো প্রাচীন ইতিহাস৷ আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন—’
‘আপনি ক’দিনের জন্যে বাইরে যাচ্ছেন, স্যার?’
‘ওহ্, একমাস কি বড়জোর ছ’সপ্তাহ৷ পারীতে গিয়ে কেমন লাগে তার ওপর নির্ভর করছে ক’দিন থাকব৷’
‘আপনি কী কী লাগেজ সঙ্গে নিচ্ছেন জানতে পারি কি?’
মিস্টার পোরলক যথেষ্ট মর্যাদাসম্পন্ন মানুষ৷ এ-প্রশ্নে খানিকটা যেন অবাক হলেন তিনি৷
‘জানি না এর সঙ্গে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কী সম্পর্ক, তবে আপনি যদি সত্যিই আনতে চান, তাহলে আমার বলতে কোনও আপত্তি নেই৷’
‘বললে ভালো হয়, স্যার৷’ অবিচলিত সিলভার উত্তর দিলেন৷
‘দাঁড়ান, মনে করে দেখি৷ একটা ট্রাঙ্ক, একা সুটকেস আর একটা অ্যাটাচি কেস৷ কিন্তু এসব জেনে আপনার কোন উপকারটা হবে সেটা একটু বলবেন?’
‘সেরকম কোনও কারণ নেই, স্যার৷ তবে ওই যে, একটু আগে আপনি বললেন, কোনও কিছু কামড়ে ধরলে আমরা সহজে ছাড়ি না৷ একদিন না একদিন আমরা জানতে পারবই মিস্টার ক্যাভেন্ডিশের কী হয়েছে৷ কিন্তু তদ্দিন পর্যন্ত তো হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না, সবরকম চেষ্টা আমাদের করতেই হবে৷’
‘সত্যি, আপনাদের তারিফ করতেই হয়৷ তবে আমি আর কোনও সাহায্য করতে পারব বলে মন হয় না৷ এবার যদি আমাকে মাপ করেন, ইন্সপেক্টর—’
‘আপনি আমাকে মাপ করবেন, স্যার৷ আরও দু-একটা ব্যাপার আমাদের খতিয়ে দেখা বাকি আছে৷ আপনি যদি আর একটু সাহায্য করেন তাহলে আমি খুব জলদি কেসটা গুছিয়ে নিতে পারব৷ তারপর আপনি এসব ব্যাপার পুরো ভুলে গিয়ে নিশ্চিন্তে যেখানে খুশি যেতে পারেন৷ নেহাত ফরমালিটি হিসেবে জিগ্যেস করছি, আপনার মালপত্রগুলো এখন কোথায় আছে বলবেন?’
‘নিশ্চয়ই৷ ভিক্টোরিয়া স্টেশনের ক্লোকরুমে৷ কিন্তু এসব ব্যাপার কি একটু হাস্যকর ঠেকছে না?’
‘যেখানে একজন ভদ্রলোকের জীবন-মরণ সমস্যা, স্যার, সেখানে আমাদের সবকিছুই খতিয়ে দেখতে হবে—তা সেটা অন্য কারও চোখে হাস্যকর লাগুক আর না-ই লাগুক৷ আমার প্রশ্নের উত্তর না দেবার মতো কোনও কারণ নিশ্চয়ই আপনার নেই?’
‘একেবারেই না৷ তবে বেকার সময় নষ্ট হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে৷’
‘আমার সঙ্গে ভিক্টোরিয়া স্টেশনে যেতেও নিশ্চয়ই আপনার আপত্তি হবে না?’
‘আপনি যেতে চাইলে আমার আর আপত্তির কী আছে৷’ মিস্টার পোরলক বললেন, ‘কিন্তু এখনও আমি আপনার উদ্দেশ্যটা বুঝতে পারছি না৷’
‘স্রেফ রুটিন ব্যাপার, স্যার৷’ বিড়বিড় করে বললেন ইন্সপেক্টর, ‘পুলিশের কাজের ষোলো আনাই তো প্রায় তাই৷ আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করলে কোনও কোনও পাবলিক খাড়া হয়ে বসে, কিন্তু ওসব আমরা গায়ে মাখি না৷ তবে আমরা সবসময় চেষ্টা করি যাতে কেউ অনর্থক বেশি উত্তেজিত না হয়৷ এবার কি তাহলে আমরা রওনা হব, স্যার?’
পোরলকের কাঁধ সামান্য নড়ল৷ তারপর তিনি রাজি হলেন৷
ভিক্টোরিয়া স্টেশনে পৌঁছে ইন্সপেক্টর বললেন, ‘এবার স্যার, আপনার জিনিসগুলো আমি একটু খেতে চাই৷ আপনার কাছে নিশ্চয়ই ক্লোকরুম টিকিট আছে?’
ক্লান্ত হেসে পোরলক টিকিটটা ইন্সপেক্টরকে দিলেন৷
‘এই নিন৷ আর মালপত্র খুলে যদি দেখতে চান তাহলে এই নিন চাবির গোছা৷ জানি না আপনি ঠিক কী খুঁজতে চাইছেন, তবে আমার জামাকাপড়গুলো কম এলোমেলো করলে খুশি হব৷’
প্রায় অপরাধী-মুখে সিলভার ট্রাঙ্কের তালা খুললেন৷ ট্রাঙ্কের ভেতরটা ওপর ওপর দেখে নিয়ে আবার তালা বন্ধ করে দিলেন৷
‘ঠিক আছে, স্যার৷’ বললেন তিনি, ‘আপনি আশা করি কিছু মনে করেননি?’
‘বিন্দুমাত্র না৷’ বেশ আন্তরিকভাবেই জবাব দিলেন মিস্টার পোরলক, ‘এবারে বলুন তো, আমার ট্রাঙ্কটা খুলে দেখার কারণ কী?’
‘ভেতরে কী আছে দেখার জন্য, স্যার৷’ অমায়িক উত্তর পাওয়া গেল৷
‘ও৷ এবার আপনি সন্তুষ্ট তো?’
‘হ্যাঁ, নিজের চোখে দেখা প্রমাণ তো মানতেই হয়৷’ আলতো করে নিজের গোঁফে টান মারলেন সিলভার : ‘ভালো কথা, স্যার, আপনার কি আর কোনও লাগেজ আছে?’
‘আশ্চর্য লোক মশাই আপনি! একমাসের জন্য পারী গেলে আর কত মাল সঙ্গে নিতে লাগে!’
‘আজ সকালে আপনার ফ্ল্যাট থেকে শুধু এই লাগেজগুলোই আপনি নিয়ে বেরিয়েছেন?’
‘কী বলতে চাইছেন, ইন্সপেক্টর?’
‘আমি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর চেয়েছি, স্যার৷’
‘পারীতে আমি শুধু এই লাগেজগুলোই নিয়ে যাচ্ছি৷’
‘আমি জানতে চেয়েছি, আজ সকালে আপনার ফ্ল্যাট থেকে শুধু এই লাগেজগুলোই আপনি নিয়ে বেরিয়েছেন কি না৷’
‘নিশ্চয়ই৷’
মুহূর্তের জন্য সিলভারের চোখ বিকিয়ে উঠল যেন৷
‘আপনার ঠিক মনে আছে তো?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ—’
‘এই একটা ট্রাঙ্ক, একটা সুটকেস, আর একটা অ্যাটাচি কেস?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ, তাই৷’
‘আরও ভালো করে ভেবে ঠিক ঠিক জবাব দিলে ভালো হয়, মিস্টার পোরলক৷’
‘আমার পাঁচরকম কথা বলা অভ্যেস নেই, ইন্সপেক্টর৷’ অবিচলিত স্বরে উত্তর পাওয়া গেল৷
‘ও৷ তাহলে নিশ্চয়ই ব্যাপারটা আপনি ভুলে গেছেন৷’
‘ভুলে গেছি? কী?’
‘আমি খবর পেয়েছি যে, আপনি বাড়ি থেকে দুটো ট্রাঙ্ক নিয়ে এই ক্লোকরুমে এসেছেন৷’
চিন্তায় মিস্টার পোরলকের চোখ কয়েক মুহূর্তের জন্য ছোট হল৷ তিনি বললেন, ‘আপনি ঠিকই বলেছেন, ইন্সপেক্টর৷ আমি অত্যন্ত দুঃখিত৷ তবে ব্যাপারটা কী জানেন, আপনার এই জিজ্ঞাসাবাদের চোটে আমার সবকিছু কেমন গুলিয়ে গেছে৷ হ্যাঁ, আরও একটা ট্রাঙ্ক আছে বটে৷ ওতে বেশ কিছু দামি জিনিসপত্র আছে—মানে, নানান ট্রফি, মেডেল এইসব৷ আমি বাইরে কোথাও গেলে ওগুলো ফ্ল্যাটে রেখে যাই না৷ ওই ট্রাঙ্কটার কথা একেবারে ভুলেই গেছিলাম—আপনি বললেন তাই মনে পড়ল৷’
‘বুঝতে পেরেছি, স্যার৷ খুবই স্বাভাবিক, বিশেষ করে আপনি যখন বাইরে যাওয়ার তাড়াহুড়োয় রয়েছেন৷ ওই ট্রাঙ্কটা কোথায় রেখেছেন?’
‘আমার ব্যাঙ্কের স্ট্রং-রুমে৷ সবসময় ওখানেই রেখে যাই৷’
‘ওটা যদি খুলে একপলক দেখি তাতে আপনি নিশ্চয়ই কিছু মনে করবেন না?’
‘একেবারেই না৷ এই নিন চাবি৷ ফিরে আসার আগে ওটা আমার দরকার পড়বে না৷ গুডবাই, ইন্সপেক্টর৷ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড সত্যিই নাছোড়বান্দা৷ তবে এছাড়া আপনাদের কোনও উপায়ও তো নেই৷ এবার আমাকে যেতে হবে৷’
সিলভার যেন মুহূর্তে আরও খানিকটা সতর্ক হলেন৷
‘না, স্যার, এভাবে আমাদের রুটিন চেক আপটা শেষ করা যাবে না৷ আমার সঙ্গে আপনাকে ব্যাঙ্কে যেতে হবে৷’
‘সে কী অদ্ভুত কথা! আমার ট্রেন ফেল হয়ে যাবে৷’
‘তা হলেও কিছু করার নেই, স্যার৷ আপনাকে আমার সঙ্গে ব্যাঙ্কে যেতে হবে৷’
পোরলকের মর্যাদাবোধ আবার উঁকি মারল৷
‘আপনি কি একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছেন না, ইন্সপেক্টর? আপনার খামখেয়ালিপনার সঙ্গে তাল মেলানোরও একটা সীমা আছে৷ আমার বেড়াতে যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে রয়েছে অথচ—’
‘কোনও উপায় নেই, স্যার৷ আমি শুধু আমার ডিউটি করছি৷ কারও বেড়াতে যাওয়ার সবকিছু ঠিকঠাক করা আছে বলে ডিউটির তো ক্ষতি করতে পারি না৷’
পোরলককে কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিচলিত বলে মনে হল৷
অবশেষে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে৷ এ এক জঘন্য বিরক্তিকর ব্যাপার, কিন্তু আপনি যদি এরকম গোঁ ধরেন তাহলে তো কিছু করার নেই—আমাকে যেতেই হবে৷’
‘ঠিক ধরেছেন, স্যার৷’ উত্তর দিলেন সিলভার, ‘ট্যাক্সিতে যেতে খুব একটা সময় লাগবে না৷’
স্টেশনের বাইরে এসে ওঁরা একটা ট্যাক্সি ধরলেন৷
ট্যাক্সিতে ওঠার ঠিক আগে পোরলক বলে উঠলেন, এক মিনিট৷ আমাকে একটু সিগারেট কিনতে হবে৷’
‘আরে, আমারও তো কিনতে হবে৷’ সিলভার বললেন৷
দশ সেকেন্ড পর পোরলক পা বাড়িয়ে ডিটেকটিভকে ল্যাং মেরে ফেলে দেবার চেষ্টা করেই ট্রাউট মাছের মতো ছিটকে পালালেন৷ কিন্তু সিলভার চটপট টাল সামলে নিয়ে তাঁকে তাড়া করলেন৷ চোর-পুলিশ খেলা চলল খুব সামান্য নয়, আর তারপর, সংক্ষিপ্ত ধস্তাধস্তির পর একটা ধাতুর বালা শক্ত করে এঁটে দেওয়া হল অভিজাত মানুষটির কবজিতে৷
‘নিশ্চিন্ত হওয়ার জন্যে এটা করলাম৷’ বললেন সিলভার, ‘এবার, যদি কিছু মনে না করেন, আমরা ব্যাঙ্কের দিকে রওনা হব৷’
যানবাহনের ভিড়ে ট্যাক্সি চলতে শুরু করতেই মিস্টার পোরলক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷
‘জুন মাসে পারীর গাছের-সারি-দেওয়া বড় রাস্তাগুলো বড় সুন্দর দেখায়৷’ তিনি বললেন৷
উত্তরে সি.আই.ডি. ইন্সপেক্টর মন্তব্য করলেন, ‘আমিও সেরকমই শুনেছি৷ শিগগিরই আমার ছুটিতে যাবার কথা৷ ভাবছি বউকে নিয়ে ওখানে ঘুরে আসব৷’
ট্র্যাফিক-বাতির নির্দেশে ট্যাক্সিটা দাঁড়িয়ে পড়ল৷
‘মনে হচ্ছে, আমার আর কখনও পারীতে যাওয়া হবে না৷’ আনমনা সুরে পোরলক বললেন৷
‘ব্যাঙ্কের ওই ট্রাঙ্কে আমি যা ভাবছি তা যদি থাকে তাহলে আর আপনার যাওয়া হচ্ছে না৷’
‘আপনার কাছে কি একটা সিগারেট হবে?’
‘সরি৷ আমি সিগারেট খাই না৷’
মিস্টার পোরলক অদ্ভুত চোখে তাঁকে দেখলেন৷
‘আপনি তাহলে গোড়া থেকেই জানতেন৷’
‘জোরদার আন্দাজ তো একটা ছিলই৷’
‘আপনার জবাব নেই, ইন্সপেক্টর৷ কেউ যে এটা ধরে ফেলবে সেটা স্বপ্নেও ভাবিনি৷ একটা নিখুঁত খুন করতে পেরেছি ভেবে আমি নিজেই নিজের পিঠ চাপড়াচ্ছিলাম৷ আপনি ব্যাপারটা ধরলেন কেমন করে?’
‘স্রেফ রুটিন৷’ মন্তব্য করলেন সিলভার৷
‘আপনি বড় বিনয়ী৷ মানতেই হয় আপনার প্রতিভা আছে৷’
‘প্রতিভা? ইয়ে, মানে, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে ওসব ব্যাপারকে আমরা খুব একটা পাত্তা দিই না, স্যার৷ শৌখিন কায়দা-কানুনের কোনও সময় আমাদের নেই৷ স্রেফ ঘাম ঝরিয়ে হাল না ছেড়ে আমরা লক্ষ্যে পৌঁছে যাই৷’
‘নিশ্চই আমি কোথাও কোনও ভুল করেছি৷ আমার কৌতূহলটা একটু মেটাবেন না?’
‘শুনলে আপনি হয়তো খুশি হবেন, স্যার, আপনি বেশ গুছিয়েও কাজ করেছিলেন৷ ক্যাভেন্ডিশকে আপনি খুন করেলন কেন? প্রথমে মোটিভ খুঁজে বের করে তারপর পেছন দিকে হেঁটে যাওয়াটাই আমাদের তদন্তের ঢঙ, কিন্তু এক্ষেত্রে—’
‘মোটিভ ছিল আমার একটা গোপন ব্যাপার, ইন্সপেক্টর৷ ক্যাভেন্ডিশনই ছিলেন একমাত্র লোক যিনি হঠাৎ করে ব্যাপারটার আঁচ পেয়ে যেতে পারতেন, আর তার ফল হিসেবে আমাকে লম্বা সময়ের জন্যে জেলে যেতে হত৷ উনি যে সত্যি সত্যি ব্যাপারটা সন্দেহ করেছিলেন তা নয়, তবে বিপদের ভয় ছিল৷ ওঁকে পথ থেকে সরাতে পারলেই আমি নিশ্চিন্ত৷ নেহাত আপনি গোঁ না ধরলে উনি ওই বন্ধ ট্রাঙ্কে বন্দি হয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্যে নিজেরই ব্যাঙ্কের স্ট্রং-রুমে পড়ে থাকতেন৷ স্ট্রং-রুমে রেখে যাওয়া জিনিস নিয়ে ব্যাঙ্ক কখনও মাথা ঘামায় না৷ মিস্টার ক্যাভেন্ডিশ নিজেই আমাকে এই আইডিয়াটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন৷ মাস ছয়েক পর যখন ব্যাপারটা সবাই প্রায় ভুলে যেত, তখন ট্রাঙ্কটা বের করে পাকাপাকি বন্দোবস্ত করব ভেবেছিলাম৷ আমার কাছে প্ল্যানটা নিখুঁত মনে হয়েছিল, আমার ভুলটা কোথায় হয়েছিল বলুন তো?’
গতানুগতিক গলায় সিলভার বললেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, আমার মনে হয় না আাপনার কোথাও ভুল হয়েছে—মানে, আপনার ছক অনুযায়ী কোথাও ভুল হয়নি৷’
‘আপনি যখন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসেন তখনও আমার ব্যবহার খুব স্বাভাবিক ছিল৷’
‘খুবই স্বাভাবিক৷ আপনি যে ব্যাপারটায় পার পেয়ে যাননি সেটা নিতান্তই একটা তাজ্জ্বব কাণ্ড৷ ওই যে, আমি বলছিলাম না, আমরা কিছুতেই হাল ছাড়ি না৷ তারপর, আজ হোক আর কাল হোক, তুচ্ছ বিচিত্র কোনও সূত্র আমাদের হাতে এসে যায়৷ তা থেকে শেষ পর্যন্ত হয়তো কিছুই পাওয়া যাবে না, তবু আমরা সেটার শেষ না দেখে ছাড়ি না৷’
‘কোন তুচ্ছ বিচিত্র সূ্র আমার সর্বনাশ ডেকে নিয়ে এল জানতে পারি?’
‘প্রথমে তো আপনি মিস্টার ক্যাভেন্ডিশকে আপনার ফ্ল্যাটে নিয়ে গিয়ে এক গ্লাস পুরনো নেপোলিয়ন ব্র্যান্ডি খাওয়ালেন৷ তারপর, যখন তিনি সেই ব্র্যান্ডি চেখে দেখছিলেন—মনে রাখবেন, এটা নিতান্তই আমার অনুমান—তখন আপনি তাঁর মাথায় এক ঘা কষিয়ে দিলেন৷’
‘না, আপনার অনুমান এতটুকু ভুল নেই৷’
‘যাই হোক, এটাই আমার কাছে সম্ভব বলে মনে হয়েছিল৷ তারপর আপনি ওঁকে খতম করে ঢুকিয়ে দেন ট্রাঙ্কের মধ্যে৷ এই ট্রাঙ্কটা আগে আপনি বহুবার ওই ব্যাঙ্কের স্ট্রং-রুমে জমা দিয়েছিলেন৷ সুতরাং সেখানকার কেরাণীরা নেহাত অভ্যাসবশেই ওটা নিয়ে নেবে৷’
‘কেন নেবে না, বলুন?’
‘অবশ্যই৷ আপনি তো জানেন আপনাদের ফ্ল্যাট-বাড়িতে একজন রাতের দারোয়ান ডিউটিতে ছিল৷ সে আপনাকে আর মিস্টার ক্যাভেন্ডিশকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে৷ সুতরাং আপনার মনে হয়েছিল, মিলিগান—মানে, ওই দারোয়ান—যদি মিস্টার ক্যাভেন্ডিশকে আবার বাড়ি থকে বেরিয়ে যেতে দ্যাখে তাহলে আপনি ডবল নিশ্চিন্ত হবেন৷’
‘বলে যান, শুনছি৷’
‘আপনার আর মিস্টার ক্যাভেন্ডিশের চেহারা অনেকটা একইরকম৷ আপনাদের হাইট প্রায় সমান, আর মুখেও মিল ছিল কিছুটা৷ শুধু তফাতের মধ্যে ওঁর গোঁফ ছিল আর আপনার মুখ দাড়ি-গোঁফহীন পরিষ্কার৷ তাছাড়া ওঁর চোখে ছিল সোনালী ফ্রেমের চশমা, আপনার ছিল না৷ আগে থেকে তৈরি করে রাখা একটা নকল গোঁফ আপনি নাকের নীচে বসিয়ে নিলেন, ওঁর চশমাটা চোখে লাগিয়ে নিলেন, আর ভুরুজোড়া ওঁর মতোই ঘন করে নিলেন৷ আপনি ভেবেছিলেন, লিফটের কলিং বেল টিপলে মিলিগান লিফট নিয়ে ওপরে আসবে৷ ছদ্মবেশে ওর সঙ্গে লিফটে করে নামাটা যথেষ্ট ঝুঁকির ব্যাপার হবে৷ তাই মিস্টার ক্যাভেন্ডিশের হ্যাট-কোট পরে ওঁর ছদ্মবেশে সোজা সিঁড়ি নেমে আপনি বেরিয়ে এলেন রাস্তায়৷’
‘একদম ঠিক বলেছেন৷’ মিস্টার পোরলক মন্তব্য করলেন, ‘আমার ধারণা, ছদ্মবেশটা কাজে দিয়েছিল৷ পরে আমি ক্যাভেন্ডিশের ওভারকোটের পকেটে কয়েকটা পাথরের টুকরোসমেত টুপিটা ঢুকিয়ে দিয়ে টেমস নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলাম—ভেবেছিলাম ওটা ডুবে যাবে৷’
‘হয়তো আপনি ঠিকই ভেবেছিলেন৷’ সিলভার সায় দিলেন৷
‘আমি ভোর চারটের সময় ফ্ল্যাটে ফিরে আসি৷ জানতাম, তখন ওই রাতের দারোয়ান রোজকার মতো চেয়ারে বসে ঝিমোবে৷ আমি ঠিক জানি, ও আমাকে তখন দেখতে পায়নি৷ আর দেখলেও বা কি—আমি প্রায়ই ওরকম দেরি করে ফিরে আসি৷’
‘না, মিস্টার পোরলক, তখন ফিরে আসার সময় মিলিগান আপনাকে দেখতে পায়নি৷’
‘তাহলে আমার পা ফসকাল কোথায় এখনো বুঝতে পারছি না৷’
‘এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷’ সি.আই.ডি. ইন্সপেক্টর মন্তব্য করলেন, ‘আমিও ব্যাপারটা ধরতে পেরেছি অনেক পরে৷ আমরা জানতাম, মিস্টার ক্যাভেন্ডিশকে শেষ জীবিত দেখেছে রাতের ওই দারোয়ান৷ সেইজন্যেই বেশ কয়েকবার ওর সঙ্গে আমি কথা বলেছি৷ শেষে ও একটা ভারি অদ্ভুত ব্যাপারের কথা বলেছে৷ এটা ও তেমন জরুরি বলে ভাবেনি৷ এমনিতে লোকটা খুঁটিয়ে সবকিছু খেয়াল করার লোক নয়৷ তবে ওর অভ্যেস হল সবসময় লোকের হাতের দিকে দেখা৷ যেমন, আমার অভ্যেস পায়ের দিকে দেখা৷ এক-একজনের এক-একরকম অভ্যেস৷ মিলিগান বলেছে, ‘মিস্টার ক্যাভেন্ডিশ’ বেরিয়ে যাওয়ার সময় ও ওঁর হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল৷ ওর মনে হয়েছিল, হাত দুটো যেন অনেকটা আপনার মতো দেখতে—লম্বা, সরু আঙুল—আর্টিস্টদের ধরনের৷ তাতে আমার মনে হল, ব্যাপারটা একটু তলিয়ে দেখা দরকার৷ খোঁজ নিয়ে জানলাম, মিস্টার ক্যাভেন্ডিশের হাত ছিল চওড়া, বেঢপ৷ ব্যস, তখন মনে হল, কিছু একটা হদিস পেয়ে গেছি৷’
‘সেটা কবে?’
‘কাল বিকেলে৷ তারপর থেকেই আমরা আপনার ওপরে কড়া নজর রেখেছি৷ আপনি ডেডবডিটা নিয়ে কী করেছেন তা আমাদের জানার কোনও উপায় ছিল না৷ ওটা যে আপনি ফ্ল্যাটেই রেখে দিয়েছেন তা ভাবিনি—যদিও আপনার ফ্ল্যাটটা সার্চ করে দেখব বলে ভাবছিলাম৷ যদি আপনি ট্রাঙ্কগুলো দিনকয়েক আগেও সরিয়ে ফেলতেন, তাহলে আমরা বোধহয় এখনও গোলকধাঁধায় ঘুরে মরতাম৷ কিন্তু আমাদের লোক আজ সকালে ওগুলো আপনার ফ্ল্যাট থেকে বের করতে দেখেছে৷ আর তারপর—তারপর বাকিটা তো ছকবাঁধা রুটিনমাফিক কাজ৷’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন