রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ

অনীশ দেব

ইয়ার্ডের খালি মালগাড়িটা চলতে শুরু করতেই হ্যানিগান একলাফে তাতে চড়ে বসল৷

সন্ধ্যার ধোঁয়াটে অন্ধকার জমাট বাধতে শুরু করেছে৷ ঠাণ্ডাটা যেন আগের চেয়েও বেড়েছে৷ হ্যানিগানের গায়ে তেলচিটে ময়লা একটা জ্যাকেট৷ তালিমারা প্যাণ্টটা চলন্ত গাড়িতে বেয়ে উঠবার সময় অনেকটা ছিঁড়ে গেছে, হাঁটুটাও ছড়ে গেছে অনেকটা৷ কিন্তু ওর সে দিকে কোনো খেয়াল নেই৷ ধপাস করে মালগাড়ির ধাতব মেঝেতে লাফিয়ে পড়তেই ঢং করে শব্দ হলো৷ মেঝেটে ধুলোয় ভর্তি—অন্ধকার৷ ওপরেই কুয়াশায় ঢাকা খোলা আকাশ৷ অবশ্য আকাশটা হ্যানিগান কুয়াশার জন্য দেখতে পাচ্ছে না৷ কিন্তু ও জানে মাথার ওপরে আকাশ থাকে, এবং এখনও রয়েছে৷ মাঝে মাঝে লাইটপোস্টের সাদা আলো ঝাপসা ভাবে গাড়িতে এসে পড়ছে৷

মেঝেতে বসে হ্যানিগান হাঁ করে হাঁফাতে লাগলো৷ জ্যাকেটের ভাঁজে ভাঁজে অনুভব করলো স্যাঁতস্যাঁতে ঘামের স্রোতে সারা শরীরে শ্রান্তির অবসাদ৷ এ সবেরই কারণ কিন্তু স্নীকি পীট৷

ট্রেন আরও জোরে চলেছে৷ লাইটপোস্টের ঝাপসা আলোগুলো যেন পরস্পর হাত মিলিয়ে তৈরী করেছে এক বিরাট শেকল৷

সব কিছু মিলিয়ে হ্যানিগান ভীষণ নিঃসঙ্গ বোধ করল৷ ও কি তা হলে ভয় পেয়েছে?

হ্যানিগান সাহস ফিরে পাওয়ার চেষ্টায় কাঁধ ঝাঁকালো৷ যত্তো সব৷ শহর ছাড়ার আগে সামান্য একটু হুইস্কি খাওয়াতে ক্ষতিটা কি হয়েছে? কিন্তু…

ওর দেহটা হঠাৎ কুঁকড়ে গেল৷ এই শীতে, না অন্য কিছুতে? শির শির করে উঠল দেহের সমস্ত স্নায়ু৷ ও কেঁপে উঠল থর থর করে৷

সত্যকে আর অস্বীকার করার চেষ্টা করল না হ্যানিগান৷ শহর ছাড়ার আগে জেরির বারে গিয়ে ও প্রাণভরে মদ গিলেছে৷ আনন্দে? উঁহু৷ ভয়ে…হ্যাঁ ভয়ে! তাই হ্যানিগান এখন পালাচ্ছে৷ পালাচ্ছে প্রাণভয়ে৷

যে শহরে হ্যানিগান ছিল, তাঁর নাম ‘নাইফভিল’৷ শহরের আসল নামটি কি তা ওর মনে নেই৷ ‘নাইফভিল’ হিসেবেই নামটা মনে রাখা হ্যানিগানের পক্ষে সহজ৷ কারণ স্মীকি পীটের আরেক নাম ‘নাইফ’—ছুরি—মৃত্যু৷ অতএব যে শহরে পীট রয়েছে, তার নাম ‘নাইফভিল’ ছাড়া আর কি হতে পারে! এ পৃথিবীতে স্নীকি পীট—দি নাইফ-এর মতো নৃশংস খুনে খুব বেশী নেই৷

বাইরের আলোর দিক থেকে চোখ সরিয়ে হ্যানিগান ভেতরে নিয়ে এলো ওর দৃষ্টিকে৷ চোখ পিটপিট করে দেখতে লাগল ঘষা অন্ধকারে ঢাকা কালি কামরাটাকে৷ একি?

কামরাটা খালি নয়?

হ্যানিগানের মুখোমুখি ধাতব দেওয়ালের গায়ে হাত-পা ছড়িয়ে বসে আছে একটা লোক৷ ভাবলেশহীন মুখে চেয়ে আছে হ্যানিগানের দিকে৷ চোখের মণি দুটো যেন কাচের মার্বেল—একেবারে স্থিরভাবে চেয়ে আছে৷ হ্যানিগান বুঝলো, লোকটা প্রথম থেকেই ওখানে বসেছিলো৷ ওকে দেখছিলো৷ এখন হ্যানিগান ওকে দেখতে লাগলো৷ বাইরের বিবর্ণ আবছা আলোয় ও যা দেখলো তাতে লোকটা প্রৌঢ়, টাক মাথা, গায়ে ময়লা ছেড়া পোশাক৷ দেহের কাঠামো দৃঢ়, চোখ দুটো রুই মাছের মতো৷

কামরার চারপাশে আর একবার চোখ বোলালো হ্যানিগান৷ তাল তাল অন্ধকার যেন অন্ধকারের পটভূমিতে নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে৷ ও ভয়ে ভয়ে সহযাত্রীর দিকে চোখ ফেরালো৷ ভালো করে দেখলো৷ না এ—‘নাইফ’ নয়৷ পীটের চেহারার সঙ্গে এ লোকটার কোনো মিলই নেই৷ অবশ্য প্রথম নজরেই হ্যানিগান সেটা বুঝতে পেরেছে, তবু আর একবার যাচাই করে নিলো৷

‘ওফ, তোমাকে দেখে যা ভয় পেয়েছিলাম!’ বিড় বিড় করলো হ্যানিগান৷ কিন্তু ট্রেনটা হঠাৎ একটা কালভার্টে উঠে পড়ায়, তার গমগম শব্দে সহযাত্রীটি উত্তর চাপা পড়ে গেলো৷ কিন্তু তার চোখ জোড়া হ্যানিগানের মুখের ওপর স্থির হয়ে রইল৷

‘দক্ষিণ দিকে যাচ্ছ বুঝি?’

সহযাত্রী যেন ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালো৷

‘আমিও ওদিকেই যাচ্ছি৷’ জামার হাতা দিয়ে মুখের ঘাম মুছলো হ্যানিগান৷ ও যেন স্মীকি পীটের অস্তিত্ব এখানেও অনুভব করছে৷ পীটের উপস্থিতি হ্যানিগানের সাহসের পলকা প্রাচীর যেন ভেঙে চুরমার করে গুড়িয়ে দেবে৷ ‘ওখানে গিয়ে কি করব এখনও কিছু ঠিক করি নি৷ শহর ছেড়ে বেরিয়ে তো পড়লাম, তারপর কি হয় না হয় দেখা যাবে৷’

‘শহর ছেড়ে’ কথাটা হ্যানিগানকে আশ্বাস দিলো৷ কথাটা বলতে পেরে ওর খুব ভালো লাগলো৷

ট্রেন শহরের সীমানা ছাড়িয়ে এবার এসে পড়েছে গ্রামের আওতায়৷ অন্ধকার…অন্ধকার…অন্ধকার৷ হ্যানিগানের কাছে নিজের উপস্থিতিও হয়ে উঠলে স্পর্শসাপেক্ষ৷ কিন্তু ও বুঝলো, ওর সহযাত্রী একই ভাবে একই জায়গায় বসে আছে! কারণ মালগাড়ির ঘটাং-ঘটাং শব্দের সঙ্গে সঙ্গে কানে আসছে ভারী শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ৷’

লোকটাকে দেখা গেল কি না দেখা গেলো, তাতে হ্যানিগানের কিছু যায় আসে না৷ ও যে একজন সঙ্গী পেয়েছে, তাই যথেষ্ট৷ আর একটি মানুষের নিঃশ্বাস প্রতিমুহূর্তেই ওকে আশ্বাস দিয়ে চলেছে : হ্যানিগান একা নয়—সঙ্গে আছে ওর টেকো সহযাত্রী৷ তাছাড়া কথা বলেও কিছুটা ভয় তাড়ানো যাবে৷ ভয়? না, না—হ্যানিগান তো ভয় পায় নি৷

‘আমি যে জন্যে পালাচ্ছি, তুমিও বোধহয় সেই জন্যেই পালাচ্ছ?’ সহযাত্রীর গলায় স্বরটা যেন অদ্ভুত ঠেকলো৷ অনেকটা যেন স্মীকি পীটের মতো৷ কিন্তু…

‘ও, তুমি তাহলে ‘নাইফ’-এর কথা শুনছো?’ নিজের মতোই হতভাগ্য, ‘নাইফ’-এর ভয়ে ভীত, আরেকজনকে পেয়ে হ্যানিগান ভীষণ খুশি হলো, ‘লোকটা একটা পাগল খুনে৷’

ওর প্রশ্নের উত্তরে লোকটা ঘাড় নাড়লো৷ একটা খামারের আলো এক মুহূর্তের জন্য আবছাভাবে কামরায় এসে পড়ায় হ্যানিগান লোকটাকে দেখতে পেল৷ ও তখনও একইভাবে বসে আছে৷ এ ব্যাটাও হয়তো আমার মতোই ‘নাইফ’-এর ভয়ে একগাদা মাল টেনেছে৷ ভাবল হ্যানিগান৷ সে হোক গে, আমার কথাগুলো অন্ততঃ শুনতে তো পাবে৷

‘বিশ্রী ব্যাপার, বুঝলে ভাই৷ গত এক সপ্তাহে ঐ হতচ্ছাড়া পীট চার চারটে লোককে খতম করেছে৷ কাগজ বেরিয়েছে, দেখো নি? পিছন দিক থেকে কেউ তাদের ছুরি মেরেছে৷ এক ডাক্তার বলেছে, এটা কোনো পাগলের কাজ৷ আমার সঙ্গীরা সবতো গতকালই শহর ছেড়ে পালিয়েছে৷ আমি পালাতাম না, কিন্তু—’

হ্যানিগান হঠাৎ থামলো৷ সহযাত্রী একেবারে নীরব৷ কিন্তু কানে আসছে ভারী নিঃশ্বাসের স্পষ্ট শব্দ৷ লোকটা মাল টেনে ঘুমিয়েই পড়লো না কি?

‘কি দোস্ত, খুব টেনেছো মনে হচ্ছে?’ দাঁত বের করে হাসলো হ্যানিগান! ঠাট্টার সুরে বলে চললো, ‘আরে ভায়া আমিও টেনেছি: তবে তোমার মতো আউট হয়ে যাই নি…যাকগে, যা বলছিলাম: আমি কিন্তু পালাতাম না—যদি না আজ বিকেলে ‘নাইফ’-এর দেখা পেতাম৷’

বাইরের একঝলক আলো কামরায় ঠিকরে পড়তেই হ্যানিগান দেখল, লোকটি যেন ঘাড় নাড়লো৷ ব্যাটা অবিশ্বাস করছে নাকি হ্যানিগানের কথা?

‘মাইরি বলছি! —জেরির বার-টা চেনো তো? ঐ যে বড় রাস্তার ধারে—তা আজ বিকেলে বার থেকে বেড়োতেই হঠাৎ জিং শব্দ তুলে কানের পাশ দিয়ে কি একটা বেরিয়ে গেলো৷ চমকে ফিরে তাকিয়ে রাস্তায় কাউকে দেখলাম না৷ কিন্তু সামনে চেয়ে দেখি—দেখি—(হ্যানিগানের গলাটা শুকিয়ে আসছে কেন?) একটা সরু লম্বা চকচকে ছুরি৷ আমার মাথা থেকে ঠিক তিন ইঞ্চি দূরে একটা কাঠের থামে বিঁধে আছে৷ ছুরির বাঁটটা থর থর করে কাঁপছে!

‘ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আবার বারে ঢুকে পড়লাম৷ বোতলের পর বোতল হুইস্কি গিলে চললাম৷ তারপর সন্ধ্যের অন্ধকারে টুক করে গাড়িতে উঠে পড়েছি—উফ!’ হাঁফ ছাড়লো হ্যানিগান, কিন্তু সেই সঙ্গে শিউরে উঠলো৷ কেন, কে জানে? ‘এখন শুধু পালাতে পারলেই বাঁচি৷’

এবার অধৈর্য হয়ে হ্যানিমান সামনে ঝুঁকে পড়লো, অন্ধকারকে লক্ষ্য করেই বললো, ‘কি হে তুমি বোবা নাকি?’ লোকটাকে দেখবার ব্যর্থ চেষ্টা করলো ও৷ একা একা কতক্ষণই বা কথা বলা যায়! নিঃসঙ্গ বোধটা কি আবার ফিরে আসছে?

হাতে পায়ে হামাগুড়ি দিয়ে হ্যানিগান ওর সহযাত্রীর কাছে এগোতে চাইলো৷ উঁচু নীচু ঢালু জমিতে ট্রেনটা ভীষণ দুলছে৷ ঘটাং-ঘটাং শব্দের কোনো বিরতি নেই৷

‘কি হলো, একেবারে চুপ মেরে বসে গেলে যে? সব শুনে তোমার কি মনে হয়?’ হ্যানিগান বেশ বুঝলো, প্রশ্নটা ও নিজেকেই করছে? ওর সহযাত্রী কোনো সাড়া দেবে না৷ এবং সত্যিই কোনো উত্তর এলো না ওর সহযাত্রীর কাছ থেকে৷’ ‘আচ্ছা, তুমিই বলো, এমন পাগল ও আছে, যে বিনা কারণে মানুষ ধরে আর খুন করে৷’

সব চুপ৷ শুধু সেই ভারী শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ৷

হ্যানিগান আরো একটু এগোতেই ট্রেনটা একটা ভীষণ ঝাঁকুনি খেলো৷

কোথা থেকে একফালি আলো এসে পড়লো কামরায়৷ হ্যানিগানের সহযাত্রী হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে সামনে গড়িয়ে পড়লো৷

হ্যানিগান দেখলো, লোকটার পিঠ ভর্তি জমাট রক্ত, একটা বিশ্রী গর্ত যেন হাঁ করে চেয়ে আছে৷ বাইরের ঝাপসা আলো রক্তাক্ত ছুরিটার গায়ে পড়ে ঠিকরে পড়ছে৷ ছুরিটা বিধে আছে ওর সহযাত্রীর পিঠে৷

লোকটা মরা৷ হ্যানিগান শিউরে উঠে পিছিয়ে এলো, এক মুহূর্ত থামলো৷ ‘কিন্তু—কিন্তু এ অসম্ভব! আমি পরিষ্কার শুনেছি ওর নিঃশব্দের শব্দ!’ প্রায় চিৎকার করে উঠলো৷

হঠাৎ হ্যানিগানের খেয়াল হল, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটা তখনও ওর কানে আসছে৷ কিন্তু সামনে থেকে নয়, এবার শব্দটা আসছে হ্যানিগনের ঠিক পেছন থেকে৷ যেন খুব কাছে…

ট্রেনটা ঝড়ের গতিতে একটা অন্ধকার টানেলে ঢুকে পড়লো৷ গম্ গম্ শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়৷ অন্ধকারে হ্যানিগানের চোখ অকেজো এবং ট্রেনের বিশ্রী শব্দে ওর কানও অসাড়৷ সুতরাং এবার আর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দটাও শুনতে পেলো না৷ শুধু অনুভব করলো—ঠিক ওর ঘাড়ের ওপর…একটা উত্তর নিশ্বাস…সেই সঙ্গে হ্যানিগানের কেমন যেন শীত শীত করে উঠলো…

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন