মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স

অনীশ দেব

‘না,’ বিষণ্ণ্ হেসে জ্যাকসন বলল, ‘দুঃখিত৷ আমি তোমাদের খেলা নষ্ট করতে চাই না৷ শুধু শুধু না খেলে আর লাভ কি? কারণ আমাকে বাদি দিয়েও তোমাদের অনেক লোক থাকবে খেলবার জন্যে, কিন্তু লুকোচুরি আমি মরে গেলেও খেলব না৷’

সময়টা বড়দিনের আগের রাত, তারুণ্যের যথাযথ উচ্ছ্বাস নিয়ে আমরা চোদ্দজনের দল উপস্থিত৷ রাতের খাওয়া-দাওয়া বেশ ভালোই হয়েছে, এখন ছেলেমানুষী খেলার মরসুম, আর আমাদের মেজাজও সে সব খেলা খেলতে কোমর বেঁধে তৈরি৷ রাজি আমাদের সবাই, শুধু জ্যাকসন বাদে৷ যখন কেউ এমন লুকোচুরি খেলার কথা প্রস্তাব করল, তখন একবাক্যে সকলেই হই-হই করে সমর্থন জানিয়েছে৷ একমাত্র তার কথাতেই ভিন্ন সুর বেজে উঠেছে৷

খেলাধুলো বা হুল্লোড় ভণ্ডুল করে দেওয়াটা জ্যাকসনের স্বভাব নয়৷ কে একজন জিগ্যেস করল, তার শরীর খারাপ লাগছে কিনা৷

‘না, শরীর ঠিক আছে৷ তবে—’ ছোট্ট হাসি হেসে তার সরাসরি প্রত্যাখ্যানকে সামান্য মোলায়েম করল জ্যাকসন, ‘লুকোচুরি খেলার মধ্যে আমি নেই৷’

একজন জিগ্যেস করল, কেন৷ উত্তর দেবার আগে একটু ইতস্তত করল সে৷

‘মাঝে মাঝে একজনের বাড়িতে আমি বেড়াতে যাই, গিয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে আসি৷ সেই বাড়িতে অন্ধকারে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে একবার একটি মেয়ে মারা যায়৷ মেয়েটা বাড়ির আনাচ-কানাচ ভালো করে চিনত না৷ সেখানে চাকর-বাকরদের যাতায়াতের জন্য দরজা দেওয়া একটা সিঁড়ি ছিল৷ ফলে ওকে কেউ তাড়া করতেই ও দরজাটা খুলে একলাফে ভেতরে ঢুকে পড়ে এই ভেবে, যে এটা কোন শোবার ঘর-টর হবে, এবং সিঁড়ির নীচে পড়ে গিয়ে ঘাড় মটকে মেয়েটা মারা যায়৷’

আমাদের চোখে মুখে কৌতূহলের ছায়া নেমে এল৷ মিসেস ফার্ণলি বলে উঠলেন, ‘কী সাংঘাতিক! যখন এটা হয় তখন আপনি সেখানে ছিলেন?’

অত্যন্ত গম্ভীর ভাবে মাথা নাড়ল জ্যাকসন৷

‘না’, সে বলল, ‘তবে অন্য একটা ঘটনার সময় আমি সেখানে ছিলাম৷ সেটা আরো সাংঘাতিক৷’ কথা শেষ করতে গিয়ে স্পষ্ট শিউরে উঠল সে৷ তারপরই জ্যাকসন প্রসঙ্গের পরিবর্তন করল, ‘জানি না, তোমাদের কেউ কখনও ‘‘মি’’ নামে একটা খেলা খেলেছ কিনা৷ এটা সাদামাটা লুকোচুরি খেলার এক চমৎকার উন্নত বুদ্ধিদীপ্ত রূপ৷ খেলাটার নাম তৈরি হয়েছে ‘‘আমি’’ শব্দটার সংক্ষিপ্ত চেহারা থেকে—‘‘মি’’৷ লুকোচুরি জাতীয় খেলা খেলতে গেলে এই খেলাই ভালো৷ এসো, তোমাদের নিয়ম কানুনগুলো বলে দিই—’

‘প্রত্যেক খেলোয়াড়কে প্রথমে একটা করে ছোট্ট কাগজের চিরকুট দেওয়া হবে৷ তার মধ্যে একটা কাগজ ছাড়া বাকি সবগুলোই সাদা৷ এবং সেই একটা কাগজে ‘‘মি’’ শব্দটা লেখা আছে৷ এই কাগজটা যে পাবে, সে-ই হল ‘‘মি’’—এবং ‘‘মি’’ যে কে হল, সেটা ‘‘মি’’ নিজে ছাড়া আর কেউ জানতে পারবে না৷ এবার সমস্ত আলো নিভিয়ে দেওয়া হবে, তারপর ‘‘মি’’ চুপিচুপি ঘর থেকে সরে পড়বে কোথাও লুকিয়ে পড়ার জন্যে৷ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বাকি খেলোয়াড়রা বেরিয়ে পড়বে তার খোঁজে, কিন্তু সত্যি সত্যি যে তারা কাকে খুঁজছে, তা তারা নিজেরাই জানে না৷ একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে আর একজনের দেখা হলেই সে ‘‘মি’’ শব্দটা চেঁচিয়ে বলে তাকে চ্যালেঞ্জ করবে, এবং তখন অন্য খেলোয়াড়টি, যদি সে সত্যিই ‘‘মি’’ না হয় তাহলে ‘‘মি’’ বলেই উত্তর দেবে৷

‘আসল ‘‘মি’’ কিন্তু এভাবে চ্যালেঞ্জ করলে কোন উত্তর দেবে না৷ চুপ করে থাকবে৷ তখন দ্বিতীয় খেলোয়াড়টি ‘‘মি’’-এর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়বে৷ এবার ওদের দুজনকে আবিষ্কার করবে কোন তৃতীয় খেলোয়াড়, চ্যালেঞ্জ করবে, এবং কোন উত্তর না পেয়ে চুপচাপ ওদের পাশে দাঁড়িয়ে পড়বে৷ এই ভাবে খেলোয়াড়দের সারি ক্রমশ লম্বা হবে, এবং সবচেয়ে শেষে যে এসে হাজির হবে তাকে যা হোক কিছু খেসারত দিতে হবে৷ এ এক হই-চই করা প্রচণ্ড হুল্লোড়ের খেলা৷ তোমার খেলে দেখতে পারো—’

আমি মন্তব্য করলাম যে খেলাটা খুব চমৎকার, এবং জানতে চাইলাম, জ্যাকসন নিজে কখনও এ খেলা খেলেছে কি না৷

‘হ্যাঁ, খেলেছি’৷ সে উত্তর দিল, ‘যে বাড়িটার কথা বলছিলাম, সেই বাড়িতে৷’

‘আর ওই মেয়েটা সেখানে ছিল? ওই যে, যে মেয়েটা ঘাড় মটকে—’

জ্যাকসন কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল৷

‘জানি না, মেয়েটা সেখানে ছিল কি ছিল না৷ হয়তো ছিল৷ কারণ আমি জানি সেদিন আমরা মোট তেরোজন ছিলাম, যেখানে মাত্র বারোজন থাকার কথা৷ শপথ করে বলতে পারি, ওর নাম আমি জানতাম না, নইলে অন্ধকারে ওই ফিসফিসে কণ্ঠস্বর শোনার পর আমি নিশ্চয়ই পাগল হয়ে যেতাম৷ না, ও খেলা আমি কিছুতেই আর খেলছি না…’

আমাদের আমন্ত্রক, টিম ভাউস, চারপাশে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসল৷ যে হাসির অর্থ খুব ধীরে এক চোখ টিপে আরও নোংরা ভাবে প্রকাশ করা যায়৷

‘নাও, গল্প শোনার জন্যে তৈরি হও,’ সে ঘোষণা করল৷

‘গল্প সত্যিই একটা আছে, তবে সেটা শোনাব কি শোনাব না নির্ভর করছে…’

কথা থামিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল জ্যাকসন৷

‘না, খেলার জন্য খেসারত তো তোমাকে এমনিতেই দিতে হবে, ‘টিম বলল, ‘সুতরাং আগেভাগেই সেটা দিয়ে দাও৷ তোমাকে এখানে এই মুহূর্তে সেই গল্পটা শোনানোর দণ্ড দেওয়া হল৷’

শুরু হল জ্যাকসনের গল্প…

তোমাদের কারো কারো হয়তো স্যাংস্টনদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে৷ মানে, ক্রিস্টোফার স্যাংস্টন ও তার স্ত্রী৷ ওরা আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হয়, অন্তত ভায়োলেট স্যাংস্টন তো বটেই৷ বছর আষ্টেক আগে উত্তর ও দক্ষিণ ডাউন্স-এর মাঝামাঝি, সারে ও সাসেক্স-এর সীমান্তের ওরা একটা বাড়ি কেনে, এবং পাঁচ বছর আগে আমাকে নেমন্তন্ন করেছিল ওদের সঙ্গে থেকে বড়দিনটা কাটিয়ে আসার জন্যে৷

বাড়িটা বেশ পুরোনো, কোন্ যুগের তা সঠিক বলতে পারব না, এবং ‘এলোমেলা’ এই বিশেষণটা সেটার চরিত্রে স্পষ্ট খাপ খেয়ে যায়৷ বাড়িটা যে খুব বড় ছিল তা নয়, কিন্তু ওটার যে মূল নির্মাতা সে জায়গা বাঁচানোর দিকে মনোযোগ দেয়নি, প্রথম প্রথম যে কেউই চট করে সেখানে পথ হারিয়ে ফেলবে৷

যাই হোক, বড়দিন তো কাটাতে গেলাম৷ ভায়োলেট চিঠিতে আশ্বাস দিয়েছিল যে আমন্ত্রিত অন্যান্য অতিথিদের প্রায় সকলেই আমার পরিচিত, আর যে দু-একজন নতুন, তারা এক কথায় ‘দারুণ’৷ অন্যান্য সকলে দু-দিন আগে পৌঁছলেও দুর্ভাগ্যবশত কাজের চাপে আমি পৌঁছলাম একদিনে দেরিতে—বড়দিনের আগের দিন প্রায় নৈশভোজের সময়ে৷ সকলে তখন পোশাক-আশাক পরতে ব্যস্ত৷ সুতরাং আমি সোজা চলে গেলাম নিজের ঘরে তৈরি হয়ে নিতে৷ শত তাড়াতাড়ি সত্ত্বেও আমি নেমে এলাম সবার শেষে, সকলে তখন আমার জন্যেই অপেক্ষা করছে৷ বসবার ঘরে পা রাখা মাত্রই নৈশভোজ ঘোষণা করা হল৷ কোন রকমে তাড়াহুড়ো করে পরিচিত সকলের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের কাজটুকু সেরে নিলাম, এবং অপরিচিত দু-তিনজনের সঙ্গে পরিচয়ের পালা শেষ করলাম৷ তারপর আমার হাত এগিয়ে দিতে হল মিসেস গরম্যানের দিকে৷

এত কথা বলার কারণ একটাই ঃ ওই ব্যস্ততার মধ্যে নতুন আলাপ হওয়া একটি দীর্ঘাঙ্গী তামাটে চেহারার সুন্দরী মেয়ের নাম আমি ঠিক খেলায় করতে পারিনি৷ সব কিছুই যেন তাড়াহুড়ো করে হতে লাগল, আর আমি ববরাবরই লোকের নাম-ধাম মনে রাখার ব্যাপারে দারুণ পণ্ডিত৷ মেয়েটির অভিব্যক্তি শীতল, চতুর, যেন সাবধান করে দিচ্ছে৷ যে সব মেয়েদের দেখে মনে হয় পুরুষ সম্পর্কে সব জানে, এ মেয়ে সেই জাতের, এবং সেই কারণেই পুরুষরা ওদের চোখে অপ্রিয়৷ কিন্তু মেয়েটিকে দেখে বেশ আগ্রহই জাগে, এবং আমারও যে কৌতূূহল হল না তা নয়৷ কে মেয়েটি? কাউকে সেকথা জিগ্যেস করলাম না কারণ আমি নিশ্চিত ছিলাম, খুব শিগগিরই কেউ না কেউ ওকে নাম ধরে ডাকবে৷

দুর্ভাগ্যবশত ওর কাছ থেকে অনেকটা দূরেই আমাকে টেবিলে বসতে হল, এবং যেহেতু মিসেস গরম্যান সে রাতে চমৎকার খোশমেজাজে ছিলেন সেহেতু মেয়েটির পরিচয় নিয়ে দুশ্চিন্তা খুব শিগগিরই আমি ভুলে গেলাম৷

স্যাংস্টনদের নিয়ে আমরা মোট বারোজন ছিলাম৷ আমাদের সকলেই তরুণ, অথবা তরুণ হতে চেষ্টা করছি৷ দলের মধ্যে স্যাংস্টনরাই বয়েসে সবার বড়, এবং ওদের কলেজে পড়া ছেলে রেগিই হয়তো সবচেয়ে ছোট৷ খাওয়া-দাওয়ার পর খেলার কথা উঠতে রেগিই ‘মি’ খেলার প্রস্তাব দিল৷ আমি যেমন তোমাদের বললাম, সেভাবে ও খেলার নিয়ম-কানুনগুলো আমাদের শিখিয়ে দিল৷

ব্যাপারটা আমারা সবাই বুঝে নিতেই ওর বাবা ফোড়ন কাটল, ‘এ সব খেলা খেলতে গেলে দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মাঝামাঝি যে দরজাটা আছে ওটা সম্পর্কে সাবধান থেক৷ বহুদিনই ভেবেছি দরজাটা খুলে নেব, কিন্তু হয়ে ওঠেনি৷ জানা না থাকলে অন্ধকারে মনে হতে পারে যে ওটা কোন ঘরের ঢোকার দরজা৷ কিন্তু আসলে ওখানে রয়েছে চাকর-বাকরদের যাতায়াতের একটা খাড়া সিঁড়ি৷ বছর দশেক আগে একটা মেয়ে সত্যি সত্যিই ওখান থেকে পড়ে ঘাড় মটকে মারা গিয়েছিল তখন এইন্সটিরা এ বাড়িতে থাকত৷

আমি জানতে চাইলাম দুর্ঘটনাটা কী ভাবে ঘটেছিল৷ উত্তরে স্যাংস্টন বলল যে এক বড়দিনের উৎসবে লুকোচুরি খেলার সময় দৌড়ে লুকোতে গিয়ে মেয়েটা সোজা নিচে পড়ে যায়৷ সবাই যখন ওকে তুলে নিয়ে আসে তখন ও মারা গেছে৷ আমরা নিজেদের ভালোর জন্যেই কথা দিলাম যে আমরা খুব সাবধান থাকব৷

সুতরাং নৈশভোজের পালা শেষ হতেই আমাদের খেলা শুরু হল৷ রেগি স্যাংস্টন চারদিকে ঘুরে ফিরে নিশ্চিত হয়ে নিল যে চাকর-বাকরদের ঘর ও আমাদের জমায়েত হওয়া বসবার ঘরটা ছাড়া সারা বাড়ির প্রতিটি আলোই নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ কাগজের টুকরো নিয়ে ছোট ছোট বারোটা পুরিয়া তৈরি করে দু-হাতের মুঠোয় সেগুলো ঝাঁকিয়ে নিল রেগি৷ তারপর একটা একটা করে তুলে দিল প্রত্যেকের হাতে৷ এর মধ্যে এগারোটা কাগজই সাদা, এবং বারো নম্বর কাগজে ‘‘মি’’ কথাটা লেখা রয়েছে৷ এই লেখা কাগজটা যে পাবে তাকেই লুকোতে হবে৷ অতএব আমরা সেই কাগজের পুরিয়া নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম৷ আমার কাগজটা খুলে দেখি সেটা সাদা৷ কয়েক মুহূর্ত পরেই ঘরের সবক’টা আলো নিভে গেল এবং টের পেলাম অন্ধকারে কেউ একজন চুপিসাড়ে উঠে দরজার দিকে এগিয়ে চলেছে৷

মিনিটখানেক পরে একজন সংকেত করতেই আমরা ছুট লাগালাম দরজা লক্ষ্য করে৷ কে যে ‘‘মি’’ হয়েছে তা আমি অন্তত ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি৷ পাঁচ-দশ মিনিট ধরে আমরা ঘরে, বারান্দায়, সিঁড়িতে, দিশেহারা ভাবে শুধু ছুটোছুটি করে বেড়ালাম, আর একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করছি ও উত্তর দিচ্ছি, ‘মি?—মি!’

একটু পরেই গোলমাল হুটোপুটি কমে এল এবং মনে হল, ‘‘মি’’-কে হয়তো খুঁজে পাওয়া গেছে৷ অবশেষে একসারি খেলোয়াড়কে খুঁজে পেলাম৷ চিলেকোঠায় যাবার একটা সরু সিঁড়ির ওপরে ওরা দম বন্ধ করে স্থির হয়ে বসে আছে৷ চ্যালঞ্জ করে নীরব উত্তর পেয়ে আমিও ঝটপট ওদের দলে যোগ দিয়ে ফেললাম, এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরও দুজন দলছুট খেলোয়াড় এসে হাজির হল, শেষ খেলোয়াড় হওয়ার ভয়ে একে অপরকে দৌড়ে হারাবার চেষ্টা করছে৷ দুজনের একজন স্যাংস্টন, এবং স্বাভাবিক ভাবেই সে শেষ খেলোয়াড় হয়ে খেসারতের খাতায় নাম লেখাল৷ একটু পরেই সে চাপা গলায় মন্তব্য করল, ‘আমরা সবাই তো এসে গেছি, তাই না?’

স্যাংস্টন একটা দেশলাই জ্বালল, তাকাল সিঁড়ি বরাবর ওপর দিকে, এবং গুণতে শুরু করল৷ গুণতে খুব একটা অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, কারণ সিঁড়ির ধাপগুলো এক একজন দখল করলেও আমরা একটা কিংবা দুটো ধাপ ছেড়ে বসেছিলাম, ফলে আমাদের প্রত্যেকেরই মাথা দেখা যাচ্ছিল৷

‘…নয়, দশ, এগারো, বারো, তেরো,’ সে গোণা শেষ করে জোরে হেসে উঠল, ‘ধ্যুৎ, এ যে দেখছি একজন বেশি হচ্ছে!’

দেশলাইয়ের কাঠিটা নিভে যাওয়ায় সে আর একটা কাঠি জ্বালল এবং আবার গুণতে শুরু করল৷ বারো পর্যন্ত গুণে বিস্ময়ের এক অস্ফুট শব্দ করে উঠল স্যাংস্টন—‘এখানে দেখছি তেরোজন রয়েছে!’ সে অবাক হয়ে বলল, ‘এবং আমি নিজেকে এখনও গুনিনি৷’

‘যত সব বাজে ইয়ে!’ আমি হেসে বললাম, ‘তুমি নিশ্চয়ই নিজেকে দিয়ে গুণতে শুরু করেছ, আর এখন নিজেকে আবার গুণতে চাইছ৷’

স্যাংস্টনের ছেলের বৈদ্যুতিক টর্চ জ্বলে উঠল, আরও উজ্জ্বল আরও সুস্থির এই আলোতে আমরা সকলেই গুণতে শুরু করলাম৷ সত্যিই আমরা আসলে বারোজন রয়েছি৷ স্যাংস্টন উঁচু গলায় হেসে উঠল৷ বলল, ‘কিন্তু হলফ করে বলতে পারি, আমি তেরোজনই গুণেছি৷’

সিঁড়ির মাঝামাঝি জায়গা থেকে ভয়োলেট স্যাংস্টনের সামান্য সচকিত কাঁপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ‘মনে হচ্ছিল, আমার দু-ধাপ ওপরে কে যেন একজন বসে আছে৷ ক্যাপ্টেন র‌্যানসাম, আপনি কি ওপরের দিকে সরে গেছেন?’

র‌্যানসাম জানালেন যে না তিনি সরেননি৷ তিনি আরও বললেন যে তাঁরও মনে হয়েছে, তাঁর ও ভয়োলেটের মাঝে কেউ যেন বসে রয়েছে৷ এক মুহূর্তের জন্যে অস্বস্তিকর কি যেন একটা শূন্যে ভেসে রইল, একটা শীতল তরঙ্গের রেশ যেন ছুঁয়ে গেল আমাদের৷ সেই ছোট্ট একটা মুহূর্তের জন্যে মনে হল, অপ্রাকৃত অদ্ভুত কিছু একটা যেন ঘটে গেছে এবং হয়তো সেটা আবারও ঘটবে৷ তারপর আমরা দল বেঁধে সজোরে হেসে উঠলাম, স্বস্তি ফিরে পেলাম আবার৷ সত্যিই আমরা মোট বারোজন রয়েছি, এবং বারোজনই যে ছিলাম যে নিয়ে তর্কের কোন অবকাশ নেই৷ হাসতে হাসতেই আমরা সদলবলে ফিরে গেলাম বসবার ঘরে৷ নতুন করে খেলা শুরু করতে৷

এবার ‘‘মি’’ হলাম আমি, এবং ভালো কোন লুকোবার জায়গা খুঁজে বের করার আগেই ভায়োলেট স্যাংস্টন আমাকে ধরে ফেলল৷ খুব শিগগিরই সার বাঁধার পালা শেষ হল, দু-তিন মিনিটের মধ্যেই আমরা বারোজন লাইন করে দাঁড়িয়ে গেলাম৷ এরপর কিছুক্ষণের বিরতি৷ ভায়োলেট একটা চাদর আনতে বলায় ওর স্বামী দোতলায় রওনা হল চারদরটা ওর ঘর থেকে নিয়ে আসতে৷ সে যেতে না যেতেই রেগি জামার আস্তিন ধরে আমাকে টান মারল৷ তাকিয়ে দেখি ওর মুখ ছাইয়ের মতো সাদা, দেখে অসুস্থ মনে হচ্ছে৷

‘শিগগির!’ রেগি ফিসফিস করে বলল, ‘বাবা ফিরে আসার আগেই ধূমপানের ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে এক্ষুনি ব্রাণ্ডি হুইস্কি যা হোক কিছু একটা দাও!’

ঘরের বাইরে এসে আমি জানতে চাইলাম, ব্যাপারটা কি, কিন্তু সে তখুনি কোন জবাব দিল না৷ ভাবলাম, আগে কিছু খাইয়ে ওকে চাঙ্গা করি, তারপর সব জিগ্যেস করব৷ সুতরাং ব্র্যান্ডি ও সোডা মিশিয়ে দিতেই রেগি এক ঢোকে সেটা শেষ করে হাঁফাতে লাগল, যেন এইমাত্র অনেকটা দৌড়ে এসেছে৷

‘আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম,’ আমাকে লক্ষ্য করে লাজুক হেসে বলল সে৷ ‘কেন, কী ব্যাপার?’

‘জানি না৷ এইবার তো তুমি ‘‘মি’’ হয়েছিলে, তাই না? যাই হোক, কে ‘‘মি’’ সে আমি জানতাম না, এবং মা অন্যান্যদের সঙ্গে বাড়ির পশ্চিম অংশে গিয়ে যখন তোমাকে খুঁজে বের করছে, তখন আমি পুব দিকে রওনা হয়েছি৷ আমার শোবার ঘরে জামাকাপড় রাখার এক বিশাল আলমারি আছে, ভেবেছিলাম, আমার পালা এলে ওখানে লুকাব, ফলে মনে হল, ‘‘মি’’ হয়তো ওই আলমারিতেই লুকিয়েছে৷ অন্ধকারে পাল্লা খুলে হাতড়াতে শুরু করলাম৷ কারো হাত আমার হাঠে ঠেকল৷ ‘‘মি?’’ আমি ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, এবং উত্তর না পেয়ে ভাবলাম আমি হয়তো ‘‘মি’’কে খুঁজে পেয়েছি৷

‘জানি না কেন, তবে এটা সত্যি যে একটা শিউরে ওঠা অনুভূতি আমাকে আঁকড়ে ধরল৷ ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না, তবে মনে হল, কোথাও কিছু একটা গোলমাল হয়েছে৷ সুতরাং টর্চলাইট বের করে জ্বেলে ধরলাম৷ দেখি কেউ নেই! কিন্তু বিশ্বাস কর, হলফ করে বলছি, কারো হাত আমার হাতে ঠেকেছে, আর সারাক্ষং তো আমি আলমারির দরজা জুড়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাহলে আমাকে পাশ কাটিয়ে কে পারবে বাইরে বেরোতে?’ সে আবার হাঁফাতে লাগল, ‘তোমার কি মনে হয় বল তো?’ সে জিগ্যেস সকরল৷

স্বাভাবিক ভাবেই আমি বললাম, ‘সব তোমার মনের ভুল৷’

সে শব্দ করে খাটো হাসি হাসল৷ বলল,—‘তুমি তো ওই কথাই বলবে—মনের ভুল, তাছাড়া আর কি?’ একটু থেমে ঢোক গিলল রেগি, ‘মনের ভুল ছাড়া আর কি ই বা হতে পারে, কী বলো?’

আমি ওকে সমর্থন জানিয়ে আশ্বস্ত করলাম যে ঘটনাটা নিঃসন্দেহে মনের ভুল৷ তারপর আমরা যখন বসবার ঘরে ফিরে এলাম তখন আর সবাই নতুন করে খেলা শুরু করবে বলে আমাদের দুজনের জন্যেই অপেক্ষা করছে৷

ব্যাপারটা আমার কল্পনা কিনা জানি না, তবে মনে হল, ‘‘মি’’ খেলার প্রতি সব রকম আগ্রহ ও উৎসাহ যেন সবার মন থেকে মিলিয়ে গেছে৷ যদি সেই মুহূর্তে কেউ অন্য কোন খেলার প্রস্তাব দিত তাহলে বাজি রেখে বলতে পারি সকলে ‘‘মি’’ খেলার হাত থেকে রেহাই পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচত৷ শুধু আমি কেন, ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের অনুভূতি দিয়ে আরো অনেকেই হয়তো বুঝতে পারছিল এ বাড়িতে কোন অশুভ প্রভাব আছে৷ কিন্তু কেন এ রকম মনে হল? স্যাংস্টন বারোজনের জায়গায় তেরোজনকে গুণেছে বলে? নাকি তার ছেলে খালি আলমারিতে কারো হাতের ছোঁওয়া পেয়েছে বলে? না, এ সব ছাড়াও আরও কিছু একটা আছে? যাই হোক খেলা আবার শুরু হল, এবং আমরা অজ্ঞাত ‘‘মি’’কে ধাওয়া করে একই রকম হই-হুল্লোড় তুলে ছুটোছুটি আরম্ভ করলাম৷ কিন্তু মনে হল, আমাদের মধ্যে অনেকেই যেন অভিনয় করছে৷ খেলার আনন্দ কমে যাওয়ার কারণ শুধুই সেই অপ্রাকৃত অনুভূতি৷ কেন জানি না, মনে হল, সবার সঙ্গে মিশে ‘‘মি’’কে খোঁজাখুঁজির পালা শুরু করি, কিন্তু মিনিট কয়েক পরেই খেলা জেতার প্রবল ইচ্ছেয় এবং ‘‘মি’’কে খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সর্ব প্রথম হওয়ার লোভে একই দলছুট হয়ে বেরিয়ে পড়লাম৷ এবং পশ্চিম প্রান্তে দোতলায় দেওয়াল ঘেঁষে যাওয়ার সময় একজোড়া হাঁটুর সঙ্গে আমার আচমকা সংঘর্ষ হল৷

হাত বাড়াতেই একটা ভারী নরম পর্দার স্পর্শ পেলাম৷ তখন বুঝলাম, আমি কোথায় এসেছি৷ এখানে দেওয়ালে গভীর খাঁজ-কাটা লম্বা লম্বা অনেকগুলো জানালার সামনে মেঝে পর্যন্ত ঝুলছে নক্সাকাটা পর্দা৷ এই রকমই একটা জানলার তাকে পর্দার পিছনে কোণ ঘেঁষে কেউ একজন বসে রয়েছে৷ হুঁ, তাহলে ‘‘মি’’কে ধরে ফেলেছি৷ সুতরাং পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম এবং আঙুলের স্পর্শে কোন মহিলার নগ্ন বাহু অনুভব করলাম৷

বাইরের রাত অন্ধকার, এবং জানলাটা শুধু যে পর্দা দেওয়া তাই-ই নয়, ভেতরে শার্সির নীচ পর্যন্ত ঝুলছে ভেনিস দেশীয় পাখি৷ ফলে পর্দা ও জানালার মাঝের অন্ধকারে ছ’ ইঞ্চি দূরে নিজের হাত রেখেও আমি দেখতে পাচ্ছি না, কোণে বসে থাকা মহিলাকে দেখে তো দূরের কথা!

‘‘মি’’? ফিসফিস করে জিগ্যেস করলাম৷

কোন উত্তর নেই৷ ‘‘মি’’-কে চ্যালেঞ্জ করলে সে উত্তর দেয় না৷ সুতরাং ওর পাশে আমি বসে পড়লাম, দলের মধ্যে প্রথম হওয়ায় অন্যদের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম৷ নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে বললাম, ‘কে তুমি? তোমার নাম কী, ‘‘মি’’?’

আমার পাশের অন্ধকার থেকে ফিসফিসে উত্তর ভেসে এল, ‘ব্রেণ্ডা ফোর্ড’৷

নামটা আমার অচেনা, কিন্তু সেই কারণেই আরও স্পষ্ট আন্দাজ করতে পারলাম মেয়েটি কে হতে পারে৷ সেই লম্বা শীতল অভিব্যক্তির তামাটে চেহারার মেয়েটিই এ বাড়িতে একমাত্র অতিথি যার নাম আমি জানি না৷ সুতরাং আমার সঙ্গিনী ও ছাড়া আর কেউ নয়৷ ওর সম্পর্কে আমার কি রকম ধারণা হয়েছিল ও ঠিক হুল্লোড়বাজ প্রকৃতির নয়৷ ফলে চাপা গলায় দু-একটা টুকিটাকি প্রশ্ন করেও ওর কাছ থেকে কোন উত্তর পেলাম না৷

‘‘মি’’ চুপচাপ থাকারই খেলা৷ ‘‘মি’’ এবং অন্যান্য যারা তাকে খুঁজে পাবে তাদের সকলেই চুপ করে থাকার কথা যাতে বাকি খেলোয়াড়রা সহজে তাদের খুঁজে না পায়৷ কিন্তু এখনে তো ধারে কাছে কেউ নেই, আর ব্রেণ্ডা খেলার নিয়মকানুনগুলো বড় বেশি বেশি মেনে চলছে৷ আবার কথা বলেও যখন কোন উত্তর পেলাম না, তখন আমার কেমন বিরক্তি লাগল৷ মেয়েটি বোধ হয় ঠান্ডা, নাক উঁচু জাতের, পুরুষদের ঘৃণা করে, আমাকে ওর ভালো লাগছে না, ফলে ওর দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে বসে মনে মনে চাইলাম, সবাই আমাদের এক্ষুনি খুঁজে বের করে ফেলুক৷

ভাবতে অবাক লাগে, খাওয়ার টেবিলে যে মেয়েটিকে প্রথম দেখে একই সঙ্গে কৌতূহল ও আকর্ষণ অনুভব করেছিলাম, এখন তার বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই৷ বরং এক অদ্ভুত ঘৃণা আমার মনের অতল থেকে পাক দিয়ে উথলে উঠছে গলা পর্যন্ত৷ জোর দিয়ে বলতে পারি, মেয়েটির নীরবতা এ ঘৃণার কারণ নয়৷ অন্য কোন কিছু৷ ওর অঙ্গাঙ্গী উপস্থিতি আমার কাছে যেন ক্রমে বেড়ে ওঠা এক আশঙ্কার রূপ নিল৷ একান্ত প্রার্থনা শুরু করলাম, যাতে শিগগিরই কেউ সেখানে চলে আসে৷

প্রার্থনায় সাড়া মিলল৷ হালকা পায়ের শব্দ শুনতে পেলাম৷ পর্দার ওপাশে কেউ আমাকে হাঁটু ছুঁয়ে গেল৷ তারপর ভারী পর্দা সরে গেল একপাশে এবং একটি মেয়েলি হাত অন্ধকারে দিশেহারা ভাবে ঘুরে ফিরে এসে থামল আমার কাঁধে৷ ফিসফিসে গলায় কেউ জিগ্যেস করল, ‘‘মি?’’

সঙ্গে সঙ্গেই মিসেস গরম্যানকে চিনতে পারলাম৷

স্বাভাবিক ভাবেই কোন উত্তর উনি পেলেন না৷ সুতরাং ভেতরে ঢুকে খসখস শব্দ তুলে আমার পাশে বসে পড়লেন৷ তারপর ‘কে, টনি না?’ চাপা গলায় উনি জানতে চাইলেন৷

‘হ্যাঁ,’ আমি ফিসফিস করে উত্তর দিলাম৷

‘তুমি ‘‘মি’’ হয়েছ?’

‘না, যে হেয়েছে সে আমার এ পাশে বসে আছে৷’

আমাকে ডিঙিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন মিসেস গরম্যান৷ শুনতে পেলাম, তাঁর হাতের নখ একটা মেয়েলি রেশমী গাউনের ওপর আঁচড়ের শব্দ তুলল৷

‘কী খবর ‘‘মি’’! কেমন আছ? কে তুমি? ওহ্ হো, কথা বলার তো নিয়ম নেই, তাই না? যাকগে, টনি, ও সব নিয়ম-টিয়ম ভাল্লাগে না৷ জানো, এই খেলা খেলতে খেলতে আমি যেন হাঁফিয়ে উঠছি৷ এর চেয়ে সববাই এক জায়গায় আগুনের ধারে বসে কিছু একটা খেললে কত ভালো হয়৷’

‘যা বলেছেন,’ সাগ্রহে সায় দিলাম আমি৷

‘এবারে নীচে গিয়ে অন্য কিছু একটা খেলার প্রস্তাব দাও না৷ এই খেলাটায় কেন জানি না গা ছমছম করছে৷ মনে হচ্ছে, এই খেলায় এমন একজন খেলোয়াড় রয়েছে যার থাকার কথা নয়৷’

আমারও একই কথা মনে হচ্ছিল, কিন্তু মুখে কিছু বললাম না৷ আমরা এ কথা সে কথায় সময় কাটাতে লাগলাম৷

কতক্ষণ এই ভাবে কেটেছে জানি না, হঠাৎ কানে এল পায়ের শব্দ এবং পরক্ষণেই রেগির চিৎকার, এই যে! এখানে কেউ আছ নাকি?’

‘হ্যাঁ আছি’, আমি উত্তর দিলাম৷

‘তোমার সঙ্গে মিসেস গরম্যান আছে?’

‘হ্যাঁ৷’

‘বাঃ, বেশ ভালো জুটি বেঁধেছে৷ তোমাদের দুজনকেই খেসারত দিতে হবে৷ তোমাদের জন্যে সেই থেকে আমরা অপেক্ষা করছি৷’

‘তা কেন, তোমরা তো ‘‘মি’’-কে এখনও খুঁজে পাওনি!’ আমি প্রতিবাদ করলাম৷

‘তোমরা পাওনি বল!’ রেগি পাল্টা জবাব দিল, ‘কারণ এবারে আমিই ‘‘মি’’ হয়েছিলাম৷’

‘কিন্তু ‘‘মি’’-তো আমাদের সঙ্গে রয়েছে,’ আমি চিৎকার করে উঠলাম৷

‘হ্যাঁ,’ সমর্থন করলেন মিসেস গরম্যান৷

পর্দা সরে গেল একপাশে, এবং পরমুহূর্তেই আমরা রেগির টর্চের চোখে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করতে শুরু করলাম৷ আমি প্রথমে মিসেস গরম্যানের দিকে তাকালাম, তারপর চোখ ফেরালাম আমার অন্য পাশে৷ আমার ও দেওয়ালের মাঝে জানালার তাকে রয়েছে কিছুটা শূন্য জায়গা! সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালাম, এবং মনে হল, না দাঁড়ালেই ভালো হত—কারণ আমার মাথা ঘুরছে, ভীষণ দুর্বল লাগছে নিজেকে৷ ‘এই তো, এখানে একটা মেয়ে ছিল,’ আমি তবু বলে উঠলাম, ‘আমি ওঁকে ছুঁয়ে পর্যন্ত দেখেছি৷’

‘আমিও’—মিসেস গরম্যানের কণ্ঠস্বর তার স্বাভাবিকতা হারিয়েছে৷

রেগি অদ্ভুত কাঁপা গলায় হেসে উঠল৷ কারণ সে রাতে ওরও এক অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা হয়েছে৷

‘কেউ নিশ্চয়ই মজা করে বেড়াচ্ছে,’ সে মন্তব্য করল, ‘নীচে আসছ তো?’

বসবার ঘরে যখন পৌঁছলাম তখন আমরা আমাদের জনপ্রিয়তা মোটামুটি হারিয়েছি৷ রেগি একেবারে বোকার মতো বলে ফেলেছে যে পর্দার পিছনে জানালার তাকে বসা অবস্থায় সে আমাদের আবিষ্কার করেছে৷ আমি লম্বা তামাটে চেহারার মেয়েটিকে দোষারোপ করলাম৷ ও প্রথমে ‘‘মি’’ হওয়ার ভান করে চুপি চুপি সরে পড়েছে৷ ও কিন্তু সে কথা অস্বীকার করল৷ এরপর আমরা ‘‘মি’’ খেলা ছেড়ে অন্য খেলায় মেতে উঠলাম৷

কিছুক্ষণ পর ফাঁক পেয়ে স্যাংস্টন আমাকে সুরাপানের আহ্বান জানিয়ে ডেকে নিয়ে গেল ধূমপান কক্ষে৷ মনে হল, সে আমার প্রতি কিছুটা বিরক্ত হয়েছে, এবং সে বিরক্তির কারণ স্পষ্ট হল তার পরবর্তী কথায়৷

‘টনি’—গম্ভীর ভাবে শুরু করল ক্রিস্টোফার স্যাংস্টন, ‘মিসেস গরম্যানের সঙ্গে পর্দার আড়ালে বসে তুমি ফস্টিনষ্টি করতে চাও কর—জোয়ান বয়েসে আমারও ও সব ভালো লাগত৷ কিন্তু তার মানে এই নয় যে সকলে মিলে খেলার মাঝে, সববাইকে দাঁড় করিয়ে রেখে, ও সব করতে হবে৷

‘কিন্তু সত্যিই ওখানে আর একজন ছিল,’ আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, ‘‘মি’’ হওয়ার ভান করছিল৷ আমার ধারণা ওই লম্বা, তামাটে চেহারার মেয়েটি, মিস ফোর্ড—ওই ছিল, কিন্তু এখন ফ্যাসাদে পড়ে অস্বীকার করছে৷ এমনকী ও ফিসফিস করে নিজের নামটা পর্যন্ত আমাকে বলেছে৷’

স্যাংস্টন অবাক চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল৷ মনে হল, মদের গ্লাসটা এখুনি তার হাত থেকে পড়ে যাবে৷

‘মিস কী—কী নাম বললে?’ সে চিৎকার করে জানতে চাইল৷

‘মিস ফোর্ড—ব্রেণ্ডা ফোর্ড৷ এই নামই তো বলেছে মেয়েটা—’

গ্লাসটা নামিয়ে আমার কাঁধে হাত রাখল স্যাংস্টন৷

‘শোন ভাই, সে বলল, ‘ইয়ার্কি ঠাট্টা আমি পছন্দ করি, কিন্তু তার একটা মাত্রা আছে৷ বাড়ির সব মেয়েরা ভয়-টয় পেয়ে ফিট হয়ে পড়ুক তা আমি চাই না৷ কারণ দশ বছর আগে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে সিঁড়ি থেকে যে মেয়েটা ঘাড় মটকে মারা যায়, তারই নাম ছিল ব্রেণ্ডা ফোর্ড!’

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন