অনীশ দেব
অরগ্যানের বিচিত্র মেলা একরাতের জন্য এল রিভারভিলে৷ গ্রামের সীমান্তে যে বিশাল পার্কটা আছে সেখানে তাদের পসরা সাজিয়ে তাঁবু খাটিয়ে বসল৷ সময়টা অক্টোবরের শুরুর এক উষ্ণ আরামের সন্ধ্যা৷ ফলে সাতটা বাজতে না বাজতেই সেই হই-হুল্লোড়-আমোদ-প্রমোদের মেলায় লোকের ভিড় জমে গেল৷
এই ভ্রাম্যমান মেলা শুরু খুব যে বড় বা জমকালো তা নয়, তবে রিভারভিলে এর কদর আছে৷ কারণ সিনেমা, থিয়েটার, খেলার মাঠ, শহুরে সবকিছুর থেকে দূরে এক পাহাড়ি এলাকায় নিঃসঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এই রিভারভিল৷
রিভারভিলের স্থানীয় অধিবাসীরা খুব উঁচুদরের খেলা দেখতে হয়তো চায় না, সুতরাং সেই পুরোনো মোটা মেয়ে, উল্কি-কাটা মানুষ এবং বাঁদর-খোকা দেখেই তাঁরা খুশি হয়, মুগ্ধ হয়ে আলোচনা করতে থাকে নিজেদের মধ্যে৷ চিনেবাদাম ও মাখন দেওয়া পপ্কর্ণ খেতে ওরা ব্যস্ত, একই সঙ্গে কাপের পর কাপ গোলাপী লেমোনেডে চুমুক দিয়ে চলেছে, আর রঙচঙে চকলেটের গা থেকে কাগজের মোড়ক খুলতে খুলতে ওদের আঙুল চটচটে হয়ে উঠেছে৷
সবাই বেশ আরামে দিলখুশ হয়ে খেলা দেখছিল, তখনই এক ম্যাজিসিয়ানের দালাল ফলাও করে চিৎকার শুরু করল৷ বেঁটে, মোটা, পরণে চেক কাপড়ের স্যুট, মুখে লম্বা এক চোঙ৷ দালালটা প্রাণপণে চেঁচালেও, ম্যাজিসিয়ান তাঁবুর সামনে তৈরি কাঠের মঞ্চের পিছনে একা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ কেমন যেন নির্বিকার, অবজ্ঞার ভাব—ভিড় করে জমায়েত হওয়া জনতার দিকে সে ফিরেও তাকাচ্ছে না৷
অনেকক্ষণ পরে যখন প্রায় জনাপঞ্চাশ লোক মঞ্চের সামনে জড়ো হয়েছে, তখন আলোয় এসে দাঁড়াল ম্যাজিসিয়ান৷ জনতার মধ্যে শোনা গেল চাপা গুঞ্জন৷
ওপর থেকে ঠিকরে পড়া কর্কশ আলোয় ম্যাজিসিয়ানকে ভীষণ অদ্ভুত দেখাচ্ছে৷ ক্ষয়ে আসা লম্বা রোগা চেহারা, গায়ের রঙ ফ্যাকাশে, এবং গর্তে বসা কুচকুচে কালো দুটো চোখ আকারে বিশাল ও ধকধক করে জ্বলছে! মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই একদৃষ্টে চেয়ে রইল তার দিকে৷ ম্যাজিসিয়ানের গায়ে ঘন কালো স্যুট ও সেকেলে সরু টাই—সব মিলিয়ে সাক্ষাৎ শয়তানের ছাপ৷
শীতল দৃষ্টিতে জনতাকে জরিপ করল সে, তার অভিব্যক্তিতে ফুটে উঠল তাচ্ছিল্য এবং চাপা বিদ্বেষ৷ তার গমগমে স্বর সহজেই পৌঁছে গেল ভিড়ের শেষ সারি পর্যন্ত৷ সে বলল, আপনাদের মধ্যে থেকে যে কোন একজনের সাহায্য আমার দরকার৷ যদি দয়া করে স্টেজে আসেন—
সবাই আশেপাশে তাকাতে লাগল, ঠেলতে লাগল একে অপরকে, কিন্তু মঞ্চের দিকে কেউই এগিয়ে এল না৷
ম্যাজিসিয়ান কাঁধ ঝাঁকাল৷ ক্লান্ত কলায় সে বলল, আপনাদের মধ্যে থেকে কেউ না এলে এ খেলা দেখানো সম্ভব নয়৷ আমি আপনাদের হলফ করে বলছি, এই খেলায় ভয়ের কিছু নেই৷ এ নেহাৎই নিরীহ খেলা৷
প্রত্যাশা নিয়ে চারপাশে তাকাল সে, আর ঠিক তখনই জনৈক যুবক কনুই দিয়ে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে লাগল মঞ্চের দিকে৷ হাত বাড়িয়ে তাকে মঞ্চে উঠতে সাহায্য করল ম্যাজিসিয়ান, এবং ছেলেটিকে একটা চেয়ারে বসাল৷
আরাম করে বসুন—ম্যাজিসিয়ান বলল, এক্ষুনি আপনাকে আমি হিপনোটাইজ করে ঘুম পাড়িয়ে দেব৷ তখন আপনাকে যা বলব আপনি তাই শুনবেন৷
ছেলেটি চেয়ারে বসে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে ছটফট করতে লাগল৷
ম্যাজিসিয়ান তার বিশাল চোখ যুবকের চোখে স্থির রেখে তার মনোযোগ ফেরাল, এবং সঙ্গে সঙ্গে তার ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেল৷
হঠাৎই ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন রঙিন পপকর্ণের একটা বিরাট প্যাকেট ছুড়ে মারল মঞ্চের দিকে৷ মঞ্চের আলোর ওপর দিয়ে উড়ে এসে প্যাকেটটা থপ করে পড়ল চেয়ারে বসে থাকা যুবকের ঠিক মাথায়৷
ছেলেটি চকিতে ঝাঁকুনি দিল একপাশে, আরেকটু হলেই সে চেয়ার থেকে পড়ে যাচ্ছিল৷ সঙ্গে সঙ্গেই একটু আগের নিশ্চুপ হয়ে থাকা জনতা গলা ফাটিয়ে হো-হো করে হসে উঠল৷
ম্যাজিসিয়ান রাগে কাঁপতে লাগল৷ মুখ-চোখ লাল করে ভয়ংকর ক্রোধে সে তাকিয়ে রইল দর্শকদের দিকে৷
কে ছুড়ল এটা? হোঁচট খাওয়া গলায় জানতে চাইল সে৷
সবাই আস্তে আস্তে চুপ করে গেল৷
ম্যাজিসিয়ান তখনও তাদের দিকে লাল চোখে তাকিয়ে৷ অনেকক্ষণ পরে তার মুখ আবার ফ্যাকাশে হল এবং বন্ধ হল শরীরের কাঁপুনি, কিন্তু তার উজ্জ্বল চোখ দুটো একই ভাবে জ্বলতে লাগল৷
অবশেষে মঞ্চে বসা যুবকটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল ম্যাজিসিয়ান, ছোট্ট করে ধন্যবাদ জানিয়ে তাকে বিদায় দিল, তারপর আবার ফিরে তাকাল দর্শকদের দিকে৷ মাঝপথে বাধা পড়ার জন্য খেলা আবার নতুন করে শুরু করতে হবে—নিচু গলায় বলল ম্যাজিসিয়ান, আর তার জন্য নতুন কাউকে দরকার৷ যিনি পপকর্ণ এর প্যাকেট ছুড়ে মেরেছেন আশা করি মঞ্চে আসতে তাঁর আপত্তি নেই?
প্রায় ডজনখানেক লোক একসঙ্গে ঘুরে তাকাল ভিড়ের পিছন দিকে, আলো আঁধারিতে দাঁড়িয়ে থাকা জনৈকের দিকে৷
সঙ্গে সঙ্গে তাকে দেখতে পেল ম্যাজিসিয়ান, তার কালো চোখ যেন ধিকধিক জ্বলে উঠল৷ গম্ভীর ঠাট্টার সুরে সে বলল, এ খেলায় যিনি বাধা দিয়েছেন তিনি আসতে ভয় পাচ্ছেন৷ ছায়ায় লুকিয়ে পপকর্ণের ঠোঙা ছুড়তেই বোধ হয় তাঁর ভালো লাগে৷
অপরাধীর ঠোঁট চিরে আকস্মিক ভাবেই বেরিয়ে এল এক অস্ফুট চিৎকার, এবং সে দু-হাতে ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে লাগল মঞ্চের দিকে৷ তার চেহারায় তেমন কোন বিশেষত্ব নেই৷ বরং প্রথম যুবকের সঙ্গে যেন অনেকটা মিল আছে৷ দুজনকে দেখেই সাদামাটা ক্ষেতী-মজুর বলে মনে হয়৷
তাচ্ছিল্যের ভাব নিয়ে দ্বিতীয় যুবক মঞ্চের ওপর চেয়ারে গিয়ে বসল, এবং স্পষ্টই দেখা গেল, প্রায় কয়েক মিনিট ধরে সে ম্যাজিসিয়ানের আরাম করে-বসার নির্দেশকে অগ্রাহ্য করতে চেষ্টা করল৷ তবে একটু পরেই তার একরোখা ভাব মিলিয়ে গেল এবং অত্যন্ত বাধ্য ছেলের মতো সে তাকিয়ে রইল তার চোখের সামনে স্থির হয়ে থাকা ম্যাজিসিয়ানের জ্বলজ্বলে দুটো চোখের দিকে৷
মিনিট খানেক পরেই ম্যাজিসিয়ানের আদেশে সে উঠে দাঁড়াল এবং মঞ্চের ওপর শুয়ে পড়ল চিৎ হয়ে৷ শোনা গেল দর্শকদের দ্রুত শ্বাস নেবার শব্দ৷
এবারে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ুন—ম্যাজিসিয়ান সুর করে বলতে লাগল, ঘুমিয়ে পড়ুন ধীরে ধীরে…এই তো আপনার চোখে ঘুম নেমে আসছে…গভীর ঘুম…আপনি এখন ঘুমিয়ে পড়েছেন৷ এবার আপনাকে আমি যা যা আদেশ করব, সব আপনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন৷ আমার প্রতিটি আদেশ আপনাকে শুনতেই হবে৷ যা বলব তাই…
একঘেয়ে সুরে েেজ চলল তার কথাগুলো৷ একই কথা সে বার বার বলতে লাগল৷ জনতার মুখে টুঁ শব্দটি নেই৷ সবাই চুপচাপ ছবির মতো দাঁড়িয়ে৷
হঠাৎই ম্যাজিসিয়ানের সুর পাল্টে গেল, এবং দর্শকরা টান টান হয়ে উঠল৷
উঠে দাঁড়াবেন না—আস্তে আস্তে ওপরে ভেসে উঠুন! ম্যাজিসিয়ান আদেশ দিল, ভেসে উঠুন ওপরে—! তার কালো চোখ বন্য আগুনের মতো স্বপ্রভ হয়ে জ্বলতে লাগল৷ দর্শকরা শিউরে উঠল৷
উঠুন ওপরে—!
তখন চমকে উঠে একসঙ্গে শব্দ করে শ্বাস টানল জনতা৷
মঞ্চে টান টান হয়ে শুয়ে থাকা যুবকের একটি পেশীও নড়ল না, কিন্তু সে এই অবস্থায় ভেসে উঠতে লাগল ওপরে৷ প্রথমটা এত ধীরে যে ঠিক বোঝাই গেল না, কিন্তু পরক্ষণেই তার গতি ক্রমে বাড়তে লাগল৷
উঠুন—! গমগম করে উঠল ম্যাজিসিয়ানের কণ্ঠস্বর৷
ছেলেটি ভাসতে ভাসতে ক্রমশ মঞ্চ থেকে কয়েক ফুট ওপরে উঠে গেল এবং তখনও তার গতি থামেনি৷
দর্শকদের মনে তখন দৃঢ় বিশ্বাস যে এটা এক ধরনের ম্যাজিক ছাড়া আর কিছু নয়, কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা অবাক বিস্ময়ে হাঁ করে দেখতে লাগল৷ ছেলেটি যেন বাতাসে ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে, নিরাবলম্ব হয়ে দোল খাচ্ছে সামান্য৷
হঠাৎই দর্শকদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হল, নিবদ্ধ হল অন্যজনের ওপর৷ ম্যাজিসিয়ান এক হাতে নিজের বুক চেপে ধরেছে, কয়েক পা টালমাটাল পায়ে এগিয়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মঞ্চের ওপর৷
ডাক্তার ডাক্তার—সবাই চেঁচিয়ে উঠল৷ চেকস্যুট পরা দালাল তাঁবু থেকে বেরিয়ে এল, ঝুঁকে পড়ল মঞ্চে পড়া থাকা নীরব দেহটার ওপর৷
সে নাড়ী দেখল, তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে দাঁড়াল৷ কেউ এক বোতল হুইস্কি এগিয়ে দিল তার দিকে, কিন্তু সে শুধুই কাঁধ ঝাঁকাল৷
হঠাৎই জনতার ভিড় থেকে একটি মহিলা চিৎকার করে উঠল৷
সবাই ফিরে তাকাল তার দিকে, এবং পরক্ষণেই মহিলাটির দৃষ্টি অনুসরণ করে তারা ওপরে তাকাল৷
সঙ্গে সঙ্গে আরও চিৎকার শোনা গেল—কারণ ম্যাজিসিয়ানের ঘুম পাড়ানো ছেলেটি তখনও পরে উঠে চলেছে! সবাই যখন মরণাপন্ন ম্যাজিসিয়ানের দিকে তাকিয়ে ছিল, তখনও তার গতি থামেনি! এখন মঞ্চ থেকে সে সাত ফুট ওপরে এবং অবাধে ভেসে চলেছে৷ ম্যাজিসিয়ান মরে যাবার পরও সে তার শেষ আদেশ—‘উঠুন!’ অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে!
ঠিকরে বেরিয়ে আসা চোখ দিয়ে দালালটা পাগলের মতো লাফ দিল ওপর দিকে, কিন্তু বেঁটে হওয়া তার হাত পৌঁছল না৷ শূন্যে ভেসে চলা শরীরটাকে তার আঙুল কোন রকমে স্পর্শ করল মাত্র, তারপরই সে বিকট শব্দে পড়ে গেল মঞ্চের ওপর৷
যেন কোন অদৃশ্য দড়ির টানে ছেলেটি কাপ হয়ে শয়ে থাকার ভঙ্গিতে ভেসে চলল ওপরে৷
মেয়েরা কোন অদৃশ্য দঁড়ির টানে ছেলেটি কাঠ-হয়ে-শুয়ে-থাকা ভঙ্গীতে ভেসে চলল ওপরে৷
মেয়েরা পাগলের মতো গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল, পুরুষরা চিৎকারে দিশেহারা৷ কেউই বুঝতে পারছে না কি করবে৷ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা দালালের চোখে আস্তে আস্তে জন্ম নিল আতঙ্ক৷ মঞ্চে লুটিয়ে পড়ে থাকা ম্যাজিসিয়ানের দিকে মরিয়া হয়ে একবার তাকাল সে৷
নেমে এসো, ফ্রাঙ্ক! নেমে এসো! জনতা চিৎকার করে উঠল, ফ্র্যাঙ্ক! জাগো, নেমে এসো৷ থামো, ফ্র্যাঙ্ক—!
কিন্তু ফ্র্যাঙ্কের পাথরের মতো দেহ ক্রমেই আরও উঠতে লাগল৷ ওপরে—ওপরে—আরো ওপরে৷ এক সময় মেলার তাঁবুর মাথায় পৌঁছে গেল নরম চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া আকাশে৷
দর্শকদের অনেকে ভয়ে মুখ ঢাকল হাতে, মুখ ফিরিয়ে নিল৷ যারা তখনও তাকিয়ে ছিল, তারা দেখল ফ্র্যাঙ্কের শরীরটা আকাশে ভাসতে ভাসতে ক্রমে একটা বিন্দুর আকার নিল, যেন একটা ছোট্ট কয়লার টুকরো ভেসে চলেছে চাঁদের দিকে৷ তারপর সেটা একেবারে অদৃশ্য হয়ে গেল৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন