অনীশ দেব
যে পরিবেশের মাঝে বসে ক্লেটন তার শেষ গল্প শুনিয়েছিল সেটা আজও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে৷ বেশির ভাগ সময়টাই সে বসে ছিল ঘরের ঐ কোণে, বড় সড় অগ্নি-আধারের পাশে রাখা প্রাচীন সোফাটার ধার ঘেঁষে, আর তার পাশেই বসে ছিল স্যান্ডারসন—নিজের নাম লেখা ব্রোসলি মাটির পাইপ থেকে ধূমপানে মগ্ন৷ ইভান্সও ছিল, আর ছিল অভিনয় জগতের রত্ন উইশ—অবশ্য সে খুব বিনয়ীও বটে৷ সেই শনিবারটায় আমরা সকলে মিলে মারমেইড ক্লাব-এ এসেছি সকালবেলায়, শুধু ক্লেটনই এর ব্যতিক্রম, কারণ কালকের রাতটা সে ক্লাবেই কাটিয়েছে—এবং এ ঘটনা থেকেই তার গল্পের অনিবার্য সূত্রপাত৷ যতক্ষণ বল দেখা যায়, ততক্ষণ আমরা গল্ফ্ খেলেছি৷ রাতের খাওয়া-দাওয়াটাও সেরে নিয়েছি এবং প্রত্যেকের মেজাজে গল্পের যন্ত্রণা সহ্য করার মতো একটা শান্ত দয়ার আবেশ৷ ক্লেটন গল্প শুরু করতেই আমরা স্বাভাবিক ভাবে ধরে নিয়েছি সে গাঁজাখুরি কোনো কাহিনী শোনাচ্ছে৷ তবে এ কথা সত্যি যে, সে কাহিনীর শুরু করেছিল অত্যন্ত সহজ-সরল ভঙ্গীতে, যেন কোন সত্যি ঘটনা শোনাচ্ছে৷ কিন্তু আমরা ভেবেছি, সেটা মানুষটার দুরারোগ্য গল্প বলার কায়দা৷
জানো, কাল রাতে এখানে আমি একা ছিলাম? স্যান্ডারসনের নেড়েচেড়ে দেওয়া একটা জ্বলন্ত কাঠের গুড়ি থেকে ঠিকরে ওঠা আগুনের ফুলকি-বৃষ্টির দিকে অনেকক্ষণ চিন্তামগ্ন চোখে তাকিয়ে থেকে ক্লেটন মন্তব্য করল৷
শুধু ক্লাবের পোষা জন্তু-জানোয়ারগুলো ছাড়া—বলল উইশ৷
হ্যাঁ, তবে ওরা বাড়ির ওদিকটায় শোয়—বলল ক্লেটন, যাই হোক, কাল রাতে—সে হাতের চুরুটে কিছুক্ষণ এক মনে টান দিল, যেন নিজের আত্মবিশ্বাস সম্পর্কে ইতস্তত করছে৷ তারপর বেশ শান্ত ভাবেই বলল, আমি একটা ভূত ধরেছি!
ভূত ধরেছ! বল কী? স্যান্ডারসন বলল, কই দেখি?
তখন চার-সপ্তাহ আমেরিকায় ঘুরে আসা ক্লেটনের একান্ত অনুগত ভক্ত ইভান্স চিৎকার করে উঠল, ভূত ধরেছ, তুমি? ওঃ, দারুণ! শিগগির বল, কী করে কী হল৷
ক্লেটন ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গীতে আমার দিকে তাকাল, বলল, কেউ যে আড়ি পাতবে তা নয়, তবে ভূত নিয়ে গুজব ছড়িয়ে ক্লাবের চমৎকার পরিচর্যা-পরিবেশন পণ্ড হয়ে যাক তা আমি চাই না৷ তাছাড়া এটা ঠিক নিত্যকার ভূত নয়৷
মনে হয় না ওটা আর কখনও আবার আসবে৷
তার মানে ভূতটা তুমি ধরে রাখনি? স্যান্ডারসন বলল৷
ধরে রাখতে মন চাইল না—বলল ক্লেটন৷
আমরা জোর গলায় হেসে উঠতেই ক্লেটনকে একটু বিমর্ষ মনে হল৷ ছোট্ট করে হেসে সে বলল, বুঝতে পারছি, তবে সত্যিই ওটা একটা ভূত ছিল৷ আমি ঠাট্টা করছি না৷ বিশ্বাস কর৷
স্যান্ডারসন তার লালচে চোখ ক্লেটনের ওপর রেখে পাইপে গভীর টান দিয়ে, অনেক কথার চেয়েও বেশি ইঙ্গিতময় এক সরু ধোঁয়ার ফোয়ারা ছুড়ে দিল৷
ক্লেটন ব্যাপারটা গায়ে মাখল না—এ আমার জীবনের সবচেয়ে আশ্চর্য ঘটনা৷
তোমরা তো জানো, আমি ভূত-টুত একেবারে বিশ্বাস করি না, আর আমিই কিনা শেষে একটা ভূত ধরে বসলাম, এখন গোটা ব্যাপারটাই আমার হাতে৷
আরো কিছুক্ষণ গভীর ধ্যানে ডুবে রইল সে, তারপর দ্বিতীয় একটা চুরুট বের করে একটা অদ্ভুত দর্শন ছুরি দিয়ে সেটা ফুটো করতে লাগল৷
তুমি ওটার সঙ্গে কথা বলেছ? উইশ প্রশ্ন করল৷
তা ধর প্রায় ঘণ্টাখানেক বলেছি৷
মিশুকে আড্ডবাজ? সন্দেহ-বাতিকদের দলে নাম লিখিয়ে আমিও শ্লেষের খোঁচাটা দিলাম ক্লেটনকে৷
বেচারা খুব বিপদে পড়েছিল—চুরুটের ডগার ওপর ঝুঁকে পড়ে ক্লেটন বলল৷ সে মুখে প্রতিবাদ বা বিরক্তির লেশমাত্র নেই৷
কাঁদছিল? কে যেন জানতে চাইল৷
স্মৃতি রোমন্থন করে বাস্তবিকই এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল ক্লেটন৷ বলল, হা ভগবান! সত্যিই কাঁদছিল বেচারা৷
তুমি মেরেছ ওকে? যথাসম্ভব আমেরিকান কায়দায় প্রশ্ন করল ইভান্স৷
তাকে উপেক্ষা করে ক্লেটন বলল, কখনো বুঝিনি, ভূতদের এ রকম করুণ অবস্থা হতে পারে—সে আবার আমাদের কিছুক্ষণ অপেক্ষায় রাখল, পকেট হাঁতড়ে দেশলাই খুঁজে বের করে চুরুটে আগুন ধরাল৷
আমি অবশ্য একটা সুযোগ নিয়েছি—অবশেষে সে মন্তব্য করল৷
আমরা এতটুকু ব্যস্ততা না দেখিয়ে প্রতীক্ষায় রইলাম৷
যে সব ভূতরা সাধারণত ভয় দেখিয়ে বেড়ায়, তারা বুনো ঘোড়ার মতো গোঁয়ার্তুমি করে একই জায়গায় বার বার ফিরে আসে৷ কিন্তু এ বেচারা সেরকম নয়৷ প্রথম দেখাতেই ওকে আমার খুব দুর্বল বলে মনে হয়েছে৷
চুরুটের টানে নিজের বক্তব্যকে যতিচিহ্ণিত করে ক্লেটন বলল, ওর সঙ্গে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল লম্বা বারান্দাটায়৷ প্রথম আমিই ওকে দেখতে পাই—আমার দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল৷ সঙ্গে সঙ্গে ওকে ভূত বলে আমি চিনতে পারলাম৷ ওর চেহারাটা কেমন স্বচ্ছ আর সাদাটে, সোজা ওর বুক ভেদ করে বারান্দায় শেষ মাথার ছোট্ট জানালার আলোর রেশটুকু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম৷ শুধু চেহারা নয়, ওর হাবভাব পর্যন্ত আমার কাছে দুর্বল ঠেকছিল৷ যেন কী করবে ঠিক করে উঠতে পারছে না৷ একটা হাত কাঠের দেওয়ালে ভর রেখে অন্য হাতটা মুখের কাছে নাড়ছে৷ ঠিক—এই রকম!
চেহারা কী রকম ছিল? স্যান্ডারসন বলল৷
রোগা৷ ছোটখাটো, মাথায় খোঁচা খোঁচা কদমছাঁট চুল৷ কান দুটো বিচ্ছিরি৷ কাঁধ ভীষণ সরু৷ পরণে ভাঁজ করা কলার দেওয়া খাটো কেনা জ্যাকেট, ঢোলা প্যান্টুলটা পায়ের কাছটায় ছিঁড়ে গেছে৷ চুপিসারে আমি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছি৷ সঙ্গে আমার কোনো আলো ছিল না—পায়ে ছিল হালকা চটি৷ সিঁড়িতে উঠেই ওকে আমার নজরে পড়ল৷ ব্যস, সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম—ভাল করে ওকে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম৷ ভয় কিন্তু একটুও পাইনি৷ বরং অবাক হয়েছি আর কৌতূহলও গেছে বেড়ে৷ ভাবলাম, ওঃ ভগবান! এদ্দিনে তাহলে একটা ভূতের দেখা পেলাম৷ আর গত পঁচিশটা বছর আমি কিনা এক মুহূর্তের জন্যেও ভূতে বিশ্বাস করিনি!
হুম্—বলল উইশ৷
আমি সিঁড়ি বেয়ে ওঠা মাত্রই ভূতটা আমাকে দেখতে পেল৷ চকিতে ঘুরে তাকাল আমার দিকে৷ সব মিলিয়ে অপরিণত যুবকের মুখ, থুতনি ও নাকের গড়ন কেমন দুর্বল, ঠোঁটের ওপরে খোঁচা খোঁচা গোঁফ৷ এক মুহূর্ত আমরা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম—ও কাঁধের ওপর দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে—এবং জরিপ করতে লাগলাম পরস্পরকে৷ তারপরই মনে হয় নিজের উঁচুদরের পেশার কথা ওর মনে পড়ল৷ ও ঘুরে দাঁড়িয়ে টান টান হয়ে খাড়া হল, মুখটা সামনে বাড়িয়ে হাত দুটো ভূতুড়ে নিয়ম মাফিক দু’পাশে ছড়িয়ে এগিয়ে এলো আমার দিকে৷ আর এগিয়ে আসবার সময় মুখটা হাঁ করে এক হালকা টানা চিৎকার করে আমাকে ভয় দেখাতে চাইল৷ কিন্তু না—ওটা শুনে এক ফোঁটাও ভয় পেলাম না৷ খাওয়া-দাওয়া করে আমি তখন এক বোতল শ্যাম্পেন শেষ করেছি, আর একা একা থাকার ফলে হয়তো দু-তিন পেগ—না, হয়তো চার-পাঁচ পেগ হুইস্কিও টেনে ফেলেছি, সুতরাং আমার শরীর তখন নিরেট পাথরের মতো—ভয় পাওয়া তো দূরস্থান! ভূতটাকে বললাম—‘বোকার মতো চেঁচিও না! এটা তো তোমার আস্তানা নয়৷ তাহলে কী করছ এখানে?’
স্পষ্ট দেখলাম, ও কুঁকড়ে গেল৷ তারপর আবার চিৎকার করল, ‘ওঁ-ওঁ-ওঁ—’
‘রাখ তোমার ভূতুড়ে চিৎকার! তুমি কি এ ক্লাবের মেম্বার?’ আমি বললাম, আর ওকে যে আমি পাত্তাই দিচ্ছি না সেটা দেখাবার জন্যে ওর শরীরের একটা কোণা ভেদ করে বেরিয়ে গেলাম, তারপর মনোযোগ দিলাম মোমবাতি জ্বালতে৷ ওর দিকে আড়চোখে চেয়ে আবার জিগ্যেস করলাম, ‘তুমি কি মেম্বার?’
আমাকে জায়গা দিতে ও একটু সরে গেল, ওর মুখের ভাব কী রকম যেন মনমরা হল৷
তারপর আমার চোখের নাছোড়বান্দা নীরব প্রশ্নের উত্তরে বলল, না, আমি মেম্বার নই—আমি একটা ভূত৷
‘সে যা-ই হও, তাতে তো আর মারমেইড ক্লাবের ভেতরে যথেচ্ছ ঘোরাঘুরি করা যায় না৷ তুমি কারো সঙ্গে দেখা করতে চাও, না কি?’ খুব সাবধানে আমাকে কথাবার্তা বলতে হচ্ছিল, কারণ, নইলে আমার হুইস্কি-জনিত বিশৃঙ্খল ব্যবহারকে ও ভেবে বসবে আমি ভয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছি৷ জ্বলন্ত মোমবাতিটা হাতে নিয়ে ওর দিকে ঘুরে দাঁড়ালাম, ‘তুমি এখানে করছটা কী?’
ও ততক্ষণে হাত নামিয়ে চিৎকার বন্ধ করে ফেলেছে, লজ্জা পেয়ে ভ্যাবাচাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে চুপচাপ৷ কিছুক্ষণ পরে ও বলল, ‘আমি এখানে ভয় দেখাতে এসেছি৷’
‘কে বলেছে তোমাকে ভয় দেখাতে?’ শান্ত গলায় বললাম৷
‘বললাম তো, আমি ভূত—’ যেন নিজের পক্ষ সমর্থনে ও বলল৷
‘সে হও গিয়ে, কিন্তু ভদ্রলোকদের প্রাইভেট ক্লাবে এসে এভাবে ভয় দেখাবার কোনো অধিকার তোমার নেই, এখানে মেয়েরা, বাচ্চারা প্রায়ই আসে৷ তাদের কেউ যদি হঠাৎ তোমার মুখোমুখি পড়ে যায়, তাহলে তো সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে যাবে৷ একবারও ভেবেছ সে কথা?’
‘না তো, স্যার—ভাবিনি৷’
‘ভাবা উচিত ছিল৷ তাছাড়া এ জায়গাটার ওপর তোমার কি কোনো দাবী আছে? মানে, এখানে তুমি খুন-টুন কিছু হয়েছিলে?’
‘না স্যার, সে-রকম কিছু নয়, তবে আমি ভাবছিলাম, জায়গাটা বেশ সেকেলে গোছের, ওক্ কাঠের দেওয়াল চারদিকে, তাই—’
‘এটা একটা অজুহাত হল?’ আমি শক্ত গলায় বললাম, ‘এখানে আসাটা তোমার খুব ভুল হয়েছে—’ বন্ধুত্বে ভরা আদেশের সুরে আরও বললাম, ‘আমি হলে আর মোরগের ডাক শোনার অপেক্ষা করতাম না—এক্ষুণি উধাও হয়ে যেতাম৷’
ও ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ল৷ ‘আসলে কী জানেন, স্যার—’ ও বলতে শুরু করল৷ আমি হলে কিন্তু এই মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যেতাম—’ বেশ জোর দিয়ে আমি বললাম৷
‘আসলে—স্যার—মানে—আমি অদৃশ্য হতে পারছি না৷’
‘পারছ না?’
‘না স্যার৷ মানে, আমি কী যেন একটা ভুলে গেছি৷ কাল মাঝরাত থেকে আমি শুধু এখানে ঘোরাঘুরি করছি, আলমারিতে, দেরাজে, শোবার ঘরে লুকিয়ে লুকিয়ে থেকেছি৷ মনটা কেবলই ছটফট করছে৷ আগে কখনও আমি ভয় দেখাতে আসিনি—মনে হচ্ছে, না এলেই ভাল হতো৷’
‘না এলেই ভাল হতো?’
‘হ্যাঁ স্যার৷ আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঠিকভাবে পেরে উঠছি না৷ কী একটা ছোট্ট ব্যাপার যেন ভুলে গেছি, আর মনে করতে পারছি না৷’
এ কথা শুনে, বুঝলে, আমি যেন একেবারে বোল্ড আউট হয়ে গেলাম৷ ও আমার দিকে এমন মনমরা চোখে তাকাল যে আমি আর তর্জন-গর্জনের সুর বজায় রাখতে পারলাম না৷ ‘ভারী অদ্ভুত তো—’ বললাম আমি, এবং কথা বলার সময় মনে হল নীচের তলায় কারো চলাফেরার শব্দ পেলাম৷—‘চল, আমার ঘরে চল৷ সেখানে গিয়ে তোমার সব কথা শুনব৷ আমি ব্যাপার-স্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না৷’ ওকে ধরে আমার সঙ্গে নিতে চাইলাম৷ কিন্তু বুঝতেই পারছ, সে চেষ্টা একরাশ ধোঁয়াকে মুঠো করে ধরবার চেষ্টারই মতো! আমার ঘরের নম্বরটা কিছুতেই আমার মনে পড়ছিল না৷ বেশ কয়েকটা শোবার ঘর খোঁজাখুঁজির পর আমার ঘরের দরজা নজরে পড়ল৷ একটা আরাম কেদারায় গা এলিয়ে ওকে বললাম, ‘যাক, এইবার বসে ধীরে-সুস্থে তোমার গপ্পোটা বলো দেখি৷ মনে হচ্ছে, তুমি বেশ ভাল ঝামেলাতেই পড়েছ৷’
যাই হোক, ও বসতে রাজি হল না, বলল, আমার আপত্তি না থাকলে ও বরং ঘরের মধ্যে একটু পায়চারি করতে চায়৷ তাই হল এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা এক দীর্ঘ-গভীর আলোচনায় ডুবে গেলাম৷ একটু পরে হুইস্কি ও সোডার আমেজটা কিছুটা কমে এলে ক্রমে ক্রমে বুঝতে পারলাম, কী ভয়ংকর বিপজ্জনক ভূতুড়ে ব্যাপারেই না আমি আগাপাস্তলা জড়িয়ে পড়েছি৷ অর্ধ-স্বচ্ছ শরীর নিয়ে পর্দাঘেরা সুন্দর পরিচ্ছন্ন সেকেলে শোবার ঘরে ও দিব্যি এপাশ-ওপাশ নিঃশব্দে পায়চারি করছে৷ নিয়ম-মাফিক ভূতের মতোই ওর চেহারা ও চালচলন—তফাত শুধু হালকা গলার স্বরটুকুতে৷ আমার মোমবাতি দানের ম্লান আলো ওর শরীর ভেদ করে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, চোখে পড়ছে দেওয়ালে টাঙানো ফ্রেমে বাঁধানো খোদাইয়ের কাজগুলো, আর ও আমাকে শুনিয়ে চলল ওর করুণ জীবন-কাহিনী—যা সদ্য সদ্য শেষ হয়েছে এই পৃথিবীর বুকে৷ ওর মুখের চেহারা খুব সাধু না হলেও বলতে পারি, স্বচ্ছ হওয়ার ফলে ওর পক্ষে সত্যি বলা ছাড়া পথ ছিল না৷
তার মানে? হঠাৎই চেয়ারে সোজা হয়ে বসে উইশ বলল৷
কী মানে? ক্লেটন জানতে চাইল৷
এই—স্বচ্ছ হওয়ার ফলে—সত্যি বলা ছাড়া পথ ছিল না—আমি ঠিক বুঝতে পারছি না৷
আমিও বুঝিনি—অননুকরণীয় আশ্বাসের ভঙ্গীতে ক্লেটন বলল, তবে কথাটা যে সত্যি, এটুকু বলতে পারি৷ ওর কাছে শুনলাম, কীভাবে ও মারা গেছে—লণ্ডনের এক পাতাল-ঘরে ও মোমবাতি হাতে নেমেছিল কোথায় গ্যাস লিক্ করছে দেখতে—আর বেঁচে থাকতে লন্ডনেরই এক বেসরকারি ইস্কুলের ইংরিজির মাস্টার ছিল৷
বেচারা! আমি মন্তব্য করলাম৷
যা বলেছ৷ বেঁচে থাকলেও ওর জীবন ছিল উদ্দেশ্যহীন, মরে গিয়েও তাই৷ ও তার বাপ-মা, মাস্টারমশাই—অনেকের কথাই বলল৷ কেউ ওকে বুঝত না, কোনো আমল দিত না৷ সত্যিকারের বন্ধু বলতে কেউ ছিল না ওর৷ সফলতা ওর জীবনে কোনো দিন আসেনি৷ খেলাধূলা ও বরাবরই এড়িয়ে চলেছে এবং পরীক্ষায় ফেল করেছে বারবার৷ একটা মেয়ের সঙ্গে বিয়েও ঠিক হয়ে গিয়েছিল আর ঠিক সেই সময়েই ঘটল ওই গ্যাস-সংক্রান্ত দুর্ঘটনা৷ ‘এখন তাহলে কোথায় আছ?’ আমি জানতে চাইলাম, ‘মানে—’
দেখলাম, ব্যাপারটা ওর কাছে ঠিক পরিষ্কার নয়৷ মানে যেখানেই ও থাক, ওর সঙ্গে এখন রয়েছে একদল স্বজাতীয় ভূত, আর ওরা নিজেদের মধ্যে প্রায়ই কোনো বাড়িতে গিয়ে আস্তানা গাড়বার কথা আলোচনা করে৷ হ্যাঁ, কোনো বাড়িকে ভূতুড়ে বাড়ি বানাবার মতলব আর কি! ওদের কাছে এই ব্যাপারটা ভীষণ রোমাঞ্চকর, তবে ওদের বেশির ভাগই সব সময় ভয়ে পিছিয়ে আসতে চায়৷ সুতরাং, অবশেষে ও আবির্ভূত হয়েছে৷
আশ্চর্য বটে! জ্বলন্ত আগুনের দিকে চোখ রেখে উইশ বলল৷
ওর কথাবার্তা শুনে আমার মোটামুটি এই রকমই মনে হয়েছে— ক্লেটন বিনয়ের সঙ্গে বলল, এক মনে পায়চারি করতে করতে মিহি সুরে ও কথা বলে গেছে—শুধু কথা—নিজের করুণ অবস্থা সম্পর্কে৷ ভয় দেখাতে এসে এই বিতিকিচ্ছিরি ঝামেলায় পড়ে ও ভীষণ মনমরা হয়ে পড়েছিল৷ সবাই ওকে বলেছিল এতে নাকি খুব মজা হবে৷ তা, সেই মজা পাওয়ার আশাতেই ও ক্লাবে এসে উদয় হয়েছিল, কিন্তু কোথায় কী! ওর সারা জীবনের ব্যর্থতার লিস্টে আরো একটা ঘটনা যোগ হল মাত্র৷ ও বলল, যখনই যা কিছু ও করতে গেছে, সেটাই নাকি কেমন তালগোল পাকিয়ে ভণ্ডুল হয়ে গেছে৷ ওর কথা আমি একটুও অবিশ্বাস করিনি৷ যদি অন্তত কারো সহানুভূতিও ভূতটা পেত—এই পর্যন্ত বলে ও একটু থামল নজর করে দেখল আমাকে, তারপর মন্তব্য করল যে শুনতে অবাক লাগলেও আমিই নাকি প্রথম ব্যক্তি যে ওর প্রতি একটু হলেও সহানুভূতি দেখিয়েছি—এটুকু দয়াও কারও কাছ থেকে ভূতটা পায়নি৷
তক্ষুনি আমি বুঝতে পারলাম, ও আসলে কি চায়, এবং মন মনে রাজিও হলাম ওকে সাহায্য করতে৷ চটপট উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘এ সব নিয়ে বেশী মন খারাপ কোরো না৷ যে করে হোক তোমাকে আবার ফিরে যেতেই হবে৷ নাও আর একবার তৈরি হয়ে চেষ্টা কর দেখি৷’ আমি এমনিতে নিষ্ঠুর হতে পারি, কিন্তু একজন যখন আমাকে সত্যিকারের বন্ধু বলে সম্মান দিয়েছে তখন তাকে সাহায্য না করাটা আমার সহ্যের বাইরে—তা সে মানুষ হোক আর ভূতই হোক৷ আমার কথায় ও বলল, ‘আমি পারছি না৷’
‘পারতেই হবে৷’ আমি বললাম এবং ও সত্যিই চেষ্টা করতে লাগল৷
চেষ্টা! বলল স্যান্ডারসন, কেমন করে?
হাত নাড়াচাড়া করে, ক্লেটন বলল৷
হাত নাড়াচাড়া করে?
হ্যাঁ, বিভিন্ন জটিল ভঙ্গীতে হাত নাড়াচাড়া করে৷ ঐ ভাবেই ও এখানে এসে হাজির হয়েছিল, এবং একইভাবে ওকে আবার অদৃশ্য হতে হবে৷ ওঃ ভগবান! কী কাজেই না ফেঁসেছি!
কিন্তু, শুধু হাত নেড়ে কেমন করে—আমি বলতে শুরু করলাম৷
তুমি দেখছি সব কিছুরই জট খুলতে চাও—আমার দিকে ফিরে বিশেষ কয়েকটা শব্দের ওপর জোর দিয়ে ক্লেটন বলল, কেমন করে আমি জানি না৷ শুধু জানি, ও অন্তত তাই করেছিল৷ বহু চেষ্টার পর, বুঝলে, এক সময় ওর হাতের ভঙ্গীগুলো ঠিক ঠিক হতেই ভূতটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল৷
ভঙ্গীগুলো তুমি খেয়াল করেছিলে? স্যান্ডারসন ধীরে ধীরে বলল৷
হ্যাঁ—বলল ক্লেটন, মনে হল কিছু একটা ভাবছে, ভঙ্গীগুলো ভারী অদ্ভুত৷ আমি আর সেই রোগা আবছা ভূতটা বসে আছি সেই নিস্তব্ধ জনশূন্য সরাইখানায়৷ আমাদের কণ্ঠস্বর ছাড়া আর কোনো শব্দ সেখানে ছিল না৷ শুধু ছিল ওর হাতের নাড়াচাড়ায় শূন্যে তৈরি এক আবছা ছবি৷ একটা মোমবাতি শোবার ঘরের অন্ধকার দূর করছে, আর দ্বিতীয় একটা জ্বলন্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে ড্রেসিং-টেবিলে, আলো বলতে সব মিলিয়ে ওইটুকুই—কখনো-সখনো মোমবাতির আলো ক্ষণিকের জন্যে দপ্ করে জ্বলে উঠছে দীর্ঘ তন্বী বিহ্বল শিখায়৷ আর অদ্ভুত সব ব্যাপার ঘটতে লাগল৷ ‘আমি পারছি না—ও বলল, আমার দ্বারা সম্ভব নয়—!’ এবং হঠাৎই বিছানার পায়ের দিকে ছোট্ট চেয়ারে বসে ও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল৷ ভগবান! কী হয়রানি একবার বোঝ৷
‘কী হচ্ছে কী এসব?’ থাম, এ কথা বলে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে গেলাম, কিন্তু…আমার হতচ্ছাড়া হাতটা ওর শরীর ভেদ করে চলে গেল! মনে আছে, বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো ছিটকে সরিয়ে নিয়েছি আমার হাত৷ সামান্য শিউরে উঠে সরে এসেছি ড্রেসিং-টেবিলের কাছে৷ তারপর, ওকে মদৎ দিতে আমিও চেষ্টা করতে শুরু করলাম৷
কী করে! স্যান্ডারসন বলল, হাত নাড়াচাড়ার ভঙ্গী করে?
হ্যাঁ, তাই৷
কিন্তু—কী একটা ভেবে বলতে শুরু করেছিলাম আমি, কিন্তু সেটা খেয়াল করে উঠতে পারলাম না৷
আশ্চর্য ব্যাপার তো—পাইপের গর্তে আঙুল ঢুকিয়ে স্যান্ডারসন বলল, তার মানে, তোমার এই ভূতটা সমস্ত রহস্যই তোমার কাছে—
ফাঁস করে দিয়েছে কিনা? হ্যাঁ, দিয়েছে৷
হতে পারে না—বলল উইশ, এ সম্ভব নয়৷ কারণ, তাহলে তুমিও ওর সঙ্গে উধাও হয়ে যেতে৷
ঠিক বলেছ—আমি আমার মনের কথা ফিরে পেয়ে সমর্থন জানালাম৷
কিছুক্ষণের জন্য সবাই চুপচাপ৷
শেষ পর্যন্ত ও পারল? স্যান্ডারসন জানতে চাইল৷
হ্যাঁ, পারল, তবে অনেক চেষ্টার পর—বলতে পারো হঠাৎই হয়ে গেল৷ ও তো হতাশই হয়ে পড়েছিল, তারপর আমাদের দুজনের মধ্যে এক চোট হল, তখন হঠাৎ ও উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে পুরো ভঙ্গীটা আস্তে আস্তে করে দেখাতে বলল, যাতে ও ভালো করে লক্ষ্য করতে পারে৷ ‘আপনারটা খুঁটিয়ে দেখলে আমি বুঝতে পারব আমার ভুলটা কোথায় হচ্ছে’, বলল ভূতটা৷ এবং সত্যিই পারল৷ কিন্তু হঠাৎ ও একটু রুক্ষ গলায় বলল, ‘আপনি এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি পারব না—এই জন্যে তখন থেকে সব খালি গুলিয়ে যাচ্ছে৷ আপনাকে দেখে আমি আরও নার্ভাস হয়ে যাচ্ছি৷’ যাই হোক, কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে একটু কথা কাটাকাটি হল৷ বুঝতেই পারছ, আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছিল, কিন্তু ভূতটা একেবারে বুনো ঘোড়ার মতো বেঁকে বসল৷ সুতরাং, অগত্যা আমি ঘুরে দাঁড়ালাম, তাকিয়ে রইলাম বিছানার পাশে রাখা পোশাক আলমারির আয়নায়৷
ও একেবারে ঝটপট শুরু করে দিল৷ আয়না দিয়ে আমি ওর সমস্ত কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম৷ হাত দুটো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, এই ভাবে, এই রকম করে, বিচিত্র সব ভঙ্গী করতে শুরু করল ভূতটা, তারপর হঠাৎই ঝুপ করে এসে পরল শেষ ভঙ্গীটা—সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুটো হাত টান টান করে ছড়িয়ে দাও দু’পাশে—এই রকম, ঠিক এই ভাবে ও দাঁড়াল৷ তারপরই উধাও! হাপিশ! হাওয়া! আয়না ছেড়ে বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ালাম ওর দিকে৷ কিন্তু কোথায় কে! জ্বলন্ত মোমবাতি ও হোঁচট খাওয়া চিন্তা নিয়ে ঘরে আমি সম্পূর্ণ একা৷ ব্যাপারটা কী হল? সত্যিই কি কিছু ঘটেছে? না অতক্ষণ ধরে আমি স্বপ্ন দেখেছি?…আর ঠিক তখনই সিঁড়ির দেওয়াল-ঘড়িটা যবনিকাপাতের বিচিত্র সুরে আবিষ্কার করল, রাত একটার ঘণ্টা বাজানোর পক্ষে সময়টা বেশ জমে উঠেছে৷ সুতরাং!—ঢং! ব্যস্, আমার শ্যাম্পেন ও হুইস্কির তাবৎ নেশা তখন কেটে গেছে৷ আর কেমন যেন অদ্ভুত লাগছে—ভীষণ অদ্ভুত৷ ওঃ ভগবান!
চুরুটের ছাইটাকে এক মুহূর্তে সে জরিপ করল, তারপর বলল, ‘এই-ই সব৷
তারপর তুমি ঘুমোতে চলে গেলে? ইভান্স প্রশ্ন করল৷
তাছাড়া আর কী করব?
আমি উইশের চোখে তাকালাম৷ আমরা সবাই মিলে ক্লেটনকে ব্যঙ্গ করতে চাইলাম, কিন্তু ওর কথায় ও ব্যবহারে এমন কিছু একটা ছিল যে শেষ পর্যন্ত সেটা আর পেরে উঠলাম না৷
আর সেই হাত নাড়ার কায়দাগুলো? বলল স্যান্ডারসন৷
ওগুলো আমি এখনই করে দেখাতে পারি৷
তাই নাকি৷ একটা পেনসিল-কাটা ছুরি বের করে পাইপের গর্তের ভেতরটা চাঁছতে চাঁছতে বলল স্যান্ডারসন, তাহলে করে দেখাও!
দেখাচ্ছি—বলল ক্লেটন৷
দেখ, ওতে কোনো কাজ হবে না—ইভান্স বলল৷
কিন্তু, যদি হয় তাহলে—আমি বলতে চেষ্টা করলাম৷
জানো, আমার মনে হচ্ছে, এ সব নিয়ে ছেলেমানুষী না করাই ভালো, বলল উইশ, তারপর পা ছড়িয়ে আয়েস করে বসল৷
উইশের সঙ্গে আমাদের বিতর্ক শুরু হল৷ তার মতে ওই সব ভঙ্গী যদি ক্লেটন নকল করতে যায় তাহলে সেটা একটা গুরুতর ব্যাপার নিয়ে ভীষণ ঠাট্টা করা হবে৷ কিন্তু গল্পটার এক বর্ণও কি তোমার বিশ্বাস হয়? আমি জানতে চাইলাম৷
উইশ চকিতে চোখ ফেরাল ক্লেটনের দিকে৷ সে তখন অগ্নি-আধারের জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেন ওজন করে দেখছে৷
হ্যাঁ, বিশ্বাস হয়—অর্ধেকেরও বেশি বিশ্বাস হয়—উইশ বলল৷
ক্লেটন—আমি বললাম, তোমার গল্পের গাঁজাখুরি ধরে ফেলা আমাদের কম্মো নয়৷ গল্পটা এমনি ঠিকঠাকই ছিল, কিন্তু ওই অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা…তুমি আমাদের মনে একেবারে সত্যি ঘটনার মতো গেঁথে দিয়েছ৷ নাও বাবা, এবারে স্বীকার করে ফেল যে পুরোটাই গুল-তাপ্পি ছাড়া আর কিছু নয়৷
আমার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে ক্লেটন উঠে দাঁড়াল, অগ্নি-আধারের সামনে বিছানো কার্পেটের ঠিক মাঝখানটায় গিয়ে থামল, এবং ঘুরে দাঁড়াল আমার দিকে মুখ করে৷ এক মুহূর্ত সে নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবল, তারপর সারাটাক্ষণই তার চোখ গভীর মনোযোগে স্থির হয়ে রইল মুখোমুখি দেওয়ালের ওপর৷ ধীরে ধীরে সে তার দু’হাত তুলে ধরল চোখের সমান্তরাল করে, এবং শুরু করল…
এখানে বলে রাখা ভালো, প্রাচীন এবং বর্তমান স্থাপত্য কর্মের নানান্ রহস্য নিয়ে স্যান্ডারসন অনেক গবেষণা করেছে৷ ফলে ক্লেটনের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গী সে রক্তাভ চোখে গভীর আগ্রহে লক্ষ্য করতে লাগল৷ ক্লেটনের শেষ হলে সে বলল, মন্দ নয়৷ তুমি জোড়াতালি দিয়ে মোটামুটি ভালোই দেখিয়েছ, তবে একটা ছোট্ট জায়গা বাদ পড়ে গেছে৷
জানি—ক্লেটন বলল, তারপর হাত ছুড়ে, দুলিয়ে, ছোট্ট এক অদ্ভুত মোচড় দিয়ে থামল, এই-টা তো? ভূতটা তো এই জায়গাটাই বার বার ভুলে যাচ্ছিল৷ দাঁড়াও, এবার পুরোটা তোমাদের প্রথম থেকে করে দেখাই৷
অস্তমিত আগুনের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসল ক্লেটন৷ কিন্তু আমার যেন মনে হচ্ছে, সেই হাসিতে সামান্য ইতস্তত ভাব ছিল৷ সে বলল, তাহলে শুরু করছি—
আমি হলে কিন্তু করতাম না—বলল উইশ৷
না না, ঠিক আছে৷ ইভান্স বলল, পদার্থ অবিনশ্বর৷ তোমার কি ধারণা এ সব ভোজবাজি ক্লেটনকে অশরীরী জগতে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে? মোটেই না৷ আমি তো বলব, ক্লেটন ভায়া, যতক্ষণ না তোমার হাতজোড়া কাঁধ থেকে খুলে পড়ে যাচ্ছে ততক্ষণ তুমি চেষ্টা করে যাও৷
আমার মত তা নয়—উঠে দাঁড়াল উইশ, এগিয়ে এসে ক্লেটনের কাঁধে হাত রাখল, যে করে হোক তোমার গল্পটা আমাকে তুমি অর্ধেকেরও বেশি বিশ্বাস করিয়ে দিয়েছ, ফলে আমি চাই না তুমি এসব নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করো৷
হায় কপাল! উইশ দেখছি ভয় পেয়ে গেছে৷ আমি বললাম৷
হ্যাঁ, ভয় পেয়েছি! আমার দিকে ফিরে তীব্র গলায় বলল উইশ, আমার ধারণা ওইসব হাতের ভঙ্গী ঠিক ঠিক নকল করলে ক্লেটনও উধাও হয়ে যাবে৷ উইশের মনোভাব হয় সত্যি, নয়তো বলতে হয়, ও অভিনয় প্রশংসা করার মতো৷
ও সব কিছু হবে না—আমি চিৎকার করে বললাম, এ পৃথিবীকে ফাঁকি দেবার একটাই মাত্র উপায় মানুষের হাতে আছে, আর সে হতে ক্লেটনের এখনও তিরিশ বছর দেরি৷ তাছাড়া…ওই রকম একটা ভূত! তোমার কী মনে হয়?
গতিশীল হয়ে আমাকে বাধা দিল উইশ৷ ছড়িয়ে থাকা চেয়ারের বৃত্ত ছেড়ে সে এগিয়ে এলো, টেবিলের পাশে এসে থমকে দাঁড়াল৷
ক্লেটন—সে বলল, তুমি একটা বোকা৷
রসিকতার আলো দু’চোখে ঝিকিয়ে হাসি ফিরিয়ে দিল ক্লেটন৷
উইশ ঠিকই বলেছে৷ তোমাদের ধারণা ভুল—ক্লেটন বলতে শুরু করল৷ আমিও উধাও হয়ে যাব৷ এই সব হাত নাড়াচাড়ার বিচিত্র ভঙ্গী যেই শেষ হবে, বাতাস কাটার শব্দের রেশ যখন শিস দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে অমনি—হুস্!—এই কার্পেট পড়ে থাকবে সম্পূর্ণ খালি, অবাক বিস্ময়ে সারাটা ঘর হয়ে যাবে স্তম্ভিত, এবং পনেরো স্টোন ওজনের সুবেশ এক ভদ্রলোক টুপ্ করে গিয়ে পড়বে অশরীরী জগতে৷ এতে আমার এতটুকু সন্দেহ নেই৷ তোমাদেরও থাকবে না৷ ফালতু তর্কের মধ্যে আমি আর যেতে চাই না৷ সোজাসুজি চেষ্টা করেই দেখা যাক৷
না! চিৎকার করে সামনে এক পা এগিয়ে এলো উইশ এবং পরক্ষণেই থমকে দাঁড়াল৷ কারণ ক্লেটন তখন হাত তুলে সেই প্রেতাত্মার হাত নাড়ার ভঙ্গীগুলো আবার নকল করতে শুরু করেছে৷
ততক্ষণে আমরা এক অদ্ভুত উত্তেজনার চরমে পৌঁছে গেছি—বিশেষ করে উইশের আচরণের জন্য৷ ক্লেটনের দিকে নিশ্চল চোখ রেখে আমরা সকলে বসে আছি৷ বিশেষ করে আমার তখন এক বিচিত্র কঠিন নিঃসাড় অবস্থা, যেন আমার মাথার পিছন থেকে ঊরুর মাঝামাঝি পর্যন্ত গোটা শরীরটা ইস্পাতে পরিণত হয়ে গেছে৷ আর ক্লেটন এক অদ্ভুত শান্ত মুখভাব নিয়ে নিজের অবয়ব ঝুঁকিয়ে দুলিয়ে ওর হাত নাড়াচাড়ার ভঙ্গী করে চলল৷ যতই সে শেষের দিকে এগোতে লাগল ততই আমাদের উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল, একটা হিমেল হাওয়া যেন আমাদের চোখ মুখ ছুঁয়ে গেল৷ শেষ ভঙ্গীটুকু ছিল হাত দুটোকে টান টান করে দু’পাশে ছড়িয়ে দেওয়া এবং তার সঙ্গে মুখ তুলে ধরা৷ যখন সে যবনিকা পতনের কায়দায় হাত দুটো দু’পাশে ছড়িয়ে দিল, আমার শ্বাসপ্রশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে এল৷ যদিও মানছি, এর কোনো মানে হয় না৷ তবে ব্যাপারটা অনেকটা যেন ছমছমে ভূতুড়ে গলার মতো৷ রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর অদ্ভুত ছায়াময় এক বাড়ির ভেতর বসে এই ঘটনার সাক্ষী থাকা৷ মনে মনে ভাবতে থাকলাম, সত্যিই কি শেষ পর্যন্ত ও—?
মুখ ওপরে তুলে, দু’হাত দু’পাশে ছড়িয়ে, নিশ্চিন্ত উজ্জ্বল অভিব্যক্তি নিয়ে ঝুলন্ত আলোর আভায় এক বিস্ময়কর মুহূর্ত ধরে দাঁড়িয়ে রইল ক্লেটন৷ সেই একটা মুহূর্ত আমাদের কাছে যেন একটা যুগ৷ আর তার পরেই আমাদের বুক ভেদ করে বেরিয়ে এল স্বস্তির এক অনন্ত দীর্ঘশ্বাস এবং আশ্বস্ত হওয়ার একগুচ্ছ অস্ফুট শব্দ, না! কিছুই হয়নি৷ কারণ, চোখের সামনেই দেখছি ক্লেটন অদৃশ্য হয়নি৷ ব্যাপারটা পুরোটাই বোগাস৷ আসলে সে একটা গাঁজাখুরি গপ্পো ফেঁদে সেটা আমাদের প্রায় বিশ্বাস করানোর জন্য এত কাণ্ড করে চলেছে!
…ঠিক তক্ষুনি ক্লেটনের মুখটা পাল্টে যেতে লাগল৷
এই পালটে যাওয়াটা যেন কোন আলো ঝলমলে বাড়ির সমস্ত আলো পলকে নিভিয়ে দেবার মতো৷ ওর চোখ হঠাৎই হয়ে গেল স্থির, অচল, অনড়, ঠোঁটের হাসি গেঁথে গেল ঠোঁটের ওপরেই৷ পাথরের মূর্তির মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ক্লেটন৷ শুধু ওর শরীরটা অল্প অল্প দুলতে লাগল৷
সেই মুহূর্তটাও যেন একটা যুগ৷ তারপরই শোনা গেল চেয়ার নাড়াচাড়ার শব্দ, জিনিসপত্র পড়ে যাবার শব্দ, এবং আমরা ব্যস্ত হয়ে উঠলাম৷ ক্লেটনের হাঁটুজোড়া যেন হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিল, ও হুমড়ি খেয়ে পড়ল সামনের দিকে৷ পলকে উঠে দাঁড়িয়ে ইভান্স ওকে ধরে ফেলল দু’হাতে…
আমরা সকলে স্তম্ভিত৷ অন্তত এক মিনিট কেউ গুছিয়ে কোনো কথা বলতে পারল না৷ আমরা বিশ্বাস করছি, আবার বিশ্বাস করতেও পারছি না…জটিল হতবুদ্ধি ভাব কাটিয়ে যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম, তখন দেখি, আমি ক্লেটনের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে আছি, ওর খাটো কোট ও জামা ছিঁড়ে ফেলে স্যান্ডারসন ওর বুকে হাত রেখে পরীক্ষা করে দেখছে…
এ রহস্যের প্রকৃত সমাধান করা আমার জ্ঞান ও বুদ্ধির বাইরে৷ ভৌতিক যাদুমন্ত্রের কোনো হাত এতে আছে কিনা আমি জানি না৷ আমি শুধু এটুকু বলতে পারি যে হাত নাড়াচাড়ার সেই অদ্ভুত প্রক্রিয়া যে মুহূর্তে ওর শেষ হল, ঠিক সেই মুহূর্তেই ওর চেহারা পুরোপুরি পালটে গেছে, ও হুমড়ি খেয়ে পড়েছে আমাদের চোখের সামনে—এবং মারা গেছে!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন