অনীশ দেব
একথা ঠিক যে চোখে দেখা প্রমাণকে মেনে না নিয়ে উপায় নেই, টুম্বিল বলল, আর যখন চোখ ও কানের মধ্যে কোন বিবাদ থাকে না, তখন তো সন্দেহের কোন প্রশ্নই ওঠে না৷
সব সময় তা হয় না, ছোট্ট করে বলে উঠল সিঙ্গলটন৷
প্রত্যেকেই ঘুরে তাকাল সিঙ্গলটনের দিকে৷ অগ্নি-আধারের দিকে পিছন ফিরে তার কাছাকাছি পাতা গালিচার ওপর দু-পা ফাঁক করে দাঁড়িয়েছিল টুম্ব্লি৷ তার উপস্থিতির প্রভাব বরাবরের মতই সারা ঘরে জাঁকিয়ে বসেছে৷ আর সিঙ্গলটন, রোজকার মতো, ঘরের এক কোণে যথাসম্ভব জড়োসড়ো হয়ে বসে রয়েছে৷ কিন্তু যখন সে কথা বলে, তখন তা না শুনে উপায় থাকে না৷ সুতরাং আমরা সকলেই ঘুরে তাকালাম তার দিকে৷ আমাদের প্রত্যাশাভরা নীরবতা যেন গল্পকারকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে৷
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে বলল, আফ্রিকায় আমার চোখে দেখা, কানে শোনা, একটা ঘটনা ভাবছিলাম—
ঘরের সবাই পলকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়ে বসল, প্রতিটি চোখ সিঙ্গলটনের ওপর নিবদ্ধ, নতুন করে কয়েকটা চুরুটে আগুন ধরানো হল৷ সিঙ্গলটনও একটা ধরালো, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সেটা নিভে গেল, আর সে দ্বিতীয়বার সেটা ধরাবার চেষ্টা করল না৷
পিগমিদের আবিষ্কারের আশায় আমরা তখন গ্রেট ফরেস্ট-এ ঘোরাঘুরি করছি৷ ভ্যান রিটেন-এর এক বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে স্ট্যানলি ও অন্যান্যরা যে সব বামনদের আবিষ্কার করেছেন তারা সাধারণ নিগ্রো ও আসল পিগমিদের মিশ্রণে জন্ম নেওয়া বর্ণসঙ্কর ছাড়া আর কিছুই নয়৷ ভ্যান রিটেন-এর আশা ছিল, সে এমন এক জাতের মানুষ আবিষ্কার করবে যারা বড় জোর ফুট তিনেক লম্বা, কি তারও কম৷ তখনও আমরা, সে-রকম জাতের কোন মানুষের সন্ধান পাইনি৷
আদিবাসীদের সংখ্যা খুবই কম, শিকারও সচারাচর চোখে পড়ে না, শিকার ছাড়া খাদ্য বলতে আর কিছুই নেই, চারদিকে গভীর ঘন স্যাঁতস্যাঁতে জঙ্গল৷ যে সব আদিবাসীর সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছে তারা এই প্রথম সাদা চামড়ার মানুষ দেখছে, এবং বেশির ভাগই কোনদিন সাদা মানুষের নামও শোনেনি৷ আকস্মিক ভাবে, একদিন সন্ধ্যা মুখোমুখি, জনৈক ইংরেজ আমাদের তাঁবুতে এল শ্রান্ত ক্লান্ত জীর্ণ চেহারা৷ তার কথা আমরা কারো কাছেই শুনিনি, সে কিন্তু আমাদের কথা শুনেছে এবং পাঁচ দিন অক্লান্ত পরিশ্রমে পায়ে হেঁটে আমাদের তাঁবুতে এসে পৌঁছেছে৷ তার গাইড ও কুলি দুজনও একই রকম পরিশ্রান্ত৷
ইংরেজ লোকটির নাম ইচাম৷ বিনয়ের সঙ্গে সে নিজের পরিচয় দিল, এবং আমাদের সঙ্গে বসে এত স্বাভাবিক শান্তভাবে খেতে লাগল যে বিশ্বাসই করা যায় না, গত পাঁচ দিনে সে মাত্র তিনবার সামান্য কিছু খেয়েছে, এ কথা আমাদের কুলিরা ইচামের কুলিদের কাছ থেকে জানতে পেরেছিল৷ খাওয়া-দাওয়ার পর ধূমপানে ব্যস্ত হয়ে সে তার আসার কারণ খুলে বলল৷
আমাদের বড় সাহেবের অবস্থা খুব খারাপ, ধোঁয়া ছাড়ার ফাঁকে সে বলল, এই ভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে তাঁর বাঁচার কোন আশা নেই৷ আমি ভাবছিলাম, যদি…
স্পষ্ট সহজ সুরে কথাগুলো সে বললেও আমি লক্ষ্য করলাম, তার খোঁচা খোঁচা গোঁফের নীচে ছোট ছোট ঘামের ফোঁটা চকচক করছে৷ নির্দয় প্রকৃতির মানুষ ভ্যান রিটেনকে দেখে বিচলিত হয়েছে বলে মনে হল না৷ সে একমনে শুনতে লাগল৷ আমি অবাক হলাম৷ কারণ সে এক কথায় সাফ প্রত্যাখ্যান করার মানুষ৷ অথচ দিব্যি ইচামের হোঁচট খাওয়া দ্বিধায় ভরা কথায় টুকরোগুলো শুনে চলেছে৷ এমন কি কয়েকটা প্রশ্নও করল৷
কে তোমার বড় সাহেব?
স্টোন—তোতলা স্বরে বলল ইচাম৷
আমরা দুজনেই তড়িৎস্পৃষ্ঠের মতো চমকে উঠলাম৷
র্যাল্ফ্ স্টোন? আমাদের ঠোঁট চিরে একই সঙ্গে বেরিয়ে এল৷
ইচাম মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল৷
কয়েক মিনিট আমি ও ভ্যান রিটেন চুপ করে রইলাম৷ ভ্যান রিটেনকে কখনও না দেখলেও আমি ওর সঙ্গে কলেজে পড়েছি, অনেক দিন তাঁবুর বাইরে ধুনী জ্বেলে আমরা ওর বিষয়ে আলোচনাও করেছি৷ বছর দুয়েক আগে বালুণ্ডা দেশের দক্ষিণ ল্যুবোতে এক আদিবাসী রোজার সঙ্গে ওর নাটকীয় শত্রুতার কথা আমাদের কানে এসেছিল৷ অবশেষে সেই ডাইনী রোজা স্টোনের কাছে পরাজিত হয়, এবং তার উপজাতির সকলেই উচিত শিক্ষা পায়৷ এমন কি জাদুকর রোজার বাঁশিটা ভেঙেচুরে তার টুকরোগুলো স্টোনকে দেওয়া হয়৷ এ নিয়ে বালুণ্ডা তখন বেশ সরগরম ছিল৷
আমরা ভেবেছিলাম, স্টোন আফ্রিকা ছেড়ে চলে গেছে, আর না গেলেও দূর কোন প্রান্তে রয়েছে৷ কিন্তু ঘটনাচক্রে দেখছি সে আমাদের কাছাকাছিই রয়েছে, এবং সম্ভবত আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য বানচাল করে দেবে৷
ইচাম-এর মুখে স্টোনের নাম শুনতেই আমার সমস্ত পুরোনো কথা মনে পড়তে লাগল৷ মনে আছে, দ্বিতীয় বিয়ের কিছুদিন পরই ও অন্ধকার মহাদেশ আবিষ্কারের নেশায় ঘরছাড়া হয়েছিল৷ ভ্যান রিটেন মনে মনে যা-ই ভাবুক মুখে প্রশ্ন করল, ল্যুবোতে স্টোনের সঙ্গে তুমি ছিলে?
না—ইচাম বলল, ওয়ার্ণার ছিল৷ সে মারা গেছে৷ আমি স্টোনের দলে ঢুকেছি স্ট্যানলি জলপ্রপাতের কাছে৷
ওর সঙ্গে আর কে কে আছে?
শুধু জাঞ্জিবারের বেয়ারা আর চাকর-বাকর—ইচাম উত্তর দিল৷
বেয়ারাগুলো কোন্ জাতের? ভ্যান রিটেন জানতে চাইল৷
মং-বাটু—ইচাম সহজ সুরে বলল৷
এতে আমি আর ভ্যান রিটেন দারুণ অবাক হলাম৷ কোন দলের নেতা হবার যে জন্মগত স্বাভাবিক গুণ স্টোনের ছিল, এ যে তার নতুন প্রমাণ৷ কারণ আজ পর্যন্ত তাদের দেশের বাইরে মং-বাটুদের দিয়ে কেউ বেয়ারার কাজ করাতে পারেনি৷ তাছাড়া, খুব দুর্গম বা দূরদেশ অভিযানেও তাদের পাওয়া যেত না৷
মং-বাটুদের মধ্যে তোমরা কত দিন ছিলে? ভ্যান রিটেনের পরের প্রশ্ন৷
কয়েক সপ্তা—ইচাম উত্তর দিল, স্টোন ওদের কথাবার্তা ভাষা শিখে ফেলেছিলেন৷ তাঁর ধারণা হয়েছিল, এই মং-বাটুরা বালুণ্ডা জাতেরই একটা শাখা৷ এবং পরে ওদের আচার ব্যবহার দেখে তাঁর সে ধারণা আরও জোরদার হয়েছিল৷
স্টোনের এই অবস্থা কদ্দিন?
এক মাসের কিছু বেশি৷ একটু থেমে ইচাম যোগ করল, আমার নিজের শরীরটাও খুব ভালো ঠেকছে না…
তোমাদের সাহেবের আসলে হয়েছেটা কী? ভ্যান রিটেন জানতে চাইল৷
কার্বাঙ্কলের মতো বড় বড় ফোঁড়া৷
এ রকম দু-একটা ফোঁড়া আর তেমন কি—ভ্যান রিটেন মন্তব্য করল৷
এগুলো ঠিক কার্বাঙ্কল নয়—বিশদ হতে চাইল ইচাম, তাছাড়া একটা দুটো তো হয়নি, একসঙ্গে অনেকগুলো করে হচ্ছে৷ কখনও পাঁচটা কিংবা সাতটা—এই রকম৷ এগুলো যদি সতিই কার্বাঙ্কল হত, তাহলে সাহব বোধ হয় আর বাঁচতেন না৷ তবে অন্যদিক থেকে এগুলো কার্বাঙ্কলের চেয়েও খারাপ৷
তার মানে?
মানে—একটু ইতস্তত করে ইচাম বলল, কার্বাঙ্কলের মতো এই ফোঁড়াগুলো তত গভীর বা ছড়ানো নয়, সে রকম যন্ত্রণাও নেই, জ্বরও হয় না৷ কিন্তু এই রোগ থেকে মনে হয় মানসিক রোগ দেখা দেয়৷ প্রথমটার বেলা আমি পটি বেঁধে দিয়েছি, কিন্তু অন্যগুলো তিনি খুব কায়দা করে আমাদের নজর থেকে লুকিয়ে রেখেছেন৷ ওগুলো খুব ফুলে উঠলে স্টোন আস্তানা ছেড়ে বাইরে বেরোন না, আর আমাকে পটি পাল্টাতেও দেন না বা কাছে থাকতে বলেন না৷
ব্যান্ডেজ তোমাদের হাতে কী রকম আছে? ভ্যান রিটেন প্রশ্ন করল৷
আছে মোটামুটি—চিন্তিত স্বরে ইচাম বলল, কিন্তু উনি ও সব ব্যবহার করতে চান না৷ একই ব্যান্ডেজ বার বার ধুয়ে ব্যবহার করেন৷
আর ফোঁড়াগুলোর কী চিকিৎসা করছে?
ক্ষুর দিয়ে কেটে সমান করে দিচ্ছে৷
কী! প্রায় চিৎকার করে উঠল ভ্যান রিটেন৷
ইচাম কোন উত্তর দিল না, কিন্তু এক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল৷
কিছু মনে কর না—ভ্যান রিটেন তাড়াতাড়ি বলে উঠল, তুমি আমাকে ভীষণ চমকে দিয়েছিলে৷ না, ওগুলো তাহলে কার্বাঙ্কল নয়৷ কার্বাঙ্কল হলে অনেক আগেই স্টোন মারা যেত৷
সে তো আপনাকে আগেই বলেছি—অস্ফুট ভাবে বলল ইচাম৷
স্টোন নিশ্চয়ই পাগল হয়ে গেছে—অবাক স্বরে মন্তব্য করলর ভ্যান রিটেন৷
ঠিক তাই—ইচাম বলল, আমার কথাবার্তা কিছুই শুনছেন না৷
এ রকম ভাবে ক’টা কার্বাঙ্কলের চিকিৎসা ও করেছে?
দুটো—অন্তত আমি তাই জানি৷ মাথা নীচু করে বলল ইচাম, যেন লজ্জা পেয়েছে, কুঁড়েঘরের দেওয়ালের ফাটল দিয়ে আমি দেখেছি৷ সাহেব হয়তো কোন ভর হওয়ায় এ সব কাণ্ড করছেন, এ কথা ভেবে আমি সব সময় তাঁর ওপর নজর রাখার চেষ্টা করেছি৷…আমার বিশ্বাস, বাকি ফোঁড়াগুলোও উনি একইভাবে চিকিৎসা করেছেন৷
খাওয়া দাওয়া কী রকম করছে? ভ্যান রিটেন জিগ্যেস করল৷
একেবারে নেকড়ের মতো৷ দুটো বেয়ারার চেয়েও বেশি৷ ইচাম বলল৷
হাঁটতে পারছে?
সামান্য হামাগুড়ি দিয়ে চলতে পারেন, তবে যন্ত্রণায় চিৎকার করেন—সহজ গলায় ইচাম জবাব দিল৷
জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে?
মাত্র দুবার—ইচাম বলল, প্রথম ফোঁড়াটা ফেটে যাবার পর একবার, আর পরে একবার৷ তখন উনি কাউকে কাছে আসতে দেন না৷ কিন্তু আমরা শুনতে পেতাম, উনি কথা বলছেন৷ এতে আদিবাসীরা ভীষণ ভয় পেয়েছিল৷
প্রলাপ বকছে কি আদিবাসীদের ভাষায়? ভ্যান রিটেন জানতে চাইল৷
না, তবে ওই জাতীয় অন্য কোন ভাষায়৷ হামিদ বুরগাশ বলছিল, উনি বালুণ্ডার ভাষায় কথা বলছেন৷ বালুণ্ডা ভাষা আমি ঠিক জানি না, তবে মনে হচ্ছিল কয়েকটা শব্দের সঙ্গে মং-বাটুর শব্দের মিল আছে৷ যাই হোক, মং-বাটু বেয়ারারা ভীষণ ভয় পেয়েছিল৷ শুধু ওরা নয়, জাজ্জিবারর লোকেরাও ভয় পেয়েছে, এমন কি হামিদ বুরগশি আর আমিও বাদ পড়িনি৷ তবে আমাদের ভয়ের কারণ অন্য৷ স্টোন সাহেব দু’রকম গলায় কথা বলছিলেন৷
দু’রকম গলায়? ভ্যান রিটেন যেন প্রতিধবনি তুলল৷
হ্যাঁ—ইচাম বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়ল, দুরকম গলায়, যেন দুজন লোক কথা বলছে৷ একটা তাঁর নিজের গলা, আর অন্যটা সরু তীক্ষ্ণ স্বর৷ এ রকম স্বর আমি কখনও শুনিনি৷ স্টোন সাহেবের কথার দু’একটা শব্দ আমি বুঝতে পেরেছিলাম—অনেকটা আমার জানা মং-বাটু শব্দের মতো৷ যেমন, নেদ্রু, মিটিবাবা, আর নিদো—এগুলোর মানে হল মাথা, কাঁধ আর ঊরু, সরু গলায় যে সব চিৎকার শুনতে পাচ্ছিলাম, তার মধ্যে খুন, মৃত্যু, ঘৃণা এই শব্দ তিনটে আমি পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি৷ হামিদ বুরগাশও এই কথাগুলো শুনতে পেয়েছে৷ ও আমার চেয়ে অনেক ভালো মং-বটু ভাষা জানে৷
বেয়ারারা কী বলছিল? ভ্যান রিটেন জানতে চাইল৷
ওরা খালি বলছিল, ‘লুকুণ্ডু, লুকুণ্ডু!’ এ শব্দটার মানে আমি জানতাম না, হামিদ বুরগাশ বলল যে এটা মং-বাটু শব্দ—মানে চিতাবাঘ৷ ইচাম বলল৷
না, এর মানে ডাকিনী-বিদ্যা—ভ্যান রিটেন বলল৷ তারপর প্রশ্ন করল, দুটো স্বর কি একই সঙ্গে শোনা যাচ্ছিল, না একটা অন্যটার উত্তর দিচ্ছিল?
ইচামের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল৷ ভাঙা গলায় ও উত্তর দিল, কখনও কখনও দুটো স্বরই একসঙ্গে শোনা যাচ্ছিল৷
একসঙ্গে! ভ্যান রিটেনের ঠোঁট চিরে বেরিয়ে এল৷
শুনে তো সবার ওই রকমই মনে হয়েছিল৷ একটু থামল ইচাম, তারপর জিগ্যেস করল, আচ্ছা, বলুন তো, কোন মানুষ কী একই সঙ্গে কথা বলতে আর শিষ দিতে পারে?
তার মানে? ভ্যান রিটেন প্রশ্ন করল৷
স্টোনের কথা আমরা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম—গম্ভীর, ভারী, শান্ত কণ্ঠস্বর৷ আর তারই সঙ্গে সঙ্গে শোনা যাচ্ছে তীক্ষ্ণ জোরালো এক শিসের শব্দ, সেই শব্দে মেশানো রয়েছে এক অদ্ভুত শ্বাসের টান৷ জানেন তো, যতই জোরে একটা বুড়ো লোক শিস দিক না কেন, তার সুর কোন ছেলে, বাচ্চা মেয়ে যুবতীর শিসের সুরের চেয়ে আলাদা৷ যে কোন কারণেই হোক, বয়স্ক লোকদের শিসের সুর অনেক ভারী হয়৷ একটা খুব ছোট্ট মেয়ে যদি একটানা শিস দিয়ে যায়, তাহলে যে রকম শোনায়, ওই শিসের শব্দটা ঠিক সেই রকম৷ তবে অনেক বেশি তীক্ষ্ণ ও তীব্র, আর ওটা শোনা যাচ্ছিল স্টোনের গম্ভীর গলা ছাপিয়ে৷
তোমরা ওর কাছে গিয়েছিলে? ভ্যান রিটেন উত্তেজিত স্বরে জানতে চাইল৷
না, যাইনি—বলল ইচাম, কারণ তাঁর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, এই সময়ে কেউ যেন তাঁর কাছে না যায়৷ যদি যায়, তাহলে তাকে মরতে হবে৷ তাঁর কথার চেয়েও আচরণে আমরা বেশি ভয় পেয়েছি৷ এ যেন কোন রাজা তাঁর মৃত্যুশয্যায় পবিত্র নির্জনতা রক্ষা করতে আদেশ করছেন৷
ও—ভ্যান রিটেন সংক্ষিপ্ত মন্তব্য করল৷
সাহেবের অবস্থা খুব খারাপ—অসহায় সুরে বলল ইচাম, যদি আপনারা…
স্টোনের প্রতি ইচামের মমতা, ভালোবাসা তার রীতিমাফিক আচরণের খোলস ছাপিয়ে ফুটে বেরোচ্ছে৷ বোঝা যাচ্ছে, স্টোনের পুজোই তার একমাত্র ব্রত৷
অন্যান্য অনেক দক্ষ মানুষের মতো ভ্যান রিটেন-এর মধ্যেও কিছুটা কঠিন স্বার্থপরতাবোধ রয়েছে৷ এবারে সেটা প্রকাশ পেল৷ সে বলল, আমরাও স্টোনের মতো প্রাণ হাতে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি, যে কোন দুজন অভিযাত্রীর মধ্যে রক্ত ও অনুভূতির বন্ধন সে অস্বীকার করে না, কিন্তু এক্ষেত্রে মরণাপন্ন একজন অভিযাত্রীর জন্য কোন অভিযাত্রী দলের মৃত্যুর মুখে ঝঁপিয়ে পড়াটা নেহাৎই বোকামি মাত্র—ইত্যাদি ইত্যাদি৷
ভ্যান রিটেন-এর যুক্তি তর্কের সামনে ইচাম নির্বিকার অথচ অপরাধী ভঙ্গীতে বসে রইল৷ যেন প্রধান-শিক্ষকের সামনে কোন ইসুকলের চেলে চুপচাপ বকুনি খেয়ে চলেছে৷ অবশেষে ভ্যান রিটেন বলল, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি পিগমিদের খোঁজে এসেছি৷ শুধু পিগমিদের খোঁজে৷
তাহলে দেখুন তো, এগুলো হয়তো আপনার কৌতূহলের খোরাক জোগাতে পারে—খুবই শান্ত গলায় ইচাম বলল৷
খাটো জামার পাশ-পকেট থেকে দুটো জিনিস বের করে সে ভ্যান রিটেন-এর হাতে দিল৷ জিনিস দুটো গোল, আকারে কুলের চেয়ে সামান্য বড়, পাঁচফলের চেয়ে অল্প ছোট৷ হাতের চেটোয় মুঠো করে ধরা পক্ষে ঠিক মাপের৷ জিনিস দুটোর রঙ কালো৷ প্রথমটা আমি ওগুলো ভালো করে দেখার চেষ্টা করিনি৷
পিগমি! অস্ফুটে চিৎকার করে উঠল ভ্যান রিটেন, সত্যিকারের পিগমিই বটে!
আরে, এরা দেখছি দু-ফুটের বেশি লম্বা হবে না৷ তুমি বলতে চাও এগুলো প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মাথা?
আমি কিছুই বলতে চাই না—ইচাম বলল, আপনি নিজের চোখেই দেখুন৷
একটা মাথা ভ্যান রিটেন আমার দিকে এগিয়ে দিল৷ অস্তায়মান সূর্যের আলোয় সেটা খুব কাছ থেকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখলাম৷ মাথাটা শুকিয়ে নিখুঁত ভাবে সংরক্ষিত করা হয়েছে, এবং পেশীগুলো অসম্ভব শক্ত৷ যেখানে কেটে নেওয়া গলার চামড়া কুঁচকে ভাঁজ হয়ে রয়েছে সেখান থেকে কশেরুকার অংশবিশেষ বাইরে বেরিয়ে আছে৷ ছুঁচলো চোয়ালের ওপর ক্ষুদে থুতনিটুকু বেশ চোখে পড়ে, টান টান হয়ে সরে যাওয়া ঠোঁটের ফাঁকে ছোট ছোট সাদা দাঁত সমান ভাবে সাজানো, ছোট্ট নাকটা চ্যাপটা, কপাল উঁচু ও চওড়া, লিলিপুট মাথায় মসৃণ চামড়ার ওপর এখানে ওখানে চোখে পড়ে থোকা থোকা পশমী চুলের বনসাই ঝোপ৷ না, বাচ্চা, ছেলেমানুষ, বা যুবক—এরকম কোন ছাপই মুখটার মধ্যে নেই, বরং কোন প্রৌঢ়ের বয়েসের ছাপই সেখানে চোখে পড়ে৷
এগুলো কোত্থেকে পেয়েছ? ভ্যান রিটেন প্রশ্ন করল৷
জানি না—ইচামের নিখুঁত উত্তর শোনা গেল, ওষুধের খোঁজে স্টোন সাহেবের জিনিসপত্র হাঁটকাতে গিয়ে এগুলো পেয়েছি৷ উনি কোত্থেকে পেয়েছেন তা বলতে পারছি না৷ তবে এটুকু শপখ করে বলব, এই এলাকায় ঢুকবার সময় ওগুলো তাঁর সঙ্গে ছিল না৷
ঠিক বলছ? বড় বড় চোখ ইচামের চোখে স্থির রেখে ভ্যান রিটেন জানতে চাইল৷৷
হ্যাঁ৷ ঠিকই বলছি—অস্ফুটে জবাব দিল ইচাম৷
এই মাথাগুলো তুমি পরীক্ষা করে দেখেছ?
খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি?
ভ্যান রিটেন তার নোটবই থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে সেটা ভাঁজ করে সমান তিন ভাগে ভাগ করল৷ এক টুকরো আমাকে দিল, আর এক টুকরো দিল ইচামকে৷
আমি মনে মনে একটা জিনিস ভেবেছি—ভ্যান রিটেন বলল, সেটা খতিয়ে দেখার জন্য আমি চাই, আমরা প্রত্যেক এই কাগজে মাথাগুলো দেখে আমাদের যা মনে হচ্ছে সেটা লিখে ফেলি৷ তারপর তিনটে লেখা মিলিয়ে দেখা যাবে৷
ইচামকে একটা পেন্সিল দিলাম, সে লিখতে শুরু করল৷ তার লেখা হয়ে গেলে পেন্সিলটা সে আমাকে ফিরিয়ে দিল৷ আমি লেখা শেষ করলাম৷
তিনটে লেখা পড়—নিজের লেখাটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ভ্যান রিটেন বলল৷
ভ্যান রিটেন লিখেছে ঃ বুড়ো বালুন্ডা রোজা৷
ইচাম লিখেছে, বুড়ো মং-বাটু রোজা৷
আর আমি লিখেছি ঃ বুড়ো কাটোংগো যাদুকর৷
দেখেছ! ভ্যান রিটেন উত্তেজিত হয়ে বলল, পিগমিদের সঙ্গে এই মাথাগুলোর কোন সম্পর্ক নেই৷
আমিও ভেবেছিলাম—ইচাম বলল৷
অথচ তুমি বলছ এগুলো স্টোনের কাছে আগে ছিল না?
না৷ এ কথা আমি হলপ করে বলতে পারি৷ ইচাম জোরের সঙ্গে বলল৷
ব্যাপারটা নিয়ে তাহলে একটু খোঁজ করা দরকার, ভ্যান রিটেন বলল, চল, আমি তোমার সঙ্গে যাব৷ আর সবার আগে আমি স্টোনকে বাঁচাবার চেষ্টা করব৷
সে হাত বাড়িয়ে ধরতেই প্রচণ্ড আবেগে ইচাম তার হাতে হাত মেলাল৷ ইচামের চোখে মুখে তখন শুধুই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাচ্ছে৷
একমাত্র উৎকণ্ঠার ঘোরেই হয়তো ইচাম পাঁচ দিনে আমাদের তাঁবুতে এসে পৌঁছতে পেরেছিল, কারণ ফেরার সময় চেনা পথ হওয়া সত্ত্বেও এবং আমাদের দলের সাহায্য পেয়েও তার একই রাস্তা পেরোতে আট দিন সময় লাগল৷
দেখলাম, স্টোনকে বেশ যত্ন-আত্তির মধ্যেই রাখা হয়েছে৷ ইচামের নির্দেশে উঁচু জারিবা কাঁটাগাছ দিয়ে কুঁড়েঘরগুলো ঘিরে দেওয়া হয়েছে৷ কুঁড়েঘরগুলো বেশ শক্ত পোক্ত ভাবে তৈরি, মাথার ওপর খড়ের ছাউনি দেওয়া৷ আর স্টোনের ঘরটা যতখানি ভালো ভাবে করা সম্ভব ততখানি যত্ন নিয়েই তৈরি করা হয়েছে৷ হামিদ বুরগাশ একাই মং-বাটু দলটাকে ধরে রেখেছে, একটা লোকও দল ছেড়ে পালায়নি, এবং তার নির্দেশে নিয়ম শৃঙ্খলা দিব্যি মেনে চলছে৷ এ ছাড়া সে একজন করিৎকর্মা পরিবেষক ও বিশ্বাসী ভৃত্য৷
স্টোন একটা ক্যাম্বিশের খাটে শুয়ে ছিল, খাটের পাশেই একটা খাটো ক্যাম্বিশের টেবিল৷ তার ওপরে একটা জলের বোতল, কয়েকটা ওষুধের শিশি, স্টোনের হাতঘড়ি ও খাপে ভরা ক্ষুর৷
স্টোনকে দেখে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও সবল বলেই মনে হল, কিন্তু সে যেন অন্য কোন জগতে রয়েছে, অচেতন, এক ঘোরের মাঝে ডুবে রয়েছে৷ আমরা যে ঘরে ঢুকেছি, তার সামনে দাঁড়িয়ে আমি, সেটা যেন সে দেখতেই পাচ্ছে না৷ স্টোনকে দেখা মাত্রই আমি চিনতে পারলাম৷ অবশ্য ওর তারুণ্যের তেজ ও সৌন্দর্য কোথায় মিলিয়ে গেছে৷ কিন্তু মাথার সোনালি ঢেউ খেলানো চুল এখনও সুপ্রচুর, চোয়ালের রেখার দৃঢ়তার ছাপ, মুখে অসুস্থতা জনিত কয়েক দিনের সোনালি দাড়ি৷ স্টোনের চোখের তারা ঘোলাটে, আর মুখ থেকে প্রলাপের যে সব টুকরো শোনা যাচ্ছে তা নিতান্তই অর্থহীন শব্দাংশ মাত্র৷
স্টোনের গায়ের চাদর সরাতে ও ব্যান্ডেজ খুলতে ভ্যান রিটেনকে সাহায্য করল ইচাম৷ ভ্যান রিটেন এবারে ভালো করে তাকে দেখল৷ বহুদিন শয্যাশায়ী কোন মানুষের তুলনায় স্টোনের স্বাস্থ্য বেশ ভালোই মনে হয়৷ হাঁটু, কাঁধ ও বুক ছাড়া শরীরের আর কোথাও কোন ক্ষতের দাগ নজরে পড়ল না৷ দু-হাঁটুতে ও হাঁঠুর ঠিক ওপরে অসংখ্য বৃত্তাকার শুকনো ক্ষতের চিহ্ণ দেখা যাচ্ছে৷ প্রত্যেক কাঁধের কাছেও একই ধরনের অজস্র ক্ষতচিহ্ণ৷ দু-তিনটে ক্ষত দেখে মনে হল সদ্য সদ্য করা হয়েছে, আর চার-পাঁচটা ক্ষত এখনও ভালো করে সেরে ওঠেনি৷ বুকের দু-পাশের পেশীর ওপর দু-দুটো টাটকা ফোঁড়া দেখা গেল৷ বাঁদিকেরটা ডানদিকের চেয়ে একটু ওপরে ও শরীরের পাশ ঘেঁষে বেড়ে উঠেছে৷
না, জিনিসগুলো ঠিক ফোঁড়া বা কার্বাঙ্কল নয়, তবে কোন শক্ত ভোঁতা পিণ্ড যেন স্টোনের স্বাস্থ্যমণ্ডিত মাংস ও চামড়া ভেদ করে মাথা তুলেছে৷
এ দুটো এখন কাটব না—ভ্যান রিটেনর বলল, ইচামও সায় দিল তার কথায়৷
স্টোনকে আবার পরিপাটি করে ঢাকা দেওয়া হল৷
সূর্যাস্তের ঠিক আগে ওকে আমরা আবার দেখলাম৷ সে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে৷ বুকের ছাতি বিশাল ও শক্তিশালী, কিন্তু সেই ঘোরটা যেন এখনও কাটেনি৷ ইচামকে ওর কাছে রেখে আমরা পাশের কুঁড়েঘরে গেলাম রাত কাটাতে৷ জঙ্গলের যে নৈশ গুঞ্জন কানে এল তা গত কয়েক মাসে শোনা শব্দের চেয়ে কিছু নতুন নয়, এবং খুব তাড়াতাড়িই আমি ঘুমিয়ে পড়লাম৷
ঘন জমাট অন্ধকারে হঠাৎই আবিষ্কার করলাম আমি জেগে রয়েছি এবং কান পেতে শুনতে চেষ্টা করছি৷ দুটো কণ্ঠস্বর আমার কানে এল, একটা স্টোনের অন্যটা শ্বাসটানা হিসহসে স্বর৷ প্রথম স্বরটা স্টোনের বলে চিনতে পারলেও দ্বিতীয় স্বরটা আমার অচেনা৷ সেই স্বরের শক্তি সদ্যোজাত কোন শিশুর কান্নার শব্দের চেয়েও অনেক কম, কিন্তু তার মধ্যে দূর দূরান্তে পৌঁছে যাবার এক অদ্ভুত ক্ষমতা রয়েছে৷ কান পেতে আছি, শুনতে পেলাম অন্ধকারে ভ্যান রিটেনের শ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ৷ একটু পরে সেও বুঝতে পারল আমি জেগে রয়েছি, শুনছি৷ ইচামের মতো আমিও বালুণ্ডা ভাষা খুব অল্প স্বল্পই জানি, কিন্তু তবুও দু-একটা শব্দ বেশ বুঝতে পারলাম৷ ক্ষণস্থায়ী নীরবতায় যতিচিহ্ণিত কথোপকথন শুনতে লাগলাম একমনে৷
তারপর হঠাৎই দুটো গলা একসঙ্গে দ্রুত শোনা গেল, স্টোনের গম্ভীর মেজাজী স্বর, যেন সে সম্পূর্ণ সুস্থ, আর সেই তীক্ষ্ণ হিসহিসে কণ্ঠ, দুজনেই একসঙ্গে তাড়াহুড়ো করে কথা বলছে—দুটো মানুষ ঝগড়া করছে৷
আমি আর পারছি না—বলল ভ্যান রিটেন, চল, গিয়ে দেখি৷
তার কাছে একটা চোখাকৃতি বৈদ্যুতিক নৈশ-বাতি ছিল৷ ভ্যান রিটেন সেটা হাঁতড়ে বের করল এবং বোতাম টিপে আমাকে সঙ্গে আসতে বলল৷ কুঁড়েঘরের বাইরে বেরিয়ে সে আমাকে চুপচাপ দাঁড়াতে ইশারা করল, সহজ প্রবৃত্তি বশে আলোটা নিভিয়ে দিল, যেন আলো জ্বালাতে ওর শুনতে অসুবিধে হচ্ছে৷
বেয়ারাদের জ্বালানো ধুনীর হালকা আলো ছাড়া আমরা মোটামুটি অন্ধকারেই দাঁড়িয়ে৷ গাছের পাতার গোলকধাঁধা ভেদ করে তারা আলো অতিকষ্টে ঠিকরে এসে পড়ছে, শোনা যাচ্ছে বহতা নদীর অস্ফুট ছলছল শব্দ৷ দুটো স্বর একই সঙ্গে আমরা শুনতে পাচ্ছি, কিন্তু হঠাৎই তীক্ষ্ণ হিসহিসে স্বরটা পালটে গেল এক ক্ষুরধার চেরা শিসের শব্দে৷ স্টোনের অনুযোগের খাপছাড়া কথার মাঝেই পথ কেটে নিয়ে সেই শিস নির্লজ্জ বিদ্রোহী ঢঙে পা ফেলে যেন এগিয়ে চলেছে৷
ওঃ ভগবান৷ ভ্যান রিটেন অবাক বিস্ময়ে বলে উঠল৷
হঠাৎই সে আলোটা নিভিয়ে দিল৷
ইচামকে আমরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন অবস্থায় আবিষ্কার করলরাম৷ স্বাভাবিক, কারণ এত দিনের দায়িত্বের বোঝা আজ ভ্যান রিটেনের কাঁধে তুলে দিতে পেরে সে এই মুহূর্তে দীর্ঘদিনব্যাপী দুশ্চিন্তা ও পরিশ্রমজনিত ক্লান্তির শিকার হয়ে নিজেকে গভীর অচেতনতার হাতে সঁপে দিয়েছে৷
শিষের শব্দ এখন থেমে গেছে, এবং দুটো স্বর আবার একসঙ্গে শোনা যাচ্ছে৷ দুটো স্বরই ভেসে আসছে স্টোনের খাট থেকে৷ কেন্দ্রীভূত উজ্জ্বল আলোয় দেখলাম, স্টোন চিৎ হয়ে শুয়ে আছে, শুধু তার হাত দুটো এখন মাথার ওপর দিকে রাখা এবং গায়ের চাদর তুলে বুকের ব্যান্ডেজটা সে ছিঁড়ে ফেলেছে৷
তার ডান বুকের ফোলা পিণ্ডটা ফেটে যাচ্ছে৷ ভ্যান রিটেন সেটা লক্ষ্য করে আলো ফেলতেই আমরা স্পষ্ট দেখতে পেলাম—তার গায়ের মাংস ফুঁড়ে একটা মাথা বেরিয়ে এসেছে৷ মাথাটা ইচামের দেখানো শুকনো নমুনার মতো, যেন লিলিপুট সাইজের কোন বালুণ্ডা রোজার মাথা৷ রঙ কুচকুচে কালো, আলো পড়ে চকচক করছে, ক্ষুদে ক্ষুদে পাপী চোখ দুটোর সাদা অংশ ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছে৷ নিগ্রোদের মতো পুরু লাল ঠোঁট জোড়া দেখলেই ঘেন্না হয়, সেই ঠোঁট সরে গিয়ে চোখে পড়ছে ছোট ছোট ঝকঝকে সাদা দাঁতের সারি৷ কালো মাথাটার ছোট্ট খুলির ওপর থোকা থোকা আঁশের মতো চুল৷ ওইটুকু মুখে নিখুঁত ভাবেই সমস্ত কিছু আমাদের নজরে পড়ল৷ চরম বিদ্বেষে মাথাটা এপাশ-ওপাশে ঘুরছে এবং সেই অদ্ভুত কৃত্রিম হিসহিসে স্বরে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে৷ স্টোন তারই মাঝে বাধা দিয়ে অধস্ফুটভাবে নানান প্রলাপ বকছে৷
স্টোনের দিক থেকে ফিরে ইচামকে অনেক কষ্টে জাগিয়ে তুলল ভ্যান রিটেন৷ জেগে উঠে সব দেখে শুনে ইচাম হতবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল৷
তুমি ওকে দুটো ফোঁড়া কেটে ফেলতে দেখেছ? ভ্যান রিটেন জিগ্যেস করল৷
কোন রকমে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল ইচাম৷
তাতে কি খুব রক্ত বেরিয়েছিল? ভ্যান রিটেনের স্বর উৎকণ্ঠিত৷
না, খুব অল্প—ইচাম উত্তর দিল৷
ওর হাত দুটো চেপে ধর—ইচামকে নির্দেশ দিল ভ্যান রিটেন৷
স্টোনের ক্ষুরটা তুলে নিয়ে হাতের আলোটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিল সে৷ স্টোনকে দেখে মনে হল না, সে আলো দেখতে পাচ্ছে বা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে৷ কিন্তু সেই ছোট্ট মাথাটা অস্থিরভাবে আমাদের লক্ষ্য করে চিৎকার করতে লাগল৷
ভ্যান রিটেন-এর হাত অটল স্থির, এবং সে ক্ষুরের আঘাত করল নিশ্চিত অথচ ধীর শান্ত ভঙ্গীতে৷ আশ্চর্য রকম অল্প রক্তপাত হল স্টোনের শরীর থেকে৷ তখন ভ্যান রিটেন সাধারণ ক্ষতের মতো করে সেখানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল৷
যে মুহূর্তে আঁচিলের মতো কালো মাথাটা কেটে ফেলা হল সেই মুহূর্তেই বন্ধ হয়ে গেল স্টোনের প্রলাপ৷ স্টোনের সবরকম পরিচর্যা সেরে আমার হাত থেকে আলোটা প্রায় ছিনিয়েই নিল ভ্যান রিটেন৷ তারপর একটা পিস্তল বের করে খাটের আশেপাশে মেঝেটা ভালো করে খুঁটিয়ে দেখল, ভয়ঙ্কর হিংস্রতায় পিস্তলের বাঁটটা দু-একবার মেঝেতে ঠুকল৷
আমরা ফিরে এলাম আমাদের কুঁড়েঘরে, কিন্তু সে রাতে আর ঘুমোতে পেরেছি কিনা সন্দেহ আছে৷
পরদিন দুপুর নাগাদ প্রকাশ্য দিনের আলোর স্টোনের ঘর থেকে আমরা আবার দুটো কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম৷ ইচামকে তার প্রহরার জাগয়ায় ঘুমন্ত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম৷ স্টোনের বুকের বাঁদিকের ফোঁড়াটা এবার ফেঁটে গেছে, এবং অবিকল আর একটা আবলুষ কাঠের মতো চকচকে কালো মাথা সেখানে দেখা দিয়েছে৷ মাথাটা চঞ্চলভাবে ছটফট করছে আর মিহি গলায় অবিরাম বকবক করছে৷ সেই মিহি কথার স্রোতকে বাধা দিয়ে মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে স্টোনের ভারী কণ্ঠস্বরে উচ্চারণ করা প্রলাপের অংশ৷ ইচাম ঘুম ভেঙে উঠল, এবং আমরা তিনজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিস্ফারিত চোখে সব দেখতে লাগলাম৷
ভ্যান রিটেন স্টোনের ক্ষুরটা তুলে নিয়ে খাটের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল৷ পুঁচকে মাথাটা তাকে লক্ষ্য করে হিসহিসে তীব্র স্বরে খিঁচিয়ে উঠতে লাগল৷
তখনই হঠাৎই স্টোন বলে উঠল, আমার ক্ষুর হাতে…কে তুমি?
চমকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল ভ্যান রিটেন৷
এখন স্টোনের চোখ অনেক উজ্জ্বল, অনেক পরিষ্কার৷ সে এখন কুঁড়েঘরের চারদিকে চঞ্চল চোখে তাকাচ্ছে৷
সব শেষ—সে বলল, সব শেষ হয়ে এসেছে—আমি স্পষ্ট টের পাচ্ছি৷ ইচামকে যেন সত্যি সত্যি দেখতে পাচ্ছি৷ কিন্তু সিঙ্গলটন! ওঃ সিঙ্গলটন! আমার ছোটবেলার সব প্রেতাত্মারা আজ আমার মৃত্যু দেখতে এসেছে! আর তুমি, অচেনা প্রেতচ্ছায়া…কালো দাড়ি, হাতে আমার ক্ষুর! ওঃ, ভগবান!
আমি ভূত নই, স্টোন, আমি বললাম, আমি বেঁচে আছি৷ ইচাম আর ভ্যান রিটেনও সত্যিকারের বেঁচে আছে৷ আমরা তোমাকে সাহায্য করতে এসেছি৷
ভ্যান রিটেন! অবাক বিস্ময়ে সে বলে উঠল, যাক, আমার অসমাপ্ত কাজ তাহলে সুযোগ্য হাতেই পড়বে৷ ভাগ্য তোমার সহায় হোক, ভ্যান রিটেন৷
ভ্যান রিটেন তার আরও কাছে এগিয়ে গেল৷
এক মিনিট একটু নাড়াচাড়া বন্ধ কর দেখি—প্রবোধ দেখার সুরে সে বলল, চিমটি কাটার মতো সামান্য ব্যথা লাগবে মাত্র৷
এ রকম অনেক চিমটি কাটার ব্যথা আমি সহ্য করেছি, পরিষ্কার স্বরে উত্তর দিল স্টোন, আমাকে আমার মতো থাকতে দাও৷ নিশ্চিন্তে মরতে দাও৷ সর্পদানবা হাইড্রাও এর কাছে কিচ্ছু না৷ তুমি বড়জোর দশটা, একশোটা, হাজারটা মাথা কেটে ফেলতে পারো, কিন্তু অভিশাপ তো আর কেটে ফেলতে বা তুলে নিতে পারবে না! যা প্রতিটি হাড়ের মজ্জায় ঢুকে গেছে তা কি মাংস কেটে বের করা যাবে? আমাকে নিয়ে আর কাটা-ছেঁড়া করবে না, কথা দাও—
তার স্বরে ছেলেবেলাকার সেই আদেশের সুর এবং এই সুর সবাইয়ের মতো ভ্যান রিটেনকেও বিচলিত করল৷
কথা দিলাম—ভ্যান রিটেন বলল৷
এই শব্দ দুটো উচ্চারণ করা মাত্র স্টোনের চোখ আবার ঝাপসা হয়ে এল৷
তাকে ঘিরে আমরা তিনজনে বসে রইলাম, দেখতে লাগলাম, সেই ভয়ঙ্কর অদ্ভুত ক্ষুরে দানবটা কি ভাবে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে স্টোনের মাংস ভেদ করে৷ এক সময় দুটো সরু সরু বীভৎস কালো হাত বেরিয়ে এল বাইরে৷ তাতে ছোট ছোট ফুটকির মতো নখের আকৃতি পর্যন্ত নিখুঁত, আর হাতের চেটোর গোলাপী রঙ কি ভয়ংকর রকম স্বাভাবিক৷ হাত-দুটো এলোপাথাড়ি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে গেল স্টোনের চিবুকের কাছে৷ টান মারল স্টোনের সোনালি দাড়িতে৷
আমি আর সইতে পারছি না—চিৎকার করে উঠল ভ্যান রিটেন, এবং ক্ষুরটা আবার তুলে নিল হাতে৷
সেই মুহূর্তে স্টোনের চোখ খুলে গেল, কঠিন দৃষ্টিতে যেন আগুন জ্বলছে৷
ভ্যান রিটেন তার কথার খেলাপ করবে? স্পষ্টভাবে বলল সে, কক্ষনো না!
কিন্তু তোমাকে যে বাঁচাতেই হবে—রুদ্ধ কণ্ঠে ভ্যান রিটেন বলল৷
আমাকে আর বাঁচানোর প্রশ্ন ওঠে না৷ আমার সব দুঃখ কষ্ট এখন শেষ হতে চলেছে—স্টোন বলল, আমার সময় এসে গেছে৷ এই অভিশাপ আমাকে বাইরে থেকে দেওয়া হয়নি, এ অভিশাপ জন্ম নিয়েছে আমার শরীরের ভেতর থেকে—যেমন এই ভয়ংকর ক্ষুদে মানুষটা৷ আমি এবার চলি—
তার চোখ বুজে এল, আমরা অসহায় ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে রইলাম, কালো কুচকুচে ক্ষুদে মানুষটা তীক্ষ্ণ স্বরে তখনও রাশি রাশি কথা ছুড়ে দিচ্ছে৷
মুহূর্ত কয়েক পরেই স্টোন আবার কথা বলল, সব রকম ভাষা তুমি জানো? তার গলার স্বর এখন আরও ভারী হয়ে এসেছে৷
আর হঠাৎই সেই ক্রমে-বেরিয়ে আসা লিলিপুট দানব ইংবেজি ভাষায় উত্তর দিল, হ্যাঁ, সব রকম জানি বটে, বাবু—তার ছোট্ট জিভ বেরিয়ে এল বাইরে, ঠোঁট কেঁপে উঠল, মাথা নাড়তে লাগল এপাশ ওপাশ৷ স্পষ্ট দেখতে পেলাম অদ্ভুত প্রাণীটার পাঁজরগুলো ওঠানামা করছে—যেন শ্বাসপ্রশ্বাসের ছন্দে কাঁপছে৷
ও কি আমাকে ক্ষমা করেছে? চাপা রুদ্ধ কণ্ঠে জিগ্যেস করল স্টোন৷
যদ্দিন দেওদারু গাছের পাতায় শ্যাওলা দুলবেক, তদ্দিন লয়—মাথা চিঁ চিঁ করে বলল, যদ্দিন পঁচারট্রেন হ্রদের ওপর তারা ঝিলিক মারবেক, তদ্দিন লয়৷
আর তক্ষুনি স্টোন এক ঝটকায় কাৎ হয়ে গেল একপাশে৷ পরমুহূর্তেই সে মারা গেল৷
সিঙ্গলটনের কণ্ঠস্বর থামতেই সারা ঘরে কিছুক্ষণের জন্য নেমে এল নিথর নিস্তব্ধতা৷ আমরা পরস্পরের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি৷ টুম্বলি বোকার মতো সেই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল, তুমি নিশ্চয়ই সেই লিলিপুট প্রাণীটাকে কেটে অ্যালকোহলে ডুবিয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছ?
সিঙ্গলটন কঠোর অভিব্যক্তি নিয়ে তার দিকে ফিরে তাকাল৷—স্টোনকে আর কোন রকম কাটাছেঁড়া না করেই আমরা কবর দিয়েছিলাম৷ সে বলল৷
কিন্তু—বিচারবুদ্ধি হীন টুম্বলি বলে উঠল, গোটা ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য৷
সিঙ্গলটনের মুখের পেশী কঠিন হল৷
আমি আশা করিনি তুমি এ কাহিনী বিশ্বাস করবে, সে বলল, কারণ প্রথমেই তো ভাই বলে নিয়েছি, নিজের চোখে দেখেও, কানে শুনেও ওই ঘটনার কথা আবার যখন ভাবি, তখন নিজেই আর বিশ্বাস করতে পারি না৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন