ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার

অনীশ দেব

আমাদের যাত্রা যখন শুরু হল তখন মিউনিখের সূর্য উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে, এবং আসন্ন গ্রীষ্মের খুশিতে বাস ভরপুর৷ রওনা হতে যাব, এমন সময় যে হোটেলে আমি আছি, তার পরিচালক হের ডেলব্রুক আমার গাড়ির কাছে নেমে এসে আমার ‘শুভ যাত্রা’ কামনা করলেন। তারপর জুড়ি গাড়ির দরজার হাতলে হাত রেখে কোচোয়ানকে বললেন, ‘মনে থাকে যেন, রাত হবার আগেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে৷ আকাশ ঝকঝকে হলেও উত্তুরে বাতাসে কেমন একটা কাঁপুনি দিচ্ছে, হয়তো হঠাৎ করে ঝড় উঠবে৷ অবশ্য আমি ভালো করেই জানি, দেরি তুমি করবে না।’ বলে উনি একটু হেসে যোগ করলেন, ‘কারণ তুমি তো জানো, আজকের রাতটা কিসের রাত৷’

জার্মানি ভাষায় জোরালো স্বরে উত্তর দিল জোহান, ‘হ্যাঁ, স্যার, জানি।’ এবং টুপিতে হাত ঠেকিয়ে চকিতে গাড়ি ছুটিয়ে দিল৷ শহরের বাইরে এসেই ওকে থামতে ইশারা করে আমি বললাম, ‘বল দেখি, জোহান, আজ কিসের রাত?’

বুকে ক্রুশ চিহ্ণ এঁকে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল ও, ‘ভাল্পার্গিসের রাত’৷ তারপর জার্মান সিলভারের তৈরি বিশাল এক শালগম সাইজের সেকেলে ঘড়িতে সময় দেখেই ও গাড়ি ছুটিয়ে দিল সজোরে, যেন নষ্ট হওয়া সময়টুকু পূরণ করতে চায়৷

থেকেই থেকেই ঘোড়াগুলো মাথা ঝাঁকিয়ে সন্দেহজনক ভাবে বাতাসের গন্ধ শুঁকতে লাগল৷ আর আমি ভয়ে ভয়ে চারপাশে দেখতে লাগলাম৷ রাস্তাটা বেশ ভালোই নির্জন, কারণ আমরা তখন ছুটে চলেছি ঝোড়ো হাওয়ায় ধু-ধু হয়ে যাওয়া এক উঁচু মালভূমির ওপর দিয়ে৷ যেতে যেতে হঠাৎই একটা রাস্তা আমার নজরে পড়ল৷ দেখে মনে হল, সচরাচর সেটা ব্যবহার হয় না৷ একটা ছোট আঁকাবাঁকা উপত্যকার বুক চিরে রাস্তাটা এগিয়ে গেছে গভীরে৷

কিন্তু তার আকর্ষণ এতই তীব্র যে জোহানকে বিরক্ত করার ঝুঁকি নিয়েও ওকে ডেকে বললাম, ওই রাস্তা ধরে যেতে আমার ভীষণ ইচ্ছে করছে৷ ও হাজার রকম অজুহাত দেখাতে শুরু করল, এবং কথা বলতে বলতে ঘন ঘন ক্রুশ আঁকতে লাগল বুকের ওপর৷ এতে আমার কৌতূহল আরও বেড়ে গেল, সুতরাং ওকে নানা রকম প্রশ্ন করতে শুরু করলাম৷ ও আত্মরক্ষার কায়দার উত্তর দিতে লাগল এবং প্রতিবাদ জানাতে বারবার ঘড়ি দেখতে শুরু করল৷

অবশেষে আমি বললাম, ‘শোন জোহান, আমি ওই রাস্তায় যেতে চাই৷ তোমার ইচ্ছে না থাকলে আমি তোমাকে আসতে জোর করব না, তবে শুধু এটুকু বল, তুমি কেন যেতে চাও না—?’

উত্তরে ও লাফিয়ে পড়ল নিজের ঘেরা জায়গা ছেড়ে, তারপর কাকুতি-মিনতি করতে লাগল, যেন আমি না যাই৷ মনে হল, সব সময়েই ও যেন কিছু একটা আমাকে বলতে গিয়েও থমকে যাচ্ছে—সম্ভবত ভয় পেয়েই, কিন্তু প্রত্যেকবারই ও বুকে ক্রুশ চিহ্ণ এঁকে শুধু বলছে, ‘ভাল্পার্গিসের রাত!’

আমি ওর সঙ্গে তর্কে নামতে চাইলাম। কিন্তু কারো ভাষা না জানা থাকলে তার সঙ্গে তর্ক করার চেষ্টাই বৃথা৷ হঠাৎই ঘোড়াগুলো চঞ্চল হয়ে উঠল, বার বার শুঁকতে লাগল বাতাসের গন্ধ৷ এতে ও ফ্যাকাশে হয়ে গেল এবং ভয়ার্ত চোখে চারপাশে তাকিয়ে হঠাৎ লাগাম ধরে ঘোড়াগুলোকে প্রায় ফুট বিশেক এগিয়ে নিয়ে গেল৷ ওকে অনুসরণ করে জানতে চাইলাম, কেন ও এমনটা করল? উত্তরে ও আবার বুকে ক্রুশ আঁকল এবং কাছেই একটা ক্রুশের দিকে ইশারা করে প্রথমে জার্মানি ভাষায় পরে ইংরেজিতে বলল, এখানে সে শুয়ে আছে, নিজেকে যে মেরে ফেলেছে৷

কেউ আত্মহত্যা করলে তাকে চৌরাস্তার মোড়ে কবর দেবার প্রাচীন রীতিটার কথা আমার মনে পড়ল! ও, আত্মহত্যা! আশ্চর্য বটে!

দুজনে যখন কথা বলছি তখন হঠাৎই শুনতে পেলাম চিৎকার ও গর্জনের মাঝামাঝি এক অদ্ভুত শব্দ৷ শব্দটা আসছে বহু দূর থেকে, কিন্তু ঘোড়াগুলো ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ল, এবং ওদের শান্ত করতে জোহানের বেশ সময় লাগল৷ ফ্যাকাশে মুখে ও বলল, ‘মনে হয় নেকড়ের গর্জন৷’

অথচ এ সময়ে এদিকে কোন নেকড়ে থাকে না বলে শান্ত করার চেষ্টায় ঘোড়াগুলোকে যখন ও আদর করছে, আকাশে শুরু হল কালো মেঘের চঞ্চল আনাগোনা৷ সূর্যের আলো মুছে গেল, এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া যেন আমাদের গা ঘেঁষে ছুটে গেল পলকে৷ এই হাওয়ার ঝলক অনেকটা যেন এক বিপদ-সংকেত, কারণ সূর্য আবার দেখা দিল উজ্জ্বল হয়ে৷ হাতের আড়াল দিয়ে দিগন্তে চোখ রাখল জোহান। বলল, ‘এই তুষার-ঝড়, তার আসতে আর দেরি নেই৷’ তারপর ও আবার তাকাল নিজের ঘড়ির দিকে, এবং সঙ্গে সঙ্গে শক্ত হাতে লাগাম টেনে ধরে ও উঠে বসল গাড়ির ঘেরা জায়গায়৷

মনে কেমন একটা জেদী ভাব জেগে ওঠায় গাড়িতে না উঠে আমি বললাম, ‘এ রাস্তাটা যেখানে গেছে, সে জায়গাটার কথা কিছু বল দেখি—’

আবার ও বুকে ক্রুশ আঁকল এবং বিড়বিড় করে প্রার্থনা করল৷ তারপর উত্তর দিল, ‘জায়গাটা খুব খারাপ৷’

‘কোন জায়গাটা?’ আমি জানতে চাইলাম৷

‘ওই গ্রামটা৷’

‘ও, ওদিকে তাহলে একটা গ্রাম আছে?’

‘না না৷ শ’ শ’ বছর ধরে কেউ ওখানে থাকে না৷’

আমার কৌতূহল বেড়ে উঠল, ‘কিন্তু তুমি যে বললে, ওখানে একটা গ্রাম আছে?’

‘এক সময় ছিল৷’

‘তা এখন কোথায়?’

এ প্রশ্নে জোহান জার্মানি ও ইংরেজি মিশিয়ে এক লম্বা গল্প ফেঁদে বসল। ফলে ওর কথা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না, কিন্তু এটুকু আঁচ করলাম যে, বহু শতাব্দী আগে ওখানে অনেক মানুষ মারা গেছে এবং সেখানেই তাদের কবর দেওয়া হয়েছে, তার পরেই মাটির নীচে শব্দ শোনা গেছে এবং কবর খুঁড়ে দেখা গেছে যে, মৃত স্ত্রী-পুরুষেরা সকলেই তরতাজা হয়ে বেঁচে আছে, ওদের ঠোঁট রক্তে লাল টুকটুকে৷ তখন সেখানে জীবিত যে ক’জন ছিল তারা সকলেই নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে তাড়াহুড়ো করে পালিয়ে যায় অন্যান্য জায়গায়৷ যেখানে জীবিত মানুষেরা বাস করে, আর মৃত মৃতই, অন্য-অন্য কিছু নয়৷

শেষ কথা ক’টা বলতে ও স্পষ্টতই বেশ ভয় পেল৷ ওর মুখ হয়ে গেল সাদা, দরদর করে ঘামছে, কাঁপতে কাঁপতে চারপাশে দেখছে যেন ভয়ঙ্কর কিছু একটা এখুনি আবির্ভূত হবে ওর চোখে সামনে৷ অবশেষে হতাশ যন্ত্রণায় ও চিৎকার করে বলে উঠল, ‘ভাল্পার্গিসের রাত৷’ এবং গাড়ির দিকে ইশারা করে আমাকে উঠতে বলল৷

আমার নীল রক্ত এতে যেন জেগে উঠল৷ এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললাম, ‘তুমি ভয় পেয়েছ জোহান—ভয় পেয়েছ! যাও, বাড়ি যাও, আমি একাই ফিরব৷ ভাল্পার্গিসের রাতের জন্য ইংরেজদের কোন মাথাব্যথা নেই৷’

হতাশার ভঙ্গী করে জোহান ঘোড়ার মুখ ঘুরিয়ে দিল মিউনিখের দিকে৷ লাঠিতে ভর দিয়ে আমি তাকিয়ে রইলাম ওর যাওয়ার পথের দিকে৷ তারপর হাল্কা মনে সরু রাস্তাটা ধরে রওনা হলাম জোহানের না-পসন্দ্ উপত্যকার গভীরে৷ ওর আপত্তির বিন্দুমাত্রও কারণ আমার নজরে পড়ল না৷ মনে হয়, সময় অথবা দূরত্বের চিন্তা না করে আমি ঘণ্টাদুয়েক উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি, এবং একটিও মানুষ কিম্বা বাড়ি আমার চোখে পড়েনি৷ জায়গাটা সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, ওটা জনমানবহীন নির্জন৷

বিশ্রামের আশায় একটু বসলাম, তাকিয়ে দেখলাম, চারপাশে৷ হঠাৎ খেয়াল হল, পথচলা শুরু করার সময় যে রকম ঠান্ডা ছিল, এখন সেটা তার চেয়ে অনেক বেশি—দীর্ঘশ্বাসের এক অদ্ভুত শব্দ যেন আমাকে ঘিরে রয়েছে, সঙ্গে কখনও-সখনও অনেক ওপর থেকে ভেসে আসছে এক চাপা গর্জন৷ ওপরে তাকিয়ে নজরে পড়ল আকাশে বিশাল ঘন মেঘের দল অস্থির গতিতে ভেসে চলেছে উত্তর থেকে দক্ষিণে৷ বাতাসে আসন্ন ঝড়ের ইঙ্গিত৷ আমার কেমন যেন শীত করতে লাগল৷

ভাবলাম, এতক্ষণ হেঁটে আসার পরিশ্রমের পর এখন চুপচাপ বসে রয়েছি, তাই হয়তো শীত করছে, সুতরাং আবার পথচলা শুরু করলাম৷ সময়ের দিকে কোন খেয়াল না রেখেই আমি পথ চলেছি। ফলে যখন ঘন হয়ে আসা গোধূলির আলো চারিদিকে জাঁকিয়ে বসল, তখনই আমার দুশ্চিন্তা শুরু হল, কী করে পথ চিনে বাড়ি ফিরে যাব৷ দিনের উজ্জ্বল আলো এখন মিলিয়ে গেছে৷ বাতাস কনকনে ঠাণ্ডা, অনেক ওপরে ভেসে যাওয়া মেঘের মিছিল যেন দলে আরও ভারী হয়েছে৷ সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে বহু দূর থেকে কিছু একটা ছুটে আসার শব্দ আর সেটা ভেদ করে কিছুক্ষণ পরে পরেই ভেসে আসছে এক রহস্যময় চিৎকার—এটাকেই জোহান নেকড়ের চিৎকার বলেছিল৷

তাকিয়ে আছি, হঠাৎই বাতাসে এক ঠান্ডা কাঁপুনি খেলে গেল এবং শুরু হল তুষারপাত৷ পেরিয়ে আসা মাইলের পর মাইল গাছপালাহীন নির্জন পথের কথা আমার মনে পড়ল, সুতরাং, আশ্রয়ের খোঁজে দ্রুতপায়ে রওনা হলাম সামনের জঙ্গলের দিকে৷

আকাশ ক্রমে আরও কালো হয়ে উঠল, বরফ পড়তে লাগল আরও ঘন হয়ে, আরও জোরে—অবশেষে এক সময় আমার সামনে ও চারপাশের মাটি হয়ে উঠল এক চকচকে সাদা গালিচা, যার শেষ প্রান্ত মিলিয়ে গেছে দূরের অস্পষ্ট কুয়াশার মধ্যে৷ ক্রমে বাতাসের গতি বেড়ে উঠল, হয়ে উঠল ঝোড়ো হাওয়া, তখন আমি বাধ্য হয়ে বাতাস ঠেলে ছুটতে শুরু করলাম৷ ক্ষণে ক্ষণেই আকাশ চিরে দিচ্ছে জ্বলন্ত বিদ্যুৎ, আর সেই আলোয় নজরে পড়ল আমার ঠিক সামনেই ঘন তুষারে ঢাকা ইউ ও সাইপ্রেস গাছের গায়ে মাখামাখি জটলা৷

অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম সেই গাছপালার আশ্রয়ে। আর সেই অপেক্ষাকৃত নিঝুম জায়গায় দাঁড়িয়ে শুনতে পেলাম অনেক উঁচুতে ছুটে যাওয়া বাতাসের শন্ শন্ শব্দ৷ দেখতে দেখতে ঝোড়ো অন্ধকার মিশে গেল রাতের অন্ধকারে৷ ক্রমে মনে হল ঝড় শান্ত হয়ে আসছে! এখন মাঝে মাঝে শুধু শোনা যাচ্ছে দুরন্ত হাওয়ার ঝটকা৷ সেই মুহূর্তে নেকড়ের অপার্থিব চিৎকার যেন হাজারো প্রতিধ্বনি তুলল আমার চারদিকে৷

কখনও কখনও অলসভাবে ভেসে যাওয়া ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে এসে পড়ছে বিক্ষিপ্ত চাঁদের আলো৷ সেই আলোয় দেখলাম সাইপ্রাস ও ইউ গাছের এক ঘন জটলার কিনারায় এসে আমি দাঁড়িয়েছি৷ তুষারপাত থেমে যাওয়ায় আমি আশ্রয় ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম এবং আরও খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করলাম জায়গাটা৷ মনে হল যে সব প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আমার চোখে পড়ছে তার মধ্যে একটা বাড়ি জীর্ণ হলেও এখনও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে, এবং সেখানেই হয়তো আমি কিছুক্ষণের জন্যে আশ্রয় পেতে পারি৷

ঝোপঝাড়ের কিনারা ঘুরে এগিয়ে যেতেই আবিষ্কার করলাম একটা নিচু দেওয়াল বাড়িটাকে ঘিরে রয়েছে, এবং এই দেওয়াল অনুসরণ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেতরে ঢোকার সরু পথ খুঁজে পেলাম৷ এটুকু নজরে পড়া মাত্রই ভেসে যাওয়া মেঘ চাঁদকে আড়াল করে দিল, কিন্তু সামনেই আশ্রয়ের হাতছানি, অতএব আমি অন্ধের মত হাতড়ে এগিয়ে চললাম৷

হঠাৎই এক নিস্তব্ধতার মুখোমুখি হয়ে আমি থমকে দাঁড়ালাম৷ ঝড় থেমে গেছে, এবং সম্ভবত নিঃশব্দ স্তব্ধ প্রকৃতির প্রতি সহানুভূতিতে আমার হৃদপিণ্ডও যেন বন্ধ করেছে তার স্পন্দন৷ কিন্তু সে এক মুহূর্তের জন্যে! কারণ হঠাৎই মেঘ চিরে এসে পড়ল চাঁদের আলো, আমাকে জানিয়ে দিল যে আমি এক কবরখানায় এসে দাঁড়িয়েছি, এবং আমার সামনেই যে চৌকো স্তূপটা রয়েছে সেটা একটা সমাধি-প্রস্তর, ওটার ওপরে ও চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তুষারের মতই শুভ্র তার রং৷

হঠাৎ চাঁদের আলোর হাত ধরে ভেসে এলো ঝড়ের এক ভয়ংকর দীর্ঘশ্বাস এবং অসংখ্য কুকুর অথবা নেকড়ের মতো চাপা একটানা গর্জন করে সে যেন তার পুরোনো তোলপাড় আবার শুরু করল৷ এক অদ্ভুত আকর্ষণে আমি এগিয়ে চললাম মার্বেল পাথরে তৈরি সেই সমাধির দিকে৷ দেখতে ওটা কার, এবং কেনই বা এইরকম একটা জায়গায় এই রকম একটা জিনিস একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছে৷ ওটার চারপাশ ঘুরে অবশেষে ডরিস-দেশীয় দরজার ঠিক ওপরে জার্মানী ভাষায় লেখা কথাগুলো পড়তে পারলাম!

স্টাইরিয়ার গ্রাৎস্-এর কাউন্টেস ডলিংগেন

প্রার্থিত মৃত্যুকে পেয়েছেন ১৮০১

সমাধি-প্রস্তরের ঠিক ওপরে নিরেট পাথরে যেন পুঁতে দেওয়া হয়েছে এক বিশাল লোহার গজাল কিম্বা শূল৷ ওটার পিছন দিয়ে যেতেই নজরে পড়ল বড় বড় রুশ হরফে খোদাই করা রয়েছে : মৃতেরা দ্রুত চলে৷

পুরো ব্যাপারটায় এমন একটা অপার্থিব গা ছমছমে আমেজ ছিল যে আমার মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল, যেন এখুনি অজ্ঞান হয়ে যাব৷ এই প্রথম মনে হল যে জোহানের উপদেশ শুনলেই বোধ হয় ভালো ছিল৷ হঠাৎই একটা চিন্তা আমার মাথায় খেলে গেল, এই রহস্যময় পরিস্থিতে আকস্মিক আঘাতের মতোই ঝলসে উঠল সেটা—‘আজকের রাত ভাল্পার্গিসের রাত’!

ভাল্পার্গিসের রাত! লক্ষ লক্ষ লোকের বিশ্বাস অনুযায়ী যে রাতে শয়তান যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায়—সমস্ত কবর খুলে যায়, মৃতেরা বেরিয়ে আসে বাইরে, চলে বেড়ায়৷ যে রাতে জল, স্থল, অন্তরীক্ষের সমস্ত অশুভ জিনিস আনন্দ উৎসবে মেতে ওঠে৷ আমার শেখা সমস্ত দর্শন, সমস্ত ধর্ম, সমস্ত সাহস এক জায়গায় জড়ো করলাম, যেন অন্ধ আতঙ্কে ভেঙে না পড়ি৷

এবার এক প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ফুঁসে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর৷ মাটি এমন ভাবে কাঁপতে লাগল যেন হাজার হাজার ঘোড়া দুদ্দাড় করে তার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে এবং এইবার তুষার নয়, বিরাট আকারের সব শিলাপিণ্ড দুরন্ত গতিতে ছুটে চলল এবং তার আঘাতে গাছের ডালপালা, পাতা, সব খসে পড়তে লাগল, সাইপ্রাস গাছের আশ্রয় হয়ে দাঁড়াল বিপজ্জনক৷ ফলে আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম এবং রওনা হলাম আশ্রয় দিতে পারে এমন এক ও একমাত্র জায়গা লক্ষ্য করে—সমাধি-প্রস্তরের গভীর ডরিসীয় দরজা৷ বিশাল ব্রোঞ্জের দরজায় গায়ে গুঁটিসুঁটি মেরে দাঁড়িয়ে মুষলধারে শিলাবৃষ্টির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেলাম৷

দরজায় গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াতেই ওটা সামান্য নড়ে উঠল এবং খুলে গেল ভেতর দিকে৷ এই নিষ্ঠুর ঝড়ের মুখে কোন সমাধির আশ্রয়ও অনেক বেশি সুখের, ভেবে যেই আমি ভেতরে ঢুকতে যাব, ঠিক তক্ষুনি অসংখ্য রেখায় আঁকাবাঁকা বিদ্যুৎ ঝলসে উঠে সারা আকাশে আলোর রোশনাই জ্বালিয়ে দিল৷ সেই মুহূর্তে সমাধির অন্ধকারে চোখ ফিরিয়ে আমি স্পষ্ট দেখলাম, একটা শবাধারে ঘুমিয়ে আছে ভারী গাল ও টুকটুকে লাল ঠোঁট এক সুন্দরী মহিলা—আমি যেমন বেঁচে আছি, এ দৃশ্য তেমনি সত্যি৷ বজ্রপাতের শব্দটা আকাশে ভেঙে পড়তেই যেন এক দানবের হাত আমাকে চেপে ধরে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরের বিক্ষুব্ধ ঝড়ের মধ্যে৷

সমস্ত ঘটনাটা এত আকস্মিক ভাবে ঘটল যে মানসিক ও শারীরিক আঘাত পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই টের পেলাম অসংখ্য শিলাপিণ্ড তোড়ে আছড়ে পড়ছে আমার ওপর৷ একই সঙ্গে এক অদ্ভুত আচ্ছন্ন করা অনুভূতি যেন আমাকে বলে দিল, আমি একা নই৷ এবার চোখ ফেরালাম সমাধির দিকে৷ সেই মুহূর্তেই দেখা গেল চোখ ধাঁধানো এক আলোর ঝলকানি! সেটা আঘাত করল সমাধির ওপরে গাঁথা লোহার শূলের ওপর। তারপর প্রচণ্ড বিস্ফোরণ মার্বেল পাথর চুরমার করে আগুনের তাণ্ডব ধরিয়ে যেন সরাসরি ঢুকে গেল মাটিতে৷ এক যন্ত্রণাময় মুহূর্তের জন্য উঠে দাঁড়াল সেই মহিলা, আগুনের শিখা তাকে জড়িয়ে লকলক করে জ্বলছে এবং তার মৃত্যু যন্ত্রণায় আর্ত চিৎকার ডুবে গেল বজ্রপাতের শব্দে৷

শেষ যা শুনতে পেলাম তা হল এই সব ভয়ংকর শব্দরোলের মিশ্রণে জন্ম নেওয়া এক বিচিত্র শব্দ, কারণ ততক্ষণে সেই দৈত্যের হাত আবার আমাকে বজ্রমুঠিতে আঁকড়ে ধরে টেনে নিয়ে চলেছে, শিলাবৃষ্টি আছড়ে পড়ছে আমার শরীরে এবং নেকড়ের গর্জনে কেঁপে উঠছে চারিদিকের বাতাস৷ শেষ যে দৃশ্য মনে আছে তা হল অস্পষ্ট সাদা এক চলমান স্তূপ, যেন চারপাশের সমস্ত সমাধি তাদের আচ্ছাদিত মৃতদেহের প্রেতাত্মাগুলো পাঠিয়ে দিয়েছে এবং তারা দুরন্ত শিলাবৃষ্টির সাদা ধোঁয়াশা ভেদ করে আমাকে ক্রমশ ঘিরে ধরছে৷

ধীরে ধীরে অস্পষ্ট ভাবে চেতনা ফিরে আসতে লাগল, তারপর এক গভীর ক্লান্তির অনুভূতি৷ কয়েক মুহূর্তের জন্য কিছুই মনে করতে পারলাম না, তারপর আস্তে আস্তে চেতনা ফিরে আসতে লাগল৷ আমার পা দুটোয় অসহ্য অস্থির যন্ত্রণা, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি ওদের একচুল নড়াতে পারছি না৷ পা দুটো যেন অসাড় হয়ে গেছে৷ আমার ঘাড়ে এক বরফশীতল স্পর্শ এবং মেরুদণ্ড, কান, সব যেন আমার পায়ের মতই মৃত, অথচ তীব্র যন্ত্রণায় অস্থির, কিন্তু আমার বুকে এক অদ্ভুত উষ্ণ স্পর্শ তৃপ্তির স্বাদ এনে দিচ্ছে৷ এ যেন এক দুঃস্বপ্ন—সঠিক বলতে গেলে, এক বাস্তব দুঃস্বপ্ন কারণ আমার বুকে চাপানো এক ভারী পাথর আমার শ্বাস-প্রশ্বাসকে কষ্টকর করে তুলছে৷

এক অগাধ স্তব্ধতা আমাকে ঘিরে ধরল, যেন সারাটা পৃথিবী ঘুমে অচেতন কিংবা মৃত—শুধু থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে থাকা হয়তো কোন জন্তুর চাপা হাঁপানির শব্দ৷ গলায় টের পেলাম এক উষ্ণ কর্কশ স্পর্শ, তারপর ভয়ংকর সত্যের মুখোমুখি হলাম। আমার হৃৎপিন্ড যেন বরফে জমে গেল, রক্তের জোয়ার ছুটে গেল আমার মস্তিষ্কের শিরায় শিরায়৷ একটা বিশাল জন্তু আমার শরীরের ওপর বসে আমার গলা চাটছে৷ চোখের ঝিলিমিলির ফাঁক দিয়ে দেখলাম আমার মুখের ঠিক সামনেই এক প্রকাণ্ড নেকড়ের দুটো বিশাল জ্বলন্ত চোখ৷ হাঁ করা লাল মুখে ধারালো সাদা দাঁতগুলো ঝকঝক করছে এবং ওটার গরম ঝাঁঝালো নিশ্বাস আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারছি৷

আরও কিছু সময়ের জন্য আমার স্মৃতিশক্তি অচল হল৷ তারপর শুনতে পেলাম একটা চাপা গর্জন! পরক্ষণেই এক তীক্ষ্ণ চিৎকার—একবার, দুবার, বারবার৷ তারপর যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা সমবেত কণ্ঠে শুনতে পেলাম, হ্যালো! হ্যালো! অতি সাবধানে মাথা তুলে শব্দ লক্ষ্য করে তাকালাম, কিন্তু সমাধিক্ষেত্র আমার দৃষ্টি আড়াল করল৷ নেকড়েটা তখনও অদ্ভুত ভাবে চিৎকার করছে এবং একটা লাল আভা সাইপ্রাস কুঞ্জে চলে ফিরে বেড়াতে লাগল, যেন শব্দটাকে অনুসরণ করছে৷ কণ্ঠস্বরগুলো আরো কাছে আসতেই নেকড়েটার গর্জন আরও দ্রুত আরও জোরালো হয়ে উঠল৷ সাড়া দিতে বা নড়াচড়া করতে আমি ভয় পেলাম৷

তারপর হঠাৎ ঘিরে থাকা গাছের আড়াল থেকে শোনা গেল একদল ঘোড়াসওয়ারের ঘোড়া ছুটিয়ে আসার শব্দ, হাতে তাদের জ্বলন্ত টর্চ৷ নেকড়েটা আমার বুক ছেড়ে উঠে পড়ল, রওনা হল সমাধিস্থলের দিকে৷ একজন ঘোড়সওয়ারকে (টুপি ও লম্বা সামরিক বেশ দেখে ওদের সৈনিক বলেই মনে হল) দেখলাম বন্দুক তুলে তাক করতে৷ অন্য একজন তার হাতে ঠেলা মারল, গুলিটা শিস দিয়ে বেরিয়ে গেল আমার মাথার ওপর দিয়ে৷ সে নিশ্চয়ই আমাকে নেকড়ে বলে ভুল করেছে৷ চুপিসারে পালিয়ে যাওয়া জন্তুটাকে আর একজন দেখতে পেল এবং সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল গুলির শব্দ৷ তারপর, দু-চার কদমেই ঘোড়সওয়ারের দল কাছে এসে গেল—কেউ এলো আমার কাছে, আর কেউ কেউ গেল বরফে সাজানো সাইপ্রাস গাছের ভিড়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নেকড়েটাকে অনুসরণ করতে৷

ওরা কাছে আসতেই আমি নড়াচড়া করতে চেষ্টা করলাম, কিন্তু শক্তি খুঁজে পেলাম না। অথচ আমি আমার চারপাশে যা যা হচ্ছে তার সবই দেখতে পাচ্ছি শুনতে পাচ্ছি৷ দু-তিনজন সৈনিক ঘোড়া থেকে লাফিয়ে নামল, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল আমার পাশে৷ একজন আমার মাথা তুলে ধরল, হাত রাখল আমার বুকে৷ ‘ভালো খবর, কমরেড!’ সে চিৎকার করে উঠল, ‘ভদ্রলোক এখনো বেঁচে আছেন।’

তারপর কিছুটা ব্র্যান্ডি ঢেলে দেওয়া হল আমার গলায়, শরীরে যেন শক্তি ফিরে এল, এবার চোখ পুরোপুরি মেলতে পারলাম, তাকালাম চারিদিকে৷ গাছের সমারোহে, আলো ও ছায়া চলাফেরা করে বেড়াচ্ছে, শুনতে পেলাম লোকজনের চিৎকার করে পরস্পরকে ডাকাডাকির শব্দ৷ ভয়ার্ত চিৎকারে বিস্ময় প্রকাশ করতে করতে ওরা ক্রমে এক জায়গায় জড়ো হল, ভূতে পাওয়া মানুষের মতো অন্যান্যরা কবরখানায় গোলকধাঁধা থেকে বেরিয়ে এল, টর্চের আলো ঝলসে উঠতে লাগল ক্ষণে ক্ষণে৷ দূরের লোকজন সবাই যখন কাছে চলে এল তখন আমাকে ঘিরে থাকা লোকেরা অধীর আগ্রহে ওদের প্রশ্ন করল, ‘কি হল, ওটাকে পাওয়া গেল?’

উত্তর পাওয়া গেল ঝটিতি, ‘না৷ শীগগির চল—জলদি৷ এ জায়গায় থাকা ঠিক নয়, বিশেষ করে আজকের রাতে৷’

‘ওটা কী ছিল?’ একাধিক সুরে ধ্বনিত হল এই প্রশ্ন৷

উত্তর পাওয়া গেল বিভিন্ন এবং অস্পষ্ট, যেন সবাই এক বিশেষ আবেগে কথা বলতে চাইছে অথচ কি এক আতঙ্কে নিজেদের জিভের রাশ টেনে ধরছে৷

‘ওটা—ওটা—একটা—’ দিশেহারা চিন্তা নিয়ে তোতলা স্বরে বলতে চাইল একজন, ‘একটা নেকড়ে—অথচ নেকড়েও ঠিক নয়—’ বলল আর একজন৷

‘পবিত্র গুলি ছাড়া ওটাকে কিছু করা সম্ভব নয়।’ স্বাভাবিক সুরে মন্তব্য করল তৃতীয় কোন ব্যক্তি৷

‘এ রাতে যেমন বেরিয়েছি, তেমনি উচিত শিক্ষা হয়েছে৷ আমাদের হাজার মার্ক আমরা সত্যি খেটে উপায় করেছি৷’ চতুর্থজনের মুখ ফুটে বেরিয়ে এল৷

‘ভাঙা মার্বেল পাথরের ওপর রক্ত ছিল।’ আর একজন বলল, ‘সেটা তো আর বজ্রপাত থেকে আসেনি৷ আর এই ভদ্রলোক—এঁর আর কোন ভয় নেই তো? গলাটা একবার দেখ৷ দেখ কমরেড, নেকড়েটা এই ভদ্রলোকের গায়ের ওপর শুয়ে তাঁর রক্ত গরম রেখেছে৷’

অফিসারটি আমার গলায় দিকে তাকিয়ে জবাব দিল, ‘ভদ্রলোকের আর কোন ভয় নেই, চামড়ায় কোন ক্ষত হয়নি৷ এ সবের মানে কি? নেকড়েটার চিৎকার না শুনলে আমরা এঁকে খুঁজেই পেতাম না৷’

‘নেকড়েটার কি হল?’ আমার মাথাটা যে তুলে ধরেছিল সে জিগ্যেস করল৷ ‘ওটা নিজের আস্তানায় ফিরে গেছে।’ লম্বাটে বিবর্ণ মুখ লোকটি উত্তর দিল, আতঙ্কে সে কাঁপছে, ‘এখানে অনেক কবর রয়েছে, তারই একটায় হয়তো ওটা থাকে৷ এসো, কমরেড—জলদি চল৷ এই অভিশপ্ত জায়গা ছেড়ে আমরা চলে যাই৷’

অফিসারটি আমাকে তুলে ধরলেন বসানোর ভঙ্গিতে, আদেশের সুরে কী যেন বললেন, তখন কয়েকজন মিলে আমাকে বসিয়ে দিল ঘোড়ার পিঠে৷ সে লাফিয়ে উঠে বসল আমার পিছনে, আমাকে জড়িয়ে ধরল, দু’হাতে, এগোতে নির্দেশ দিল সবাইকে। অতএব সাইপ্রাস গাছের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে আমরা সামরিক শৃঙ্খলায় দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে চললাম৷

আমার জিভ তখনও বিদ্রোহ করায় আমি চুপ করে থাকতে বাধ্য হলাম৷ নিশ্চয়ই আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, কারণ পরের যে ঘটনা মনে আছে, তা হল আমি দাঁড়িয়ে আছি, দু’পাশে দুজন সৈনিক আমাকে ধরে রেখেছে৷ চারিদিকে প্রায় উজ্জ্বল দিনের আলো, আর উত্তর দিকে প্রতিফলিত হয়েছে সূর্যের আলোর এক লাল রেখা, আনকোরা তুষারের ওপর যেন রক্ত ঢেলে তৈরি করা হয়েছে এক পায়ে চলা পথ৷

অফিসার তখন অন্যান্যদের বলছেন যা তারা দেখেছে তা যেন কাউকে না বলে৷

শুধু যেন বলে যে একজন অজ্ঞাত পরিচয় ইংরেজকে পাওয়া গেছে, আর একটা বিরাট কুকুর তাকে পাহারা দিচ্ছিল৷

‘কুকুর! ওটা তো কুকুর ছিল না।’ সবচেয়ে ভয় পাওয়া মানুষটা বাধা দিয়ে বলল, নেকড়ে দেখলে আমার চিনতে ভুল হয় না৷

তরুণ অফিসার শান্ত স্বরে জবাব দিল, ‘আমি বলছি কুকুর৷’

কুকুর! ব্যঙ্গভরে পুনরাবৃত্তি করল অন্য জন৷

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে সূর্যের তেজে সঙ্গে সঙ্গে তার সাহসও বাড়ছে, তারপর আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে সে বলল, ‘ভদ্রলোকের গলাটা দেখুন৷ এটা কি কোন কুকুরের কাজ, স্যার?’

সহজাত প্রবৃত্তিবশে আমি হাত দিলাম গলায়, এবং সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম৷ ওরা আমাকে ঘিরে ধরল দেখবার জন্য, কেউ কেউ তাদের জিন থেকে ঝুঁকে পড়ল, আর তখনই আবার শোনা গেল ‘সেই তরুণ অফিসারের কণ্ঠস্বর, আমি যা বললাম—কুকুর৷ এ ছাড়া অন্য কিছু বলতে গেলে সবাই আমাদের কথায় হাসবে৷’

এরপর আর একজন অশ্বারোহী সৈনিকের ঘোড়ায় আমাকে তুলে দেওয়া হল, এবং আমরা মিউনিখের শহরতলী অঞ্চলে ঢুকে পড়লাম৷ সেখানে হঠাৎই একটা জুড়ি গাড়ি দেখতে পেয়ে আমাকে সেটাতে তুলে দেওয়া হল৷ গাড়ি ছুটে চলল আমার হোটেল অভিমুখে—তরুণ অফিসারটি আমার সঙ্গী হলেন, আর একজন সৈনিক ঘোড়ায় চড়ে আমাদের অনুসরণ করল, বাকিরা ফিরে গেল তাদের ব্যারাকে৷

আমরা হোটেলে পৌঁছতেই হের্ ডেলব্রুক এত তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন যে স্পষ্ট বোঝা যায় তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তায় ছিলেন৷ অফিসারটি আমাকে অভিবাদন করে যখন বিদায় নিতে চলেছে, তখন আমি তাকে এবং তার সাহসী কমরেডদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানালাম৷ সে খুব সহজ গলায় উত্তর দিল যে সে ভীষণ খুশি হয়েছে, এবং অনুসন্ধানকারী দলকে তুষ্ট করার জন্য হের ডেলব্রুক আগেই সব ব্যবস্থা করেছেন৷ এই হেঁয়ালিভরা কথায় হোটেল পরিচালক হাসলেন, এবং অফিসারটি কাজের ওজর দেখিয়ে বিদায় নিল৷

‘কিন্তু হের্ ডেলব্রুক’—আমি জানতে চাইলাম, ‘সৈন্যদলের লোকেরা আমাকে কি করে, আর কেনই বা খুঁজতে গেল?’

নিজের কাজের জন্য যেন লজ্জায় কাঁধ ঝাঁকালেন তিনি, তারপর উত্তর দিলেন, ‘আমার ভাগ্য ভালো যে আমার দলের সেনাপতির কাছ থেকে ছুটি পেয়েছি এবং অনুসন্ধানের জন্য স্বেচ্ছা সৈনিকের দল চাইতে পেরেছি৷’

‘কিন্তু কী করে জানলেন যে আমি পথ হারিয়েছি?’ আমি প্রশ্ন করলাম৷

‘কোচোয়ান তার ভাঙাচোরা গাড়ি নিয়ে এখানে এসেছিল, ঘোড়াগুলো পালিয়ে যাওয়ার পর তার গাড়ি উলটে যায়৷’

‘কিন্তু শুধু এই কারণেই তো আর সৈন্য বাহিনী থেকে অনুসন্ধান-দল পাঠানো যায় না?’

‘না, না৷’ সে উত্তর দিল, আসলে কোচোয়ান আসার আগেই আপনি যার অতিথি সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে এই তারটা আমি পাই—বলে পকেট থেকে একটা টেলিগ্রাম মেসেজ আমার দিকে এগিয়ে দিলেন৷ এবং আমি পড়লাম ঃ

বিসত্রিজ

আমার অতিথি সম্পর্কে সাবধান—তাঁর নিরাপত্তা আমার কাছে অমূল্য৷ তাঁর যদি সামান্য কিছুও হয়, বা তিনি হারিয়ে যান, তাহলে তাঁকে খুঁজে বের করে নিরাপত্তা অটুট রাখতে চেষ্টার কোন ত্রুটি রাখবেন না৷ ভদ্রলোক ইংরেজ, ফলে ভ্রমণ বিলাসী৷ তুষার, নেকড়ে ও অন্ধকার রাত প্রায়ই বিপজ্জনক হয়ে ওঠে৷ যদি তার বিপদের সামান্যতম আভাসও পান একটা মুহূর্তও নষ্ট করবেন না৷ আপনার উৎসাহ ও প্রচেষ্টার যথাযথ উত্তর আমায় ঐশ্বর্য দেবে৷

—ড্রাকুলা

কাগজটা হাতে নিয়ে মনে হল ঘরটা আমার চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে, আর তৎপর হোটেল পরিচালক যদি আমাকে না ধরে ফেলতেন তাহলে আমি হয়তো পড়েই যেতাম৷ সমস্ত ঘটনার মধ্যেই কেমন একটা অদ্ভুত জিনিস রয়েছে এবং সেটা এতই অপার্থিব যে কল্পনা করা দুঃসাধ্য৷ আমি যেন বিপরীত শক্তির হাতে এক খেলনা হয়ে গিয়েছিলাম—এই চিন্তার আভাসটুকুই আমাকে যেন অসাড় পঙ্গু করে দিল৷ নিঃসন্দেহে আমি এক ধরনের রহস্যময় কোন নিরাপত্তার আশ্রয়ে ছিলাম৷ এক দূর দেশ থেকে ঠিক সঙ্কট মুহূর্তে এসেছে এক তারবার্তা, তুষার-ঘুম ও নেকড়ের দাঁত থেকে বাঁচিয়ে আমাকে বিপদমুক্ত করেছে৷

অধ্যায় ১ / ২১

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন