আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি

অনীশ দেব

আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি

সামান্য উষ্ণতার আশায় মেঝেতে পা ঠুকলেন এরকুল পোয়ারা৷ হাতের আঙুলে সজোরে ফুঁ দিলেন৷ তাঁর গোঁফের কোণ বেয়ে টপটপ করে গলে পড়ছে তুষারের কণা৷

দরজায় টোকা মেরে একজন পরিচারিকা প্রবেশ করলো৷ আচরণে ধীরস্থির, মোটা-সোটা, গ্রাম্য মেয়ে। দু’চোখে যথেষ্ট কৌতূহল নিয়ে সে অপলকে চেয়ে রইলো এরকুল পোয়ারোর দিকে৷ সম্ভবত ঠিক এরকম কাউকে সে আগে কখনও দেখেনি৷

সে জানতে চাইলো, ‘আপনি কি ঘণ্টি বাজিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ৷ দয়া করে একটু আগুনটা জ্বেলে দেবার ব্যবস্থা করবে?’

মেয়েটি চলে গেলো৷ এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কাগজ ও কাঠ নিয়ে ফিরে এলো৷ বিশাল ভিক্টোরিও তাপচুল্লীর সুমুখে হাঁটু গেড়ে বসে আগুন জ্বালানোর প্রস্তুতি শুরু করলো সে৷

এরকুল পোয়ারা তাঁর মেঝেতে পা ঠোকা, হাত দোলানো এবং আঙুলে ফুঁ দেবার কাজ চালিয়ে যেতে লাগলেন৷

তিনি এই মুহূর্তে বেশ বিরক্ত৷ কারণ তাঁর গাড়ি একটি মূল্যবান মেসারো গ্রাৎস্—একটা গাড়ির কাছে যতখানি যান্ত্রিক সূক্ষ্মতা তিনি আশা করেন, সে মাপকাঠি অনুযায়ী তাঁর সঙ্গে ব্যবহার করেনি৷ তাঁর ড্রাইভার, জনৈক যুবক, যে ভালো অঙ্কের মাইনে পেয়ে থাকে, শত চেষ্টাতেও গাড়ির অবস্থার উন্নতি করতে পারেনি৷ অবশেষে প্রতিবাদের চরম নোটিস জানিয়ে জনপদ থেকে দেড় মাইল দূরের এক দ্বিতীয় শ্রেণীর রাস্তায় গাড়িটা স্তব্ধ হয়েছে৷ তখন শুরু হয়েছে তুষারপাত৷ এরকুল পোয়ারো তাঁর চকচকে বার্নিশ-করা চামড়ার জুতো পরেই সেই দেড় মাইল অতিক্রম করতে বাধ্য হয়েছেন৷ তারপর এসে পৌঁছেছেন নদীর কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম হার্টলি ডীন-এ৷ গ্রীষ্মকালে এই গ্রামে প্রাণচঞ্চলতার প্রতিটি লক্ষণ দেখা গেলেও শীতে এর চরিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত—নিষ্প্রাণ৷ সুতরাং একজন অতিথির আবির্ভাবে, ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ অতিথিশালা রীতিমতো আতঙ্ক প্রকাশ করেছে৷ মালিক ভদ্রলোক যথেষ্ট বাকচাতুরী দেখিয়ে জানিয়েছেন যে স্থানীয় গ্যারেজ থেকে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যেতে পারে এবং তাতে এই অসম্পূর্ণ যাত্রা সম্পূর্ণ করা যেতে পারে৷

এ প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এরকুল পোয়ারা৷ তাঁর ল্যাটিন অহমিকা-বোধ ক্ষুন্ন হয়েছে৷ গাড়ি ভাড়া করবেন তিনি? তাঁর নিজেরই তো গাড়ি রয়েছে—যথেষ্ট বড় গাড়ি দামী গাড়ি৷ শহরে ফিরে যেতে হলে তিনি নিজের গাড়িতেই যাবেন, অন্য কোন গাড়িতে নয়৷ আর গাড়ি মেরামতের কাজ যদি তাড়াতাড়িও শেষ হয়, তাহলেও এই বরফের মধ্যে তিনি কাল সকালের আগে রওনা হচ্ছেন না৷ তাঁর এখন প্রয়োজন একটা ঘরের, একটা তাপচুল্লীর, এবং রাতের খাবার৷ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মালিক ভদ্রলোক তাঁকে ঘরে নিয়ে গেছেন, পরিচারিকাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন তাপচুল্লীতে আগুন জালানোর ব্যবস্থা করতে, তারপর ফিরে গেছেন স্ত্রীর কাছে সাম্প্রতিক খাদ্য সরবরাহ-সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করতে৷

এক ঘণ্টা পরে তাপচুল্লীর আরামদায়ক উষ্ণতার দিকে পা ছাড়িয়ে এরকুল পোয়ারো ক্ষমাশীল মনোভাব নিয়ে রোমন্থন করছিলেন তাঁর সদ্যসমাপ্ত নৈশভোজের স্মৃতি৷ সত্যি যে স্টেকগুলো কোথাও শক্ত কোথাও অসম্ভব নরম ছিলো, ব্রাসেলস স্প্রাউটগুলো ছিলো আকারে বড়, ফ্যাকাশে, আর থকথকে, আলুগুলোর ভেতরটা ছিলো পাথরের মতো শক্ত৷ সেদ্ধ আপেলের টুকরো অথবা তাকে অনুসরণকারী পায়েসের কথাও তেমন বলার মতন নয়৷ চীজটা যেমন শক্ত, বিস্কুটগুলোও ছিলো তেমনি নরম৷ লাফিয়ে ওঠা আগুনের শিখার দিকে সন্তুষ্ট চোখে তাকিয়ে তরল কাদার কাপে, যাকে আলংকারিক ভাষায় কফি বলা হয়, সন্তর্পণে চুমুক দিতে দিতে ভাবলেন এরকুল পোয়েরো, তা হলেও, পেট খালি থাকার চেয়ে ভর্তি অবস্থা অনেক ভালো, আর বরফ বিছানো পথে বার্নিশ-করা চামড়ার জুতো পায়ে হেঁটে আসার পর তাপচুল্লীর পাশে বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া নেহাতই স্বর্গ!

দরজায় টোকা মারার শব্দ করে পরিচারিকাটি ঘরে ঢুকলো৷

‘স্যার, গ্যারেজের লোক এখানে এসেছে, আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়৷’

এরকুল পোয়ারো৷ সৌজন্যের সুরে উত্তর দিলেন, ‘তাকে ওপরে আসতে অনুমতি দেওয়া হোক৷’

মেয়েটা খিলখিল করে হেসে চলে গেলো৷ পোয়ারো স্বাভাবিক ভাবেই অনুমান করলেন, তাঁর সম্পর্কে মেয়েটির বর্ণনা আগামী বহু বছর ধরে ওর বন্ধুবান্ধবদের আনন্দের খোরাক যোগাবে৷

দরজায় আর একবার টোকা মারার শব্দ হলো একটু ভিন্ন ধরনের শব্দ এবং পোয়ারো ডেকে উঠলেন, ভেতরে এসো৷’

তিনি অনুকূল মনোভাব নিয়ে তাকালে যুবকটির দিকে৷ ঘরে ঢুকে কেমন অপ্রতিভ ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে, টুপিটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করছে দু হাতে৷

তিনি ভাবলেন, উপস্থিত যুবক তাঁর দেখা মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সুদর্শন পুরুষদের অন্যতম নির্দশন৷ তার সরল মুখমণ্ডলে গ্রীক দেবতার সঙ্গে বাহ্যিক সাদৃশ্যের ছায়া অত্যন্ত স্পষ্ট৷

যুবকটি চাপা নীরস কণ্ঠে বললো, ‘গাড়িটার কথা বলতে এলাম স্যার৷ ওটা আমরা গ্যারেজে নিয়ে এসেছি৷ আর গোলামালটা কোথায় তাও ধরে ফেলেছি৷ মাত্র ঘণ্টা খানেক লাগবে সারাই করতে৷’

পোয়ারো বললেন, ‘কি গোলমাল হয়েছে?’

যুবকটি সাগ্রহে গাড়ির ইঞ্জিন-সংক্রান্ত পরিভাষায় ঝাঁপিয়ে পড়লো৷ পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে শান্তভাবে মাথা নাড়লেন, কিন্তু তিনি শুনছিলেন না কিছুই৷ নিখুঁত দেহসৌষ্ঠবকে তিনি বরাবরই শ্রদ্ধা করেন৷ তাঁর মতে, চারপাশে চশমাওলা ইঁদুরের সংখ্যা বড় বেশি৷ খুশি হয়ে আপন মনেই তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, একজন গ্রীক দেবতা—আর্কেডির কোন তরুণ মেষপালক৷’

যুবকটি হঠাৎই থেমে গেলো৷ ঠিক তখনই এরকুল পোয়ারোর ভুরুর বুনুনি ঘন হয়ে উঠলো সেকেন্ডের জন্য৷ তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিলো নান্দনিক, দ্বিতীয়টি মানসিক৷ দৃষ্টি উঁচিয়ে ধরতেই তাঁর চোখজোড়া তীক্ষ্ম হয়ে এলো কৌতূহলে৷

তিনি বললেন, ‘বুঝেছি, বুঝেছি৷’ একটু থেমে তিনি আবার যোগ করলেন, ‘তুমি এইমাত্র যা যা বললে সবই আমার ড্রাইভার আমাকে জানিয়েছে৷’

যুবকের দু গালে পলকে ছড়িয়ে পড়া রক্তাভা পোয়ারোর নজর এড়ালো না৷ ঘাবড়ে গিয়ে তার আঙুলগুলো চেপে বসলো টুপিটার ওপর৷

সে তোতলা হয়ে বললো, ‘ওই-হ্যাঁ, স্যর৷ সে আমি জানি৷’

এরকুল পোয়ারো মসৃণ কণ্ঠে বলে চললেন, ‘কিন্তু তুমি ভেবেছো নিজের মুখে সে কথা আমাকে জানালে ভালো হবে?’

‘অ্যা—হ্যাঁ, স্যর। ভাবলাম, নিজের মুখে খবরটা আপনাকে দিয়ে আসি৷’

এরকুল পোয়ারো বললেন, ‘তোমার দায়িত্বজ্ঞান প্রশংসা করার মতো৷ ধন্যবাদ৷’

শেষ কথাগুলোর আলোচনার পরিসমাপ্তির অস্পষ্ট অথচ নির্ভুল ইঙ্গিত থাকলেও তিনি কখনোই ভাবেননি যুবকটি বিদায় নেবে, এবং তাঁর অনুমানকে অভ্রান্ত প্রমাণিত করে সে নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে রইলো৷

তার আঙুলগুলো এক অজ্ঞাত আক্ষেপে পশমের টুপিটাকে সজোরে আঁকড়ে ধরতে লাগলো৷ আরও নীচু এবং বিহ্বল স্বরে সে বললো, ‘ইয়ে—মাপ করবেন, স্যর—এ কথা কি সত্যি যে আপনিই সেই গোয়েন্দা ভদ্রলোক—মানে, আপনিই মিঃ হারকিউলিস পরিট?’ নামটাকে সযত্নে উচ্চারণ করলো সে৷

পোয়ারো বললেন, ‘হ্যাঁ, সত্যি৷’

যুবকের মুখমণ্ডলে রক্তের ঝলক উঁকি মারলো৷

সে বললো, ‘খবরের কাগজে আপনার সম্পর্কে একটা লেখা পড়েছিলাম৷’

‘হুঁ—’

ছেলেটির দু’গাল এখন ঘোর লাল৷ তার দু চোখে যন্ত্রণার ছায়া—যন্ত্রণা এবং আকুতি৷ এরকুল পোয়ারো তার সাহায্যে এগিয়ে এলেন৷

তিনি নরম স্বরে বললেন, ‘হ্যাঁ, বলো, কি জানতে চাও?’

উত্তরে শব্দগুলো ভেসে এলো দুরন্ত গতিতে৷

‘ভয় হচ্ছে, আপনি হয়তো এটাকে আমার তরফে চরম ধৃষ্টতা বলে মনে করবেন, স্যর৷ কিন্তু ঘটনাচক্রে এভাবে এ জায়গায় আপনার এসে পড়াটা—মানে, এরকম সুযোগ নষ্ট করা যায় না, বিশেষ করে আপনার সম্পর্কে কাগজে পড়বার পর৷ কত ঘটনা আপনি শুধু বুদ্ধি দিয়ে মিটমাট করে দিয়েছেন৷ যাই হোক, ভাবলাম, আর কিছু না হোক একবার আপনাকে জিগ্যেস করে দেখবো৷ শুধু জিগ্যেস করাতে তো ক্ষতি নেই, বলুন?’

এরকুল পোয়ারো মাথা নাড়লেন৷ তিনি বললেন, ‘তুমি কোন ব্যাপারে আমার সাহায্য চাও?’

যুবক সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়লো৷ শুষ্ক বিহ্বল কণ্ঠে সে বললো, ‘একটি—একটি মেয়ের ব্যাপারে৷ আপনি—আপনি যদি ওকে খুঁজে দেন৷’

‘খুঁজে দেবো? তার মানে সে কি হারিয়ে গেছে?’

‘হ্যাঁ, স্যর৷’

এরকুল পোয়ারো চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন৷

তিনি তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন, ‘আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি, ঠিক৷ কিন্তু যাদের কাছে তোমার প্রথমে যাওয়া দরকার তারা হলো পুলিশ৷ এটা ওদেরই কাজ, আর এসব ব্যাপারে ওদের আমার চেয়ে অনেক বেশি হাত আছে৷’

ছেলেটি নড়েচেড়ে দাঁড়ালো৷

অপ্রতিভ স্বরে সে বললো, ‘ সে আমি যেতে পারবো না, স্যর৷ ব্যাপারটা ঠিক পুলিশে যাবার মতন নয়৷ বলতে গেলে ঘটনাটা একটু অদ্ভুত৷’

এরকুল পোয়ারো স্থির চোখে দেখলেন তার দিকে৷ তারপর একটা চেয়ার নির্দেশ করলেন৷

ঠিক আছে, তাহলে বোসো—কি নাম তোমার?’

‘উইলিয়ামসন, স্যর, টেড উইলিয়ামসন৷’

‘বোসো, টেড৷ পুরো ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলো৷’

‘ধন্যবাদ, স্যর৷’ সে চেয়ারটা টেনে অতি সন্তর্পণে তার কিনারায় বসলো৷ তার দু চোখে এখনও সারমেয়সুলভ আকুতি৷

এরকুল পোয়ারো নরম সুরে বললেন, ‘বলো৷’

টেড উইলিয়ামসন গভীর শ্বাস নিলো৷

‘মানে, জানেন, স্যর, ঘটনাটা ঘটেছিলো ঠিক এইরকম৷ ওকে আমি মাত্র একবারই দেখেছি৷ ওর সঠিক নাম-ঠিকানা কিছুই আমি জানি না৷ কিন্তু পুরো ব্যাপারটাই অদ্ভুত, বিশেষ করে আমার চিঠি ফিরে আসাটা৷’

‘প্রথম থেকে শুরু করো৷’ বললেন এরকুল পোয়ারো, ‘তাড়াহুড়োর কোন প্রয়োজন নেই৷ শুধু যা যা ঘটেছে সেইটুকুই আমাকে শোনাও৷’

‘বলছি, স্যর৷ আপনি হয়তো “গ্রাসলন’ চেনেন, স্যর, ব্রিজ পার হয়ে নদীর ধারে যে বড় বাড়িটা?’

‘আমি এখানে কিছুই চিনি না৷’

‘বাড়িটা স্যর জর্জ স্যান্ডারফিল্ডের৷ গ্রীষ্মকালে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে বা পার্টি দিতে তিনি বাড়িটা ব্যবহার করে থাকেন—তিনি নিয়ম মেনে শুধু হাসিখুশি হল্লোড়বাজ লোকদেরই নেমন্তন্ন করেন৷ অভিনেতা-অভিনেত্রী এই সব৷ সে যাক, আসল ঘটনা ঘটে গত জুন মাসে—বাড়ির ওয়ারলেসটা খারাপ হয়ে যাওয়ায় ওঁরা আমাকে ডেকে পাঠান সেটা সারাই করতে৷’

পোয়ারো সম্মতিসূচক ভাবে মাথা নাড়ালেন৷

‘আমি তো গেলাম৷ ভদ্রলোক তখন তাঁর অতিথিদের নিয়ে নদীতে বেড়াতে গেছেন, রাঁধুনীও বাড়িতে ছিলো না, আর তাঁর চাকরও তাঁর সঙ্গে গেছে লঞ্চে অতিথিদের পানীয় ও খাবার পরিবেশন করার জন্যে৷ বাড়িতে ছিলো শুধু ওই মেয়েটা—ও ছিলো একজন মহিলা অতিথির পরিচারিকা৷ ও-ই দরজা খুলে আমাকে নিয়ে গেলো ওয়ারলেস সেটটার কাছে, এবং যতক্ষণ আমি কাজ করেছি সারাক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো৷ সুতরাং আমাদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হয়৷ ওর নাম নিটা, ওই আমাকে বলেছে৷ ওর মালকিন একজন রুশীয় নর্তকী৷’

‘মেয়েটি জাতিতে কি, ইংরেজ?’

‘না, স্যর, মনে হয় ফরাসী হবে৷ ওর কথায় এক অদ্ভুত টান ছিলো৷ কিন্তু ইংরেজি ও ভালোই বলছিলো৷ ও—ও বেশ সহজভাবে কথাবার্তা বলতে থাকে এবং কিছুক্ষণ পরে আমি ওকে জিগ্যেস করি ও আমার সঙ্গে সে রাতে সিনেমায় যেতে পারবে কিনা, কিন্তু ও বলে রাতে দিদিমণির ওকে দরকার হতে পারে৷ তবে ও ইচ্ছে করলে তাড়াতাড়ি হাতের কাজ সেরে বিকেল নাগাদ, বেরোতে পারে, কারণ অতিথিদের লঞ্চে বেড়িয়ে ফিরতে ফিরতে দেরি হবে৷ সুতরাং, মোট কথা হলো আমিও বিকেলটা মালিককে না জানিয়ে ছুটি নিয়ে নিই (আর সেজন্য বরখাস্ত হতে হতে বেঁচে গেছি) এবং নদীর তীরে আমরা দুজনে বেড়াতে যাই৷’

সে একটু থামলো৷ একটা অস্পষ্ট হাসি তার ঠোঁটে খেলা করছে৷ দু চোখ স্বপ্নিল৷

পোয়ারো মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘ওকে দেখতে কেমন, সুন্দর?’

‘ওরকম সুন্দরী আপনি দেখেননি৷ ওর চুল ছিলো সোনার মতো—ঘাড়ের কাছ থেকে দুপাশে ডানার মতো উঠে গেছে—আর ভীষণ হাসিখুশি, ছটফটে ওর স্বভাব। আমি—আমি ওকে দেখা মাত্রই ওর প্রেমে পড়েছি, স্যর৷ এতটুকু বানিয়ে বলছি না৷’

পোয়ারো সম্মতি জানালেন নীরবে৷

উইলিয়ামসন বলে চললো, ‘ও তারপর বলেছে ওর দিদিমণি আবার দিন পনেরোর মধ্যে এখানে আসবেন এবং তখন আমরা দেখা করবো বলে ঠিক করি৷’ সে একটু থামলো, ‘কিন্তু ও আর আসেনি৷ ওর কথামতো নির্দিষ্ট জায়গায় আমি ওর জন্যে অপেক্ষা করেছি, কিন্তু ওর দেখা পাইনি, অবশেষে সাহস করে আমি ওই বাড়িতে গেছি, গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি৷ ওরা বললো, রুশীয় ভদ্রমহিলা ওর তাঁর পরিচারিকা দুজনেই বাড়িতে রয়েছেন৷ ওরা পরিচারিকাকে ডেকে পাঠায়, কিন্তু সে আসতেই দেখলাম সে নিটা নয়! একটা ময়লা রঙের রুক্ষ চেহারার মেয়ে—যদি কাউকে সাহসী বলতে হয় তো একেই বলতে হয়৷ ওরা ওকে মেরি বলে ডাকছিলো৷ ‘তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছো?’ ও বললো, মুখে একগাল বোকা-বোকা হাসি৷ ও নিশ্চয়ই বুঝেছিলো আমি একটু থতমত খেয়ে গেছি৷ বললাম, ও-ই কি সেই রুশীয় ভদ্রমহিলার পরিচারিকা, আর আমি যাকে আগে দেখেছি সে যে অন্য মেয়ে সে বিষয়েও কি যেন বলেছি, তখন ও জোরে হেসে উঠেছে, বলেছে, আগের পরিচারিকাকে হঠাৎই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ ‘ছুটি দেওয়া হয়েছে?’ অবাক হয়ে বলেছি, ‘কি জন্যে?’ মেয়েটা একটা কাঁধ ঝাঁকানোর ভঙ্গি করে হাত ওল্টালো৷ ‘আমি কি করে জানবো?’ ও বললো, ‘আমি তো তখন ছিলাম না৷’

‘সত্যি, স্যর, এ ঘটনায় আমি হতভম্ব হয়ে গেছি। সেই মুহূর্তে কি বলবো ভেবে পাইনি।

‘কিন্তু পরে সাহস সঞ্চয় করে আমি মেরির সঙ্গে আবার দেখা করলাম। নিটার ঠিকানা চাইলাম ওর কাছে। ওকে বলিনি যে নিটার পদবী আমি জানি না। যদি আমার কথামতো কাজ করে তাহলে ওকে একটা উপহার দেবো বলে কবুল করেছিলাম—ও সেই ধরনের মেয়ে যারা লাভ ছাড়া কোন কাজ করতে চায় না। সে যাক, ঠিকানা ও আমাকে এনে দিল—নর্থ লণ্ডনের একটা ঠিকানা, আমি সেই ঠিকানায় চিঠি লিখলাম নিটাকে—কিন্তু দিন কয়েক বাদেই চিঠিটা ফিরে এলো—খামের ওপর “এই ঠিকানায় বর্তমানে নেই “ লিখে পোস্ট অফিস ওটাকে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে।’

টেড উইলিয়ামসন থামলো, তার চোখ,গভীর নীল। স্থির চোখ, পোয়ারোর দিকে নিবদ্ধ। সে বললো, ‘এবারে তো বুঝলেন, স্যর? এটা নিয়ে পুলিশের কাছে যাওয়া যায় না। কিন্তু আমি ওকে খুঁজে বার করতে চাই। জানি না, কি ভাবে ওর খোঁজ করবো। যদি—যদি আপনি ওর সন্ধান আমাকে এনে দেন …’ তার মুখের রঙ গাঢ় হলো, ‘আমার—আমার খুব সামান্য কিছু জমানো টাকা আছে। পাউন্ড পাঁচেক হবে—হয়তো টেনেটুনে দশ পাউন্ড ও হতে পারে।’

পোয়ারো শান্ত কন্ঠে বললেন, ‘আর্থিক দিকটা এক্ষুনি আলোচনা করার কোন প্রয়োজন নেই। প্রথমে এই কথাটা ভেবে দ্যাখো—এই মেয়েটি, নিটা—সে তোমার নাম, কোথায় কাজ করো, তা জানতো?’

‘হ্যাঁ, স্যর, জানতো।’

‘সুতরাং ইচ্ছে করলেই সে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারতো?’

টেড ধীরে ধীরে বললো, ‘হ্যাঁ, স্যর। ‘

‘তাহলে তোমার কি মনে হয় না—হয়তো—’

টেড উইলিয়ামসন তাঁকে বাধা দিলো।

‘আপনি বলতে চাইছেন, স্যর, আমি ওকে ভালবাসলেও ও আমাকে ভালবাসেনি? কি জানি, হয়তো সেটা সত্যি হতে পারে। কিন্তু আমাকে ওর ভালো লেগেছে—এতে কোন ভুল নেই—নিছক মজা করার জন্যে ও আমার সঙ্গে মেশেনি। আর আমিও অনেক ভেবেছি,স্যর, হয়তো এসবের পেছনে কোন কারণ আছে। কেন না,স্যর, যে সব লোকের সঙ্গে ও ছিলো তারা খুব সুবিধের ছিলো না। হয়তো ও কোন বিপদে পড়েছে, বুঝতেই পারছেন কি বলতে চাইছি।’

‘তার মানে সে মা হতে চলে ছিলো? তোমার জন্য?’

‘না, স্যর, আমার জন্য নয়।’ টেডের মুখে রক্তের আকস্মিক ঝলক, আমাদের মধ্যে সেরকম সম্পর্ক ছিলো না।’

পোয়ারো চিন্তান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালেন।

তিনি মৃদু স্বরে বললেন, ‘আর তোমার ধারণা যদি সত্যি হয়-তা সত্ত্বেও তুমি ওকে খুঁজে বার করতে চাও?’

টেড উইলিয়ামসনের মুখে রক্তের উচ্ছ্বাস সীমাহীন।

সে বললো, ‘হ্যাঁ, স্যর, চাই, এবং সেটাই শেষ কথা। ও যদি অরাজী না হয় তাহলে আমি ওকে বিয়ে করতে চাই। যে বিপদেই ও পড়ুক না কেন তাতে আমার কথার কোন নড়চড় হবে না। শুধু আপনি যদি একটু কষ্ট করে ওর খোঁজ আমাকে এনে দেন, স্যর?’

এরকুল পোয়ারো স্মিত হাসলেন। তিনি আপন মনেই বললেন, “সোনালী ডানার মতো চুল। “হুঁ, আমার ধারণা এটাই হারকিউলিসের তৃতীয় শ্রমের পরীক্ষা। যদি আমার স্মৃতি বিশ্বাসঘাতকতা না করে থাকে, তাহলে সেটা ঘটেছিলো আর্কের্ডিতে।’

টেড উইলিয়ামসনের অনেক পরিশ্রমে লিখে দেওয়া নাম ও ঠিকানা লেখা কাগজটার। দিকে চিন্তিতভাবে তাকিয়ে রইলেন এরকুল পোয়ারো।

মিস ভ্যালেটা, ১৭ আপার রেনফ্রু লেন, এন.১৫।

এই ঠিকানায় গিয়ে তিনি নতুন কিছু জানতে পারবেন কিনা কে জানে। সম্ভবত পারবেন না৷ কিন্তু টেড তাঁকে এর বেশি কোন সূত্র দিতে পারেনি৷

সতেরো আপার রেনফ্রু লেন চেহারায় মলিন হলেও চরিত্রে সম্ভ্রাস্ত৷ পোয়ারোর টোকার উত্তরে দরজা খুলে দিলেন জনৈক ঝাপসা-চোখ শক্তসমর্থ মহিলা৷

‘মিস ভ্যালেটা?’

‘অনেক দিন হলো চলে গেছে সে৷’

দরজাটা বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, পোয়ারো একধাপ এগিয়ে চৌকাঠে পা রাখলেন৷

‘তার ঠিকানাটা হয়তো আপনি আমাকে দিতে পারবেন?’

‘উঁহু৷ সে কোন ঠিকানা রেখে যায়নি৷’

‘এ বাড়ি ছেড়ে সে গেছে কবে?’

‘গত গ্রীষ্মে৷’

‘সঠিক তারিখটা আমাকে বলতে পারেন?’

দুটো আধ ক্রাউনের বন্ধুত্বপূর্ণ ঠোকাঠুকির টুংটাং শব্দ শোনা গেলো পোয়ারের ডান হাত থেকে৷ ঝাপসা-চোখ ভদ্রমহিলা যেন যাদুমন্ত্রবলে নরম হলেন৷ হয়ে উঠলেন দয়ার প্রতিমূর্তি৷

‘আপনাকে সাহায্য করা তো আমার কর্তব্য, স্যর৷ দাঁড়ান, ভেবে দেখি৷ আগষ্ট, না, তারও আগে—জুলাই—হ্যাঁ, জুলাই মাসেই হবে৷ জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তা নাগাদ৷ খুব তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলো মেয়েটা৷ বোধহয় ইটালিতেই ফিরে গেছে৷’

‘তাহলে সে ইটালিয়ান ছিলো?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, স্যর৷’

‘আর এক সময়ে সে একজন রাশিয়ান নর্তকীর পরিচারিকা ছিলো, তাই না?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ৷ মাদাম সিমোলিনা না কি যেন নাম৷ থেসপিয়ানে নাচতেন তিনি, যে নাচ দেখবার জন্যে এখানকার লোকেরা একেবারে পাগল৷ তিনি ছিলেন নামী তারকাদের একজন৷’

পোয়ারো বললেন, ‘মিস ভ্যালেটা চাকরি ছাড়লো কেন, জানেন?’

মহিলা একমুহূর্ত ইতস্তত করে বললেন, ‘নাঃ, জানি না।’

‘তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিলো, তাই না?’

‘মানে—যদ্দুর শুনেছি একটু-আধটু জল ঘোলা হয়েছিলো! কিন্তু জানবেন, মিস ভ্যালেটা আমাকে কিছুই খুলে বলেনি৷ মন খুলে কথা বলবার মতো মেয়ে সে ছিলো না৷ কিন্তু তাকে দেখে মনে হতো রেগে আগুন হয়ে আছে৷ মেয়েটার মেজাজও ছিলো অত্যন্ত খারাপ—একেবারে আইটালিয়ান মেজাজকালো চোখজোড়া সব সময়েই কটমট করতো, যেন আপনার বুকে ছুরি বসাতে পারলে তার মন ঠাণ্ডা হয়৷ তার মেজাজ খারাপ থাকলে আমি তো ধারেকাছেও ঘেঁষতাম না!’

‘তাহলে মিস ভ্যালেটার এখনকার ঠিকানা আপনি জানেন না?’

উৎসাহ দিতে টুংটাং শব্দে আবার বেজে উঠলো আধ ক্রাউন দুটো৷

উত্তরের সুর সত্যি বলেই মনে হলো ঃ ‘যদি জানতাম, স্যর, আপনাকে সে খবর দিতে পারলে অত্যন্ত খুশি হতাম৷ কিন্তু বললাম তো—মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে হঠাৎ চলে যায়, আর এই সার কথা৷’

পোয়ারো চিন্তিতভাবে আপন মনেই বললেন, হুঁ, এই সার কথা৷

মুক্তি আসন্ন একটি ব্যালের জন্য দৃশ্যপট আঁকছে অ্যামব্রোস ভ্যান্ডেল৷ সেই কাজের সাগ্রহ বিরতির সামান্য মোড় ফেরাতেই তার কাছ থেকে বেশ সহজেই খবরাখবর পাওয়া গেলো৷

‘স্যান্ডারফিল্ড? জর্জ স্যান্ডারফিল্ড? বড় বাজে লোক৷ টাকার গড়াগড়ি খাচ্ছে জানি, কিন্তু লোকে বলে যে দু-নম্বরী আদমী৷ কালো ঘোড়া৷ কোন নাচুনীর সঙ্গে লটরপটর? নিশ্চয়ই, মশাই, ছিলো বৈকি—কাত্রিনার সঙ্গে৷ কাত্রিনা সামুশেনকা৷ আপনি নিশ্চয়ই তাকে দেখেছেন? কি বলবো, মশাই—দারুণ মাল৷ কি নাচের কায়দা! ‘দ্য সোয়ান অফ টুওলেলা’—এটা নিশ্চয়ই আপনি দেখেছেন? ওতে দৃশ্যসজ্জা আমার ছিলো৷ আর ডিবুসি না ম্যানাইন-এর ওটা দেখেছেন ‘লা বিশ ও বোয়া’? ওতে মাইকেল নভগিনের সঙ্গে মেয়েটা নেচেছিলো৷ মাইকেলের তুলনা নেই, কি বলেন?’

‘তাহলে মিস কাত্রিনা স্যর জর্জ স্যান্ডারফিল্ডের বান্ধবী ছিলেন?’

‘হ্যাঁ, সপ্তাহশেষের ছুটিগুলো তো তার সঙ্গে তার নদীর ধারের বাড়িতেই মেয়েটা কাটাতো৷ শুনেছি লোকটা নাকি বেশ জমকালো পার্টি দেয়৷’

‘মাদমোয়াজেল সামুশেনকার সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দিতে পারেন?’

‘কিন্তু, মশাই, সে তো এখানে আর নেই৷ প্যারিস না কোথায় যেন হুট করে চলে গেছে৷ জানেন, লোকে বলে সে নাকি বলশেভিক গুপ্তচর না কি যেন ছিলো—অবশ্য আমি তা বিশ্বাস করি না—জানেন তো, লোকে এ ধরনের কথা বলতে ভালোবাসে৷ কাত্রিনা সবসময় ভান করতো যে সে একজন হোয়াইট রাশিয়ান—তার বাবা রাজকুমার না গ্র্যান্ড ডিউক ছিলো—সাধারণতঃ যা হয়ে থাকে৷ এবং লোকে যেগুলো সহজে হজম করতে পারে৷’ ভ্যান্ডেল একটু থামলো, এবং ফিরে এলো নিজের বিষয়ে, ‘আর আমি যা বলছিলাম, যদি আপনাকে বাথশেবার মনন বুঝতে হয় তাহলে নিজেকে ডুবিয়ে দিতে হবে সেমিটিক ঐতিহ্যে৷ আমি একে বলি—’

মহানন্দে বলে চললো সে৷

স্যর জর্জ স্যান্ডারফিল্ডের সঙ্গে এরকুল পোয়ারো যে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলেন তার সূত্রপাত তেমন শুভ হলো না।

অ্যামব্রোস ভ্যান্ডেল বর্ণিত “কালো ঘোড়া “ যেন একটু অস্বস্তি বোধ করছেন মনে হলো। স্যর জর্জ বেঁটেখাটো সমর্থ পুরুষ,মাথার চুল মোটা এবং কালো, ঘাড়ে চর্বির থাক।

তিনি বললেন, ‘বলুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, কি ভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি? ইয়ে—আপনার সঙ্গে বোধহয় আগে কখনও পরিচয় হয়নি, তাই না?’

‘না, এই প্রথম।’

‘হুঁ, তা কি ব্যাপার? স্বীকার করছি, আমার ভীষণ কৌতূহল হচ্ছে। ‘

‘খুবই সামান্য ব্যাপার—শুধু একটা খবর জানতে এসেছি।’

স্যর জর্জ অস্বস্তিভরে সশব্দ হাসি হাসলেন।

‘আমার কাছ থেকে কোন ভেতরকার খবর জানতে চান? জানতাম না, টাকা লগ্নির ব্যাপারে আপনার এত আগ্রহ আছে।’

‘ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য আমি আসিনি। আমি এসেছি একজন মহিলার খোঁজে।’

‘ও,’ স্যর জর্জ স্যান্ডারফিল্ড আরামকেদারায় শরীর এলিয়ে বসলেন। তিনি যেন স্বস্তি পেলেন। তাঁর স্বরে এখন অপেক্ষাকৃত সহজ সুর।

পোয়ারো বললেন, ‘আশা করি, মাদমোয়াজেল কাত্রিনা সামুশেনকার সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিলো?’

স্যান্ডারফিল্ড সশব্দে হাসলেন।

‘হ্যাঁ। মুগ্ধ করার মতো মেয়ে। নিতান্ত দুঃখের কথা যে ও লন্ডন ছেড়ে চলে গেছে।’

‘উনি লন্ডন ছেড়ে গেলেন কেন?’

‘কি জানি, মশাই, জানি না। হয়তো প্রযোজকদের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। ও অল্পেতেই রেগে উঠতো, জানেন—একবারে রাশিয়ান মেজাজ। দুঃখিত যে আপনাকে কোনরকম সাহায্য করতে পারলাম না, কারণ ও এখন কোথায় আছে তা আমার ধারণার বাইরে। ওর সঙ্গে কোন যোগাযোগই রাখিনি।’

উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ঘরে পাওয়া গেলো আলোচনার পরিসমাপ্তির ইঙ্গিত৷

পোয়ারো বললেন, ‘কিন্তু আমি মাদমোয়াজেল সামুশেনকার খোঁজে এখানে আসিনি৷’

‘ওর খোঁজে আসেননি?’

‘না, আমি তাঁর পরিচারিকার খোঁজে এসেছি৷’

‘ওর পরিচারিকা?’

স্যান্ডারফিল্ড অপলকে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে৷

পোয়ারো বললেন, ‘তাঁর পরিচারিকাকে হয়তো আপনার মনে আছে?’

স্যান্ডারফিল্ডের যত অস্বস্তি আবার ফিরে এলো৷

হতবু্দ্ধি স্বরে তিনি বললেন, ‘পাগল, কি করে মনে থাকবে? অবশ্য এটুকু মনে আছে যে ওর পরিচারিকা একটা ছিলো৷ তবে একটু বাজে ধরনের ছিলো মেয়েটা৷ উঁকি মারা, আড়িপাতার স্বভাব ছিলো৷ আমি হলে ও মেয়ের কোন কথাতেই কান দিতাম না৷ মেয়েটা ছিলো যাকে বলে জন্মমিথ্যুক৷’

পোয়ারো বিড়বিড় করে বললেন, ‘তাহলে মেয়েটি সম্পর্কে অনেক কথাই আপনার মনে আছে দেখছি?’

স্যান্ডারফিল্ড তড়িঘড়ি বলে উঠলেন, ‘ওপর ওপর দেখে যেটুকু মনে হয়েছে, তার বেশি কিছু নয়৷ ওর নামটা পর্যন্ত আমার মনে নেই৷ দাঁড়ান, মেরি না কি যেন—নাঃ, এ ব্যাপারে কোনরকম সাহায্যই আপনাকে করতে পারলাম না দুঃখিত৷’

পোয়ারো শান্ত স্বরে বললেন, ‘মেরি হেলিনের নাম আমার থেসপিয়ান থিয়েটার থেকেই জানা হয়ে গেছে—সঙ্গে জেনেছি ওর ঠিকানা৷ কিন্তু স্যর জর্জ, আমি বলছি সেই মেয়েটির কথা, মেরি হেলিনের আগে যে মাদমোয়াজেল সামুশেনকার কাছে ছিলো৷ আমি নিটা ভ্যালেটার কথা বলছি৷’

স্যান্ডারফিল্ড অপলক বিমূঢ়৷

তিনি বললেন, ‘ওকে আমার একটুও মনে পড়ে না৷ শুধু মেরির কথাই আমার মনে আছে৷ ছোটখাটো ময়লা রঙের মেয়ে, দু চোখে নোংরা চাউনি৷’

পোয়ারো বললেন, ‘যে মেয়েটির কথা আমি বলছি সে গত জুলাইয়ে আপনার বাড়ি, গ্রাসলনে ছিলো৷’

গোমড়া মুখে বললেন স্যান্ডারফিল্ড, ‘সে যাই হোক, ওকে যে আমার মনে নেই শুধু এটুকুই আমি বলতে পারি৷ মনে হয় না সে সময় কাত্রিনার সঙ্গে কোন পরিচারিকা ছিলো৷ হয়তো আপনার কোন ভুল হচ্ছে৷’

এরকূল পোয়ারো নেতিবাচক মাথা নাড়লেন৷ না, তিনি মনে করেন না তাঁর কোন ভুল হচ্ছে৷

ছোট্ট ধূর্ত চোখে চকিতে পোয়ারোকে দেখলো মেরি হেলিন এবং সঙ্গে সঙ্গেই চোখ সরিয়ে নিলো৷ মসৃণ সুষম স্বরে বললো ও, ‘কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, মঁসিয়ে, মাদাম সামুশেনকা আমাকে চাকরি দেন জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে৷ তাঁর আগের লোক নাকি হঠাৎই চাকরি ছেড়ে চলে গেছে৷’

‘কখনও কি শুনেছো সে কেন চাকরি ছেড়ে চলে গেছে?’

‘সে হঠাৎ চলে গেছে—শুধু এটুকুই শুনেছি৷ হয়তো শরীর খারাপ বা ওই রকম কিছু হয়েছিলো৷ মাদাম আমাকে কিছু বলেননি৷’

পোয়ারো বললেন, ‘তোমার দিদিমণির কাছে কাজ করতে তোমার কখনও অসুবিধে হয়নি?’

মেয়েটি কাঁধ ঝাঁকালো৷

‘দিদিমণি বড় খেয়ালি৷ এই কাঁদছেন তো এই হাসছেন৷ কোন কোন সময় এত নিরাশ হয়ে পড়তেন যে কথাও বলতেন না, খেতেনও না৷ কখনও পাগল হয়ে উঠতেন আনন্দে৷ অবশ্য নাচিয়েরা ওই রকমই হয়৷ এর নাম মেজাজ৷’

‘আর স্যর জর্জ?’

মেয়েটি সচকিতে চোখ তুলে তাকালো৷ একটা অসদ্ভাবের চাউনি ঝিকিয়ে উঠলো ওর দু চোখে৷

‘ও, স্যর জর্জ স্যান্ডারফিল্ড? তাঁর সম্পর্কে আপনি জানতে চান? হয়তো আসলে এই খবরটা আপনি জানতে চাইছিলেন? অন্যটা তাহলে নেহাৎই অজুহাত ছিলো, হ্যাঁ? হুঁ, স্যর জর্জ, ওঁর সম্পর্কে কিছু অদ্ভুত খবর আপনাকে শোনাতে পারি, কি করে—’

পোয়ারো বাধা দিলেন, ‘তার কোন প্রয়োজন নেই৷’

মেয়েটি অবাক চোখে তাঁর দিকে চেয়ে রইলো, মুখ হাঁ করে৷ ওর চোখে হতাশাজনিত ক্রোধ৷

‘আমি সব সময়েই বলি আপনার অজানা কিছু নেই, আলেক্সি পাভলোভিচ্৷’

যথাসম্ভব তোষামোদী সুরে শব্দগুলো মৃদুকণ্ঠে উচ্চারণ করলেন এরকুল পোয়ারো৷

তিনি আপন মনেই ভাবছিলেন যে হারকিউলিসের এই তৃতীয় শ্রমের পরীক্ষার কল্পনাতীত ঘোরাঘুরি এবং সাক্ষাৎকারের প্রয়োজন হয়েছে৷ নিখোঁজ পরিচারিকার এই ছোট্ট ঘটনা তাঁর দেখা যাবতীয় রহস্যের মধ্যে দীর্ঘতম এবং সর্বাপেক্ষা জটিল বলে ক্রমশ নিজেকে জাহির করছে৷ প্রত্যেকটি সূত্র, পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর, অভ্রান্তভাবে নির্দেশ করেছে অদৃশ্য নিশানায়৷

সেই একই কারণ তাঁকে এই সন্ধ্যায় নিয়ে এসেছে প্যারিসের স্যামোভার রেস্তোরাঁয়, যার মালিক,কাউন্ট আলেক্সি পাভলোভিচ্, অহঙ্কার প্রকাশ করে থাকেন এই কথা বলে যে অভিনয়-জগতের খুঁটিনাটি তাঁর নখদর্পণে।

তিনি এখন মাথা নাড়লেন আত্মপ্রসাদের ভঙ্গিতে।

‘ঠিকই বলেছেন, ভাই,আমার অজানা কিছু নেই—সব সময়েই আমাকে জানতে য়য়। আপনি জিঞ্জেস করছেন মেয়েটা কোথায় গেছে—আমাদের ছোট্ট সামুশেনকা, সুন্দরী নাচুনী? হুঁ! ক্ষুদে মেয়েটা জবর জিনিস ছিলো।’ আঙুলের ডগায় চুমু খেলেন তিনি, ‘কি আগুন—কি ছলাকলা! মেয়েটার হতো—ওর সময়ে প্রিমিয়ার ব্যালেরিনা হতে পারতো ও—কিন্তু হঠাৎই সব শেষ—ও নিঃশব্দে সরে গেলো—পৃথিবীর শেষপ্রান্তে—আর দেখতে দেখতে লোকে ভুলে গেলো ওর কথা। ‘

‘তিনি এখন আছেন কোথায়?’ জানতে চাইলেন পোয়ারো।

‘সুইজারল্যান্ডে। ভ্যাগ্রেলে আল্পসে। যারা ক্রমশ রোগা হয়ে যায়, শুকনো কাশির কবলে পড়ে, তারাই সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়৷ ও আর বাঁচবে না, ওর দিন শেষ হয়ে এসেছে৷ ও অদৃষ্টে বিশ্বাসী৷ মৃত্যু ওর অনিবার্য৷’

বিষণ্ণতার ঘোর কাটাতে কাশলেন পোয়ারো৷ তাঁর তথ্যের প্রয়োজন৷

‘ঘটনাচক্রে তাঁর একজন পরিচারিকার কথা কি আপনার মনে আছে? নিটা ভ্যালেটা নামে একজন পরিচারিকা?’

‘ভ্যালেটা? ভ্যালেটা? একজন পরিচারিকাকে একবার স্টেশনে দেখেছি—যখন কাত্রিনাকে লণ্ডনের ট্রেনে তুলে দিতে গেছি তখন। মেয়েটা ইটালিয়ান ছিলো, পিসায় দেশ, তাই না? হ্যাঁ, আমার স্পষ্ট মনে আছে ও পিসা থেকে এসেছিলো, জাতে ইটালিয়ান৷’

এরকুল পোয়ারো আর্তনাদ করে উঠলেন৷

‘তাহলে তো,’ বললেন, তিনি, ‘আমাকে পিসায় রওনা হতে হয়৷’

পিসার ক্যাম্পো সান্টোতে দাঁড়িয়ে ছিলেন এরকুল পোয়ারো৷ তাকিয়ে আছেন একটি কবরের দিকে৷

তাহলে এইখানে এসেই তাঁর অনুসন্ধান শেষ হলো—এই সামান্য একমুঠো মাটির ঢিবির কাছে এসে৷ এর নীচেই শুয়ে আছে সেই হাসিখুশি মেয়েটি যে একজন ছাপোষা ইংরেজ মিস্ত্রীর হৃদয়ে এবং কল্পনায় আন্দোলন এনেছিলো৷

সেই আকস্মিক অদ্ভুত প্রেমের এই পরিসমাপ্তিই হয়তো সবচেয়ে ভালো হলো৷ জুলাইয়ের সেই অপরাহ্নে স্বপ্নময় কয়েক ঘণ্টার স্মৃতির মধ্যেই মেয়েটি চিরকাল বেঁচে থাকবে যুবকটির মানসে৷ বিুরুদ্ধ দুই জাতির সংঘাত শ্রেণীবিভেদের সংঘাত স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা, এ সবেরে সম্ভাবনা চিরতরে নিশ্চিহ্নে মুছে গেছে৷

বিষন্ন ভাবে মাথা নাড়লেন এরকুল পোয়ারো৷ তাঁর মন ফিরে গেলো ভ্যালোটা পরিবারের সঙ্গে তাঁর আলোচনার মুহূর্তে৷ মা, গোলগাল গ্রাম্য মুখ; ঋজু, শোকার্ত বাবা; ময়লা রঙ, সংবদ্ধ ওষ্ঠাধর বোন৷

‘হঠাৎই হয়েছে, সিনর, একেবারে হঠাৎ৷ যদিও অনেক বছর ধরেই এখন তখন ওর ব্যথা উঠতো৷ ডাক্তারবাবু আমাদের পছন্দ-অপছন্দের সুযোগ দেননি—তিনি বলেছেন, একটুও দেরি না করে অ্যাপেণ্ডিসাইটিস অপারেশান করাতে৷ সঙ্গে সঙ্গে তিনিই ওঁকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন৷ হ্যাঁ, হ্যাঁ, ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করবার পর সেই অবস্থাতেই ও মারা যায়৷ ওর জ্ঞান আর ফিরে আসেনি৷’

মা নাক টানলেন সশব্দে, বিড়বিড় করে বললেন, ‘বিয়াংকা খুব বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিল৷ অত অল্প বয়েসে ও মারা যাবে ভাবা যায় না৷’

এরকুল পোয়ারো আপন মনেই পুনরাবৃত্তি করলেন, ও বড় অল্প বয়েসে মারা গেছে৷

এই সংবাদই তিনি বয়ে নিয়ে যাবেন সেই যুবকের কাছে যে তাঁকে বিশ্বাস করে তাঁর সাহায্য চেয়েছে৷

ও তোমার জন্য নয়, বন্ধু৷ ও বড় অল্প বয়েসে মারা গেছে৷

তাঁর অনুসন্ধান শেষ—শেষ হলো এইখানে, যেখানে আকাশের পটভূমিতে লীনিং টাওয়ারের ছায়াময় অবয়ব, যেখানে প্রথম বসন্তের ফুলোরা আসন্ন জীবন ও খুশির প্রতিশ্রুতিতে মেলে ধরেছে তাদের বিবর্ণ গোলাপী শরীর৷

এই চূড়ান্ত রায়কে মেনে নিতে তাঁর মনের বিদ্রোহী অস্বীকারের কারণ কি বসন্তের চঞ্চলতা? নাকি অন্য কিছু? তাঁর মস্তিষ্কের অন্দরমহলে কোন অস্বস্তি—কয়েকটা শব্দ—একটা কথা—একটা নাম? পুরো ব্যাপারটাই বড় বেশি পরিচ্ছন্ন ভাবে শেষ হলো না—চোখে লাগার মতো মিলে গেলো না খাপে খাপে?

এরকুল পোয়ারো দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷ সমস্ত সন্দেহের নিরসন করতে গেলে আর ও একটা জায়গায় তাঁর যাওয়া দরকার৷ ভ্যাগ্রে সে আল্পস—সেখানে তাঁকে যেতেই হবে৷

এই হচ্ছে, তিনি ভাবলেন, সত্যি সত্যি পৃথিবীর শেষপ্রান্তে৷ এই বরফের থাক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা একচালা ঘরগুলো যার প্রতিটিতে শুয়ে আছে নিশ্চল এক একটি মানুষ, লড়াই করছে ছলনাময়ী মৃত্যুর সঙ্গে৷

সুতরাং অবশেষে তিনি এসে পৌঁছলেন কাত্রিনা সামুশেনকার কাছে৷ শয্যা-আচ্ছাদনের ওপরে দীর্ঘ, কৃশ দু-হাত ছড়িয়ে শুয়ে আছেন তিনি৷ ভাঙা দু গালে গাঢ় লালচে আভা৷ তাঁকে দেখে এক টুকরো স্মৃতি চঞ্চল হয়ে উঠলো পোয়ারোর মনে৷ ওঁর নাম তাঁর মনে ছিলো না, কিন্তু ওঁর নাচ তিনি দেখেছেন—শিল্পকে ভুলিয়ে দেওয়া শিল্পকলার চুড়ান্ত নৈপুণ্যে আত্মহারা হয়ে গেছেন, তিনি মুগ্ধ হয়েছেন একই সঙ্গে৷

তাঁর মনে পড়লো ‘হান্টার’ মাইকেল নভগিনের কথা,অ্যামব্রোস ভ্যান্ডেলের মস্তিষ্ক অকল্পনীয় অদ্ভুত অরণ্যে তাঁর ছন্দোময় লম্ফন এবং আবর্তনের কথা৷ তাঁর আরও মনে পড়লো সুন্দর ভেসে যাওয়া ‘হিণ্ড’-এর কথা, শিকারের আশায় যে চির-অনুসৃত, এবং চির-আকাঙ্ক্ষিত—মাথায় শিং বসানো একটি সোনালী সুন্দর প্রাণী, যার পা দুটো ঝিকমিকে ব্রোঞ্জের৷ তাঁর মনে পড়লো গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় ওর অস্তিম পতনের কথা, আর মাইকেল নভগ্রিন তখন হতবুদ্ধি দাঁড়িয়ে, নিহত হরিণের দেহ হাতে নিয়ে৷

কাত্রিনা সামুশেনকা ঈষৎ কৌতূহল নিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে৷

কাত্রিনা বললেন, ‘আপনাকে আগে কখনও দেখিনি, তাই না? কি চান আপনি আমার কাছে?’

এরকুল পোয়ারো অভিবাদনের ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকালেন৷

‘প্রথমে, আপনাকে আমি ধন্যবাদ দিতে চাই—আমার অতীতের একটি সন্ধ্যাকে আপনার শিল্পের মাধ্যমে মনোরম করে তোলার জন্য৷’

কাত্রিনা হালকাভাবে হাসলেন৷

‘আর একটু প্রয়োজনেও আমি এখানে এসেছি৷ বহুদিন ধরে আমি আপনার একজন পরিচারিকার খোঁজ করছি—তার নাম ছিলো নিটা৷’

‘নিটা?’

কাত্রিনা অবাক চোখে চেয়ে রইলেন৷ তাঁর চোখ পরমাশ্চর্য, আয়ত৷

প্রশ্ন করলেন কাত্রিনা, ‘নিটার সম্বন্ধে আপনি—কি জানেন?’

‘সবই বলবো আপনাকে৷’

পোয়ারো তাঁকে বললেন সেই সন্ধের কথা, যেদিন তাঁর গাড়ি খারাপ হয়েছিলো৷ বললেন টেউ উইলিয়ামসনের কথা, কি ভাবে সে আঙুলে টুপি নাড়াচাড়া করতে করতে বাধো-বাধো স্বরে বলেছিলে তার ভালোবাসা ও যন্ত্রণার কথা৷ অত্যন্ত মনোযোগে সব শুনলেন কাত্রিনা৷

পোয়ারোর কথা শেষ হতে তিনি বললেন, ‘বড় দুঃখের, সত্যি বড় দুঃখের৷’

এরকুল পোয়ারো মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন৷

‘হ্যাঁ,’ বললেন তিনি, ‘এটা আর্কেডির গল্প, তাই না? এই মেয়েটি সম্পর্কে আমাকে কতটুকু বলতে পারেন, মাদাম?’

কাত্রিনা সামুশেনকা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন৷

‘একজন পরিচারিকা আমার ছিলো—জুয়ানিটা৷ খুব ভালো ছিলো মেয়েটা—হাসিখুশি, উচ্ছল৷ ঈশ্বরের আদরের মানুষের যা সচরাচর ঘটে থাকে ওরও তাই হলো৷ অল্প বয়েসেই মারা গেলো ও৷’

এ তো পোয়ারোর নিজের কথা—শেষ কথা—অনিবার্য শব্দনিচয়৷ এখন সেই কথাই তিনি আবার শুনছেন—তা সত্ত্বেও তিনি ক্ষান্ত হলেন না৷

তিনি প্রশ্ন করলেন, ‘সে মারা গেছে?’

‘হ্যাঁ, মারা গেছে৷’

এক মিনিট নীরব রইলেন এরকুল পোয়ারো, তারপর বললেন, ‘কিন্তু তবুও একটা কথা আমার মাথায় ঢুকছে না, আমি স্যর জর্জ স্যান্ডারফিল্ডকে আপনার এই পরিচারিকার কথা জিগ্যেস করেছিলাম এবং তাঁকে দেখে মনে হয়েছিলো যেন ভয় পেয়েছেন৷ প্রশ্ন হলো, কেন?’

নৃত্যপটিয়সীর মুখমণ্ডলে ঈষৎ বিরক্তির অভিব্যাক্তি ছায়া ফেললো৷

আপনি শুধু বলেছেন আমার একজন পরিচারিকা৷ সে ভেবেছে আপনি মেরির কথা বলছেন—জুয়ানিটা চলে যাবার পর যে মেয়েটা আমার কাছে আসে৷ সম্ভবত ও জর্জকে কোন একটা ব্যাপার নিয়ে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করেছি৷ বড় বদ ছিলো মেয়েটা। লুকিয়ে চুরিয়ে খুটখাট করার স্বভাব ছিলো ওর, সব সময় ড্রয়ার খুলে চিঠিপত্র ইত্যাদি ঘাঁটাঘাঁটি করতো৷’

পোয়ারো মৃদুস্বরে বললেন, ‘ও, তাহলে সেই জন্য৷’

তিনি এক মিনিট থামলেন, তারপর আবার অশান্ত সুরে বলে চললেন, ‘জুয়ানিটার পদবী ছিলো ভ্যালোটা, সে পিসায় অ্যাপেণ্ডিসাইটিস অপারেশন করাতে গিয়ে মারা যায়৷ তাইতো?’

নর্তকী কাত্রিনা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাবার পূর্বমুহূর্তে তাঁর মুখমণ্ডলে প্রছন্ন অথচ উপস্থিত ইতস্তত ভাবটুকু পোয়ারোর নজর এড়ালো না৷

‘হ্যাঁ৷’

আত্মমগ্ন ভাবে বললেন পোয়ারো, ‘কিন্তু তবুও। একটা ছোট্ট গোলমাল থেকে যাচ্ছে—তার আত্মীয়রা তাকে বিয়াংকা বলে উল্লেখ করছিলো, জুয়ানিটা নয়৷’

কাত্রিনা তাঁর কৃশ কাঁধ ঝাঁকালেন৷

তিনি বললেন, ‘বিয়াংকা—জুয়ানিটা, এতে কি আসে যায়? আমার মনে হয় ওর আসল নাম ছিলো বিয়াংকা, কিন্তু জুয়ানিটা নামটা বেশি স্বপ্নময় বলে মনে হওয়ায় ও নিজের ওই নাম রাখে৷’

‘ও, আপনার তাই মনে হয়?’ একটু থামলেন পোয়ারো, তারপর কণ্ঠস্বর পরিবর্তন করে বললেন, ‘কিন্তু এর অন্য একটা কারণ আমার জানা আছে৷’

‘কি কারণ?’

পোয়ারো সামনে ঝুঁকে এলেন৷

তিনি বললেন, ‘যে মেয়েটিকে টেড উইলিয়ামসন দেখেছিলো তার চুল ছিলো সোনালী ডানার মতো, সে-ই বলেছে৷’

আরও কাছে ঝুঁকে এলেন পোয়ারো৷ কাত্রিনার চুলের কম্পমান ডেউ দুটো স্পর্শ করলো তাঁর আঙুল৷

‘সোনালী ডানার মতো, সোনালী শিংয়ের মতো? যে ভাবে আপনি দেখবেন, এটা নির্ভর করবে কি ভাবে আপনাকে লোকে দেখছে, শয়তানের বেশে না দেবদূতের ভূমিকায়! দুটোর যে কোন একটা আপনি হতে পারেন৷ নাকি এ দুটো তরাসিত সেই হরিণের সোনালী শিং?’

কাত্রিনা বিড়বিড় করে বললেন, ‘তরাসিত সেই হরিণ…’ এবং তাঁর স্বরে চূড়ান্ত নৈরাশ্য৷

পোয়ারো বললেন, ‘প্রথম থেকেই টেড উইলিয়ামসনের বর্ণনা আমাকে বিচলিত করেছে—আমাকে কিছু একটা মনে করিয়ে দিয়েছে—সেই কিছু একটা আপনি, ঝিকমিকে ব্রোঞ্জের পায়ে অরণ্যের বুক চিয়ে নেচে নেচে ছুটে চলেছেন৷ আমার ধারণা কি আপনাকে খুলে বলবো, মাদমোয়াজেল? আমর মনে হয় কোন একটা সপ্তাহ আপনার কোন পরিচারিকা ছিলো না, আপনি ‘গ্রাসলন’ এ একাই গিয়েছিলেন, কারণ বিয়াংকা ভ্যালেটা ইটালিতে ফিরে গেছে এবং নতুন কোন পরিচারিকা আপনি তখনও রাখেননি৷ বর্তমানে যে অসুস্থতার শিকার আপনি হয়েছেন তার লক্ষণ তখনই আপনি অনুভব করতে পারছিলেন, এবং যখন সকলে সারাদিনের জন্য নৌকাবিহারে রওনা হলো আপনি থেকে গেলেন বাড়িতে৷ দরজায় শুনলেন ঘণ্টির শব্দ, আপনি দরজা খুলে দিলেন, দেখলেন—বলবো, কি দেখলেন? আপনি দেখলেন শিশু-সরল এক যুবককে দেবতার মতো যার রূপ! এবং তার জন্য একটি মেয়ের জন্ম দিলেন আপনি—না, জুয়ানিটা নয়—ইনকগিনিটা—আর তার সঙ্গে ঘণ্টা কয়েক পায়ে হেঁটে বেড়ালেন আর্কেডিতে৷’

এক সুদীর্ঘ নীরবতা৷ তারপর কাত্রিনা চাপা ভগ্ন স্বরে বললেন, ‘অন্তত একটা বিষেয়ে আমি আপনাকে সত্যি কথা বলেছি৷ এ গল্পের সত্যিকারের পরিণতিটা আপনাকে আমি জানিয়ে দিয়েছি৷ নিটা অল্প বয়েসে মারা যাবে৷’

‘উহুঁ, অসম্ভব!’ এরকুল পোয়ারো যেন বদলে গেছেন৷ তিনি সশব্দে চড় মারলেন সামনের টেবিলে৷ হঠাৎই তিনি হয়ে উঠেছেন বাস্তববাদী, পার্থিব ব্যবহারিক৷

তিনি বললেন, ‘তার কোন প্রয়োজন নেই৷ আপনাকে মরতে হবে না৷ নিজে বাঁচবার জন্য আপনাকে লড়তে হবে, পারবেন না?—সেই সঙ্গে বাঁচাতে হবে আর একজনকে৷’

কাত্রিনা মাথা নাড়লেন বিষাদে, হতাশায়৷

‘সেখানে আমার বেঁচে থাকার জন্যে কি আছে?’

‘অভিনয় জীবন নেই, মানছি! কিন্তু ভেবে দেখুন, অন্য এক জীবন তো রয়েছে৷ আচ্ছা, মাদামোয়াজেল, সত্যি কথা বলুন দেখি, আপনার বাবা কি সত্যিই কোন রাজকুমার কি গ্র্যান্ড ডিউক ছিলেন, নাকি কোন জেনারেল?’

কাত্রিনা শব্দ করে হেসে উঠলেন৷

তিনি বললেন, ‘বাবা লেনিনগ্রাডে লরি চালাতো!’

চমৎকার! তাহলে গ্রামের একজন গ্যারেজ মিস্ত্রীর স্ত্রী হতে আপনার অসুবিধেটা কোথায়? আপনি হতে পারবেন দেবশিশুর মতো সুন্দর সন্তানদের জননী, যাদের পায়ে সম্ভবত ফুটে উঠবে আপনার অতীতের নাচের ছন্দ৷’

কাত্রিনা মুহূর্তে স্তব্ধ-নিঃশ্বাস হলেন৷

‘কিন্তু এসব নিছকই কল্পনা অবাস্তব!’

‘সে যাই হোক,’ অসীম আত্মতুষ্টির সুরে বললেন এরকুল পোয়ারো, আমার বিশ্বাস এ কল্পনা পুরোপুরি সত্যি হতে চলেছে৷

দ্য আর্কেডিয়ান ডিয়ার

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন