অনীশ দেব
অসহ্য উত্তপ্ত রাত৷ ক্রান্তিয় অঞ্চলের পক্ষেও এ উষ্ণতা অপ্রত্যাশিত৷ একটা গেলাসে জিন ও সোডা ঢালছিলো ভিকেরী, হোটেল-ঘরের দরজায় কারো সতর্ক টোকার শব্দ শুনতে পেলো৷
‘কে? সারা?’ অস্ফুট কণ্ঠে বললো সে৷
উত্তরে নিঃশব্দে অথচ ক্ষিপ্ত পায়ে ঘরে পা রাখলো এক আগন্তুক, এবং একই সঙ্গে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিলো৷
‘আমি ফেনার৷’ বলল আগন্তুক, ‘সারার স্বামী!’ চেয়ারে বসা ভিকেরীর দিকে তাকিয়ে প্রকট হাসলো সে, ‘আমাকে দেখে কি চমকে গেলেন নাকি? সারাও চমকে উঠেছিলো৷’
‘কিন্তু আপনি—’ ভিকেরী চেয়ার ছেড়ে উঠতে গেলো৷
‘কষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই৷’ ফেনার তাকে বললো, ‘যেমন আছেন তেনি বসে থাকুন৷’ দাঁত বের করে হাসতে হাসতেই জ্যাকেটের পকেট থেকে বেঢপ ‘ওয়েবলি’টা বার করলো আগন্তুক এবং ভিকেরীর মধ্যদেশ লক্ষ্য করে উঁচিয়ে ধরলো৷
‘অসহায় থিতু নিশানা৷’ ভিকেরী বলল, ‘নাঃ, আপনার এই অখেলোয়াড়ী মনোভাবের ঠিক প্রশংসা করতে পারছি না৷’
‘হ্যাঁ, খেলোয়াড়ী মনোভাব সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া তো আপনারই সাজে, বিশেষ করে আমার স্ত্রীকে নিয়ে যে খেলাটা দেখালেন তারপর৷ বিখ্যাত শ্বেত শিকারী, কি বলেন? পাশাপাশি হোটেলের ঘর আর আনুষঙ্গিক সবকিছু—চমৎকার শিক্ষার- অভিযান৷’
ভিকেরী দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘আমার মনে হয় এখন এ অভিযোগকে অস্বীকার করে কোন লাভ নেই৷ সুতরাং গুলি করুন এবং নিজের ফাঁসিকাঠের পথটা মোলায়েম করুন৷’
‘ভালো কথাই মনে করিয়ে দিয়েছেন৷ ফাঁসিতে ঝোলার ইচ্ছে আমার নেই৷ সুতরাং গুলি আপনাকে আমি করছি না৷’ পিস্তলটা স্থির লক্ষ্যে অচঞ্চল রেখে জ্যাকেটের পকেট হাতড়ালো সে এবং বার করে আনল একটা ছোট চামড়ার বটুয়া৷ অলস শান্ত ভঙ্গীতে বটুয়াটা খুলে উজ্জ্বল বিচিত্র রঙের কিলবিল করা একটা বস্তু ভিকেরীর পায়ের কাছে ফেললো৷ জিনিসটা প্রবালের সরু হারের মতো, কিন্তু জীবন্ত৷
যদি ভালো চান তো নড়াচড়া করবেন না৷’ মৃদু স্বরে বললো ফেনার, ‘হ্যাঁ, ওটা একটা ক্রেইট৷ লোকে বলে ‘ক্রেইট’ নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে মারাত্মক সাপ৷’
‘এক মিনিট, মিঃ ফেনার, আমার কথাটা শুনুন—’
ছোট প্রবালের হারটা হঠাৎই নিজেকে টান টান করে নিলো৷ ভিকেরী পিছিয়ে যাওয়ার আগেই গোলাপী বিদ্যুৎ ছোবল মারলো৷ প্যান্টের পাতলা কাপড় ভেদ করে আবার, আরও একবার তার বিষ দাঁত ভিকেরীর ডান পায়ে বসিয়ে দিলো ক্রেইটটা৷
ভিকেরী শ্বাস টেনে চোখ বুজলো৷ সাপটাকে পায়ে পিষে মারার কোনো চেষ্টাই করলো না সে৷ হঠাৎই সাপটা ক্লান্তভাবে এলিয়ে পড়লো এবং নিজের শরীর গুটিয়ে কার্পেটের মাঝখানে পড়ে রইলো৷
ফেনার ঢোক গিলল, কপাল মুছলো সে বললো, উঠে দাঁড়াল৷ পিস্তলটা টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল৷ ‘এটা রেখে গেলাম,’ হয়তো এটা কাজে লাগবে৷ সবাই বলে, দশ মিনিটেরও কম সময়ে—’
ভিকেরী হঠাৎ সশব্দে হাসল৷ ‘মিঃ ফেনার, আপনি এক নম্বরের বোকা!’
‘তার মানে?’
‘একটা গেঁইয়া লোক আপনাকে ‘ক্রেইট’ বলে একটা জল-ঢোঁড়া গছিয়ে দিলো, আর আপনি তার কথা বিশ্বাস করলেন৷ যেমন একটা বাজে মেয়েছেলের কথায় বিশ্বাস করে বসলেন, আপনার স্ত্রীর সঙ্গে আমার লটরপটর চলছে৷ ঐ মেয়েটাকে আমি পছন্দ করতাম না বলেই আমার আর সারার নাম জড়িয়ে সে আপনাকে একটা গপ্পো শুনিয়েছে৷’ ভিকেরী আবার হাসলো, ‘জানি, এ কথা বিশ্বাস করতে আপনার সময় লাগবে, কিন্তু প্রকৃত ঘটনা আপনার জানা দরকার,তাই বললাম৷’
‘এই গল্প আমাকে আপনি হজম করতে বলেন?’
‘বিশ্বাস করা না করা আপনার অভিরুচি৷’ ভিকেরী অসহায় ভাবে হাত নাড়লো, ‘তবে আপনার এই বিষাক্ত সম্রাটের প্রকৃত চরিত্রটা একবার যাচাই করে যান৷ আসুন, একটু গলা ভেজানো যাক৷ আমার স্বাস্থ্যের যে কোনো ক্ষতি হয়নি, হবে না—সেটা স্বচক্ষেই দেখে নিন৷’
এবং সত্যিই কোনো ক্ষতি হলো না ভিকেরীর—শুধু ফেনারকে একটু জিন খাওয়ানো ছাড়া৷ সামান্য কথোপকথনেই ফেনার বুঝলো, ভিকেরীকে সে মিথ্যেই সন্দেহ করেছে৷ ভিকেরী কার্পেটে পড়ে থাকা ঐ ছোট্ট সাপটার মতই নিষ্পাপ ও নিরীহ৷
বিদায় নেবার সময় তার রূঢ় ব্যবহারের জন্য ভিকেরীর কাছে বারবার ক্ষমা চাইলো ফেনার৷ বললো, ‘সারাকে সে প্রথম প্লেনেই লণ্ডনে পাঠিয়ে দিয়েছে, এবং কাল সকালে সেও লণ্ডন রওনা হবে৷’
ভিকেরী তাকে শুভযাত্রা কামনা করে বলল, ‘পিস্তলটা তাহলে সঙ্গে নিয়ে যান; আর সাপটাকেও ফেলে যাবেন না৷ আশা করি, একটা জল-ঢোঁড়ার বাচ্চার জন্য বটুয়ার কোনো প্রয়োজন হবে না৷ ওটা স্রেফ পকেটে ভরে নিন৷ শরীরের উষ্ণতা এবং ছোঁয়া পেয়ে সাপের বাচ্চাটা ভালোই থাকবে—’ হাসলো ভিকেরী৷
ফেনার পাশের ঘরে রওনা হতেই (যে ঘরে প্রথমে তার স্ত্রী ছিলেন) ভিকেরী জামা-কাপড় ছেড়ে বিশ্রামের আয়োজন করতে লাগলো৷ তার মনে বয়ে চললো আম্বিক হিসাবে ঝঞ্ঝা৷ যথা, সারা লণ্ডন পৌঁছলে ওর সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করতে তার কতোটা সময় লাগবে? ফেনারের বিষয়-সম্পত্তির আর্থিক মূল্যের পরিমাণও যেন কতো টাকা বলেছিলো৷ আর জ্যাকেটের পকেটের অস্বস্তিকর পরিবেশে জেগে উঠে, কাপড়ের আড়াল ভেদ করে ফেনারের স্থূল দেহে ছোবল মারতে ঐ বিষাক্ত ‘ক্রেইট’ টার ঠিক কতোটা সময় লাগবে?
তার শেষ প্রশ্নের উত্তরটা এলো সঙ্গে সঙ্গেই৷
দেওয়ালের অপর প্রান্তে, পাশের ঘরে, মানুষটার বুকফাটা আর্তচিৎকার ভেসে এলো তার কানে৷ এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই, বিষাক্ততায় ‘ক্রেইট’-এর জুড়ি নেই, ভেবে খাটের কিনারায় এসে বসলো ভিকেরী, তার নকল পায়ের চামড়ার ফিতেগুলো ধীরে-সুস্থে খুলতে লাগলো প্লাষ্টিকের পাল্টা নামিয়ে রেখে বিষণ্ণভাবে হাসলো সে৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন