অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি

অনীশ দেব

মিলিয়ন ডলার বন্ড রবারি

‘ইদানীং ঋণপত্র চুরির যেন একটা হিড়িক পড়ে গেছে!’ একদিন সকালে খবরের কাগজটাকে পাশে নামিয়ে রেখে মন্তব্য করলাম, ‘পোয়ারো, এসো, বিশ্লেষণ নামক বিজ্ঞানের জটিলতা ছেড়ে এবার আমরা সরাসরি অপরাধের প্রতি আসক্ত হই৷’

‘বন্ধুবর হেস্টিংস, তুমি যে ঠিক—কি যেন বলো তোমরা?—“তাড়াতাড়ি ধনী হও” পন্থা অবলম্বন করতে চাইছ, হ্যাঁ?’

‘কেন চাইব না! এই শেষ পৃষ্ঠার খবরটা দেখেছ? লন্ডন অ্যান্ড স্কটিশ ব্যাঙ্ক নিউ-ইয়র্কে প্রায় দশ লক্ষ ডলার মূল্যের লিবার্টি বন্ডস্ পাঠাচ্ছিল, কিন্তু মাঝরাস্তায় “অলিম্পিয়া” নামক যাত্রীবাহী জাহাজ থেকে সেগুলো এক আশ্চর্য উপায়ে উধাও হয়ে যায়৷’

‘সমুদ্র-অসুস্থতা বাদ না সাধলে আমি সানন্দে এ জাতীয় কোনও বিশাল জাহাজের যাত্রী হয়ে যেতাম৷’ স্বপ্নাচ্ছন্ন অস্ফুট কণ্ঠে বলল পোয়ারো৷

‘ঠিকই বলেছ’, সোৎসাহে সায় দিলাম, ‘কয়েকটা জাহাজকে দেখে তো রাজপ্রাসাদ বলে ভ্রম হয়; আকর্ষণীয় টলটলে সাঁতার-দীঘি, উন্মুক্ত বিস্তৃত বারান্দা, জমজমাট রেস্তোরাঁ, দীঘির কিনারে ছায়াঘন তালগাছের সারি—সত্যি, সমুদ্রে যে আছি বিশ্বাস করাই শক্ত!’

‘কিন্তু আমি, সমুদ্রের উপস্থিতি অনুভব করতে আমার বিন্দুমাত্রও সময় লাগে না!’ দুঃখিত স্বরে মন্তব্য করল পোয়ারো, ‘আর যে সব তুচ্ছ আকর্ষণের কথা তুমি বললে তার আবেদন আমার কাছে সামান্যই; কিন্তু বন্ধু, একবার ভাব তো সেইসব প্রতিভাধর ব্যক্তিদের কথা, যারা ছদ্মবেশে কোনও জাহাজের যাত্রী হয়ে ভ্রমণ করছে! হয়তো এইরকম কোনও ভাসমান রাজপ্রাসাদেই সন্ধান পাওয়া যাবে অপরাধ-জগতের মুষ্টিমেয় অবিস্মরণীয় প্রতিভাশালী শিরোমণিদের!’

আমি হাসলাম, ‘ও, তোমার আগ্রহ তাহলে এই দিকে! যে চতুর-চূড়ামণি লিবার্টি বন্ডস্ সুকৌশলে আত্মসাৎ করেছে তুমি তার সঙ্গে সম্মুখ-সমরে নামতে চাও?’

গৃহকর্ত্রী আমাদের আলোচনায় যাতিপাত করলেন৷

‘একটি অল্পবয়েসি মেয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়, মিঃ পোয়ারো৷ এই যে তার কার্ড৷’

কার্ডে ছাপা অক্ষরে লেখা ঃ মিস এস্মি ফারক্যুয়ার৷

পোয়ারো অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে টেবিলের নীচে প্রায় ঝাঁপ দিয়ে কুড়িয়ে নিল পড়ে-থাকা একটা রুটির টুকরো৷ সেটাকে অতি সন্তর্পণে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিয়ে গৃহকর্ত্রীকে ইশারায় জানালো মেয়েটিকে ডেকে দিতে৷

মিনিট কয়েকের মধ্যেই যে মেয়েটি ঘরে প্রবেশ করল সে আমার দেখা সুন্দরীশ্রেষ্ঠাদের অন্যতম৷ বয়েস তার আনুমানিক পঁচিশ; আয়ত গভীর চোখের রঙ বাদামি এবং তার নিখুঁত দেহসৌষ্ঠব মুগ্ধ করার মতো৷

‘দয়া করে আসন গ্রহণ করুন, মাদমোয়াজেল৷ এ আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু, ক্যাপ্টেন হেস্টিংস, যে আমাকে ছোটখাটো সমস্যায় প্রায়ই সাহায্য করে থাকে৷’

‘কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আজ যে সমস্যা নিয়ে আমি আপনার কাছে এসেছি সেটা মোটেই “ছোটখাটো” নয়’, আমার দিকে অভিবাদন জানিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে মেয়েটি বলল, ‘আমার ধারণা, ইতিমধ্যেই আপনি হয়তো ব্যাপারটা খবরের কাগজে পড়ে থাকবেন৷ অলিম্পিয়া থেকে চুরি যাওয়া লিবার্টি বন্ডস্-এর কথাই আমি বলছি৷’ পোয়ারোর মুখমণ্ডলে হয়তো ঈষৎ বিস্ময়ের ছায়াপাত ঘটে থাকবে, কারণ মেয়েটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠল, ‘আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন, লন্ডন অ্যান্ড স্কটিশ ব্যাঙ্কের মতো এক বিশাল প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী৷ একদিক থেকে ভাবলে কিছুই না, আবার অন্যদিক থেকে ভাবলে অনেক কিছু৷ আপনি হয়তো জানেন না মঁসিয়ে পোয়ারো, মিঃ ফিলিপ রিজওয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা ঠিক হয়ে আছে৷’

‘ও—আচ্ছা! যখন ঋণপত্রগুলো চুরি যায়—’

‘তখন সেগুলো ফিলিপের দায়িত্বেই ছিল৷ অবশ্য এমন নয় যে ওর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসতে পারে, কারণ ঠিক ওর দোষে ঋণপত্রগুলো চুরি যায়নি৷ কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যাপারটা ওকে যেন পাগল করে তুলেছে৷ তার ওপর ফিলিপের মামা বরাবরই বলছেন, ঋণপত্রগুলো যে তার কাছে আছে, সে কথা ফিলিপ হয়তো জাহাজে উঠে কোনও সহযাত্রীকে অন্যমনস্কভাবেই বলে থাকবে। সব মিলিয়ে এটা ওর উন্নতির পথে এক ভীষণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷’

‘মিঃ রিজওয়ের মামার নাম কী?’

‘মিঃ ভ্যাভাসুর, লন্ডন অ্যান্ড স্কটিশ ব্যাঙ্কের যুগ্ম সাধারণ পরিচালক৷’

‘মিস ফারক্যুয়ার, আপনি বরং সম্পূর্ণ ঘটনাটা আমাকে খুলে বলুন—’

‘তাহলে শুনুন৷ আপনি বোধহয় জানেন, এই ব্যাঙ্কের উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকায় তাদের ঋণের প্রসার ঘটানো এবং সেই কারণেই তারা প্রায় দশ লক্ষ ডলার মূল্যের লিবার্টি বন্ডস্ সেখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়৷ মিঃ ভ্যাভাসুর এই কাজের জন্যে বেছে নেন তাঁর ভাগ্নে ফিলিপকে৷ কারণ, প্রথমত, ফিলিপ বহু বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যাঙ্কের কর্তব্য পালন করে এসেছে, এবং দ্বিতীয়ত নিউ ইয়র্কে ব্যাঙ্কের কার্যকলাপ সম্পর্কে অন্তরঙ্গভাবে অবহিত ছিল৷ গত ২৩শে অলিম্পিয়া লিভারপুল থেকে ছাড়ে, এবং সেইদিনই সকালে ফিলিপের হাতে ঋণপত্রগুলো তুলে দেওয়া হয়; তুলে দেন লন্ডন অ্যান্ড স্কটিশ ব্যাঙ্কের দুই যুগ্ম সাধারণ পরিচালক—মিঃ ভ্যাভাসুর ও মিঃ শ’৷ ঋণপত্রগুলো গুণে, প্যাকেটে ভরে, ওর সামনেই সিলমোহর করে দেওয়া হয়৷ তারপর ও সেটাকে নিজের ট্রাঙ্কে তুলে রেখে তালা দিয়ে দেয়৷’

‘সাধারণ তালা লাগানো ট্রাঙ্ক?’

‘না৷ মিঃ শ’ হাবস কোম্পানির একটা বিশেষ তালা ট্রাঙ্কে লাগিয়ে নেবার জন্যে বার বার করে অনুরোধ করেন৷ ফিলিপ, আপনাকে তো একটু আগেই বলেছি, প্যাকেটটা রেখেছিল ট্রাঙ্কের একেবারে নীচে৷ নিউ-ইয়র্কে পৌঁছবার কয়েক ঘণ্টা আগে ট্রাঙ্ক থেকে প্যাকেটটা চুরি যায়৷ গোটা জাহাজটা তন্ন-তন্ন করে খোঁজা সত্ত্বেও কোনও ফল হয়নি৷ সুতরাং পরিস্থিতি দেখে এ ধারণা হওয়াটাই স্বাভাবিক, ঋণপত্রগুলো সরাসরি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে৷’

পোয়ারো একটা মুখভঙ্গি করল৷

‘কিন্তু ঋণপত্রগুলো পুরোপুরি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়নি, মাদমোয়াজেল, কারণ যতদূর জানি অলিম্পিয়া নিউ ইয়র্কে পৌঁছনোর আধ ঘণ্টার মধ্যেই সেগুলোকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে বিক্রি করে ফেলা হয়৷ সুতরাং, নিঃসন্দেহে আমার পরবর্তী কর্তব্য হচ্ছে মিঃ রিজওয়ের সঙ্গে দেখা করা৷’

‘চেশায়ার চীজ’-এ আমার সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ গ্রহণ করার জন্য আমি আপনাদের অনুরোধ করতে যাচ্ছিলাম৷ কারণ ফিলিপ সেখানে থাকবে৷ ও আমার সঙ্গে দেখা করতে আসছে, কিন্তু এখনও জানে না আমি ওর হয়ে আপনার সঙ্গে এ ব্যাপারে পরামর্শ করছি৷’

এই শুভ প্রস্তাবে বিনা দ্বিধায় সম্মত হলাম আমরা, এবং ট্যাক্সি চড়ে রওনা হলাম গন্তব্যস্থল অভিমুখে৷

মিঃ রিজওয়ে যথারীতি প্রতীক্ষায় ছিল৷ দুজন নিছক অপরিচিতের সঙ্গে তার বাগদত্তাকে উপস্থিত হতে দেখে সে একটু অবাকই হল৷ ফিলিপ রিজওয়ে দীর্ঘকায় কেতাদুরস্ত সুদর্শন যুবক; কপালের দু’পাশে চুলে ঈষৎ রুপোলি আভাস থাকলেও বয়েস তার তিরিশের বেশি নয়৷

মিস ফারক্যুয়ার তার কাছে এগিয়ে গেল, হাত রাখল ফিলিপের হাতে৷

‘তোমাকে না জিগ্যেস করে কাজ করার জন্যে আমাকে ক্ষমা করো, ফিলিপ৷’ ও বলল, ‘এসো—মঁসিয়ে পোয়ারো, যাঁর কথা তুমি প্রায়ই শুনে থাকবে এবং তাঁর বন্ধু ক্যাপ্টেন হেস্টিংসের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দিই৷’

রিজওয়েকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে বলে মনে হল৷

‘আপনার কথা না শুনে থাকলে আর কার কথা শুনব, মঁসিয়ে পোয়ারো!’ সহাস্যে হাত ঝাঁকিয়ে ফিলিপ রিজওয়ে বলল, ‘কিন্তু আমি ভাবতেই পারিনি এস্মি আমার—আমাদের এই সমস্যা নিয়ে আপনার সঙ্গে পরামর্শ করার কথা ভাবছে৷’

‘আমার ভয় ছিল, জানতে পারলে তুমি হয়তো আমাকে বারণ করতে, ফিলিপ৷’ নম্রস্বরে বলল মিস ফারক্যুয়ার৷

‘ও, আত্মরক্ষার জন্যে তুমি তাহলে চেষ্টা-চরিত্র করতে শুরু করেছ৷’ মৃদু হেসে মন্তব্য করল রিজওয়ে, ‘আশা করি, মঁসিয়ে পোয়ারো এই অসাধারণ রহস্যের ওপর কিছু আলোকপাত করতে পারবেন; কারণ, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে আমার মনের সমস্ত শৃঙ্খলা নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে৷’

বাস্তবিকই, মুখমণ্ডলে শ্রান্তির ছাপ, কোটরগত চোখ স্পষ্টভাবে প্রমাণ করছে কী প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্যেই না তাকে কাজ করতে হচ্ছে৷

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে,’ আশ্বাসের সুরে বলল পোয়ারো, ‘আসুন, এবার খাওয়াদাওয়ায় মনোযোগ দেওয়া যাক৷ খেতে খেতেই চার মাথা এক করে আমরা চিন্তা করব এ সমস্যার সমাধান কী করে করা যায়৷ মিঃ রিজওয়ের গল্পটা আমি তাঁর মুখ থেকেই আগোগোড়া শুনতে চাই৷’

যখন আমরা রেস্তোরাঁটির কয়েকটি বিশেষ খাদ্যের প্রশস্তিতে আলোচনারত তখন ফিলিপ রিজওয়ে শান্ত স্বরে প্রাক-ঋণপত্র চুরির ঘটনাবলী পোয়ারো বলে যেতে লাগল৷ মিস ফারক্যুয়ারের কাহিনির সঙ্গে তার কাহিনির কোনও পার্থক্য খুঁজে পাওয়া গেল না৷ কাহিনি শেষ হলে পোয়ারো একটি প্রশ্নের মাধ্যমে কথোপকথনে সক্রিয় অংশ নিল৷

‘ঠিক কীভাবে আপনি আবিষ্কার করলেন ঋণপত্রগুলো চুরি গেছে, মিঃ রিজওয়ে?’

ফিলিপের হাসিতে বিষণ্ণ তিক্ততা ঝরে পড়ল৷

‘কষ্ট করে “আবিষ্কার” করার কোনও প্রয়োজন ছিল না, মঁসিয়ে পোয়ারো৷ কারণ ব্যাপারটা কোনও অন্ধেরও নজর এড়িয়ে যেত না৷ আমার ট্রাঙ্কটা বাঙ্কের নীচ থেকে অর্ধেক বেরিয়ে ছিল৷ আর ওটার সারা শরীর বিভিন্ন ওজনের আঘাতের দাগ৷ যেন তালাটাকে ভাঙবার জন্যে কারা ওটাকে সজোরে আছাড় মেরেছে৷’

‘কিন্তু আমার তো ধারণা ছিল ওটা চাবি দিয়েই খোলা হয়েছে?’

‘হ্যাঁ, তাই৷ কারণ যারাই তালা ভাঙার চেষ্টা করে থাকুক, তাদের চেষ্টা সফল হয়নি৷ এবং অবশেষে তারা হয়তো অন্য কোনও উপায়ে তালাটা খুলতে সক্ষম হয়েছে৷’

‘আশ্চর্য’, বলল পোয়ারো, ওর চোখে ঝিলিক মেরে গেল আমার বহু-চেনা সবুজ আলোর দ্যুতি, ‘সত্যিই আশ্চর্য! ওরা গায়ের জোরে তালা ভাঙার চেষ্টা করে এতখানি মূল্যবান সময় নষ্ট করল—অথচ তারপরই হঠাৎ আবিষ্কার করল চাবিটা সর্বক্ষণ ওদের কাছেই ছিল—কারণ হাবস কোম্পানির তালার নকল চাবি বানানো সম্পূর্ণ অসম্ভব!’

‘আর সেই কারণেই চাবি পাওয়া ওদের পক্ষে সম্ভব ছিল না৷ কারণ ওটা দিনরাত—চব্বিশ ঘণ্টা—আমার সঙ্গেই ছিল৷’

‘আপনি ঠিক বলছেন?’

‘এ কথা আমি শপথ করে বলতে পারি; আর তাছাড়া, চাবিটা—অথবা তার নকল—যদি ওদের কাছেই থেকে থাকবে, তাহলে শুধু শুধু ভাঙা-যায়-না এমন একটা তালা ভাঙবার চেষ্টা করে ওরা সময় নষ্ট করবে কেন?’

‘হুঁ! এই প্রশ্নটার কথাই আমরা মনে মনে চিন্তা করছি৷ আমি একরকম ভবিষ্যদ্বাণী করে বলতে পারি, এ সমস্যার সমাধান, যদি তা কোনওদিন আমরা জানতে পারি, পুরোপুরি নির্ভর করবে এই অদ্ভুত ঘটনার ওপর৷ এর পর যে প্রশ্নটা আপনাকে করব তার আগে একান্ত অনুরোধ, দয়া করে আমার ওপর খেপে উঠবেন না ঃ ট্রাঙ্কটা যে আপনি তালা-খোলা অবস্থায় রেখে আসেননি, সে বিষয়ে আপনি কি নিশ্চিত?’

ফিলিপ রিজওয়ে নির্বাক মুখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইল, এবং পোয়ারো শশব্যস্তে সাফাই গাইতে লাগল, ‘মানে, জানেন তো অনেক সময় অন্যমনস্কতাবশত এরকম হয়ে যায়, বিশ্বাস করুন!…সুতরাং ঋণপত্রগুলো চুরি গিয়েছিল ট্রাঙ্ক থেকেই৷ কিন্তু এরপর সেই চোর ওগুলো নিয়ে কী করল? ওগুলো নিয়ে সে তীরে পৌঁছল কেমন করে?’

‘ঠিক বলেছেন!’ চেঁচিয়ে উঠল রিজওয়ে, ‘ঠিক এই কথাটাই আমিও ভেবেছি! কেমন করে সে শুল্ক-অফিসারদের চোখে ধুলো দিয়ে তীরে পৌঁছল? কারণ, চুরির খবর গোপনে শুল্ক-দপ্তরের কানে তোলা হয়, এবং জাহাজের প্রতিটি যাত্রীকে তারা আগাপাস্তলা অনুসন্ধান করে দেখেন!’

‘আশা করি, ঋণপত্রের প্যাকেটটা আয়তনে বেশ বড়ই ছিল?’

‘নিশ্চয়ই৷ ওটাকে জাহাজে লুকিয়ে রাখাও বেশ কষ্টকর হতো—তাছাড়া, আমরা তো জানিই যে ওগুলোকে জাহাজে লুকিয়ে রাখা হয়নি৷ কারণ অলিম্পিয়া ঘাটে পৌঁছনোর আধ ঘণ্টার মধ্যে ওগুলোকে বিক্রির জন্যে দাখিল করা হয়৷ এমনকী আমি ঋণপত্রগুলোর নম্বর দিয়ে তার করে কাউকে সাবধান করে দেবার সময়ও পাইনি৷ একজন দালাল তো শপথ করে বলছে, অলিম্পিয়া পৌঁছনোর আগেই কয়েকটা ঋণপত্র সে কিনেছে৷ কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, ঋণপত্র কখনো তার করে পাঠানো যায় না৷’

‘হয়তো তার করে নয়, হয়তো কোনও দ্রুতগামী নৌকোর মাধ্যমে ঋণপত্রগুলো অলিম্পিয়া থেকে তীরে এসে পৌঁছেছে?’

‘না, তা সম্ভব নয়৷ কারণ অলিম্পিয়ার আশপাশে সরকারি নৌকো ছাড়া অন্য কোনও জলযান ছিল না; তাছাড়া সেই নৌকোগুলোও আসে ঋণপত্র চুরির খবর পাওয়ার পর সেগুলো অনুসন্ধানের জন্যে৷ আমি নিজেও জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে নজর রেখেছি যাতে চুরি যাওয়া ঋণপত্রগুলো অলিম্পিয়ার বাইরে না যায়৷ বিশ্বাস করুন, মঁসিয়ে পোয়ারো, এত সব দেখে-শুনে আমি পাগল হয়ে যেতে বসেছি! অনেকে তো বলতে শুরু করেছে এ চুরি নাকি আমারই কাজ!’

‘কিন্তু নিয়ম অনুযায়ী শুল্ক-অফিসাররা তো আপনাকেও সার্চ করেছিল, করেনি?’

‘হ্যাঁ, করেছিল৷’

ফিলিপ রিজওয়ে বিস্ময়-বিহ্বল মুখে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইল৷

‘আপনি আমার প্রশ্নের অর্থ ধরতে পারেননি দেখছি৷’ হেঁয়ালি মাখানো হাসি ঠোঁটে ফুটিয়ে বলল পোয়ারো, ‘এবার আমাকে ব্যাঙ্কে গিয়ে কিছু খোঁজখবর করতে হবে৷’

রিজওয়ে একটা কার্ড বের করে তাতে দু’কলম কী লিখে দিল৷

‘এটা দেখালেই মামা আপনার সঙ্গে তক্ষুনি দেখা করবে৷’

পোয়ারো তাকে ধন্যবাদ জানালো, মিস ফারক্যুয়ারের কাছে বিদায় নিল, তারপর আমরা একসঙ্গে রওনা হলাম থ্রেডনিডল্ স্ট্রিট—অর্থাৎ লন্ডন অ্যান্ড স্কটিশ ব্যাঙ্কের প্রধান-অফিস অভিমুখে৷ রিজওয়ের কার্ড দেখাতেই একরাশ টেবিল-চেয়ারের গোলকধাঁধা পেরিয়ে, কর্মব্যস্ত কেরানিদের পাশ কাটিয়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল দোতলার একটা ছোট অফিসে৷ সেখানে ব্যাঙ্কের যুগ্ম সাধারণ পরিচালক দুজন আমাদের অভ্যর্থনা জানালেন৷ মিঃ শ’-এর মুখ দাড়ি-গোঁফ কামানো, পরিচ্ছন্ন; মিঃ ভ্যাভাসুরের গালে অনতিদীর্ঘ সাদা দাড়ি৷ ব্যাঙ্কের কর্তব্য পালনেই যে তাদের সিংহভাগ কেটে গেছে, সেটা বোঝা যায় তাদের চুলের শুভ্রতা এবং মুখমণ্ডলের রাশভারী অভিব্যক্তি থেকে৷

‘আশা করি, আপনি একজন সম্পূর্ণ বেসরকারি তদন্ত-প্রতিনিধি?’ মিঃ ভ্যাভাসুর বললেন, ‘সেটাই স্বাভাবিক, সেটাই স্বাভাবিক৷ আমরা অবশ্য, বুঝতেই পারছেন, পুরো ব্যাপারটা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে তুলে দিয়েছি৷ এ কেসের দায়িত্ব এখন ইন্সপেক্টর ম্যাকনিলের ওপর৷ তাঁর কর্মদক্ষতায় আমাদের পুরোপুরি আস্থা আছে৷’

‘নিশ্চয়ই, সে বিশ্বাস আমারও আছে৷’ মার্জিত স্বরে বলল পোয়ারো, ‘আপনার ভাগ্নের তরফ থেকে শুধু কয়েকটা প্রশ্ন করার যদি অনুমতি দেন তাহলে বাধিত হব৷ প্রথমে তালাটার কথায় আসি; হাবস কোম্পানি থেকে ওটা আনবার নির্দেশ কে দিয়েছিলেন?’

‘আমি নিজে৷’ জবাব দিলেন মিঃ শ’, ‘কারণ কোনও কর্মচারীকে এ ব্যাপারে বিশ্বাস করাটা আমি যুক্তিযুক্ত মনে করি না৷ আর চাবির কথা যদি জিগ্যেস করেন, একটা ছিল মিঃ রিজওয়ের কাছে, আর অন্য দুটো রয়েছে যথাক্রমে আমার এবং আমার সহকর্মীর কাছে৷’

‘তাহলে কোনও কর্মচারীর পক্ষে সে চাবি হাতে পাওয়া সম্ভব ছিল না?’

মিঃ শ’ সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে মিঃ ভ্যাভাসুরের দিকে তাকালেন৷

‘আশা করি, এ কথা বলা ভুল হবে না, চাবিগুলো গত ২৩ তারিখে যে অবস্থায় সিন্দুকে রাখা হয়েছিল, এখনও সেই অবস্থাতেই রয়েছে৷’ বললেন মিঃ ভ্যাভাসুর, ‘দুর্ভাগ্যবশত আমার সুযোগ্য সহকর্মী দিন পনেরো আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন—প্রকৃতপক্ষে ফিলিপ যেদিন রওনা হয় সেই দিনই৷ এই সবেমাত্র তিনি সুস্থ হয়েছেন৷’

‘দুঃসহ ব্রংকাইটিস নেহাত খেলার কথা নয়—অন্তত আমার এই বয়েসে৷’ বিষণ্ণ কণ্ঠে মিঃ শ’ বললেন, ‘কিন্তু দুঃখের কথা, আমার দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে মিঃ ভ্যাভাসুরকে প্রচণ্ড অসুবিধের মধ্যে একাই সমস্ত কাজ সামলাতে হয়েছে, বিশেষ করে এই অতিরিক্ত অপ্রত্যাশিত দুশ্চিন্তা তার দায়িত্বকে আরও শতগুণ বৃদ্ধি করেছে৷’

পোয়ারো আরও কয়েকটা প্রশ্ন করল৷ মনে হল, সে মামা-ভাগ্নের পারস্পরিক অন্তরঙ্গতার নিখুঁত পরিমাপ করতে চাইছে৷ মিঃ ভ্যাভাসুরের সমস্ত উত্তরই এল সংক্ষিপ্ত এবং যথাযথভাবে৷ তাঁর ভাগ্নে ব্যাঙ্কের একজন নিষ্ঠাবান বিশ্বাসী কর্মী, কোনওরকম ধার-দেনা বা আর্থিক কষ্ট তার আছে বলে মিঃ ভ্যাভাসুরের জানা নেই৷ এ ধরনের দায়িত্বপূর্ণ কাজ দিয়ে তাকে আগেও বেশ কয়েকবার বাইরে পাঠানো হয়েছে৷ অবশেষে আনুষ্ঠানিক ভদ্রতার সঙ্গে আমাদের বিদায় দেওয়া হল৷

‘বড় হতাশ হলাম৷’ রাস্তায় পা দিয়েই মন্তব্য করল পোয়ারো৷

‘কেন, আরও কিছু জানবে আশা করেছিলে নাকি? বৃদ্ধ ভদ্রলোক দুজন তো তোমাকে বলতে কিছু বাকি রাখেননি৷’

‘না, তাঁদের অতিরিক্ত তথ্য সরবরাহে আমি হতাশ হইনি, বন্ধু৷ কোনও ব্যাঙ্ক পরিচালকের চরিত্রে তোমাদের জনপ্রিয় উপন্যাসের ভাষায় “শ্যেনদৃষ্টি এবং ধারালো বুদ্ধিসম্পন্ন কোনও ব্যবসায়ী’কে খুঁজে পাব এ আশা আমি করিনি৷” উঁহু—আমি হতাশ হয়েছি বর্তমান রহস্য সম্পর্কে—এর সমাধানটা বড্ড সহজ৷’

‘হুঁ; তোমারও কি মনে হয় না, সমাধানটা জলের মতো সহজ, শিশুসুলভ সরল?’

‘তুমিই জানো, ঋণপত্র কে চুরি করেছে?’

‘নিশ্চয়ই জানি৷’

‘তাহলে তো—মানে আমাদের উচিত—না হলে অপরাধী—’

‘নিজেকে বিভ্রান্ত করে উত্তেজিত হয়ো না, হেস্টিংস৷ আপাতত আমরা কোনও কিছু না করে চুপচাপ থাকব৷’

‘কিন্তু কেন? কীসের জন্যে অপেক্ষা করছ তুমি?’

‘অলিম্পিয়ার জন্যে৷ মঙ্গলবার নিউ-ইয়র্ক থেকে তার ফিরে আসার কথা৷’

‘কিন্তু যদি তুমি জেনে থাকো ঋণপত্র কে চুরি করেছে, তাহলে অপেক্ষা করার প্রয়োজনটা কী? অপরাধী এই সুযোগে গা-ঢাকা দিতে পারে৷’

‘কোথায়? দক্ষিণ-সাগরের কোনও দ্বীপে, যেখানে বিচারের জন্যে অপরাধীকে বিদেশি সরকারের হাতে অর্পণ করা হয় না? না, বন্ধু, না; সেখানকার জীবনযাত্রার সঙ্গে সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারবে না৷ আর আমার প্রতীক্ষার কারণ জানতে চাইছ—মানছি, এরকুল পোয়ারোর বুদ্ধিমত্তার কাছে এ রহস্যের কোনও রহস্যই আর রহস্য নেই, কিন্তু অন্যান্যদের সীমিত বোধশক্তির কথা মনে রেখে, যাদের ওপর মঙ্গলময় ঈশ্বরের করুণা সুপ্রচুরভাবে বর্ষিত হয়নি—যেমন, ইন্সপেক্টর ম্যাকনিল—কিছু অনুসন্ধানলব্ধ প্রমাণ আমাকে সংগ্রহ করতে হবে৷ অন্যান্যদের ক্ষুদ্রতর বোধশক্তির কথা প্রত্যেকেরই বিবেচনা করা উচিত৷’

‘সত্যি পোয়ারো! বিশ্বাস করো, তোমাকে অন্তত একটিবার ল্যাজে-গোবরে অবস্থায় দেখবার জন্যে আমি ভালোরকম টাকা খরচ করতে রাজি আছি! তোমার এই অহঙ্কার দিন দিন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে!’

‘শুধু শুধু রাগ কোরো না, হেস্টিংস৷ সত্যি কথা বলতে কী, সময়ে সময়ে লক্ষ্য করেছি তুমি আমাকে ভীষণ অপছন্দ করো৷ হায় রে, আমার একমাত্র অপরাধ আমি মহত্ত্বের অপরাধে অপরাধী!’

ছোটখাটো মানুষটা তার বক্তব্যের শেষে এমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল যে না হেসে থাকতে পারলাম না৷

মঙ্গলবার এল. অ্যান্ড এন.ডবলিউ.রেলওয়ের একটি প্রথম শ্রেণীর কামরায় চড়ে আমরা রওনা হলাম লিভারপুল অভিমুখে৷ পোয়ারো নিছক একরোখাভাবেই ওর সন্দেহের—অথবা নিঃসন্দেহ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাকে আলোকিত করতে রাজি হয়নি৷ আমিও যে পরিস্থিতির সঙ্গে ঠিক তাল মিলিয়ে চলতে পারিনি তা নিয়ে বারংবার বিস্ময় প্রকাশ করে আত্মপ্রসাদ লাভ করল সে৷ তর্ক করতে প্রবৃত্তি হল না; নিস্পৃহতার ভানের আড়ালে কৌতূহলকে দমন করে বসে রইলাম৷

অ্যাটলাণ্টিক পারাপারকারী একটা বিশাল যাত্রীবাহী জাহাজ জেটি ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিল৷ সেখানে পৌঁছেই পোয়ারো কর্মব্যস্ত এবং তৎপর হয়ে উঠল৷ আমাদের কর্মসূচীতে ছিল যথাক্রমে জাহাজের চারজন তত্ত্ববধায়কের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা, এবং পোয়ারোর জনৈক বন্ধু সম্পর্কে খোঁজখবর করা, যিনি গত ২৩শে অলিম্পিয়ার যাত্রী হয়ে নিউ-ইয়র্ক গিয়েছিলেন৷

‘একজন বয়স্ক ভদ্রলোক, চোখে কালো চশমা পরা৷ পক্ষাঘাতে চলাফেরার শক্তি হারিয়েছেন; কেবিন থেকে খুব কমই বেরোতেন৷’

উপরোক্ত বর্ণনার সঙ্গে মিল পাওয়া গেল জনৈক মিঃ ভেন্টনরের, যিনি সি ২৪ নম্বরে ছিলেন, ফিলিপ রিজওয়ের ঠিক পাশের কেবিনেই৷ পোয়ারো যে কীভাবে মিঃ ভেন্টনরের অস্তিত্ব এবং দৈহিক বর্ণনা অনুমান করল তা না বুঝতে পারলেও মনে মনে বেশ উত্তেজনা অনুভব করলাম৷

‘এবারে বলো দেখি,’ লাগাম হারানো স্বরে জানতে চাইলাম, নিউ ইয়র্কে পৌঁছে এই ভদ্রলোকই কি সবার প্রথমে জাহাজ থেকে নেমেছিলেন?’

তত্ত্ববধায়ক মাথা নাড়ল৷

‘না, স্যর—উনি নেমেছিলেন প্রায় সবার শেষে৷’

হতাশ হয়ে পেছিয়ে এলাম৷ লক্ষ্য করলাম, পোয়ারো আমার দিকে চেয়ে আকর্ণ হাসি হাসছে৷ সে তত্ত্বাবধায়ককে ধন্যবাদ জানালো, একটা নোট হাত বদল করল, এবং আমরা বিদায় নিলাম৷

‘সবই ঠিক আছে মানলাম,’ উত্তপ্ত স্বরে মন্তব্য করলাম, ‘কিন্তু যতই দাঁত বের করে হাসো না কেন, ওই শেষের উত্তরটা তোমার মহামূল্য সিদ্ধান্তকেও নিশ্চয়ই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে!’

‘তুমি ঠিক একই রকম আছ, হেস্টিংস৷ বরাবরের মতোই আসল সত্যটা এখনও তোমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে৷ ওই শেষ উত্তরটা আমার সিদ্ধান্তকে বরং আরও নিশ্চিত করেছে৷’

হতাশায় হাত ছুড়লাম৷

‘তোমার মতলব তুমিই ভালো জানো৷ আমি হাল ছেড়ে দিলাম৷’

ট্রেনে চড়ে লন্ডনে ফেরার পথে পোয়ারো মিনিট কয়েক ধরে ব্যস্তভাবে কি সব লিখল, তারপর সেটাকে একটা খামে ভরে মুখ বন্ধ করল৷

‘এটা সুবোধ ইন্সপেক্টর ম্যাকনিলের জন্যে৷ যাওয়ার পথে এটা আমরা স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে যাব৷ তারপর রওনা হব র‌্যাদেভু রেস্তোরাঁ অভিমুখে; সেখানে মিস এস্মি ফারক্যুয়ারকে আমাদের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দিয়ে আমাদের সম্মানিত করবার জন্যে আমি অনুরোধ করেছি৷’

‘আর রিজওয়ে?’

‘হুঁ, রিজওয়ে কী?’ পোয়ারোর চোখের তারায় দুষ্টুমি ঝিলিক মারল৷

‘তুমি নিশ্চয়ই তাকে সন্দেহ—মানে, সেটা কি যুক্তিসঙ্গত—’

‘হেস্টিংস, অসংলগ্ন সংলাপ ক্রমশ তোমার মুদ্রাদোষে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে৷ সত্যি কথা বলতে কী, রিজওয়েকে আমি সন্দেহ করেছিলাম৷ রিজওয়েই যদি ঋণপত্র-চোর হতো—যা হওয়াটা নেহাত অসম্ভব ছিল না—তাহলে এ রহস্য আরও অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠত, সুচারু সুশৃঙ্খল শিল্পময় হতো এর চরিত্র৷’

‘কিন্তু মিস ফারক্যুয়ারের কাছে বোধহয় ততটা আকর্ষণীয় ঠেকত না৷’

‘হয়তো তোমার কথাই ঠিক৷ সুতরাং, ঈশ্বর যা করেন মঙ্গলের জন্যে৷ এবারে এসো, হেস্টিংস, গোটা সমস্যাটা একবার পর্যালোচনা করে দেখা যাক৷ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এর শেষ জানবার জন্যে তুমি কৌতূহলে মরে যাচ্ছ৷ প্রথমে সিলমোহর করা ঋণপত্রের প্যাকেটটা রিজওয়ের ট্রাঙ্ক থেকে চুরি গেল এবং মিস ফারক্যুয়ারের কথা অনুযায়ী, সরাসরি হাওয়ায় মিলিয়ে গেল৷ এই হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তকে আমরা প্রথমেই নাকচ করব, কারণ বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে এটা নিতান্তই কল্পনাবিলাস৷ তাহলে ভাবা যাক, প্যাকেটটা কোথায় যেতে পারে৷ প্রত্যেকেই নিশ্চিত একবাক্যে বলছে, ওটা শুল্ক-অফিসারদের চোখে ধুলো দিয়ে তীরে নিয়ে যাওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব ছিল—’

‘বলছে; কিন্তু আমরা জানি যে—’

‘তুমি হয়তো জানতে পারো, হেস্টিংস৷ আমি জানি না৷ আমার মত হল, সবাই যখন বলছে কাজটা অসম্ভব ছিল, ওটা সত্যিই অসম্ভব ছিল৷ সুতরাং, থেকে যাচ্ছে মাত্র দুটো সম্ভাবনা ঃ প্যাকেটটা জাহাজের কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল—এবং এটাও বড় কঠিন কাজ ছিল—অথবা ওটা ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল সমুদ্রে৷’

‘তুমি বলতে চাও কর্কের সঙ্গে বেঁধে ফেলে দেওয়া হয়েছিল?’

‘না, কর্ক ছাড়াই৷’

বিস্ময়াহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম৷

‘তাই যদি হতো, তাহলে ঋণপত্রগুলো আর নিউ ইয়র্কে বিক্রি করা সম্ভব হতো না!’

‘তোমার যুক্তিসঙ্গত মনের প্রশংসা না করে পারছি না, হেস্টিংস৷ ঋণপত্রগুলো নিউ-ইয়র্কে সত্যিই বিক্রি করা হয়েছিল, সুতরাং ওগুলো কখনোই সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়নি৷ এবারে বুঝতে পারছ, এই পরস্পরবিরোধী ঘটনাগুলো কোনদিকে আঙুল তুলে দেখাচ্ছে?’

‘যেখান থেকে আমরা শুরু করেছি ঠিক সেই দিকেই!’

‘উঁহু—কক্ষনো না! প্যাকেটটা যদি জলেই ফেলে দেওয়া হয়ে থাকে, আর ঋণপত্রগুলো নিউ-ইয়র্কে বিক্রি করা হয়ে থাকে, তাহলে ওই প্যাকেটে কোনওদিনই ঋণপত্রগুলো ছিল না৷ কোনও প্রমাণ কি আছে যে ওই প্যাকেটে সত্যি সত্যিই ঋণপত্র ছিল? মনে করে দ্যাখো, লন্ডনে প্যাকেটটা হাতে পাওয়ার পর মিঃ রিজওয়ে কখনও সেটা খুলে দেখেননি৷

‘হ্যাঁ, কিন্তু তাহলে—’

অধৈর্য ভঙ্গিতে হাত উঁচিয়ে পোয়ারো বলল, ‘আমাকে আগে শেষ করতে দাও৷ ঋণপত্রগুলো শেষ দেখা গিয়েছিল ২৩ তারিখ সকালে, লন্ডন অ্যান্ড স্কটিশ ব্যাঙ্কের অফিসে৷ তাদের পুনরাবির্ভাব ঘটল নিউ ইয়র্কে, অলিম্পিয়া পৌঁছবার আধ ঘণ্টা পরে; অবশ্য জনৈক দালালের উক্তি অনুযায়ী, যার কথা কেউই কানে তোলেনি, অলিম্পিয়া পৌঁছবার আগেই নিউ-ইয়র্কে ঋণপত্রগুলোর সাক্ষাৎ পাওয়া যায়৷ সুতরাং, যদি মনে করা যায়, ওগুলো কোনওদিনই অলিম্পিয়াতে ছিল না, তাহলে? অন্য কোনও উপায়ে কি ওগুলো নিউ-ইয়র্কে পৌঁছতে পারে? হ্যাঁ, পারে৷ কারণ অলিম্পিয়ার সঙ্গে একই দিনে সাদাম্পটন থেকে নিউ-ইয়র্ক অভিমুখে রওনা হয় “জাইগ্যান্টিক” নামক যাত্রিবাহী জাহাজ, এবং অ্যাটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করতে এই জাহাজটা সংক্ষিপ্ততম সময় নেয়৷ জাইগ্যান্টিকের মাধ্যমে ঋণপত্রগুলো ডাকে পাঠানো হয়ে থাকলে ওগুলো নিউ ইয়র্ক পৌঁছবে অলিম্পিয়া পৌঁছবার একদিন আগেই৷ সব পরিষ্কার হয়ে পড়ায় রহস্যের কুয়াশা ক্রমশ ফিকে হয়ে আসতে লাগল৷ সিলমোহর করা প্যাকেটটা নিছকই একটা নকল মাত্র, এবং আসলের সঙ্গে নকলের অদলবদলটা নিশ্চয়ই ব্যাঙ্কের অফিসেই হয়ে থাকবে৷ তখন যে তিনজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের একজনের পক্ষে একটা নকল প্যাকেট তৈরি করে আসলের পরিবর্তে রেখে দেওয়া নিতান্তই বাঁ হাতের কাজ৷ এবারে ঋণপত্রগুলো ডাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল নিউ ইয়র্কে, অপরাধীর কোনও সহযোগীর কাছে৷ তাকে নির্দেশ দেওয়া হল, অলিম্পিয়া ঘাটে পৌঁছনো মাত্রই ওগুলো যেন বিক্রি করে ফেলা হয়৷ কিন্তু অলিম্পিয়াতে একজনের থাকা প্রয়োজন, যাকে নকল-চুরির নাটক উপযুক্ত সময়ে পরিচালনা করতে হবে৷’

‘কিন্তু কেন?’

‘কারণ রিজওয়ে যদি হঠাৎ প্যাকেটটা খোলে এবং দ্যাখে ওটা একটা নকল প্যাকেট, তাহলে সন্দেহের তির বিদ্যুৎগতিতে ছুটে যাবে লন্ডনে৷ সুতরাং জাহাজে উপস্থিত থাকা ভদ্রলোকটি, যাঁর ঘর ঠিক রিজওয়ের পাশেই, তাঁর কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করলেন৷ স্থূল, স্পষ্ট ঢঙে ট্রাঙ্কের তালা ভাঙতে চেষ্টা করলেন তিনি, যাতে সকলের নজর এই চুরির চেষ্টার প্রতি আকৃষ্ট হয়; অথচ পরে একটা সদৃশ-চাবি দিয়ে ট্রাঙ্কের তালা খুলে প্যাকেটটা সমুদ্রে ফেলে দিলেন, নিউ ইয়র্কে পৌঁছে সবার শেষে তীরে নামলেন৷ স্বাভাবিকভাবেই অপরের দৃষ্টি এড়াতে তাঁর চোখে রয়েছে কালো চশমা, এবং পাছে রিজওয়ের সঙ্গে জাহাজে দেখা হয়ে যায়, তাই তিনি পক্ষাঘাতে পঙ্গু, কেবিন ছেড়ে বেরোন না৷ নিউ ইয়র্কে নেমে লন্ডনগামী প্রথম জাহাজে চড়ে তিনি লন্ডনে ফিরে এলেন৷’

‘কিন্তু কে—কে এই ভদ্রলোক?’

‘এমন একজন, যাঁর কাছে ট্রাঙ্কের দ্বিতীয় চাবি থাকা সম্ভব, যিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন ওই বিশেষ তালা লাগানোর, যিনি মোটেই ব্রংকাইটিসে অসুস্থ হননি—অর্থাৎ তোমার সেই “বাচাল” বৃদ্ধ, মিঃ শ’! কখনো কখনো উঁচু-মহলেও অপরাধীর সন্ধান পাওয়া যায়, বন্ধু৷ ও, এই তো আমরা এসে গেছি! মাদমোয়াজেল, আমি রহস্য-মীমাংসায় সফল হয়েছি৷ তাহলে অনুমতি করছেন?’

এবং, সহাস্যে, পোয়ারো বিস্মিত মেয়েটির এগিয়ে দেওয়া হাত দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে দিল।

সকল অধ্যায়

১. ড্রাকুলা’জ গেস্ট – ব্রাম স্টোকার
২. লুকুণ্ডু – এডওয়ার্ড লুকাস হোয়াইট
৩. মি – এক্স-প্রাইভেট এক্স
৪. লেভিটেশান – জোসেফ পি. ব্রেনান
৫. দি ইনএক্সপিরিয়েন্সড গোস্ট – এইচ.জি. ওয়েলস্‌
৬. দি ওয়েল – উইলিয়াম ওয়াইমার্ক জ্যাকবস
৭. দি ভ্যানিশড ফেসেস – টম ক্রিস্টেনসেন
৮. হোয়েন আই ওয়াজ ডেড – ভিনসেন্ট ও’ সুলিভ্যান
৯. ওয়াজ ইট এ ড্রীম – গী দ্য মপাসাঁ
১০. ড্রয়ার নাম্বার ফোর্টিন – ট্যাল্মেজ পাওয়েল
১১. আর্কেডিয় কুরঙ্গ – আগাথা ক্রিস্টি
১২. নিখুঁত খুনের কাছাকাছি – হেনরি হোল্ট
১৩. উদ্দেশ্য জটিল – আগাথা ক্রিস্টি
১৪. দি লেডি অর দি টাইগার – ফ্র্যাঙ্ক আর ষ্টকটন (ইংল্যাণ্ড)
১৫. অপহৃত ঋণপত্র – আগাথা ক্রিস্টি
১৬. নিঃশ্বাসে নিয়তি – রবার্ট ব্লচ
১৭. রাতের ট্রেনে একা – রবার্ট ব্লচ
১৮. জহ্লাদের জন্ম দিলাম – রবার্ট ব্লচ
১৯. হাতের মুঠোয় পৃথিবী – জেমস হেডলি চেজ
২০. শুধু যাওয়া আসা – জেমস হেডলি চেজ
২১. আলোছায়ার খেলা – আগাথা ক্রিস্টি

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন