অনীশ দেব
এক প্রাচীন গ্রাম্য বাড়িতে বিলিয়ার্ড-ঘরে দাঁড়িয়ে ছিল দুজন পুরুষ, কথা বলছিল পরস্পরের সঙ্গে৷ যে খেলায় এতক্ষণ ওরা অনিচ্ছা ভরে মগ্ন ছিল, এখন তা শেষ করে ওরা বসল গিয়ে খোলা জানালার কাছে৷ সামনেই এক বিশাল পার্ক৷ সেদিকে চোখ রেখে অলস কথোপকথন শুরু হল দুজনের৷
তোমার তো সময় হয়ে এল, জেম কিছুক্ষণ নীরবতার পর একজন বলল, এবার ছ’ সপ্তাহ ধরে হাই তুলে তোমার মধুচন্দ্রিমা কাটাবে৷
জেম বেনসন তার লম্বা হাত-পা চেয়ারে ছড়িয়ে বসল এবং প্রতিবাদের এক অদ্ভুত গম্ভীর শব্দ করল৷
জিনিসটা কখনও আমার মাথায় ঢুকল না! হাই তুলে বলে চলল উইলফ্রেড কার, অবশ্য এ আমার না বোঝারই কথা, নিজের চাহিদা মেটাবার পয়সাই কখনও আমার ছিল না, দুজনের তো দূরের কথা৷ তবে আমি যদি তোমার মতো বড়লোক হতাম, তাহলে হয়তো ব্যাপারটা অন্য চোখে দেখতে পারতাম৷
এই মন্তব্যের শেষ অংশে এমন ইঙ্গিত ছিল যে তার জ্ঞাতিভাই বেনসন উত্তর দেবার কোন চেষ্টা করল না৷ বরং জানালার দিয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে শান্ত ভাবে ধূমপান করে চলল৷
তোমার মতো বড়লোক আমি নই—মিস্টার কার আবার বলতে শুরু করল, সময়ের স্রোতে আমি আমার নৌকো ভাসিয়ে নিয়ে যাই এবং কখনও কখনও বন্ধু-বান্ধবদের দরজায় নোঙর ফেলি, তাদের ঘরে গিয়ে নৈশভোজে ভাগ বসাই৷
জানালা দিয়ে বাইরে চোখ রেখেই জেম বেনসন বলল, তোমার পক্ষে এ নেহাৎ খারাপ নয় উইলফ্রেড, যে তোমার নোঙর ফেলার দরজা আছে, নৈশভোজ আছে—আর আছে বন্ধু-বান্ধব৷
এবার মিস্টার কার বলল, সত্যি বলছি, জেম তুমি ভাগ্যবান ব্যক্তি, মহাভাগ্যবান ব্যক্তি৷ যদি পৃথিবীতে অলিভ-এর চেয়ে ভালো কোন মেয়ে থাকে তাহলে তাকে আমি একটিবার দেখতে চাই৷
হুঁ৷ অপর জন শান্ত স্বরে বলল৷
মেয়েটার তুলনা নেই—কার বলে চলল, বাইরে এত ভালো ভদ্র৷ ও ভাবে, তুমি বুঝি নীতি ধর্মের গুরুমশাই!
প্রাণ খোলা আনন্দের হাসি হাসল সে, কিন্তু অন্য জন এ হাসিতে যোগ দিল না৷ ওর ন্যায়-অন্যায় বোধটা খুব বেশি—আনমনা ভাবে বলে চলল কার, জানো, ও যদি একবার টের পায় সে আসলে তুমি একটি—
আসলে কি? ভয়ানক ভাবে মুখিয়ে উঠল বেনসন, আসলে আমি একটি কী?
লোকে তোমাকে যা জানে, আসলে তুমি তা নও—বর্ণচোরা হাসিতে মুখ ভরিয়ে উত্তর দিল উইলফ্রেড কার, আর এ কথা টের পেলে আমার ধারণা, অলিভ তোমাকে ছেঁড়া চটির মতো ছুড়ে ফেলে দেবে৷
অন্য কোন আলোচনা করো—ধীর স্বরে বেনসন বলল, তোমার রসিকতা সব সময় আমার ভালো লাগে না৷
এই মুহূর্তে অন্য আর একটাই আলোচনা আমি করতে পারি—সেটা হল আমার আর্থিক অবস্থা—উইলফ্রেড কার র্যাক থেকে বিলিয়ার্ড খেলার লাঠি তুলে নিয়ে বিলিয়ার্ড টেবিলের অন্য প্রান্তে যেতে যেতে ধীরে স্বরে বলল৷
অন্য কোন আলোচনা থাকালে কর—আবার বলল বেনসন৷
এই দুটো বিষয়ের মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে—বলল কার, বিলিয়ার্ড লাঠিটা রেখে দিয়ে জরীপ করতে লাগল তার জ্ঞাতি ভাইকে৷
চুরুটের শেষ প্রান্তটুকু জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিল বেনসন, তারপর চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজল৷
আমার কথা কোন্ পথে এগোচ্ছে ধরতে পেরেছ? অবশেষে কার বলল৷
বেনসন চোখ খুলে তাকাল, জানালার দিকে ইশারা করে মাথা নাড়ল, তুমি কি আমার চুরুটের পথে যেতে চাও?
তোমার কথা চিন্তা করেই আমি স্বাভাবিকা পথে যেতে চাই—নির্লজ্জ ভাবে পাল্টা উত্তর দিল অন্যজন, আমি জানালা দিয়ে বিদায় নিলে হাজারো প্রশ্ন উঠবে, আর তুমি তো জানো, আমার একটু বাচাল স্বভাব আছে—জিভ পাতলা মানুষ৷
নিজেকে অনেক চেষ্টায় সংযত রেখে বেনসন উত্তর দিল, আমার ব্যাপারে কথা না বললেই হল, তুমি বকবক করে গলা ভেঙে ফেললেও আমার আপত্তি নেই৷
আমি খুব বিপদে পড়েছি—কার ধীরে ধীরে বলল, আগামী দু-সপ্তাহের মধ্যে যদি পনেরোশো পাউন্ড জোগাড় না করতে পারি, তাহলে আমাকে হয়তো পথে দাঁড়াতে হবে৷
সে তোমার কাছে আর নতুন কী? বলল বেনসন৷
পথে দাঁড়ানোরও রকমফের আছে—উত্তর দিল অপর জন, তাছাড়া বাড়ির ঠিকানাটাও তখন যুতসই হবে না৷ সত্যি বলছি জেম, তোমার কাছে পনেরশো হবে?
না—জেম বেনসন সহজ সুরে বলল৷
কারের মুখ ফ্যাকাশে হল৷ ভারী গলায় বলল সে, আমাকে সর্বনাশের হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে বলছি—
তোমাকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে আমি ক্লান্ত—কারের দিকে ফিরে তাকে খুঁটিয়ে মেপে নিল বেনসন, বলল, আর বাঁচিয়েই বা লাভ কী! যদি বিপদে পড়ে থাক তাহলে নিজেই সে বিপদ কাটিয়ে ওঠ৷ তোমার অটোগ্রাফ বিলিয়ে বেড়ানোর বাতিকটা এবার একটু কমাও৷
ওটা বোকামি—মানছি—কার বলল, ও রকম আর করব না৷ ও ভালো কথা, আমার কাছে কিছু অটোগ্রাফ বিক্রি আছে৷ নেবে নাকি!
কার? অপরজন প্রশ্ন করল৷
তোমার৷
বেনসন চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে গেল, শান্ত স্বরে জিগ্যেস করল, ব্ল্যাকমেল?
সে তুমি যে নামে খুশি ডাকো—কার বলল, আমার কাছে কিছু চিঠি বিক্রি আছে, দাম পনেরোশো পাউন্ড৷ আর আমি এমন একজন লোককে জানি, যে শুধু তোমার কাছ থেকে অলিভকে পাওয়ার জন্য এই চিঠিগুলো পনেরোশো দিয়ে কিনতে রাজি আছে৷
যদি তোমার কাছে আমার সই করা কোন চিঠিপত্র থেকে থাকে, তাহলে ভালোয় ভালোয় সেগুলো আমাকে দিয়ে দেওয়া উচিত—খুব আস্তে আস্তে বলল বেনসন৷
চিঠিগুলো আমার—হালকা সুরে কার বলল, যাকে তুমি লিখেছিলে সেই মেয়েটি আমাকে দিয়েছে৷ এ কথা হলফ করে বলতে পারি যে সব ক’টা চিঠিই ভদ্রলোকের মতো লেখা নয়৷
হঠাৎই উইলফ্রেড কারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল বেনসন, কোটের কলার ধরে টেবিলের ওপরে ধরাশায়ী করল তাকে৷ তারপর—চিঠিগুলো ফেরত দাও—বড় বড় শ্বাস ফেলে বলল সে৷
ওগুলো আমার সঙ্গে নেই—ধস্তাধস্তি করতে করতে কার বলল, আমি অত বোকা নই৷ ছাড়, নইলে দাম আরো বেড়ে যাবে৷
বেনসন শক্ত সমর্থ হাতে উইলফ্রেড কারকে টেবিল থেকে তুলল, হয়তো টেবিলে ওর মাথা ঠুকে দেবার উদ্দেশ্যে, কিন্তু কি ভেবে হঠাৎই ছেড়ে দিল৷ কার ঝটিতি উঠে বসল৷
বেনসন বলল, তাহলে তুমি চিঠিগুলো আমাকে দেবে না?
নিশ্চয়ই দেব—তবে যে দাম বলেছি সেই দামে—কার বলল, কিন্তু মনে রেখ, যদি তোমার ওই নোংরা হাত দ্বিতীয়বার আমার গায়ে ওঠে তাহলে চিঠির দাম দ্বিগুণ হয়ে যাবে৷ যাক, এখন আমি চললাম, তোমাকে ব্যাপারটা ভাবার জন্যে কিছু সময় দিয়ে গেলাম৷
বাক্স থেকে একটা চুরুট তুলে নিয়ে ধরাল সে, তারপর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল৷ তার জ্ঞাতি ভাই জেম বেনসন দরজা বন্ধ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল, তারপর জানালার দিকে ফিরে প্রচণ্ড রাগে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল৷
একটু পরেই বাইরে তাকিয়ে সে তার ভাইকে দেখতে পেল৷ ধীরে ধীরে পা ফেলে চলে যাচ্ছে৷ লক্ষ্য করতে লাগল সে তার ভাইয়ের অপসৃয়মান শরীরটা, চাঁদের আলোয় যেন দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে৷ দ্রুত ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বেনসন৷
কিছুক্ষণ পরে ছেলেকে শুভরাত্রি জানাতে মিসেস বেনসন যখন ঘরে এসে ঢুকলেন তখন ঘরটা খালি৷ টেবিলটা ঘুরে ধীর পায়ে তিনি এসে দাঁড়ালেন জানালার সামনে, দেখতে পেলেন দ্রুত পা ফেলে তাঁর ছেলে বাড়ির দিকে ফিরে আসছে৷
সে জানলার দিকে মুখ তুলে তাকাল৷
শুভরাত্রি—মিসেস বেনসন বললেন৷
শুভরাত্রি—গভীর স্বরে বেনসন বলল৷
উইলফ্রেড কোথায়?
ও চলে গেছে—বেনসন বলল৷
চলে গেছে?
হ্যাঁ, কিছুক্ষণ কথাবার্তা হল…ও আবার টাকা চাইছিল, আর আমিও খোলাখুলি না বলে দিয়েছি৷ মনে হয় না ও আর এখানে আসবে৷
বেচারা উইলফ্রেড! মিসেস বেনসন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সব সময় ও একটা না একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ে৷ তুই ওকে আজেবাজে কথা কিছু বলিসনি তো? যতখানি বলা উচিত তার বেশি বলিনি—কঠোর স্বরে তাঁর ছেলে উত্তর দিল, শুভরাত্রি৷
কুয়োটা পুরোনো পার্কের এক কোণে দাঁড়িয়ে৷ বহু বছর অব্যবহারে উশৃঙ্মল ঘন আগাছার ঝোপে ওটা প্রায় চোখের আড়ালে চলে গেছে৷ একটা ভাঙা ঢাকনায় কুয়োর মুখ অর্ধেকটা ঢাকা পড়েছে, তার ঠিক ওপরেই একটা মরচে ধরা পুরোনো কপিকল, জোরালো বাতাসে এলোমেলো পাইন গাছের সমবেত সঙ্গীতের তালে তালে কপিকলটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ তোলে৷ সূর্যের সরাসরি আলো কখনও কুয়ো পর্যন্ত পৌঁছয় না, ফলে তার আশপাশের মাটি ভিজে স্যাঁতসেঁতে এবং ঘাসের রঙ সবুজ৷ অথচ পার্কের বাকি অংশটা ঝাঁ ঝাঁ গরমে হাহাশ্বাস তুলছে৷
গ্রীষ্মের নিঃঝুম সুগন্ধী সন্ধ্যায় দুজন মানুষ পার্কে পায়চারি করছিল, হাঁটতে হাঁটতে তারা এগিয়ে চলল কুয়োটার দিকে৷
এই জঙ্গলে ঢোকার কোন মানে হয় না—অলিভ পাইন গাছের সীমানার কাছে দাঁড়িয়ে অস্বস্তির চোখে তাকিয়ে জেম বেনসন বলল৷
পার্কের সবচেয়ে সেরা জায়গা—বলল মেয়েটি, জানো, এ জায়গাটা আমার দারুণ ভালো লাগে৷
জানি, কুয়োর পাড়ে বসে থাকতে তোমার আরও ভালো লাগে—বেনসন ধীরে ধীরে বলল, কিন্তু আমার সেটা পছন্দ নয়৷ কোন দিন বেশি ঝুঁকে পড়লে তুমি কুয়োতে পড়ে যাবে৷
আর সত্যের মুখোমুখি হব—অলিভ হালকা সুরে বলল, এসো—
ও ছুটে হারিয়ে গেল পাইনের ছায়ার ঘেরাটোপে, আগাছার ডালপালা শব্দ করে ভাঙতে লাগল ওর ছুটন্ত পায়ের নীচে৷ বেনসন ধীর পায়ে ওকে অনুসরণ করল, আবছায়া পরিসীমা পার হয়েই সে দেখতে পেল অলিভকে ঃ কুয়োর কিনারায় চমৎকার ভঙ্গীতে বসে আছে ও, পা দুটো লুকিয়ে রয়েছে কুয়োকে ঘিরে থাকা ঘাস ও আগাছার ঘন বিন্যাসের গভীরে৷
ও ইশারায় বেনসনকে ওর পাশে এসে বসতে বলল, এবং একটা বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে ওর কোমর ধরা পড়তেই ও অনুচ্চ গলায় হাসল৷
জায়গাটা আমার দারুণ লাগে—দীর্ঘ নীরবতাকে ছুটি দিয়ে ও বলল, কি অন্ধকার ছমছমে! জানো জেম, এখানে একা বসে থাকতে আমার সাহসই হবে না! হয়তো ভাবব, সব জঙ্গল আর গাছের পেছনে কত কী ভয়ঙ্কর জিনিস লুকিয়ে রয়েছে, এখুনি ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার ওপর৷ ও বাবা!
তার চেয়ে বরং চল, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি—নরম গলায় বলল বেনসন, এই কুয়ো এলাকাটা সব সময় খুব স্বাস্থ্যকর নয়, বিশেষত গরমের সময়৷ চল, চলে যাই৷
মেয়েটি অবাধ্য ঝাঁকুনিতে সারা দেহ নাকিয়ে প্রতিবাদ জানিয়ে নিজের জায়গায় আরও ভালো করে বসল৷
শান্তিতে তোমার চুরুট খাও৷ ও শান্ত স্বরে বলল, এখানে বসে নির্জনে কথা বলতে আমার বেশ ভালো লাগছে৷ উইলফ্রেড-এর খবর কিছু পেয়েছ?
উহুঁ, কোন খবর নেই৷
বড় অদ্ভুত ভাবে উধাও হয়ে গেল, তাই না? ও বলে চলল, মনে হয়, নতুন কোন বিপদ, আর তোমার নামে আবার সেই গদগদ ভাষায় চিঠি পাঠাবে ঃ প্রিয় জেম, আমাকে এবারের মতো বাঁচাও৷
জেম বেনসন একরাশ সুগন্ধী ধোঁয়ার মেঘ উড়িয়ে দিল বাতাসে, চুরুটটা দাঁতের ফাঁকে চেপে কোটের হাতা থেকে ছাই ঝেড়ে ফেলল মাটিতে৷
তোমাকে ছাড়া ও যে কি ভাবে চলত কে জানে—বেনসনের হাতে অনুরাগী চাপ দিয়ে অলিভ বলল, বহুদিন আগেই ও হয়তো তলিয়ে যেত৷ আমাদের বিয়ের পর, জেম, নতুন সম্পর্কের সুবাদে আমি ওকে কিছুটা জ্ঞান দেব৷ ও একটু ছন্নছাড়া, কিন্তু ওর কয়েকটা ভালো গুণও আচে৷ বেচারা৷
দুর্ভাগ্য বশত সেই চমৎকার গুণগুলো আমার ঠিক নজরে আসেনি৷ অস্বাভাবিক তিক্ততায় বলল বেনসন৷
ও আর কারও শত্রু নয়, নিজেরই শত্রু—বেনসনের আকস্মিক বিস্ফোরণে চমকে উঠে বলল অলিভ৷
তুমি ওর সম্পর্কে কতটুকু জানো? সংক্ষিপ্ত স্বরে বলল অপরজন, ব্ল্যাকমেল করতে ওর বাধত না, নিজের সামান্য লাভের জন্যে বন্ধুর জীবন ধবংস করতে পর্যন্ত ওর বিবে আটকায়নি৷ একটা লোফার, ইতর, মিথ্যেবাদী!
গম্ভীর অথচ শান্ত দৃষ্টিতে মেয়েটি তাকাল তার দিকে, কোন কথা না বলে তার একটা হাত টেনে নিল কাছে, এবং ওরা নিশ্চুপে বসে রইল৷
এদিকে সন্ধ্যা গভীর হয়ে লীন হয়ে যায় রাতে, গাছের শাখা প্রশাখায় পরিস্রুত চাঁদের পর্যাপ্ত আলো ওদের ঘিরে ফেলে রূপোলি তন্তজালে৷ অলিভের মাথা তখন বেনসনের কাঁধে৷ হঠাৎই এক তীক্ষ্ণ চিৎকার করে ও লাফিয়ে উঠল!
কী ওটা? রুদ্ধশ্বাসে আর্তনাদ করে উঠল অলিভ৷
কীসের কথা বলছ? জানতে চাইল বেনসন, লাফিয়ে উঠে ওর হাত চেপে ধরলর সুদৃঢ় মুঠিতে৷
হঠাৎই কেমন যেন ভয় পেয়ে গেলাম—বেনসনের কাঁধে আস্তে আস্তে হাত রাখল ও, মনে হল, এইমাত্র যে কথাগুলো বললাম, সেগুলোই আমার কানে বাজছে৷ আমি স্পষ্ট শুনলাম যেন কেউ আমাদের ঠিক পেছন থেকেই ফিসফিস করে বলল, জেম, আমাকে এবারের মতো বাঁচাও!
কল্পনা—বলল বেনসন, কিন্তু তার গলা কেঁপে গেল, আসলে তুমি এই অন্ধকারে, গাছের ছায়ায় ভয় পেয়েছ৷ চল, তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি৷
না, ভয় আমি পাইনি—বলল মেয়েটি, তারপর আবার বসল নিজের জায়গায়—তুমি সঙ্গে থাকলে আমি কাউকে ভয় পাই না, জেম৷ কেন যে বোকার মতো চেঁচিয়ে উঠলাম!
বেনসন কোন উত্তর না দিয়ে চুরুট টানতে লাগল৷ তার চুরুটের টান এত গভীর হল যে প্রতি প্রশ্বাসে চুরুটের আগুনে তার মুখ আলোকিত হয়ে উঠতে লাগল৷ দৃঢ় ও কঠিন ইস্পাত সুলভ একটা হাত সে বাড়িয়ে দিল অলিভের পিছন দিয়ে, অবশেষে থামল এসে ইঁটবাঁধানো পাঁচিলের ওপর৷
তোমার শীত করছে না তো? ও একটু নড়ে উঠতেই নরম গলায় জানতে চাইল জেম বেনসন৷
না—ও কেঁপে উঠল, বছরের এ সময়টা তো শীত করার কথা নয়, কুয়োটার ভেতর থেকে কেমন একটা ঠান্ডা স্যাঁতসেঁতে বাতাস উঠে আসছে৷
ওর কথা শেষ হতে না হতেই কুয়োর গভীর থেকে একটা জলের ছলকানির শব্দ ভেসে এল, এবং সঙ্গে সঙ্গে চাপা আতঙ্কিত চিৎকার করে কুয়োর পাড় থেকে দ্বিতীয়বার লাফিয়ে উঠল অলিভ৷
কী হল আবার? ভয়ার্ত সুরে জিগ্যেস করলর বেনসন৷ ওর পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি মারল কুয়োর মধ্যে, যেন অলিভের ভয়ের কারণটা এখুনি উঠে আসবে কুয়ো থেকে৷
ওঃ, আমার ব্রেসলেট—দুঃখে কেঁদে ফেলল অলিভ, আমার মায়ের দেওয়া৷ ওটা কুয়োর মধ্যে পড়ে গেছে৷
তোমার ব্রেসলেট! যান্ত্রিক ভাবে পুনরাবৃত্তি করল বেনসন, তোমার ব্রেসলেট! কোনটা, হীরেরটা?
যেটা আমার মায়ের ছিল—অলিভ বলল, ওটা সহজেই তোলা যাবে, কি বলো?
আগে যে করে হোক কুয়োর জলটা আমাদের বের করে দিতে হবে৷
তোমার ব্রেসলেট! বোকার মতো আবার বলল বেনসন৷
জেম, কী হয়েছে তোমার? ভয়ার্ত গলায় জানতে চাইল অলিভ৷
কারণ যে মানুষটাকে ও ভালোবাসে, সে এখন নিঃসীম আতঙ্কে জরীপ করছে অলিভকে৷ তার বিকৃত মুখের ফ্যাকাশে পাণ্ডুর রঙের জন্যে চাঁদের আলোই একমাত্র দায়ী নয়৷ ভয়ে কুঁকড়ে কুয়োর কিনারার দিকে সরে গেল অলিভ৷
ওর আতঙ্ক বেনসনের চোখ এড়াল না, অনেক চেষ্টায় নিজেকে সামলে স্বাভাবিক করে ওর হাত ধরল সে৷ চাপা স্বরে বিড় বিড় করে বলল, আমার ছোট্ট খুকু সোনা! আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ তো! যখন তুমি বোধ হয় আমার কাছ থেকে পড়ে যাচ্ছ কুয়োর ভেতর—নীচে—অনেক নীচে—
বেনসনের গলা ভেঙে গেল, আর উদভ্রান্ত অসহায় মেয়েটি ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে, তাকে আঁকড়ে ধরে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল৷
এই, কী হচ্ছে! কেঁদো না লক্ষ্মীটি, কেঁদো না—আদরের সুরে বলল বেনসন৷
কাল সকালে আমরা কাঁটা-বঁড়শি দড়ি নিয়ে এখানে আসব, তারপর মাছ ধরার মতো খুঁজে তুলে আনব ব্রেসলেটটা৷ একটা নতুন খেলা হবে, না? অর্ধেক হাসি অর্ধেক কান্না মেশানো বলায় বলল অলিভ৷
না ওটা অন্য ভাবে তুলতে হবে—বেনসন বলল, তবে দেখো, কাল সকালের মধ্যেই জিনিসটা তুমি ফেরত পাবে৷ কিন্তু কথা দাও, তার আগে ব্রেসলেটটা যে হারিয়েছে সে কথা কাউকে তুমি বলবে না৷ কথা দাও৷
অবাক হয়ে অলিভ বলল, কথা দিলাম৷ কিন্তু কেন?
প্রথমত, জিনিসটা খুব দামি—আর, তাছাড়া—তাছাড়া আরও অনেক কারণ আছে৷ আর…জিনিসটা তোমাকে ফিরিয়ে দেওয়াটা তো আমারই কর্তব্য৷
কুয়োতে ঝাঁপিয়ে পড়ে তুলে আনবে নাকি? দুষ্টুমি করে ও জানতে চাইল৷
চল, বাড়ি চল—শান্ত গলায় বেনসন বলল, তোমার মাথায় যত সব আজেবাজে বীভৎস খেয়াল চাপছে৷
মেয়েটি ফিরে তাকিয়ে বেনসনের হাত ধরল, আলগা পায়ে দুজনে রওনা হল বাড়ির দিকে৷
মিসেস বেনসন বাইরের উঠোনে বসে ছিলেন, ওদের দেখে উঠে দাঁড়ালেন৷ অনুযোগের সুরে ছেলেকে বললেন, ওকে এতক্ষণ বাইরে রেখেছিস কী করতে? কোথায় ছিলি তোরা?
কুয়োর পাড়ে বসে ছিলাম—হেসে বলল অলিভ, আমাদের ভবিষ্যৎ আলোচনা করছিলাম৷
জায়গাটা মোটেই ভালো নয়—জোরের সঙ্গে বললেন মিসেস বেনসন, আমার মনে হয়, কুয়োটা ভরাট করে ফেলা উচিত, জেম৷
ঠিক আছে—ধীরে ধীরে সে বলল, অনেক আগে যে কেন করা হয়নি কে জানে৷
তার মা অলিভকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই খালি চেয়ারটায় বসল বেনসন, দু’হাত দু’পাশে অস ভাবে এলিয়ে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়৷ কিছুক্ষণ পরে সে উঠে পড়ল, রওনা হল দোতলার বিশেষ একটা ঘরের দিকে৷ ঘরটায় খেলাধূলার নানান সাজ-সরঞ্জাম থাকে৷ সেখান থেকে সমুদ্রে মাছ ধরার একটা দড়ি ও কয়েকটা বঁড়শি নিয়ে সে চুপিসাড়ে আবার নেমে এল নীচে৷ পার্ক পেরিয়ে হালকা পায়ে রওনা হল কুয়োটার দিকে৷ তারপর দড়িটাকে ঠিকঠাক করে নিয়ে কুয়োর পাড়ে বসে সেটা আস্তে আস্তে নামিয়ে দিল ভেতরে৷
ঠোঁট টিপে বসে রইল বেনসন, শুধু কখনও কখনও চমকে উঠে তাকাতে লাগল চারপাশে, যেন এক্ষুনি কাউকে দেখতে পাবে গাছের সারির আড়াল থেকে উঁকি মেরে তার দিকে লক্ষ্য রাখছে৷ বার বার সে দড়ি ফেলে চেষ্টা করতে লাগল, অবশেষে, অনেকক্ষণ পরে, সে শুনতে পেল কুয়োর ভেতরের দেওয়ালে কিছু একটা ধাক্কা খাওয়ার ছোট্ট ধাতব শব্দ৷
বেনসনের শ্বাসপ্রশ্বাস স্তব্ধ হল, ভয় ও ত্রাস ভুলে গিয়ে সে এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে দঁড়িটাকে টেনে তুলতে লাগল, যাতে বঁড়শিতে গাঁথা জিনিসটা খুলে পড়ে না যায়৷ ওর নাড়ির স্পন্দন দ্রুত হল, চোখ হয়ে উঠল উজ্জ্বল৷ দড়ি ক্রমে ছোট হয়ে আসতেই সে বঁড়শিতে গাঁথা জিনিসটা অস্পষ্ট দেখতে পেল, এবং অবিচলিত হাতে বাকি দড়িটুকু টেনে তুলল৷ দেখল, ব্রেসলেটের বদলে সে একগোছা চাবি বঁড়শিতে গেঁথেছে৷
অস্ফুট চিৎকার করে বঁড়শিতে ঝাঁকুনি দিয়ে চাবির গোছাটা সে আবার জলে ফেলে দিল, তারপর চুপচাপ দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল৷ রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙতে কোন শব্দ সাহসী হল না৷ কিছুক্ষণ পায়চারি, হাত-পা ছড়িয়ে, আবার কুয়োর কাছে ফিরে এসে তার কাজ শুরু করল৷
আরও এক ঘণ্টা কি তারও বেশি সে দড়ি নিয়ে বৃথাই চেষ্টা করল৷ আগ্রহের তেজে ভয়-ডর সে ভুলেই গেল, এবং কুয়োর ভেতরে চোখ নামিয়ে ধীরে অথচ সতর্ক ভাবে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যেতে লাগল৷ দু-দুবার বঁড়শিটা বিঁধল এবং শত চেষ্টা করেও এবার সে আর ছাড়াতে পারল না৷ তখন দড়িটাকে কুয়োর ভেতরে ফেলে দিয়ে মাথা নীচু করে সে হেঁটে ফিরে এল বাড়িতে৷
প্রথমে সে গেল বাড়ির পিছন দিকের আস্তাবলে, তারপর নিজের ঘরে ফিরে এসে অস্থির ভাবে পায়চারি করতে লাগল৷ অবশেষে জামা কাপড় না ছেড়েই বিছানায় গা এলিয়ে দিল, তলিয়ে গেল অস্বস্তিভরা ঘুমে৷
আর কেউ জেগে ওঠার আগেই সে ঘুম থেকে উঠল এবং চুপিসারে নেমে এল নীচে৷ তারপর ধীর পায়ে রওনা হল আস্তাবলের দিকে৷
মরচে ধরা পাম্পের হাতলের ক্যাঁচ-ক্যাঁচ শব্দ এবং লাল টালি বাঁধানো উঠোনে ছড়িয়ে থাকা জলের দাগ জানিয়ে দেয় আরও একজনের ঘুম ভেঙেছে৷ মাত্র কয়েক পা এগোতেই বেনসনের নজরে পড়ল শক্তিশালী চেহারার বালি রং চুল একটি লোক পাম্পের কাছে বসে প্রচণ্ড পরিশ্রমে হাঁফাচ্ছে৷
সব কিছু তৈরি, জর্জ? সে শান্ত স্বরে প্রশ্ন করল৷
হ্যাঁ বাবু—সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কপালে হাত বুলিয়ে লোকটি বলল, বব ভেতরে সব ব্যবস্থা শেষ করে এনেছে৷ নাইবার পক্ষে চমৎকার সকাল৷ ও কুয়োর জল নিশ্চয়ই বরফের মতো ঠান্ডা হবে৷
জলদি কাজ শেষ করো—অধৈর্য ভাবে বলল বেনসন৷
ঠিক আছে বাবু—জর্জ বলল, পাম্পের ওপরে রাখা একটা খুব ছোট্ট তোয়ালে তুলে নিয়ে জোরে জোরে মুখ ঘষল—ঝটপট শেষ কর বব৷
তার ডাকে সাড়ো দিয়ে আস্তাবলের দরজায় একটি লোক আবির্ভূত হল৷ তার কনুইয়ের কাছে গলানো এক লাছি শক্ত দড়ি ও হাতে একটা ধাতব বাতিদানে বসানো মোমবাতি৷
তার বাবুর নজর অনুসরণ করে জর্জ বলল, এটা হাওয়াটা পরখ করার জন্যে বাবু৷ অনেক সময় এঁদো কুয়োর হাওয়াতে বিষ থাকে৷ ওতে এই মোমবাতি যদি জ্বলে তাহলে বুঝতে হবে মানুষের কিছু হবে না৷
বেনসন সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল এবং জর্জ তড়িঘড়ি তার শার্টের কলার তুলে ওয়েস্টকোটে হাত গলিয়ে তাকে অনুসরণ করল৷
ওরা তিনজন বড় বড় ভিজে ঘাসের মধ্যে দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে পৌঁছে গেল কুয়োর কাছে৷ সব দড়িটাকে ছুড়ে ফেলল মাটিতে এবং বাবুর কাছ থেকে ইশারা পেয়ে বাতিদানে বসানো মোমবাতিটা তার দিকে এগিয়ে দিল৷
বেনসন তার কাছ থেকে মোমবাতিটা নিয়ে দড়ির সঙ্গে বাঁধল৷ তারপর সেটা কুয়োর পাড়ে বসিয়ে দেশলাই জ্বেলে ধরাল এবং আস্তে আস্তে নামাতে শুরু করল নীচে—কুয়োর ভেতরে৷
শক্ত করে ধরুন বাবু—তাড়াতাড়ি বলে উঠল জর্জ, একটু কাত করে না নামালে দড়িটাই পুড়ে যাবে—
তার কথা শেষ হতে না হতেই দড়িটা পুড়ে গিয়ে মোমবাতিটা ছিটকে পড়ল জলে৷
বেনসন চাপা স্বরে দিব্যি কাটল৷
দাঁড়ান, এক্ষুনি আর একটা নিয়ে আসি—যেতে যেতে মুখ ফিরিয়ে বলল সে৷
বলি এখানে মালিকটা কে? তুমি না আমি! কর্কশ গলায় বলল বেনসন৷
জর্জ ধীর পায়ে আবার ফিরে এল, বাবুর চোখে এক পলক তাকিয়ে তার প্রতিবাদ জিভেই থেমে গেল, এবং সে গম্ভীর মুখে বেনসনের কার্যকলাপ দেখতে লাগল৷
বেনসন ততক্ষণে কুয়োর পাড়ে বসে গায়ের জামা-কাপড় খুলতে শুরু করেছে জর্জ ও বব দুজনেই অবাক কৌতূহলী চোখে তাকে লক্ষ্য করতে লাগল৷ প্রস্তুতি পর্ব শেষ করে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল৷ নীরব মুখমণ্ডলে তখন তার হিংস্র প্রতিজ্ঞার ছাপ৷
দড়ির ফাঁস দেওয়া প্রান্তটা দু’হাতের তলায় গলিয়ে নিল বেনসন, তারপর কুয়োর পায়ে বসে একটা পা ঝুলিয়ে দিল ভেতরে৷
জর্জ দড়িটা শক্ত করে চেপে ধরল এবং ববকেও একই কাজ করতে ইশারা করল৷
জল পেলেই আমি চেঁচিয়ে বলব—বলল বেনসন, তখন আরও গজ তিনেক দড়ি ঝপপট ছেড়ে দিও যাতে কুয়োর তলায় পৌঁছতে পারি৷
ঠিক আছে বাবু—দুজনেই সমস্বরে উত্তর দিল৷
বেনসন দ্বিতীয় পা-টাও ঝুলিয়ে দিল ভেতরে, তারপর ধীরে ধীরে বলল, জর্জ, দড়িটে টান দেওয়া মাত্রই কিন্তু আমাকে তুলতে শুরু করবে৷ নাও এখন দড়ি নামাও৷
ওদের হাত থেকে দড়ি নেমে চলল৷ এক সময় অন্ধকার গহ্বর থেকে এক প্রতিধ্বনিময় চিৎকার ও হালকা ছলাৎ শব্দ ওদের জানিয়ে দিল বেনসন জলে পৌঁছে গেছে৷ আরও তিন গজ ওরা দঁড়ি ছাড়ল, তারপর হাতের মুঠো আলগা করে উৎকর্ণ হয়ে অপেক্ষায় রইল৷
বাবু নীচে নেমে গেছে—চাপা গলায় বব বলল৷
অপর জন সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ল, হাতের তালু দুটো সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে আরও শক্ত হাতে দড়ি চেপে ধরল৷
পুরো একটা মিনিট কেটে গেল, ওরা দুজন অস্বস্তিভরে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল৷ তারপর হঠাৎই এক প্রচণ্ড ঝাঁকুনি ও তার পরবর্তী অপেক্ষাকৃত দুর্বল ধারাবাহিক ঝাঁকুনিতে দড়িটা ওদের হাত থেকে প্রায় ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চাইল৷
টান্! টান্! চিৎকার করে উঠল জর্জ, এবং কুয়োর গায়ে এক পা চেপে প্রাণপণে টানতে লাগল দড়িটা—শিগগিরই টান! মনে হচ্ছে, বাবু কোথাও ঠেকে গেছে, নড়ছে না, টান—
ওদের আসুরিক পরিশ্রমে দড়িটা ধীরে ধীরে উঠতে লাগল, এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি করে, অবশেষে শোনা গেল জলের ভেতরে এক ভয়ংকর হুটোপাটির শব্দ এবং তাকে অনুস্বরণ করে অন্ধকার গহ্বর থেকে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেসে এল অমানুষিক আতঙ্কের এক হিমেল চিৎকার!
ওঃ, কী ভারী লাগছে বাবুকে! হাঁফাতে হাঁফাতে বলল বব, কোথাও আটকে গেছে নাকি! বাবু চুপচাপ থাকুন, দোহাই আপনার, নড়চড় করবেন না৷
কারণ টান-টান দড়িটা তার শেষ প্রান্তে ঝুলন্ত ওজনের ধস্তাধস্তিতে ভয়ঙ্কর ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে৷
ওরা দুজন উঃ-আঃ করে হাঁফাতে হাঁফাতে এক ফুট দু-ফুট করে দড়িটাকে টেনে তুলতে লাগল৷
এই তো, হয়ে গেছে বাবু—আনন্দে চিৎকার করে বলল জর্জ৷
ওর একটা পা কুয়োর গায়ে সর্ব শক্তিতে গাঁথা, আর দু’হাতে দড়ি টেনে চলেছে অক্লান্ত ভাবে, দড়ির বোঝা ক্রমে উঠে আসছে ওপরে৷ সজোরে এক লম্বা টান মারতেই একটা মৃত মানুষের মুখ উঁকি মারল কুয়োর কিনারায়, তার দুচোখ ও নাকের ফুটো কাদায় বোজা! তার ঠিক পিছনেই তাদের বাবুর অমানুষিক বীভৎস মুখ—কিন্তু এটা জর্জের নজরে পড়ল অনেক দেরিতে—কারণ এক বিকট চিৎকার করে দড়ি ছেড়ে দিয়ে সে তখন পিছিয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ঘটনার আকস্মিকতায় তার সঙ্গী ছিটকে পড়েছে মাটিতে, দড়ি পিছলে গেছে তার হাতের মুঠো থেকে৷ সুতরাং পরক্ষণেই শোনা গেল প্রচণ্ড এক ঝপাং শব্দ৷
বোকা কোথাকার! থতিয়ে বলল বব, অসহায় ভাবে ছুটে গেল কুয়োর কাছে৷
ছোট! ছোট! জর্জ চিৎকার করে উঠল, ছুটে আর একটা দড়ি নিয়ে আয়!
কুয়োর ভেতরে ঝুঁকে পড়ে প্রাণান্ত চিৎকারে ডাকতে লাগল সে৷ তার সঙ্গী তখন পাগলের মতো চেঁচাতে ছুটে চলেছে আস্তাবলের দিকে৷ জর্জের কণ্ঠস্বর নির্মম পৌনঃপুনিকতায় প্রতিধবনিত হয়ে ফিরতে লাগল কুয়োর ওপর থেকে নীচে, নীচে থেকে ওপরে৷ কিন্তু আর সব তখন একেবারে চুপচাপ৷
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন