কাজী আনোয়ার হোসেন
দমকা হাওয়ায় উড়ছে কোটি কোটি তুষারকণা। একতিল নড়ল না রানা বা কার্সন ওরফে মোরেলি।
পাহাড়ের এত ওপরে বেড়ে গেছে শীতের দাপট।
‘তো?’ একটু ঝুঁকে রানার চেহারা দেখতে চাইল লোকটা।
উইণ্ডচিটারের পাশে ওয়ালথার রেখেছে সতর্ক রানা। সহজ সুরে বলল, ‘প্রথমে নিজের নাম বলেছ জন কার্সন। আর এখন বলছ তুমিই রোমিয়ো মোরেলি। তুমি সে, তার নিশ্চয়তা কোথায়?’
‘তুমি কিন্তু অন্তর থেকে ভাল করেই জানো, মোরেলি ছাড়া আর কেউ আসবে না এখানে।’ হাসল লোকটা।
‘মিটিং সম্বন্ধে জানে, এমন যে-কেউ আসতে পারে।’
‘তা নয়, বাচ্চা ছেলেটা আর আমি ছাড়া আর কেউ জানত না এখানে আসতে হবে।’ মাথা নাড়ল কার্সন।
‘তুমি তো কিউলেক্সও হতে পারো।’
‘ভাবছ আমি কিউলেক্স?’ গলা ছেড়ে হাসল কার্সন।
‘সে হয়তো জানে মোরেলির সঙ্গে এখানে দেখা করব আমি।’
‘বোকার মত কথা বোলো না। ভাল করেই জানো আমি কিউলেক্স নই।’
‘তুমি তা-ই বলছ। তবে আমি অত শিয়োর নই।’
‘আমি যদি কিউলেক্স হতাম, তো এখানে এলাম কেন?’
‘যাতে খুন করতে পারো মোরেলিকে।’
‘তুমি যা-ই বলো, আমিই কিন্তু সত্যিকারের মোরেলি।’
রানার মনে হলো, মঞ্চে নাটকের ডায়ালগ দিচ্ছে ওরা। ‘ধরে নিলাম তুমিই মোরেলি। তো এই শীতের ভেতরে দাঁড়িয়ে না থেকে, চলো, কথা বলি আমার গাড়ির ভেতরে বসে।’
কাঁধ ঝাঁকাল কার্সন ওরফে মোরেলি। ‘বেশ, চলো।’
রানার পাশে হেঁটে রেঁনোর সামনে এল সে।
রানা দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসতেই প্রশংসার সুরে বলল সে, ‘সেই আমলের ভাল একটা গাড়ি।’
‘এখনও আগের মতই চলছে ইঞ্জিন,’ বলল রানা।
প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে ঠাস্ শব্দে দরজা আটকে নিল কার্সন। তাতে এদিক-ওদিক দুলল হালকা গাড়িটা।
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর বলল সে, ‘বরং খুলে বলি বাস্তিলো দে ভ্যানারির কথা। ওকে রেখেছিলাম আমার নকল হিসেবে। দায়িত্ব দিই, কারণ কয়েক মাস ধরে আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছে মাফিয়ার ডনেরা। এমনকী মাফিয়া কমিশনের বড় পদ থেকেও বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে।’
ওরা তোমার ওপরে এত খেপল কেন?’
‘কারণ, দুনিয়ার অর্ধেক ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ করতাম আমি। তাতে যে পরিমাণ টাকা আসত, তার ষাট ভাগ নিজের কাছে রেখে বাকি অংশ দিতাম মাফিয়া কমিশনকে। কখনও কখনও আরও অনেক বেশি দামে বিক্রি করেছি লাখ লাখ ডোয ড্রাগ্স্।
‘কবে বুঝলে খুনি লেলিয়ে দেয়া হয়েছে তোমার পেছনে?’
‘মাফিয়া কমিশন থেকে যেদিন আমাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিল, সেদিনই সন্ধ্যায় জানিয়ে দিল আমার এক বন্ধু। তথ্য গোপন রাখতে পারেনি গড ফাদারদের চিফ কাপো।’
‘সেই লোকের নাম কী?’
রানার দিকে চেয়ে হাসল’ কার্সন। ‘পরে সবই খুলে বলব। পর পর দু’বার আমাকে খুন করতে চেয়েছে তারা। একবার কর্সিয়ায়। আরেকবার নেপলসে।’
‘নেপলসে? কিউলেক্স এসেছে ওই শহর থেকে।’
সতর্ক চোখে রানাকে দেখল কার্সন ওরফে মোরেলি। ‘তুমি তো দেখি অনেক কিছুই জানো!!
‘আমাকে জানানো হয়েছে।’
‘কে জানাল?’
‘সেটা তোমার না জানলেও চলবে।’
‘দ্বিতীয়বারের মত হামলা করা হলে…’
‘ওটা করা হয়েছিল তোমার ভিলায়, কর্সিয়ায়।’
ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল সে। ‘হ্যাঁ, তখনই বুঝলাম, মাফিয়া কমিশনের কাছ থেকে বাঁচতে হবে। যোগাযোগ করলাম বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তারা আবার আমার ব্যাপারে জানাল বিসিআই-এর চিফকে। তাদের কাছ থেকে টেলিফোন নাম্বার পেয়ে যোগাযোগ করেছি ভদ্রলোকের সঙ্গে।’
‘এ-পর্যন্ত আমি জানি,’ বলল রানা। ‘তবে তাতে আমার কোন লাভ হচ্ছে না। তুমিই যে মোরেলি, সেটা জানার আপাতত কোন উপায় আমার নেই।’ ি
‘দেরি না করে কর্সিয়া থেকে ইয়টে উঠি ভ্যানারি, এলিনা আর আমি। তখন থেকে অভিনয় করেছে ভ্যানারি। পরে ভ্যালেন্সিয়ায় পৌঁছে বন্দরে নেমে পড়ি। নতুন করে রওনা হলো ইয়ট। ওটাতে তখন ছিল ভ্যানারি আর এলিনা।’
‘অর্থাৎ তোমাকে ছাড়াই রওনা হলো ইয়ট দ্য লিলি।’
‘হ্যাঁ।’
‘তারপর তারা গেল ম্যালাগায়। তখনও তোমার পরিচয়ে অভিনয় করছে ভ্যানারি?’
‘ওকে সাহায্য করছিল এলিনা।’
ভ্যানারি কি ম্যালাগায় ইয়ট থেকে নেমেছিল?’,
‘না। আমার মনে হয়েছে, সে ইয়টে রয়ে গেলেই ভাল হবে। সেক্ষেত্রে ওকে দেখতে পাবে না কেউ। তাই বুঝবে না, সে আসলে আমি নই।’
‘ম্যালাগায় তাকে চিনে ফেলেছে কেউ, সেটা কি সম্ভব?’
‘না, সেটা অসম্ভব।’ হাসল কার্সন ওরফে মোরেলি।
‘তারপর কী হলো?’
‘তোমাকে ইয়টে নেয়ার জন্যে তীরে এল এলিনা।’
এ-পর্যন্ত ঠিকই বলেছ।’
‘আর তখনই তোমার সঙ্গে এলিনার কী সম্পর্ক, সেটা জেনে গেল কেউ। স্কুবা গিয়ার পরে পিছু নিল তোমাদের।
‘সে কে হতে পারে বলে ভাবছ?’
‘আর কে, কিউলেক্স! আগেই আমার সম্পর্কে সবই জেনে নিয়েছে। তা ছাড়া, আমার ইয়ট ম্যালাগায় ভিড়লে বুঝে গিয়েছিল, এ-সুযোগে আমাকে খুন করতে পারবে। তোমার দ্য লিলিতে ওঠা আর আমাকে খুনের চেষ্টা, এ-দুটো হয়তো কাকতালীয়।’
‘কিউলেক্স কেন বুঝল না যে ইয়টে আছে নকল লোক?’
‘আমাকে কখনোই কাছ থেকে দেখেনি সে।’ .
‘কিউলেক্স ইয়টে ভ্যানারিকে খুন করার পর, পালিয়ে যাওয়ার সময় আহত করেছে এলিনাকে,’ নরম সুরে বলল রানা।
‘স্রষ্টাকে ধন্যবাদ, ও গুরুতরভাবে আহত হয়নি।’
তীক্ষ্ণ চোখে কার্সন ওরফে মোরেলির চোখ দেখল রানা। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে ঠোটে একটা শলা ঝোলাল লোকটা। লাইটার দিয়ে আগুন জ্বেলে নিল সিগারেটে। রানার দিকে বাড়িয়ে দিল খোলা প্যাকেট। জবাবে মাথা নাড়ল রানা। ‘ছেড়ে দিয়েছি।’
আগে একে স্প্যানিশ সিগারেট ফুঁকতে দেখেছে রানা। তখন ছিল ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের এজেন্ট। সে যে পাকা একজন অভিনেতা, তাতে ওর মনে কোন সন্দেহ নেই।
‘এলিনা এখন কেমন আছে?’ জানতে চাইল রানা।
‘জানতে চাইছ ক্লিনিক থেকে ওকে ছেড়ে দিয়েছে কি না?’
‘হ্যাঁ,’ জবাব দিল রানা।
‘ভালই আছে। সুস্থ হয়ে উঠছে।’
‘কবে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করবে?’
‘বোধহয় একটু দেরি হবে,’ দ্বিধা করে বলল মোরেলি।
‘মাইক্রোফিল্ম কখন হাতে দেবে আমাদের?’
‘এলিনা চলে এলেই। আমি বিসিআই চিফের সঙ্গে এ- বিষয়ে কথা বলেছি। এলিনা আমার সঙ্গে বাংলাদেশে যাবে। তোমার তো এসব জানা থাকার কথা।’
‘জানি,’ বলল রানা। ‘তবে আগে দেখব মাইক্রোফিল্মে কী ধরনের তথ্য দিয়েছ।’
‘তাতে আমার কোন সমস্যা নেই,’ মাথা দোলাল সে।
‘একটা ব্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না,’ বলল রানা।
‘কী বিষয়ে?’ ধোঁয়া ছেড়ে নিজের মুখ ঢেকে দিল কার্সন ওরফে মোরেলি। রেঁনোর উইণ্ডশিল্ডে তার চেহারার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে রানা। সিগারেটে আবারও টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সে।
‘টরেমোলিনোসে কিউলেক্সের পিছু নিলে কীভাবে?’
হেসে ফেলল মোরেলি। ‘সহজেই।’
‘সেটা একটু ব্যাখ্যা করো। তোমার ওখানে থাকার কথা নয়।’
চোখ সরু করে রানাকে দেখল সে। ‘তুমি আসলে কী বলতে চাইছ?’
‘তোমার কোন কথা আমি বিশ্বাস করছি না। কিউলেক্সকে বন্দি করব, এমন সময় তাকে ভাগিয়ে দিলে। নিজের পরিচয় দিলে জন কার্সন হিসেবে। তুমি সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট। আর এখন বলছ তুমিই রোমিয়ো মোরেলি। তা হলে তোমার কোন্ পরিচয় আমি সত্যি বলে ধরে নেব?’
‘তো শোনো, জানতাম যে তুমি কিউলেক্সের পিছু নেবে। এটা তো মানো?’
মাথা দোলাল রানা। ‘বেশ। কিন্তু তোমার তো ম্যালাগায় থাকার কথা নয়। তুমি রোমিয়ো মোরেলি, লুকিয়ে আছ ভ্যালেন্সিয়াতে। সেক্ষেত্রে ম্যালাগায় এসে নিজের বিপদ ডেকে আনবে কেন?’
‘ওটা আমার জন্যে ছিল ইন্স্যুরেন্স,’ বলল মোরেলি।
‘কীসের ইন্স্যুরেন্স?’
‘আমি ইয়ট থেকে ভ্যালেন্সিয়াতে নেমে গেলে নিরাপদে ছিলাম। এটা তো বুঝতে পারছ?’
নড করল রানা।
‘এবার ভেবে দেখো, সবার চোখ ইয়টের ওপরে। সেখানে হামলা করল কিউলেক্স, অথচ আমি আছি পর্দার আড়ালে।’
‘কিন্তু তোমার তো চলে যাওয়ার কথা সোল ই নিয়েরেতে,’ বলল রানা।
‘এলিনাকে আমি সেটাই বলেছি।’
‘সেক্ষেত্রে তুমি ম্যালাগায় এলে কেন? আমি কিন্তু এখনও আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি।’
‘ম্যালাগায় গেছি তোমার ব্যাপারে আরও তথ্য জানতে।’ কাঁধ ঝাঁকাল মোরেলি। ‘যে-কোন সময়ে খুন হব। কাজেই যত দ্রুত সম্ভব লুকিয়ে পড়তে হবে। আর সেটা চাই মাতৃভূমিতে। আমার সঙ্গে নেব এলিনাকে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’
‘আমি শুনছি।’
‘জানতে চেয়েছি, এজেন্ট হিসেবে তুমি কতটুকু যোগ্য।’
নীরবতা নামল গাড়িতে। ঠাণ্ডা চোখে মোরেলিকে দেখছে রানা। ওর মত একই শীতল চোখে ওকে দেখছে মোরেলি।
‘কীভাবে জানলে কোথায় আছি?’ জানতে চাইল রানা।
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল মোরেলি। ‘জানতাম ‘কিউলেক্সকে খুঁজে নেবে। অন্তত চেষ্টা করবে।’
‘বলতে থাকো।’
‘আমার লোকের কাছে জেনেছি, তাকে খুঁজছ তুমি।’
‘আগেই কি জেনেছ যে আমি আসলে কে?’
‘অবশ্যই। এলিনা যেখানে যেখানে গেছে, ওর ওপরে চোখ রেখেছে আমার লোক।’
‘তো সেজন্যে সে-রাতে মারিয়া আর আমার পিছু নিলে?’
‘অবশ্যই। পরে নাইট ক্লাবে তিনজন মিলে সঙ্গমে অভ্যস্ত সেই পতিতার সঙ্গে দেখা করলে তুমি। বুঝে গেলাম এবার কিউলেক্সের খোঁজ পেয়ে যাব। পরে তোমার পিছু নিয়ে পৌঁছে গেলাম সেই ভিলায়।’
‘কিউলেক্স ঘুমিয়ে আছে, এমন সময়ে তাকে ধরতে বাড়ির ভেতরে ঢুকলাম, কিন্তু তোমার তৈরি করা কোন আওয়াজ বা অন্যকিছুর জন্যে সতর্ক হয়ে গেল সে। এর কী ব্যাখ্যা দেবে?’
‘মানুষ তো ভুল করে,’ রানার চোখে তাকাল মোরেলি।
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘বুঝলাম, কিন্তু সেক্ষেত্রে মিথ্যা কাহিনী তৈরি করলে কেন?’
‘মানে জন কার্সনের সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টের গল্প?’ এখন মোরেলির উচ্চারণে ব্রিটিশ টান নেই। ‘ওটা চট করে তৈরি করে নিয়েছি। সে-সময়ে মাথায় আর কিছু আসেনি। ভেবে দেখো, আমার কি হঠাৎ করে বলা উচিত ছিল: এই যে আমি! আমিই রোমিয়ো মোরেলি! ওটা অতিরিক্ত নাটকীয় হয়ে যেত না?’
‘এখনও নাটকীয়তা কম হচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘নাইট ক্লাবে মারিয়া আর আমাকে বলতে পারতে, তুমি আসলে কে। পরে ভাড়া করা ভিলায় নিয়ে মারিয়ার সঙ্গে ঘুমালে। এখানের হোটেলেও একই কাজ করলে। অথচ, অনায়াসেই মারিয়াকে মাইক্রোফিল্ম বা অন্যান্য তথ্য দিতে পারতে। সেক্ষেত্রে তোমার দেয়া তথ্য সঠিক কি না, এতক্ষণে আমরা জেনে যেতাম।’
সিগারেটের ফিল্টারে চিমটি কেটে উইণ্ডশিল্ড ভেদ করে দূরে তাকাল কার্সন ওরফে মোরেলি। বাইরে ঝরছে তুষার। অবশ্য আগের চেয়ে কমেছে। গভীর এই রাতে কাঁচে দু’জনের প্রতিচ্ছবি দেখছে রানা।
কাঁচে ওর প্রতিবিম্বের দিকে চেয়ে আছে লোকটা।
‘কখনও কোন মেয়েকে নিয়ে বেডরুমে শুলে জরুরি কথা বলি না,’ ভুরু কুঁচকে বলল মোরেলি। ‘সেটা নিজের বেডরুম হলেও। টরেমোলিনোসের সেই ভিলায় তোমার পিছু নিয়ে যাওয়ার আগে কিউলেক্স আমার বেডরুমে গুবরে পোকা রেখে গেছে কি না, সেটা জানার কোন উপায় ছিল না আমার। সে ভেবেছিল ইয়টে আমাকে খুন করেছে। কিন্তু সেটা না-ও তো হতে পারে। অনেক আগে থেকেই হয়তো পিছু নিচ্ছে আমার। আমাকে শেষ করে দিতে হয়তো নিজের ভিলায় বসে অপেক্ষা করছিল। তুমি বা আমি সেটা কী করে জানব?’
চুপ করে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকল রানা। ভাবছে, আরও কিছু বলবে লোকটা।
‘তারপর এলাম স্কি রিসোর্টে। বলো তো, কাকে বিশ্বাস করব আমি? হয়তো সব কামরায় আছে ইলেকট্রনিক গুবরে পোকা। আগেই পরিচয় হয়েছে বলে তোমাকে আমি চিনি। ছেলেটাকে পাঠালাম কেবল-কার ইঞ্জিন-রুমে, যাতে তোমাকে জানিয়ে দেয় কোথায় দেখা করব। কিন্তু তোমাকে বা আমাকে ভেবে ওকে খুন করল কিউলেক্স। মনে হলো, খুন হওয়ার আগে ছেলেটা হয়তো তোমাকে বলে গেছে, কোথায় আসতে হবে। তাই আজ এসেছি এখানে। আমার কথায় কোথাও কোন ভুল খুঁজে পেলে?’
‘এবার কী?’ তার দিকে তাকাল রানা। ‘মাইক্রোফিল্ম কি এখানেই আমার হাতে দেবে?’
‘আজ নয়,’ বলল মোরেলি। ‘মারিয়া আর তুমি অন্য এক জায়গায় আমার কাছ থেকে মাইক্রোফিল্ম নেবে।’
‘কোথায় যেতে হবে আমাদেরকে?’
‘ভেবেছিলাম এলিনা এলে তোমার হাতে ওটা দেব। তবে -এখন ভাবছি অন্য কথা। হোটেলে অতজনের ভেতরে না দিয়ে আমরা দেখা করব প্রাডো লানোর স্কি রানে।
‘ওটা অবশ্য বেশ নির্জন এলাকা,’ মাথা দোলাল রানা। ‘তুষারের রাজ্যে ইলেকট্রনিক গুবরে পোকা থাকার কথা নয়। আমার আপত্তি নেই ওখানে যেতে।’
‘তুষার নয়, ভয় আমার অন্যখানে। টেলিস্কোপিক লেন্সসহ রাইফেল দিয়ে এক মাইল দূর থেকে আমাকে শেষ করে দিতে পারবে দক্ষ মাস্-ম্যান। ওটা আমার অস্বস্তির কারণ।’
‘সেক্ষেত্রে তাকে জানতে হবে, তুমি আসলে সে।’
‘হয়তো আগে থেকেই জানে। আশপাশে খাপ পেতে বসে আছে। ছেলেটাকে তো রেহাই দিল না। ভাল করেই তো চেনে মারিয়াকে। তাই আমাদের ওপরে হয়তো চোখ রাখবে।’
‘হয়তো।’
‘তা-ই তোমাদেরকে আসতে হবে গোপন কোথাও।’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘তেমন জায়গা খুঁজে নেয়া কঠিন।’
‘কে বলেছে? আমরা দেখা করব কেবল-কারে। অনেক ওপরে আমাদের ওপরে চোখ রাখতে পারবে না কেউ।’
‘গণ্ডোলায়?’ কয়েক সেকেণ্ড ভাবল রানা। ‘ওখানে দেখা করে মারিয়া আর আমাকে দেবে মাইক্রোফিল্ম? ওটার ভেতরে দরকারি কিছু পাওয়া গেলে দু’দিনের ভেতরে তোমাকে নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হব।’
‘আমিও তা-ই চাই। মাইক্রোফিল্মে বহু কিছুই পাবে।’
‘অবশ্য ঢালু পাহাড় থেকে তোমার ওপরে গুলি চালাতে পারবে কিউলেক্স,’ বলল রানা।
‘আর সেজন্যে তুমি থাকবে স্কিসহ বোরেগুইলাস স্টেশনের কাছে,’ বলল মোরেলি, ‘আমরা উঠে এলে কাভার দেবে।’
আরও কিছুক্ষণ ভাবল রানা। বুঝে গেল খারাপ কোন প্রস্তাব
দেয়নি লোকটা। এতে বিপদের সম্ভাবনা কমবে। জানিয়ে দিল ও, ‘আমি রাজি।’
‘তোমরা কখন আসতে চাও?’
‘আগামীকাল সকাল দশটায়?’ বলল রানা।
‘ঠিক আছে,’ মাথা দোলাল মোরেলি। ‘মারিয়ার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখব না। ফূর্তির চেয়ে অনেক বেশি জরুরি চুক্তিটা বহাল রাখা।’
‘তা হলে আগামীকাল দেখা হবে, বলল রানা।
দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল মোরেলি। হু-হু করে হিম-বাতাস ভরে গেল ভেতরে। একবার শিউরে উঠল রানা। রেঁনোর দরজা বন্ধ করে নিজের গাড়ির দিকে পা বাড়াবার আগে বলল মোরেলি, ‘তুমি রওনা হও। আমি পিছু নেব।’
মাথা দোলাল রানা।
আঁধারে মনুমেন্টের ওদিকে হারিয়ে গেল মোরেলি।
রেঁনোর ইঞ্জিন প্রথমবারে চালু হওয়ায় অবাক হলো রানা। মিনিটখানেক ইঞ্জিন গরম করে ঘুরিয়ে নিল গাড়ি। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল মনুমেন্ট ঘুরে পিছু নিয়েছে সিমকা। ধীর গতি তুলে সরু রাস্তা পার হয়ে হাইওয়েতে এসে উঠল রানা। নতুন করে শুরু হয়েছে জোর বেগে তুষারপাত। একবার দেখল, পেছনে আসছে দুটো হেডলাইট।
হাইওয়ে এঁকেবেঁকে নেমে গেছে বহু নিচে। বারবার ব্রেক করতে হচ্ছে রানাকে। একটা বাঁক পেরিয়ে টের পেল, মোটেই কাজ করছে না ওর গাড়ির ব্রেক। সামনে নেমে গেছে কালো পাথরে ভরা উপত্যকা। ওটার বুকে ডিনামাইট ফাটিয়ে তৈরি করা হয়েছে আঁকাবাঁকা পথ। দূরে ডানে বাঁক। গতিহ্রাস করতে গিয়ে রানা ভাবল, বোধহয় জমাট বরফে পিছলে গেছে চার চাকা। কিন্তু দ্বিতীয়বার ব্রেক করতে ডেবে গেল প্যাডেল।
ঝোড়ো বেগে নেমে চলেছে রেঁনো। ক্লাচ চেপে শি স্টিক নিউট্রাল করতে চাইল রানা। তবে এত বেশি বেগে নিচের গিয়ার দেয়া গেল না পুরনো গাড়িতে। বাম পায়ে মেঝেতে ব্রেক প্যাডেল চেপে ধরল ও। তারই ফাঁকে বিদ্যুদ্বেগে বাঁক ঘুরে দেখল, একটু দূরে এস-এর মত জটিল হয়ে গেছে রাস্তা!
স্টিয়ারিং নিয়ে ধস্তাধস্তি করছে রানা। এস-এর মত জায়গা পেরিয়ে আবার সোজা হলো ঢালু রাস্তা। তবে সেটা মাত্র কিছুক্ষণের জন্যে। রেঁনোর হেডলাইট গিয়ে পড়ল রাস্তার ধারে বড় এক সাইনবোর্ডের ওপরে:
Switchback! Slow Down!
পর্বতের গায়ে চুলের কাঁটার মত সুইচব্যাক! বারবার ব্রেক প্যাডেলে চাপ দিলেও মোটেই কমছে না রেঁনোর গতি। হ্যাচকা টানে গিয়ারের স্টিক নিউট্রাল করতে চাইলেও তাতে কোন লাভ হলো না। দু’চাকা এদিকে-ওদিকে সরিয়েও কমছে না গতি। একবার বেগ কমলে নিচের গিয়ার ফেলে গাড়ি থামাতে পারবে রানা। রিয়ার ভিউ মিররে দেখল, পেছনে গাড়ির হেডলাইট। মোরেলি বোধহয় ভাবছে বদ্ধউন্মাদ হয়ে গেছে রানা। আর সেজন্যেই এত বাজে ড্রাইভিং করছে!
দু’বার হেডলাইট নিভিয়ে চালু করল রানা। মোরেলি হয়তো বুঝবে, বড় কোন বিপদে পড়েছে সামনের ড্রাইভার।
দ্রুত এগিয়ে এল পাহাড়ি সুইচব্যাক। গতিহ্রাস না করেই সাঁই করে বাঁক নিল রেঁনো। গতিবেগ এক শ’ ছত্রিশ মাইল!
পথের পাশের নর্দমায় গাড়ির চাকা ফেলে গতিহ্রাস করতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে ভাবল রানা। আনমনে মাথা নাড়ল। উচিত হবে না এত বড় ঝুঁকি নেয়া। অ্যাক্সেল থেকে উপড়ে যাবে চাকা। কয়েক গড়ান দিয়ে পাহাড়ে বিধ্বস্ত হবে গাড়ি। তাতে বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। লাফ দিয়ে দিয়ে নেমে- চলেছে রেঁনো।
স্টিয়ারিং হুইল ধরে রাখতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রানা। কর্কশ শব্দ তুলছে চার চাকার রাবার। পাহাড়ের উল্টোদিকে খাড়া নেমে গেছে পাথুরে খাদ। নিচে সর্পিল নদী। আর সেটা বুঝিয়ে দেয়ার জন্যে ডানে রাখা হয়েছে একফুট উঁচু গাছের গুঁড়ির দেয়াল। যদিও রেঁনোর পতন ঠেকাবে না ওটা!
বিদ্যুদ্বেগে বামে পাহাড়ের দিকে সরে এল রানা। পাঁচ শত গজ দূরে ডানে আবারও বাঁক নিয়েছে পথ। ওখানেও সড়ক মন্ত্রণালয়ের নিচু গাছের গুঁড়ির দেয়াল। তার আগে একই ধরনের সাইনবোর্ড।
দূরের বাঁক বড় দ্রুত চলে আসছে কাছে। ওখানে উল্টে গিয়ে হয়তো নিচের নদীতে গিয়ে পড়বে রেঁনো। সরে এসে বামের কাঠের গুঁড়ি ঘেষ্টে এগোল রানা। কর্কশ শব্দে কী যেন খসে গেল গাড়ি থেকে। পরক্ষণে আবার সরে পাহাড়ের গায়ে ঘষা দিল ও। যে-কোন সময়ে ডিগবাজি খেয়ে উল্টে পড়বে রেঁনো! আবারও নিচে নেমে গেছে পথ। এত বেশি গতিবেগে গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না রানা। আর তখনই পাশে শুনল আরেকটা গাড়ির ইঞ্জিনের ভারী গর্জন।
ওর পাশে ছুটছে মোরেলির সিমকা। ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে রেঁনোকে পাশ কাটাল লোকটা। রানা বুঝল না আসলে কী করতে চাইছে সে।
নিজের গাড়ি সরাসরি রেঁনোর সামনে নিয়ে এল মোরেলি। সে সরে না গেলে তীব্র গতিতে দুর্ঘটনায় পড়বে দুই গাড়ি!
আবারও শিট স্টিক নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করছে রানা। যদিও তাতে একতিল নড়ল না স্টিক। এদিকে হালকা ব্রেক করে মোরেলি চলে এসেছে সরাসরি ওর সামনে।
চোখ বুজে মৃত্যুর জন্যে অপেক্ষা করবে কি না, সেটা ভাবল রানা। কিন্তু এল না দুর্ঘটনার বিকট আওয়াজ।
হঠাৎ রেঁনোর ফ্রন্ট বাম্পারে ঠেকে গেল সিমকার পেছনের বাম্পার। জ্বলে উঠেছে গাড়িটার ব্রেক লাইট। ধীরে ধীরে কমে আসছে দুই গাড়ির গতি। মনে মনে লোকটার ড্রাইভিঙের তারিফ না করে পারল না রানা।
পেছনের গাড়ির গতি কমিয়ে দেয়ার এটা পুরনো কৌশল।
স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরেছে রানা। ভাল করেই জানে, পথে গর্ত বা পাথর থাকলে সিমকার বাম্পার থেকে ছিটকে সরে যাবে রেঁনো। সেক্ষেত্রে বামের খাদে পড়ে অথবা পাহাড়ে লেগে বিধ্বস্ত হবে ওর গাড়ি।
বারবার জ্বলছে মোরেলির ব্রেক লাইট।
পাহাড়ি বাঁকের দশ গজের মধ্যে পৌঁছে শেষমেশ থেমে গেল সিমকা ও রেঁনো। ব্যাক গিয়ার ফেলে ড্রাইভিং সিটে বসে রইল রানা। কনকনে শীতেও গোসল হয়ে গেছে ঘেমে-নেয়ে।
সিমকার দরজা খুলে নামল মোরেলি। রানার পাশে এসে থামল। হাওয়ায় তার চারপাশে বইছে তুষারের শ্বেত কণা।
রেঁনোর আলোয় জ্বলজ্বল করছে সিমকার পেছনদিক। একবার ওদিকে চেয়ে বলল সে, ‘মনে হচ্ছে স্যাবোটাজ করা হয়েছে তোমার গাড়িটা।’
মাথা দোলাল রানা। ‘সাহায্যের জন্যে ধন্যবাদ।’
‘পেছনে পেছনে প্রাডো পর্যন্ত চলো,’ বলল মোরেলি।
আপত্তি করল না রানা।
আধঘণ্টা পর প্রাডোর বার এস্কুই-এর কাছে পৌঁছে গেল ওরা। ওখান থেকেই বিদায় নিল মোরেলি।
গভীর রাতেও খোলা থাকে প্রাডোর এক গ্যারাজ। ওখানে গিয়ে মেকানিকের কাছে রেঁনোটা বুঝিয়ে দিল রানা। এরপর গিয়ে ঢুকল বার এস্কুই-এ। তিন মগ লুমামবা আর এক কাপ কফি শেষ করেও মনে কোন স্বস্তি পেল না।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন