ব্ল্যাক লিস্ট – ১৬

কাজী আনোয়ার হোসেন

ষোলো

পরদিন সকাল।

হোটেলের রেস্টুরেন্টে বসে আছে রানা ও এলিনা। ওদের মত যারা ব্রেকফাস্ট করতে এসেছে, বারবার ঘুরে ঘুরে দেখছে পরীর মত রূপসী মেয়েটাকে।

ব্রেকফাস্ট শেষ করে বলল রানা, ‘তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছ, হোটেল ছেড়ে কোথাও যাবে না।’

‘তবে আমার কিন্তু খুব খারাপ লাগবে,’ বলল এলিনা। ‘স্কি করতে পারব না।’

‘তুমি সোল ই নিয়েরেতে গেলে মোরেলি হত্যার পুরো দায় চেপে বসবে তোমার মাথায়।’

‘সেটা বুঝতে পেরেছি,’ ঠোঁট ফোলাল এলিনা।

‘নিজেও তুমি খুন হয়ে যেতে পারো।’

‘ঠিক আছে, কিন্তু তুমি নিজে এখন কোথায় যাবে?’

‘ফিরব সোল ই নিয়েরের রিসোর্টে। কাজ শেষ করে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করব।’

কিছুক্ষণ পর সুইটে এলিনাকে পৌঁছে দিল রানা। নেমে এসে হোটেল ত্যাগ করে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেল। পাহাড়ি এলাকা সোল ই নিয়েরের উদ্দেশে ঝড়ের বেগে চলেছে।

পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ‘সোল ই নিয়েরেতে ওদের হোটেলের পার্কিংলটে গাড়ি রেখে লবিতে ঢুকল রানা। এদিকে-ওদিকে চোখ বোলাতেই দেখতে পেল, লাউঞ্জ থেকে সামান্য দূরে বারের স্টুলে বসে আছে ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু বার্টি এইচ. স্মিথ। হাতে স্কচ উইস্কির প্রায় খালি গ্লাস।

গিয়ে তার পাশের স্টুল দখল করল রানা। ‘সকালেই চালু করে দিলি?’

‘না রে, এইমাত্র এসেছি।’

‘এত তাড়াতাড়ি এলি যে?’

‘মনে হলো আগেভাগেই আসি। আমাকে ডাকলি কেন? নিশ্চয়ই জরুরি কোন কাজ?’

‘এখানে থাকলেও মৃত্যুভয়ে দেখা দিচ্ছে না নোবলম্যান। ওদিকে নকল ‘ একজন ভান করছে, সে নাকি মোরেলি। আমার ধারণা সে মাফিয়ার পাঠিয়ে দেয়া খুনি। চাইছে আমরা যেন তাকে পৌঁছে দিই নোবলম্যানের কাছে।

‘তো এখন কী করতে চাস?’

‘তা হলে এবার শোন…’ বন্ধুর দিকে ঝুঁকে নিচু গলায় বলতে লাগল রানা।

কথা শেষ হলে পাঁচ মিনিট পর বার ত্যাগ করে নিজেদের সুইটে এল ও। পোশাক পাল্টে পাশের কামরার দরজায় ঠক- ঠক করে টোকা দিল।

একটু পর দরজা খুলল মারিয়া। ‘ও, তো ফিরেছ?’

‘একটু আগে,’ বলল রানা।

‘তো আজ আমাকে কী করতে হবে?

‘রাতে পাবে জরুরি কাজ।’

‘কী ধরনের কাজ?’ আগ্রহ নিয়ে রানাকে দেখল মারিয়া।

‘ক্যাথিকে যেভাবে হোক আটকে রাখবে লাউঞ্জে।’

‘আর তারপর?’

‘ওদিকে জরুরি কিছু কাজ সেরে নেব বার্টি আর আমি। তারপর তোমার ছুটি।’

সত্যিকারের কোন কাজ দেয়া হবে না ভেবে হতাশ হয়ে গেল মারিয়া। তবুও বলল, ‘কিন্তু ক্যাথি আবার কী দোষ করল? ওকে তো সরল মনের মেয়ে বলেই জানি।’

‘দোষী না নিরপরাধ সেটা পরে দেখব,’ বলল রানা। ‘বার্টি আর আমি একা চাই কার্সনকে। তখন যেন মেয়েটা ওখানে না থাকে।’

‘দেখি কী করতে পারি। এখন কী করবে বলে ভাবছ?’

‘আজ চমৎকার এই দিনে আমরা একসঙ্গে স্কি করব।’

‘এক্ষুণি আসছি!’ দ্রুত পায়ে নিজের ঘরে ফিরল মারিয়া।

.

ছিমছাম এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চের বিরতির সময়টা বাদ দিলে সারাদিন তুষারে ছাওয়া পাহাড়ের ঢালে স্কি করল রানা ও মারিয়া। মোরেলি, এলিনা, কার্সন, ক্যাথি ও মুলারের কথা যেন ভুলেই গেল রানা। মাত্র দু’একবার মনে এল মিশন ব্ল্যাক লিস্ট সফল করার চিন্তা। আর ভাবল আজ রাতে কী করবে ওরা।

বিকেলে বোরেগুইলাসে কার্সন ও ক্যাথির সঙ্গে ওদের দেখা হলো। কেন যেন ভীত বলে মনে হলো মেয়েটাকে। ওদিকে আগের মতই ফূর্তিতে আছে কার্সন ওরফে মোরেলি।

‘আমরা সকাল থেকে দুর্দান্ত একটা সময় কাটালাম, তা-ই না, ক্যাথি?’ ব্রিটিশ সুরে বলল লোকটা।

‘তা-ই?’ অবাক হলো ক্যাথি।

‘আমি তো ভেবেছি তুমি খুশি হয়েছ! কী সুন্দর পরিবেশ! স্কি রান ছিল দেখার মত!’ মারিয়ার দিকে চেয়ে চওড়া হাসি দিল কার্সন। ‘আর আপনি? সুন্দরী লেডি?’ তার কণ্ঠে সত্যিকারের প্রশংসা।

‘ভালই তো লাগল সময়টা,’ জানাল মারিয়া।

‘গতকাল আপনাকে ডিনারে পাব ভেবেছিলাম। কোথায় ছিলেন আপনি?’

‘ঘরেই ছিলাম মাথা-ব্যথা নিয়ে,’ বলল মারিয়া।

‘এদিকে আমি ছিলাম গ্রানাডায়,’ জানাল রানা।

কথাটা শুনে কাঁধ ঝাঁকাল কার্সন। তাকে ডেকে নিয়ে নিচু গলায় বলল রানা, ‘আজ রাতে আমার পরিচিত একজনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।’

‘তা-ই?’ একটু ফ্যাকাসে হলো কার্সনের মুখ।

‘ট্রিপের ব্যাপারে তোমাকে জানাব।’

‘কী ধরনের ট্রিপ? আমি তো কিছুই বুঝছি না, কিং!’

‘বাংলাদেশে তোমাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে।’

‘ও, তো জেনে গেছ মাইক্রোফিল্মে সবকিছু আছে?’

‘তা নয়। তবে মনে হচ্ছে, তোমার নিরাপত্তার জন্যেই আমাদের ভেতরে একটা মিটিং হওয়া উচিত।’

‘আমরা কোথায় বসব?’ খুক খুক করে গলা পরিষ্কার করে জানতে চাইল কার্সন।

‘কারও কামরায় নয়,’ বলল রানা, ‘আমার ধারণা, ওখানে কেউ ইলেকট্রনিক গুবরে পোকা রেখে গেছে।’

বিস্ফারিত হলো কার্সনের দু’চোখ। ‘তাই ভাবছ?’

ভণ্ড কোথাকার, মনে মনে বলল রানা। শালা, তুই নিজেই তো গুবরে পোকা রেখে গেছিস! ‘আমার তা-ই ধারণা।’

‘তা হলে কোথায় আলাপ করা যেতে পারে?’

‘নাইট ক্লাবে,’ বলল রানা।

‘হোটেলের বেসমেন্টে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আমার কোন আপত্তি নেই,’ রাজি হয়ে গেল কার্সন।

‘তা হলে ওখানে বসব আমরা রাত দশটার পর।’

‘বেশ।’

‘মারিয়াকে বলেছি, ও যেন ক্যাথিকে সঙ্গ দেয়,’ বলল রানা। ‘চাই না আমাদের আলাপে অন্য কেউ থাকুক।’

‘ঠিক আছে, বুড়ো খোকা!’

‘একসঙ্গে ডিনার সেরে তারপর ক্যাথিকে নিয়ে লাউঞ্জে যাবে মারিয়া।’

‘কাঁঠালের আঠার মত লেগে আছে ক্যাথি, এ-কথা ঠিক, ‘ ভুরু কুঁচকে বলল কার্সন।

‘তা হলে দেখা হবে রাতে,’ বলল রানা।

পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিল ওরা। রানা ও মারিয়া ফিরে এল হোটেলে।

ওদিকে আরও স্কি করতে রয়ে গেল কার্সন ও ক্যাথি। স্কি করার পর কিছু শপিং শেষ করে হোটেলে ফিরবে তারা।

হোটেলের সুইটে ফিরে ওর প্ল্যান আরও গুছিয়ে নিল রানা। রাত নয়টায় একই টেবিলে ডিনারে বসল ওরা। দশটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে খাবার সেরে গল্প করার জন্যে ক্যাথিকে নিয়ে লাউঞ্জে গিয়ে বসল মারিয়া।

নিজেদের আলাপ সেরে নেয়ার জন্যে কার্সনকে সঙ্গে নিয়ে বেসমেন্টে নাইট ক্লাবে গিয়ে ঢুকল রানা।

এখনও লাউড স্পিকারে বাজতে শুরু করেনি মিউযিক। স্টেজে নাচের জন্যে তৈরি হচ্ছে নর্তকেরা। ঘরের এককোণে একটা টেবিল বেছে নিল রানা। দরকার আছে বলেই কার্সনকে জানাল ওর বামে বসতে। ডানের চেয়ার এখনও খালি। খেয়াল করেছে, যে-কোন সময়ে বাজতে শুরু করবে বাজপড়া বিকট মিউযিক। এরই ভেতরে মাতাল হয়ে গেছে কয়েকজন গেস্ট। সুস্থ সঙ্গীরা তাদেরকে জাপটে ধরে নাইট ক্লাব থেকে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। পরের মিনিটে দূরে বার্টিকে দেখতে পেল রানা। একের পর এক টেবিল পাশ কাটিয়ে এসে ওদের টেবিলের কাছে পৌঁছে গেল সে। রানার দিকে চেয়ে আন্তরিক হাসি দিল। ‘আরেহ্, কিং! চলে এসেছ?’

‘বসে পড়ো, বার্টি, হাতের ইশারায় কার্সনের পাশে তাকে বসতে ইশারা করল রানা। ‘এসো, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি জন কার্সন। আর এ আমার বন্ধু বার্টি এইচ. স্মিথ।’

আন্তরিক হেসে চেয়ার টেনে বসল বার্টি। হাতের ইশারায় ডেকে আনল এক ওয়েটারকে। তিন মিনিটের ভেতরে ওয়াইন দিয়ে গেল সে। পরের মিনিটে দপ করে নিভল সব বাতি। বদলে ছাতে জ্বলল ঘুরন্ত রঙিন আলো। শক্তিশালী কিছু বাতি গিয়ে পড়ল ড্যান্স ফ্লোরের ওপরে।

‘আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনি ইতালিয়ান, হাসি- হাসি চেহারায় কার্সনকে বলল বার্টি।

‘আপনাকেও তো মনে হয় না,’ আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল কার্সন।

‘আমি তো আর ইতালিয়ান বলে নিজেকে দাবি করছি না,’ প্রাণখোলা হাসি হাসল বার্টি।

ওর কথায় সরু হয়ে গেল কার্সনের দুই চোখ। চট্ করে তাকাল রানার দিকে। নিস্পৃহ চেহারায় বসে আছে বিসিআই এজেন্ট। ‘কিং, এই ভদ্রলোক আসলে কী বলতে চাইছেন?’

‘মূল কথা: কীভাবে প্রমাণ করবে যে তুমিই আসলে মোরেলি?’ সহজ সুরে বলল রানা।

আরাম করে চেয়ারের পিঠে হেলান দিল কার্সন। ‘আমার তো ধারণা এরই ভেতরে সব ধরনের প্রমাণ দিয়ে দিয়েছি। সেসব কি যথেষ্ট নয়?’

‘বাংলাদেশে তোমাকে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমাকে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল বার্টি। ‘নকল কাউকে ওখানে পাঠাব না, কারণ তাতে অসম্মান হবে আমার ডিপার্টমেন্টের।’

‘আমি সত্যিই মোরেলি,’ কর্সিয়ান সুরে বলল কার্সন। ভেলেটায় এভাবেই কথা বলেছে।

চুপচাপ দু’জনের কথা শুনছে রানা।

‘আমরা আসলে সম্পূর্ণ আলাদা দুই বিষয় নিয়ে কথা বলছি, কার্সন, সহজ সুরে বলল বার্টি। ‘আমার ডিপার্টমেন্ট বলছে, বাংলাদেশে যেন পৌঁছে দেয়া হয় আসল রোমিয়ো মোরেলিকে। সে এমন এক লোক, যে কি না দুনিয়ার অর্ধেকের বেশি ড্রাগ পাচার করত।’

‘আমিই সেই লোক,’ রেগে গিয়ে বলল কার্সন।

‘তা হলে বলছ তুমিই রোমিয়ো মোরেলি?’ মৃদু হাসল বার্টি। যদিও চোখ দুটো ওর বরফের মত শীতল।

‘হ্যাঁ, আমিই সে,’ জোর দিয়ে বলল কার্সন। চেপে বসেছে ঠোঁটে ঠোঁট। চেহারায় অজানা দুশ্চিন্তা।

‘সেটা আমার কাছে প্রমাণ করো, সেনোর মোরেলি!’

ঠোঁটে আঙুল রাখল কার্সন। ‘এত জোরে আমার নাম উচ্চারণ করবেন না! খুনিদের হাতে খুন হতে চাই না!’

‘এত শব্দে কেউ কিছু শুনবে না,’ বলল বার্টি। ‘আবারও বলছি: কী প্রমাণ আছে যে তুমি মোরেলি?’

‘আমি তো এরই ভেতরে মাইক্রোফিল্ম দিয়েছি!’ ধীরেসুস্থে কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

শার্টের পকেট থেকে এনভেলপ নিল বার্টি। ওটার ভেতর থেকে বের করল এক রোল ফিল্ম। আস্তে করে রাখল টেবিলের মাঝে।

মাইক্রোফিল্মের দিকে চেয়ে আছে কার্সন। কয়েক সেকেণ্ড পর ফিসফিস করে বলল, ‘আমার নিজের দেয়া মাইক্রোফিল্ম?’

‘না। রোমিয়ো মোরেলির,’ শুকনো গলায় বলল বার্টি।

‘কিন্তু আমি তো কিংকে আসল মাইক্রোফিল্ম দিয়েছি!’

‘তোমার পক্ষে ওটা হাতে পাওয়া সম্ভব ছিল না, কার্সন।’

‘কেন অসম্ভব?’ শুকনো হাসল কার্সন। আবছা আলোয় তার চোখে আতঙ্ক দেখতে পাচ্ছে রানা।

‘কারণ, আমি নিজে আসলে রোমিয়ো মোরেলি, কার্সন,’ চাপা স্বরে বলল বার্টি। ‘পারলে অস্বীকার করো দেখি!’

গ্র্যানিট পাথরের মত হয়ে গেল কার্সনের চেহারা। স্কি রানে এ-ধরনের কালচে পাথর দেখেছে রানা। টেবিলের মাঝে পড়ে থাকা মাইক্রোফিল্মের দিকে চেয়ে আছে লোকটা। খুব ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে তুলে নিল ফিল্ম। চেষ্টা করল ওটা খুলে দেখতে।

ভেতরের ম্যাটার এভাবে দেখতে পাবে না,’ বলল বার্টি ‘সবই আছে খুব ছোট আকারে। তা ছাড়া, ওটা ডুপ্লিকেট।’

পাতলা ঘামে ভিজে গেছে কার্সনের চেহারা। একবার ঢোক গিলে নিয়ে বলল, ‘ডুপ্লিকেট?’

‘অবশ্যই,’ বার্টির ঠোঁটে এখন শয়তানির হাসি।

মন দিয়ে দু’জনকে দেখছে রানা।

‘তা হলে সত্যিকারেরটা কোথায়?’ বলল কার্সন।

‘মিস্টার কিং ওটা পাঠিয়ে দিয়েছেন ঢাকায়। সঠিক সময়ে ওটার বিষয়ে রিপোর্ট আসবে।’

দীর্ঘ একটা সময় বার্টির দিকে চেয়ে রইল কার্সন, তারপর বড় করে শ্বাস ফেলল। ‘ও, বুঝলাম। আর কিছু বুঝতে আমার বাকি নেই।’

‘আমরাও সবই বুঝেছি,’ বলল রানা। ‘এবার কী করবে ভাবছ, কার্সন?’

ঘুরে ওর দিকে তাকাল কার্সন। ঠোঁট মুচড়ে বলল, ‘এটা কী ধরনের ফাজলামি, কিং? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’

আত্মরক্ষা করতে চাইছে লোকটা, বুঝে গেল রানা। বার্টি আর ও মিলে যে পরিকল্পনা করেছে, তাতে ওরা সফল। ওরা এখন ভাল করেই জানে, এ-লোক আর যে-ই হোক, মোরেলি নয়। আসল মোরেলি ভুরু কুঁচকে ওদেরকে দেখত, তারপর হো-হো করে হেসে ফেলত। হয়তো বলত, কায়দা করে সত্যিই জেনে নিলে যে আমি আসলে কে!

কার্সনের বড় সমস্যা হচ্ছে, সে জানে না দেখতে কেমন মোরেলি। ওর মনে গভীর ভয়, সত্যিই হয়তো বার্টি রোমিয়ো মোরেলি। তার ওপরে মাইক্রোফিল্ম দেখে ঘাবড়ে গেছে। ওটা হয়তো সত্যিকারের জিনিস। ফলে এখন কী করা উচিত, ভেবে পাচ্ছে না সে।

‘আজ মোরেলির কথাতেই আমরা এই মিটিং ডেকেছি,’ বার্টিকে দেখাল রানা।

‘হ্যাঁ।’ মুচকি হাসল বার্টি। ‘আমি জানতে চেয়েছি যে কে আমাকে খুন করতে চায়। দেখতে কেমন সে।’

শতবছরের পুরনো চামড়ার মত কালচে হয়ে গেছে কার্সনের মুখ। একবার ঢোক গিলে বলল সে, ‘আপনি আমাকে হাসালেন, মিস্টার স্মিথ।

‘আমাকে মোরেলি বলে ডাকতে পারো, মিস্টার কার্সন,’ ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল বার্টি। ‘আগে কখনও ভেবেছ, নকল সাজতে গিয়ে এভাবে ধরা পড়বে?’

সতর্ক চোখে কার্সনকে দেখছে রানা।

‘এটা ঠিক, তোমার খেলাটা সত্যি-সত্যি ইঁদুর- বেড়ালের,’ শুকনো গলায় বলল কার্সন। তার মুখ বেয়ে দরদর করে ঝরছে ঘামের স্রোত। ‘কিন্তু আমি ইঁদুর-বেড়াল খেলতে পছন্দ করি না।’

‘কেউ পছন্দ করে না,’ বলল বার্টি। ‘বিশেষ করে সে যদি হয় ইঁদুর। মাত্র এক মিনিট আগে ছিলে বেড়াল। আর এখন দেখছ বাঘের সোনালি চোখ।

বড় করে শ্বাস ফেলল কার্সন। ‘এবার কী করতে চাও তোমরা?

‘আমি জানতে চাই, কেন আমাকে বোকা বানাতে চেয়েছ,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

ঠোঁট সরু করে হাসল কার্সন। ‘তুমি যে-ই হও, প্রথম থেকেই তোমাকে বোকা লোক বলে মনে হয়েছে আমার।’

‘সত্যি কথা হচ্ছে, ভেলেটায় তুমি মোরেলির রোলে অভিনয় করলে সতর্ক হয়ে উঠি,’ জবাবে নরম সুরে বলল রানা। ‘তারপর ওখান থেকে ফেরার সময়ে ব্রেক ফেইল করল আমার গাড়ি। আর সেই দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পেলাম তোমার কল্যাণে। তাতে আরও বেশি সন্দেহ হলো মনে। পরে গাড়ির নিচে মিলল ইলেকট্রনিক গুবরে পোকা। তখন বুঝলাম কেবল-কার ইঞ্জিন-রুমে ট্রাটুকে যখন খুন করা হয়, সে-সময়ে ওখানে ছিলে তুমি। পরের রাতে গেলে ভেলেটায় মোরেলিকে খুন করতে।’

বন্ধুর কথা শুনতে শুনতে ড্রিঙ্কে চুমুক দিচ্ছে বার্টি।

মুখে জমাট হাসি নিয়ে কাঁধ ঝাঁকাল কার্সন। ‘মোরেলিকে খুন করতে গিয়ে তোমাদের পিছু নিয়ে সোল ই নিয়েরেতে এসেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাদের সঙ্গে যারা দেখা করবে, তাদের ওপরে চোখ রাখা।’

‘অর্থাৎ, তুমি জানতে যে আমরা মোরেলির সঙ্গে দেখা করব,’ চট্ করে বার্টিকে দেখে নিল রানা।

‘অস্বীকার করছি না। ভেবেছি ভেলেটায় নিজেকে মোরেলি বলে পরিচয় দেয়াই উচিত হবে। সেক্ষেত্রে কোন না কোন সময়ে হাতের মুঠোয় পাব আসল মোরেলিকে।’ বার্টির দিকে তাকাল কার্সন। ‘আর ঠিক যা ভেবেছি, তা-ই হলো।’

‘একের পর এক মিথ্যা বলেছ তুমি,’ বলল রানা। ‘তা ঠিক।’ কাঁধ ঝাঁকাল কার্সন।

‘এ-ও ভেবেছ: তার নাম ভাঙিয়ে কে হাজির হয়েছে, সেটা জানতে আড়াল থেকে বেরোবে মোরেলি,’ বলল রানা।

‘ভুল বলোনি।’

‘ভেবেছিলে নকল মাইক্রোফিল্ম আমরা পরখ করে দেখার আগেই তাকে খুন করে উধাও হবে।’

‘ঝুঁকি না নিয়ে উপায় ছিল না।’

‘অনেক বেশি ঝুঁকি নিয়েছ, কার্সন। কিন্তু শেষমেশ ধরা পড়লে।’

‘আমি কিন্তু গাড়ির ব্রেক নষ্ট করিনি।’ বড় করে শ্বাস নিল কার্সন। ‘সত্যিই যদি তোমাকে খুন করতে চাইতাম, তো পরে তোমাকে এত ঝুঁকি নিয়ে বাঁচাতাম না।’

রানার দিকে তাকাল বার্টি।

‘তা নয়, কার্সন,’ বলল রানা। ‘আমার গাড়ির ব্রেক লাইন কেটে দেয়ার পরে যখন জানলে, ভেলেটায় দেখা করতে আসেনি মোরেলি, তখন আমাকে না বাঁচিয়ে তোমার আর কোন উপায় ছিল না। আমি একমাত্র মানুষ, যাকে বিশ্বাস করে দেখা করবে মোরেলি। আমার যুক্তি খণ্ডন করতে পারবে?’

পাথরের মত চেহারা করে বসে থাকল কার্সন।

হঠাৎ নিভে গেল নাইট ক্লাবের প্রতিটা বাতি। থেমে গেল স্টেরিয়োর মিউযিক। মঞ্চ থেকে নেমেছে নতর্কেরা। তাদের বদলে স্টেজে উঠল একদল স্প্যানিশ ফ্ল্যামেনকো পোশাক পরা নর্তক। ওদের পেছনে যে যার সিটে বসল ছয় গিটারিস্ট।

মাইক হাতে নিল এক পুরুষ গায়ক।

ঝনঝন করে বেজে উঠল গিটার।

‘তোমরা এবার আমার কাছে কী চাও?’ বার্টির দিকে তাকাল কার্সন।

‘কেউ না কেউ আমাকে খুন করতে তোমাকে ভাড়া করেছে,’ শুকনো গলায় বলল বার্টি। ‘তোমাকে বলতে হবে সে আসলে কে।’

‘কেউ আমাকে খুন করতে পাঠায়নি,’ বলল কার্সন।

‘মিথ্যা বলে রেহাই পাবে না,’ হুমকির সুরে বলল বার্টি। ‘তুমি একজন পেশাদার খুনি। তোমার নাম কার্সন নয়। বেশ কয়েক দেশের পুলিশের খাতায় লেখা আছে; নানা জায়গায় গিয়ে মানুষ খুন করো তুমি। ইন্টারপোল তোমার সম্পর্কে ভাল করেই জানে।’

এটা ছিল রানা আর বার্টির হাতের শেষ তাস।

বরফের মত ঠাণ্ডা চোখে রানা আর বার্টিকে দেখল কার্সন। ‘আমি পেশাদার খুনি, এটা ঠিক। যে সবচেয়ে বেশি টাকা দেয়, আমি তার হয়েই কাজ করি।’

পরস্পরের দিকে তাকাল রানা ও বার্টি।

‘কে এবার তোমাকে ভাড়া করেছে?’ আবারও জানতে চাইল বার্টি।

‘যদি মুখ খুলি, আজই খুন হব,’ ফাঁপা হাসল কার্সন।

‘আর মুখ না খুললে এখনই এই নাইট ক্লাবে খুন হবে, ‘ গম্ভীর কণ্ঠে বলল বার্টি।

‘আমি এমনিতেই খুন হব,’ শুকনো গলায় বলল কার্সন।

‘মুখ খুললে এখান থেকে বেরোতে পারবে,’ বলল বার্টি। ‘কাজেই বলো, কে তোমাকে ভাড়া করেছে। মিথ্যা না বললে রিসোর্ট থেকে তোমাকে বেরিয়ে যেতে দেব। আমার লোক তোমাকে দূরে কোথাও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেবে।

ঘুরে বারের দিকে তাকাল বার্টি। ওখানে দাঁড়িয়ে আছে এক ওয়েটার। বিএসএস এজেন্টের ইশারায় মাথা দোলাল সে। ঘরের উল্টোদিকে তাকাল রানার বন্ধু। ওখানে কালো কোট পরা এক লোক বসে আছে একটা টেবিলে। তার দিকে বার্টি তাকাতেই ব্যারেট হ্যাট উঁচু করে এদিকে তাকাল সে।

মাফিয়া স্টাইলে ঘটছে সব।

ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে কার্সন।

বাজতে শুরু করেছে ফ্ল্যামেনকো মিউযিক। একা নাচছে এক নর্তক। জুতো দিয়ে মেঝেতে তৈরি করছে মেশিনগানের গুলির মত খট-খট শব্দ। ক্রমে আরও দ্রুত তালে নেচে চলেছে সে।

‘বলো, কে তোমাকে ভাড়া করেছে!’ ধমকে উঠল বার্টি।

‘আমি এর জবাব দেব না,’ চাপা স্বরে বলল কার্সন।

‘আমরা কি ধরে নেব তারা মাফিয়ার ডন?’ জানতে চাইল রানা।

ওকে বিরক্তি নিয়ে দেখল কার্সন। ‘ওরা ছিল কিউলেক্সের বস্, আমার নয়!’ কথাটা মুখ ফস্কে বলে দিয়ে বিস্ফারিত হলো তার চোখ। বুঝে গেছে, জানিয়ে দিয়েছে আসলে তাকে ভাড়া করেছে কে।

মাত্র একজন পারে তাকে ভাড়া করতে!

‘তা হলে লিনা?’ কার্সনের দিকে ঝুঁকল রানা।

চমকে গেছে লোকটা। হাঁ করেও খপ করে বন্ধ করল মুখ। কয়েক সেকেণ্ড পর ধীরে ধীরে দোলাল মাথা। পরক্ষণে ঝড়ের বেগে নড়ল সে। গতি তার বিদ্যুতের মত। বেল্টের দিকে তাকে হাত নামাতে দেখল রানা। ওর জানা আছে, ওখানে আছে ভারী ক্যালিবারের ওয়েবলি। আগেই দেখেছে, লোকটার শার্টের নিচে রাখা আছে অস্ত্রটা। বিপদ হলে বের করবে ওয়েবলি। আর সেটা ভেবেই তাকে নিজের বামে রেখেছে রানা, যাতে ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিতে পারে তার হাত।

‘বুম!’ শব্দে গর্জে উঠল ওয়েবলি।

মেঝের তক্তায় গেঁথে গেল ওটার শক্তিশালী বুলেট।

একই সময়ে কড়াৎ শব্দে গর্জন ছাড়ল আরেকটা অস্ত্র।

ওটা প্রমাণ সাইযের ওয়ালথার।

হৃৎপিণ্ডে বুলেট বিঁধে যেতেই ঝটকা খেয়ে সিটের পিঠে হেলান দিল কার্সন, পরক্ষণে সুতো দিয়ে বাঁধা পুতুলের মত মুখ থুবড়ে পড়ল টেবিলের ওপরে। মেঝেতে ওয়েবলির ওপরে পা চাপিয়ে দিয়েছে রানা। চেয়ার ছেড়ে দ্রুত কার্সনের পাশে গেল বার্টি। এত জোরে বাজছে মিউযিক, তার ওপরে নর্তকের জুতোর মেশিনগানের মত শব্দ, নাইট ক্লাবের কারও সাধ্য নেই যে বুঝবে কী ঘটেছে আঁধার টেবিলে।

কাঁধ খামচে ধরে লাশ সোজা করে চেয়ারে বসাল বার্টি। এদিকে ঝুঁকে ওয়েবলি তুলল রানা। অস্ত্রটা বেল্টের নিচে গুঁজে শক্ত হাতে ধরল কার্সনের ডানকাঁধ। পরস্পরের দিকে একবার তাকাল দু’বন্ধু, তারপর একই সঙ্গে দু’দিক থেকে ধরে টেনে তুলল কার্সনের লাশ। রওনা হয়ে গেল টেবিলগুলোর মাঝের সরু পথে। যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে যেতে হবে নাইট ক্লাব থেকে।

কাছের এক ওয়েটারকে স্প্যানিশ ভাষায় বলল বার্টি, ‘আমাদের দোস্ত তো দেখি পুরো মাতাল হয়ে গেল!’

সহানুভূতি নিয়ে মাথা দোলাল ওয়েটার।

কাঠের মেঝেতে মেশিনগানের মত আওয়াজ তুলে মঞ্চে নেচে চলেছে ফ্ল্যামেনকো ড্যান্সার। ড্রিঙ্ক হাতে তার দিকে চেয়ে আছে হোটেলের অতিথিরা।

‘মাঝে মাঝে মনে হয়, আর করব না শালার এই চাকরি!’ লবিতে পা রেখে সিঁড়ির দিকে চলল বার্টি। ‘একেক শালার ওজন যেন হাতির সমান!’

রানা ও বার্টির ভাগ্য ভাল, এ-মুহূর্তে লবিতে কেউ নেই। দু’পাশ থেকে লাশ ধরে টলমল করতে করতে লবি পেরিয়ে গেল ওরা। ধীরে ধীরে উঠল সিঁড়ি বেয়ে। পাঁচ মিনিটের মাথায় কার্সনের ঘরে ঢুকে বিলাসবহুল বেডে শুইয়ে দিল লাশটাকে।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন