ব্ল্যাক লিস্ট – ১৭

কাজী আনোয়ার হোসেন

সতেরো

দ্রুত হাতে মৃতদেহ সার্চ করছে বার্টি। টুকটাক যা পেল, সবই রাখল ব্যুরোর ওপরে। বাথরুমে গিয়ে নিয়ে এল শুকনো তোয়ালে। কার্সনের বুলেটের ক্ষত থেকে রক্তে ভেসে গেছে বেড। বার্টির হাত বেয়ে এখনও টপটপ করে পড়ছে। নিজের ওয়ালথারের গুলিতে কার্সনের হৃৎপিণ্ড ফুটো করেছে ও। হাতের রক্ত তোয়ালেতে মুছে চট্ করে দেখে নিল হাতঘড়ি। ‘যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।’

কার্সনের ওয়ালেট থেকে কাগজপত্র, নিয়ে পড়তে শুরু করেছে রানা। ‘আইডি অনুযায়ী এর নাম জন কার্সন।’

‘নকল নাম,’ রানার পাশে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করল বার্টি। ‘পাকা কারও হাতের কাজ।’

‘কাগজ এমআই-ফাইভের। …তোর কী ধারণা?’

মাথা নাড়ল বার্টি। ‘যোগাযোগ করেছি। এই নামে ওদের কোন এজেণ্ট নেই।’

ক্রেডিট কার্ড ও পাসপোর্ট দেখল রানা। আবারও মাথা নাড়ল বার্টি। ‘না রে, এই শালার সবই নকল। তোর মনে নেই, বলেছিল সে ভাড়াটে খুনি? পরে আমি ইন্টারপোলে এর হাতের ছাপ পাঠাব।’

কাগজপত্র দেখা শেষ করে লোকটার লাগেজ খুলল রানা। কিন্তু ভেতরে এমন কোন তথ্য নেই, যা দেখে মনে হবে না কার্সন আসলে ব্রিটিশ নয়।

স্মার্টফোনের ক্যামেরা ব্যবহার করে লাশের দু’হাতের দশ আঙুলের ছাপ নিল বার্টি। কাজটা শেষ করে কয়েক দিক থেকে ছবি নিল কার্সনের মুখের। রানার মনে হলো, ‘নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে লোকটা। এখন বোঝার উপায় নেই যে সে ছিল ঠাণ্ডা-মাথার একজন খুনি।

এমন কোন কাগজপত্র নেই, যেটা দেখে মনে হবে বিশেষ কোন দলের হয়ে খুন করত। এটাও জানা গেল না, আসলে কাদের হয়ে কাজ করছে এলিনা।

বারবার হাতঘড়ি দেখছে বার্টি।

‘এত ব্যস্ত কেন তুই?’ জানতে চাইল রানা।

‘ভাবছি লাশটা কোথায় সরাব।’

‘কিছু করার নেই,’ বলল রানা। ‘এখানেই থাকুক।’

‘কিন্তু ক্যাথি মোনালিসা এলে তো ঘরে ঢুকে চমকে যাবে। তারপর চিৎকার করে মানুষ জড় করবে।’

‘তাতে আমাদের কী?’ বন্ধুর দিকে তাকাল রানা। ‘কার্সনের সঙ্গে আমাদের তো কোন সম্পর্ক নেই।’

‘নাইট ক্লাবে যে তার সঙ্গে আমাদেরকে দেখা গেছে, তার কী হবে?’

‘গার্ডিয়া সিভিলের লোকের সঙ্গে কথা বলবি। তারা সামলে নেবে সব।’

‘এখন বাজে রাত সাড়ে এগারোটা।’ আরেকবার হাতঘড়ি দেখল বার্টি। ‘ডিউটি অফিসারকে এখন পাব না।’

‘তো সকালে কথা বলিস।’ কার্পেটের দিকে তাকাল রানা। ‘আরও বড় এক সমস্যা নিয়ে ভাবছি। এলিনা পার্কারসন জানে না, তার ভাড়া করা খুনি নিজেই খুন হয়ে গেছে। মেয়েটা ভাবছে, সোল ই নিয়েরেতে এসে কার্সনকে চিনিয়ে দেবে, আসলে কে মোরেলি। তার মানেই আগে হোক বা পরে এলিনা এখানে আসবে। আর সেটা যেভাবে হোক ঠেকাতে হবে।’

‘কী করে ঠেকাবি?’ ভুরু কুঁচকে রানাকে দেখল বার্টি।

দ্রুত ভাবছে রানা। একটু পর বলল, ‘ধর, আমরা ফোন দিলাম গ্রানাডায় এলিনার হোটেলে। নোবলম্যানের তরফ থেকে নকল মেসেজ পেল ক্লার্ক। তাতে বলা হলো, আপাতত সোল ই নিয়েরে ত্যাগ করে অন্য জায়গায় যাচ্ছে মোরেলি। পরে জানাবে কোথায় এলিনার সঙ্গে দেখা করবে। এরপর এই হোটেলের সবার ফোনে কান পাতবি তোরা। আর মেয়েটা ফোন দিলেই আমরা জানব কার সঙ্গে কথা বলেছে সে। সেই লোকই আমাদের রোমিয়ো মোরেলি।’

‘তা হলে কাজ দিতে হবে ফোন কোম্পানির ঘুষখোর কর্মচারীদের,’ বলল বার্টি। ‘তবে তাতে অর্থনৈতিকভাবে ফতুর হয়ে যাবে ব্রিটেন।’

‘একটা কথা ভেবেছিস? একটু পরে মেয়েটা হয়তো ফোন করে কার্সনকে জানাতে চাইবে, কে মোরেলি। যাতে তাকে খুন করা যায়। কিন্তু ওর ফোন ধরবে না মৃত কার্সন।’

কাঁধ ঝাঁকাল বার্টি। ‘সেক্ষেত্রে মেয়েটা বুঝবে বিপদে পড়েছে বা খুন হয়ে গেছে কার্সন। তখনও বোধহয় সে ফোন করবে মোরেলিকে। তাতেও আমরা জানব কে আমাদের ড্রাগ লর্ড।

‘আমি লাউঞ্জে নেমে যাচ্ছি,’ বলল রানা, ‘ক্যাথি এ-ঘরে এসে লাশ দেখে হোটেলের সবাইকে যেন জড় করতে না পারে, সেটা ঠেকাতে হবে।’

‘তুই তা হলে রওনা হয়ে যা,’ বলল বার্টি। ‘আমি এলিনা পার্কারসনের কাছে মেসেজ পাঠিয়ে একটু পরে আসছি।’

কার্সনের কামরা থেকে বেরোবার আগে হলওয়েতে চোখ রাখল দুই বন্ধু। বাইরে কেউ নেই। হলওয়েতে বেরিয়ে এসে যে যার কাজে চলল ওরা।

.

কয়েক মিনিট পর মারিয়া আর ক্যাথিকে লাউঞ্জে দেখতে পেল রানা। গল্প করছে মেয়ে দুটো। ওকে দেখে মুখ তুলে ওর দিকে তাকাল তারা। গলা ছেড়ে হাসির আওয়াজ শুনে ঘুরে তাকাল রানা। সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে হের মুলার, তার সঙ্গের দুই জার্মান ও ড্যানিশ যুবক। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে কমপক্ষে দশজন স্কিয়ার দম্পতি। ফূর্তিতে আছে সবাই।

মারিয়া ও ক্যাথির উদ্দেশে মাথা দুলিয়ে ওদের মাঝে গিয়ে বসে পড়ল রানা। ওকে দেখে আন্তরিক হাসল হের মুলার। একে একে ওর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল অন্যদের।

হাসিমুখে সবার উদ্দেশে হাত নাড়ল রানা। ক্যাথি আর মারিয়ার মাঝে কাউচে বসে চেয়ে রইল ফায়ারপ্লেসের জ্বলজ্বলে কমলা আগুনের দিকে। আনমনে ভাবল, এ-ঘর কত নিরাপদ, নেই গুলির আওয়াজ আর তাজা রক্ত।

নিজের জীবনের মজার মজার কাহিনী বলছে হের মুলার। প্রচুর শিকার করেছে আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও ভারতে। মাছ ধরতে কখনও বোট নিয়ে চলে গেছে আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝে। একা উঠেছে কয়েকটি মহাদেশের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের চূড়ায়। এসব শুনতে শুনতে পকেট থেকে স্মার্টফোন নিয়ে মারিয়াকে টেক্সট্ মেসেজ পাঠাল রানা।

খুন হয়ে গেছে কার্সন। মোরেলিকে খুন করতে চাইছে এলিনা পার্কারসন। ক্যাথি যেন কিছু না জানে।

হাসি-হাসি চেহারায় হের মুলারের কথা শুনছিল মারিয়া, হাতে স্মার্টফোন। ওটার স্ক্রিন জ্বলে উঠতেই চট্ করে মেসেজ খুলে পড়ল সে। কনুই দিয়ে রানার পাঁজরে হালকা এক গুঁতো দিয়ে বুঝিয়ে দিল, সে বুঝতে পেরেছে।

মেসেজের শেষ বাক্য রানা লিখেছে, কারণ ও এখনও নিশ্চিত নয় যে কী করা উচিত ক্যাথি মোনালিসার বিষয়ে। মেয়েটা যদি কার্সনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে থাকে, তো সে ভাল করেই জানে কী কাজে এসেছিল লোকটা। আর তা যদি না হয়, সেক্ষেত্রে অনুচিত হবে পুলিশি তদন্তের জালে ফেলে ওকে হয়রানি করা।

মিনিট তিনেক পর লাউঞ্জের দরজা পেরিয়ে পরিচিত এক দম্পতিকে দেখে তাদের উদ্দেশে হাসল বার্টি। তারপর ওর চোখ গিয়ে পড়ল রানার ওপরে। ধীর পায়ে বন্ধুর পাশে থেমে নিচু গলায় বলল, ‘লবিতে আয়, জরুরি।’ রানার কাঁধ চাপড়ে দিল সে। ঝুঁকে মারিয়ার গালে চুমু দিয়ে তাকাল হের মুলারের দিকে। আড্ডায় যোগ দিতে পারছে না বলে দুঃখের হাসি ওর মুখে। মৃদু মাথা দুলিয়ে আবারও চলে গেল লাউঞ্জ ছেড়ে।

মারিয়ার বাহু স্পর্শ করে কাউচ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা, লাউঞ্জ ছেড়ে বেরিয়ে এল লবিতে। ঘরের পেছনের দিকে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত কাঁচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে বার্টি। চোখ নিচের স্কি রানের ওপরে। আসলে দেখছে কাঁচে বন্ধুর প্রতিচ্ছবি। নির্জন লবিতে ওরা ছাড়া আর কেউ নেই।

বার্টির পাশে গিয়ে থামতেই রানার কানের কাছে ফিসফিস করল সে, ‘মেয়েটা গ্রানাডার হোটেল থেকে বেরিয়ে গেছে। ধারণা করছি আসবে সোল ই নিয়েরেতে।’

‘কখন রওনা হয়েছে?’

‘আজ বিকেলে। ঠিক কখন, সেটা জানতে পারিনি।’

‘দুঃসংবাদ।’

মাথা দোলাল বার্টি।

জানালার কাঁচের মাধ্যমে ডেস্ক ক্লার্ককে দেখতে পেল রানা। কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছে সে, তারপর ক্রেডলে রিসিভার রেখে দিয়ে গিয়ে ঢুকল লাউঞ্জে। দু’মিনিট পর আবার এল লবিতে। এখন তার পেছনে আসছে ক্যাথি মোনালিসা।

বার্টির পাঁজরে কনুইয়ের গুঁতো দিল রানা।

সিঁড়ির দিকে চলেছে ক্যাথি, শুকিয়ে আমশি হয়ে গেছে মুখ। সন্দেহ নেই এখনই গিয়ে ঢুকবে ওদের সুইটে!

পরস্পরকে দেখল রানা ও বার্টি। এদিকে লাউঞ্জ থেকে বেরিয়ে এসেছে মারিয়া, চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা। বার্টির পাঁজরে আরেক গুঁতো বসাল রানা। ‘তুই মারিয়াকে লাউঞ্জে আটকে রাখ্। আমি যাচ্ছি ক্যাথির সঙ্গে কথা বলতে।’

‘ঠিক আছে,’ নড করল বার্টি।

ক্যাথি সিঁড়ি বেয়ে দেড়তলা উঠতেই ওর পিছু নিল রানা। বুঝেছে, লবির ক্লার্ককে ফোন করে মেয়েটাকে ডেকে নিয়েছে কেউ। সে যে কে এবং কী তার উদ্দেশ্য, আঁচ করছে রানা।

চতুর্থতলার করিডরে বাঁক নিয়ে ব্যাগের ভেতরে চাবির জন্যে হাত ভরল ক্যাথি। আর তখনই দেখল ওদের ঘরের দরজা খোলা। ঘুরে করিডরের এদিকে-ওদিকে চোখ বোলাল মেয়েটা। এমনটা হবে ভেবে আগেই করিডরের কোণে থেমে এক পা পিছিয়ে গেছে রানা। উঁকি দিল ওদিকে।

এইমাত্র মেয়েটার পেছনে আটকে গেছে দরজা।

দ্রুত হেঁটে ক্যাথির সুইটের দরজার সামনে থামল রানা। ভারী কবাটের জন্যে প্রথমে কোন আওয়াজ শুনতে পেল না। তারপর ওর মনে হলো, ঘরের ভেতরে নিচু গলায় কথা বলছে কারা যেন। একটা কণ্ঠ হালকা, অন্যটা উঁচু স্বরের। দুটোই নারীকণ্ঠ। ক্যাথি বোধহয় লাশ দেখে চমকে গেছে।

কিন্তু কার সঙ্গে কথা বলছে সে?

ভেতরে তো অন্য কারও থাকার কথা নয়!

বোধহয় আলাপ করছে টেলিফোনে!

থেমে গেল নিচু গলার আওয়াজ। তারপর ক্র্যাচ্ আওয়াজ তুলে খুলল একটা দরজা।

ওটা কি কোন ক্লসিটের?

বাইরে বেরোবার জন্যে পোশাক পাল্টে নিচ্ছে মেয়েটা?

সুইটের দরজা থেকে সরে করিডরের শেষমাথায় পৌঁছে ব্যালকনিতে থামল রানা। এ-হোটেলের তিনদিকে ব্যালকনি। ওখানে দাঁড়িয়ে ক্যাথি করিডরে বেরোবে, সেজন্যে অপেক্ষা করল রানা।

পেরিয়ে গেল পুরো দশ মিনিট।

একবার হাতঘড়ি দেখল রানা, তারপর ধৈর্য হারিয়ে ফিরে এল করিডরের মাঝে ক্যাথিদের দরজার সামনে। কবাটে কান পেতে কোন আওয়াজ শুনতে পেল না।

ধীরে ধীরে পেরোচ্ছে সময়।

আরও দেরি না করাই বোধহয় ভাল। ওয়ালথার বের করে দরজার নবে মোচড় দিল রানা। আগের মতই খোলা দরজার তালা। কবাট ঠেলে পিস্তল হাতে ঘরে ঢুকে পড়ল রানা।

বিছানায় পড়ে আছে কার্সনের লাশ।

ঘরে আর কেউ নেই।

পাশের ঘরে উঁকি দিল রানা। ওখানেও কেউ নেই।

তা হলে কোথায় গেল ক্যাথি মোনালিসা?

ক্লসিটের দরজার দিকে তাকাল রানা।

কিন্তু ওটা এতই ছোট, ওখানে কেউ লুকাতে পারবে না।

এবার কী করবে সেটা ভাবতে শুরু করেছে রানা, এমন সময় শুনতে পেল আবছা আওয়াজ। শ্বাস নিতে ভুলে গেল ও। তখনই আবারও শুনল আওয়াজটা। খস খস আওয়াজে নড়ে উঠেছে কেউ। ঝট করে আবারও ক্লসিটের দিকে তাকাল রানা। কিন্তু আওয়াজটা ওদিক থেকে আসেনি।

শব্দ হয়েছে বাথরুমে।

উদ্যত ওয়ালথার হাতে বাথরুমের কাছে চলে গেল রানা।

বাথরুমের দরজা বন্ধ।

‘ক্যাথি,’ নিচু গলায় ডাকল রানা।

ওদিক থেকে এল না কোন জবাব।

কেউ না কেউ আছে বাথরুমে।

আর সে ক্যাথি নয়।

মেয়েটা তা হলে গেছে কোথায়?

নাকি অন্য কারও সঙ্গে বাথরুমে আছে সে?

‘ক্যাথি,’ আগের চেয়ে একটু জোরে ডাকল রানা।

এবারও কোন জবাব নেই।

‘আমি দরজা খুলছি, হাতে পিস্তল, সতর্ক করল রানা। ‘মাথার ওপরে হাত তুলে বেরিয়ে এসো।’ দরজার একপাশে সরে গেল ও।

কবাট খুলল না কেউ।

একদিকের চৌকাঠে শরীর ঠেস দিয়ে দরজার নব ধরে মোচড় দিল রানা। ভেতরে ঠেলা খেয়ে সামান্য খুলে গেল দরজা। হামলা হবে ভেবে সতর্ক হয়ে উঠেছে রানা।

কিন্তু আক্রমণ এল না। কোথাও কোন আওয়াজ নেই।

একটু খোলা দরজার ওদিকে চোখ গেল ওর। বাতি জ্বলছে বাথরুমে। ফ্যাকাসে চেহারায় ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে এলিনা পার্কারসন, চোখে ভীষণ ভয়।

বাথরুমে পা রেখে ওর দিকে ওয়ালথার তাক করল রানা। আর তখনই চোখ গেল বেসিনের ওপরে। ওখানে ছোট এক বোতল ফ্লুইড, হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ আর কয়েক টুকরো তুলা। ড্রাগ নিচ্ছে অপ্সরার মত সুন্দরী মেয়েটা!

বিস্ফারিত চোখে রানার দিকে তাকাল এলিনা।

‘ক্যাথি কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল এলিনা। ফিসফিস করে বলল, ‘ওকে দেখিনি। এখানে এসে দেখি… মারা গেছে কার্সন!’

এলিনার কনুই ধরল রানা। ওর গায়ে ঢলে পড়ল মেয়েটা। কাঁপা গলায় বলল, ‘কার্সনকে খুন করেছে ক্যাথি?’

জবাব না দিয়ে পাল্টা জানতে চাইল রানা, ‘তুমি সোল ই নিয়েরেতে এলে কেন?’

চোখ তুলে ওকে দেখল এলিনা। বাথটাবের কিনারায় ওকে বসিয়ে দিল রানা। নিজেও বসল ওর পাশে। হাতের পিস্তলের নল তাক করে রেখেছে এলিনার বুকে। ভাল করেই জানে, এই মেয়ে আসলে চরম প্রতারক।

‘আমি… আমি এসেছিলাম…’

‘কার্সনের সঙ্গে দেখা করতে,’ তথ্য জুগিয়ে দিল রানা। ‘যাতে চিনিয়ে দিতে পারো মোরেলিকে। যাতে খুন করা যায় তাকে।’

চুপ করে আছে এলিনা। থরথর করে কাঁপছে দু’ঠোঁট। রানার চোখ থেকে সরিয়ে নিল নিজের চোখ। ফিসফিস করে বলল, ‘তা-ই আসলে।’

‘মোরেলিকে খুন করতে কার্সনকে ভাড়া করেছিলে,’ বলল রানা। ‘মিথ্যা বলে রেহাই পাবে না। মারা যাওয়ার আগে সবই বলে গেছে কার্সন।’

‘আমি কিছুই অস্বীকার করছি না,’ নিচু স্বরে বলল এলিনা। গালে ফিরেছে রঙ। একবার দেখল হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ।

‘কী কারণে মোরেলিকে খুন করতে চাও?’ জানতে চাইল রানা। ‘তুমি কি বেশকিছু দিন ধরেই ড্রাগ অ্যাডিক্ট? মোরেলির দেয়া ড্রাগে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছ বলে তার ওপরে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলে?’

‘আমি আসলে জানি না কেন ওকে খুন করতে চাই,’ ঢোক গিলে বলল এলিনা। ‘তবে এই দুনিয়ায় ওর চেয়ে বেশি আর কাউকে এতটা ঘৃণা করি না।’

‘মোরেলি তো ড্রাগের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে,’ বলল রানা। ‘অপরাধীদেরকে ধরিয়ে দেবে ভেবেছে।’

বুকের কাছে ঝুলে গেল এলিনার মাথা।

আবারও জানতে চাইল রানা, ‘তুমি এখানে এলে কেন?’

‘কার্সনের সঙ্গে কথা বলতে,’ বিড়বিড় করল এলিনা। ‘ব্যালকনির দিক থেকে এসে দেখি ওর ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকলাম। তারপর… তারপর দেখি… ও খুন হয়েছে!’

এলিনার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রানা। বুঝে গেছে, কোন্ পথে ঘর ছেড়ে চলে গেছে ক্যাথি। ঘরে কার্সনের লাশ দেখে ভীষণ ভয় পেয়েছে। দেরি করেনি পালিয়ে যেতে। ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো খুলে পা রেখেছে ব্যালকনিতে, তারপর সিঁড়ি বেয়ে ছুটে নেমে গেছে নিচে। এর কিছুক্ষণ পর কার্সনের সঙ্গে কথা বলতে এ-ঘরে এল এলিনা। হয়তো আলাপের জন্যে এখানেই দেখা করার কথা ছিল। কিন্তু এলিনা যখন দেখল খুন হয়ে গেছে কার্সন, তখন নার্ভাস হয়ে ড্রাগ নিতে ঢুকেছে বাথরুমে। আর প্রায় একই সময়ে ঘরের দরজা খুলেছে রানা।

‘ঘরে ঢুকে দেখি কে যেন গুলি করে মেরেছে কার্সনকে। প্রথমে ভাবলাম, কাজটা ক্যাথির। তবে এখন মনে হচ্ছে, কে তাকে খুন করতে এসেছে, সেটা জেনে গিয়েছিল মোরেলি।’ অশ্রুতে ভরে গেল এলিনার অপূর্ব সুন্দর দুটো চোখ। ‘আমার খুব ভয় লাগছে, কিং!’

ওর চোখে তাকাল রানা। ‘মোরেলি আসলে কে, সেটা চিনিয়ে দেবে তুমি, এলিনা। বাঁচতে হলে এ-ছাড়া তোমার আর কোন উপায় নেই। যেভাবে হোক মোরেলির কাছ থেকে মাইক্রোফিল্ম পেতে হবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল এলিনার চেহারা। ‘কিং, মোরেলি জেনে গেছে তাকে খুন করতে খুনি ভাড়া করেছি আমি! এখন তাকে চিনিয়ে দিলে বাঁচতে দেবে না আমাকে! কিং, প্লিয, আমাকে ছেড়ে দাও! আমি পালিয়ে যাব!’

‘সে-উপায় নেই, এলিনা, গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা। ‘তুমি মোরেলিকে চিনিয়ে দেবে। দূর থেকে আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেই চলবে। তারপর..:

‘মোরেলি নিজের পরিচয় অস্বীকার করবে!’ ফুঁপিয়ে উঠল এলিনা। ‘তারপর প্রথম সুযোগে খুন করবে আমাকে!’

‘লিনা…’

হাইপোডারমিক সিরিঞ্জের জন্যে হাত বাড়াল এলিনা। সে কী করতে চায় সেটা বুঝে মন খারাপ হয়ে গেল রানার। নরম সুরে বলল, ‘লিনা, ড্রাগ তোমাকে বাঁচতে দেবে না। বাস্তবে পা রাখো!’

হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ শক্তহাতে ধরেছে এলিনা। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘রানা, এ-ছাড়া আমার আর কোন উপায় নেই!’

পকেটে ওয়ালথার রেখে হাইপোডারমিক নিডল নেয়ার জন্যে হাত বাড়াল রানা। আর তখনই হঠাৎ করে বদলে গেল এলিনার দুঃখী-দুঃখী ভাব। অপরূপ মুখটা যেন হয়ে গেল হিংস্র বেড়ালের মত। জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ। হীরার মত দাঁতের ওপর থেকে সরে গেছে লিপস্টিক-মাখা লাল ঠোঁট রানা আত্মরক্ষা করার আগেই খচ করে ওর বাহুতে গেঁথে গেল হাইপোডারমিক নিডল!

কর্কশ সুরে হেসে উঠল এলিনা পার্কারসন।

রানার মনে হলো, মাত্র এক সেকেণ্ডে উধাও হয়ে গেছে ওর শরীরের সব শক্তি!

কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে টেনে তুলল এলিনা। ঘরে নিয়ে গিয়ে ধুপ করে বসিয়ে দিল একটা চেয়ারে। এলিনার ঠোঁটে এখন শেয়ালের মত দুষ্ট হাসি। খুশিমনে বলল, ‘এটা আমার নিজের তৈরি মিক্সচার। এবার লক্ষ্মী ছেলের মত চুপ করে বসে থাকো। আর এই সুযোগে আমি বিদায় নিচ্ছি।’

‘না, এলিনা, ভুল করছ,’ বলতে চাইল রানা, কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। ওর চোখের সামনে দুলছে গোটা ঘর। তারই ভেতরে হাসতে হাসতে ফ্রেঞ্চ উইণ্ডো খুলে ব্যালকনিতে বেরিয়ে গেল এলিনা।

ঘরের ভেতরে নেমেছে থমথমে নীরবতা।

এরপর যেন কেটে গেল কোটি বছর। তারপর দরজায় জোরে জোরে টোকা দিল কেউ। বোধহয় বার্টি।

‘রানা! তুই কি ভেতরে আছিস? রানা?’

ঠোঁট ফাঁক করলেও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না রানা। ভাবতে চাইল, কখন কাটবে দেহের অবশ ভাব!

দড়াম করে খুলে গেল ঘরের দরজা। পিস্তল হাতে ঝড়ের বেগে ভেতরে ঢুকল বার্টি। চেয়ারে রানাকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে হতবাক হয়ে গেছে।

‘কী রে, রানা? বসে আছিস কেন?’

বারকয়েক ঠোঁট নাড়ল রানা। ওর হাত-পায়ে ধীরে ধীরে ফিরে আসছে সাড়া।

সুইটের দুই রুম দেখে নিয়ে বাথরুমে উঁকি দিল বার্টি। ওখানে ওষুধের কড়া গন্ধ। ঘরে ফিরে রানার পিঠে চাপড় দিল সে। আরেকটু হলে চেয়ার থেকে কাত হয়ে মেঝেতে পড়ত রানা। চেয়ার থেকে টেনে তুলে ওকে বাথরুমে নিল বার্টি। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে পানির ধারার নিচে ধরল রানার ঊর্ধ্বাঙ্গ। বরফ-ঠাণ্ডা পানি কুলকুল করে নামছে মাথা বেয়ে মেঝেতে।

বন্ধুর মুখ ধুয়ে দিতে দিতে বলল বার্টি, ‘নতুন ড্রাগ, কিছু দিন আগেই আমাদের হাতে এসেছে। ইনজেক্ট করলে নড়াচড়া করা যায় না। চুপচাপ বসে বসে সব দেখতে হয়। কিছুক্ষণের জন্যে দেহ হয় অবশ। মাফিয়া এই ড্রাগের নাম দিয়েছে উউরারা।’

মিনিট দুয়েক পর উঠে বসল রানা। এখনও মাথা ঘুরছে। নিচু গলায় বলল, ‘গ্রানাডা থেকে চলে এসেছে এলিনা পার্কারসন। ঘরে কার্সনের লাশ দেখেছে। ভাবছে, ওকে হাতে পেলে খুন করবে মোরেলি। এখন পালিয়ে যাচ্ছে। সে-সুযোগ পেলে আবারও চেষ্টা করবে মোরেলিকে খুন করতে।’

‘আমি যখন তোকে খুঁজতে ওপরে এলাম, নিচতলায় ওকে দেখেছি,’ বলল বার্টি। ‘লবিতে সিন ক্রিয়েট করছিল। তারপর ক্লার্ককে রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে।’

‘চল, ওকে ধরতে হবে!’ উঠে দাঁড়িয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ঘরে ঢুকল রানা। চট্ করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে বার্টির সঙ্গে বেরোল করিডরে। প্রায় ছুটতে ছুটতে লবিতে নামল ওরা। নিজেদের ভেতরে কথা বলছে বেশ কয়েকজন। সবার চোখ পার্কিংলটে। তাদের পাশে থেমে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল রানা ও বার্টি।

ওদের পেছনে এসে থামল মারিয়া। নিচু গলায় বলল, ‘লাল এক জাগুয়ারে আছে এলিনা। কী যেন হয়েছে ওখানে। আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি।’

পার্কিংলটে হঠাৎ করেই জ্বলে উঠল দুটো হেডলাইট। প্রাডো লানোর পাহাড়ি রাস্তায় গিয়ে পড়েছে উজ্জ্বল আলো। রওনা হয়ে গেল গাড়িটা। চলেছে হাইওয়ে লক্ষ্য করে।

‘আসলে কী হয়েছে?’ অধৈর্য হয়ে বলল রানা।

‘তার প্রেমিক মারিয়ো কাপতি কোথায় গেছে, সেটা ক্লার্ক জানে না কেন সেজন্যে চেঁচামেচি করেছে,’ বলল মারিয়া।

‘মারিয়ো কাপতি আসলে কে?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমরা সেটা জানি না,’ বলল বার্টি। ‘ক্লার্ক যখন বলল এখানে এই নামের কেউ নেই, রাগে প্রায় পাগল হয়ে গেল মেয়েটা। শুরু করল চিৎকার করে গালি। লাউঞ্জে যারা ছিল, সবাই চলে এল লবিতে। আর তখনই তোর খোঁজে ওপরে গেলাম আমি।’

‘তার মাত্র আধমিনিট পর হোটেল থেকে বেরোল এলিনা,’ বলল মারিয়া, ‘আর তার একটু পর নিচে নেমে এলে তোমরা।’

ছুটন্ত জাগুয়ারের ওপরে গিয়ে পড়ল রানার চোখ। নিচু গলায় বলল ও, ‘এলিনাকে থামাতে হবে।’

‘এদিকে আমি কী করব?’ জানতে চাইল বার্টি।

‘মারিয়ো কাপতির ব্যাপারে খোঁজ নে,’ বলল রানা। ‘যদিও মনে হয় না এই নামের কেউ আছে।’

ভিড়ের ভেতর দিয়ে দরজার কাছে চলে গেল রানা।. কিছুটা দূরে আছে হের মুলার। ওর উদ্দেশে হাত নাড়ল সে।

হোটেল থেকে বেরিয়ে ছুটতে ছুটতে পার্কিংলটে এল রানা। তালা খুলে উঠে পড়ল রেঁনো গাড়ির ড্রাইভিং সিটে। বরফের টুকরো হয়ে গেছে পুরনো ইঞ্জিন। পাঁচবারের বার চালু হলো। শক্ত বরফে চাকা পিছলে জাগুয়ারের পিছু নিল রেঁনো।

নিচে নেমে গেছে হাইওয়ে। ডানে বাঁক নিয়ে আবারও দূরে জাগুয়ার গাড়িটার পেছনের লাল বাতি দেখতে পেল রানা। ওর মনে পড়ল, সামনেই বামে ঘোড়ার নালের মত বড় একটা বাঁক। তারপর আবারও চুলের কাঁটার মত ঘুরে গেছে রাস্তা। পাশেই গভীর নদীখাদ। ইঞ্জিনের সম্পূর্ণ শক্তি নিংড়ে নিতে চাইছে রানা। মনের ভেতরে ভয়, চোখের আড়ালে চলে যাবে জাগুয়ার।

পথের বাঁকে হেডলাইটের আলো পড়তেই ব্রেক কষে গতি কমাল রানা। টের পেল, ঠিকভাবেই কাজ করছে ব্রেক শ্য। পরের বাঁক পেরিয়ে ঘোড়ার নালের মত জায়গায় জাগুয়ার গাড়িটাকে দেখল রানা। অন্ধকারে ধীরবেগে যেতে যেতে হঠাৎ করেই কেন যেন ঝোড়ো গতি তুলল গাড়িটা। জ্বলজ্বল করছে পেছনের লাল বাতি। তারপর কী যেন হয়ে গেল এলিনার। বোধহয় বরফে পিছলে গেছে চার চাকা। হঠাৎ সরে গিয়ে পথের ধারে নিচু পাথুরে দেয়ালের ওপরে চড়াও হলো জাগুয়ার।

আকস্মিক এ-ঘটনায় চমকে গেছে রানা। মনে মনে বলল, ‘ব্রেক, এলিনা! ব্রেক করো!’

আসলে কী ঘটেছে সেটা বুঝল না রানা। ওর চোখের সামনে দেখল, পথের পাশের পাথুরে নিচু দেয়াল টপকে সাঁই করে বহু নিচে সরু নদীর খাদের দিকে নেমে গেল জাগুয়ার!

একপলক আগে পাহাড়ের খাড়া গায়ে ছিল হেডলাইটের উজ্জ্বল আলো, পরক্ষণে মিলিয়ে গেছে শেষ রশ্মি!

গিরিখাদের নিচ থেকে এল লোহা-লক্কড় ভাঙার বিকট আওয়াজ। তারপর হঠাৎ নামল নীরবতা। উঁচু পাহাড়ের গায়ে এসে লাগল কমলা আগুনের আভা। পাক খেয়ে উঠে আসছে ঘন কালো ধোঁয়া।

জাগুয়ার যেখান থেকে নিচে পড়েছে, ওখানে পৌঁছে রেঁনো থামাল রানা। ইঞ্জিন বন্ধ করে চাবি হাতে নেমে এল গাড়ি থেকে। ভাঙা দেয়ালের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অন্তত এক শ’ ফুট নিচে পড়ে নদীতীরে বিধ্বস্ত হয়েছে জাগুয়ার। চারপাশে ভাঙা লোহা ও প্লাস্টিকের টুকরো। জ্বলন্ত গাড়িটা চাটছে দাউ-দাউ আগুনের হলকা।

পরের দু’মিনিটে পেছনে আলো দেখতে পেল রানা। হোটেল থেকে আসছে অতিথিরা। প্রথমে এসে থামল এক দম্পতির ফিয়াট গাড়ি। তারপর এল একে একে অনেকে।

বেশিরভাগ মানুষ ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার বর্ণনা তারিয়ে তারিয়ে বলতে ভালবাসে। কী অদ্ভুত বিকৃতি তাদের মানসিকতায়!

পাহাড়ের যেখানে গিয়ে প্রথমে পড়েছে জাগুয়ার, ওখানে নেমে এল রানা। পকেট থেকে ছোট্ট ফ্ল্যাশলাইট বের করে- আলো জ্বেলে এদিকে-ওদিকে তাকাল। পাথরে লেগে আছে জাগুয়ারের চটে যাওয়া লাল রঙ। পাহাড়ি ঢালু জমি বেয়ে নদীতীরে নেমে এল ও। অবশ্য আগুনের তীব্র তাপে যেতে পারল না গাড়িটার কাছে। জাগুয়ারের ড্রাইভিং সিটে আছে অঙ্গার হয়ে যাওয়া এলিনা। এখন কেউ বলবে না দুনিয়ার অন্যতম সুন্দরী মেয়ে ছিল সে।

ওপরের পথে থেমেছে ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি। ওটা থেকে নেমেছে অগ্নিযোদ্ধারা।

পোর্টেবল হাতে এক্সটিংগুইশার। পাহাড়ি খাদে নেমে এল তারা, পরনে স্কি জ্যাকেট। মিনিট পাঁচেকের ভেতরে স্প্রে ছিটিয়ে আগুন নেভাল তারা।

গোটা সময় তাদের পাশে দাঁড়িয়ে অঙ্গার হওয়া এলিনার দেহাবশিষ্টের দিকে চেয়ে রইল রানা। একটু পর ওর পাশে থামল গার্ডিয়া সিভিলের এক অফিসার। হাতে শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট। ওটার আলোয় পরিষ্কার রানা দেখল এলিনার পোড়া মুখ। ওর মনের ভেতরে ঘুরপাক খেল মেয়েটার সঙ্গে কাটিয়ে দেয়া অদ্ভুত রোমাঞ্চকর রাতটির কথা

ওর পাশে এসে থামল কে যেন। নিচু গলায় বলল, ‘রানা, চল, ওপরে যাই।’

‘ওর মৃত্যু বড় অদ্ভুত, বার্টি,’ প্রায় বিড়বিড় করল রানা।

‘বুঝে গিয়েছিল যে ওকে ধরা পড়তেই হবে,’ বলল বার্টি। ‘ওকে বাঁচতে দিত না রোমিয়ো মোরেলি।’

‘হয়তো সে এখনও জানে না এখানে কী ঘটেছে।’

‘জেনে নেবে।’

‘তা-ই আসলে।’

‘মারিয়ো কাপতির ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছি,’ বলল বার্টি।

বন্ধুর দিকে তাকাল রানা।

মাথা নাড়ল বার্টি। ‘আশপাশের হোটেলে এ-নামে কেউ নেই।’

‘অথচ ক্লার্ককে এই নাম বলেছে এলিনা।’

‘তোদের হোটেলের ক্লার্ক ওকে বলেছিল, এই নামে কেউ নেই,’ বলল বার্টি, ‘আর তাতে রেগে গিয়েছিল এলিনা।’

লাশের দিকে আবারও তাকাল রানা। ‘তা হলে কি তুই বলতে চাস সোল ই নিয়েরেতে আসেইনি মোরেলি?’

‘এটা অন্তত জানি, গত একমাসের ভেতরে কোন হোটেলে ওঠেনি সে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল রানা। ‘আগেই বোধহয় জেনেছে, খুনি ভাড়া করে তাকে খুন করাতে চাইছে এলিনা।’

বন্ধুর দিকে তাকাল বার্টি। ‘তা হলে কি ধরে নেব, এলিনাকে দুনিয়া থেকে সরাতে আমাদের সঙ্গে মিটিঙে বসার ব্যাপারে মিথ্যা বলেছে মোরেলি?’

‘হয়তো তা-ই,’ বলল রানা, ‘সে জানত এলিনা আর কার্সনের ব্যাপারে। মাফিয়া থেকে পাঠানো হত্যাকারী, এলিনার ভাড়া করা খুনি আর আমরা সবাই ভেবেছি মোরেলি এখানে এসেছে। অথচ সবাইকে হয়তো বোকা বানিয়ে দিয়েছে।’

এবার তোর বস্ আর আমার বসকে সব জানাতে হবে, ‘ বলল বার্টি। ‘নতুন করে যোগাযোগ করতে হবে মোরেলির সঙ্গে। চল, ওপরে যাই।’

পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগল দুই বন্ধু।

আফসোসের সুরে বলল বার্টি, ‘মেয়েটা সত্যিই দুর্দান্ত সুন্দরী ছিল। তবে সুন্দরীরা বেশিরভাগ সময় খুব বোকা হয়। এলিনা হয়তো মোরেলিকে ভালবাসত, আবার একই সঙ্গে ঘৃণা করত তাকে।’

‘অথবা ভালবাসত মোরেলির টাকা,’ মন্তব্য করল রানা। ‘টাকা কে না ভালবাসে, রানা?’ হাসল বার্টি। ‘ওকে ধাওয়া করত মোরেলির দলের খুনি।

আত্মহত্যা করে বসেছে মেয়েটা।’

সেটা বুঝেই হয়তো

‘এখন বড় প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কোথায় আছে সেই মোরেলি,’ বিড়বিড় করল রানা।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন