ব্ল্যাক লিস্ট – ৫

কাজী আনোয়ার হোসেন

পাঁচ

ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের সিচুয়েশন রুম সম্পূর্ণ সাউণ্ডপ্রুফ। সেখানে যাঁর যাঁর চেয়ারে বসে আছেন বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান আর বিএসএস-এর চিফ মার্ভিন লংফেলো। মুখোমুখি দুই চেয়ারে মাসুদ রানা ও মারিয়া হ্যারল্ড।

‘এবার বাতি নিভিয়ে দাও,’ জানালেন মিস্টার লংফেলো।

পরের সেকেণ্ডে ঘুটঘুটে অন্ধকার নামল বিশাল ঘরে। সামনের দেয়ালের মস্ত স্ক্রিনে ফুটে উঠল একটা ছবি।

‘রোমিয়ো মোরেলি,’ গুড়গুড় করল বিসিআই চিফ রাহাত খানের ভারী কণ্ঠ। ‘এ-ছবি তার পনেরো বছর আগের। অপেক্ষাকৃত বড় ছবি থেকে কেটে নেয়া হয়েছে।’

রানা দেখল লোকটার পেছনে ভ্যাটিকান সিটির গম্বুজ।

‘ক্যানন ক্যামেরার এই ছবি অন্যগুলোর চেয়ে ভাল। এ- ছাড়া মোরেলির অন্যান্য যেসব ছবি পাওয়া গেছে, সেসবের জন্যে খরচ করতে হয়েছে বহু টাকা। তা ছাড়া, এমন কোন প্রমাণ নেই যে মাফিয়ার ভেতর থেকে কেউ এসব ছবি বিক্রি করেছে। যদিও আমরা সেটাই ধারণা করছি।’

ছবির দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল রানা। ওটা এতই ঝাপসা যে ভাল করে বোঝা যায় না লোকটার নাক-মুখ। মোরেলির মাথার চুল কালো। থুতনি বড়। তবে মুখের তুলনায় বেমানান নয়। খুব ছোট ছবি থেকে বড় করা হয়েছে দৃশ্যটা।

রাহাত খান একটা বাটন টিপে দেয়ায় স্ক্রিনে ভেসে উঠল কর্সিয়ার ম্যাপ। লাল কালিতে ঘেরা হয়েছে বাসিয়া শহর।

‘জানা গেছে কর্সিয়ার বাসিয়ার শহরতলীতে নির্জন এলাকায় গোপনে বাস করে রোমিয়ো মোরেলি। তার বাড়িটা নেপোলিয়ানের আমলে তৈরি চমৎকার এক ভিলা। সেখানে কাজ করে বারোজন ভৃত্য। এ ছাড়া তাকে পাহারা দেয় দু’জন বডিগার্ড। এলিনা পার্কারসন নামের এক মেয়েকে রক্ষিতা হিসেবে রেখেছে মোরেলি।

‘মোরেলির মা বাঙালি মেয়ে, বাংলাদেশ থেকে ইতালিতে গিয়েছিল স্কলারশিপ নিয়ে। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় বিয়ে করে মাফিয়ার এক ফুটসোলজারকে। এরপর আর লেখাপড়া হয়নি তার। একটা ছেলে হওয়ার মাত্র ছয় বছর পর ক্যান্সারে ভুগে মারা যায়। তার কয়েক বছর পর এক বন্দুক-যুদ্ধে খুন হয় মোরেলির বাবা। বর্তমানে রোমিয়ো মোরেলির বয়স প্রায় পঁয়তাল্লিশ। কিছু দিন রোমে চাকরি করার পর গোপন কোন কারণে তাকে চাকরি থেকে ছাঁটাই করে ইতালিয়ান সরকার। বিয়ে করেছিল ভালবেসে। কয়েক বছর পর নিউমোনিয়ায় মারা গেছে তার সেই স্ত্রী। মোরেলির চাকরি ছিল না বলে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে পারেনি। তাতে তিক্ত মনে ভিড়ে যায় একদল জালিয়াত ও চোরের দলে। এরপর ওখান থেকে বেরিয়ে এনফোর্সার হিসেবে যোগ দেয় ইতালিয়ান মাফিয়ায়। খুন-খারাবিতে বেশ ভাল করে। কয়েক বছর আগে যখন ইউরোপ আর এশিয়ায় ড্রাগ পাচার করতে মরিয়া হয়ে উঠল ইতালিয়ান আর আমেরিকান মাফিয়া ডনেরা, সে-সুযোগে নেপস্-এ নিজের ফ্লো পয়েন্ট তৈরি করল সে। এশিয়া আর ইউরোপে মাত্র তিন বছরে হয়ে উঠল ইতালি ও আমেরিকান মাফিয়া ডনদের চোখের মণি।’

‘সেক্ষেত্রে মাফিয়াদের কাছ থেকে সরে যেতে চাইছে কেন সে, স্যর?’ প্রথমবারের মত মুখ খুলল রানা।

‘আমাদের ধারণা তার মা বাঙালি বলেই বোধহয় ভেবেছে তাকে নিরাপদ আশ্রয় দেবে বাংলাদেশ,’ বললেন রাহাত খান। ‘আর এ-সুযোগটা আমরা নিতে চাই। তিনদিন আগে তাঁর অফিসে জরুরি বৈঠকে বসেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা। ওখানে ছিলেন স্বরাষ্ট্র সচিব, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের সচিব, উপ-সচিব; বাংলাদেশ পুলিশ, ডি.এস.বি., এন.এস.আই. আর দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধানেরা। বৈঠক শেষে সিদ্ধান্ত হয়, বিসিআই চিফ হিসেবে আমাকে অনুরোধ করা হবে ড্রাগস্ পাচারে জড়িত আন্তর্জাতিক মহলের বিরুদ্ধে যেন আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করি। সরকারের উপদেষ্টারা মনে-প্রাণে চান হুড়মুড় করে যেন বাংলাদেশে এসব ড্রাট্স্ না প্রবেশ করে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মিটিং শেষে যোগাযোগ করেছি দেশের প্রতিটি ছোটবড় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে। প্রধান উপদেষ্টার মতই একই কথা বলেছেন তাঁরা। তাঁদের দলের নেতা-কর্মী বা তাদের আত্মীয়-স্বজন ড্রাগস্‌ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত থাকলে, আমরা যেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিই। জাতির ক্রান্তিকালে এ-বিষয়ে একমত হয়েছেন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীবৃন্দ।

‘আমি তাঁদেরকে কথা দিয়েছি, মাফিয়ার ব্যবহৃত সব রুট চিহ্নিত করব আমরা। এবং এসবের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি অপরাধীকে গ্রেফতার করতে আইনী সংস্থাগুলোকে সহায়তা দেব। যেহেতু বাংলাদেশের মতই ব্রিটেনেও ঢুকছে প্রচুর ড্রাগ, তাই আলাপ করেছি বিএসএস চিফ মার্ভিন লংফেলোর সঙ্গে। আমার প্রস্তাব ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। এরপর আমাদের দুই দেশের নেতৃত্বে যাঁরা আছেন, ভিডিয়ো কলে আলাপ সেরে লংফেলো ও আমার পরিকল্পনায় সম্মতি দিয়েছেন তাঁরা। আর তাই বাংলাদেশ আর ব্রিটেনের যৌথ এই মিশন নিয়ে আমরা এখন কাজ করছি।’

এবার সত্যি দেশের জন্যে লড়তে পারব, ভাবল রানা। আরও তথ্য পাওয়ার জন্যে চুপ করে থাকল ও।

স্ক্রিন থেকে উধাও হলো ম্যাপ। বদলে দেখা গেল এক শত আশি ফুট দৈর্ঘ্যের বিশাল এক সাদা রাজকীয় ইয়ট।

‘ওটা মোরেলির ইয়ট দ্য লিলি,’ বললেন রাহাত খান। ‘মাস্তুলে দেখছ তোমরা ফ্রান্সের পতাকা। নিজেকে কর্সিয়ার মানুষ হিসেবে ভাবলেও মোরেলির জন্ম আসলে মিলানে।’

স্ক্রিনে এল মস্তবড় এক ভিলার ছবি।

‘মোরেলির বাড়ি। নিজের নিরাপত্তার জন্যে মাত্র দু’জন বডিগার্ড রাখে সে। যদিও সর্বক্ষণ চারপাশ থেকে ভিলা পাহারা দেয় অন্তত বারোজন গানম্যান।’

পরের ছবিতে দেখা গেল ঝোপের ভেতরে পড়ে আছে এক লোকের ক্ষত-বিক্ষত লাশ। অন্তত পাঁচবার বুকে-পেটে গুলি করা হয়েছে। পচে বিকৃত হয়ে গেছে চেহারা, চেনা যায় না।

‘ডামডাম বুলেট,’ মনে মনে বলল রানা।

করাত দিয়ে বুলেটে X-এর মত কেটে নেয়া হয়। লক্ষ্যে লাগলে ছেতরে শরীরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে ওটার টুকরো।

‘এই লাশ ফ্রান্সের সিক্রেট সার্ভিসের জেমিল এরেনকোর। সে ঢুকতে চেয়েছিল মোরেলির ভিলায়। তাকে দেখে ফেলে গানম্যানেরা। পরিণতি তো দেখতে পেলে তোমরা।’

এরপর দেখা গেল রুক্ষ, বিরান এক এলাকা। যুম লেন্স ব্যবহার করে বহু দূর থেকে তোলা হয়েছে একটা গাছ আর সেটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকা এক লোকের ছবি। যুম করা হলো দৃশ্য। তাতে রানার মনে হলো লোকটার বয়স হবে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ। বেশ লম্বা। শক্তপোক্ত দেহ। গাছের ছায়ায় মুখ বড় অস্পষ্ট।

‘এই ছবিও মোরেলির। গত কিছু দিনের ভেতরে তোলা। এরচেয়ে আরও কাছে যেতে পারেনি আর কেউ।’

টেলিস্কোপিক লেন্স ব্যবহার করে উল্টোদিকের টিলার ওপর থেকে গোপনে তোলা হয়েছে ছবি। মুখ স্পষ্ট করে দেখা না গেলেও দেহের আকার-আকৃতি পরিষ্কার। ‘কমপিউটার ব্যবহার করে ধারণা করা হচ্ছে, মোরেলির ওজন এক শ’. চুরাশি পাউণ্ড। উচ্চতা কমপক্ষে ছয় ফুট। স্বাস্থ্য চমৎকার।’

কালো হলো স্ক্রিন। এরপর শুরু হলো মোশন পিকচার। সুনীল সাগরের ধারে রুপালি সৈকতের দৃশ্য। জায়গাটা বোধহয় ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরা। বালিতে হাঁটছে সংক্ষিপ্ত বিকিনি পরা অদ্ভুত সুন্দরী এক মেয়ে। সূর্যের আলোয় ঝিকিয়ে উঠছে মাথার সোনালি চুল। কে যেন কথা বলছে মেয়েটার সঙ্গে। সেজন্যে হেঁটে যাওয়ার মাঝে ঘুরে তাকাল ক্যামেরার দিকে।.

‘এলিনা · পার্কারসন,’ বললেন রাহাত খান। বয়স ছাব্বিশ। জন্মেছে ডেনমার্কে। তরুণী বয়সে এসেছে রোমে। সিনেমায় নেমেছিল। তবে ছায়াছবি ফ্লপ হওয়ায় শেষ হয়ে যায় ক্যারিয়ার। এরপর দু’বছর থেকেছে সুইটয়ারল্যাণ্ডে। মাফিয়ার হয়ে মানি লণ্ডারিং করত। ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। যদিও বিচারের মুখোমুখি হয়নি। শোনা যায় সুইস কর্তৃপক্ষ বিপুল টাকার বিনিময়ে সীমান্তের ওদিকে তাকে পালিয়ে যেতে দেয়।

‘তারপর তার ঠাঁই হয় মোরেলির ভিলায়। যদিও তাকে ‘বিয়ে করেনি ড্রাগ লর্ড। কোথাও গেলে সঙ্গে করে তাকে নেয়। এ-মেয়ে ডেনিশ, সুইডিশ, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, ইংরেজি আর আরবি ভাষায় গড়গড় করে কথা বলতে পারে। সুইস ব্যাঙ্কে চাকরির সময় যে ইন্টারভিউ দিয়েছিল, তাতে পেয়েছিল ১৪৫ আইকিউ স্কোর। দুর্দান্ত এক ‘স্কিয়ার।’

এবারের ছবি উঁচু পাহাড়ের। তুষারের বুকে এঁকেবেঁকে নেমে যাচ্ছে এলিনা পার্কারসন। এই মেয়ে সত্যিই খুব ভাল স্কিয়ার, মনে মনে প্রশংসা করল রানা।

শীতের মাসে স্কিয়িং করে সময় কাটায়।’

স্ক্রিনে এল নতুন ম্যাপ।

এটা মার্কেইটর প্রজেকশন। তাতে দেখা যাচ্ছে কীভাবে ইউরোপ আর এশিয়ায় ছড়িয়ে গেছে ড্রাগের চেইন।

‘গত কয়েক বছরে বারবার বদলে গেছে ড্রাগ চালানের রুট। আর সেটা মাফিয়া কমিশনের অনুমতি নিয়েই করেছে রোমিয়ো মোরেলি। এরফলে বড় মাপের মাফিয়া ডনদের আয় বেড়ে গেছে কয়েক গুণ।’

আরও একটা ম্যাপ এল স্ক্রিনে।

ওটাতে আছে কীভাবে সাগরপথে পাচার হচ্ছে ড্রাগের চালান।

পরের ছবি বাস্ত্রিয়ায় মোরেলির এস্টেট ও ভিলার।

‘মন দিয়ে শোনো,’ খুক খুক করে কাশলেন বিসিআই চিফ রাহাত খান। ‘মাফিয়ার হয়ে এই দুই মহাদেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ করত মোরেলি। হয়তো গুজব হতে পারে, তবে শোনা যাচ্ছে মাফিয়া কমিশনের তৃতীয় ক্ষমতাশালী নেতা হয়ে ওঠে সে। আর তার সঙ্গেই গিয়ে দেখা করবে তোমরা।’

ছবি মিলিয়ে যেতেই জ্বলে উঠল সিচুয়েশন রুমের বাতি। নীরবতা নেমেছে ঘরে।

বললেন রাহাত খান, ‘কারও মনে কোন প্রশ্ন?’

চুপ করে থাকল রানা আর মারিয়া।

মার্ভিন লংফেলোর দিকে তাকালেন রাহাত খান।

‘ড্রাগসের ব্যবসা আরও বড় করতে চায় মাফিয়া ডনেরা, বললেন লংফেলো। ‘ছয় মাস আগে চেইনের সিস্টেম আরও ভালভাবে চেক করেছে তাদের বিশেষজ্ঞরা। আর এরপর আমেরিকান ডনেরা যোগাযোগ করেছে ইতালিয়ান ডনেদের সঙ্গে। গোপন মিটিং করেছে তারা। তাতে উঠে এসেছে ক্ষতিকর একটি দিক। গোটা ড্রাগসের ব্যবসার প্রায় অর্ধেক মুনাফা একাই নিচ্ছিল মোরেলি। আর সেজন্যেই আমেরিকান আর ইতালিয়ান ডনেরা সিদ্ধান্ত নেয়, এবার চিরকালের জন্যে বিদায় করে দেবে তাকে। দলের সেরা খুনিকে পাঠায় মোরেলিকে খুন করতে। তবে এরপর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। তোমরা আগেই দেখেছ, কী পরিণতি হয়েছে ফ্রেঞ্চ এজেন্টের। এবং সে-ই ছিল মাফিয়ার বেছে নেয়া সেরা খুনি। …এরপর অন্যদিক থেকে হামলা করল মাফিয়া ডনেরা। এজন্যে বেছে নিল এলিনা পার্কারসনকে। পুরনো মামলায় সুইট্যারল্যাণ্ডের এক ডিটেকটিভ পুলিশ অফিসার একদিন কর্সিয়ার বাসিয়ায় গিয়ে গ্রেফতার করতে চাইল মেয়েটাকে। তখন মোরেলির বডিগার্ডেরা সরিয়ে নিয়ে গেছে এলিনাকে। একই দিনে কাছের এক সৈকতে জোয়ারের সময়ে কে বা কারা যেন একটা খুঁটিতে হাত-পা বেঁধে রেখে গেছে পুলিশ অফিসারকে। কীভাবে যেন নিজেকে মুক্ত করেছে সে। এরপর দেরি না করে পালিয়ে গেছে কর্সিকা থেকে। আর ফেরেনি।’

রাহাত খান ও মার্ভিন লংফেলোর দিকে তাকাল রানা।

‘বলো, রানা?’ একই সঙ্গে ওর দিকে মনোযোগ দিলেন রাহাত খান ও মার্ভিন লংফেলো।

‘আমরা এসব কীভাবে জানলাম? কাদের মাধ্যমে?’

‘মোরেলি নিজেই এনক্রিপ করা ফোনে আমার সঙ্গে কথা বলেছে,’ জানালেন রাহাত খান। ‘তুমি বোধহয় জানতে চাইছ কেন আমাদের কাছে নিরাপত্তা চাইছে? এর জবাব হচ্ছে: ইতালিয়ান সরকার, ফ্রেঞ্চ সরকার বা অন্যদেরকে একফোঁটা বিশ্বাস করে না সে। মাতৃভূমির কাছে সাহায্য চেয়ে বসেছে। আগেই বলেছি, বদলে আমাদের হাতে দেবে ড্রাগসের সঙ্গে জড়িত ইতালিয়ান ও আমেরিকান মাফিয়া ডন এবং তাদের দলের গুরুত্বপূর্ণ সবার নাম, ঠিকানা, সম্ভাব্য রুট ও তাদের কাজের একটি ব্ল্যাক লিস্ট।’

‘স্যর, আমরা জানব কীভাবে যে তার তৈরি ব্ল্যাক লিস্ট আসলে নকল নয়?’ জানতে চাইল রানা।

‘আপাতত সেটা জানার কোন উপায় নেই,’ বললেন লংফেলো। ‘আর সেজন্যেই আমরা পাঠাচ্ছি তোমার সঙ্গে মারিয়াকে। যাতে সে ড্রাগ চালানের রুটের বিষয়ে অন্তত মোরেলির কাছ থেকে বিশদ তথ্য জেনে নিতে পারে। তাতে হয়তো বোঝা যাবে’ লোকটা সত্যি কথা বলছে কি না।’

‘স্পেনের সোল ই নিয়েরেতে স্কি রিসোর্টে রোমিয়ো মোরেলির সঙ্গে দেখা করবে তোমরা,’ বললেন রাহাত খান। ‘প্রতিবছর একই স্কি রিসোর্টে যায় এলিনা পার্কারসন। আর সেই একমাস ধরে তাকে সঙ্গ দেয় মোরেলি।’

‘স্যর, সেক্ষেত্রে সে নিশ্চয়ই ছদ্ম-পরিচয় ব্যবহার করবে?’ রানার দিকে তাকালেন বিসিআই চিফ। ‘ঠিকই বলেছ, রানা। এ-মিশনে তার কোডনেম হচ্ছে দ্য নোবলম্যান। খুব সতর্ক থাকবে তোমরা। হয়তো তার ওপরে হামলা করবে মাফিয়ার খুনিরা।’

‘আমরা মোরেলির সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ করব, স্যর?’

‘ম্যালাগায় আমাদের এজেণ্ট আছে,’ বললেন লংফেলো। ‘ওকে তুমি চেনো। রানা, তোমরা স্পেনের ম্যালাগায় গিয়ে দেখা করবে এজেণ্ট বার্টি এইচ. স্মিথের সঙ্গে। পরে সোল ই নিয়েরের সেই রিসোর্টে মোরেলির দলের কমবয়সী এক ছেলে তোমাদেরকে জানিয়ে দেবে কোথায় হবে দু’পক্ষের মিটিং।’

‘আমার কাভার কী হবে, স্যর?’ জানতে চাইল রানা।

‘তুমি পেশাদার ফোটোগ্রাফার স্যামি কিং,’ রানার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মারিয়াকে দেখলেন রাহাত খান। ‘আর তুমি এখন থেকে কিঙের মডেল। আজই তৈরি হবে তোমাদের সমস্ত কাগজপত্র। এ-ছাড়া. ব্যাকগ্রাউণ্ড হিসেবে যেসব নোট দেয়া হবে, ওগুলো মুখস্থ করে নেয়ার পর সব পুড়িয়ে দেবে।’

‘আমাকে কি ফোটোগ্রাফারের মডেল হিসেবে উলঙ্গ হয়ে পোয দিতে হবে?’ জানতে চাইল মারিয়া হ্যারল্ড।

ওর কথা শুনে লজ্জায় ফ্যাকাসে হলেন চিরকুমার রাহাত খান। উদাস চোখে দেখলেন সামনের দেয়াল।

‘দরকার হলে সবই করবে,’ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন বিএসএস চিফ লংফেলো। ‘মনে রাখবে, সবচেয়ে জরুরি কথা হচ্ছে: তোমরা পেশাদারী মনোভাব নিয়ে কাজ করবে।’

চট্ করে বসের দিকে তাকাল রানা। লালচে হয়ে গেছে মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের মুখ। কড়া চোখে ওর দিকে তাকালেন তিনি। দোষ যেন সব রানার।

আমি আবার কী করলাম, চেহারায় এমনই এক বেচারা ভাব ফুটিয়ে তুলল রানা।

দু’চোখের মণি চকচক করছে মিস্টার লংফেলোর।

‘একটা কারেকশন। তোমরা স্পেনে যাবে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে।’

‘এর কি কোন প্রয়োজন আছে?’ নিচু গলায় বলল রানা।

‘তোমরা এখন থেকে মিস্টার কিং ও মিসেস কিং। গত তিন বছর ধরে লিডসে বাস করছ। এতে মিশনে স্বস্তির সঙ্গে কাজ করতে পারবে মারিয়া। ‘

‘আমার এতে কোন সমস্যা নেই,’ বলল মারিয়া। ‘তবে মিশনে বড় কোন গোলমাল হয়ে গেলে, তখন গা বাঁচিয়ে স্পেন থেকে কীভাবে বেরোব, এ-ব্যাপারে কিছু ভেবেছেন?’ মিস্টার লংফেলোর দিকে তাকাল সে।

রানা চেয়ে আছে বিএসএস চিফের দিকে।

কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললেন রাহাত খান, ‘গ্রানাডায় আমাদের লোক আছে। তার বাড়ি রিসোর্ট থেকে গাড়িতে করে মাত্র আধঘণ্টা দূরে। এ-বিষয়ে ম্যালাগায় গেলে সবই জানাবে বার্টি এইচ. স্মিথ।’

‘বেশ, বলল রানা, ‘ওর কাছ থেকে জেনে নেব।’

‘পারতপক্ষে আমাদের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করবে না। যদি যোগাযোগ করতেই হয়, তো দেবে কোডেড মেসেজ বা এনক্রিপ করা কল। মাফিয়ার হাত স্পেনে অনেক লম্বা, তাই বাধ্য না হলে স্মার্টফোন ব্যবহার করবে না।’

মাথা দোলাল মারিয়া হ্যারল্ড। রানার দিকে তাকাল। নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল, ‘তো এই মিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিজেকে সঁপে দিলাম তোমার হাতে।’

এবার ব্রিফিং শেষ করা যাক,’ অস্বস্তি নিয়ে বললেন বিসিআই চিফ। ‘তোমরা হোটেলে ফিরে বিশ্রাম নাও।’

একবার তাঁর দিকে মাথা দুলিয়ে সিচুয়েশন রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা। করিডর ধরে পাঁচ কদম যেতেই টের পেল, পাথরের মেঝেতে হাই-হিলের খট খট শব্দ তুলে ওর পিছু পিছু আসছে ওর ‘সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী মারিয়া কিং!

.

হোটেল হিল্টনের তৃতীয়তলায় নিজেদের সুইটে শুয়ে আছে রানা। প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিল, কিন্তু হঠাৎ করে দুই কামরার মাঝের দরজায় ঠক-ঠক আওয়াজে চটকা ভেঙে গেল ওর।

‘কিছু বলবে?’ বিছানায় উঠে বসে জানতে চাইল রানা। ‘রানা!’ নিচু গলায় ডাকছে মারিয়া।

‘কী হয়েছে?’

‘জানালা দিয়ে দেখো!’

‘কী দেখব?’ দূতাবাসের ডিপ্লোমেটিক ব্যাগে করে আসা হোলস্টারে ভরা ওয়ালথার পিপিকে বেডপোস্টে ঝুলছে। ওটা হাতে নিয়ে জানালার একপাশে গিয়ে থামল রানা।

‘রাস্তার ওপরে চোখ বোলাও। গাড়িটার দিকে।’

দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পিস্তলের নল দিয়ে জানালার পর্দা সামান্য ফাঁক করল রানা। কয়েক তলা নিচে প্রায় অন্ধকার রাস্তা। গোটা ব্লকে একটা ক্যাডিলাক ছাড়া অন্য কোন যানবাহন নেই। ক্যাডিলাকের ড্রাইভারের সিটে এক লোক। কয়েক সেকেণ্ড পর রাস্তা পার হয়ে গাড়ির পাশে থামল আরেকজন। নিচু গলায় কী যেন বলছে ড্রাইভারকে। কথা শেষ করে উঠে পড়ল গাড়ির পেছন সিটে। রওনা হয়ে গেল ক্যাডিলাক। সামনে ডানে বাঁক নিল ওটা।

জানালা থেকে সরে সুইটের দুই কামরার মাঝের দরজায় টোকা দিল রানা। ‘তুমি কি কাউকে চিনতে পেরেছ?’

দরজা খুলল মারিয়া। ‘হ্যাঁ। যে-লোক ক্যাডিলাকে উঠল, আমাদের সুইটের জানালার দিকে চোখ ছিল তার। আজই এই হোটেলের লবিতে তাকে দেখেছি। হাতে চামড়ার ছোট একটা কেস। ওই যে, যেটার ভেতরে রাইফেলের স্কোপ রাখে। আর এই একই লোককে আগে দেখেছি ডালাস এয়ারপোর্টে।’

‘ঠিক আছে,’ অন্যমনস্কভাবে বলল রানা।

কয়েক সেকেণ্ড পর জানতে চাইল মারিয়া, ‘এবার?’

‘গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ো,’ বলল রানা। ‘অন্তত এটা বুঝলাম যে ওরা জানে, আমরা কোথায় উঠেছি।’

‘লোকটাকে ফলো করা গেলে…’

‘মারিয়া, লণ্ডন কিন্তু বড় শহর। এতক্ষণে তিন মাইল দূরে চলে গেছে।’

‘রানা…’

নিজের বেডের দিকে চলল রানা। ‘শুয়ে পড়ো, মারিয়া। ঘুমিয়ো স্বপ্নে দেখো স্বামীর সঙ্গে স্পেনে ফূর্তি করছ।’

বিড়বিড় করে কী যেন বলে দরজা আটকে দিল মেয়েটা। কয়েক সেকেণ্ড পর বেডের স্প্রিঙের ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ শুনতে পেল রানা। তারপর ওদিক থেকে আর কোন আওয়াজ এল না। জানালার পাশে চেয়ার টেনে ওটাতে বসল রানা। চেয়ে রইল নিচের রাস্তার দিকে।

রাত গভীর হলেও হামলা করতে এল না কেউ।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন