কাজী আনোয়ার হোসেন
রাগে থমথম করছে মাসুদ রানার মুখ। একবার ওকে দেখে নিয়ে আলমারির দরজা মেলে নিচের ড্রয়ার খুলল বার্টি এইচ. স্মিথ। ড্রয়ারের ভেতরে আছে চামড়ার কেস। সেটা থেকে হাতে নিল রেডিয়ো ট্র্যান্সমিটার। ওটা চিনল রানা। জাপানি যন্ত্রটা এতই শক্তিশালী, অনায়াসেই সংকেত দেয়া যাবে চাঁদে।
রাটন টিপে দিতেই সবুজ বাতি জ্বলল ট্র্যান্সমিটারের কন্সোলে। সেকেণ্ড পাঁচেক পর ট্র্যান্সমিশন স্ক্র্যাম্বল হতেই রানার হাতে যন্ত্রটা ধরিয়ে দিল বার্টি। নিচু গলায় বলল, ‘কথা বল তোর বসের সঙ্গে।’
সামনে ঝুঁকে বসল রানা। ‘স্যর, আমি।’
‘হ্যাঁ, বলো।’
‘নোবলম্যান খুন হয়ে গেছে।’
‘খুন হয়ে গেছে?’ চুপ হয়ে গেলেন রাহাত খান। কয়েক সেকেণ্ড পর গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কি শিয়োর?’
‘অর্ধেক মাথা উড়ে গেছে,’ বলল রানা। ‘মাফিয়ার লোক ভাল করেই জানত কোথায় আছে সে।’
‘আর নোবলম্যানের রক্ষিতা?’
‘সে আহত।’
‘ভাবছ আমাদের পক্ষ থেকে ইনফরমেশন লিক হয়েছে?’
‘আমি এখনও জানি না, স্যর।’
‘মারিয়া হ্যারল্ড এখনও হোটেলে আছে?’
‘থাকার তো কথা, স্যর। যদি না থাকে, সেক্ষেত্রে আমরা জানব কোথা থেকে লিক হয়েছে ইনফরমেশন।’
‘তুমি তা হলে হোটেলে গিয়ে দেখো সে আছে কি না।’
‘জী, স্যর।’ ট্র্যান্সমিটার অফ করে বার্টির দিকে তাকাল রানা।
‘মনে হয় না মারিয়া হ্যারল্ড বেঈমান,’ বলল ওর বন্ধু।
‘একটু পরে সেটা বুঝব। তুই সাবধানে থাকিস।’ পুরনো . বাড়িটা থেকে বেরিয়ে হনহন করে হেঁটে, হোটেলে ফিরল রানা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল তিনতলায়। নিজেদের সুইটের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল, ঘুম থেকে উঠেছে মারিয়া। পাশের ঘরে গুনগুন করে গান গাইছে। দু’ঘরের মাঝের দরজা এখন খোলা। হোলস্টার থেকে ওয়ালথার হাতে নিয়ে পাশের ঘরের দরজায় গিয়ে থামল রানা। নিচু গলায় ডাকল, ‘মারিয়া?’
‘ও, রানা? চলে এসেছ?’
‘ভুলে যেয়ো না যে আমি স্যামি কিং।’
‘ওহ্, সরি! সব ঠিক আছে তো?’
দরজার কোনা থেকে মেয়েটাকে দেখছে রানা। তার সঙ্গে অন্য কেউ নেই দেখে নিয়ে ঢুকল ঘরে। সুতির চমৎকার গাউন পরেছে মারিয়া। খুব দামি না হলেও দেখলে মনে হয় অভিজাত। ওর দিকে চেয়ে হাসল মেয়েটা। রানা বুঝে গেল, মোরেলি-হত্যার ব্যাপারে এখনও কিছুই জানে না মারিয়া।
‘তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত লাগছে, কিং।’
বেডের কোণে বসল রানা। জানালা দিয়ে আসা ম্যালাগার কড়া রোদে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে মারিয়ার মুখ। নিচু গলায় বলল রানা, ‘মোরেলি মারা গেছে।’
ফ্যাকাসে হয়ে গেল মেয়েটার মুখ। সত্যি অভিনয় করলে সেটা ভাল করেই বুঝত রানা। ফিযিওলজিস্টরা বলেন, আর্টারিয়াল সিস্টেম কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় না।
‘খুন হয়ে গেছে? তার নিজের ইয়টে?’
মাথা দোলাল রানা। ‘ওয়েট স্যুট পরা একজনের হাতে।’
‘আর মোরেলির সঙ্গের মেয়েটা?’
‘সে আহত হয়েছে। অবশ্য বাঁচবে। গোটা ব্যাপার সেট- আপ বলে মনে হচ্ছে আমার।’
‘তা হলে আমাদের এখন কী করা উচিত?’
‘অপেক্ষা করব,’ বলল রানা। ‘দেখি কী বলেন আমার বস্।’
ওর দিকে তাকাল মারিয়া। ‘মোরেলিকে যে-লোক খুন করেছে, তার চেহারা কি দেখতে পেয়েছ?’
‘আবছাভাবে।’
‘এনসেনাডায় যে স্নাইপার, আমাদের ওপরে গুলি চালিয়েছিল, তার সঙ্গে লোকটার চেহারার কোন মিল পেলে?’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘চেহারা দেখার সুযোগ পাইনি।’
‘লণ্ডনে যে-লোক হোটেলের কাছে ছিল, সেই একই লোক মোরেলিকে খুন করে থাকতে পারে বলে তোমার মনে হয়?’
‘হয়তো। খুনির পরনে ছিল ওয়েট স্যুট। যে-কেউ হতে পারে সে। তোমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী খুনি হলেও অবিশ্বাস করার কিছু নেই।’
রানার কথা পাত্তা দিল না মারিয়া। বেশ জোর দিয়েই বলল, ‘এ-ই সেই লোক, যে কি না এনসেনাডা থেকে ফলো করে এসেছে লণ্ডনে। তারপর হাজির হয়েছে ম্যালাগায়।’
‘হয়তো।’
‘আর কে হবে!’
চুপ করে আছে রানা। ওর সামনে এসে থামল মারিয়া। নিচু গলায় বলল, ‘শুনেছি তুমি দুনিয়ার পাঁচজন গুপ্তচরের একজন। তা হলে কীভাবে তুমি মোরেলিকে খুন হতে দিলে?’
মেয়েটার চোখে তাকাল রানা। এতই রেগে গেছে, ওর চেহারা থেকে যেন বেরোল রাগের আগুনের হলকা। ভয় পেয়ে দু’পা পিছিয়ে গেল মারিয়া। চাপা স্বরে বলল রানা,
এইমাত্র যা বললে, সেটা আর কখনও বলবে না।’
ফ্যাকাসে মুখে বলল মারিয়া, ‘সরি, আর এমন হবে না।’ পকেটে স্মার্টফোন বেজে উঠতেই ওটা বের করে স্ক্রিন দেখল রানা। কল রিসিভ করতেই ওদিক থেকে বলল বার্টি, ‘আমি। কথা হয়েছে এলিনা পার্কারসনের সঙ্গে।’
‘কী বলল?’
‘অ্যালকাযাবা থেকে সামান্য দূরে প্রাইভেট এক ক্লিনিকে তাকে নিয়ে গিয়ে রেখেছে গার্ডিয়া সিভিলের অফিসারেরা। যে ডাক্তার ওকে চিকিৎসা দিচ্ছে, সে আবার আমাদের ভাতা নিয়মিত পায়।’
‘গুড,’ বলল রানা।
‘মেয়েটার জ্ঞান ফিরেছে। এখন তোর সঙ্গে দেখা করতে চায়।’
দ্রুত ভাবল রানা। ‘ঠিক আছে। ক্লিনিকের ঠিকানা দে।
‘আমিই নিয়ে যাব তোকে।’
‘বেশ, বিশ মিনিট পর তা হলে লবিতে আছ। আরেকটা কথা, গার্ডিয়া সিভিল কীভাবে জানল কোন্ ক্লিনিকে তাকে নিয়ে যেতে হবে?’
হাসল বার্টি। ‘ওদেরও ক’জনকে ভাতা দিই আমরা।’
বিদায় নিয়ে স্মার্টফোন পকেটে রাখল রানা।
‘কে ফোন করেছিল? কী বলল?’ নিচু গলায় বলল মারিয়া। মোরেলি খুন হয়েছে সেটা এখনও হজম করতে পারেনি। এ থেকে রানা বুঝে গেল, গোপনে কোন অন্যায়ে জড়িয়ে যায়নি মারিয়া হ্যারল্ড।
‘সুস্থ হয়ে উঠছে মেয়েটা। একটু পর তার সঙ্গে দেখা করতে যাব।’
‘আর আমি? আমি যাব না?’
আপাতত মারিয়াকে চোখের আড়াল করবে না ভেবেছে রানা। নরম সুরেই বলল, ‘তুমিও আমার সঙ্গে যাবে।’
কথাটা শুনে সহজ, হলো মারিয়া। ঠোঁটে ফুটল হাসি। ‘ভাল হলো। ভাবছিলাম আমাকে দল থেকে বাদ দিয়ে দেবে কি না। সত্যি বলতে এসপিয়োনাজের কিছুই তো জানি না। শুধু জানি, কোন্ ধরনের পথে ড্রাগ্স্ পাচার হয়।
‘তুমি এখন থেকে খুব সতর্ক থেকো,’ বলল রানা।
কেন যেন লজ্জায় লালচে হলো মারিয়ার দু’গাল। বিড়বিড় করে বলল, ‘অবশ্যই সতর্ক থাকব।’
পনেরো মিনিট পর লবিতে নেমে এল ওরা। ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে বার্টি। হোটেল থেকে বেরিয়ে ফিয়াট ৫০০ গাড়িতে চাপল ওরা। ড্রাইভ করল বার্টি। জানিয়ে দিল, যে প্রাইভেট ক্লিনিকে এলিনা পার্কারসনকে রাখা হয়েছে, ওটা বেশি দূরে নয়। রানাকে নিজের দিকে আকর্ষিত করতে বার্টির সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছে মারিয়া। যদিও সেটা বুঝেও যেন কিছুই বুঝল না রানা। ডুবে গেল চিন্তার সাগরে।
প্রথমে এনসেনাডায় ওদের ওপরে হামলা করেছে এক স্নাইপার। এরপর লণ্ডনে ওদের হোটেলের ওপরে চোখ রাখল কেউ। তাতে ওর বোঝা উচিত ছিল, মোরেলিকে খুন করতে হয়তো পাঠিয়ে দেয়া হবে আততায়ী। এখন নিজেকে দোষ দিচ্ছে রানা। কেন ধরে নিল মারিয়া আর ওকে খুন করতেই ফাঁদ পেতেছে তারা? অথচ, বড় টার্গেট তো আসলে ছিল রোমিয়ো মোরেলি। ওর গাফিলতির কারণেই খুন হয়ে গেছে লোকটা!
বাঁক নিয়ে রাস্তার ধারে গাড়ি রাখল বার্টি। দরজা খুলে নেমে পড়ল ওরা। চারদিকের বাড়িঘরের মাঝে সরু এক গলিতে সূর্যের আলো থেকে চিরকালীন ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছে চারতলা প্রাইভেট ক্লিনিক। ভেতরে ডেটলের কড়া গন্ধ। মেঝে ও চারদেয়াল ঝকঝকে তকতকে। ম্যালাগার নোংরা সব বস্তি থেকে একেবারেই আলাদা। এখানে বোধহয় চিকিৎসা নিতে আসে স্পেনের সমাজের উঁচু পর্যায়ের সব মানুষ।
রিসেপশন রুমের একদিকে মার্বেলের তৈরি ঘোরানো চওড়া সিঁড়ি। ওটা বেয়ে ওপরে রওনা দিতেই বার্টির পিছু নিল হাতির নিতম্বের মত বিশাল পাছার সাদা ইউনিফর্ম পরা বয়স্কা এক মহিলা নার্স। নিচু গলায় বলল, তাদের রোগিণী আগের চেয়ে এখন অনেক ভাল আছে।
তৃতীয়তলায় উঠে করিডর ধরে এগোল ওরা। একটু যেতেই খোলা এক দরজার সামনে দেখা গেল চিকন এক লোককে। তার পরনে বিযিনেস স্যুট। গলায় কালো টাই। বার্টির দিকে চেয়ে এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত বিশাল এক হাসি দিল সে। ‘আসুন, আসুন, মিস্টার স্মিথ! আমাদের কী পরম সৌভাগ্য যে আপনি নিজেই চলে এসেছেন!’
‘আমাদের রোগিণী এখন কেমন আছে?’ বলল বার্টি।
পেটের ওপরে দু’হাত জড় করল ডাক্তার গঞ্জালেস। বড় করে শ্বাস নিয়ে কী যেন ভেবে নিল, তারপর নিচু গলায় বলল, ‘আপনারা তো জানেন ওটা বুলেটের ক্ষত। এক্ষেত্রে মাঝে মাঝে রক্ত-প্রবাহে সেপসিস হয়। ওটা ভয়ঙ্কর ধরনের বিষ।’ কথাগুলো এখন বলছে রানার দিকে চেয়ে। ধরে নিয়েছে এই দলে ও-ই সবচেয়ে বড় মূর্খ। ‘সেটা যদি না হয়, আমার ধারণা বিশ্রামের সময় দিলে একেবারে সুস্থ হয়ে উঠবে মেয়েটা।’
‘কতদিন বিশ্রাম নিতে হবে ওর?’ জানতে চাইল রানা।
কী যেন ভেবে নিয়ে বলল ডাক্তার, ‘বেশ কয়েক দিন।’
‘তার মানে ক্ষতটা অত সিরিয়াস নয়,’ বলল রানা।
চকচক করে উঠল গঞ্জালেসের দু’চোখ। পরক্ষণে দুশ্চিন্তা ভরা ম্লান হাসি দিল সে। ‘বিষয়টা বেশ সিরিয়াস, সেনোর কিং। তবে স্রষ্টা চাইলে তাকে সুস্থ করে দিতে পারেন।
ডাক্তার যে আপাতত এলিনাকে ক্লিনিক থেকে ছেড়ে দেবে না, সেটা বুঝে গেছে রানা। নিজেও জানে, বুলেটের ক্ষত কখনও কখনও হয়ে ওঠে মারাত্মক। সেক্ষেত্রে সামান্য ক্ষতের ঘা থেকে মারা যেতে পারে রোগী।
‘ভাল দিক হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে রোগিণীকে এই ক্লিনিকে নিয়ে আসা হয়েছে,’ বলল ডাক্তার গঞ্জালেস। ‘প্রায় শকের ভেতরে চলে গিয়েছিল। ওটা হলে পরিণতি আরও খারাপ হতো।’
মাথা দোলাল রানা। ‘আমরা কি এখন ওর সঙ্গে কথা বলতে পারব?’
‘অবশ্যই পারবেন!’ বার্টির দিকে হাতের ইশারা করে খোলা দরজা দেখাল ডাক্তার। ‘প্রিয়, আসুন আপনারা।’
দরজা পেরিয়ে বড় এক ঘরে ঢুকল রানা ও বার্টি। ওদের পেছনে মারিয়া, ডাক্তার গঞ্জালেস ও মোটা মহিলা নার্স। ঘরের মাঝে আছে হাসপাতালের আধুনিক একটি বেড। সরিয়ে দেয়া হয়েছে চারদিকের পর্দা। বেডের পাশের ছোট্ট টেবিলে জ্বলছে ল্যাম্প। ব্ল্যাঙ্কেট দিয়ে ঢাকা এলিনা পার্কারসনের বুক। কাঁধে ও বুকের ওপরের অংশে পুরু ব্যাণ্ডেজ। চোখ বুজে শুয়ে আছে অপরূপা মেয়েটা। বালিশে এলিয়ে পড়েছে সোনালি একরাশ চুল। সেজন্যে ওকে দেখাচ্ছে ঘুমন্ত কোন পরীর মত।
ঘরে কেউ ঢুকেছে সেটা বুঝে চোখ মেলে পায়ের দিকে তাকাল এলিনা। রানার মুখের ওপরে স্থির হলো ওর দৃষ্টি। দুর্বল সুরে বলল, ‘মিস্টার কিং।’
এক পা এগোল রানা। ‘তুমি সুস্থ হয়ে উঠছ, সেটা দেখে খুশি হলাম।’
ক্লান্ত হাসল মেয়েটা। ‘আসলে… কী যে হয়ে গেল…’ এলিনার চোখ বেয়ে টপটপ করে নেমেছে অশ্রু।
অদ্ভুত সুন্দরী মেয়েটার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। ‘এলিনা, জানি, খুব বাজে একটা ঘটনা ঘটেছে। তুমি কি এ- বিষয়ে আমাকে কিছু বলতে চাও?’
‘আমি… আসলে খুব লজ্জিত,’ ফিসফিস করল এলিনা। চোখে কেন যেন করুণা প্রার্থনার দৃষ্টি।
ঘুরে অন্যদের দিকে তাকাল রানা। ‘ঠিক আছে, তোমরা ঘরের বাইরে যাও। আমি ওর সঙ্গে একা কথা বলতে চাই।’
‘আমিও থাকব, একটু জোর দিয়ে বলল মারিয়া।
ইংরেজ মেয়েটার চোখে তাকাল রানা। দু’সেকেণ্ড পর বলল, ‘বেশ। তুমি থাকো। তবে অন্যেরা চলে যাক।’
ঘর ছেড়ে করিডরে গেল সাদা ইউনিফর্ম পরা নার্স, বার্টি এবং ডাক্তার গঞ্জালেস। পেছনে দরজাটা ভিড়িয়ে দিল বার্টি।
এলিনার হাত আলতো করে ধরল রানা। ‘কী বলতে আমাকে ডেকেছ, এলিনা? কী কারণে লজ্জিত বোধ করছ?’
রানার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল এলিনা। দুর্বল স্বরে বলল, ‘আমরা আসলে চালাকি করেছি। যেটা উচিত হয়নি।’
‘কী ধরনের চালাকি?’ নিচু স্বরে জানতে চাইল মারিয়া।
চুপ করে থাকল এলিনা। চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে।
‘আমাকে খুলে বলো, এলিনা,’ নরম স্বরে বলল রানা।
‘বুদ্ধিটা ছিল মোরেলির। ভয়ের ভেতরে ছিল সে। ভাবছিল যে-কোন সময়ে ওকে খুন করবে যে-কেউ।’
‘ওর ওপরে হামলা হবে সেটা এত নিশ্চিত ছিল কেন?’ জানতে চাইল রানা।
‘আগেও তো কয়েকবার হামলা করা হয়েছে ওর ওপরে।’
‘ঠিক আছে, বুঝলাম যে সে ধারণা করেছিল স্পেনে এলে তার ওপরে হামলা হবে। কিন্তু সেটা কি আমাদের সঙ্গে তার মিটিং হবে, সেজন্যে?’
‘হ্যাঁ,’ ফিসফিস করে বলল এলিনা।
‘মোরেলি যদি আগেই জানত আক্ৰমণ হবে, সেক্ষেত্রে জেনে-বুঝে ফাঁদে পা দিল কেন?’
‘ফাঁদে পা দেয়নি তো,’ বলল এলিনা। ‘কোন ঝুঁকিও নেয়নি। আমি সেটাই বলতে চাইছি।’
চট করে মারিয়ার দিকে তাকাল রানা। ওর মনের ভেতরে বিদ্যুতের গতিতে খেলে গেছে একটা চিন্তা। আগের চেয়ে জোরে এলিনার কবজি ধরল ও। ‘ঠিক আছে, প্রথম থেকে সব খুলে বলো।’
‘ইয়টে আসলে মোরেলি ছিলই না,’ লজ্জা নিয়ে রানার দিকে তাকাল এলিনা।
অবাক হয়নি রানা। সহজ সুরে বলল, ‘তা-ই?’
‘হ্যাঁ। তুমি যার সঙ্গে ইয়টে গিয়ে কথা বললে, সে আসলে মোরেলি নয়। সে ছিল ওর বহু বছরের পুরনো বন্ধু বাস্তিলো দে ভ্যানারি। সিসিলির লোক।’
‘আর মোরেলি? সে ইয়টে তা হলে ছিল না?’
‘না, ছিল না। আগেই চলে গেছে সিয়েরা নেভাডায়। কথা ছিল ইয়টে মিটিং হওয়ার পর ওকে আমরা জানাব, তোমরা স্কি রিসোর্টে যাবে। প্রথম সাক্ষাৎকার ছিল তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্যে। নিজের ডাবলকে ইয়টে রেখেছিল মোরেলি।’
‘আর সে-লোক খুন হয়ে গেছে,’ আনমনে বলল মারিয়া।
করুণ চোখে রানার চোখে তাকাল এলিনা। ‘ঘটনা তা-ই।’
রানার পাশে এসে দাঁড়াল মারিয়া। কড়া গলায় বলল, ‘তুমি যে আসলে মিথ্যা বলছ, সেটা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি।’
ভয় পেয়ে কনুইয়ের জোরে উঠে বসল এলিনা। শুকিয়ে গেছে সুন্দর মুখ। ‘এভাবে বলছেন কেন? আমি তো মিথ্যা বলছি না!’
‘মিথ্যাই বলেছ তুমি!’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল মারিয়া। ‘রোমিয়ো মোরেলি মারা গেছে! আর তুমি আমাদের কাছে নকল তথ্য বিক্রি করতে চাইছ। সেটাই তোমার উদ্দেশ্য।
‘কথাটা ঠিক নয়!’ ঘামছে এলিনা। ‘শপথ করে বলছি!’
‘আমি কোনভাবেই তোমার বলা কোন মিথ্যা কথা বিশ্বাস করব না,’ জোর দিয়ে বলল মারিয়া।
‘মোরেলি এখন সিয়েরা নেভাডায়,’ ঢোক গিলল এলিনা। ‘ভ্যালেন্সিয়ায় ওকে ইয়ট থেকে নামিয়ে দিয়েছি আমরা। আমি তার প্রমাণ দিতে পারব।’
‘কীভাবে সেটা প্রমাণ করবে?’
‘আ… আমি…’ বারকয়েক ফুঁপিয়ে উঠল এলিনা। অসহায় চোখে তাকাল রানার চোখে।
‘কী করে প্রমাণ দেবে?’ এলিনার বাহু স্পর্শ করল মারিয়া। ‘এসব মিথ্যা কথা বলে কিন্তু রেহাই পাবে না!’
বুলেটের ক্ষতে টান পড়তেই গুঙিয়ে উঠল এলিনা। চোখ বেয়ে দরদর করে ঝরছে অশ্রু। ফুঁপিয়ে উঠে বলল, ‘আমি মিথ্যা বলছি না! ভালভাবেই বেঁচে আছে মোরেলি! বিশ্বাস না হলে ভ্যালেন্সিয়ার রেকর্ড দেখুন। ওখানে ইয়ট থেকে নেমে গেছে মোরেলি!’
সোজা হয়ে এক পা পিছিয়ে গেল মারিয়া। চোখ সরু করে দেখছে এলিনাকে। কয়েক সেকেণ্ড পর রানার দিকে তাকাল। ‘এই মেয়ে সত্যি বলছে কি না, সেটা আমরা রেকর্ড দেখে জেনে নিতে পারব।’
মারিয়ার সাহস ও দৃঢ়তার জন্যে মনে মনে ওর প্রশংসা করছে রানা। পরস্পরকে আরেকবার দেখে নিল ওরা। এটা এখন জানা গেছে, সত্যিই মৃত্যু হয়নি মোরেলির।
‘সে এখন কোথায় আছে?’ জানতে চাইল রানা।
মুখ আরও শুকিয়ে গেছে এলিনার। ‘আমি তো বলেছি। সিয়েরা নেভাডায়।’
‘কিন্তু…’
‘মোরেলি আমাকে জানিয়ে দেবে তোমাদের সঙ্গে কোথায় দেখা করবে সে।’
‘ছদ্ম-পরিচয়ে রিসোর্টে আছে সে?’
ঘন ঘন মাথা দোলাল এলিনা। ‘হ্যাঁ! আমি মিথ্যা বলছি না! ইয়টের গোটা ব্যাপারটার জন্যে আমি দুঃখিত।’
‘সত্যিই দুঃখিত হওয়া উচিত তোমার,’ বিরক্তি চেপে বলল রানা।
‘তোমরা তো রিসোর্টে ওর সঙ্গে দেখা করবে, তা-ই না?’
‘মোটেও না,’ সরাসরি জানিয়ে দিল রানা।
‘দেখা করবে না?’ ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেল এলিনা।
‘কেন ঝুঁকি নেব?’
‘তা…. তা হলে তো….’ ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করেছে
মেয়েটা। ‘ও… ও যে… তা হলে আমাকে খুন করবে?’
‘আমারও তা-ই ধারণা,’ সহজ সুরে বলল রানা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন