ব্ল্যাক লিস্ট – ১

কাজী আনোয়ার হোসেন

এক

বহুদিন ধরে দেশে ফিরতে আনচান করছিল মাসুদ রানার মন। আর এবার বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের জরুরি তলব পেয়ে গতকাল বিকেলে আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে এসেছে ও।

আজ ভোরে বসের ফোন পেয়ে গুলশানের একতলা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে বিশ্রী এক বিশাল জ্যাম ঠেলে কমাণ্ডোদের নিয়ম অনুযায়ী মিটিঙের নির্ধারিত সময়ের ঠিক পাঁচ মিনিট আগে আটটা পঞ্চান্ন মিনিটে হাজির হয়ে গেছে মতিঝিলে বিসিআই হেডকোয়ার্টারে। এরপর লিফটে চেপে ছয়তলায় উঠে জানল, এইমাত্র অফিসে পা রেখেছেন বিসিআই চিফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর সোহেল আহমেদ।

ব্যাটার সঙ্গে এখন আড্ডা দেয়ার উপায় নেই, ভাবতে ভাবতে সিঁড়ি বেয়ে সাততলায় উঠে এল। আর তখনই মনে মনে মস্তবড় এক হোঁচট খেল রানা। বুড়োর নতুন প্রাইভেট সেক্রেটারি রূপসী পপি সুলতানা সত্যিই যেন শিশিরস্নাত তাজা এক শ্বেত-গোলাপ! অবশ্য তার সামনে না থেমে রোমান্টিক এক ফ্লাইয়িং কিস তাকে পাঠিয়ে দিয়ে সোজা ঢুকে পড়ল রানা বৃদ্ধ বাঘের গুহায়। নিঃশব্দে চেয়ার টেনে বসতেই সরু এক লাল ফাইল ওর দিকে ঠেলে দিলেন বিসিআই চিফ। মৃদু খুক-খুক করে কেশে উঠে শুকনো গলায় বললেন, ‘মন দিয়ে পড়ো।’

পাক্কা দশ মিনিট গভীর মনোযোগে ফাইল ঘাঁটল রানা। তারপর কাগজ থেকে চোখ তুলে তাকাল বসের দিকে। ‘স্যর, তার মানে আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোন তথ্য সরাতে পারেনি কর্নেল হাকিমুল রাজা।’

ধীরে ধীরে মাথা দোলালেন বিসিআই চিফ। ‘আগেই সন্দেহ করা হয়েছিল স্বরাষ্ট্র সহকারী সচিব জলিল হায়দার চৌধুরীকে। তাই তার কমপিউটারে ছিল বাতিল করে দেয়া কিছু বাজে ডকুমেন্ট। গত পরশু রাতে হাকিমুল রাজার দাওয়াতে গিয়ে সায়ানাইড মেশানো খাবার খেয়ে খুন হয়ে গেছে বিশ্বাসঘাতকটা।’

‘অর্থাৎ, মিশন ব্যর্থ হয়ে গেছে পিসিআই-এর।’

দূরের দেয়ালে চোখ রাখলেন বিসিআই চিফ। ‘তা বলা যায় না। আমি নিজেও মস্ত সর ভুল করে বসেছি।’

চুপ করে তাঁর দিকে চেয়ে রইল রানা।

‘তোমরা সিনিয়ররা দেশে ছিলে না, তাই পিসিআই-এর সেরা অপারেটর হাকিমুল রাজাকে বন্দি করার নির্দেশ দিয়েছি জসিম ও রেজাউলকে।’ চুপ হয়ে গেলেন বৃদ্ধ। থমথম করছে তাঁর গম্ভীর মুখ।

কু ডাকছে রানার মন। পিসিআই এজেন্ট কর্নেল হাকিমুল রাজা পৃথিবীর দুর্ধর্ষ পাঁচজন স্পাইয়ের একজন।

‘জসিম আর রেজাউল পরশু রাতেই মারা গেছে,’ চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন বিসিআই চিফ। ‘ওদের মৃত্যুর দায় আমি এড়াতে পারি না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর মুখ খুলল রানা, ‘ওদের তো, স্যর, সব ধরনের ট্রেইনিং ছিল।

‘হ্যাঁ, তা ছিল।’ মৃদু মাথা দোলালেন রাহাত খান। কী যেন ভাবতে শুরু করেছেন। একটু পর মুখ তুলে রানাকে দেখলেন। ‘তবে তুমি হয়তো বুঝতে পারছ না, রানা, আমার আসলে উচিত ছিল আরও অনেক বেশি সতর্ক হওয়া। গুলশান দুই-এ পিসিআই-এর সেফহাউসে তখন ছিল একাধিক দক্ষ খুনি। অথচ, জসিম বা রেজাউলকে যথেষ্ট সতর্ক করিনি। এ-ছাড়াও বেশকিছু বিষয়ে মারাত্মক সব ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

বস্ আরও কিছু বলবেন বলে অপেক্ষা করছে রানা।

‘তথ্য ও তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে ধারণা করা হচ্ছে, অমানুষিক নির্যাতনকারী পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠীর চরম নির্যাতন, অত্যাচার ও অনাচারে আগামী এক যুগের ভেতরে কয়েক টুকরো হবে গোটা পাকিস্তান,’ বললেন রাহাত খান। ‘তুমি তো জানো, দেশটির ট্র্যাডিশনাল সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ নির্ভরশীল পাঞ্জাবি আর্মি অফিসারদের ওপরে। এবং তাদেরই পা-চাটা হাজার হাজার সরকারি আমলা ও একদল দুর্নীতি-পরায়ণ রাজনৈতিক নেতা মিলে ভয়ানক বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছে বালোচিস্তান ও অন্যান্য সব প্রদেশে। …এরফলে আমরা যেন পরে সেসব এলাকার ফুঁসে ওঠা নেতৃত্বের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে পারি, সেজন্যে বিসিআই থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছিল জরুরি পলিটিকাল আর ইকোনমিকাল ডেটা। এ-ছাড়া . বিসিআই এজেন্টদের আরেকটি জরুরি দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকারের তৈরি নতুন নীল- নকশা সংগ্রহ করা। ইসলামাবাদে এ-কাজে ব্যস্ত ছিল সবমিলিয়ে আমাদের পাঁচজন তরুণ প্রতিভাবান ছেলে। কিন্তু গত ক’দিন আগে সতর্ক হয়ে ওঠে পিসিআই। তাদের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রথম সুযোগে তারা নিশ্চিহ্ন করে দেবে বিসিআই এজেন্টদেরকে। এবং সেই কাজ দেয়া হয় কর্নেল হাকিমুল রাজাকে।’ ঠোঁটে পুরু এক কালো হাভানা চুরুট গুঁজে রানার উপহার দেয়া রনসন লাইটার দিয়ে ওটাতে আগুন দিলেন বৃদ্ধ। ‘চারদিন আগে ইসলামাবাদে হাকিমুল রাজার দলের হাতে খুন হয়েছে আমাদের সেই পাঁচ এজেন্ট। অথচ আমরা আমাদের ছেলেদের নির্মম মৃত্যুর জন্যে কোন ধরনের বদলা নিতে পারিনি। বা বলতে পারো খুঁজেই পাইনি, হাকিমুল রাজা বা তার দলের খুনিদেরকে। রানা, এ-দায় তো আসলে আমারই।’

চাপা শ্বাস ফেলল রানা। ‘স্যর, হাকিমুল রাজা দুনিয়ার প্রথম সারির গুপ্তচরদের একজন। আমরা অসতর্ক হয়ে খুন হয়ে গেলে আপনি তো সেজন্যে দায়ী হতে পারেন না।’

চুরুটে টান দিয়ে ছাতের দিকে একরাশ নীলচে ধোঁয়া পাঠালেন বৃদ্ধ। ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। ‘ঠিক করেছি, এবার দেরি না করে দেখা করব আমাদের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। আমি আসলে বুঝে গেছি, আমার সময় হয়ে গেছে অবসরে যাওয়ার। বিসিআই-এর নেতৃত্বে নতুন রক্ত এলে আমার চেয়ে ঢের ভালভাবে এই সংগঠন চালাতে পারবে সে।’

‘প্রথমে ভুলও করবে প্রচুর,’ ঢোক গিলল রানা। ‘ফলে নানা দেশে ভয়ানক সব বিপদে পড়বে আমাদের এজেন্টরা

‘আমার তা মনে হয় না; গম্ভীর চেহারায় রানাকে দেখলেন বিসিআই চিফ। ‘প্রধান উপদেষ্টার কাছে তোমার কথাই জানাব।’

আরও বড় একটা ঢোক গিলল রানা। ‘কিন্তু, স্যর…’

‘আসলে, রানা, এ-ছাড়া আর কোন উপায়ও তো নেই,’ বললেন (অব.) মেজর জেনারেল। ‘আশা করি বিসিআই চিফের দায়িত্ব তুমি নিজের কাঁধে তুলে নেবে। আমি যখন পাকিস্তানে বন্দি ছিলাম, তখনও তো ভাঙা এই বিসিআই তুমিই গড়ে তুলেছিলে।’ আবারও কিছুক্ষণ কী যেন ভাবলেন রাহাত খান। তারপর নরম সুরে বললেন, ‘আসলে বুড়ো হয়ে গেছি, রানা। অনেক ধরনের ভুল করে বসেছি। এরপর হয়তো আরও বড় কোন ভুল করব, আর যেজন্যে মনে হবে আমার উচিত নিজের মৃত্যুকে ডেকে আনা।’

‘স্যর, দয়া করে এখনই এ-ধরনের কোন সিদ্ধান্ত নেবেন না,’ অনুরোধের সুরে বলল রানা। ‘আমরা আপনার কাছে মাত্র কয়েকটা দিন সময় চাইছি।’

‘সে-সময় পেলে তোমরা কী করবে, রানা?’ গম্ভীর সুরে বললেন বিসিআই চিফ।

‘আমরা বিসিআই থেকে প্রতিশোধ নেব। কর্নেল হাকিমুল রাজা আর তার দলের সবাইকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে খুঁজে বের করব। এরপরেও যদি আপনার মনে হয় অবসরে যাবেন, তখন আমরা কোন আপত্তি তুলব না।’

রানার পেছনে সাদা দেয়ালে চোখ রাখলেন রাহাত খান। একটু পর মৃদু মাথা দোলালেন। ‘বেশ, আমি না হয় আরও কয়েকটা দিন অফিসে এলাম।’

মরা কাঠের মত শুকিয়ে গেছে রানার গলা। ভীষণ কষ্টে চুরচুর হয়ে ভাঙছে বুকের পাঁজর। ছলছল করছে দু’চোখ। চট্‌ করে অন্যদিকে তাকাল। চাইছে না কট্টর বুড়ো দেখে ফেলুক ওর চোখের অসহায় অশ্রু। ‘আশা করি, স্যর, এই ক’দিনের ভেতরে ভাল কোন সংবাদ আমরা আপনাকে দিতে পারব।’

নির্বাক হয়ে বসে আছেন বিসিআই চিফ

‘তা হলে আমি আসি, স্যর,’ বলে চিফের অফিস থেকে বেরিয়ে এল রানা। এখন আর মনে নেই সুন্দরী পপির কথা।

অধ্যায় ১ / ১৯

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন