কাজী আনোয়ার হোসেন
টিলা টপকে ম্যালাগা বন্দর-নগরীর সামান্য দূরে কোস্তা দেল সোল এয়ারপোর্টের রানওয়েতে নামল ব্রিটিশ এয়ারওয়েইযের রাজহংসীর মত সাদা রঙের এ৩৩০-৩০০ বিমান। পরের দশ মিনিটে ব্যাগেজ সংগ্রহ করে কাস্টম্স্ ও ইমিগ্রেশন এরিয়া পেরিয়ে টার্মিনাল থেকে বেরিয়ে এল রানা ও মারিয়া। আগেই ওদের বলা হয়েছে, বাইরে অপেক্ষা করবে বিএসএস-এর নীল রঙের ছোট এক ফিয়াট ৫০০ গাড়ি।
বিসিআই ও বিএসএস-এর যৌথ খরচে সুইট বুক করা হয়েছে এসি ম্যালাগা প্যালাসিয়ো হোটেলে।
কিছুক্ষণ পর হোটেলের রেজিস্ট্রি খাতায় ওদের পাসপোর্ট দেখে জরুরি তথ্য টুকে নিল ক্লার্ক। এরপর নিজেদের নকল নাম সই করে তিনতলায় ওদের সুইটে ঢুকল রানা ও মারিয়া।
কামরার চওড়া জানালা দিয়ে দেখা গেল মালাগা বন্দর। সুনীল জলের অপূর্ব সুন্দর মেরিনায় নোঙর করেছে নানান আকারের বাণিজ্যিক জাহাজ ও প্রমোদতরী।
সুইটের দ্বিতীয় কামরা দখল করল মারিয়া। দু’ঘরের মাঝের দরজা আটকে দেয়ার আগে বলল, ‘লম্বা জার্নি, তাই খুব ক্লান্তি লাগছে। শাওয়ার নেয়ার পর ঘণ্টাখানেক ঘুমিয়ে নেব।’
‘বেশ,’ খুশিমনে বলল রানা। সুইট থেকে বেরিয়ে মেইন ডোর লক করে নেমে এল নিচে। লবি পেরিয়ে রাস্তায় বের হয়ে এক ব্লক যেতেই পথের কোণে একতলা এক বাড়ির গেটে দেখতে পেল রঙচটা এক সাইনবোর্ড:
ড্রিম্স্ কনস্ট্রাকশন কোম্পানি
ডিরেক্টর বার্টি এইচ. স্মিথ।
আঙুলের গাঁট দিয়ে বাড়ির দরজায় ঠক-ঠক করে টোকা দিল রানা। তাতে স্প্যানিশ ভাষায় ভেতর থেকে কে যেন বলল, ‘কে আপনি?’
‘সেনোর স্যামি কিং
‘তা-ই নাকি?’ আধমিনিট পর খুলে গেল বাড়ির দরজা। কবাট জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের মত উঁচু বাৰ্টি .এইচ. স্মিথ।
‘কী খবর তোর, বার্টি?’ জানতে চাইল রানা।
‘আরে শালা! কতদিন পর তোর চাঁদমুখ দেখলাম!’ এক পা এসে গ্রিযলি ভালুকের মত প্রিয় বন্ধুকে জাপটে ধরল বার্টি।
হাঁসফাঁস লেগে উঠতেই ধমকে উঠল রানা, ‘অ্যাই, ছাড় বলছি! নইলে কিন্তু হাঁটু তুলে জায়গামত গুঁতো দেব!’
ওর কথা শুনে ঝড়ের বেগে দু’পা পিছিয়ে গেল বার্টি এইচ. স্মিথ। ‘ভয় দেখাস্ ক্যান! আয়, ভেতরে আয়।’
বন্ধু করিডরে ঢুকতেই দরজা আটকে ঘুরে এগোল বাটি, -পেছনে রানা। ডানের দরজা গলে বড় এক ঘরে ঢুকল ওরা। চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল রানা। ঘরের একদিকে চল্টা ওঠা ছোট ডেস্ক ও পেছনে আর্মচেয়ার। ডেস্কের সামনে কাঠের দুটো খটখটে চেয়ার। পাশে ফাইল রাখার কাঠের পুরনো এক আলমারি। একদিকে সরু দরজা। ওদিকে ওয়াশরুম। ঘরে আর কোন আসবাবপত্র নেই। ডেস্কের পেছনের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে ম্যালাগা বন্দরের অপূর্ব সুন্দর দৃশ্য।
রানার পিঠে মাঝারি আকারের এক চাপড় বসাল বার্টি এইচ. স্মিথ। বহু দিন পর দেখা, কী বলিস, দোস্ত! ইতালির সেই ঘটনার পর থেকে যে ডুব দিলি, আর দেখা পেলাম না!’
কয়েক বছর আগের একটা ঘটনা মনে পড়ল রানার।
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক বোমার উপাত্ত সংগ্রহ করছিল বার্টি। দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে এক হোটেলে খুন হয়ে যেত। কিন্তু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওর হোটেলে হাজির হয় রানা। রুম থেকে বন্ধুকে বের করে সোজা নিয়ে তোলে নিজের গাড়িতে। রওনা হয়ে বলে, ‘একটু আগে জানলাম, উবে গেছে তোর কাভার। উত্তর কোরিয়ান সিক্রেট সার্ভিস টিমের কয়েকজন এজেন্ট আসছে তোকে খুন করতে।’
এ-ঘটনার আধঘণ্টা পর রেডিয়োতে ওরা শুনল, কারা যেন ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে সেই হোটেলের বারোজন গেস্ট ও সাতজন কর্মচারীকে।
সাহায্য পেয়ে রানার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল বার্টি। এরপর ডার্ক মেডিউসা* (রানা ৪৬০ দ্রষ্টব্য) পর্ব শেষ হলে ইতালিতে নির্জন এক হোটেলে উঠেছিল রানা ও ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের নোরা গোল্ডফিল্ড।
দারুণ কাটছিল ওদের সময়। কিন্তু পঞ্চম দিনে এল বিসিআই চিফ মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের ফোন। তিনি বললেন: আত্মহত্যা করার আগে অস্থায়ী ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্স চিফ জ্যারেট যোগাযোগ করেছে ঘনিষ্ঠ ক’জন স্যাঙাতের সঙ্গে। তাদেরকে বলেছে—তোমাদের উচিত পৃথিবী থেকে মাসুদ রানাকে সরিয়ে দেয়া। নইলে তোমাদেরকেও ছাড়বে না সে। সেক্ষেত্রে খুন হবে, রাধ্য হবে আত্মহত্যা করতে, অথবা বহু বছরের জন্যে পচে মরবে জেলে। সুতরাং, নিজ স্বার্থে তোমাদের উচিত তাকে খুন করা।
বিসিআই চিফ আরও জানান: ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস চিফ মার্ভিন লংফেলো হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেই তিনি জোর দাবি জানাবেন, যেন রানার পেছনে লেলিয়ে দেয়া মৃত্যুদূত ব্রিটিশ এজেন্টদেরকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। তবে আপাতত ওর উচিত আত্মগোপন করা।
সেদিনই নোরাকে আমেরিকাগামী বিয়ানে তুলে হোটেলে ফিরতেই লবির তিনদিক থেকে এল ওর ওপরে হামলা। গোলাগুলির সময় খুন হলো চারজন ব্রিটিশ এজেন্ট। অন্য দু’জনকে ফাঁকি দিয়ে গোপনে সীমান্ত পেরিয়ে ফ্রান্সের পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ল আহত রানা।
এদিকে ওর পিছু নিল সেই দুই ব্রিটিশ এজেন্ট। যদিও তাদের সঙ্গে দেখা হয়নি রানার। কারণ বন্ধুর প্রতি ভালবাসা, কৃতজ্ঞতাবোধ আর বিএসএস-এর চিফের নির্দেশে অসৎ দুই ব্রিটিশ এজেন্টকে প্রথম সুযোগে খতম করে দেয় বার্টি।;
‘সত্যিই বহু দিন পর আবার দেখা,’ পিঠে বার্টির আরেক চাপড় খেয়ে স্বীকার করল রানা।
‘চিফ লংফেলো বলেছেন তুই আসবি।’ আলমারি খুলে হোলস্টার আর ওয়ালথার পিপিকে রানার হাতে ধরিয়ে দিল বার্টি। ‘বিসিআই থেকে দিয়ে গেছে।’ এবার আলমারি থেকে
ডাব্লিউ-ডাব্লিউ টু বশ অ্যাণ্ড লম্ব্ ৭X৫০ এমকে ৪১ ওয়াইড ফিল্ড অ্যাঙ্গেলের বিনকিউলার। আনমনে বুঝতে চাইল ওটার ওজন। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘মনে হয় তোর একটা খবর জানা উচিত।’
‘কী সেটা?’ কৌতূহলী চোখে বন্ধুকে দেখল রানা।
চোখে বিনকিউলার তুলে বন্দরের দিকে তাকাল বার্টি। রানা বুঝে গেল, ও যখন এল, এই বিনকিউলার দিয়ে বন্দরের জাহাজ দেখছিল ওর বন্ধু।
গত দু’বছর ধরে বিএসএস-এর হয়ে ম্যালাগার স্টেশন- মাস্টার হিসেবে কাজ করছে বার্টি। খুব ভাল করেই জানে ম্যালাগায় কে আসছে আর কে চলে যাচ্ছে।
কোট খুলে বাম বগলের কাছে হোলস্টার পরে ওটার ভেতরে পিস্তল রাখল রানা। নতুন করে পরল কোট। বার্টির পেছনে দাঁড়িয়ে তার কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল বন্দরের মেরিনার দিকে। ওর মনে হলো, বার্টি চোখ রেখেছে বড় এক ইয়টের ওপরে। ওটা আছে মেরিনার ঠিক মাঝে।
‘ওটাই,’ নিচু গলায় বলল বার্টি। ‘দ্য লিলি, মোরেলির ইয়ট।’
বিএসএস-এর সিচুয়েশন রুমের ছবিটার কথা মনে পড়ল রানার। ওর হাতে বিনকিউলার ধরিয়ে দিল বার্টি।
চোখে যন্ত্রটা ঠেকিয়ে মেরিনার দিকে তাকাল রানা। দুর্দান্ত এক বিনকিউলার। সবই দেখতে পাচ্ছে পরিষ্কারভাবে। ইয়টের ডেকে ক’জন ক্রু। কোথাও কোন বিশৃঙ্খলা নেই। মেইন ডেকে কয়েকটা কেবিন। নিচে দু’সারিতে কিছু পোর্টহোল বলে দিচ্ছে দু’ডেক নিচেও আছে একাধিক কেবিন। বিশাল আকারের দুর্দান্ত সুন্দর এক প্রমোদতরী মাস্তুলে পতপত করে উড়ছে ফ্রান্সের পতাকা।
ডেস্কের পেছনে গিয়ে চেয়ারে বসল বার্টি। খস খস করে সরাল কিছু কাগজ। রানা বুঝল, বন্ধু চাইছে ওর মনোযোগ। চোখ থেকে বিনকিউলার সরিয়ে নেবে, তার আগেই এক মেয়েকে মেইন কেবিন থেকে বেরিয়ে ডেকে আসতে দেখল রানা। তার পরনে সোয়েটার ও বাদামি প্যান্ট। মেয়েটার কোমর ছাড়িয়ে হাঁটুর কাছে নেমেছে সোনালি চুল। সুগঠিত দুই উদ্ধত স্তনের জন্যে ফুলে আছে সোয়েটারের ওপরদিক। বুকের তুলনায় কোমর এতই সরু, বুড়োমানুষও তাকে দেখে ভাববে: ধরার বুকে নেমেছে সত্যিকারের অপ্সরা। সুডৌল দু’উরু যেন তরুণ কবির স্বপ্নের প্রিয় কোন প্রেমের কবিতা। মসৃণ সাদা ত্বকে রোদ ঠিকরে পড়ে দেখাচ্ছে কাঁচা সোনার মত। ডাগর দুটো নীল চোখ যেন স্বর্গের মায়াহরিণীর। রোদ চোখে লাগতেই মাথার ওপর থেকে নামিয়ে সানগ্লাস পরল. মেয়েটা। তাতে একটু হলেও বুকে দাগা লাগল রানার। তাই বিড়বিড় করে বলল, ‘এলিনা পার্কারসন।’
গলা লম্বা করে জানালা দিয়ে তাকাল বার্টি। একবার ঢোক গিলে বলল, ‘হ্যাঁ, রে, শালা!’
‘দেখার মত এক রূপসী মেয়ে,’ বিড়বিড় করল রানা।
‘সন্দেহ কী, মাসুদ রানার সত্যিকারের উপযুক্ত প্রেমিকা, ‘চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলল বার্টি। ‘কী করে যে এদের জুটিয়ে নিস!’
‘আমি বিসিআই চিফের কথার একতিল এদিক-ওদিক করি না,’ আত্মরক্ষা করতে চাইল রানা।
‘তা হলে বুঝতে হবে, জরুরি ভিত্তিতে বস্ পাল্টাতে হবে আমাকে,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল বার্টি। ‘যাক্ গে! ওরা এসেছে গতকাল।’ আবারও কাগজ ঘাঁটতে লাগল সে।
সোয়েটারে ঢাকা এলিনার দুই কাঁধ ও বুক শেষবারের মত দেখে নিয়ে বিনকিউলার নামাল রানা। আর সঙ্গে সঙ্গে ওর কাছ থেকে যন্ত্রটা কেড়ে নিল বার্টি। ‘একা একাই সব দেখে নিচ্ছে, শালা! চোখে বিনকিউলার লাগিয়ে জানালা দিয়ে তাকাল সে। ‘তুই, ব্যাটা, পারলে কাগজে মন দে!’
ডেস্কে থাকা ছোট্ট কাগজটা তুলে মেসেজ পড়ল রানা।
BARTY H. SMITH. 4 PASEO ZAFIO. ARRIVE TUESDAY. ABOARD LILY. HAVE VISITOR READY. ELINA PARKERSON WILL BRING HIM TO YACHT. WILL SET UP SKI RENDEZVOUS LATER ABOUT DRUG DEAL.
THE NOBLEMAN
‘দ্য নোবলম্যান?’ বার্টির দিকে তাকাল রানা।
মাথা দোলাল বিএসএস এজেন্ট। ‘ব্যাটা বোধহয় নিজেকে ভদ্রলোক বলে মনে করে!’
‘ভাল করেই জানে, মাফিয়া থেকে তাকে বের করে দেয়া হয়েছে,’ বলল রানা। ‘কাগজে যা লেখা, তাতে তো মনে হচ্ছে আমাকে ইয়টে নিয়ে যাবে মেয়েটা।’
‘আমার এ-বাড়িতে তো আর আসবে না, ইয়টেও আমাকে ডেকে নেবে না-হায় রে, আমার কপালটাই মন্দ!’ বামহাতে কপালে চাপড় দিল বার্টি। ‘শুধু কি তা-ই, তোর হোটেলের রুমের নম্বরও জানে। নিজেই মেসেজ করে পাঠিয়ে দিয়েছি।’
‘কখন হোটেলে আসবে মেয়েটা?’
‘দুপুরের পর। লবিতে।’ হাতঘড়ি দেখল বার্টি। ‘হাতে পাবি ধর্ আধঘণ্টা।’
‘আর মারিয়া হ্যারল্ডের কী হবে?’
‘সে বুক ভরা হতাশা নিয়ে বসে থাকুক নিজের ঘরে। তোর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে মোরেলি। তার সঙ্গে তো আর নয়।’
‘লোকটা এত অনর্থক বাগাড়ম্বর করছে কেন?’ জানতে চাইল রানা। ‘তোর কী ধারণা?’
‘মাফিয়া ডনদের তরফ থেকে যে-কোন সময়ে হামলা হবে, তাই মিনিটে মিনিটে আণ্ডারওয়্যারে পাতলা পায়খানা, করছে। হয়তো জানতে চায়, কেউ পিছু নিয়েছে কি না।’
‘অথবা আমরা তাকে ফলো করছি কি না,’ বলল রানা। বার্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবারও হোটেলে ফিরে এল ও। সুইটে না গিয়ে রয়ে গেল লবিতে।
মিনিট বিশেক পর এলিনা পার্কারসন যখন লবিতে পা রাখল, হৃদয়ের হাজারো কষ্টে ভীষণ তিক্ত হয়ে গেল উপস্থিত মহিলারা। চোখে জন্মের খিদে নিয়ে চেয়ে আছে পুরুষেরা। ডেস্কের পেছনে চেয়ারে রসে থাকা ক্লার্ক মনে মনে হয়ে গেল ‘সিনেমার নায়ক টম ক্রু।
লবির সোফা ছেড়ে এলিনা পার্কারসনের দিকে এগিয়ে গেল রানা। ইংরেজিতে বলল, ‘মিস পার্কারসন?’
‘জী, মিষ্টি করে হাসল মেয়েটা। কণ্ঠে সামান্য বিদেশি টান। ‘আমি বুঝি একটু দেরি করে ফেলেছি? সরি!’
‘দুনিয়ার সবাই এই দেরিটা খুশিমনে মেনে নেবে,’ অন্তর থেকেই বলল রানা।
ফিয়োর্ডের বরফখণ্ডের মত শীতল চোখে ওকে দেখল এলিনা। ‘আমরা তা হলে বরং রওনা হয়ে যাই?’
‘বেশ,’ বলল রানা।
ঘুরে লবি থেকে বেরোবার দরজার দিকে পা বাড়াল মেয়েটা। তার পিছু নিল রানা। হোটেল থেকে বেরিয়ে স্পেনের সোনালি উজ্জ্বল রোদে হাঁটতে লাগল ওরা।
‘প্লাযা পেরোলেই গন্তব্যের কাছে চলে যাব,’ বলল এলিনা। ‘ট্যাক্সি লাগবে না।’
হাত বাড়িয়ে তার কনুই ধরল রানা। আর যাই হোক, এটা তো ইউরোপ! রানা তার হাত ধরে এগোচ্ছে বলে কোন ধরনের আপত্তি তুলল না এলিনা। সোনালি যুবতী আর বাদামি রানাকে দেখছে রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া স্প্যানিশ যুবকেরা। চোখে অঢেল প্রশংসা এলিনার জন্যে, আর রানার জন্যে একরাশ চরম ঘৃণা।
‘আজ সুন্দর একটা দিন, তা-ই না?’ বড় করে শ্বাস নিয়ে বলল এলিনা।
‘ম্যালাগা তোমার ভাল লাগে?’ মেয়েটার মুখ থেকে চোখ সরাতে পারছে না রানা।
‘তা তো বটেই,’ বলল এলিনা। ‘এ-শহরে কোন ঝামেলা নেই। সূর্যের সোনালি আলো সবসময় ভাল লাগে। উষ্ণতা সত্যিই অন্যকিছু।’
কেমন কাটল ইয়টে সময়টা?’ জানতে চাইল রানা।
বড় করে শ্বাস নিল এলিনা। ‘কোস্টা ব্রাভার কাছে উত্তাল ছিল সাগর। তা ছাড়া আর কোন সমস্যা হয়নি।’
‘আর তোমার সঙ্গী? তার কেমন লেগেছে?’
চোখে চিন্তা নিয়ে রানাকে দেখল এলিনা। ‘মিস্টার নোবলম্যান?’
‘হ্যাঁ, মিস্টার নোবলম্যান,’ একটু জোর দিয়ে বলল রানা।
‘একটু পর তার সঙ্গে দেখা হবে তোমার।’
‘শুনেছি তুমি খুব ভাল স্কিয়িং করো, মেরিনার কাছে এসে বলল রানা।
‘আমার ভাল লাগে স্কিয়িং করতে,’ বলল এলিনা। তোমারও কি ভাল লাগে?’
‘কখনও কখনও, বিশেষ করে অ্যাসপেনে গেলে।’
‘আমিও হয়তো কোনদিন আমেরিকায় গিয়ে স্কিয়িং করব,’ বলল এলিনা। ওর নীল চোখে উষ্ণতা দেখতে পেল রানা।
‘মিস্টার নোবলম্যান সেটা পছন্দ না-ও করতে পারে।’
মেয়েটা হাসতেই হীরার মত নিখুঁত ঝকঝকে দাঁত দেখল রানা। ‘তা হতেও পারে,’ চট্ করে রানাকে দেখল। ‘মনে হয় তোমার সঙ্গে ভাল আড্ডা জমবে নোবলম্যানের।
জেটিতে পা রাখতেই ওদের দিকে এল তরুণ এক ছেলে। এলিনার সামনে থামল সে। চিকন শরীর হলেও তার হাত-পায়ের পেশি তারের মত টানটান। মাথার চুল কুচকুচে কালো। ঠোঁটের ওপরে ব্রু গোঁফ। ‘সেনোরিটা, আসুন।’ এলিনার হাত ধরে ছোট এক পাওয়ারবোটের দিকে চলল সে।
তার সাহায্য নিয়ে বোটে উঠল এলিনা। নরম সুরে বলল, ‘ধন্যবাদ, প্লেটিনো।’ হাতের ইশারায় দেখাল রানাকে। ‘ইনি মিস্টার কিং।’
‘উঠে পড়ুন, সেনোর,’ তরুণের চোখের কালো মণিতে বুদ্ধিদীপ্ত দ্যুতি।
লাফ দিয়ে বোটে উঠল রানা। এলিনা সিটে বসতেই দড়ি খুলে লগি দিয়ে বোট সরিয়ে নিল প্লেটিনো। বোট ঘুরিয়ে চালু করল ইনবোর্ড মোটর। চলল ওরা ইয়টের দিকে। ওটা আছে মাত্র তিন শ’ গজ দূরে।
সূর্যালোকে ঝিকমিক করছে নীল উপসাগরের জল। ওপর থেকে ঝাঁপিয়ে এসে ছোটসব মাছ ছোঁ দিয়ে ধরছে সফল সি- গালেরা। যারা মাছ পাচ্ছে না, কর্কশ চিৎকার করতে করতে ‘আবার উঠছে আকাশে। পা থেকে টপ-টপ করে ঝরছে জল।
একটু পর ইয়টের পাশে ভিড়ল পাওয়ারবোট। ইয়টের গায়ে এবার দ্য লিলি শব্দটা দেখতে পেল রানা। ডেক থেকে . ওদের দিকে চেয়ে আছে দু’জন নাবিক। দড়ির মই নিচে ফেলল তারা। একে একে এলিনা আর রানা উঠে এল ডেকে।
মেইন ডেকের বড় কেবিনটা ইয়টের স্যালন। ভেতরে বড় এক লাউঞ্জিং চেয়ারে বসে আছে মধ্যবয়স্ক এক লোক। মুখ থেকে পুরু সিগার সরিয়ে উগলে দিল নীলচে ধোঁয়া। তার মাথা ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে ধূম্রজাল।
এলিনার পর কেবিনে পা রাখল রানা। ধোঁয়া থেকে মাথা সরিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা। মৃদু হেসে নিচু গলায় বলল, ‘তো চলে এসেছ, এলিনা ডার্লিং? গুড!’
জবাবে হাসল এলিনা পার্কারসন। রানাকে দেখাল। ‘ইনি মিস্টার কিং। এসেছেন ব্রিটেন থেকে।’ হাতের ইশারায় দেখাল, মোরেলিকে। ‘মিস্টার কিং, ইনি মিস্টার নোবলম্যান।’
কেবিনে চোখ বোলাল রানা।
প্রতিটি আসবাবপত্র রাজকীয়।
হাত বাড়িয়ে শক্ত করে ওর হাত ধরল নোবলম্যান। হ্যাণ্ডশেক করে বলল, ‘মিস্টার কিং, আশা করি আপনি স্কি করতে পছন্দ করেন?
মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘ভালবাসি।’
এলিনা আর আমিও। তবে সময় পাই না বলে তেমন স্কি করা হয়ে ওঠে না। এবার কিছু দিনের জন্যে সোল ই. নিয়েরেতে যাব। আশা করি ওখানে আবার দেখা হবে আপনার সঙ্গে।’
‘আমিও তা-ই আশা করি।’
‘আপনার সঙ্গে কি অন্য কেউ থাকবে?’
‘আমার স্ত্রী।’ সতর্ক চোখে মোরেলিকে দেখল রানা। ছবির সঙ্গে এর বয়স ও উচ্চতা মেলে। যদিও নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই এই লোকই সেই ড্রাগ লর্ড।
‘আমি সত্যিই ভালবাসি আমার মাতৃভূমি বাংলাদেশকে, ‘ বলল মোরেলি, ‘সেখানেই শেষ জীবন কাটাতে চাই।’ হাসল ড্রাগ লর্ড। ‘আপনার কোন আপত্তি না থাকলে তা হলে আমাদের রদেভু হবে সোল ই নিয়েরেতে।’
বাংলাদেশকে তুমি এতই ভালবাস যে ড্রাগ্স্ ছড়িয়ে ছেয়ে ফেলেছ চারপাশ, ভাবল রানা। মুখে বলল, ‘আশা করি প্রথম মিটিঙে আমরা আমাদের কাজ শেষ করতে পারব?’
‘স্কি রিসোর্টে।’
মাথা দোলাল রানা। পরক্ষণে জানতে চাইল, ‘সেক্ষেত্রে আজ দেখা করার কী দরকার ছিল?’
‘সিকিউরিটির জন্যে এটা না করে উপায় ছিল না,’ সিগারে টান দিয়ে ভুসভুস করে নীলচে ধোঁয়া ছাড়ল মোরেলি।
‘আপনি এখানে নিরাপদ বলেই তো মনে হচ্ছে,’ বলল রানা।
‘তা হয়তো নয়,’ ম্লান হাসল রোমিয়ো মোরেলি।
চেয়ার টেনে বসল সবাই। আলাপ শুরু হওয়ার আগেই ট্রেতে করে ড্রিঙ্ক নিয়ে এল এক স্টুয়ার্ড। সে বিদায় নিতেই কোন্ রিসোর্টে রানা ও মারিয়ার সঙ্গে তার দেখা হবে, সেটা জানিয়ে দিল মোরেলি।
এই একই কথা মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খানের কাছে শুনেছে রানা। ড্রিঙ্কের ফাঁকে চলল নানান আলাপ। পনেরো মিনিট পর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল এলিনা। নরম সুরে বলল, ‘আমার মনে হয় হোটেলে ফেরার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন মিস্টার কিং।’
‘সময় দেয়ার জন্যে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ, মিস্টার নোবলম্যান,’ উঠে দাঁড়াল রানা। ‘আশা করি তুষারের রাজ্যে আবারও দেখা হবে আমাদের।’
চেয়ার না ছেড়েই হাত বাড়িয়ে ওর সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল মোরেলি। রানার হাত ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে এল এলিনা। নিচু গলায় বলল, ‘দুঃখিত, জরুরি কাজ আছে বলে নিজে আর তোমাকে তীরে পৌঁছে দিতে পারব না। প্লেটিনো তোমাকে তীরে দিয়ে আসবে।’
মেয়েটার সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করল রানা। ‘আপ্যায়নের জন্যে তোমাদের দু’জনকেই অনেক ধন্যবাদ।’
ডেক পেরিয়ে দড়ির মই বেয়ে পাওয়ারবোটে নামল রানা। ওপরের ডেক থেকে হাত নাড়ল এলিনা পার্কারসন। ইয়ট থেকে সরে গেল বোট। ধীর বেগে চলল তীরের দিকে। তবে পঞ্চাশ গজ যেতে না যেতেই হঠাৎ শোনা গেল চিৎকার। চট্ করে ঘুরে ইয়টের দিকে তাকাল রানা। প্লেটিনোর উদ্দেশে বলল, ‘থামো, প্লেটিনো!’
একটু আগে স্যালনে গিয়ে ঢুকেছে এলিনা, তারপর আবার বেরিয়ে এসেছে-এখন টলমল করছে মাতালের মত।,
স্যালনের ভেতরে ঝলসে উঠছে কমলা ফুলকি। পরক্ষণে সাগরের বিক্ষুব্ধ জলের ওপর দিয়ে ভেসে এল রাইফেলের টানা গুলিবর্ষণের আওয়াজ।
আর্তনাদ করে উঠল কেউ।
একটা গুলিতে ধুপ করে ডেকে পড়ল এলিনা পার্কারসন। মাঝপথে থেমে গেল ওর চিৎকার।
ডেক পার হয়ে ইয়টের রেইলিঙের কাছে গেল কালো ওয়েট স্যুট পরা কে যেন। পরক্ষণে লাফিয়ে নেমে গেল সাগরে। রানার হাতে উঠে এসেছে ওয়ালথার পিপিকে, ‘তবে লোকটাকে স্পষ্টভাবে দেখতে না পেয়ে গুলি করা থেকে বিরত থাকল।
‘ইয়টের দিকে চলো!’ প্লেটিনোকে নির্দেশ দিল রানা।
ভয় পেলেও বোট ঘুরিয়ে ইয়টের দিকে গেল বিচলিত তরুণ। স্কুবা ডাইভার সাগরের যেখানে নেমেছে, ওখানে এখন বড় বুদ্বুদ ছাড়া আর কিছুই নেই। চারপাশে যেসব জাহাজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার সুযোগটা নিয়েছে খুনি। ইয়টের ডেকে স্কুবা গিয়ার ফেলে রেখে ওয়েট স্যুট পরনে ডুব-সাঁতার দিয়ে পালিয়ে গেছে সে।
পাওয়ারবোট নিয়ে পুরো এক মিনিট চারপাশে ঘুরল রানা। কোথাও দেখতে পেল না আততায়ীকে। এবার দেরি না করে দড়ির মই বেয়ে উঠে গেল ইয়টের ডেকে।
এলিনাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ইয়টের চার ক্রু। তাদের একজনকে সরিয়ে দিয়ে মেয়েটার পাল্স দেখল রানা। জ্ঞান হারালেও ভালভাবেই শ্বাস নিচ্ছে এলিনা। সোয়েটারের কাঁধ কালচে হয়ে গেছে রক্তে।
উঠে দাঁড়িয়ে স্যালনে গিয়ে ঢুকল রানা।
মেঝেতে পড়ে আছে মোরেলি। অজস্র বুলেটের আঘাতে প্রায় দু’টুকরো হয়ে গেছে তার মাথা। ডেকে আছড়ে পড়ার আগেই মারা গেছে লোকটা।
স্যালন থেকে বেরিয়ে তীরের দিকে তাকাল রানা। কিন্তু ওদিকে কোথাও নেই কালো ওয়েট স্যুট পরা কেউ। পাইলট হাউসে ঢুকে শিপ-টু-শোর রেডিয়ো ব্যবহার করে বার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করল রানা। ওর কথা শুনে কয়েক সেকেণ্ডের জন্যে হতবাক হয়ে গেল বিএসএস এজেন্ট। তবে চট করে নিজেকে সামলে নিয়ে ফোন দিল ম্যালাগার গার্ডিয়া সিভিল-এ।
এলিনার পাশে এসে বসল রানা। সামান্য নড়ে উঠল মেয়েটার চোখের পাতা।
‘এলিনা, শুয়ে থাকো,’ বলল রানা।
চোখ মেলে ওকে দেখল মেয়েটা। গুঙিয়ে উঠে বলল, ‘খুব ব্যথা!’ পরক্ষণে সোয়েটারে রক্ত দেখে জ্ঞান হারাল।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন