কাজী আনোয়ার হোসেন
কিছুক্ষণ পর বার এস্কুই ত্যাগ করে হোটেলে ফিরে এল রানা। ওদের সুইটে ঢুকে জ্বেলে নিল বাতি। শুনতে পেল পাশের ঘরে পায়ের হালকা শব্দ। পরক্ষণে খুলে গেল মাঝের দরজা। কৌতূহলী চোখে ওকে দেখল মারিয়া
‘তা হলে দেখা হলো তার সঙ্গে?’
‘হ্যাঁ,’ সংক্ষেপে জানাল রানা। সরে ব্যুরো থেকে প্যাড ও কলম নিয়ে খস খস করে কাগজে লিখল: ‘ঘরে গুবরে পোকা। কথা বোলো না।’
কাগজটা দেখাতেই মাথা দোলাল মারিয়া। দুই সেকেণ্ড পর প্রশ্ন করল, ‘কেমন কাটল সময়?’
প্যাডে লিখল রানা: ‘আগামীকাল সকাল দশটায় গণ্ডোলায় তার সঙ্গে দেখা করবে তুমি। পরে সব খুলে বলব।’
নড করল মারিয়া।
‘আমি এবার বিশ্রাম নেব,’ বলল রানা।
‘ঠিক আছে,’ মাথা দোলাল মারিয়া।
আঙুল তুলে বাইরের করিডর দেখাল রানা। ওখানে গিয়ে কথা বলতে চায়।
‘গুড নাইট, স্যামি,’ বলে নিজের ঘরে ঢুকল মারিয়া। গায়ে শাল জড়িয়ে সুইট ছেড়ে চলে গেল করিডরে।
ওর পিছু নিল রানা।
সিগারেট জ্বেলে ওকে দেখল মারিয়া। ‘তুমি শিয়োর যে ঘরে গুবরে পোকা আছে?’
‘আমি নিশ্চিত।’
‘মোরেলির সঙ্গে দেখা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ। আমরা তাকে চিনি জন কার্সন নামে।’
রানার চোখে তাকাল মারিয়া। ‘আমিও সেটাই ভেবেছি।’
‘আমি অত শিয়োর নই। আগামীকাল মাইক্রোফিল্ম হাতে পেলে, দু’দিনের ভেতরে জানব সে নকল লোক কি না
‘মাইক্রোফিল্ম না দেখলেও তার কথা থেকে অনেক কিছুই বুঝতে পারব,’ বলল মারিয়া।
‘দেখা যাক কী বলে। আমার কাজ হবে পাহাড়ের ঢাল থেকে তোমাদেরকে কাভার দেয়া। সে সেটাই চাইছে।’
‘কিন্তু মোরেলির সঙ্গে দেখা হবে, সেটা আগে থেকে কীভাবে জানল কিউলেক্স?’
‘আমাদের পিছু নিয়ে এখানে এসেছে সে।’
‘চারপাশে চোখ রাখব আমি।’
‘দরকার হবে না। সে-কাজ আমিই করব। তোমার কাজ হবে জেনে নেয়া যে মিথ্যা বলছে কি না।’
সিগারেটে টান দিল মারিয়া। ‘আগেই আমাদের হাতে সব বুঝিয়ে দেয়নি কেন সে?’
‘আমাকে বলেছে, সে কোন ঝুঁকি নিতে চায়নি।’
কাঁধ ঝাঁকাল মারিয়া। ‘যুক্তি আছে তার কথায়।’
‘তার সঙ্গে কেবল-কারে উঠে চলে যাবে ওপরে। স্কি করে নেমে আসবে বোরেগুইলাসে। হোটেলে ফিরে তোমার জন্যে অপেক্ষা করব। মাইক্রোফিল্ম হাতে পেলে তুলে দেব একজনের হাতে। এটা জানা খুব জরুরি যে মাইক্রোফিল্ম আসল কি না।’
‘ম্যালাগায় কারও হাতে দেবে?’
‘গ্রানাডায় বিসিআই-এর লোক আছে,’ বলল রানা।
‘আশা করি একই জিনিস বিএসএসও হাতে পাবে।’
‘নিশ্চয়ই।’
সুইটে ঢুকে দরজা আটকে দিল ওরা।
দুই ঘরের মাঝের দরজা ভিড়িয়ে নিল মারিয়া।
জুতো ও উইণ্ডচিটার খুলে বেডে শুয়ে পড়ল রানা। মনে ঘুরপাক খাচ্ছে নানান ধরনের দুশ্চিন্তা। একটু পর মেডিটেশন করে ঘুমিয়ে গেল অকাতরে।
.
সোনালি রোদে ঝিকঝিক করছে গিরিখাদের তুষার, ধাঁধিয়ে দিচ্ছে চোখ। যেইস ৬০x বিনকিউলার চোখে সেদিকে চেয়ে আছে রানা। মারিয়া ও মোরেলিকে নিয়ে উঠে আসছে কেবল-কার। মেয়েটার পরনে হলদে সোয়েটার। সাধারণত এসব গণ্ডোলা বহন করে চারজন স্কিয়ার, তবে কেবল-কারে এখন আছে ওরা মাত্র দু’জন। রানা বুঝে গেল, মোটা অঙ্কের ঘুষ দিয়ে বিশেষ সুবিধা নিয়েছে ড্রাগ লর্ড।
অবশ্য এসব নিয়ে ভাবছে না রানা। চোখ বোলাল তুষারে ভরা ঢালু পাহাড়ে। আর তখনই দেখতে পেল তাকে।
বড় একটা পাথরে কনুই রেখে কেবল কারের দিকে দীর্ঘ নলের রাইফেল তাক করেছে সে। চোখ স্কোপের সাইটে। রানা বুঝতে পারল না ওটা কোন্ কোম্পানির অস্ত্র।
সঠিক সময়ের জন্যে অপেক্ষা করছে লোকটা। স্কোপের মাঝ দিয়ে দেখছে গণ্ডোলা। ওটায় চেপে উঠে আসছে মারিয়া ও মোরেলি।
কখন এবং কোথায় হামলা করতে হবে সেটা কীভাবে জানল আততায়ী? – ভাবল রানা।
হামলার পেছনে স্বয়ং জন কার্সন নেই তো?
হয়তো তার সঙ্গী এই খুনি।
দু’জন মিলে ফাঁদে ফেলতে চেয়েছে মারিয়া আর ওকে!
ওদের নিজেদের ভেতরের কথা ফাঁস হলো কীভাবে?
হোটেলে জরুরি কোন কথা বলেনি ওরা।
কার্সন ওরফে মোরেলি ছাড়া অন্য কারও জানার কথা নয়, কোথায় দেখা করা হবে।
অথচ, সে কি কিউলেক্স?
খাপ পেতে বসে আছে আততায়ী!
সম্ভবত সে-ই!
উইণ্ডচিটারের চেইন খুলে ওয়ালথার হাতে নিল রানা। চেম্বারে গুলি আছে দেখে নিয়ে রেখে দিল পকেটে। গিরিখাদে লোকটার কাছে পৌছুতে হলে স্কি করে নেমে যেতে হবে বহু নিচে। কিউলেক্স প্রাণে বাঁচলে মোরেলিকে খুন করবে সে, কাজেই গুলি শুরু করার আগেই পাথুরে জমিতে ক্রল করে গিয়ে শেষ করতে হবে তাকে।
কেবল-কারের উঠে আসার ধীরগতি আর পাথুরে জমিতে শুয়ে থাকা লোকটাকে দেখে রানা বুঝল, গণ্ডোলায় মারিয়া বা কার্সনের খুন হয়ে যাওয়া ঠেকাতে হলে হাতে ও পাবে বড়জোর দেড় মিনিট!
বরফে ছাওয়া ঢাল বেয়ে রওনা হয়ে গেল রানা। সামনেই শক্ত বরফের এলাকা। ওটা এড়িয়ে গেল ও। ওর স্কিয়িঙের কারণে ওপরে শুরু হয়েছে তুষারের একটা ধস। হুড়মুড় করে নেমে এল সাদা ঢেউ। কয়েক সেকেণ্ডে ডুবে গেল রানার দু’হাঁটু। কাত হয়ে পড়ে যেতে গিয়েও সামলে নিল ও। তুষারের খরস্রোত নেমে গিয়ে ধাক্কা খেল নিচের পাথুরে জমিতে। এদিকে এরই ভেতরে কয়েক সেকেণ্ড নষ্ট করে বসেছে রানা। নিচে পাথুরে জমিতে আর দেখতে পেল না লোকটাকে। বিনকিউলার চোখে তাকাল নিচের ঢালে। এক পলক পরে আবারও দেখল রাইফেল হাতে আততায়ীকে।
তুষারের স্রোতের ধাক্কায় অন্তত পঞ্চাশ গজ সরে গেছে রানা। এখনও আছে বহু ওপরে। তুষার ধসের এলাকা থেকে সরে ঝড়ের বেগে নামতে লাগল রানা। কোনাকুনিভাবে চলেছে আততায়ীকে লক্ষ্য করে।
এক মিনিট পেরোবার আগেই পৌঁছে গেল পাথুরে জমিতে। চট্ করে জুতো থেকে খুলল স্কির ক্ল্যাম্প। এবার পিছলে যাবে না ওর পা। বিনকিউলার চোখে তাকাল নিচের পাথুরে কিনারায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পোলের মাঝে চলে এসেছে কেবল-কার। রাইফেলের গ্রিপ ধরে গণ্ডোলার দিকে চেয়ে আছে আততায়ী।
পকেট থেকে ওয়ালথার নিয়ে তার মাথা লক্ষ্য করে ট্রিশার স্পর্শ করল রানা। তাতে লোকটার মাথার পাশের পাথরে লেগে ‘বিইইইয়িং’ শব্দে কোথায় যেন চলে গেল .৩৮ বুলেট।
ঝট্ করে মাথা ঘুরিয়ে ওপরে তাকাল আততায়ী।
বহু দূরে আছে বলে তার সাদা চেহারা ঝাপসাভাবে দেখল রানা। ঘুরে ওর দিকে রাইফেল তাক করল লোকটা। পরক্ষণে রানার মাথার তিন ফুট ওপরে গেঁথে গেল ভারী ক্যালিবারের গুলি। খুন হয়ে যাওয়ার তোয়াক্কা না করে আবারও গুলি পাঠাল রানা।
যদিও পাথরের ওদিকে মাথা নিচু করে নিয়েছে খুনি।
তাকে আর দেখতে পেল না রানা। ওর পাশের পাথরে এসে লাগল বুলেট। ঝুপ করে তুষারে ভরা ঢালু জমিতে বসে পড়ল রানা। কেবল বেয়ে উঠছে গণ্ডোলা। ভেতরে মারিয়ার হলদে সোয়েটার দেখতে পেল ও। অবশ্য দ্বিতীয়বার ওদিকে দেখার সুযোগ পেল না। ওর দিকে পিঠ দিয়ে রাইফেল হাতে উঠে দাঁড়িয়েছে আততায়ী। গণ্ডোলার দিকে তাক করল অস্ত্রটা। আর একই সময়ে আবারও গুলি পাঠাল রানা।
ওর গুলি গায়ে না লাগলেও খোঁড়লের মত এক জায়গায় ঝুপ করে বসে পড়ল লোকটা। তাকে গণ্ডোলার দিকে রাইফেল তাক করতে দেখে বুঝে গেল রানা, ঠিক সময়ে পৌঁছুতে পারবে না আততায়ীর কাছে। কেবল ক্ল্যাম্প আটকে বিদ্যুদ্বেগে আবারও স্কি করে নেমে যেতে লাগল।
দুই পোল বামহাতে রেখে, ডানহাতে ধরেছে ওয়ালথার। যে-কোন সময়ে পিছলে গিয়ে শুরু হবে ওর দীর্ঘ পতন। কিছুটা নেমে টের পেল, স্কি করতে হলে গুলি লাগাতে পারবে না টার্গেটে। চট করে থেমে বসে পড়ল রানা। স্কি খুলে কুঁজো হয়ে তাকাল নিচে। ওই যে, পাথরের স্তূপের ভেতরে লোকটা!
দেরি না করে গুলি পাঠাল রানা। প্রায় একই সময়ে গণ্ডোলা লক্ষ্য করে গুলি করেছে আততায়ী। রানার গুলি কানের পাশ দিয়ে যেতেই চমকে গেছে সে। ফলে কাঁচ ভেদ করে মোরেলির হৃৎপিণ্ডে না বিঁধে বুলেট লেগেছে গণ্ডোলার নিচে।
পরক্ষণে আবারও গুলি পাঠাল রানা। তাতে পাথুরে জমিতে শুয়ে পড়ে ওর দিকে রাইফেলের নল তাক করল আততায়ী।
এদিকে তুষারে পিছলে সরসর করে নেমে চলেছে রানা। ওর চারপাশের তুষারে এসে লাগল বেশকিছু গুলি।
পিচ্ছিল পাথরের স্তরে নেমে, ক্রল শুরু করতেই রানার কানের পাশ দিয়ে গেল একটা বুলেট। আর তখনই আবারও আততায়ীকে দেখতে পেল ও।
এবার তার ঘাড় লক্ষ্য করে গুলি পাঠাল রানা।
তাতে ভীষণ ঝটকা খেয়ে তুষারে পড়ল লোকটা। মাথার চারপাশে ভেসে উঠেছে লাল কুয়াশার মত কণা।
উঠে দাঁড়িয়ে পিছলে নিচে নেমে এল রানা। আততায়ী পড়ে আছে রক্তের পুকুরে। সে আর কেউ নয়, কুখ্যাত কিউলেক্স ওরফে সোলনি দে নায়েসুরা।
পিস্তলের বুলেটের আঘাতে মৃত্যুবরণ করেছে পুরুষ মশা!
মোরেলি আর রানাকে খতম করতে ব্যবহার করেছে ৩০- ০৬ স্প্রিংফিল্ড কার্তুজের উইনচেস্টার মডেল ৭০ স্নাইপার রাইফেল। সঙ্গে আছে বশ অ্যাণ্ড লম্ব্ ব্যালভার ভ্যারিয়েবল পাওয়ার লি ডট টেলিস্কোপ। এই ধরনের রাইফেলের ব্যারেল থেকে বেরোবার সময় স্প্রিংফিল্ড ব্রোঞ্জ পয়েন্ট কার্ট্রিজের গতি হয় প্রতি সেকেণ্ডে ঊনত্রিশ শ’ ষাট ফুট। তিন শ’ গজ দূরত্বে প্রতি সেকেণ্ডে গতিবেগ বাইশ শ’ ষাট ফুট। মাযল থেকে বেরোলে তখন বুলেটের হিটিং পাওয়ার প্রতি ফুট-পাউণ্ডে ঊনত্রিশ শ’ বিশ ফুট। তিন শ’ গজ দূরে সেই শক্তি কমে হয় সতেরো শ’ ফুট-পাউণ্ড। আর ভ্যারিয়েবল পাওয়ার স্কোপের গুণে বাতাস ও উচ্চতা বুঝে মাত্র দুটো মুভিং পার্টস সরিয়ে সঠিক জায়গায় পাঠানো যায় প্রচণ্ড গতি বুলেট।
এই মারণাস্ত্র এতই নিখুঁত, মার্কস্-ম্যানের হাত থেকে প্রাণে বাঁচার উপায় আসলে নেই বললেই চলে।
মৃত মশার লাশের প্যান্টের পেছন-পকেটে ওয়ালেট পেল রানা। ওটার ভেতরে আছে কিছু কাগজপত্র। পরিচয়-পত্রে লেখা: সোলনি দে নায়েসুরা। এসেছে ইতালির বারি থেকে। তামাটে মুখ ক্লিন শেভড়। মাথার চুল কালো। জুলফি বেশ লম্বা। পরনে দামি উইণ্ডচিটার ও টাইট ফিটিং স্কি প্যান্ট।
পেছনে হঠাৎ করে শব্দ পেয়ে ঘুরে তাকাল রানা। এইমাত্র স্কি করে এসে থেমেছে গার্ডিয়া সিভিলের মধ্যবয়স্ক এক অফিসার। পা থেকে স্কি খুলে ওর দিকে এল সে। একহাতে নোটবুক ও কলম। রানা খেয়াল করল, হোলস্টারের বোতাম আটকে রেখেছে লোকটা।
ওকে একবার দেখে নিয়ে লাশের পাশে থামল অফিসার। মৃতদেহের দিকে ঝুঁকে খস খস করে কী যেন লিখল নোটবুকে। মৃতের পাল্স্ আছে কি না, সেটা বোঝার জন্যে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করল মশার ঘাড়। পাস্ নেই দেখে নিয়ে তুষারে পড়ে থাকা কাগজপত্র তুলে চোখ বোলাল। আনমনে কী যেন বলে মন দিল রাইফেল ও স্কোপের প্রতি।
চুপ করে আছে রানা।
‘আপনাকে বিরক্ত করছি সেজন্যে মাফ করবেন, সেনোর,’ একবার কেশে নিয়ে ইংরেজিতে বলল অফিসার।
মৃদু হাসল রানা। ‘জানলেন কীভাবে যে আমি ইংরেজি জানি?’
‘ধারণা করেছি,’ বলল সে। ‘সেনোর, আপনি কি এই হত্যাকাণ্ডের একজন সাক্ষী?’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা।
‘আপনি হয়তো স্রেফ সাক্ষী নন, এর মৃত্যুর জন্যে দায়ী।’
এবার ওকে গ্রেফতার করতে চাইবে লোকটা, ভাবল রানা। আসামীর আইনগত কোন্ কোন্ অধিকার আছে, সেটা জানায় না স্পেনের পুলিশ। অপরাধীর কোন অধিকারই থাকে না।
ওয়ালেট বের করতে উইণ্ডচিটারের চেইন খুলবে বলে হাত ওপরে তুলল রানা। আর সঙ্গে সঙ্গে হোলস্টার থেকে .৪৫ কোল্ট পিস্তল বের করে ওর দিকে তাক করল লোকটা।
নরম সুরে বলল, ‘সেনোর, পকেট থেকে কিছু দয়া করে বের করবেন না।’
‘পরিচয়-পত্র বের করছি,’ হাসি-হাসি চেহারা করল রানা। ‘যাতে জানাতে পারি, আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন ম্যালাগার সেনোর বার্টি এইচ. স্মিথ।’
এ-কথায় কী যেন ভেবে রানার হাত থেকে ওয়ালেট নিল অফিসার। আইডি কার্ড দেখে বলল, ‘বুঝতে পেরেছি। আগেই আপনার কথা আমাদেরকে বলা হয়েছে।’ রানার হাতে ওয়ালেট ধরিয়ে দিল সে। ‘বিরক্ত করেছি সেজন্যে দুঃখিত, সেনোর। আমার আর কিছু জানার নেই। আপনি এখন চলে যেতে পারেন।’
বিএসএস এজেন্ট বার্টির লম্বা হাতের দৌড় দেখে মনে মনে হাসল রানা। গার্ডিয়া অফিসারের দিকে তাকাল। ‘আপনি কি একে চেনেন?’
মাথা নাড়ল অফিসার। ‘না, আগে দেখিনি। তবে সে আসলে কে এবং কোথা থেকে এসেছে, সবই জেনে নেব।’
‘আমার বোধহয় একটা কথা বলা উচিত,’ বলল রানা। ‘এই লোক বোধহয় ম্যালাগায় একজনকে খুন করেছে।’
‘তা-ই?’
‘এ-ছাড়া খুন করেছে গত দু’রাত আগে প্রাডো লানোতে ছোট এক ছেলেকে।’
সরু হলো অফিসারের চোখ। ‘আপনি অনেক কিছু জানেন দেখছি, সেনোর।
‘খুব কমই জানি,’ বলল রানা।
পা ঠুকে খটাস্ করে ওকে স্যালিউট দিল অফিসার। ‘ঠিক আছে, আপনাকে দেরি করিয়ে দিতে চাই না। এবার বরং এখান থেকে চলে যান। যে-কোন সময়ে এখানে আসবে আমার জুনিয়র অফিসার। কম বয়স ওর। অনেক কিছু বুঝতে চাইবে না।’
ঢালু পাহাড়ের দিকে তাকাল রানা। ওপর থেকে স্কি করে নেমে আসছে আরেক গার্ডিয়ার অফিসার।
‘আপনাকে ধন্যবাদ,’ মধ্যবয়স্ক অফিসারকে বলল রানা।
কোমর পর্যন্ত বাউ করে আরেকবার রানাকে স্যালিউট দিল সে। ‘সেনোর স্মিথকে জানাব, আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।’
জুতোয় স্কির ক্ল্যাম্প আটকে পোল দুটো হাতে নিল রানা। ঘুষখোর অফিসারের কথা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে রওনা হয়ে গেল নিচে প্রাডো লানো লক্ষ্য করে। মিনিট বিশেক পর পৌছুল হোটেলের কাছে। লাউঞ্জে ঢুকে ফায়ারপ্লেসের কমলা দাউ-দাউ আগুনের পাশে দেখতে পেল মারিয়াকে। আপাতত লাউঞ্জে আর কেউ নেই।
খুশিতে ঝলমল করছে মেয়েটার মুখ। প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘হাতে সব পেয়ে গেছি!’
মৃদু মাথা দোলাল রানা।
‘নিচে মনে হলো কোন ঝামেলা হয়েছে,’ বলল মারিয়া।
‘কিউলেক্স আমার হাতে খুন হয়ে গেছে,’ বলল রানা।
কথাটা শুনে ফ্যাকাসে হলো মারিয়ার মুখ। ‘সে কীভাবে জানল যে আমরা কেবল-কারে আছি? তুমি, আমি আর মোরেলি ছাড়া তো আর কারও জানার কথা নয়!’
‘তুমি কি সত্যিই ভাবছ কার্সন আসলে মোরেলি?’ জানতে চাইল রানা। কাঁধ ঝাঁকাল মারিয়া। ‘ড্রাগের রুটের ব্যাপারে অনেক কিছুই সে জানে। এ বিষয়ে
এ-বিষয়ে আমার হাতে একটা মাইক্রোফিল্ম দিয়েছে। নকল কারও তো এটা করার কথা নয়।’
‘আজকে বিকেলে গ্রানাডায় যাব,’ বলল রানা। ‘জিনিসটা তুলে দেব একজনের হাতে। ফিল্মটা সত্যি না মিথ্যা, সেটা জেনে নিতে এক দিনের বেশি লাগার কথা নয়।’
মাথা দোলাল মারিয়া। কী যেন ভাবছে। মুখ তুলে তাকাল রানার চোখে। ‘সরি, যে-কাজ দেয়া হয়েছিল, সেটা পারিনি। আসলে চট করে জানার উপায় নেই মাইক্রোফিল্ম খাঁটি কি না।’
‘এসব নিয়ে মন খারাপ কোরো না,’ বলল রানা, ‘বিসিআই বা বিএসএস-এর বিশেষজ্ঞরা সহজেই সব বুঝবে।’
‘আসলে জানিও তো না কেন আমাকে এখানে পাঠানো হলো,’ ঠোঁট ফুলিয়ে রানাকে দেখল মারিয়া।
‘কাজে সাহায্য করার জন্যে,’ বলল রানা, ‘আর সেটা তুমি করেছ। এত ভেবো না।
চুপ করে আগুনের ধারে বসে থাকল মারিয়া।
নিজেদের সুইটে ফিরল রানা। পোশাক পাল্টে আবার নেমে এল নিচে। হোটেল ত্যাগ করে চলে গেল কেবল- কারের জংশনে। বিশ মিনিট পর পৌঁছুল গাড়ি মেরামতির গ্যারাজে। ওকে দেখে দুঃখ প্রকাশ করল মেকানিক। ‘সরি, সেনোর, আশা করি দুপুর দুটোর আগে আপনার গাড়ি ফেরত দিতে পারব। তাতে কোন অসুবিধে নেই তো?’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘অসুবিধে নেই। তবে কী ধরনের ত্রুটি হয়েছে গাড়িতে, সেটা জানতে এসেছি।’
‘ব্রেকের ফ্লুইড সব পড়ে গেছে, সেনোর।’
‘সেটা কীভাবে হলো?’
‘আসলে সমস্যা পাইপ লাইনে,’ চুপ হয়ে গেল মেকানিক।
‘একটু ব্যাখ্যা করে বলুন,’ বলল রানা।
‘বড় অবাক কাণ্ড, সেনোর,’ দীর্ঘশ্বাস ফেলল মেকানিক। ‘নইলে তো আর পাইপ লাইন থেকে ফ্লুইড পড়ার কথা নয়। আসলে এটা তো কোনভাবেই সম্ভব নয়।’
‘তো তা হলে কী হয়েছিল?’ জবাবটা কী হবে, ভাল করেই বুঝে গেছে রানা।
‘ছুরি দিয়ে কাটা হয়েছে লাইন। সেটা করেছে কোন এক অমানুষ। আপনি দুর্ঘটনায় পড়ে মারাও যেতে পারতেন। রানার চোখে তাকাল মেকানিক। ‘এটা করেছে আপনার- কোন জন্মশত্রু, সেনোর। সে হয়তো কোন মহিলার প্রতারিত স্বামী।’
স্পেনের মানুষ খুব রোমান্টিক, ভাবল রানা। মুখে বলল, ‘ঘটনা হয়তো তা-ই। তবে মেয়েটা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী।’
ঝলমল করে উঠল মেকানিকের মুখ। ‘বাহ্! তা হলে তো আপনার জীবনের সেরা মুহূর্ত পেয়ে গেছেন!
‘আমি তা হলে দুটোর সময় গাড়ি নিতে আসব।’
‘আরেকটা কথা, সেনোর,’ বলল মেকানিক।
‘সেটা আবার কী?’
দ্বিধায় পড়ে গেছে লোকটা। আশপাশে কেউ আছে কি না সেটা চট্ করে দেখে নিল, তারপর পকেট থেকে বের করল ছোট্ট এক কয়েনের মত কিছু। ‘সেনোর, এটা কি আপনার?’
মেকানিকের হাতের তালু থেকে ওটা নিয়ে দেখল রানা। যন্ত্রটা আধুনিক এক ম্যাগনেটিক গুবরে পোকা। একই সঙ্গে ট্র্যান্সমিটার ও ডিরেকশন ফাইণ্ডার। বহু দিন ধরেই পেশাদার গুপ্তচরেরা ব্যবহার করে। তৈরি করা হয়েছে জাপান বা জার্মানিতে।
‘এটা যে কী, সেটা জানি না,’ বলল রানা।
‘আমিও না, সেনোর।
‘কোথায় পেলে এটা?’
‘রেঁনো গাড়ির অ্যাক্সেলের কাছে।’
‘হয়তো হাইওয়েতে চলার সময়ে গাড়িতে আটকে গেছে।
‘ওটার ভেতরে চুম্বক আছে। ভাবলাম, এটা দেখলে আপনি হয়তো অবাক হবেন।’
‘অবাক তো হয়েইছি।’ পকেটে গুবরে পোকা রেখে দিল রানা। ওয়ালেট থেকে দশ হাজার পেসেতা নিয়ে ধরিয়ে দিল মেকানিকের হাতে। ‘এটা তোমার মুখ বন্ধ রাখার জন্যে।’
ঘন ঘন মাথা দোলাল লোকটা। বুঝেছি, সেনোর।’
‘আমিও বুঝেছি,’ মনে মনে বলল রানা। গাড়িতে গুবরে পোকা রেখে কার্সন ওরফে মোরেলি আর ওর কথা কান পেতে শুনেছে কিউলেক্স। পরে আজ সকালে গেছে টার্গেটকে খুন করতে, আর তখন নিজেই হয়ে গেছে খুন।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন