কাজী আনোয়ার হোসেন
প্রশান্ত মহাসাগরের বিশাল বিস্তৃত সুনীল বুকে ছোট্ট এক লালচে ফোঁটার সমান আমেরিকার আগ্নেয়দ্বীপ হাওয়াই।
বারো দিন আগে এ-দ্বীপের সাধারণ হোটেল হাওয়াই-এর একটি সুইটে উঠেছে রানা। আর আজ এখানে ওর তেরোতম ভোর। একটু আগে ঘুম ভেঙে যেতেই বাথরুম থেকে মুখ- হাত ধুয়ে এসেছে রানা। এরপর শুরু করেছে লিভিংরুমে বুকডন। প্রথমে বিশবার, তারপর চার দফায় কয়েক সেকেণ্ড বিরতি নিয়ে আরও আশিবার। ব্যথা থেকে বুঝতে পেরেছে, দাউ-দাউ করে পুড়ছে ওর ট্রাইসেপ ও ডেল্টয়েড পেশির ল্যাকটিক অ্যাসিড। বুকডন শেষ করে বিশ্রাম না নিয়েই বেডরুমে ফিরে দু’পায়ের আঙুল বাধিয়ে নিল টেবিলের নিচের অংশে। বিশবার করে পাঁচ দফায় দিল মোট এক শ’টা সিট আপ। আড়ষ্ট হয়ে গেছে ওর পেটের পেশি। উঠে চলে গেল বেডরুমের দরজার লিন্টেলের সামনে। রানার ওজন নেয়া ওটার জন্যে কিছুই নয়। লাফ দিয়ে তাকের মত জায়গাটার কিনারা দু’হাতে ধরল রানা। দু’পা ঝুলছে শূন্যে। ভাঁজ করে নিল হাঁটু। হাতের জোরে চিবুক তুলল লিন্টেলের কাছে। কয়েক সেকেণ্ড পর নামিয়ে নিল শরীর। আবারও চিবুক নিল লিন্টেল ব্রাবর। পাঁচ দফায় এক শ’বার চিন আপ করার পর আস্তে করে নেমে পড়ল মেঝেতে। তরতাজা বোধ করছে।
ভোরের ধূসর আলো ফোটার আগেই এই তিন ব্যায়াম সেরে নিল আরও ছয় দফা। এটা রানার কাছে আসলে সাধনার মত। ভাল করেই জানে, শারীরিকভাবে আনফিট হলে যে-কোন সময়ে আসবে করুণ মৃত্যু।
ব্যায়াম শেষ করে বাথরুমে ঢুকে শাওয়ার সেরে নিল রানা। পোশাক পরে ব্রেকফাস্টের জন্যে রেস্টুরেন্টের দিকে রওনা হবে, এমন সময় বেজে উঠল, স্মার্টফোন। ওটার স্ক্রিনের দিকে চেয়ে চমকে গেল রানা। ওকে কল করেছেন বিসিআই চিফ! বৃদ্ধের কণ্ঠ আবারও শুনবে ভেবে ধক করে উঠল ওর হৃৎপিণ্ড। শিরার ভেতরে কেমন এক শিরশিরে অনুভূতি। বুড়ো কি তা হলে দারুণ কোন রোমাঞ্চকর অ্যাসাইনমেন্ট দেবেন ওকে?
একবার ঢোক গিলে কল রিসিভ করল রানা।
ও-প্রান্ত থেকে টিট-টিট-টিট শব্দ হচ্ছে। তিন সেকেণ্ড পর খস খস শব্দ হতেই রানা বুঝল, কাজ শুরু করেছে বিসিআই-এর টেকনিশিয়ানদের তৈরি নিখুঁত ফোনকল এনক্রিপশন ইলেকট্রনিক মেশিন।
‘হ্যালো, স্যর, আই হোপ দ্যাট ইউ আর ওয়েল?’ নিচু গলায় বলল রানা।
‘ভাল আছি, রানা,’ গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বললেন (অব.) মেজর জেনারেল রাহাত খান। ‘এটাও জানি, ফিরে পেয়েছ তোমার ফিটনেস। সেক্ষেত্রে কি ধরে নেব আগের মতই ভাল স্কিয়িং করো?’
‘মোটামুটি পারি, স্যর,’ আরেকবার ঢোক গিলল রানা। ‘সেক্ষেত্রে নতুন করে অফিসে যোগ দেয়ার পর এটা হবে তোমার প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট, রানা।’
‘আমাকে কোথায় যেতে হবে, সার?’
‘স্পেন। ওখানে খুব বেশি তুষারপাত না হলেও সঙ্গে নেবে একজোড়া ভাল স্কি।’
‘জী, স্যর।’
‘অবশ্য, তার আগে মেয়েটাকে নিয়ে হাজির হবে লণ্ডনে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের হেডকোয়ার্টারে।’
বুড়োটার কি মাথা খারাপ হয়ে গেল, ভুরু কুঁচকে ফেলল রানা। উনি কি ভাবছেন ওর সঙ্গে কোন মেয়ে আছে? আর তাকে নিয়ে হাজির হতে হবে বসের সামনে?
‘স্যর, সঙ্গে করে কোন মেয়েকে নিয়ে আসব?’
‘যে চলেছে তোমার সঙ্গে স্পেনে। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের নার্কোটিক ডিভিশনে কাজ করে, নাম মারিয়া হ্যারল্ড। সিয়েরা নেভাডায় গিয়ে এক লোকের সঙ্গে দেখা করবে তোমরা। পরে এ-বিষয়ে ব্রিফ করব। আগে হাওয়াই দ্বীপ ত্যাগ করে চলে যাও এনসেনাডায়।’
‘স্যর, এনসেনাডা তো বাজা ক্যালিফোর্নিয়ায়।’
‘হ্যাঁ, খুব ছোট এক জেলে-শহর।’
আগেও ক’বার মেক্সিকোয় গেছে রানা। মহাসাগরের তীরে জেলে-শহর বা গ্রামের পরিবেশে শুঁটকি মাছের চিমসে বাজে গন্ধের কথা মনে পড়ে গেল ওর।
‘তুমি মারিয়া হ্যারল্ডকে পিক করে ফিরবে লণ্ডনে। শুনেছি ড্রাগের চালানের রুট জানার বিষয়ে সে সত্যিকারের প্রতিভা।’
‘স্যর, সেক্ষেত্রে আমার নিজের কাজ আসলে কী হবে?’
‘তুমিই তো তোমাদের দু’জনের দলের লিডার। তোমরা ড্রাগ লর্ড রোমিয়ো মোরেলির কাছ থেকে এক বা একাধিক মাইক্রোফিল্ম সংগ্রহ করবে। শুনেছি পুরনো আমলের ধ্যান- ধারণার মানুষ সে। স্মার্টফোন বা কমপিউটার ব্যবহার করে না। মাফিয়ার খুনিরা গলা ফাঁক করে দেয়ার আগেই তার কাছ থেকে বুঝে নেবে সব। অবশ্য তোমার প্রথম কাজ এখন এনসেনাডার লা ক্যাসা ভার্দে মোটেলে গিয়ে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করা।’
‘জী, স্যর। যত দ্রুত সম্ভব লণ্ডনে পৌঁছে যাব আমরা।’
‘ব্রিটেনে ফিরে বিবাহিত দম্পতি হিসেবে পশ কোন হোটেলে উঠবে। আমি এখন লণ্ডনেই আছি। আমার ফোন পেলে চলে আসবে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের হেডঅফিসে। আরও কিছু জানতে চাও?
‘জী-না, স্যর।’
‘তুমি এয়ারপোর্টে গেলেই মেক্সিকোর ভিসার ব্যবস্থা করবে সৈয়দ শাহ্ আতিকুল্লাহ্। সিকিয়োর ই-মেইলে জরুরি কিছু তথ্য পাবে। বিমানে উঠে ওগুলো পড়ে নিয়ো।’
টিট করে একটা আওয়াজ হতেই কেটে গেল লাইন। মাত্র ক’দিন আগে মরুময় দেশ মরোক্কো থেকে হাওয়াই দ্বীপে উড়ে এসেছে রানা। অথচ আজই আবার এখান থেকে বিদায় নিতে হবে। স্মার্টফোন রেখে ইণ্টারকমে হোটেল ডেস্ক ক্লার্ককে জানাল ও, যাতে ওর বিল রেডি করে সে। এবার কল দিল এয়ারপোর্টে। ওখান থেকে জানানো হলো, মাত্ৰ দু’ঘণ্টা পর এনসেনাডার উদ্দেশে রওনা হচ্ছে অ্যাওরোমেক্সিকো এয়ারওয়েইযের ছোট এক বিমান।
চট্ করে নাস্তা সেরে লাগেজ গুছিয়ে নিলে ওই বিমানে করে দুপুরের আগেই এনসেনাডায় পৌঁছে যেতে পারবে, কাজেই দেরি না করে বিমানের টিকেট বুক করল রানা।
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন