কাজী আনোয়ার হোসেন
ছয়দিন আগে বিসিআই হেডকোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে গেছে মাসুদ রানা। এরপর তিনদিন আগে পাকিস্তানের ইসলামাবাদে পাঁচজনের দুর্ধর্ষ একটি দল বেশ ক’টা গ্রেনেড ফাটিয়ে আর একে ফরটি-সেভেন অ্যাসল্ট রাইফেলের গুলিবর্ষণে খুন করেছে হাকিমুল রাজার কিলার টিমের আট সদস্যকে। অবশ্য কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে হাকিমুল রাজা।
সশস্ত্র সেই অচেনা পাঁচ যুবক যে ইসলামিক কোন জঙ্গি দলের সদস্য নয়, সেটা ভাল করেই জেনে গেছে পিসিআই- এর কর্মকর্তারা। তবে তাদের সাধ্য হয়নি পাকিস্তানের লাখ লাখ পুলিশ ও মিলিটারি পারসোনেলকে লেলিয়ে দিয়ে সেই বেপরোয়া যুবকদেরকে গ্রেফতার করা। পাকিস্তানের পশ্চিম সীমান্ত পার হয়ে ইরানে ঢুকে অদৃশ্য হয়ে গেছে ওরা।
এরপর একে একে পার হয়ে গেছে আরও তিনটে দিন। বিসিআই হেডকোয়ার্টার ত্যাগ করার পর ষষ্ঠ দিনে উত্তর আফ্রিকায় মরোক্কোর রাজধানী রাবাতে গতকাল স্যাভয় লে গ্র্যাণ্ড হোটেলের বিলাসবহুল এক সুইটে উঠেছিল মাসুদ রানা। তবে এখন আর সেখানে নেই ও। ভয়ঙ্করভাবে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে ওর সুইট। দু’পাশের দুই সুইটের অতিথিরা আহত হয়েছেন গুরুতরভাবে।
নকল এক পাসপোর্ট দেখিয়ে হোটেলের রেজিস্ট্রি খাতায় নিজের নাম লিখেছিল রানা: সৈয়দ আসাদ জায়েদ। ঠিকানা: ২৮ নং ফ্লাওয়ার গার্ডেন, খাইবান-এ-রুমি, ব্লক এইট, ক্লিফটন, করাচি, সিন্ধ, পাকিস্তান। ব্যবসায়ী মানুষটি এসেছিল মরোক্কোয় অত্যাধুনিক জার্মান প্রিন্টিং মেশিন বিক্রি করার উদ্দেশে। গতকাল গভীর রাতে হোটেল থেকে বহু দূরে সরে যাওয়ার পর, পান-সিগারেটের ছোট্ট এক টং দোকানের পাশে থেমে রেডিয়োর বরাতে রানা জেনে গেছে, রাবাতের পুলিশ ডিপার্টমেণ্ট ধারণা করছে, স্যাভয় লে গ্র্যাণ্ড হোটেলে প্রচণ্ড সেই বিস্ফোরণে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে করুণভাবে মারা গেছেন মিস্টার সৈয়দ।
গতকাল গভীর রাতে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের তাগিদে চট্ করে ঘুম ভেঙে গেল রানার। মনে চরম অস্বস্তি নিয়ে বাতি না জ্বেলে সার্চ করতে লাগল ওর বেডরুম। একটু পর বিছানার নিচে উঁকি দিতেই দেখতে পেল দপ দপ করে জ্বলছে বৃত্তাকার এক ডায়ালের ভেতরে গোটা কয়েক লাল সংখ্যা!
ডায়ালের সঙ্গে আছে কৎবেলের সমান আকারের সাদাটে কাদার মত একদলা প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ!
ওটা বিস্ফোরিত হবে মাত্র বাইশ সেকেণ্ড পর!
এদিকে ডায়াল আর ডেটোনেটর আছে রানার হাতের নাগালের বহু দূরে দেয়ালঘেঁষা নিচু বেডের ফ্রেমের ওদিকে। হামাগুড়ি দিয়ে ওখানে ঢুকতে পারবে না ও!
তখনই একলাফে উঠে দাঁড়িয়ে চার সেকেণ্ডে রানা পৌঁছে গেছে সুইটের সদর দরজার কাছে। পরের দুই সেকেণ্ড ব্যয় করেছে দরজাটা খুলতে। এরপর ষোলো সেকেণ্ডে করিডোর’ ধরে তীরবেগে ছুটে সরে গেছে চার ঘর দূরে। আর এরপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে থরথর করে কেঁপে উঠল গোটা হোটেল। তখন কোথাও না থেমে একছুটে নিচতলায় নেমে এসেছে রানা। নির্জন কিচেনে ঢুকে পেছন-দরজা খুলে পা রেখেছে সামনের’ সরু গলিতে। গভীর রাতে গিয়ে উঠেছে রানা এজেন্সির মরোক্কো শাখার চিফ (অব.) ক্যাপ্টেন গোলাম কাদেরের ফ্ল্যাটে।
এরপর ভোরে এসে পৌঁছেছে বর্তমান এই অ্যাপার্টমেন্ট ভবনের পাঁচতলায় ভাড়া নেয়া এই ফ্ল্যাটে। গত তিনদিন ছদ্মনামে এই সেফহাউসটাতে ছিল বিসিআই-এর যুগল এজেন্ট তানিম জাফরি আর তার স্ত্রী জ্যোৎস্না জাফরি। ওদের কাজ ছিল মুখোমুখি এক অ্যাপার্টমেন্টের ওপরে চোখ রাখা। অবশ্য আজ রাত তিনটেয় ওরা গিয়ে উঠেছে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি বাংলার মহাবিক্রম-এর একটি ডাবল-বেড কেবিনে। ভোর চারটায় বাংলাদেশের উদ্দেশে রাবাত বন্দর ছেড়ে রওনা হয়ে গেছে জাহাজটা।
রানার এই ছোট্ট ফ্ল্যাটের জানালা দক্ষিণমুখী হলেও ঘরে ঢুকছে না একফোঁটা বাতাস। মাত্র ক’দিন আগে জানা গেছে, নিচের গলির উল্টোদিকের বাড়িটার পঞ্চমতলা সেফহাউস হিসেবে দু’বছর ধরে ব্যবহার করছে পিসিআই। গত তিনদিন ধরে ছুটা কাজের মেয়েটাকে মোটা অঙ্কের দিরহাম ঘুষ দিয়ে পিসিআই সেফহাউসের ড্রয়িংরুমের জানালা খুলিয়ে রেখেছে গোলাম কাদের। ওর নির্দেশ মত ফ্যাকাসে সবুজ পর্দা সরিয়ে. দিয়েছে মেয়েটা।
এখন নিজের ফ্ল্যাটের জানালার কাছে চেয়ারে বসে ওদিকের ঘরের দিকে চেয়ে আছে রানা। গতকাল সন্ধ্যায় কাজের মেয়েটা বাতি নিভিয়ে বিদায় নেয়ার পর থেকে ড্রইংরুমে বিরাজ করছে ঘুটঘুটে কালো আঁধার। রানার সামনে ট্রাইপডে বসে আছে স্কোপওয়ালা পুরনো এক রেমিংটন রাইফেল। মেলা বয়স হলেও তুলনা নেই ওটার। যত্নের সঙ্গে জিরো-ইন করে দিয়েছে রানার সাগরেদ রানা এজেন্সির তুখোড় অপারেটর, মার্ক-ম্যান রামিন রেজা। ওর ওপর ভরসা রাখা যায় যে, এক হাজার গজের ভেতরে নিখুঁতভাবে লক্ষ্যভেদ করবে ওর রাইফেলটার ৩০৮ বুলেট।
মাসুদ ভাই! হাক্কুর সঙ্গে লাল মুলোর মত অচেনা এক ঢ়েঙা শ্বেতাঙ্গ,’ নিচতলায় নোয়াখালির রশিদ আলীর ছোট্ট ইলেকট্রনিক্সের দোকানে বসে ওয়াকি-টকিতে জানাল গোলাম কাদের। ‘এখন সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। বোধহয় সোজা গিয়ে ঢুকবে ফ্ল্যাটে। প্রথম ঘরটাই ড্রইংরুম। তবে জানালার দিকে চোখ গেলে হয়তো সরাসরি দেখবে আপনাকে।’
‘ঠিক আছে, নিচে বসে চারপাশে চোখ রাখো,’ শান্ত স্বরে বলল রানা।
‘জী, মাসুদ ভাই।’ খুট শব্দে কেটে গেল সংযোগ।
লাল মুলো বোধহয় জন মিউলার, ভাবল রানা।
সিআইএ-র এই হারামি এজেন্টের সঙ্গে মাখামাখি আছে হাকিমুল রাজার। অবশ্য দু’জনই তারা জানে, যার যার দেশের স্বার্থে দেরি করবে না পরস্পরকে পা বাড়িয়ে ল্যাং মেরে ফেলতে। পাকিস্তানি জান্তাদের চোখ আমেরিকার মিলিটারি হার্ডওয়্যার ও মোটা অঙ্কের আর্থিক সহায়তার ওপরে। ওদিকে আমেরিকার চাই সন্ত্রাসী দেশটির কাছ থেকে তালেবান গোষ্ঠীর বিষয়ে জরুরি সব তথ্য ও উপাত্ত। আফগানিস্তান থেকে লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে হয়েছে তাদেরকে। আমেরিকার সরকার স্বভাবে চরম স্বেচ্ছাচারী হলেও খুব খুশি হবে নতুন তালেবান নেতৃত্বকে কঠোরভাবে শায়েস্তা করার সুযোগ পেলে।
জন মিউলারের কথা ঘুরেফিরে আবারও মনে এল রানার। স্যাভয় লে গ্র্যাণ্ড হোটেলে ওর সুইটে বোধহয় বোমা রেখে গেছে ওই লোকটাই। সিআইএ-র হিংসুটে এই এজেন্ট বহুদিন ধরে চাইছে ওকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে সেজন্যে ক’বার আড়াল থেকে হামলা করলেও সফল হয়নি।
স্কোপের ভেতর দিয়ে সামনের আঁধার ড্রয়িংরুম দেখছে রানা। ফ্ল্যাটের সদর দরজা খুলে সামান্য ডানে সরলে হাকিমুল রাজা পাবে বৈদ্যুতিক সুইচের বোর্ড। আর আশা করা যায়, সে একবার বাতি জ্বেলে নিলে দুই গুলিতে তাকে আর জন মিউলারকে দুনিয়াছাড়া করতে পারবে রানা।
এক এক করে পেরোল পুরো দু’মিনিট। এরপর স্কোপে সরু একচিলতে সাদা আলো দেখতে পেল রানা। ভেতরের দিকে বামে খুলে যাচ্ছে সামনের ফ্ল্যাটের দরজা। প্রথমে এসে ঢুকল মাঝারি আকারের এক লোক। ডানে সরে এসে হাতড়াতে শুরু করেছে বৈদ্যুতিক বাতির সুইচবোর্চ প্রথমজনের পেছনে ফ্ল্যাটে পা রেখেছে দ্বিতীয়জন।
সুইচ পেয়ে হাকিমুল রাজা জ্বেলে নিল সাদা টিউব লাইট। সে ঘুরে দাঁড়াতেই তার মুখোমুখি হলো লালচে চেহারার দ্বিতীয় লোকটা। লম্বায় সে হাকিমুলের চেয়ে অন্তত ছয় ইঞ্চি উঁচু। সঙ্গীর ঠোঁটে চুমু দেয়ার জন্যে নেমে এস মিউলারের ভারি কামুক ঠোঁট। বিসিআই-এর ডেটা প্রসেসিং ব্রাঞ্চের চিফ রাশেদ আশরাফের তথ্য অনুযায়ী: পিসিআই এজেন্ট (অব.) কর্নেল হাকিমুল রাজা ও আমেরিকান সিআইএ এজেন্ট জন মিউলার দু’জনেই বহুদিনের সমকামী।
স্কোপের ভেতর দিয়ে সরাসরি চেয়ে আছে রানা। পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে পাকিস্তানি এজেন্টের তুলে ধরা মুখে নেমে এল সিআইএ এজেন্টের মুখ। রানাকে খতম করে মহাফূর্তিতে আছে তারা। এবার বোধহয় বেডরুমে গিয়ে একদফা মৌজ না করলেই নয়!
মিউলারের মোটা মাথার গোড়ায় স্কোপের ক্রস-হেয়ার তাক করল রানা। ধীরে ধীরে ট্রিগারে চেপে বসল ওর তর্জনী। পরক্ষণে আলতো স্পর্শে ছিটকে গেল . ৩০৮ বুলেট। এক সেকেণ্ডের দশ ভাগের এক ভাগ সময়ে চারপাশে ছড়িয়ে গেল বিকট ‘কড়াৎ!’ আওয়াজ। স্কোপের ভেতর দিয়ে চেয়ে আছে রানা। ফেটে গেছে আকাশ থেকে পড়া মাঝারি তরমুজের মত মিউলারের মাথা। সামনে হোঁচট খেয়ে কাত হয়ে কাটা কলাগাছের মত ধুপ করে মেঝেতে পড়ল তার লাশ। পরের সেকেণ্ডে রক্তাক্ত, ক্ষত-বিক্ষত চেহারায় মৃত মিউলারের পাশে লুটিয়ে পড়ল হাকিমুল রাজার মৃতদেহ।
রানার এক ঢ়িলে খতম হয়ে গেছে দুই পাখোয়াজ ঘুঘু!
আপাতত কাজ শেষ বিসিআই এজেন্টের। ট্রাইপডে রাখা রেমিংটন রাইফেল থেকে পিছিয়ে ধীরেসুস্থে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রানা। ঘর থেকে বেরিয়ে সোজা গিয়ে খুলল ফ্ল্যাটের সদর দরজা। হাত থেকে রাবারের গ্লাভস দুটো খুলে গুঁজে রাখল প্যান্টের পকেটে। দ্রুত নেমে এল নিচতলায়। গলিতে বেরিয়ে এসে হেঁটে চলল বড় রাস্তার দিকে। দূরে শুনতে পেল পুলিশের গাড়ির একাধিক সাইরেন। রানাকে পাশ কাটিয়ে হনহন করে আরেক গলিতে গিয়ে ঢুকল গোলাম কাদের। একবার ওদিকে চেয়ে নিয়ে হাঁটার গতি বাড়াল রানা। ভাল করেই জানে, কর্নেল হাকিমুল রাজার আকস্মিক মৃত্যু এবং স্যাভয় লে গ্র্যাণ্ড হোটেলের সুইটে ওর লাশের চিহ্নমাত্র না পেয়ে উন্মাদ হয়ে উঠবে পিসিআই-এর কর্মকর্তারা। চারপাশে পাঠাবে রেড অ্যালার্ট: ফ্রম নাউ অন ড্রপ ইয়োর অল আদার মিশস্! গিভ ইয়োর ফুল অ্যাটেনশন টু কিল দ্য বাস্টার্ড বিসিআই এজেন্ট মাসুদ রানা!
তাদের সঙ্গে দল পাকিয়ে রানাকে খুঁজে বেড়াবে সিআইএ-র শতখানেক এজেন্ট। আর এমনটা হবে ভেবেই নিখুঁত এক নকল পাসপোর্ট বিসিআই থেকে রানাকে পাঠিয়ে দিয়েছেন মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান।
যেহেতু প্রদীপের তলা সবসময় অন্ধকার, সেই গূঢ় নিয়ম মেনে আজ দুপুর বারোটায় কেএলএম-এর এক বিমানে চেপে ব্যবসার জরুরি কাজে আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপে চলেছেন ভারতীয় শর্ষে-তেল ব্যবসায়ী সুপ্রিয় সোমনাথ সাহা।
আপাতত বেশকিছু দিনের জন্যে গভীর অতলে ডুবে যেতে হচ্ছে তাঁকে!
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন