ব্ল্যাক লিস্ট – ৮

কাজী আনোয়ার হোসেন

আট

অন্যের মগজে নিজের চিন্তা গোপনে পাঠিয়ে দেয়া নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এ-পৃথিবীতে। তবে ইএসপি নিয়ে সত্যিকার কোন প্রমাণ আজও কেউ দেখাতে পারেনি। এখন মারিয়ার দিকে চেয়ে প্রাণপণে নিজের ইচ্ছে তার মগজে গুঁজে দিতে চাইছে রানা। মনে মনে বলছে, ‘এলিনা পার্কারসনের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দাও, মারিয়া! তুমি হচ্ছ দলের ভাল মানুষটা! আর আমি চিরকালের বাজে লোক!

ওর চোখে চেয়ে আছে মারিয়া। কী ভাবছে সেটা সে-ই জানে! রোমান্টিক কিছু হতে পারে। লালচে হলো গোটা মুখ।

মারিয়ার মগজে নিজের মনের কথা পাঠাতে না পেরে বেশ হতাশ হয়ে গেছে রানা। বুঝতে পারছে, মেয়েটা বোধহয় ভাবছে ওকে নিয়ে নোংরা কিছু ভাবছে লোকটা!

মহাঝামেলায় পড়েছি তো! তিক্ত মনে ভাবল রানা। ঘুরে তাকাল এলিনার দিকে। আরও কঠোর সুরে বলল, ‘কোনভাবেই মোরেলির সঙ্গে আর দেখা করব না আমরা! খেলা খতম তোমাদের! প্রথম থেকেই মিথ্যা বলেছ! কাজেই মিটিং করতে গিয়ে কোন ধরনের ঝুঁকি নেব না আমি!’

চোখ সরু করে রানার দিকে চেয়ে আছে মারিয়া। দ্রুত কী যেন হিসাব কষছে। ‘এক মিনিট!’ কয়েক সেকেণ্ড পর চট্‌ করে বলল সে। ‘এটা কি ঠিক হবে যে মোরেলির সঙ্গে দেখা না করেই স্পেন ছেড়ে চলে যাব আমরা?’

ফোঁপানি থামিয়ে. চোখে একরাশ আশা নিয়ে মারিয়ার দিকে তাকাল এলিনা।

বাগানের সুন্দর ফুলে বিশ্রী এক শুঁয়োপোকা কিলবিল করতে দেখলে যেভাবে ভুরু কুঁচকে ওটার দিকে তাকায় মানুষ, সেভাবে কঠোর চোখে মারিয়াকে দেখল রানা। ‘দেখা না করে চলে গেলে অসুবিধে কী আমাদের?’ রাগী গলায় বলল,

‘প্রথম থেকেই তো এরা মিথ্যা কথা বলছে!’

‘কিন্তু মোরেলি যেসব তথ্য দেবে বলেছে, তার কী হবে?’

‘ওগুলো না পেলেও আমাদের চলবে।’

‘তোমার হয়তো লাগবে না,’ নরম সুরে বলল মারিয়া। ‘তবে আমার লাগবে! আমি নিজের কাজ থেকে পিছিয়ে যেতে চাই না! আমি ঝুঁকি নিতে দ্বিধা করব না!’

ওদের নাটক কেমনভাবে দেখছে এলিনা, সেটা চট্ করে দেখে নিল রানা। লন টেনিস ম্যাচে দর্শকেরা যেভাবে মাথা এদিক-ওদিকে ঘুরিয়ে খেলোয়াড়দের খেলা দেখে, সেভাবে একবার মারিয়া, আরেকবার ওকে দেখছে মেয়েটা।

‘দেরি না করে আমার বসকে জানিয়ে দেব, আমরা বাতিল করে দিচ্ছি মিশন!’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল রানা।

এবার সত্যিই যেন বিরক্ত হলো মারিয়া। ‘আমি মোরেলির সঙ্গে দেখা করতে চাই। এই মিটিং থেকে হয়তো অনেক কিছুই আমরা জেনে নিতে পারব!’

‘এ-মেয়ের সামনে আমাদের আলাপ করা ঠিক হচ্ছে না।’ আরও গম্ভীর হয়ে গেল রানা।

‘এলিনা পার্কারসন কী শুনছে, তাতে আমার কিচ্ছু যায় আসে না! আমি আমার অ্যাসাইনমেন্টে সফল হতে চাই!’

দলে বিভক্তির ফলাফল কেমন হবে, সেটা নিয়ে যেন চিন্তায় পড়ে গেছে রানা। কয়েক সেকেণ্ড পর বলল, ‘তুমি কি তা হলে সত্যিই মোরেলির সঙ্গে দেখা করতে চাও?’

মাথা দোলাল মারিয়া। ‘অবশ্যই! ইয়টে তুমি যাওয়ার পর সব গুবলেট হয়ে গেল। তবে তার অর্থ এমন নয় যে…

মারিয়াকে বাধা দিয়ে এলিনার দিকে চেয়ে বলল রানা, ‘আর তুমি, এলিনা? তুমি কোন্ নিশ্চয়তা দেবে যে এবার সিয়েরা নেভাডায় গেলে সত্যিকারের মোরেলির সঙ্গে আমাদের দেখা হবে?’

‘আমি তো আগেই বলেছি! সমস্ত তথ্য হাতে পেলেই তোমরা বুঝবে, কোনকিছু গোপন করা হয়নি।’

উদাস ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

তাতে রেগে গিয়ে বলল মারিয়া, ‘যেভাবে হোক মোরেলির সঙ্গে আমি দেখা করব। এটা আমার দেশের জন্যে খুবই জরুরি।’

লক্ষ্মী মেয়ে, মনে মনে হাসল রানা। কঠোর চেহারায় এলিনার দিকে ঝুঁকে পড়ল। ‘ঠিক আছে, শেষবারের মত তোমাদেরকে আরেকটা সুযোগ দিলাম আমি।’

স্বস্তি বোধ করে চোখ বুজল এলিনা, মুখে অপূর্ব সুন্দর এক চিলতে হাসি।

‘তবে আমাদের সঙ্গে পূর্ণ সহায়তা করবে তুমি, এলিনা, ‘ বলল রানা। ‘ধরে নেয়ার কোন কারণ নেই যে বাড়ি ফিরে গেছে সেই খুনি। তোমাকেও হয়তো শেষ করে দিতে চাইবে সে।’

ভুরু কুঁচকে গেল মারিয়ার। ‘কিন্তু সেটা করবে কেন? তাকে তো টাকা দেয়া হয়েছে মোরেলিকে শেষ করার জন্যে। সে তো নিজের কাজ শেষ করেছে।’

‘তা নয়, খুনি জেনে নেবে মোরেলি আসলে খুন হয়নি। মাফিয়া কমিশনও জানবে, মারা যায়নি সে। আর তখন এলিনাকে মুঠোর ভেতরে ভরতে চাইবে খুনি। অথবা ওর পিছু নিয়ে হাজির হবে মোরেলির কাছে।’

ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেল এলিনার।

‘এ-ঘরের সামনে একজন গার্ড রাখব,’ বলল রানা। ‘এ-ব্যাপারে কথা বলব স্মিথের সঙ্গে।’

‘কিন্তু পেশাদার খুনি তো যেখানে-সেখানে হাজির হতে পারে,’ বলল মারিয়া, ‘গার্ড কীভাবে বুঝবে যে কখন আসবে হামলা?’

ভুরু কোঁচকাল রানা। ‘আমাদের জানা নেই কে আসলে খুনি। তাই নার্স ও ডাক্তার ছাড়া আর কাউকে এ-রুমে ঢুকতে দেয়া হবে না।’

ব্যথায় মুখ কুঁচকে আবারও উঠে বসল এলিনা। ‘কিন্তু আমরা ঠিকই জানি, কে আসলে সেই খুনি।’

‘কী করে জানলে?’ ওর দিকে তাকাল মারিয়া।

‘তার কথা আমরা আগেই জেনেছি। পেশাদার খুনি সে। নাম অ্যালবার্ট কিউলেক।’

‘তার কথা তুমি কীভাবে জানলে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।

‘আণ্ডারওঅর্ল্ডের সবাই তাকে বলে কিউলেক্স মশা। ছয় মাস আগে একবার কর্সিকায় এসেছিল মোরেলির ভিলায়। ওই বাড়িতে আছে নানান ধরনের ফাঁদ। দেয়ালে দেয়ালে আধুনিক সব ডিভাইস। তাই শেষমেশ আর ঢুকতে পারেনি একটা তারে পা দেয়ায় ক্যামেরায় উঠেছিল তার ইনফ্রারেড ছবি। ওটা ডেভেলপ করে মোরেলি জেনেছে, ওর ওপরে হামলা করতে এসেছিল পেশাদার খুনি কিউলেক্স।’

‘কিউলেক্সকে আগে থেকেই চেনে মোরেলি?’ জানতে চাইল রানা।

‘না, কখনও সামনা-সামনি দেখা হয়নি ওদের। তবে মোরেলির এক লোক চিনত কিউলেক্সকে।

‘তার মানে নিজ চোখে কখনও ড্রাগ লর্ডকে দেখেনি কিউলেক্স। অর্থাৎ সে ধরে নিয়েছে খুন হয়েছে মোরেলি?’

মাথা দোলাল এলিনা। ‘আমি আগে কখনও এটা ভেবে দেখিনি। তবে কথাটা ঠিক বলেই তো মনে হচ্ছে।’

‘কিউলেক্স সম্পর্কে আরও কিছু তোমার জানা আছে?’ বলল রানা। ‘এমন কিছু, যেটা থেকে তাকে ধরা যাবে?

গোলাপি হয়ে গেল এলিনার গাল। বিড়বিড় করে বলল, ‘শুনেছি মেয়েদেরকে খুব পছন্দ করে সে।’

‘আরও কিছু?’ জানতে চাইল রানা।

ব্রিত চেহারায় বিড়বিড় করল এলিনা, ‘শুনেছি একই সময়ে বিছানায় দুটো করে মেয়েকে নেয় সে।’

‘তা-ই?’ খুক খুক করে কাশল রানা।

‘এটা খুব অপমানজনক,’ গম্ভীর কণ্ঠে বলল মারিয়া।

এলিনার দিকে তাকাল রানা। ‘তার মানে সে ট্রিপল- ডেকার সেক্স করে?

‘হ্যাঁ,’ চোখ নামিয়ে নিল এলিনা। ‘প্রতিবার কাউকে খুন করার আগে সেটা করে। তাতে নাকি মন ভাল থাকে তার।’

‘সে আমাদেরকে খুঁজে নেয়ার আগেই, এই তথ্য থেকে হয়তো আমরা তাকে খুঁজে নিতে পারব,’ বলল রানা।

‘আমাদেরকে খুঁজে নেবে… মানে?’ অবাক চোখে ওর দিকে তাকাল মারিয়া।

‘ড্রাগ লর্ডের চেহারা চেনে না সে।’ জানালার বন্ধ কাঁচের দিকে তাকাল রানা। ‘কাজেই এবার আমাদের পিছু নিয়ে মোরেলির কাছে যেতে চাইবে সে।’

উজ্জ্বল হয়ে উঠল মারিয়ার চোখ-মুখ। ‘তা হলে আমাদের বোধহয় উচিত হবে ম্যালাগায় ফূর্তি করে বেড়ানো। সেক্ষেত্রে আমাদের ফাঁদে হয়তো পড়বে সে।’

‘না, মাথা নাড়ল রানা। ‘নিজেরা ফাঁদে পড়তে চাই না। তার আগেই খুঁজে বের করব তাকে।’ এলিনার দিকে তাকাল ও। ‘এবার বলো কীভাবে যোগাযোগ করবে মোরেলির সঙ্গে।’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল এলিনা। ‘নিজেই আমার সঙ্গে কথা বলবে মোরেলি। তার আগে তোমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে।’

‘কিন্তু তুমি যে স্পেশাল এই ক্লিনিকে আছ, সেটা মোরেলি জানবে কীভাবে?’ জানতে চাইল মারিয়া।

‘ঠিকই জেনে নেবে,’ হালকা করে কাঁধ ঝাঁকাল এলিনা। ‘এতে মনে কোন সন্দেহ রাখবেন না।’

‘স্কি রিসোর্টে গিয়ে বোকার মত অপেক্ষা করতে চাই না,’ বলল রানা।

‘ডাক্তার বলেছেন দু’চার দিনের ভেতরে আমাকে ছেড়ে দেবেন,’ বলল এলিনা। ‘তাই এক বা দু’দিন আগে তোমরা ওখানে চলে গেলে তাতে কোন ক্ষতি নেই।’

‘আমরা আপাতত ম্যালাগাতেই থাকছি,’ বলল রানা, ‘শেষ করতে চাই কিউলেক্সকে। সেক্ষেত্রে নিশ্চিন্তে দেখা করতে পারব মোরেলির সঙ্গে।’

এলিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এল রানা ও মারিয়া। করিডরে এখন কেউ নেই। আশপাশের বেশকিছু কেবিন থাকলেও এই তলায় কোন অফিস নেই। সিঁড়ি বেয়ে রিসেপশনে নেমে এল ওরা। একটা সোফায় বসে নতুন একটা সিনে ম্যাগাযিনে চোখ বোলাচ্ছে বার্টি। রানাকে দেখে উঠে দাঁড়াল। ‘কথা শেষ তোদের?’

‘চল, এবার ফেরা যাক,’ বলল রানা। ‘মারিয়াকে হোটেলে পৌঁছে দেয়ার পথে আলাপ সেরে নেব।’

একটু পর গলি থেকে বেরিয়ে ফিয়াট গাড়িতে উঠল ওরা। গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে হোটেলের দিকে চলল বার্টি। ক্লিনিকের কেবিনে এলিনার সঙ্গে কী ধরনের কথা হয়েছে, সংক্ষেপে ওকে জানাল রানা। ফলে ম্যালাগার কমাণ্ড্যান্টের কাছে ফোন দিল বার্টি। তাতে স্থির হলো, এখন থেকে এলিনার ওপরে চোখ রাখবে গার্ডিয়া সিভিলের দু’জন সদস্য। ফোন রেখে গাড়ি চালাতে চালাতে বন্ধুর দিকে তাকাল বার্টি। ‘ম্যালাগায় কিউলেক্স পা রাখলে সে খবর আমি ঠিকই পেতাম। তোদের কোন ভুল হচ্ছে না তো?’

‘হচ্ছে না,’ বলল রানা। ‘এটা নতুন খবর।’

‘তা হলে তোর বোধহয় একবার ঢুঁ দেয়া উচিত ম্যালাগার আণ্ডারওঅর্ল্ডে,’ বলল বার্টি।

‘সেটা কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

‘বস্তি এলাকা বলতে পারিস। আবার ওখানেই আছে একের পর এক দারুণ সব নাইট ক্লাব। সেখানে গেলে হয়তো জানবি ম্যালাগায় সত্যিই এসেছে কি না কিউলেক্স। এক কাজ কর, মারিয়াকে নিয়ে ঢুঁ দে নাইট ক্লাবগুলোতে। তোরা বড়লোক ট্যুরিস্ট। পরনে দামি পোশাক। যাতে বিপদ না হয়, সেজন্যে তোদের সঙ্গে থাকবে একজন বডিগার্ড। এমনই একজনকে ভাল করেই চিনি। তোদের হয়ে এখানে- ওখানে খোঁজ নেবে। নাম ওর পেদ্রো রামিরেজ। সন্ধ্যায় তোদের হোটেলে তাকে পাঠিয়ে দেব।’

একবার মারিয়ার দিকে তাকাল রানা, তারপর বাটিকে বলল, ‘আমি কিউলেক্সের কাছে পৌঁছে যেতে চাই।’

বাকি পথ ওদের ভেতরে আর কোন কথা হলো না।

ওদেরকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে চলে গেল বার্টি। ওরা সুইটে ফিরতে না ফিরতেই রানার কাছে এল একটা ফোন। ‘ঠিক আছে, রামিরেজের সঙ্গে কথা হয়ে গেছে,’ জানাল বার্টি।

‘গুড,’ খুশি হলো রানা।

‘সে দৈর্ঘ্যে পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ভদ্রলোকের মত চেহারা। ঠোঁটের ওপরে পেন্সিল গোঁফ। খুব বুদ্ধিমান। ভাবচক্কর দেখে বোঝা যায় না যে দরকার হলে নির্দ্বিধায় মানুষ খুন করে।’

‘আমার তাতে কোন সমস্যা নেই,’ বলল রানা।

‘আরেকটা কথা। এইমাত্র ইন্টারপোল থেকে একটা তথ্য পেলাম।’

‘ইন্টারপোল?’

‘হ্যাঁ। ইয়টে মৃত লোকটার ছবি ওদেরকে দিয়েছিলাম। ওরা বলছে, লোকটা রোমিয়ো মোরেলি নয়। সত্যি সত্যিই সে বাস্তিলো দে ভ্যানারি।’

‘অর্থাৎ, মিথ্যা বলছে না এলিনা পার্কারসন,’ বলল রানা।

‘তাই তো দেখছি। দেখ, রাতে কিছু জানতে পারিস কি না। গুড লাক!’

.

সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসতেই লবিতে নেমে এল রানা ও মারিয়া। ঘরের পেছনদিক থেকে এসে ওদের সামনে থামল এক লোক। দৈর্ঘ্যে সে হবে বড়জোর পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ভদ্রলোকের মত চেহারা। ঠোঁটের ওপরে পেন্সিলের মত গোঁফ। পরনে দামি স্যুট। তার সঠিক বর্ণনাই দিয়েছে বার্টি।

রানার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। ‘আমিই পেদ্রো রামিরেজ। আপনাদের আজকের গাইড।’

‘আমি স্যামি কিং,’ হাতটা ধরে ঝাঁকিয়ে দিল রানা। .’আর ইনি আমার স্ত্রী মারিয়া কিং।’

‘আমাদের সেনোরা কিং সত্যিই অপূর্ব সুন্দরী,’ মারিয়াকে বিরাট এক বাউ দিল রামিরেজ। ‘তাঁকে যিনি জীবনে পেয়েছেন, সত্যিই তাঁর ভাগ্য খুবই সুপ্রসন্ন।’

রানা দেখল আড়ষ্ট হয়ে গেছে মারিয়ার গম্ভীর চেহারা।

‘মিস্টার স্মিথ আমাকে বলেছেন, কী কারণে আজ রাতে বেড়াতে যাবেন আপনারা,’ চট্ করে একবার রানাকে দেখে নিল রামিরেজ।

‘বলুন তো, ঠিক কোথা থেকে শুরু করব?’ বলল রানা।

গড়গড় করে একের পর এক নাইট ক্লাবের নাম বলে গেল রামিরেজ। হোটেল থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি-ক্যাব নিল ওরা। পেছনের সিটে মারিয়ার পাশে বসল রামিরেজ। সামনের সিটে রানা। স্প্যানিশ ভাষায় মারিয়ার প্রশংসা করছে রামিরেজ। অবশ্য তাতে আলাপ জমাতে না পেরে কথা বলতে শুরু করল ইংরেজিতে। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল রানা।

ম্যালাগায় কোথা থেকে শুরু বস্তি এলাকা, আর তার শেষে নাইট ক্লাবের আরম্ভ, সেটা বোঝা বেশ কঠিন। প্রথমে সাগরতীরে বন্দরের কাছে শহরের লা ম্যালাগুয়েতা এলাকার এক রেস্টুরেন্টে ঢুকল রানা, মারিয়া ও রামিরেজ। কিছুক্ষণ আগে সাগরের পশ্চিমে ডুবে গেছে পোচ ডিমের লালচে কুসুমের মত সূর্য। রঙিন কাঁচের পিদিমে মোমবাতি জ্বেলে দিয়েছে ওয়েটাররা। ঘরের পেছনদিকের এক টেবিলে বসে সি-ফুড আর ওয়াইন অর্ডার করে ডিনার সেরে নিল ওরা।

‘আমার একটা কথা মনে হচ্ছে, রামিরেজ,’ বলল রানা।

‘বলুন?’ মৃদু হাসল যুবক। রহস্যময়তা পছন্দ করে সে।

‘আমি ভঙ্গি করব যে আমি এক ধনী ব্রিটিশ ট্যুরিস্ট,’ বলল রানা। ‘আর আপনার কাজ হবে আমাকে আর আমার স্ত্রীকে সবচেয়ে দামি নাইট ক্লাবে নিয়ে যাওয়া। দু’হাতে টাকা ছিটাব। কিন্তু স্ত্রীকে নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নই। সুন্দরী স্প্যানিশ মেয়েদেরকে বিছানায় নিতে চাই। আমি আবার মানসিকভাবে বিকৃত। তাই সেক্স করতে আমার লাগবে একই সঙ্গে দুটো মেয়ে।

কয়েক সেকেণ্ড ভেবে নিয়ে বলল রামিরেজ, ‘কিন্তু সেটা করবেন কীভাবে, সেনোর? আপনার সঙ্গে তো সর্বক্ষণ আছে সুন্দরী এই স্ত্রী!’

‘গোপনে আপনার সঙ্গে বিছানায় যাচ্ছে আমার স্ত্রী।’

কথাটা শুনে বেশ খুশি হয়ে হাসি দিল রামিরেজ। ‘বাহ্!’

‘আর আমরা যখন একই সঙ্গে বিছানায় যেতে রাজি এমন দুটো মেয়েকে পাব, টাকার বিনিময়ে জেনে নেব গত কয়েক দিনের ভেতরে কেউ ওদেরকে ভাড়া নিয়েছে না। বিশেষ করে গতরাতে।’

‘বুঝলাম,’ মাথা দোলাল রামিরেজ। ‘তা হলে, চলুন, প্রথম নাইট ক্লাব থেকে শুরু করি। দেখা যাক কী জানা যায়।’

ম্যালাগার প্রথম নাইট ক্লাবটাতে ঢুকল রানা, রামিরেজ ও মারিয়া। বেশিরভাগ ক্লাবের পরিবেশ প্রায়ান্ধকার। ছাত খুব নিচু। হলঘরে নেই কোন জানালা। চারপাশে ছোটসব টেবিল। ঘরের মাঝখানে মঞ্চ। ওখানে ছাত থেকে ঝুলছে শুকনো শেওলা, বেল্ট, দড়ি, মেয়েদের গার্ডার, জি-স্ট্রিং, ব্রা, চাবুক ইত্যাদি। গোপন কোথাও থেকে বাজছে স্টেরিয়ো মিউযিক। শক্তিশালী স্পিকার ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই আওয়াজ। চারপাশে দপ-দপ করে জ্বলছে রঙিন বাতি। দেয়ালে প্রজেক্ট করা হচ্ছে উলঙ্গ নারীর ছবি ও বিভিন্ন আসনে যৌনমিলনের নোংরা দৃশ্য।

একটু পর হঠাৎ করে নিভে গেল দপ-দপ করা বাতি। একে একে মঞ্চে উঠল ক’জন গিটার বাদক। তাদের সঙ্গে আছে এক ফ্ল্যামেনকো ড্যান্সার। বোঝা গেল না সে নারী নাকি পুরুষ।

মাঝরাত পর্যন্ত একে একে অন্তত আধ ডযন ক্লাব ছুঁড়ে ফেলল রানা, রামিরেজ ও মারিয়া। যদিও তাতে কোন লাভ হলো না। ষষ্ঠ ক্লাব থেকে বেরিয়ে রামিরেজের দিকে তাকাল হতাশ রানা। ‘এবার?’

এ তো বিপদের কথা, সেনোর,’ মাথা নাড়ল স্প্যানিশ যুবক। ‘কিছুই তো জানলাম না আমরা। একাকী পতিতা, জোড়া পতিতা; তিনজন মিলে মিলন করে যারা, তাদের সঙ্গেও তো কথা বলে দেখেছি! কিন্তু ওরা কেউ গত ক’দিনে একসঙ্গে কাজ করেনি। পরের কোন ক্লাবে হয়তো কপাল খুলতে পারে আমাদের।’

‘এমন ক্লাব আরও কয়টা আছে?’ জানতে চাইল রানা।

‘আর বেশি নেই,’ চোখ সরু করল রামিরেজ। ‘আমার মনে হয় এবার আমাদের যাওয়া উচিত টরেমোলিনোসে।’

‘ওটা আবার কোথায়?’

‘ম্যালাগার খানিক দক্ষিণে। ওটা কোস্তা দেল সোল-এ।’

‘ওখানেও এদিকের মত নাইট ক্লাব আছে?’

‘ওরা দেশের সেরা। কী নেই ওখানে!’

মৃদু মাথা দোলাল রানা। ‘বেশ, তা হলে ওখানে চলুন।’

রাত দেড়টার পর টরেমোলিনোসের প্রধান সড়কে প্রায় অন্ধকার এক নাইট ক্লাবে ঢুকল ওরা। বিশাল ঘরের দরজার কাছে ছাত থেকে ঝুলছে কয়েকটা খাঁচা। সেগুলোর ভেতরে আছে সিংহ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গরিলা, চিতাবাঘ ইত্যাদি।

ফসফরাসের মত কিছু দিয়ে পেইন্ট করা হয়েছে চেয়ার ও টেবিলে। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। ঘরের মাঝে ছোট এক স্টেজে নাচতে নাচতে ঘেমে-নেয়ে গোসল হয়ে যাচ্ছে এক পুরুষ ফ্ল্যামেনকো নর্তক। দেয়ালে প্রজেক্ট করা হয়েছে দুই লেসবিয়ানের যৌনক্রিয়ার চলচ্চিত্র। গিটারের সঙ্গে তাল রেখে দ্রুত গান গেয়ে চলেছে এক গায়িকা। সেই বিকট আওয়াজে প্রায় বধির হওয়ার দশা দর্শকদের। মারিয়া ও রামিরেজকে নিয়ে একটা টেবিল দখল করে স্যাংগ্রিয়ার অর্ডার দিল রানা।

একটু পর টেবিল ছেড়ে কোথায় যেন গেল রামিরেজ।

পরস্পরকে দেখল রানা ও মারিয়া, দু’জনই হতক্লান্ত।

কিছুক্ষণ পর কে যেন এসে হাত রাখল রানার কাঁধে। সতর্ক হয়ে ঝট করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকাল রানা। কাঁধের হোলস্টারের কাছে চলে গেছে হাত।

‘আমি বোধহয় পেয়ে গেছি ওদের, ঝুঁকে ওর কানে বলল রামিরেজ।

হাত বাড়িয়ে মারিয়ার বাহু স্পর্শ করল রানা। নীরবে বুঝিয়ে দিল বসে থাকতে। রামিরেজের পিছু নিল ও। নাইট ক্লাবের একদিকে ছোট এক দরজার কাছে ওকে নিল রামিরেজ। ওদিকে সরু করিডর। ওটা ধরে এগিয়ে পেছনদিকের এক ঘরে পা রাখল ওরা। ভেতরে পুরনো এক টেবিলের ধারে তিন ঠ্যাঙের চেয়ারে বসে আছে ময়লা ফ্ল্যামেনকো কস্টিউম পরা মাঝবয়সী এক মহিলা। ছাত থেকে ঝাপসা আলো দিচ্ছে ঘোলাটে বার্। তাতে যেন ঘরে আরও চেপে বসেছে অন্ধকার। মহিলার চুল কালো। চোখও কালো। চোখের নিচে যে ব্যাগের মত ফুলে আছে, ওটাও কালো।

‘ট্রিয়াঙ্কা,’ বলল রামিরেজ। ‘ইনিই তোমার খদ্দের।’

রানার দিকে চেয়ে ক্লান্ত হাসল মহিলা। খসখসে স্বরে বলল, ‘আপনাকে দেখে খুব খুশি হলাম।’

মন খারাপ হলেও হাসি-হাসি চেহারা করল রানা। ‘আর তোমার সঙ্গিনী?’

‘ও আমার মত এতটা দক্ষ নয়। তবে একই সঙ্গে কাজ করবে।’

‘নাম কী ওর?’

‘নেলি,’ বড় করে শ্বাস ফেলে বলল ট্রিয়াঙ্কা।

‘ট্রিয়াঙ্কা, তোমাকে কিন্তু খুব পেশাদার হতে হবে,’ বলল রানা। ‘আমি চাই না আমার পয়সা পানিতে যাক।’

‘ট্রিয়াঙ্কা আর নেলিকে নিলে কাউকে ঠকতে হয় না,’ নাক ফুলিয়ে বলল পতিতা। ‘আমরা সেরা। খুবই পেশাদার।’

‘আমি কিন্তু কাঁচা কাউকে চাই না,’ বলল রানা। ‘আগেই বলছি, তোমরা একই সঙ্গে কাজ না করলে পরে কিন্তু বিপদে পড়বে। এক পয়সাও দেব না।’

‘আমরা অনেক দিন ধরেই একসঙ্গে কাজ করছি,’ হাত তুলে আশ্বস্ত করতে চাইল ট্রিয়াঙ্কা। ‘আমাদেরকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করবেন না। টাকা আমরা সবসময় ভাগ করে নিই।’

‘কত চাও তোমরা?’

‘একেকজন মাত্র ষাট হাজার পেসেতাস।’

‘অনেক বেশি চাইছ! আমি জানব কী করে যে ঠকে যাচ্ছি কি না?’

‘দেখুন, এই এলাকার যে-কাউকে জিজ্ঞেস করুন। সত্যি কথাই বলবে তারা।’

‘সেনোর কাকে জিজ্ঞেস করবেন, ট্রিয়াঙ্কা?’ হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রামিরেজ। ‘সত্যিই কি এমন কেউ আছে, যার কাছ থেকে জেনে নেয়া যাবে?’

‘নিশ্চয় আছে!’ জোর দিয়ে বলল ট্রিয়াঙ্কা, ‘যেমন মারবেলার সেই ফ্রেঞ্চ। বহু বছর ধরে একটা বাড়িতে ভাড়া নিয়ে ওখানে বাস করছেন তিনি।’

‘আমি নিজে ব্রিটিশ নাগরিক,’ বলল রানা, ‘কখনও কোন ফ্রেঞ্চকে বিশ্বাস করি না!’

ক্লান্ত হাসল ট্রিয়াঙ্কা। ‘তো শুনুন, আপনার মত আমিও কোন ফ্রেঞ্চকে বিশ্বাস করি না!’

‘তা-ই?’ কাঁধ ঝাঁকাল রানা।

কী যেন মনে পড়তেই এবার বলল ট্রিয়াঙ্কা, ‘এক মিনিট! গতকাল তো একজনের সঙ্গে শুয়েছি নেলি আর আমি। সে সত্যিকারের এক পিশাচ! চাইলে তার কাছ থেকে জেনে নিতে পারবেন! আমাদেরকে সবদিক দিয়েই ব্যবহার করেছে।’

‘নাম কি লোকটার?’ আগ্রহ দেখাল রানা।

ওর কথায় কুঁচকে গেল ট্রিয়াঙ্কার ভুরু। ‘তা জানি না। ‘নিজের নাম বলেনি সে। আপনার মতই শ্যামলা রঙের লোক। দেখে মনে হয়েছিল ইতালিয়ান হবে। ভাল করে স্প্যানিশ বলতে পারে না।’

রামিরেজের দিকে তাকাল রানা।

জবাবে চট্‌ করে ওকে চোখ টিপল সে।

‘লোকটা থাকে কোথায়?’ জানতে চাইল রানা।

‘আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল টরেমোলিনোসেরই এক ভিলায়।’

প্যান্টের পেছনের পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে ষাট হাজার পেসেতাস নিল রানা। ‘তার ঠিকানা জানালে কাজ না করেই পাবে এই ষাট হাজার পেসেতাস।’

টাকা দেখে বিস্ফারিত হয়েছে মহিলার চোখ। রানা দেখল দরদর করে ঘামছে ট্রিয়াঙ্কা। লালায় ভিজে গেছে নিচের ঠোঁট। লোভ আর সতর্কতার দুই দড়িতে পা রেখে কী করবে ভাবছে মহিলা। বুঝে গেছে, রানা অস্বাভাবিক যৌনক্রিয়া করতে তাকে ভাড়া করছে না। ওদিকে টাকা হাতে পাওয়া খুব জরুরি।

পেসেতাস নেয়ার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল ট্রিয়াঙ্কা।

‘আগে লোকটার ঠিকানা দাও,’ বলল রানা।

‘ঠিকানা জানি না। তবে আপনাকে চিনিয়ে দেব বাড়িটা।’

হাত পিছিয়ে নিয়ে তিরিশ হাজার পেসেতাস আলাদা করল রানা। অর্ধেক টাকা রাখল মানিব্যাগে। বাকি টাকা ধরিয়ে দিল ট্রিয়াঙ্কার হাতে। ‘এখন অর্ধেক। রাকিটা বাড়ি চেনার পর।’

বিচলিত চোখে ওকে দেখল রামিরেজ। ‘সেনোর, ইয়ে… অন্য সেনোরার কী হবে? মানে… আপনার স্ত্রী?’

‘রামিরেজ, আধঘণ্টার ভেতরে ওকে হোটেলে পৌঁছে দেবেন আপনি,’ বলল রানা। ‘আমি কাজ শেষে পরে ফিরব।’ ভাবছে, কেউ থাকলে রামিরেজ ও মারিয়ার পিছু নিয়ে হোটেলে যাবে সে। এ-সুযোগে নিজের কাজ সেরে নিতে পারবে ও।

ট্রিয়াঙ্কা উঠে দাঁড়াতেই তার বাহু ধরে নাইট ক্লাবের পেছন দরজা দিয়ে রাস্তায় বেরোল রানা। ক্লাবের সামনে উজ্জ্বল সব বাতির আলো থাকলেও পেছনদিকে ঘুটঘুটে আঁধার।

‘আপনি একটু অপেক্ষা করুন, বলল ট্রিয়াঙ্কা। আবার পেছনের দরজা দিয়ে নাইট ক্লাবে ঢুকে পড়ল সে। মিনিট পাঁচেক পর আবার বেরিয়ে এল। প্রায় একই সময়ে নাইট ক্লাবের পাশের রাস্তায় এসে থামল এক ট্যাক্সি-ক্যাব। রানাকে ওটা দেখাল মহিলা।

একে একে ক্যাবের পেছনের সিটে উঠল রানা ও ট্রিয়াঙ্কা। মহিলার সস্তা মেকআপ, মেয়েলি ঘাম ও পুরনো না ধোয়া পোশাকের গন্ধে একটু সরে বসল রানা।

ক্যাবের ড্রাইভারকে এগিয়ে যেতে বলল পতিতা। মাথার ক্যাপ পেছনের দিকে ঠেলে রওনা হয়ে গেল ড্রাইভার। সরু সব রাস্তা দিয়ে চলেছে শহরের পেছনে টিলার দিকে। পেরিয়ে গেল টরেমোলিনোসের বাণিজ্য এলাকা। সামনে পড়ল আবাসিক শহরতলী।

মিনিট দশেক পর সামনে ঝুঁকে ড্রাইভারের কাঁধে চাপড় দিল ট্রিয়াঙ্কা। ‘থামো! আমরা পৌঁছে গেছি!’

ব্রেক কষে রাস্তার ধারে ট্যাক্সি রাখল ড্রাইভার।

ডানদিকের ভিলার দিকে আঙুল তাক করল ট্রিয়াঙ্কা।

‘ওই বাড়ি?’ বলল রানা। ‘ওখানে একা থাকে লোকটা?’

মাথা দোলাল ট্রিয়াঙ্কা। ‘হ্যাঁ, একাই থাকে ওখানে।’

তার হাতে বাকি তিরিশ হাজার পেসেতাস ধরিয়ে দিল রানা। ট্যাক্সি-ক্যাব থেকে নেমে মিটিয়ে দিল ড্রাইভারের টাকা। বাড়তি টাকাও দিয়েছে, যাতে ট্রিয়াঙ্কাকে নাইট ক্লাবের সামনে নামিয়ে দেয় সে।

এক মিনিটের ভেতরে ফিরতি পথে অদৃশ্য হলো ট্যাক্সি- ক্যাব। শোল্ডার হোলস্টার থেকে ওয়ালথার নিয়ে একবার চেক করে নিল রানা।

ট্রিয়াঙ্কা যে ভিলার কথা বলেছে, ওটা ছোট এক চৌকো বাড়ি। চারপাশে জংলা গাছে ভরা বাগান। সামনের দিকে চওড়া গেট। ওপরে লোহার হুড়কো। নিঃশব্দে ওটা সরিয়ে গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকল রানা।

ঘুটঘুটে আঁধারে ডুবে আছে বাড়িটা।

জংলা বাগানের মাঝ দিয়ে ভিলার একপাশে চলে এল রানা। বুঝে গেল, হয় বাড়ির বাসিন্দা কোথাও গেছে, নয় তো ঘুমিয়ে আছে সে।

পর পর দুটো জানালা দিয়ে উঁকি দিল রানা।

একটা কিচেন, অন্যটা ডাইনিংরুম।

তৃতীয় জানালা রানাকে জানিয়ে দিল, এ-ঘর বেডরুম। খাটে ঘুমিয়ে আছে কেউ।

ওকে কেউ দেখছে কি না সেটা বুঝতে একবার চারপাশে দেখে নিল রানা। একদম থমথম করছে রাত। আবার কিচেনের জানালার কাছে ফিরল রানা। কোন আওয়াজ না করেই খুলে নিল সরু জানালা। পাল্লায় ছিটকিনি দেয়া নেই বলে অবাক হয়েছে। জানালা টপকে সাবধানে নেমে এল কিচেনের টাইল করা মেঝেতে। ওয়ালথার হাতে করিডরে এসে নিঃশব্দে চলল বেডরুমের দিকে। ভাবছে, আজ সত্যিই ভাগ্যদেবী ওর প্রতি খুব প্ৰসন্ন।

ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে বেডরুমের দরজা। কোন আওয়াজ না করেই ঘরে ঢুকল রানা। দরজার পাশেই বৈদ্যুতিক বাতির সুইচ। খাটের দিকে ওয়ালথার তাক করে ঝট্ করে বাতি জ্বালল রানা। খুনি হয়তো হাতের কাছে রেখেছে তার পিস্তল।

‘খবরদার! একদম নড়বে না!’ ধমকে উঠল রানা। কিন্তু খাটে কোনধরনের নড়াচড়া নেই। উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যাচ্ছে বেডরুম। আর তখনই প্রথমবারের মত রানা বুঝতে পারল, মস্তবড় ভুল করে বসেছে ও!

খাটে যে শুয়ে ছিল, সে এখন আর ওখানে নেই!

বালিশ ও কোল-বালিশ সাজিয়ে তার ওপরে কম্বল রেখে সরে গেছে লোকটা!

চট্‌ করে বোঝার উপায় নেই যে ওখানে ঘুমাচ্ছে না কেউ।

চরম অস্বস্তি নিয়ে বাতির সুইচ অফ করতে চাইল রানা। আর তখনই শুনল পেছনে মৃদু আওয়াজ।

ওয়ালথার হাতে ঝড়ের বেগে ঘুরতে চাইল রানা। কিন্তু একই সময়ে বাতাস কেটে সাঁই করে মাথার ওপরে নেমে এল ভারী লোহার পাইপ। হঠাৎ দপ করে নিভে গেল ওর চোখের সব আলো।

সকল অধ্যায়

নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন

লগইন