কাজী আনোয়ার হোসেন
পরদিন সকালে হোটেলের ডাইনিংরুমে ব্রেকফাস্টের পালা শেষ করে এনেছে রানা, এমন সময় ঘরে ঢুকে ওর সামনে এসে থামল মারিয়া। একটু আগে স্নান করেছে বলে তরতাজা দেখাচ্ছে ওকে। মুখে মৃদু হাসি।
‘গুড মর্নিং, মিসেস কিং,’ মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে নকল বাউ দিল রানা।
‘গুড মর্নিং, মিস্টার কিং,’ একটু আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল মারিয়া। চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়ল রানার পাশে।
‘তোমাকে খুব ফ্রেশ লাগছে,’ বিস্কিটে কামড় দিল রানা।
কেউ ওদেরকে দেখছে কি না, তা একবার এদিক-ওদিক চেয়ে দেখে নিল মারিয়া। আপাতত ডাইনিংরুমে আছে মাত্র পাঁচজন অতিথি।
‘তোমার কথা মত কার্সনকে সারারাত আমার ঘরে রেখেছি,’ কড়া চোখে রানাকে দেখল মারিয়া।
‘সেজন্যে অসংখ্য ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘সময়টা নিশ্চয়ই খুব খারাপ কাটেনি?’
লালচে হলো মারিয়ার দুই সাদা গাল। নিচু গলায় বলল, ‘আসলে এসব কী ঘটছে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না!’
‘আমি তো তোমাকে আগেই বলেছি, জনি বোধহয় ছদ্ম- পরিচয়ে আমাদের সঙ্গে ভিড়ে গেছে।’
আরেকবার চারদিকে তাকাল মারিয়া
রানার ব্রেকফাস্ট করা শেষ।
এখনও অর্ডার দেয়নি মারিয়া, তাই ওদের কাছে এসে থামল এক ওয়েটার। তাকে দুটো পোচ ডিম, পুরু মাখন দেয়া পাউরুটির চারটে স্লাইস, কমলার জুস আর এক মগ কফি আনতে বলল মারিয়া। লোকটা চলে যেতেই রানার দিকে তাকাল। ‘আমি এখনও জানি না কার্সন আসলে কে।’
‘তা-ই?’ হতাশ হলো রানা।
‘বলেছিলে মোরেলির ডাবলকে হয়তো খুন করেছে।’
‘ভুল ভেবেছি,’ বলল রানা। ‘ওর খুন করার উপায় ছিল না। জোরাল অ্যালিবাই আছে।’
‘মাফিয়া সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে সে।’
কাঁধ ঝাঁকাল রানা। ‘নিজেকে বলছে এমআই-ফাইভের এজেন্ট। মাফিয়াদের ড্রাগসের চেইন ভাঙতে কাজ করছে।’
সেটা আমিও জানি। কিন্ত ওর কথা সত্যি বলে মনে হয়নি আমার।’
এই একই কথা ভেবেছে রানা। বলল, ‘ইন্টারেস্টিং!’
‘সারারাত কোথায় ছিলে?’ হঠাৎ জানতে চাইল মারিয়া।
ব্রেকফাস্ট, কমলার জুস আর ধোঁয়া ওঠা কফির মগ দিয়ে গেল ওয়েটার। সে বিদায় নিতেই বলল রানা, ‘এক বন্ধুর ওখানে।’
কাঁটাচামচ দিয়ে ডিম পোচের অংশ কেটে ডান ভুরু উঁচু করে ওকে দেখল মারিয়া। ‘তাই নাকি?’
‘আমার সেই বান্ধবী আসলে মিসেস কার্সন।’
‘ও?’ বিড়বিড় করল মারিয়া। ‘আমার অবশ্য মনে হয়েছিল নাইট ক্লাবে গেলে ওর সঙ্গে তোমার দেখা হবে।’
‘তা-ই হয়েছে।’
‘মোরেলির সেই ছেলেটার ব্যাপারে কিছু জানলে?’
ঘাড় ফিরিয়ে চারপাশ দেখে নিয়ে বলল রানা, ‘ইঞ্জিন- রুমে আমার আগেই পৌঁছে গিয়েছিল কিউলেক্স। ছেলেটাকে গুলি করে পালিয়ে গেছে। মারা যাওয়ার আগে বেচারা বলে গেছে কোথায় দেখা করবে মোরেলি।’
‘আমাকে সেটা বলেছ। আজ মাঝরাতে। আমিও কি যাব?’
‘প্রয়োজন নেই। আমাকে একা যেতে বলেছে।’
‘আমাদের বোধহয় এখানে বসে এসব আলাপ করা উচিত হচ্ছে না,’ নিচু কণ্ঠে বলল মারিয়া।
‘বললে অসুবিধে কী?’ হাসল রানা। ‘তোমার কফির মগে ইলেকট্রনিক গুবরে পোকা রেখেছে কেউ? অবশ্য তোমার ঘরে এখন থেকে গোপন কোন কথা আর বলা যাবে না। আমার ধারণা: ওখানে গুবরে পোকা রেখে গেছে কার্সন অথবা কিউলেক্স। নইলে খুনির জানার কথা না ইঞ্জিন-রুমে মোরেলির কন্ট্যাক্টের সঙ্গে দেখা করতে যাব। ভাল কথা, মোরেলি সম্বন্ধে কিছু বলেছে কার্সন?’
‘মোরেলি?’ মাথা নাড়ল মারিয়া। ‘না, হঠাৎ এ-কথা তুললে যে?
‘আমার ধারণা: জনি কার্সন চেনে এলিনা পার্কারসনকে।’
ওর কথা শুনে চমকে গেছে মারিয়া। ‘তুমি শিয়োর?’
‘পুরো শিয়োর নই,’ বলল রানা।
‘ইতালিয়ান ভাষায় কার্সন খুব দক্ষ। চরম এক পর্যায়ে হঠাৎ করে এক ইতালিয়ান মনীষীর উদ্ধৃতি দিয়েছিল।’
‘তা-ই? তো তার সঙ্গে এলিনার কী ধরনের সম্পর্ক আছে বলে তুমি ভাবছ?’
‘হয়তো কিছুই না। তবে মনে হলো, জনি কার্সন হয়তো আসলে আমাদের সেই রোমিয়ো মোরেলি।’
চুপ করে থাকল রানা।
কাঁধ ঝাঁকাল মারিয়া। ‘তা যদি না-ও হয়, কার্সন বোধহয় • জাতে ইতালিয়ান। খুব ভাল করেই চেনে মোরেলিকে।’
‘কার্সন কি স্কি করে?’ জানতে চাইল রানা।
‘তা জানি না। আমার কি জানার কথা, বলো?’
‘আজ আমরা স্কি করব,’ বলল রানা। ‘আমার কাভারের জন্যে ওটা খুব জরুরি। বেশকিছু ছবিও তুলব।’
‘গুড। বিরক্তিকর কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছি।’
‘আমার তো ধারণা ফূর্তিতেই আছ,’ বলল রানা।
চোখে আগুন নিয়ে ওকে দেখল মারিয়া। ‘বাজে কথা একদম বলবে না। এটা কোন লাইফ হলো?
‘তা হলে কোন্ ধরনের জীবন তুমি চাও?’
‘যেখানে কোন বিপদ হবে না। নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দেব জীবন।’ দূর দেয়ালে তাকাল মারিয়া। ‘আমার বোধহয় উচিত হয়নি এ-ধরনের চাকরি নেয়া।’ রানাকে দেখল মেয়েটা। ‘আমরা কখন স্কি করতে যাব?’
‘আগে শাওয়ার নেব। তারপর রওনা হব।’
‘সাড়ে নয়টায় তোমার জন্যে লবিতে অপেক্ষা করব,’ বলল মারিয়া।
‘বেশ। প্রথমে আমরা যাব ভেলেটায়। ওপরদিক থেকে শুরু করতে কোন আপত্তি নেই তো তোমার?’
‘না, নেই। গর্বের সঙ্গে থুতনি উঁচু করল মারিয়া। ‘আমি অনেকের চেয়ে অনেক ভাল স্কি করি!’
চেয়ার ছাড়ল রানা। সিঁড়ি বেয়ে উঠে চলে এল ওদের সুইটে। মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছে পরের কাজ।
.
সোনালি রোদে ভরা চমৎকার দিন। সকাল সাড়ে নয়টায় হোটেল ত্যাগ করে ইকুইপমেন্ট বয়ে প্রাডো লানোতে এল রানা ও মারিয়া। ওরা স্থির করেছে, স্কি করবে বোরেগুইলাস পর্যন্ত। স্টেশনে কেবল-কার-এ চাপল ওরা। ঝাঁকি খেতে খেতে দুলতে দুলতে উঠতে লাগল কেবল-কার। চলেছে সিয়েরা নেভাডার দিকে। এত ওপর থেকে দেখা যাচ্ছে মাইলের পর মাইল এলাকা। পরিবেশ বরফের মত কনকনে। আবারও চারপাশে তাকাল রানা। ওর মনে হলো দুনিয়া ছেড়ে চলে এসেছে মহাশূন্যে। বহু দূরে নিচে বিছিয়ে আছে গ্রানাডা। জায়গাটা ঘিরে ভাসছে ঘোলাটে মেঘের ভেলা। দৃশ্যটা এতই সুন্দর যে, শ্বাস নিতে ভুলে যাবে যে-কেউ 1
আবারও জানালা দিয়ে চারপাশে তাকাল রানা। বাতাসে আর্দ্রতা টের পেয়ে বুঝে গেল, আজ রাতে আবারও তুষারপাত হবে। বরফে ভরা পাহাড়ের চূড়ায় কেবল-কার পৌঁছে যেতেই দু’দিক থেকে ওটাকে শক্ত হাতে ধরল দু’জন অ্যাটেন্ড্যান্ট। কার থেকে নেমে পড়ল রানা ও মারিয়া। তুষারে ভরা সমতল জমি পার করে পৌঁছে গেল স্কি রানের সামনে। এত ওপরে বাতাস খুব হালকা। হিমশীতে ওদের মনে হলো কোটি কোটি সুঁই বিধছে দেহে। বহু নিচে বিশাল বিরান শুভ্র অঞ্চল। তারই বুকে অভ্র ও স্ফটিক মিশ্রিত স্লেট পাথরের স্তূপ, কালো গিরিখাদ, শুভ্র তুষার ও অসীম নীল আকাশের রাজত্ব। কোথাও নেই সবুজের কোন চিহ্ন।
নীরবে অস্ট্রিয়ান স্কির বাকল আটকে নিল রানা। দেখতে পেল কানাডিয়ান স্কি পরতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে মারিয়া। মেয়েটার কাজ শেষ হলে ক্যাপের ওপর থেকে সানগ্লাস নিয়ে চোখে পরে নিচে তাকাল রানা। কানের ওপরে চাপিয়ে নিল ক্যাপ। মারিয়ার উদ্দেশে বলল, ‘তুমি আগে রওনা হও!’
মাথা দোলাল মারিয়া। সামান্য ভাঁজ করল দু’হাঁটু, তারপর তুষারে ভরা খাড়া ঢালু জমিতে নিচের দিকে রওনা হয়ে গেল। ওর পিছু নিল রানা। অবলীলায় নেমে চলেছে সাঁই-সাঁই করে। তুষারের নরম বুকে চেপে বসেছে স্কির নিচের দু’দিকের অংশ। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে রানা বুঝে গেল, স্কি করার জন্যে আজকের দিনটা সত্যিই ভাল।
নেমে যাওয়ার মাঝপথে একবার থামল ওরা। পকেট থেকে দুটো স্যাণ্ডউইচ বের করে রানাকে অবাক করল মারিয়া। চারপাশের, থমথমে নীরবতার ভেতরে চুপচাপ হালকা নাস্তা সেরে নিল ওরা। দু’চোখ ভরে দেখে নিল বরফে ছাওয়া নির্জন পর্বতের অদ্ভুত নীরব রূপ।
আবারও রওনা হলো ওরা। ওপর থেকে নেমে পৌঁছে গেল বোরেগুইলাসে। ওখান থেকে স্কি করে নামল আরও নিচে।
এরপর দেরি না করে ফিরে গেল হোটেলে। বিকেলে লাউঞ্জে ফায়ারপ্লেসের কমলা আগুনের ধারে বসে শুনল জনি কার্সন ও ক্যাথি মোনালিসার প্রেম-কাহিনী। সেটা শোনার ফাঁকে লবির দরজার ওপরে চোখ রাখল রানা। হোটেলের অতিথিদের অনেকে এল আবার বিদায় নিল। ওরা যেখানে বসে আছে, সেখান থেকে দেখা যাচ্ছে বোরেগুইলাস আর প্রাডো লানোর লোয়ার রান। স্কিয়ারদের ছোটার ভেতরে কী ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা নিয়ে বিশদ আলাপ করল কার্সন ও মারিয়া।
বিকেল পেরিয়ে গেলে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুইটে ফিরল রানা। আবারও শাওয়ার সেরে ইজিচেয়ারে বসে বিশ্রাম নিল। রাত নয়টার দিকে আবার নেমে এল লাউঞ্জে।
আজ ডিনারে রেস্টুরেন্টের কিচেন থেকে লোভনীয় যেসব খাবার দেয়া হলো, নীরবে খেল সবাই। এরপর রাত সাড়ে এগারোটায় সতর্ক হয়ে উঠল রানা। এখনও লাউঞ্জে রয়ে, গেছে বেশিরভাগ অতিথি। ড্রিঙ্কের ফাঁকে চলছে নানান গল্প।
পরিচিতদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুইটে ফিরল রানা। চেক করে নিল ওয়ালথার ও স্টিলেটো। সকালে ওপরের স্কি রান থেকে কিনেছে এই এলাকার ম্যাপ। ওটা খুলে দেখল কোন্ পথে যেতে হবে ভেলেটায়। গ্রানাডা থেকে সরকারি পিচঢালা রাস্তা গেছে কোস্তা দেল সোল-এর মতরিলে। তিন মাইল দূরে প্রাডো লানোর হাইওয়ে মিশেছে গিয়ে সেই রাস্তায়। এরপর উত্তরদিকে দু’ভাগ হয়েছে হাইওয়ে। ওখানে পৌঁছে দক্ষিণের পথ ধরে যেতে হবে, ভেলেটায়। পকেটে ম্যাপ রেখে বেডের পাশের টেবিল থেকে ভাড়া করা রেঁনো গাড়ির চাবি নিয়ে লবিতে নেমে এল রানা।
ডাইনিংরুমে দেখতে পেল বসে বসে গল্প করছে মারিয়া ও ক্যাথি। কার্সন আবার কোথায় গেল কে জানে, আনমনে ভাবল রানা। জানালা দিয়ে তাকাল হোটেলের পার্কিংলটের দিকে। বার এস্কুই থেকে বেরিয়ে প্রাডোর দিকে চলেছে ক’জন ট্যুরিস্ট। তাদের ভেতরে আছে হের আর্নেস্ট মুলার।
লবির দরজা খুলে বাইরের অন্ধকারে পা রাখল রানা। ওকে খেয়াল করেছে হের মুলার। ওর দিকে হাত দোলাল সে। ‘ভুলে যাবেন না যে একসঙ্গে স্কি করব আমরা!’
‘আমি দিনের আলোয় স্কি করতে পছন্দ করি,’ জার্মান ভাষায় বলল রানা।
হাসল হের মুলার। রানাকে পাশ কাটিয়ে ঢুকে পড়ল হোটেলের লবিতে।
পার্কিংলটে এসে রেঁনোর ড্রাইভিং সিটে উঠল রানা। মন খারাপ হয়ে আছে। ম্যালাগায় ট্যুরিস্টদের ভিড় ছিল। রেন্টাল কোম্পানি থেকে ভাল সব গাড়ি আগেই সংগ্রহ করে নিয়েছে তারা। রানার কপালে জুটেছে উনিশ শ’ ছিয়াত্তর সালের এই ঝরঝরে গাড়ি। তিনবার ইঞ্জিন স্টার্ট করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো ও। চতুর্থবারে চালু হলো ইঞ্জিন। জানালা সামান্য নিচু করে নিল রানা। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এসে হু-হু করে বইছে শীতের হাওয়া। পুরনো গাড়িটা হয়ে গেছে হিমঠাণ্ডা কফিনের মত। অবশ্য কিছুক্ষণ চললে ইঞ্জিনের তাপে গরম হয়ে উঠবে ভেতরের পরিবেশ।
আকাশ থেকে ঝরছে শুভ্র তুষার। রাস্তায় কোথাও কোথাও জমে গেছে বরফ। আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে জায়গাগুলো। পাকা পার্কিংলটে ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে তুষারের স্তূপ।
কর্কশ আওয়াজ করছে রেঁনোর ইঞ্জিন। সাবধানে পার্কিংলট থেকে বেরিয়ে রাস্তা ধরে এগোল রানা। চেষ্টা করছে পথের মাঝ দিয়ে এগোতে। বরফ জমে সরু হয়ে গেছে রাস্তা। বড়জোর পরস্পরকে পেরোতে পারবে সাধারণ দুটো গাড়ি। সামনে গ্রানাডার দিকে যাওয়া এক বাসকে পাশ কাটাতে গিয়ে আরেকটু হলে দুর্ঘটনার শিকার হতো একটা গাড়ি। বাসটাকে হাতি আর ছোট গাড়িটাকে পিঁপড়ে বলে মনে হলো রানার
প্রাডো লানোর দিক থেকে এসে হাইওয়েতে উঠল দুটো গাড়ি। ওগুলোকে অনুসরণ করে এগোল রানা। তারপর বাঁক নিয়ে চলল ভেলেটার দিকে। ক্রমে বাড়ছে তুষারপাতের ধারা। হেডলাইটের সামনে যেন ঝরছে পেঁজা তুলো। তৈরি করেছে সাদা এক পর্দা। বেশি দূর দেখতে পাচ্ছে না রানা।
এঁকেবেঁকে ওপরে গেছে রাস্তা। একটু পর কঠিন হয়ে গেল সামনের হাইওয়ে দেখা। তার ওপরে জায়গায় জায়গায় জমে গেছে বরফ। মাঝে মাঝে পিছলে যেতে চাইছে গাড়ির চাকা। একবার রাস্তা থেকে হড়কে গেলে শত শত ফুট নিচে পাথুরে জমিতে আছড়ে পড়বে গাড়ি। খাড়া পথে অতিরিক্ত খাটতে গিয়ে গুঙিয়ে উঠছে রেঁনোর পুরনো ইঞ্জিন।
গতি মন্থর করে পিচ্ছিল বরফের ওপর দিয়ে এগিয়ে চলল রানা। তারপর সামনে সাইনবোর্ডে দেখতে পেল: ভেলেটা।
সাইনবোর্ড পেরোলেই পাকা সরু এক রাস্তা উঠেছে পাথুরে টিলায়। ওখানে আছে কংক্রিটের তৈরি বহু বছরের পুরনো মনুমেন্ট। রেঁনোতে চেপে উঠে এসে কংক্রিটের চত্বরে থামল রানা। ঝিরঝির করে ঝরছে তুষার। অন্য কোন গাড়ি নেই পার্কিংলটে। একবার হাতঘড়ি দেখল রানা। এখন বাজে বারোটা পাঁচ। আনমনে ভাবল ও, এখন কোথায় আছে রোমিয়ো মোরেলি? আরেকটা কথা মনে এল ওর: ট্রাট্টু খুন হয়ে গেছে সেটা জানার পরেও কি এখানে দেখা করবে লোকটা?
হয়তো এসেছে সে। লুকিয়ে আছে মনুমেন্টের কাছে।
ইগনিশনের চাবি মুচড়ে ইঞ্জিন বন্ধ করল রানা। পাকা চত্বরে নানান গাড়ির চাকার পুরনো সব চিহ্ন। একবার শিউরে উঠল রানা। নির্জন এ-পাহাড়ে নিজেকে বড় একা লাগল ওর। হয়তো কাছেই কোথাও আছে মোরেলি। বাস্তিলো দে ভ্যানারি আর ট্রাটুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে ওকে গুলি করে।
চট্ করে গাড়ির হেডলাইট নিভিয়ে দিল রানা। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল ড্রাইভিং সিটে। এবার কী করবে সেটা সিদ্ধান্ত নেয়ার চেষ্টা করল। কয়েক সেকেণ্ড পর উইণ্ডচিটারের পকেট থেকে নিল ওয়ালথার। ড্যাশবোর্ডের ড্রয়ার খুলে সংগ্রহ করল ফ্ল্যাশলাইট। নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে এদিকে-ওদিকে আলো ফেলে দেখল, আশপাশে কেউ নেই। গাড়ি থেকে নেমে ভীষণ শীতে গায়ে কাঁপ ধরে গেছে ওর। উইণ্ডচিটারের চেইন টেনে নিল গলা পর্যন্ত। ঠাস্ শব্দে বন্ধ করল রেঁনোর পুরনো ড্রাইভিং দরজা। একবার মুখ তুলে আকাশে তাকাল রানা। পাহাড়ি হাওয়ায় ভর করে ঝরঝর করে ঝরে চলেছে শুভ্র তুষার। ক্রমে বাড়ছে শীতের প্রকোপ।
ওপর থেকে ঝুঁকে আছে বিশাল মনুমেন্ট। ওটার পেছনে এসে লাল এক সিমকা গাড়ি দেখতে পেল রানা। বরফ ও তুষারের স্তূপ এড়িয়ে গাড়িটা কীভাবে নিয়ে এল ড্রাইভার, সেটা ভেবে পেল না ও। সিমকার বনেটে হাত রেখে দেখল, এখনও গরম হয়ে আছে ইঞ্জিন।
মনুমেন্ট মেরামতের জন্যে পেছনদিকে এনে রাখা হয়েছে সিমেন্টের অনেকগুলো বস্তা, শতখানেক রড ও প্রচুর বালি। সিমকার পাশে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল রানা। হু-হু করে বয়ে চলা হিমঠাণ্ডা হাওয়ায় কাঁপ ধরছে ওর শরীরে। আরও কয়েক সেকেণ্ড পর পদশব্দ শুনে ওদিকে ওয়ালথার তাক করল রানা।
বালি-স্তূপের পাশে থেমে বলল কেউ, ‘যাক, পৌঁছে গেছ!’
হাওয়ার শোঁ-শোঁ শব্দে কণ্ঠস্বরটা চিনতে পারল না রানা।
ওর দিকে এগোল লোকটা।
ফ্ল্যাশলাইটের আলোয় এবার তাকে চিনে গেল রানা।
জন কার্সন!
অবশ্য এখন হারিয়ে গেছে তার ব্রিটিশ উচ্চারণ।
লোকটা আসলে কে বা কোন্ দেশের? -ভাবল রানা।
সামনে বেড়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল কার্সন।
হ্যাণ্ডশেক না করে তার দিকে চেয়ে রইল রানা।
‘ভয় নেই,’ ইতালিয়ান সুরে বলল কার্সন। ‘তোমার কোন ক্ষতি করব না। আমিই মোরেলি। রোমিয়ো মোরেলি।’
নোট নিতে এবং টেক্সট হাইলাইট করতে লগইন করুন
লগইন